পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি ব্যবস্থাপনা, ভূমি বিরোধ ও ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি: প্রাসঙ্গিক ভাবনা
5510
সূচনা
পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি পাহাড়ি আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল। এ অঞ্চলের ভৌগলিক ও জাতিগত বৈশিষ্ট্য, এর শাসন ব্যবস্থা এবং এ অঞ্চলের মানুষের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও তাদের জীবন-জীবিকা দেশের মূল স্রোতধারা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ ও নিষ্পত্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় যার উপর নির্ভর করছে পার্বত্যবাসীর ভবিষ্যৎ সমাজ ও রাজনীতি।
এ অঞ্চলে অসংখ্য ঝর্ণা, উচ্চ-অনুচ্চ পাহাড়, বন, নদী, নয়নাভিরাম বহু প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম হ্রদ, বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা, লতাগুল্ম, ঔষধি, বিভিন্ন প্রজাতির পশু পাখি, কীটপতঙ্গ এবং বৈচিত্রপূর্ণ জাতিগোষ্ঠী ও তাদের ঐতিহ্যমন্ডিত সমৃদ্ধ সংস্কৃতি রয়েছে।
এ অঞ্চলের এইসব বৈচিত্র্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগত কারণে তার বাস্তবতা স্বীকার করে পার্বত্য চট্টগ্রামে আলাদা শাসন, বিচার ও আইন ব্যবস্থা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত হয়ে আসছে। বৃটিশ আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম ‘শাসন বহির্ভূত অঞ্চল’-এর মর্যাদা ভোগ করতো। এ মর্যাদা ১৯৬৫ সালে প্রনীত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে ও স্বীকৃতি লাভ করে।
পরবর্তীতে পাকিস্তান সরকার ‘শাসন বহির্ভূত অঞ্চল’- এর মর্যাদা বাতিল করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘উপজাতীয় অধ্যুষিত অঞ্চল’ ঘোষণা করে। বাংলাদেশের সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রাম ‘শাসন বহির্ভূত অঞ্চল’ বা ‘উপজাতীয় অধ্যুষিত অঞ্চল’ এর স্বীকৃতি না পেলেও ১৯৯৭ সালে সম্পাদিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মধ্য দিয়ে ‘উপজাতীয় অধ্যুষিত অঞ্চল’- এর মর্যাদা পুন:প্রতিষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বে ২১.৩৫ ডিগ্রি অক্ষাংশ ও ২৩.৪০ ডিগ্রি এবং .ডিগ্রি ও ৯২.৫০ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে ৫০৯৩ বর্গমাইল নিয়ে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম গঠিত।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগলিক সীমানা- এর উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, দক্ষিণে চট্টগ্রাম ও বার্মার সীমান্ত, পূর্বে ভারতের মিজোরাম এবং পশ্চিমে চট্টগ্রাম [উত্তর পূর্ব মিজোরাম ও দক্ষিণ পূর্ব মিজোরাম, পূর্ব দক্ষিণ বার্মা, দক্ষিণ পশ্চিম চট্টগ্রাম ও বার্মা]।
১৯৯১ সালের আদমশুমারী অনুসারে এ অঞ্চলের জনসংখ্যা- ৯৭৬,৪৩৬ । তৎমধ্যে পাহাড়ী আদিবাসী- ৫০১, ১৪৪, অ-আদিবাসী- ৪৭৩,৩০১। ২০০১ সালের আদমশুমারীতে জাতিভিত্তিক জনসংখ্যার হিসাব নেই।
পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৩টি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী রয়েছে। এই ১৩টি জাতি হলো- চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, বম, খ্যাং, চাক, পাংখো, লুসাই, অহমিয়া, ও নেপালী। এদের প্রত্যেকের আলাদা ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে।
তবে তাদের চাষাবাদ পদ্ধতি অভিন্ন। একসময় সব আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী জুমচাষ করতো। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা ‘জুম্ম’ বা ‘জুম্মা’ নামেও পরিচিত।
তবে বর্তমানে ম্রো, বম, লুসাই, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর লোকেরা অধিক পরিমানে জুমচাষ করে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের পরিচয় একসঙ্গে বুঝাতে ‘জুম্ম’, ‘পাহাড়ি’ ‘পাহাড়ি আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জাতিভিত্তিক জনসংখ্যা (১৮৭১-১৯৯১)
ক্রমিক নং | জনগোষ্ঠী | ১৮৭১ | ১৯০১ | ১৯৫১ | ১৯৮১ | ১৯৯১ |
১ | চাকমা | ২৮,০৯৭ | ৪৪,৩৯২ | ১৩৩,০৭৫ | ২৩০,২৭৩ | ২৩৯,৪১৭ |
২ | মারমা | ২২,০৬০ | ৩০,৭০৬ | ৬৫,৮৮৯ | ১২২,৭৩৪ | ১৪২,৩৩৪ |
৩ | ত্রিপুরা | ৮,১০০ | ২৩,৩৪১ | ৩৭,২৪৬ | ৫৪,৩৭৫ | ৬১,১২৯ |
৪ | ম্রো | ২৩৭৮ | ১০,৫৪০ | ১৬,১২১ | ১৭,৮১১ | ২২,১৬১ |
৫ | তঞ্চঙ্গ্যা | ১৯,২১১ | ||||
৬ | বম | ৩০৫ | ৬৯৬ | ৯৭৭ | ৫৭৩৩ | ৬৯৭৮ |
৭ | পাংখো | ১৭৭ | ২৪১ | ৬২৭ | ২,২৭৮ | ৩,২২৭ |
৮ | চাক | ৯১০ | ২,০০০ | |||
৯ | খ্যাং | ৩০৬ | ১,৪২৭ | ১৩০০ | ৫৪৫৩ | ১৯৫০ |
১০ | খুমি | ৫৩৪ | ১০৫৩ | ১৯৪১ | ১১৮৮ | ১১২৪১ |
১১ | লুসাই | ৬৭৮ | ৩৩৪১ | ১০৪১ | ৬৬২ | |
১২ | অন্যান্য | ৮২৮ | ||||
মোট | ৬১,৯৫৭ | ১১৩,০৭৪ | ২৬০,৫১৭ | ৪৪১,৭৯৬ | ৫০১,১৪৪ |
পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংখ্যা (১৮৭২-১৯৯১)
জাতিসত্তা | ১৮৭২ | ১৯০১ | ১৯৫৯ | ১৯৮১ | ১৯৯১ |
বাঙালি | ১০৯৭ | ৮৭৬২ | ২৬১৫০ | ৩০৪৮৭৩ | ৪৭৩৩০১ |
আদিবাসী | ৬১৯৫৭ | ১১৬০০০ | ১৩৩০৭৫ | ৪৪১৭৭৬ | ৫০১১৪৪ |
মোট | ৬৪৯২৬ | ১২৬৬৬৩ | ১৬১১৮৪ | ৭৪৮৬৩০ | ৯৭৬৪৩৬ |
বাঙালি | ২% | ৭% | ৯% | ৪১% | ৪৯% |
আদিবাসী | ৯৮% | ৯৩% | ৯১% | ৫৯% | ৫১% |
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
বৃটিশ আগমনের আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের নিজেদের শাসনব্যবস্থা ছিল। সেই আমলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও কখনো কখনো আদিবাসীদের শাসনাধীনে ছিল।
চট্টগ্রাম অঞ্চলটি কখনো ত্রিপুরাার মহারাজা, কখনো আরাকান রাজ কখনো মোঘল ও পরবর্তীতে চাকমা রাজার শাসনাধীনে ছিলো। ত্রিপুরার মহারাজা ১২২৪ খ্রীষ্টাব্দ থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চল শাসন করা শুরু করেন। তার আগে চট্টগ্রাম অঞ্চল শাসন করতো হিন্দু রাজারা।
চট্টগ্রাম অঞ্চল বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজশক্তির হাতবদল হয়েছিল। এটি মূলত: একটি যুদ্ধ ক্ষেত্র ছিল। ১২৪৩ খ্রীষ্টাব্দের পর হতে চট্টগ্রামে হিন্দু রাজত্বের অবসান দেখা যায়।
তারপর হতে ত্রিপুরা, মগ, মুসলমান ও পর্তুগীজদের পরষ্পর সংঘর্ষে লিপ্ত হতে দেখা যায়। এজন্য চট্টগ্রামকে ব্রক্ষ ভাষায় ‘চিতাগাঁও বা চিৎগা’ বলে। চিতা বা চিৎ শব্দের অর্থ হল যুদ্ধ আর গাঁও শব্দের অর্থ হল স্থান অর্থাৎ যুদ্ধক্ষেত্র বা যুদ্ধস্থান।
ত্রিপুরারাজ চট্টগ্রাম অধিকার করেন, দামোদর দেবের বংশধর হতে। এটি ১২৪৪ খ্রীষ্টাব্দে বলে অনুমিত হয়।
ইতিহাসে দেখা যায়, ১৫০০ খ্রীষ্টাব্দ হতে ১৫৩২ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত এই ৩২ বৎসর চট্টগ্রাম অঞ্চল দখলকে কেন্দ্র করে ত্রিপুরারাজ, পর্তুগীজ, মুসলমান সেনাপতি ও বাদশাহগণের উপর্যুপরি আক্রমন, লুণ্ঠন, কাটাকাটি, রক্তারক্তি হয়েছিল। কিন্তু এ অঞ্চলে কেউ স্থায়ী রাজত্ব স্থাপন করতে পারেনি।
১৫১২ খ্রীষ্টাব্দে হোসেন শাহ চট্টগ্রাম আক্রমন করেন। এই সময়ে আরাকানীজ, মুসলমান, হিন্দু ও পর্তুগীজে ভয়ানক কাটাকাটি, মারামারি ও খন্ডযুদ্ধ আরম্ভ হয়। সুযোগ বুঝে ত্রিপুরা রাজার প্রধান সেনাপতি রায় কাচাগ চট্টগ্রাম আক্রমন করেন।
হোসেন শাহ-এর সৈন্য পরাজিত হয়ে পলায়ণ করে এবং রায় কাচাগ আরাকানীজদের পরাজিত করে পুনরায় চট্টগ্রাম অধিকার করেন। ১৫২৬ খ্রীষ্টাব্দে মহারাজা বিজয় মানিক্য রিপরার সিংহাসনে আরোহন করেন।
বহুদিন যুদ্ধের পর মুসলমান ও আরাকানীজ (মগ) সৈন্য পরাজিত করে চট্টগ্রাম অধিকার করেন। কয়েক মাস পর উড়িষ্যা বিজয়ী মাহামদ সাহা চট্টগ্রাম অধিকার করেন।
৮ মাস যুদ্ধের পর তিনি ত্রিপুরা রাজার সহিত যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দী হন। মোটামুটিভাবে ১২৪৪ সাল থেকে ১৫২৬ অবধি বিভিন্ন সময়ে চট্টগ্রাম ত্রিপুরা মহারাজার অধীনে ছিল। এসময় পার্বত্য চট্টগ্রামও ত্রিপুরা মহারাজার অধীনে ছিল।
১৫০০ খ্ৰীষ্টাব্দ থেকে ১৫৩২ খ্রীষ্টাব্দে আরাকানাধিপতি মেঙবেঙ বিভিন্ন সময়ে চট্টগ্রাম অধিকার করেন। ১৫৮৭ খ্রীষ্টাব্দে মাংফুলা নামক আরাকানের জনৈক নরপতি চট্টগ্রামের সমুদয় অঞ্চল দখল করেন। ১৬১৭ খ্রীষ্টাব্দে আরাকানাধিপতি পর্তুগীজগণের প্রধান আড্ডা সন্দ্বীপ আক্রমণ করত: অনেক পর্তুগীজ ধ্বংস করেন। এরপর আরাকানাধিপতি মিনখ্যাং বাঙ্গালাদেশ আক্রমন করে ঢাকা পর্যন্ত রাজ্যবিস্তার করেন ।
১৭৬০ খ্রীষ্টাব্দে নবাব মীরকাসিম চট্টগ্রাম, মেদিনীপুর, বর্দ্ধমান এই ৩টি জেলা ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে দান করেন। তখন মাহাং রেজা খাঁ চট্টগ্রামের শাসনকর্তা ছিলেন। ১৭৬৪ খ্রীষ্টাব্দে চাকমা রাজা শ্ৰী দৌলত খাঁ ও রণূ খাঁ বৃটিশের বিরুদ্ধাচারণ করেন।
চাকমা রাজার সাথে বৃটিশদের যুদ্ধ হয়। অবশ্য পরে চাকমা রাজা জানবক্স খাঁ ও ইংরেজ সরকারের মধ্যে আপোষ চুক্তি সম্পাদিত হয় এবং অবশেষে সমঝোতা চুক্তির মধ্য দিয়ে যুদ্ধের অবসান ঘটে। চাকমা রাজা কর্তৃক চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়ায় শুকবিলাস ও রাজানগর নামে পর পর দু’টি রাজধানী স্থাপিত হয়।
চাকমা রাজা সেরমত্যার রাজত্বকাল (১২০০ খ্রী: রাজধানী মনিজগিরি) থেকে রাজা সেরমুক্ত খাঁ (১৭৩৭ খ্রী: রাজধানী আলেক দং বর্তমান আলীকদম) অবধি রাজ্যশাসন হিসাব করলে চাকমা রাজাদের স্বাধীন রাজত্বকাল ৫০০ বছর বলে ধরে নেওয়া যায় । [সূত্র: শ্রী শ্রী রাজনামা ও চাকমা রাজবংশের ইতিহাস- বিপ্রদাস বড়ুয়ার সম্পাদনা ]৷
একসময় চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া, নোয়াপাড়া, কোয়েপাড়া, সারওয়াতলী, রাউজান প্রভৃতি অঞ্চল আদিবাসীদের পূর্ণ দখলে ছিল। চট্টগ্রাম শহরের দু’টি রাণীর দীঘি, কমিশনারের বাংলো, রাজাপুর, নন্দনকানন, বক্সিরহাট প্রভৃতি আদিবাসীদের দখলে ছিল।
এ জেলার রানীর হাট, ধামাই রাস্তা, ধামাই খিল, চাকমাকুল, রাজাকুল, ওয়াংজা, মুড়া, কদমতলী, শাকপুরা, সাতকানিয়া প্রভৃতি চট্টগ্রামে চাকমাদের প্রভাব প্রতিপত্তিকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের মাঝে বিশেষত: চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা আদিবাসীদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ। পার্বত্য চট্টগ্রামের এই তিনটি আদিবাসী পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম ছাড়াও কুমিল্লা, নোয়াখালী, চাদপুর, রাজবাড়ী, সিলেট ও ঢাকার কিয়দংশে রাজত্ব কায়েম করেছিল।
শত শত বছর ধরে শাসনব্যবস্থা পরিচালনার কারণে আদিবাসীদের নিজস্ব শাসনব্যবস্থাও গড়ে উঠেছিলো। এসব অঞ্চলে রাজা প্রশাসনে ত্রিপুরা কানির প্রচলন ছিলো। বর্তমান কুমিল্লা নামটিই ছিলো ‘ত্রিপুরা’।
পাকিস্তান আমলে ‘ত্রিপুরা’ নামটির পরিবর্তন করে কুমিল্লা করা হয়। কুমিল্লায় অনেকগুলি ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে।
এগুলির কোনটি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে, কোনটি আবার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণাধীন রয়েছে। ত্রিপুরাসহ আদিবাসীদের সমস্ত ঐতিহাসিক নিদর্শন রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীনে পরিচালিত হওয়া বাঞ্চনীয়।
বৃটিশ সরকার ১৮৬০ সালে রাজস্ব আদায় ও শাসন কার্য পরিচালনার সুবিধার্থে কোম্পানী আমলে গঠিত জেলাসমূহকে পুনর্গঠন করে জেলার আয়তনকে আরো ক্ষুদ্র আকারে রূপান্তরিত করে সারা ভারতবর্ষে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস করে। এ সময় [১৮৬০ সালে] ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম’ অঞ্চলকেও আলাদা প্রশাসনিক ইউনিট ও জেলা হিসেবে মর্যাদা প্রদান করে।
বৃটিশ সরকার ১৮৭৪ সালে ভারতীয় আইনসভা “তফসিলভুক্ত জেলা আইন ৭৪” পাস করে। উক্ত তফসিলভুক্ত জোলা আইন এর আওতায় অনগ্রসর ও সম্পূর্ণ আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি তফসিলভুক্ত জেলায় পরিণত করা হয়।
১৮৭০ সালে ব্রিটিশ ভারত সরকার ‘রুলস ফর এডমিনিস্ট্রেশন অফ ব্যাকওয়ার্ড ট্র্যাক্টস, ১৮৭০’ (Rules for Administration of Backward Tracts, 1870) প্রণয়ন করে। এ আইনের আওতায় ১৮৭৩ সালে ব্রিটিশ ভারত সরকার ‘ইনার লাইন রেগুলেশন, ১৮৭৩’ (Inner Line Regulation, 1873) প্রণয়ন করে এ সব অঞ্চলে অনুমতি ব্যতিরেকে বহিরাগতদের চলাচলে বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়।
১৮৭৪ সালে ব্রিটিশ ভারত সরকার ‘তফসিল জেলা আইন-১৮৭৪’ (Schedule District Act, XIV of 1874) প্রণয়ন করে আদিবাসীদের ভূমি অধিকার সংরক্ষণ ও স্ব-শাসন ব্যবস্থার নিশ্চয়তা বিধান করে। এ উভয় আইন পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রয়োগ করা হয়।
১৮৮৪ সালের আঞ্চলিক সার্কেল বিধির আওতায় [Rules for Territorial Circles Chittagong Hill Tracts] মং বা মান সার্কেল সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলাকে ৫টি সার্কেলে ভাগ করা হয়। এই ৫টি সার্কেল হলো- ১. রাজা হরিশ্চন্দ্রের সার্কেল [চাকমা সার্কেল], ২. মং রাজার সার্কেল, ৩. বোমাং রাজার সার্কেল, ৪. সদর সাব ডিভিশনাল খাসমহল, ৫. সাঙ্গু সাব ডিভিশনাল খাসমহল।
উক্ত আঞ্চলিক সার্কেল বিধি দ্বারা তিন রাজার তিনটি সার্কেলের সীমানা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। ১৮৮৪ সালের আঞ্চলিক সার্কেল বিধি সংশোধন ও পরিবর্তন করে ১৮৯২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্কেলগুলিকে পুনর্গঠন করা হয়।
এ সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের ৫টি সার্কেল- এর পরিবর্তে ৪টি সার্কেল করা হয়। এগুলি হল- ১. চাকমা সার্কেল, ২. মং সার্কেল, ও ৩. বোমাং সার্কেল ও ৪. সংরক্ষিত বনাঞ্চল।
জেলার প্রশাসনিক কার্যক্রম সুচারুরূপে পরিচালনাৰ্থে ১৭ বিধি সম্বলিত ‘Rules for the administration of the Chittagong Hill Tracts’ নামে এক বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়।
উক্ত বিধিমালার ৪ নং বিধিতে মৌজা এলাকার আয়তন নির্ধারণ করা হয়। বিধিতে বলা হয় সর্বনিম্ন দেড় বর্গমাইল এবং সর্বোচ্চ ২০ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে এক একটি মৌজা গঠন করা হবে এবং ৭ নং বিধিতে মৌজা হেডম্যানগণের প্রশাসনিক ক্ষমতা নির্ধারণ করা হয়।
বৃটিশ সরকার ১৮৯২ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি “Rules for the administration of the Chittagong Hill Tracts’ সংশোধন ও সংযোজন করে ১৯০০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন (Regulation of 1900) নামে একটি আইন জারী করে। এই আইনটি পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘হিলস্ট্রাক্টস ম্যানুয়েল’ বা ‘১৯০০ এ্যাক্ট’ নামে সমধিক পরিচিত। বৃটিশ প্রণীত এই আইনটি পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো প্রযোজ্য।
এ আইন এবং পরবর্তীতে প্রণীত আইনের ভিত্তিতে ভূমি ব্যবস্থাপনাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হয়ে আসছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী বিভিন্ন জাতির সমাজ ব্যবস্থার নিজস্ব প্রথা-পদ্ধতি ও রীতিনীতি বিদ্যমান।
এ জাতিগোষ্ঠীসমূহ শত শত বছর ধরে নিজস্ব প্ৰথা-পদ্ধতি দ্বারা শাসিত হয়ে আসছে। বৃটিশ সরকার আইন প্রণয়ন করে [১৯০০এ্যাক্ট] উক্ত আইনে আদিবাসীদের প্রথা-পদ্ধতি, রীতিনীতির স্বীকৃতি দেয়। তবে, আদিবাসীদের সকল প্রকার প্রথা পদ্ধতি হিলট্রাক্টস ম্যানুয়েলে অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
বৃটিশ আগমনের আগেও পার্বত্য চট্টগ্রামে গ্রাম হেডম্যান বা গ্রাম প্রধান প্রধা প্রচলিত ছিল। প্রকৃত অর্থে কবে কখন গ্রাম হেডম্যান প্রথার উৎপত্তি হয়েছিল তা সঠিকভাবে বলা কঠিন। তবে ১৮৬৮ সালের পত্রালাপ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের তৎকালীন সুপারিন্টেন্ডেন্ট ক্যাপ্টেন জে এম গ্রাহাম এর লেখা থেকে জানা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘গ্রাম হেডম্যান’ বা গ্রাম প্রধান [Village Headman] প্রথা চালু ছিল।
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথানুসারে রাজারাই গ্রাম হেডম্যানকে নিয়োগ প্রদান করতেন। ক্যাপ্টেন লুইনের প্রতিবেদনে তার সত্যতা মেলে।
১৮৬৭ খ্রীষ্টাব্দের ‘Report on the capitation tax revenue settlement of the Chittagong Hill Tracts’ শিরোনামের প্রতিবেদনে ক্যাপ্টেন লুইন উল্লেখ করেছেন যে, ‘Formerly the head of a village (for what we miscall a Talukdar) was appointed by the chief being generally the most able man of the village was set forward by his village fellows to be their mouthpiece and through whom they paid their tribute.’
পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা ঘোষণাকালে মান বা মং সার্কেলের অস্তিত্ব ছিলো না। জুম খাজনা আদায়, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তর অঞ্চলকে নিয়ে পরবর্তীতে মান সার্কেল প্রতিষ্ঠা করা হয়।
এই সার্কেলের রাজা বা সার্কেল চীফ হিসেবে নিয়োগ পান ক্যজ সাইন চৌধুরী। তবে, চাকমা ও বোমাং রাজা পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা সৃষ্টির আগে থেকেই চাকমা ও মারমা জনগোষ্ঠীর রাজা হিসেবে স্বীকৃত পেয়ে আসছেন। ১৯১৯ ও ১৯৩৫ সালে প্রণীত ভারত শাসন আইনে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘পৃথক শাসিত অঞ্চল’ বা ‘শাসন বহির্ভূত এলাকা’ এর মর্যাদা সংরক্ষণ করা হয়।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগকালে প্রণীত ‘দি ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স এ্যাক্ট, ১৯৪৭’ (The Indian independence Act, ১৯৪৭) এর ৮ ধারার (২) উপ-ধারায় বর্ণিত হয় যে, নূতন আইন বা সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত ভারত শাসন আইন ১৯৩৫ অনুযায়ী ভারত ও পাকিস্তান ডোমিনিয়ন, এর প্রদেশ ও অংশসমূহ শাসিত হতে থাকবে।
দেশ বিভাগোত্তরকালে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশ নিজস্ব সংবিধান প্রণয়ন না করা পর্যন্ত ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুসরণ করতে থাকে। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্রে এবং ১৯৬২ সালে দ্বিতীয় শাসনতন্ত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি- ১৯০০ অব্যাহত রাখা হয়। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সংবিধানে প্রচলিত আইন হিসাবে পার্বত্য চটগ্রাম শাসনবিধি-১৯০০ বহাল রাখা হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ ও নিষ্পত্তি আর ভূমি ব্যবস্থাপনা
পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ ও নিষ্পত্তি, ভূমি ব্যবস্থাপনা সমতল এলাকার ভূমি ব্যবস্থাপনা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ ও নিষ্পত্তি ও সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এই অঞ্চলের ঐতিহ্যগত বা প্রথাগত প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অত্যধিক। পার্বত্য চটগ্রামের ঐতিহ্যবাহী প্রশাসনিক ব্যবস্থা তিন স্তরবিশিষ্ট।
যথা: ১. সার্কেল প্রশাসন ২. মৌজা প্রশাসন ও ৩.গ্রাম প্রশাসন। এই প্রথাগত প্রতিষ্ঠানগুলো জমি, ও বন ব্যবস্থাপনা, জুম ও জমির রাজাস্ব,, জেলার আইন শৃঙ্খলাসহ নানা বিষয়ে ডেপুটি কমিশনারকে পরামর্শ প্রদান, সামাজিক বিচার, শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন সেবামূলক কাজে ভূমিকা রাখা ইত্যাদি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে থাকে।
সার্কেল চীফ প্রথা ও সার্কেল প্রশাসন
রাজা বা সার্কেল চীফ পদটি বংশ পরম্পরার একটি উত্তরাধিকারী পদ। চাকমা সার্কেলে রাজার সন্তানদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ সন্তানই রাজ সিংহাসন পাবার বৈধ অধিকারী।
রাজার যদি একজনের অধিক স্ত্রী থেকে থাকেন সে ক্ষেত্রে প্ৰথম স্ত্রীর জ্যেষ্ঠ পুত্র (সামাজিক ও বৈধ বিবাহ ধারা জন্মগ্রহণকারী সস্থান) রাজা পদের বৈধ উত্তরাধিকারী হন। চাকমা সার্কেলের রাজা নিয়োগের এই নিয়ম মান সার্কেলেও সমভাবে প্রযোজ্য।
তবে, চাকমা সার্কেলে রাজার ঔরসজাত কোন সন্তান না থাকলে জ্যেষ্ঠ কন্যার পুত্র রাজা হলেও মান সার্কেলে তা হয় না। মান বা মং রাজার ঔরসজাত সন্তান না থাকলে রাজার স্ত্রী বা রাজার পৈত্রিক সূত্রের রক্ত সম্পর্কীয় যোগ্য ব্যক্তি প্রচলিত রীতি ও সমাজ স্বীকৃত প্রথা অনুযায়ী মং সার্কেলের সার্কেল টাফ পদে অধিষ্ঠিত হতে পারেন।
চাকমা ও মং সার্কেলের সার্কেল চীফ নিয়োগে কিছুটা মিল থাকলেও বোমা সার্কেলের সার্কেল চীফ নিয়োগ পদ্ধতি আলাদা। বোমাং রাজ পরিবারে মাতৃ পিতৃকুলের মধ্যে যিনি বয়োজ্যেষ্ঠ তিনিই বোমাং রাজা পদের বৈধ উত্তরাধিকারী।
রাজ পরিবারের এই বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি যদি সার্কেল চীফ পদ গ্রহণে অস্বীকৃতি না জানান সে ক্ষেত্রে বোমাং রাজ পরিবারের রীতি নীতি অনুসারে সরকারের পক্ষে বিভাগীয় কমিশনার রাজপদ হস্তান্তরের কাজ সম্পাদন করেন।
সার্কেল চীফ এর দায়িত্ব ও কার্যাবলী
(১) সার্কেল চীফ বা রাজা নিজ নিজ সার্কেলের প্রধান। আইনের বিধান মোতাবেক সার্কেল চীফ সংশ্লিষ্ট জেলার ভেপুটি কমিশনার, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয়, পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডকেও অন্যান্য বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করতে পারেন। সার্কেল চীফ প্রয়োজন মনে করলে পার্বত্য জেলা পরিষদের সভায় উপস্থিত থাকতে পারেন এবং মতামত পেশ করতে পারেন।
(২) সার্কেল চীফ হিসেবে তিনি ডেপুটি কমিশনারের পরে সাব-কালেক্টর বা সরকারের খাজনা আদায়কারী।
(৩তিনি মৌজার হেডম্যান নিয়োগ ও অপসারণে ডেপুটি কমিশনারকে পরামর্শ দিয়ে থাকে।
(৪) মৌজা হেডম্যানগণ কর্তৃক খাজনা আদায় ও এলাকার শক্তি – শৃংখলা বজায় রাখাসহ অপরাধ দমনে তাঁদের প্রতি আদেশ নির্দেশ ও পরামর্শ প্রদান রাজার দায়িত্ব ও ক্ষমতার আওতাধীন।
(৫) মৌজা হেডম্যান কর্তৃক আদায়কৃত খাজনা বা রাজস্ব সরকারী কোষাগারে জমা দান নিশ্চিত করা রাজার দায়িত্ব।
(৬) এলাকার জনগণের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার ও স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন।
(৭) ঐতিহ্যবাহী প্রশাসনিক ব্যবস্থার সর্বোচ্চ পদের অধিকারী হিসেবে সার্কেল চীফ স্ব স্ব সার্কেলের স্থায়ী বাসিন্দার সার্টিফিকেট প্রদানের একমাত্র আইনত: ছূড়ান্ত অনুমোদনকারী।
(৮) ডেপুটি মিশনারের আদালতে বিচারাধীন মামলায় প্রথাগত আইন ও সামাজিক রীতি নীতির ব্যাখার প্রয়োজনে ডেপুটি কমিশনার সংশ্লিষ্ট সার্কেল চীফ এর নিকট মতামত আহবান করলে তিনি তাঁর ব্যাখা ও মতামত প্রদান করে থাকেন।
(৯) সার্কেল চীফ কার্বারিদের নিয়োগ প্রদান করে থাকেন যিনি ভূমি ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও সামাজিক বিচার সম্পাদনে মৌজা প্রধানকে সহযোগিতা প্রদান করে থাকেন।
(১০) কমিশনারের মঞ্জুরী সাপেক্ষে সার্কেল চীফ যে মেীজার অধিবাসী সেই মৌজাকে খাস মৌজা হিসেবে নিজের হেফাজতে রাখতে পারবেন।
(১১)সার্কেল চীফ মৌজা হেডম্যানগণের রাজস্ব ও কল্যাণমূখী প্রশাসন বিষয়ে দক্ষতা বৃদ্ধির বিষয়টি নিশ্চিত করবেন।
(১২) সার্কেল চীফ হেডম্যান ও কার্বারীদের মাধ্যমে স্ব স্ব সার্কেলের বন, বন ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে
ভূমিকা পালন করে থাকেন।
হেডম্যান প্রথা ও মৌজা প্রশাসন
ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রথাগত প্রতিষ্ঠানের তিনটি স্তরের মধ্যে মৌজা প্ৰশাসন সবচেয়ে গুৰুত্বপূৰ্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। মেীজা প্রশাসন ঐতিহ্যবাহী প্রশাসন ব্যবস্থার মধ্যবর্তী স্তর। ঐতিহ্যবাহী প্রশাসনের এই প্রতিষ্ঠান বৃটিশ কর্তৃক প্রবর্তিত হয়।
প্রশাসনের এই স্তরটি সাধারন প্রশাসন, আইন শৃংখলা রক্ষা, রাজস্ব আদায়, বন ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, সামাজিক বিরোধ নিষ্পত্তি, মৌজার উন্নয়ন কর্মকান্ড ইত্যাদি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ৩৯০টি মৌজায় বিভক্ত।
চাকমা সার্কেলের চীফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বলেন, ‘বৃটিশরা ১৯০০ সালের বিধান প্রণয়নের পর মৌজা হেডম্যান [দি অফিস অব মেীজা হেডম্যান] পদ্ধতির সূচনা হয়। বেশ কিছু গ্রাম নিয়ে গঠিত একটি আঞ্চলি ইউনিটের প্রধান হলেন এইসব হেডম্যানরা। তাঁরা চীফ অথবা গ্রামবাসী কর্তৃক নির্বাচিত হতেন।
বৃটিশ শাসনের প্রথমদিকে হেডম্যানরা চীফদের দ্বারা নিযুক্ত হতেন। বর্তমানে সার্কেল চীফের পরামর্শক্রমে ডেপুটি কমিশনাররা হেডম্যান নিযুক্তি দিয়ে থাকেন। এই ধরণের নিয়োগ বংশানুক্রমিক নয়, তবে হেডম্যানের পুত্র নিযুক্তির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পেয়ে থাকেন।’
মৌজা হেডম্যানের দায়িত্ব ও কার্যাবলী
(১) হেডম্যান ভূমি রাজস্ব ও জুম খাজনা সংগ্রহ করেন।
(২) হেডম্যান ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। ভূমি বন্দোবস্তী, হস্তান্তর, ক্রয়-বিক্রয়, ভূমির সীমানা নির্ধারিণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেন এবং এ সব ক্ষেত্রে মৌজা প্রধানেরমতামত ও সুপারিশ গ্রহণ বাধ্যতামূলক।
(৩) তিনি মৌজার আইন শৃংখলা ও সামাজিক শৃংখলা রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
(৪) তিনি ভূমির রেকর্ড সংরক্ষণ করেন।
(৫) হেডম্যান মৌজার স্থায়ী বাসিন্দার সার্টিফিকেট প্রদান করে থাকেন।
(৬) তিনি জুম চাষী পরিবার প্রধানের নাম, পরিবারের সদস্য সংখ্যা, খাজনা মওকুফপ্রান্ত পরিবার ইত্যাদি তথ্য সম্বলিত জুম তৌজি তৈরী করেন এবং জুম চাষ নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।
(৭) তিনি ঘাস/শনখোলা ও গর্জন খোলার খাজনা এবং গো চারণভুমির ট্যাক্স আদায় করেন।
(৮) হেডম্যান মেজার বন ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি মৌজার বনজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ নষ্ট না করার জন্য নিষেধাজ্ঞা জারী করতে পারেন। হেডম্যান মৌজাস্থ কোন এলাকার বনজ সম্পদ সংরক্ষণের স্বার্থে জুম বা অন্য কোন চাষ করার ক্ষেত্রে নিযেধাজ্ঞা জারী করতে পারেন।
(৯) যদি হেডম্যানের বিবেচনায় নবাগত কেউ তাঁর মৌজায় জুম চাষ করলে পরবর্তী বছর মৌজাবাসীর জুম চাষে জমির সংকট দেখা দেবে বলে মনে হয়, তাহলে তিনি তাঁর মৌজায় নবাগতদের জুম চাষ নিষিদ্ধ করে দিতে পারেন।
(১০) জুম চাষের জন্য ক্ষতিকর প্রতীয়মান হলে হেডম্যান তাঁর মৌজায় গোচারণ নিষিদ্ধ করে দিতে পারেন।
(১১) জেলা প্রশাসকের আনুষ্ঠানিক বন্দোবস্তী ব্যতিরেকে পৌর এলাকা বহির্ভূত মেীজায় মৌজা হেডম্যান তাঁর মৌজার কোনো আদিবাসী বাসিন্দাকে বসতবাড়ি নির্মাণের জন্য সর্বোচ্চ ০.৩০ একর জমি ভোগ দখলে রাখার অনুমতি দিতে পারেন। তবে এসব বসতবাড়ীর দখলভুক্ত রাখার জন্য তাকে একটি রেজিষ্টার তৈরী করে রাখতে হবে।
(১২) সরকারী ভূমি বন্দোবস্ত, হস্তান্তর, ভাগ-বন্টন এবং সাবলেট প্রদানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মেীজা হেডম্যান সুপারিশ প্রদানের ক্ষমতা সংরক্ষণ করেন।
(১৩) হেডমান মৌজার জনগণের স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ এলাকার সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন।
কার্বারী এখা ও কার্বারী প্রশাসন
কার্বারী প্রশাসন পার্বত্য চট্টমের ঐতিহ্যবাহী প্রশাসনের সর্বশেষ স্তর। এটি এই প্রশাসনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্তর। মৌজা প্রধানের সহকারী হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ ও নিষ্পত্তি , গ্রামে বন ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, গ্রামের শান্তি-শৃংখলা, সামাজিক বিরোধ নিষ্পত্তি ও সামাজিক স্থিতিশীলতা, গ্রামের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, অবকাঠামো ইত্যাদির উন্নয়নে কার্বারী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
কার্বারীর ক্ষমতা ও কার্যাবলী বিষয়ে হিলট্রাক্টস ম্যানুয়েল বা পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনে বিস্তারিত কোন কিছু লেখা নেই। তবে এটি একটি প্রথাসিদ্ধ বিষয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী সমাজ জীবনে শত শত বছর ধরে এটি চলে আসছে। নিম্নে কার্বারীর ক্ষমতা ও কার্যবিলী বিষয়ে আলোকপাত করা হল-
১. কার্বারী গ্রামের সকল ধরণের মামলা (ফৌজদারী ও দেওয়ানী) নিষ্পত্তি করে থাকেন। জরিমানা আরোপের ক্ষেত্রেও কোন ধরণের সিলিং নির্ধারিত নয়। কার্বারী প্রয়োজন ও যুক্তি মাফিক দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের নিকট থেকে জরিমানা আদায় করে থাকেন।
২. কার্বারী গ্রমীন সমাজের সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষা ও সমাজের সকল প্রকার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন।
৩. গ্রামীন মানুষের জীবনে এমন কোন বিষয় বা কাজ নেই যেখানে কার্বারী সংশ্লিষ্ট নন।
৪. কার্বারী গ্রামভিত্তিক সামাজিক উৎসব পালন ও পূজা পার্বনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
৫. কার্বারী মৌজা প্রধানকে রাজস্ব অাদায়, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি ইত্যাদি কাজে সহায়তা করেন।
৬. কার্বারী মৌজা প্রধানকে জুম নিয়ন্ত্রণ, বন ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে সহযোগিতা প্রদান করে থাকেন।
অধিবাসীদের ভূমির অধিকার
পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমির উপর অধিকার বহুভাবে ভোগ করার বিধান রয়েছে। ভূমির উপর সমষ্টিগত মালিকানা আদিবাসীদের ভূমি ব্যবস্থাপনার এক গুরুত্বপূর্ণ দিক। যুগ সুগ ধরে এই প্রথাগত রীতির ভিত্তিতে আদিবাসীরা বন ও ভূমির সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা ও চাষাবাদ করে আসছে।
বৃটিশের অধীনে চলে যাবার আগে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্ত ভূমিই ছিলো সমষ্টিগত মালিকানাধীন। এই অঞ্চল ছিলো তখন শুধু বন আর বন আদিবাসীরা এই অঞ্চলে তখন মূলত: জুমচাষ করতো।
বৃটিশ আসার পর পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যক্তিগত মালিকানার সূত্রপাত ঘটে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমির অধিকারকে প্রধানত: দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
১. প্রথাগত অধিকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি (Hill Tracts Mannual)
২. চুক্তির আলোকে ভূমি অধিকার
প্রথাগত অধিকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি: পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের প্রথাগত অধিকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিকে আবার দু’ভাগে বিভক্ত করে আলোচনা করতে পারি। যথা-
ক. চিরাচরিত প্রথা
খ. পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি (Hill Tracts Mannual) ও অন্যান্য আইন
ক. চিরাচরিত প্রথা: পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীরা যুগ যুগ ধরে জুমচার করে আসছে। জুমভূমি আদিবাসীদের সমষ্টিগত মালিকানার উপর প্রতিষ্ঠিত। সমষ্টিগত মালিকানা হলেও এটি অত্যন্ত সুশৃংখলভাবে পরিচালিত হয়।
চিরাচরিতভাবে প্রতিষ্ঠিত এই পদ্ধতি এমন যে, এক জুমচাষী অপর জুমচাষীর জুমভূমি কখনোই দখল করে না। যে জুমচাষী কোন পাহাড়কে চাষ করবে সে জুমভূমি সেই প্রথম চাষীর জুমভূমি হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। তবে, পতিত অবস্থায় এই জুমভূমি থেকে গ্রামের নিবাসী সকলের লাকড়ি , কলা পাতা, গাছ, বাঁশ ও বনজ শাক-সবজি সংগ্রহের অধিকার রয়েছে।
তা’ছাড়া প্রথম চাষাবাদকারী ব্যক্তির অনুমতি নিয়ে গ্রামের যে কেউ উক্ত জুমভূমির উপর জুম চাষ করতে পারে। এভাবেই অধিবাসীরা জুমভূমির উপর তাদের সমষ্টিগত মালিকানা নিশ্চিত করে আসছে।
আদিবাসীদের চিরাচরিত প্রথা ‘সমষ্টিগত মালিকানা’ আইএলও কনভেনশন- ১০৭ এ স্বীকৃতি পেয়েছে। আইএলও কনভেনশন-১০৭ এর ১১ নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে যে, ‘সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর সদস্যদের ঐতিহ্যগত অধিকৃত ভূমির উপর যৌথ কিবা ব্যাক্তিগত মালিকানার অধিকার স্বীকার করতে হবে।’
বাংলাদেশ সরকার আইএলও কনভেনশন-১০৭ অনুসাক্ষর করেছে। সুতরাং সে অর্থে আদিবাসীদের এই চিরাচরিত প্রথাগত আইন দেশের একটি আইনে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধান প্রথাগত আইনকে স্বীকৃতি (পরোক্ষভাবে) প্রদান করে। সংবিধানের ১৪৯ ধারায় বলা হয়েছে যে- ‘এই সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে সকল প্রচলিত আইনের কার্যকারীতা অব্যাহত থাকিবে।’
১৫২ ধারায় ব্যাখ্যা অংশে বলা হয়েছে- ‘প্ৰচলিত আইন অর্থ এই সংবিধান প্রবর্তনের অব্যবহিত পূর্বে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানায় বা উহার অংশ বিশেষে আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন কিন্তু কার্যক্ষেত্রে থাকুক বা না থাকুক, এমন কোন আইন।’ বাংলাদেশ সংবিধানের এই ধারা ‘পার্বত্য চটগ্রাম শাসনবিধি’-কে প্রচলিত আইন হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।
খ. পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসনবিধি ও অন্যান্য আইনের আলোকে: বৃটিশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের প্রথাগত বিষয়সমূহ শাসনবিধিতে সম্পূর্ণরূপে স্বীকৃতি প্ৰদান ননগ করলেও আংশিক স্বীকৃতি প্রদান করেছে। বৃটিশ সরকার আদিবাসীদের প্রথাগত প্ৰতিষ্ঠানকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে এবং রাজা ও হেডম্যান- এর ক্ষমতা পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিবিতে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
বৃটিশ সরকং অধিবাসীদের সমষ্টিগত মালিকানা ব্যবস্থাকেও আংশিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে এবং মৌজা প্রধানের উপর মৌজার ভূমি ও সম্পদ ব্যবস্থাপনার ক্ষমতা অর্পন করেছে।
পূর্বে উল্লেখ করেছি, বৃটিশ সরকার ১৮৯২ সালে Rules for Administration of the Chittagong Hill Tracts, 1892’ জারী করে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে ৪টি সার্কেলে ভাগ করে।
বৃহত্তর সার্কেল ‘সংরক্ষিত বনাঞ্চল’ সরাসরি বৃটিশ সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত আর সার্কেল চীফগণের সার্কেলভূক্ত অঞ্চল ডেপুটি কমিশনারের নেতৃত্বাধীনে সরাসরি রাজা ও হেডম্যান কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বৃটিশ আমল থেকে বর্তমান অবধি তিন সার্কেলে অন্তর্ভুক্ত জমির ক্ষেত্রে রাজা-হেডম্যান তথা ঐতিহ্যবাহী প্ৰতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে আসছে।
বৃটিশ কর্তৃক প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির মধ্য দিয়ে পার্বত্য অদিবাসীরা কতগুলি অধিকার ভোগ করতো। এর অন্যতম দিকগুলো হলো-
১. বৃটিশ আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম ‘শাসন বহির্ভুত অঞ্চল’ ছিলো। এ বিধান পার্বত্য চটগ্রাম অঞ্চলকে একটি আদিবাসী অঞ্চল হিসেবে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপণ ভূমিকা পালন করেছে। তা’ছাড়া এ বিধান অনিবাসীদের অস্তিত্ব এবং তাদের সংস্কৃতি ও অর্থনীতি সুরক্ষারও রক্ষাকবচ ছিলো। পাকিস্তান আমলে এ বিধান বিলুপ্ত করার কারণে বিভিন্ন এলাকা থেকে পার্বত্য চটগ্রামে অভিবাসনের সযোগ সৃষ্টি হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে বহিরাগতদের অভিবাসন পাকিস্তান আমলে শুরু হলেও সবচেয়ে বেশী পরিমাণে অভিবাসন ঘটে ১৯৭৯-১৯৮৬ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে। এ সময় ৪ লক্ষাধিক সেটলার বাঙালিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে অভিবাসন ঘটানো হয়। এই অবিভাসনের মধ্য দিয়ে পার্বতা চট্টগ্রামের জনসমিতির বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তন ঘটানো হয়।
২. বৃটিশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিতে অধিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের আংশিক বিষয় স্বীকৃতি প্রদান করে। বৃটিশ সরকার ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতিস্বরপ রাজা-হেডম্যানকে পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির আওতাধীন করে তাঁদের উপর বেশ কিছু ক্ষমতা প্রদান করেছে, যা নিম্নরূপ:
ক. সার্কেলের আওতাধীন জমি বন্দোবস্তের ক্ষেত্রের মৌজা প্রধানের সুপারিশ ও মতামত গ্রহণের বিধান রাখা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আইন ও রীতি মোতাবেক মৌজা প্রধানের সুপারিশ ও মতামত ব্যতিত মৌজাধীন কোন জায়গা জমি বন্দোবস্ত হতে পারেনা। [৩৪ ধারা]।
খ. পার্বত্য চটগ্রামে জমি ও জুম খাজনা সংগ্রহ করবে প্ৰথাগত প্রতিষ্ঠান। [ধারা ৪২ ও ৪৩]
গ. পার্বত্য চট্টগ্রামে সামাজিক শৃংখলা রক্ষা ও সামাজিক বিচারি কার্যাদি সম্পাদন করবেন রাজা, হেডম্যান ও কার্বারী। পার্বত্য চট্রগ্রাম শাসনবিধির ৪০ ধারায় উল্লেখ রয়েছে- ‘মৌজা প্রধানগণ সংশ্লিষ্ট অধিবাসী কর্তৃক আনীত বিরোধীয় সকল বিষয়ের উপর বিচারপূর্বক সিদ্ধান্ত প্রদান করবেন। মৌজা প্রধানগণ সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয়ের প্রচলিত সামাজিক রীতি অনুসারে পার্বত্য ট্রাইবেলদের বিচার কার্য সম্পাদন করবেন। এ ধরণের বিচারে হেডম্যান সর্বোচ্চ ২৫ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবেন।
ঘ. ডেপুটি কমিশনার জেলার সার্বিক প্রশাসন পরিচালনা বিষয়ে রাজার পরামর্শ গ্রহণ করবেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিতে এই বিধান রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির ৩৮ ধারায় উল্লেখ রয়েছে যে, ‘সার্কেল চীফগণ ডেপুটি কমিশনারের উপদেষ্টা কাউন্সিল হিসেবে পরিগণিত হবেন এবং সংশ্লিষ্ট সার্কেলের প্রশাসন সংক্রান্ত সকল বিষয়ে তথ্য ও উপদেশ দিয়ে জেলা প্রশাসককে সহায়তা করবেন।
ঙ. প্রাকৃতিক ও বনজ সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব মৌজা প্রধানের। পার্বত্য চটগ্রাম শাসনবিধির ৪১ ধারায় এ বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। মৌজার সম্পদ সংরক্ষণের উদেশ্যে মৌজা প্রধান-
১. কোন নিবাসী গৃহস্থালী কাজে ব্যতিত অন্য কোন কাজে তাঁর মৌজা হতে বাঁশ, কাঠ বা অন্যান্য বনজ দ্রব্য অন্য কোন মৌজায় এবং অনিবাসী কোন ব্যক্তিকে যেই কোন কাজে, অনুরূপ কিছু অপসারণ নিষিদ্ধ করতে পারবেন।
২. মৌজাস্থ কোন এলাকা বা এলাকাসমূহে বাঁশ, কাঠ বা অন্যান্য বনজ দ্রব্য সংরক্ষণের ঐ এলাকা বা এলাকাসমূহকে জুমচাষের আওতামুক্ত করা হয়েছে মর্মে ঘোষণা প্রদান করতে পারবেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের গুরুত্বপূর্ণ প্রথাগত সম্পদ-অধিকার
প্রাকৃতিক সম্পদ | অধিকারভোগী | আইন/প্রথা | পরিচালনা কর্তৃপক্ষ |
জুমভূমি | আদিবাসী পরিবার | পার্বত্য চট্টগ্রাম বিধি ৫০ ধারা | হেডম্যান |
জুমভূমি | আদিবাসী পরিবার | পার্বত্য চট্টগ্রাম বিধি ৪১ ধারা | হেম্যান, জেলা প্রশাসক/পার্বত্য জেলা পরিষদ |
ব্যবহৃত জুমভূমি | আদিবাসী পরিবার | সনাতনী প্রথা | হেডম্যান |
বনজ দ্রব্য | মৌজায় বসবাসকারী | পার্বত্য চট্টগ্রাম বিধির ধারা ৪১ (এ) | হেডম্যান ও কার্বারী |
চারণ ভূমি | মৌজায় বসবাসকারী | পার্বত্য চট্টগ্রাম বিধির ৪৫ (বি) | হেডম্যান ও জেলা প্রশাসক/ পার্বত্য জেলা পরিষদ |
তৃণভূমি | মৌজায় বসবাসকারী | পার্বত্য চট্টগ্রাম বিধির ধারা ৪৫ | হেডম্যান ও জেলা প্রশাসক/ পার্বত্য জেলা পরিষদ |
বন্য প্রাণী | আদিবাসী জনগণ | সনাতনী প্রথা | হেডম্যান ও সার্কেল চীফ |
জলজ সম্পদ | মৌজায় বসবাসকারীরা | সনাতনী প্রথা | হেডম্যান |
বৃহৎ জলাধারসমূহ | মৌজায় বসবাসকারীরা | সনাতনী প্রথা | হেডম্যান |
ক্ষুদ্র জলাশয় | মৌজায় বসবাসকারীরা | সনাতনী প্রথা | হেডম্যান |
প্রাকৃতিক সম্পদসমূহ | মৌজায় বসবাসকারীরা/সরকার | জেলা প্রশাসকের তাৎক্ষণিক নির্দেশ, পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন (সংশোধিত) ১৯৯৮ | হেডম্যান ও জেলা প্রশাসক/ পার্বত্য জেলা পরিষদ |
উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিতে আদিবাসীদের অনেকগুলো প্রথাগত অধিকার স্বীকার করে নিলেও বৃটিশ সরকারের প্রতিনিধি ডিপুটি কমিশনারের নিকট অনেক ক্ষমতা সংরক্ষণ করেন।
মৌজা প্রধান নিয়োগ, ভূমি বন্দোবস্ত ও লীজ প্রদানের চূড়ান্ত ক্ষমতা ডেপুটি কমিশনারের হাতে রেখে দেওয়া হয়। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে চট্টগ্রামে পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদ গঠনের মধ্য দিয়ে এ ক্ষমতা পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তরের বিধান করা হয়।
অবাঞ্চিতদের বিতাড়ন করার অধিকার: অত্র জেলার বাসিন্দা নন এমন কোন ব্যক্তির দ্বারা জেলার সুশাসন ও শান্তির জন্য হুমকি সৃষ্টির আশংকা আছে বলে প্রতীয়মান হলে কারণ উল্লেখ পূর্বক ডেপুটি কমিশনার ঐ ব্যক্তিকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জেলা ত্যাগ করার জন্য এবং জেলার বাইরে থাকলে অত্র জেলায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করার জন্য আদেশ জারী করতে পারেন। [ধারা-৫১]
আই এল ও কনভেনশন-১০৭
১. আদিবাসীদের চিরাচরিত প্রথা ‘সমষ্টিগত মালিকানা’ আইএলও কনভেনশন-১০৭ ও ১৬৯ এ স্বীকৃতি পেয়েছে।
২. বাংলাদেশ সরকার আইএলও কনভেনশন-১০৭ এ অনুস্বাক্ষর করেছে। সুতরাং সে অর্থে আদিবাসীদের এই চিরাচরিত প্রথাগত আইন দেশের একটি আইনে পরিণত হয়েছে।
৩. বাংলাদেশের সংবিধান ও প্রথাগত আইনকে স্বীকৃতি (পরোক্ষভাবে) প্রদান করে।
ক. সংবিধানের ১৪৯ ধারায় বলা হয়েছে যে-
‘এই সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে সকল প্রচলিত আইনের কার্যকারীতা অব্যাহত থাকিবে।’
খ. ১৫২ ধারায় ব্যাখা অংশে বলা হয়েছে-
‘প্রচলিত আইন অর্থ এই সংবিধান প্রবর্তনের অব্যবহিত পূর্বে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানায় বা উহার অংশ বিশেষে আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন কিন্তু কার্যক্ষেত্রে থাকুক বা না থাকুক, এমন কোন আইন।’
পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমির মালিকানার ধরণ
১. প্রথাগত মালিকানা
২. অপ্রথাগত মালিকানা
১. প্রথাগত মালিকানা
বৃটিশ আগমনের আগে পার্বত্য চট্টগ্রামের জমি ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণরূপে প্রথাগত নীতি পদ্ধতির ভিত্তিতে পরিচালিত হতো। একসময় পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ীরা সবাই জুমচাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতো। জুমভূমির উপর ব্যক্তির এক ধরণের অলিখিত মালিকানা থাকলেও এই জুমভূমির উপর গ্রামবাসীর সমষ্টিগত অধিকার ছিলো।
জুমভূমির প্রথাগত মালিকানা পদ্ধতি হলো- যে ব্যক্তি প্রথমবার কোন পাহাড়ে জুমচাষ করবে সে পাহাড় বা জুমভূমির মালিক হবে প্রথম চাষাবাদকারী ব্যক্তি। এই জুমভূমি কেউ যদি চাষ করতে চায় তা’হলে জুমভূমির মালিকের (প্রথম চাষী) অনুমতি নিয়ে চাষাবাদ করতে হবে। মালিকানার জন্য কোন কাগজ পত্রের প্রয়োজন হয় না।
প্রথা পদ্ধতি ও মূল্যবোধ এরকমই যে, কোন জুমভূমি মালিকের অনুমতি ব্যতিত অন্য কেউ সেখানে চাষ করে না। তবে জুমভূমির তরিতরকারী, বাঁশ বা লাকড়ি সংগ্রহের ক্ষেত্রে গ্রামবাসীর সকলের অধিকার রয়েছে।
ক্রমিক নং | ভূমির ধরণ | মালিকানার ধরণ | ব্যবহার |
১ | জুমভূমি | সমষ্টিগত মালিকানা | জুমচাষের জন্য |
২ | মৌজা রিজার্ভ | সমষ্টিগত মালিকানা | বন সংরক্ষণ ও গাছ বাঁশের জন্য |
৩ | গো চারণভূমি | সমষ্টিগত মালিকানা | গরু মহিষ চারণের জন্য |
৪ | গ্রাম | সমষ্টিগত মালিকানা | গৃহ নির্মাণ ও বসবাসের জন্য |
৫ | শশ্মান/কবর | সমষ্টিগত মালিকানা | মৃতদেহ সৎকারের জন্য |
২. অপ্রথাগত মালিকানা
সারাদেশে রাষ্ট্রীয় আইনের আলোকে যেভাবে ভূমির মালিকানা পায়, অনুরূপ আইনও পার্বত্য চটগ্রামে প্রচলিত।এই মালিকানা তিন ধরণের হয়ে থাকে। যেমন-
ক. ব্যক্তির নামে মালিকানা: সারা বাংলাদেশে ব্যক্তির নামে যেরূপ ভূমির মালিকানা রয়েছে, অনুরূপভাবে ব্যাক্তর নামে ভূমির মালিকানা পার্বত্য চট্টগ্রামেও রয়েছে। অনেকেই মনে করেন পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যক্তির নামে কোন জায়গা জমির বন্দোবস্তী নেই।
এরা মনে করেন পার্বত্য চটগ্রামের সকল ভূমি সমষ্টিগত মালিকানার অধীন। আসলে তা সঠিক নয়। পার্বত্য চটগ্রামে মাত্র কয়েক ধরণের জমিই সমষ্টিগত মালিকানাধীন। এগুলি হল- ১. জুমভূমি, ২. গো চারণভূমি ও ৩. মৌজা রিজার্ভ বা কালিত্র, ৪. গ্রামভূমি, ৫. শশ্মান ইত্যাদি।
পার্বত্য চটগ্রামে মূলত: হালচাষের জমিগুলি বন্দোবস্তীকৃত ও ব্যক্তি মালিকানাধীন। তবে পাহাড় সমতল ও বেশ কিছু উঁচু-নীচু বন্দোবস্তীকৃত ও ব্যক্তি মালিকানাধীন রয়েছে। কোন কোন ব্যক্তির নামে ২৫ একর বা ততোধিক পাহাড় জমি ৯৯ বছরের জন্য লীজও রয়েছে।
খ. বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের নামে মালিকানা: পার্বত্য চট্টগ্রামের বহু জমি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে লীজ, বন্দোবস্তী আছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সেবামূলক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, এনজিওসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে লীজ ও বন্দোবস্তী রয়েছে।
গ. রাষ্ট্রীয় বা সরকারী প্রতিষ্ঠানের নামে মালিকানা: পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারী বহু প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেসব প্রতিষ্ঠানের নামে জমি বন্দোবস্তী রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন সরকারী অফিস যেমন জেলা প্রশাসন কাৰ্যালয়, উপজেলা প্রশাসন কাৰ্যালয়, জেলখানা, শিক্ষা অফিস, কৃষি অফিস ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের নামে বন্দোবস্তী রয়েছে।
এসব প্রতিষ্ঠান সরকারী হলেও সরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষকে জমির খাজনা প্রদান করতে হয় স্থানীয় হেডম্যানকে।
লেখকঃ শক্তিপদ ত্রিপুরা।
============================================================
পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ ও নিষ্পত্তি নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভূমি সংক্রান্ত কতিপয় বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে একটি কমিশন গঠন ও আনুষঙ্গিক বিষয়ে বিধান প্রণয়নকল্পে প্রণীত আইন -পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি-বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন।
আরও পড়ুন- পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি-বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।