বন-বনায়ন প্রেক্ষিত পার্বত্য চট্টগ্রাম

Jumjournal
Last updated Sep 22nd, 2021

721

featured image

আজ সারাবিশ্ব পরিবেশ বিপর্যয় বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। তবে বাংলাদেশের পরিবেশবাদী সংগঠন ও ব্যক্তি যেভাবে গড়ে ওঠার সেভাবে মোটেও হয়নি। অন্যদিকে পরিবেশ বিপর্যয়ের ফল প্রতিটি মানুষের উপরে যেভাবে প্রভাব ফেলছে তা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়।

তাই এই আলােচনাটি পরিবেশের উপরে চিন্তা করে ‘বন-বনায়ন ও প্রেক্ষিত পার্বত্য চট্টগ্রাম’ নাম দেয়া হয়েছে। নাম দেয়ার প্রয়ােজন ছিল সমগ্র বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে।

অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে এ আলােচনা সমগ্র বাংলাদেশকেন্দ্রিক না হয়ে কেন শুধুমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিয়ে। এ প্রশ্নের উত্তর এ আলােচনায় নিশ্চয় আলােকপাতের চেষ্টা করা হবে।

আমরা যখনি পরিবেশ নিয়ে ভাবি অথবা কথাবার্তা বলি তখনি প্রাসঙ্গিকভাবে বন এর কথা আপনাআপনি চলে আসে। অন্যদিকে বনায়নের বিষয়টিও পরিবেশ রক্ষার জন্য অতি প্রয়ােজনীয় একটি উপাদান হিসেবে চলে আসে।

বন এবং বনায়ন বিষয়টি একে অপরের সব শব্দ এবং পরিবেশ রক্ষার্থে বিষয়টি কোনভাবে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। অপরদিকে বন এর বনায়নের সংজ্ঞা নিয়েও অনেক বিতর্ক আসে যা আভিধানিক অর্থের সাথে এদেশের জনমানষের সংজ্ঞার মধ্যে অনেক অমিল খুজে পাওয়া যায়।

ইদানিংকালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বন অধিদপ্তর, বনের যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে তা অনেক পরিবেশবাদী ও বননির্ভর তথা বনজীবী জনগােষ্ঠীর কাছে এক হাস্যকর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া বনায়নের যে সংজ্ঞা ও প্রক্রিয়া সারাদেশব্যাপী দেখা যায় তা এদেশের আপামর জনগণের দৃষ্টিতে কী প্রভাব ফেলেছে তা অত্যন্ত নেতিবাচক।

এ বিষয়টিকে আমরা এভাবে আলােচনায় আনতে পারি যে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রে অনেক মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তর রয়েছে তৎমধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় বা কৃষি অধিদপ্তর, মৎস্য অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এবং বন অধিদপ্তর উল্লেখযােগ্য।

কৃষি অধিদপ্তর বা বিভাগ তারা ধান চাষ করে না বা ধান ফলায় না, মৎস্য অধিদপ্তর বা মৎস্য বিভাগ মাছ চাষ করে না, প্রাণি সম্পদ অধিদপ্তর কোন পশু পালন করে না।

তারা জ্ঞানভিত্তিক তথ্য ও উপাত্ত দিয়ে সেবা দান করে চলছে এবং অনেক উন্নয়ন করছে বলা যায়। বন অধিদপ্তর সরাসরি বনায়ন করে চলেছে যা অন্যান্য মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সাথে তাদের কার্যক্রমের কোন মিল নেই।

বন অধিদপ্তরের বন রক্ষা বা বনায়ন কার্যক্রমটি সফলতার মুখ দেখাতাে দুরের কথা বাংলাদেশে কী পরিমাণ বন আছে তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান এ বিভাগের কাছে নেই। অন্যদিকে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বনায়নের প্রকল্প বিগত ৪০ বছরে কোন সফলতার মুখ দেখেইনি বরং তা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ প্রকল্প হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে।

কারণ প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিদেশী প্রজাতির গাছ লাগিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য বিষয়টিকে এনে এক ভয়াবহ পরিণতির দিকে এগােচ্ছে।

এখানে দাতা গােষ্ঠীদের মন রক্ষাসহ ব্যবসায়িক চিন্তাচেতনা ও অর্থপ্রাপ্তি বিষয়টি মুখ্য বলে পরিগণিত হয়েছে এবং আজো তা ঘটে চলছে। অন্যদিকে উন্নয়ন ও পরিবেশ শব্দটি একে অপরের পরিপন্থী। এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে এ আলােচনায় পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয়টি আনা হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের মােট ভূমির ২৪ শতাংশ সেই ১৮৮২-৮৩ সালে তৎকালীন বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের কর্তাব্যক্তিরা এখানকার জনমানুষের জীবনযাত্রা ও মূল্যবােধকে অগ্রাহ্য করে কেবলমাত্র রাজস্ব আদায়ের দিকটি বিবেচনা করে রক্ষিত বন হিসেবে ঘােষণা করেছে।

যার সর্বমােট পরিমাণ ৭,৮৬,৭১০ লক্ষেরও অধিক একর যথাক্রমে কাচালং, রাইক্ষ্যং, সাংগু ও মাতামুহুরী রক্ষিত বন উল্লেখযােগ্য। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই বনসমূহে কী পরিমাণ গাছগাছালি, লতাগুল্ম ও অন্যান্য বনজ সম্পদ রয়েছে তা সরকারের কোন বিভাগের কাছে তার সঠিক তথ্য নেই।

আবার নতুন করে বন সৃষ্টির লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের জুম ভূমি দখল করে তিন জেলায় ২,১৮,০০০ একর দখল করে নিয়েছে। এ দখল করে নেয়া প্রক্রিয়াসমূহ উদ্দেশ্য প্রণােদিত এবং যথাযথ আইনকে প্রয়ােগ না করে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় আদিবাসীদের অস্তিত্ব বিলীন করার পায়তারা করা হয়েছে।

একদিকে আদিবাসীদের দখলীয় ভূমি দখল করা অব্যাহত রেখে বন বাগান সৃষ্টির প্রয়াস চালানাে হলেও অন্যদিকে হাজার হাজার টন ইটভাটায় নির্বিচারে গাছ কেটে পােড়ানাে এবং তার সমপরিমাণ গাছ তামাক চুলায় জ্বালানাে হচ্ছে।

তা বন্ধ করার কোন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। মাঝে মাঝে নামমাত্র অভিযান চালিয়ে কিছু আর্থিক জরিমানা করা হলেও অবৈধভাবে গাছ কেটে যে ব্যবহার তা বন্ধের কোন উদ্যোগ দেখা যায়নি।

সারাবিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়টিকে সামনে এনে বাসযােগ্য পৃথিবী সৃষ্টির লক্ষ্যে যে আন্দোলনের কার্যক্রম শুরু করছে সে কার্যক্রমে বাংলাদেশও অংশীদার হয়েছে। তবে এ অংশীদারীত্বের অবস্থানটা একটু ভিন্ন বলে মনে হয়।

কার্বন উৎপাদনকারী পশ্চিমা দেশসমূহকে দোষারােপ করে ক্ষতিপূরণ আদায়ে যথেষ্ট উদ্যোগী ভূমিকা পালনে সচেষ্ঠ বলে মনে হয়। এই প্রচেষ্টা হয়তােবা সফল হবে। ক্ষতিপূরণ হিসাবে প্রচুর আর্থিক অনুদানও হয়তােবা পাওয়া যাবে ।

কিন্তু তার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে এই চিন্তা সরকার বা সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্তাব্যক্তিরা সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণে সফল হয়েছেন? হয়তােবা কাগজে কলমে সব ঠিকঠাকভাবে আছে। সঠিক বাস্তবায়নের চিত্র কী হবে তা সহজে অনুমেয়।

কারণ জনগণের দাবী ও ইচ্ছা অগ্রাহ্য করে বন্য প্রাণি সংরক্ষণ আইন ইতােমধ্যে মহান জাতীয় সংসদে পাস করা হয়েছে। সে আইনের প্রয়ােগ ও বাস্তবায়ন কিভাবে হবে তার যথেষ্ট সন্দেহ থেকে যায়। কারণ এ আইন সংসদে পাস করার আগে।

বাস্তবতার নিরিখে বননির্ভর জনগােষ্ঠী তথা বনজীবী, পরিবেশবাদী এবং নাগরিক সমাজের। লােকজন আলাপ-আলােচনার আহ্বান জানিয়েছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে জনদাবী উপেক্ষা করে বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ আইন পাস করা হয়েছে।

অপরদিকে ১৯২৭ সালের বন আইনকে যুগােপযােগী করার লক্ষে সংশােধনী করার মাধ্যমে নতুন আইন প্রণয়নের জন্য অপেক্ষমাণ বলে জানা যায়। এ আইনটি মহান সংসদে পাস করার আগে বনবাসী, নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দ ও পরিবেশবাদীরা বারে বারে আলােচনা করার আহ্বান জানালেও সরকার তা আমলে নিচ্ছেনা।

এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয় নিয়ে একটু আলােচনা করি। নতুন পুরাতন মিলে ৩৫ শতাংশের অধিক ভূখণ্ড বর্তমানে বন বিভাগের আওতায় নেয়া হয়ে গেছে বলে ধারণা করা যেতে পারে। বন বিভাগের আওতাধীন ভূমিসমূহে গাছবিহীন বন-বাগানসহ যথেষ্ট পরিমাণ বিদেশী প্রজাতি বনায়নের নামে রােপণ করা হচ্ছে তা লক্ষণীয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামের জলবায়ু যেভাবে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে তাতে উদ্বিগ্ন না হয়ে থাকাটা অকল্পনীয়। কারণ ঝর্ণা-ঝিড়ি এবং ছােট ছােট খালে এই জায়গাগুলােতে আর পানীয় জল আগের মত নেই। কোন কোন খাল ঝিরি-ঝর্ণা সম্পূর্ণ খরা মৌসুমে শূন্য হয়ে যাচ্ছে।

আগেই আলােচনা করা হয়েছে যে উন্নয়ন ও পরিবেশ পরস্পর বিরােধী শব্দ। এখানে উন্নয়ন নামে পাহাড় কেটে সড়ক-মহাসড়ক তৈরীর কাজ দ্রুত গতিতে চলছে। এই রাস্তাঘাট তৈরীর জন্য ঝিরি-ঝর্ণা ও খাল থেকে অবৈধভাবে প্রচুর পরিমাণ পাথর উত্তোলন করা অব্যাহত আছে।

তার পাশাপাশি রাস্তা হওয়ার ফলে প্রাকৃতিক বন উজারসহ বনবিভাগের বাগানও অসাধু ব্যবসায়ী ও বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যােগসাজশে উজার করে পাচার করা হচ্ছে।

আমরা সকলে জানি পানীর উৎস গাছপালা ও বন। অন্যদিকে ঝর্ণা-ঝিরি ও খালে পানি ধরে রাখার মূল উপাদান হচ্ছে পাথর। এই গাছপালা-পাথর বা প্রাকিতিক সম্পদসমূহ প্রায় শেষ পর্যায়ে।

কিছু অর্থ প্রাপ্তির জন্য যে যেভাবে পারে এই প্রাকৃতিক সম্পদকে নষ্ট করছে। মনে হয় এটাকে দেখা বা রক্ষা করার কেউই নেই। জনসংখ্যা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে সে মানবসম্পদ টিকে রাখার জন্য প্রাকৃতিক সম্পদের উপরে যেভাবে চাপ পড়ছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।

আবার সারা বাংলাদেশ যদি পার্বত্য চট্টগ্রাম নির্ভর হয় তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সম্পদ কিভাবে রক্ষা করা যাবে সকলকে তা ভাববার সময় এসেছে বলে মনে হয়। সুতরাং পার্বত্য চট্টগ্রামে এমন বন ও বনায়ন করা দরকার যাতে করে এ এলাকার অধিবাসীসহ এই অঞ্চলের ভূমির ধারণ ক্ষমতার মধ্যে থাকে।

মনে রাখতে হবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল ঐতিহ্য নষ্ট হলে এর প্রভাব বাংলাদেশসহ সকল দেশে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাই আমাদের সকলকে গভীরভাবে ভাবতে হবে।

এ আলােচনার মাধ্যমে সকল পাঠকদের আহ্বান জানাতে চাই পরিবেশ রক্ষায় এগিয়ে আসুন এবং যে বন আইনটি জাতীয় সংসদে পাসের আশায় অপেক্ষমাণ সে বিষয়ে বিশদ আলােচনার জন্য সরকারের প্রতি চাপ অব্যাহত রাখবেন। এ প্রত্যাশায় সকলকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

লেখক: জুয়ামলিয়ান আমলাই

তথ্যসুত্র : তাক্রুপ্ : বৈসুক -সাংগ্রাই-বিঝু-বিষু-বিহু-সংকলন ২০১৩

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা