পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী পাহাড়িদের অস্তিত্ব সংরক্ষণের উপাখ্যান

Jumjournal
Last updated Oct 7th, 2020

868

featured image

ভূমিকা:

পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসী বিভিন্ন ভাষাভাষি সংখ্যালঘু পাহাড়ি জনজাতিকে আমাদের দেশে প্রচলিত তদানীন্তন ঔপনিবেশিকদের দৃষ্টিভঙ্গিতে কখনো Tribal কখনও বা Aboriginal বর্তমানে আধুনিক সভ্যসমাজের প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনায় প্রভাবিত হয়ে Minor ethnic-community অর্থাৎ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বিভিন্ন রকমারী Primitive সমাজের আদিম ভাবধারায় জীবনযাপন জীবিকা-নিৰ্বাহকারী জনগণ হিসাবে আখ্যায়িত।

অথচ এসব Indigenous People পাহাড়ি জনজাতি সমূহের সংস্কৃতি চিন্তা-চেতনা ভাবধারা সভ্যজগৎ থেকে যে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে নেই তা একবারও আমরা অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে পুঙ্খানু-পুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করে দেখি।

এ দুর্গম পাহাড়-পর্বতে বিপদসংকুল অরণ্য পরিবেশ জনবসতির উপযোগী, বিচিত্র জীবন-যাপনের সংস্কৃতি, প্রচলিত আচরণ ধ্যান-ধারণায় সভ্যতার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অবকাঠামো এরাই গড়ে তুলেছিল।

আদিবাসী ঐতিহ্যের স্বরূপ:

বস্তুত এই পার্বত্য এলাকার অধিকাংশ আদিবাসী ভিন্ন ভাষাভাষি মানবজাতি Prehistoric অর্থাৎ প্রাগৈতিহাসিক যুগের আদিম ভাবধারায় প্রভাবিত প্রকৃতিপূজারী সনাতন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও এদের পরিবারিক গঠন পদ্ধতি ও সামাজিকতা এমনকি সম্পত্তি ভোগদখলের উত্তরাধিকার রীতিনীতি (Inheritance law) কিছুটা হিন্দুদের মতো।

এতেই প্রমাণিত যে- এরা দীর্ঘদিন হতে অত্র অঞ্চলের আর্যজাতিভূক্ত হিন্দু সমাজের সংস্পর্শে রয়েছে।

তাইতো তাদের কথিত ভাষার লোকগীতি-নাটক-পৌরাণিক কাহিনীতে রাম-লক্ষ্মণ-সীতার উপস্থিতিও পরিলক্ষিত হয়।

যদিওবা এসব পার্বত্যবাসীদের অনেকের নিজস্ব কোন লিপি নেই (Alphabet) মুদ্রণ যন্ত্রতো দূরের কথা-অক্ষরজ্ঞান সম্পর্কে তাদের ধারণা এসেছে বড্ড দেরিতে।

তবুও সীমিত শব্দাবলী দিয়ে তাদের কথোপকথন, রূপকথা , সঙ্গীতমালা-পালাগান, প্রবাদ-প্রবচন, ধাঁধা এটাই তাদের কথা সাহিত্য যা বংশপরম্পরায় তাদের লোকের মুখে মুখে ক্রমবিকশিত হয়েছে।

কখনো একে অপরের মনের ভাবপ্রকাশের স্বাথে, কখনো জীবনযাপন কর্মপ্রবাহের চঞ্চলতার সুত্রে, কখনো বা সুখ-দু:খ বিরহ-ব্যথা বেদনা আনন্দের অনুভূতি উপলদ্ধিতে ব্যক্ত করার প্রচেষ্টা হিসাবে এসব সংস্কৃতির।

অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বাস্তবতার নিরিখে ও প্রকৃতিগত ধারাবাহিকতায় সৃষ্টি হয়েছে। সীমিত পরিসরে, ভিন্ন অবয়বে ও বৈচিত্র্য নিয়ে।

তাই বলে এটাকে তুচ্ছ, অবহেলা ও অবজ্ঞা করা অনুচিত, কেননা পৃথিবীর সকল দেশেই নানা জাতিতে নানা সমাজের নানা ভাষাভাষি জনগোষ্ঠীতে এসব কথাসাহিত্য লোক সংস্কৃতির মধ্যে মানবজাতি ক্রমবিকাশের ইতিহাস অন্তর্নিহিত।

যেগুলো নৃ-তত্ত্বের (Anthropology) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান সম্পদ। পার্বত্য চট্টগ্রামের এইসব আদিবাসীদের জীবনালেখ্যেও তাই ফুটে উঠেছে।

পৃথিবীর উপরিভাগ (stratosphere) ছাড়াও সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্র সম্পর্কে ধারণা তাদের বয়স্ক পরোহিতদের মধ্যে আজও বিদ্যমান।

এলাকার জলবায়ু, আবহাওয়া, খরা-বন্যা, রোগব্যাধি, মহামারি, জীবজন্তুর আক্রমণ, ফসলহানি ইত্যাদি সম্পর্কে পূর্বাভাস দানে বিজ্ঞব্যক্তির আজও কদাচিৎ দেখা সাক্ষাত মেলে।

Herb-shrub, গাছ-গাছড়া, গুল, ফলমূলের সমন্বয়ে ভেষজ ঔষধ প্রস্তুতকারী বৈদ্য (Herbalist) ভবিষ্যত জীবন সম্পর্কে বাণী প্রদানকারী জ্যোতিষী-গণকদের (Astrologer) সমারোহে সামাজিক কর্মকাণ্ড বিস্তৃত।

সংস্কৃতির স্থাপত্য শিল্প নক্সানন্দিত প্যাগোডা- স্মৃতিসৌধের স্তম্ভ ঐশ্বর্যের কীর্তি (Paleontological Architect) গুলো আজও কিছু কিছু জেগে আছে নিরব নিস্প্রভ হয়ে এই পার্বত্য জনপদে।

কালের বিবর্তনে কিংবা সময়ের নির্মম করাল গ্রাসে পার্বত্য সভ্যতার এই উজ্জ্বল নিদর্শন Arcanium-গুলো শত সহস্র মৌনসাক্ষী হয়ে পার্বত্যঞ্চলের আদিবাসী জনসমাজ ছাতাবিহীন বৃষ্টিতে ছায়াবিহীন প্রখর রোদে টিকে আছে স্বদেশে নিজভূমিতে পরবাসী সংখ্যালঘু ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী উপজাতি পরিচয়ে।

অমীমাংশিত ইস্যু-বাংলাদেশের আদিবাসী জনগণ বনাম ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী/উপজাতি:

ইদানিং প্রায় ফেসবুকে, পত্রপত্রিকায়, বেতার টিভি, প্রচার মাধ্যমে জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত আদিবাসী সংজ্ঞায়ন বিষয়ে বাংলাদেশের আদিবাসী জনগন বনাম ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী/উপজাতি দ্বি-রৈখিক বিতর্ক এক স্পর্শকাতর অমীমাংশিত ইস্যুতে পরিগণিত।

দেশের অনেক খ্যাতনামা শিক্ষক-গবেষক, সাহিত্যসেবী লেখকশ্রেণি এসব পাহাড়ি জাতিসত্তা ও সমতলভূমি জাতিসত্তাদের প্রতি বাংলাদেশের আদিবাসী হিসাবে স্বীকৃতির জনমত তুলে ধরেছেন এভাবে সারাবিশ্ব আজ এসব অবহেলিত নিপীড়িত মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা ভাবনা করছে।

আমাদের দেশেও এসব বিপন্ন আদিবাসী মানব সমাজের উপর গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। বৈরী মনোভাব নিয়ে বৈরিতার উপসম হবার নয়।

আদিবাসী মানব সমাজ, জনগষ্ঠী অথবা জাতিসত্তার পরিচিতি পাবার অধিকারী তারাই যাদের প্রাক-আগ্রাসান ও প্রাক-সাম্রাজ্যবাদী অধিকারের আগে থেকেই একটি ঐতিহাসিক ধারাবহিকতা আছে, যা তাঁরা নিজ বাসভূমি তৈরি করেছিলেন।

যারা তাঁদের বাসভূমিতে অথবা তার কিয়দংশে পাশাপাশি বসবাসকারী অন্যান্য মানবকুল থেকে নিজের একটি বিশেষত্বময় পৃথক সত্তার অধিকারী মনে করেন।

যারা আজ সমাজের প্রতিপত্তিশালী না হয়েও ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য তাঁদের নিজস্ব ভূখণ্ড, গোষ্ঠীসত্তা, সাংস্কৃতিক কাঠামো, সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ও বিধিব্যবস্থা রেখে যেতে চান, একটি বিশেষ মানবসমাজের ধারাবহিকতা অক্ষুন্ন রাখার জন্য।

বলা হয়ে থাকে ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী। বিজ্ঞানের বদৌলতে, সভ্যতার ক্রমবিকাশে এই ছোট হয়ে আসা।

আর এই ছোট হয়ে আসার মধ্য দিয়েই বিবর্তনপরিবর্তন হচ্ছে প্রতিনিয়ত এই পৃথিবীর।

সাথে সাথে এসব আদিবাসী মানুষের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া জ্ঞান ও ভাষা, আচারআচরণ ও অর্থনৈতিক জীবন ব্যবস্থাও এই ছোট হয়ে আসার চাপে ক্রমশ হারাতে বসেছে।

তাই দেশজ বুদ্ধিজীবী মহলের দৃষ্টি আজ এই সব বিপন্ন মানুষের দিকে।

বস্তুত আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যাদের আদিবাসী হিসাবে অভিহিত করা যায় তাদের আওতায় পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী সংখ্যালঘু উপজাতি এই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসমূহকেও বাদ দেয়া যায় না।

কারণ এসব জনগোষ্ঠী তাদের পূর্বপুরুষ প্রাগৈতিহাসিক সময় কাল থেকে যে বনাঞ্চলে বসবাস করতেন সে বনাঞ্চলের সঙ্গে তাদের বংশপরম্পরায় সম্পর্কে এখনও পুরোপুরি ছেদ পড়েনি।

যদিওবা আধুনিক সভ্যসমাজ নিজেদের উন্নয়নের চাহিদা মেটাতে এসব বনবাসী আদিবাসীদের আপন বাসস্থান থেকে ক্রমান্বয়ে উচ্ছেদ করছে এবং সেই সঙ্গে জীবন জীবিকা নির্বাহের জন্য যতটুকু উপযুক্ত প্রকৃতিজাত বনাঞ্চল তাদের প্রয়োজন সেই বনাঞ্চলও ক্রমশ ধ্বংস করে চলছে।

এরা যান্ত্রিক ও ভৌগোলিক অগ্রসরতা থেকে পিছিয়ে রয়েছে। এদরকে উন্নয়নের দৌড়ে পিছনে ফেলে রাখা হয়েছে।

এদের কোন অপরাধ নেই-তথাপি এদের ভাষা, সংস্কৃতি, রীতি-নীতি ঐতিহ্যের ইতিহাসকে পিছনে ফেলে রাখা হয়েছে।

তাদের সামনে আশা আকাঙ্ক্ষার কোন সিড়ি পর্যন্ত রচনা করে দেখা হয়নি। শিক্ষার আলো তাদের দুয়ারে তুলে ধরা হয় নি।

তারা দুর্ভাগাদের দল সমৃদ্ধ শ্রেণি যদি তাদেরকে স্বাভাবিক ও উচ্চাশা পূর্ণ জীবনের ক্ষেত্রে তুলে আনার জন্য হাত বাড়িয়ে দেন, সরকারও যদি সেই মতো কর্মপন্থা গ্রহণ করেন, তবেই তাদের সামনে সৌভাগ্যের আলো জ্বলে উঠতে পারে।

অস্তিত্ব সংরক্ষণের কার্যকরী পদক্ষেপ :

এটাই সত্য যে, বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতির অবকাঠামো নির্মাণে কিংবা ক্রমবিকাশের ধারায় পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনজাতি মূল জনগোষ্ঠীর সাথে সমান তালে এগিয়ে যেতে পারেননি এবং আজও এরা পুরানো সমাজ ব্যবস্থা ও সংস্কৃতির স্বকীয় স্বতন্ত্রতার মধ্যে থেকে নিজেদের প্রকাশ ও বিকাশ ঘটাতে চায়।

যেহেতু এসব মানবগোষ্ঠী আপন আপন কৃষ্টি নির্ভর জীবন-যাপন করে এবং চাহিদার অতিরিক্ত অন্য সভ্যতার সমাজের কুষ্টির উপাদানকে অনুসরণ করার চিন্তা চেতনায় প্রলোভিত হয় না সেহেতু তাদের সংস্কৃতি সভ্যতার মানদণ্ডে হয়তোবা অনুন্নত, যান্ত্রিক ও ভৌগোলিক অগ্রযাত্রায় অনগ্রসর পিছিয়ে পড়া সমাজ, এই পিছিয়ে পড়া সমাজকে আবার নির্বিচারে শোষণ করছে সভ্যতার সমাজ নিজেদের সভ্যতার উৎকর্ষ সাধনে।

আধুনিক প্রযুক্তি অবিলম্বে সেই সভ্যতার সমাজের মানুষ এই পিছিয়ে পড়া সমাজের মানুষকে করে তুলছে নিরাপত্তাহীন, আশ্রয়হীন ও অনিশ্চিত।

পাবত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ আদিবাসী জনগণ গরিব।

উচ্চতর পর্যায়ে কয়েকজন রাজনীতিক, জনপ্রতিনিধি, চাকুরিজীবী, আমলা, এনজিও কর্মকর্তা ও ব্যবসায়িক পেশাজীবী ব্যতীত অন্যান্য সকল সর্বস্তরের আদিবাসীরাই অনেক বেশি গরিব, নিরক্ষরও বটে।

এই দারিদ্ররতা ও নিরক্ষরতা হেত যে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে সেই বৈষম্যকে বিতাড়িত করতে হবে আগে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা তাহলে বাংলাদেশের স্বাভাবিক উন্নতিশীল জীবন্যাত্রা পদ্ধতির সাথে শরীক হয়ে Unitary জাতীয়বােধের চেতনায় একীভূত হতে পারবে।

দুর্গম পশ্চাৎপদ পার্বত্য এলাকার আদিবাসী ছেলেমেয়েদের বিশেষ পদ্ধতিতে বিশেষ ব্যবস্থায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে।

হতে পারে কিন্ডার গার্টেন, বোর্ড স্কুল কিংবা ক্যাডেট কলেজ শিক্ষাপদ্ধতি ব্যবস্থাপনা, পরিচালনাসমূহের Concept এর সংমিশ্রণ সমন্বয় ঘটিয়ে যুবক সম্প্রদায় যারা সামাজিক ও উচ্চ সামাজিক শিক্ষা লাভের উপযোগী তাদের প্রয়োজন ও দক্ষতা অনুসারে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি দিয়ে উন্নত জীবনের মান গড়ে তুলতে সহায়তা করতে হবে।

যেমন- কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে, স্বাস্থ্যকর্মী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে, ট্যুরিজম এন্ড কাটারিং ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে, কৃষি শিক্ষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তির বিশেষ সহায়তা সুযোগ সুবিধাদি দিয়ে কর্মসংস্থানের পথকে সুপ্রশস্ত করতে পারে।

যারা বয়সে বৃদ্ধ কিন্তু বাস্তববুদ্ধি, শিল্প, স্থাপত্য, সংস্কৃতিতে পারদর্শী এবং কাজ করতে আগ্রহী তাদের সংস্কৃতি, শিল্প স্থাপত্যের সে শ্রেণির কাজে কিছু কিছু ভাতা দিয়ে আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে পারা যায়।

Cultural Complex কিংবা Museum garden কিংবা Indigenous Foundation গড়ে তুলে এতে এদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে।

এসব কর্মকাণ্ড শিল্পস্থাপত্য সৃষ্টিকারীদের জীবিকা নির্বাহের পথে বিরাট একটা অবলম্বন হতে পারে।

আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় তাদের বেঁচে থাকার আগ্রহকে গঠনমূলক কাজে সম্প্রসারিত করে ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাদের প্রায় বিলুপ্ত শিল্পস্থাপত্য ঐতিহ্যকে রক্ষাও করা হবে।

বাংলাদেশে অন্যান্য আদিবাসী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী :

বাংলাদেশে কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিরাই একমাত্র আদিবাসী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নয়, নির্যাতিত নিপীড়িত সংখ্যালঘু জনজাতি নয়।

বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় রয়েছে মান্দি (গারো), সাঁওতাল, হাজং, কোচ, ওরাও, রাজবংশী, মনিপুরী (বিপিয়া), খাসিয়া, রাখাইনসহ অপরাপর প্রায় ৪২টি আদিবাসী জনজাতি। যারা প্রায় নিকৃষ্টতম ব্যবহার পায়।

তাদের বসবাসের কোন ভূখণ্ড নেই।

জন্মভূমির দাবিতে কিংবা স্বদেশ বলে কোন দেশের পরিসীমায় আলাদা হিসেবে জীবনাচারের ক্ষেত্রেও তৈরি করে রাখা হয়নি।

জীবন দুর্বিষহ হয়ে থাকলেও তাদের পৌরাণিক আদি সনাতন ভূখণ্ড ভারতীয় উপমহাদেশের কোথাও প্রত্যাবর্তন করতে পারে না।

অর্থ সঞ্চয় করে, উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে অথবা ভিন্ন ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে কিংবা বাঙ্গালি পরিবারের সদস্য সদস্যাদের সঙ্গে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে মৈত্রী কিংবা মুক্তিলাভের আশাও তারা কখনো করতে পারে না।

National Main Stream অর্থাৎ জাতিসত্তার মূলধারায় সংমিশ্রণের পথও অপ্রশস্ত। তাদের জনজাতিদের মধ্য হতে সামান্য কয়েকজন হয়তোবা সরকারি অফিসে উচ্চসহকারী পদে নিয়োজিত থাকতে পারে।

কয়েকজন হয়তো ব্যাংকার, শিল্পী, কারিগর, চিকিৎসক, শিক্ষক কিংবা রাজনৈতিক দলের কর্মী হতে পারে। কিন্তু তাদের অধিকাংশের তো দাঁড়াবার কোন স্থান নেই।

আস্থা, স্বকীয়তা, স্বতন্ত্রবোধ বজায় রাখার কোন ভিত্তি তাদের জন্য গড়ে তোলা হয়নি।

আজ যদি বৃহত্তর বাঙালী সমৃদ্ধ সমাজ তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন যদি তাদের প্রতি কিছুটা সংহতির প্রত্যাশায় মনোযোগী হন, টিকে থাকার বিরূপ পরিবেশ থেকে যদি তাদের মুক্ত করা হয়, নিরক্ষতার অভিশাপ, দরিদ্রতার করালগ্রাস থেকে বিমোচন, ভূমি সত্বাধিকার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সংরক্ষণের অগ্রাধিকার দেয়া হয়, তা হলেই এসব আদিবাসী জনজাতিকে বাঁচানো সম্ভব। এর দলে ভবিষ্যতে যারা আসবে তাদের উত্তরসূরীরাও উদ্ধার পাবে।

উপসংহার :

অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক ও উৎসাহ উদ্দীপনার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা নিষ্পত্তি সম্বলিত বিশেষ শাসন কাঠামো প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিগত ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন, রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি-বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ (সংশোধন) আইন, পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয় বিষয়ক কার্যবিধিমালা প্রণীত হয়েছে।

এতে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের জন্য জনপ্রতিনিধিত্বের সংরক্ষিত আসন ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এ ধরনের সংরক্ষিত ব্যবস্থা সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন। জাতীয় পর্যায়ে নীতিমালা প্রণয়নে, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে প্রবেশে এটা করা প্রয়োজন সংবিধানের ধারায় নতুন সংযোজন প্রবর্তনের মাধ্যমে।

এতে তাদেরকে আভ্যন্তরীণ জীবন সংক্রান্ত সর্বপ্রকার বিধি প্রবর্তন, নিয়ন্ত্রণ ও কার্যকরী করার পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সীমিত আওতায় এমন ক্ষমতা, দায়-দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে যেন নিজেরাই নিজেদের অধিকার, নিজেদের উন্নতি, শাসন পদ্ধতি নিজেরাই নির্ধারণ করতে পারে।

মানবাধিকারের দৃষ্টিতেও সংখ্যালঘুদের অস্তিত্ব সংরক্ষণের এটাই স্বীকৃত ও স্বতসিদ্ধ পন্থা।

এখনই সময় এসব বিধানাবলী যথাশীঘ্রই কার্যকরী পদক্ষেপ অবলম্বন করা হলে আদিবাসীদের অভ্যন্তরে ভ্রাতৃত্ব সংঘাতসহ পাহাড়ি বাঙালী পারস্পরিক অবিশ্বাস দূরীভূত হবে।

আর এটির বাস্তবায়ন যতই দীর্ঘায়িত ও কালক্ষেপণ করা হবে। ক্রমশই এর জটিলতা ঘনীভূত ও সম্প্রসারিত হবে।

এসব দিক নিশানাহীন আদিবাসী জনজাতিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করে স্বদেশের ধারাবাহিক উন্নয়নে শান্তি সম্প্রীতি শৃঙ্খলায় সামিল করা নিতান্তই জরুরি।


লেখক: মংক্য শোয়েনু নেভী, বিশিষ্ট লেখক, বান্দরবান।

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা