পাংখোয়া জনগোষ্ঠী বিবাহ বিচ্ছেদ (ইনসেন)

Jumjournal
Last updated Dec 15th, 2019

930

featured image

পাংখোয়া বিবাহ বিচ্ছেদ

 পাংখোয়া পরিবারের স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে নানা কারণে সামাজিকভাবে বিবাহ বিচ্ছেদ (ইনসেন) হতে পারে।

ইনসেন: পাংখোয়া পরিবারে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ (ইনসেন) হতে পারে।

 

পৃথকভাবে বসবাসের বিভিন্ন পদ্ধতি: স্বামী কিংবা স্ত্রী যে কোনো একজনের মৃত্যুতে পাংখোয়াদের সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত একটি দাম্পত্য জীবন তথা বিবাহিত জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। তবে বিবাহ বিচ্ছেদ সামাজিকভাবে অনুমোদিত না হলেও সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমেও পাংখোয়া স্বামী ও স্ত্রী তাদের জীবদ্দশায় বিবাহ বিচ্ছেদ (ইনসেন) করতে পারে অধিকন্তু নিম্নোক্ত কারণে তাদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ (ইনসেন) হয়ঃ-

ক) স্বামী-স্ত্রী পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে সমাজপতি তথা কার্বারী/হেডম্যান আদালতে গিয়ে ‘নিপারেল’ ও ‘নুনারেল’ এ দু’জনের উপস্থিতিতে আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে ‘ইনসেন’ (বিবাহ বিচ্ছেদ) করতে পারে।

খ) স্বামী-স্ত্রী একে অপরের বিরুদ্ধে কার্বারী বা হেডম্যান আদালতে অভিযোগ উত্থাপন করে দাম্পত্য কলহের সমাধানে পৌঁছুতে ব্যর্থ হলে সমাজসিদ্ধ নিয়মে স্বামী ও স্ত্রী পরস্পর থেকে পৃথক হওয়ার জন্য বিবাহ বিচ্ছেদ (ইনসেন) করতে পারে। স্ত্রী যদি স্বেচ্ছায় পৃথকভাবে বসবাস করে সেক্ষেত্রে ‘মান’-এর অর্থ স্বামীকে ফেরত প্রদান করতে হয় । আর স্বামী যদি স্বেচ্ছায় পৃথকভাবে বসবাস করে, তাহলে স্বামীর ভরনপোষণ থেকে স্ত্রী বঞ্চিত হয়।

ব্যতিক্রম: আধুনিক পাংখোয়া সমাজে স্বামী-স্ত্রীর বিবাহ বিচ্ছেদ হলেও কেবলমাত্র স্বামী কর্তৃক বিবাহ বিচ্ছেদকে তাদের আধুনিক সমাজ ব্যবস্থা অনুমোদন করে। কিন্তু স্ত্রী কর্তৃক বিবাহ বিচ্ছেদ দেয়াটা সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়।

 

কোন কোন ক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রীইনসেনকরার অধিকার রাখে: নিম্নোক্ত কারণে পাংখোয়া সমাজে স্বামী বা স্ত্রী পরস্পর থেকে ‘ইনসেন’ করার অধিকার রাখেঃ-

ক) স্বামী যদি দৈহিক মিলনে অক্ষম বা পুরুষত্বহীন হয় কিংবা স্ত্রী গর্ভধারণে অক্ষম হয়, সেক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন যথোপযুক্ত ডাক্তারী পরীক্ষার সনদ পত্র দ্বারা ‘ইনসেন’ (বিবাহ বিচ্ছেদ) দাবী করতে পারবে।

খ) স্বামী বা স্ত্রী যদি পরকীয়া প্রেম কিংবা ব্যভিচারে বা নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে লিপ্ত হয় এবং এ ধরণের অপরাধের জন্য যে কোনো একজন সামাজিক আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয় তাহলে সামাজিক আদালতে জরিমানা স্বরূপ দোষীকে একটি ‘৪ মুঠি’ শূকর দিতে হয়। সেক্ষেত্রে অপরজন ‘ইনসেন’ দাবী করতে পারে।

গ) স্ত্রীর সম্মতি বা অনুমতি ব্যতিরেকে স্বামী দ্বিতীয়বার বিবাহ করলে সেক্ষেত্রে সতীনের সাথে একত্রে বসবাসে অসম্মত হয়ে প্রথমা স্ত্রী ‘ইনসেন’ দাবী করতে পারে।

ঘ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন যদি মানসিক বিকারগ্রস্ত অথবা বিকৃত রুচির হয়, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘ইনসেন’ দাবী করতে পারে।

ঙ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একপক্ষ যদি নিষ্ঠুর প্রকৃতির, অহেতুক সন্দেহপ্রবণ, মাদকাসক্ত, অকর্মণ্য এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনকারী হয়, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘ইনসেন’ দাবা করতে পারে।

চ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোন একপক্ষ যদি অবিশ্বস্ত বা অবাধ্য হয়, পারিবারিক দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রতিপালনে অনিচ্ছুক বা উদাসীন হয়, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘ইনসেন’ দাবী করতে পারে।

 

স্বামী হতে পৃথকভাবে বসবাসের আইনগত ফলাফল

ক) সমাজ স্বীকৃত পদ্ধতিতে সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রী ‘ইনসেন’ করে উভয়ে পৃথক হয়ে গেলে পরবর্তীতে অন্য কারো সাথে পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে (সূত্র : রোসম পাংখুয়া)।

খ) ইনসেন-প্রাপ্ত স্বামী ও স্ত্রীর পরস্পরের সম্মতিতে দৈহিক মিলন বৈধ হয়। এরূপ দৈহিক মিলনজাত সন্তান বৈধ সন্তান হিসেবে গণ্য হয়।

গ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো পক্ষকে ‘ইনসেন’-এর পর পারস্পরিক পূনঃ সমঝোতা ও আস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে ‘ইনকাই’ ও ‘মান’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দাম্পত্য জীবনে ফিরে আসার জন্য সামাজিক স্বীকৃতি নিতে হয়।

ঘ) ইনসেন-প্রাপ্ত স্বামী ও স্ত্রী পারস্পরিক কর্তৃত্ব হারায়।

ঙ) ইনসেন-প্রাপ্ত স্ত্রী তার স্বামীর পদবী ও মর্যাদা হারায়।

চ) ইনসেন-প্রাপ্ত স্বামীর ভরনপোষণ হতে স্ত্রী বঞ্চিত হয়। স্বামী সরকারী চাকুরীজীবি হলে তার মৃত্যুর পর ইনসেন-প্রাপ্ত স্ত্রী তার স্বামীর পেনশন সুবিধা হতে বঞ্চিত হয়।

ছ) স্ত্রী স্বেচ্ছায় ‘ইনসেন’ এর জন্য সামাজিক আদালতে দাৰী জানালে সেক্ষেত্রে স্বামী তার স্ত্রীর নিকট ‘মান’ বাদ দেয়া অর্থ ফেরত পায়। সামাজিক আদালতে পক্ষগণের দায়দায়িত্ব নির্ধারণ সাপেক্ষে পরস্পরের দেনা-পাওনা পরিশোধ করতে হয়।

রেফারেন্স: পাংখোয়া দম্পতি লাইকিম ও স্ত্রী বেলাই উভয়ের ইনমান এর কারণে স্ত্রী বেলাই’কে তার পণ বাবদ পাওয়া গয়াল ও মঙ/গং স্বামী লাইকিম’কে ফেরত প্রদান করতে হয়েছিল। দুমদুম্যার বাসিন্দা লাইকিম তার সামাজিক প্রথা অনুসারে জুরাছড়ির মৈদং মৌজার বেলাই’কে বিয়ে করার এক বছর পর বাপের বাড়ীতে বেড়াতে গিয়ে স্ত্রী বেলাই বেশ কিছুদিন সেখানে থেকে যায়। এ সময় শাশুড়ির নিকট হতে বেলাই খবর পায় যে, তার স্বামী তাকে ত্যাগ করেছে।

এ খবর পাবার কিছুদিন পর বেলাইকে তার শ্বশুর বাড়ীর লোকজন পুনরায় আনতে গেলে সে আর শ্বশুর বাড়ী ফিরে যায়নি। এ ঘটনার নিষ্পত্তির জন্য বসন্ত মৌজার হেডম্যান লালচিং কিম এর সামাজিক আদালতে বিচার হয়। কিন্তু হেডম্যান আদালতে সুষ্ঠু সিদ্ধান্ত না হওয়াতে বিষয়টি রাজার আদালতে উথাপিত হয়। রাজ আদালতে কন্যা পক্ষকে ১টি গয়াল, ১টি মঙ/গং ও নগদ দুইশত টাকা পাত্রপক্ষের কাছে ফেরত প্রদানের নির্দেশ দেয়া হয়।

(সূত্রঃরাম কুপ লাল কার্বারী, পাংখোয়া পাড়া, বিলাইছড়ি, রাঙ্গামাটি)

 

ইনসেন স্ত্রীর গর্ভবতী অবস্থা

ক) ইনসেন স্ত্রী যদি গর্ভবতী অবস্থায় থাকলে অনাগত সন্তানের দায়-দায়িত্ব থাকে এবং ধাত্রী বিদ্যামতে যদি প্রমাণিত হয় যে, ইনসেন হওযায় পূর্বে স্ত্রী গর্ভবতী ছিল, সেক্ষেত্রে ভিন্ন কিছু নিশ্চিত প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত স্বামীকে উক্ত সন্তানের পিতৃত্বের স্বীকৃতি ও অধিকার পাংখোয়া সামাজিক প্রথা অনুসারে দিতে হয়।

উক্ত সন্তান অবৈধ বা জারজ বলে গণ্য হয় না। উক্ত সন্তান তার পিতার নিকট হতে ভরনপোষণ পায় এবং আইনগত উত্তরাধিকারী হয়। স্ত্রী সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে স্বামীর নিকট হতে ভূমিষ্ট সন্তানের তিন বছর পর্যন্ত ভরনপোষণ এবং সন্তান প্রসবের যাবতীয় খরচ পায়। তিন বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত উক্ত সন্তানকে স্ত্রীর হেফাজতে রাখার অধিকার থাকে।

খ) ‘ইনসেন’ হওয়ার তারিখ হতে পরবর্তী ২৮০ দিন পর স্ত্রীর গর্ভে যদি কোনো সন্তান জন্মগ্রহণ করে, সেক্ষেত্রে ভিন্ন কিছু নিশ্চিত প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত উক্ত সন্তান অবৈধ বা জারজ বলে গণ্য হয় এবং স্বামী উক্ত সন্তানের পিতৃত্ব গ্রহণে বাধ্য থাকে না।

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা