প্রথাগত আইনে আদিবাসী ত্রিপুরা নারীর অবস্থান
1399
বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির অধিকারী ত্রিপুরা জাতি পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী তৃতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ আদিবাসী জনগোষ্ঠী। তিন পার্বত্য জেলা বা তিন সার্কেলে আদিবাসী বসবাস করলেও তাদের বেশির ভাগ অংশ খাগড়াছড়ি জেলা তথা মং সার্কেলে বাস করে।
তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যতীত সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফরিদপুর, বরিশাল ও চট্টগ্রাম জেলায়ও কিছু কিছু ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর লোক বসবাস করে। ত্রিপুরা মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীভুক্ত টিবেটো বর্মণ শাখার বোড়ো শ্রেণিভুক্ত ভাষার একটি নয়, ত্রিপুরারা মোট ৩৬টি গোত্র, দল বা দফায় বিভক্ত।
প্রত্যেক গোত্রে ভাষার ৪/৫টি উপগত বা দল রয়েছে। এই ৩৬টি গোত্রের মধ্যে বাংলাদেশে ১৬টি গোত্র বসবাস করে।
আদিবাসী ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী মূলত সনাতন ধর্মের অনুসারী। বর্তমানে তাদের একটি বড় অংশ খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী।
তবে প্রকৃতি পূজারী হিসেবে ত্রিপুরা সমাজে পশুবলি প্রথারও প্রচলন আছে, যদিও খ্রিষ্টধর্ম ও বৈঞ্চব মতাবলম্বীরা এ প্রথা অনুসরণ করে না।
ত্রিপুরারা অপদেবতা ও ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করে। তাদের প্রধান অপদেবতা বুরাসা, যার পরিবারভুক্ত ১৯টি অপদেবতা আছে।
এই অপদেবতা মানুষের ক্ষতির কারণ বলে ত্রিপুরা আদিবাসীরা বিশ্বাস করে। তাই ত্রিপুরাদের জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ ইত্যাদি মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে বুরাসার প্রথম ও দ্বিতীয় পুত্র করায়া ও গরায়ার পূজা করা হয়।
এছাড়া রোগ-ব্যাধি, বিপদ-আপদ ও অমঙ্গল থেকে রক্ষা পেতে অপদেবতাদের পূজা করা হয়। ত্রিপুরাদের নিজ তান্ত্রিকাচারে অনুষ্ঠিত পূজায় মন্ত্রতন্ত্র ও পদ্ধতির সাথে হিন্দু পুরোহিতদের পূজার রীতি বা পদ্ধতির মিল নেই।
ত্রিপুরা সমাজে ধর্মীয় নানা অবস্থানের কারণে সৃষ্ট বৈচিত্র্যপূর্ণ ধর্মীয় ভাবধারা, সাময়িক রীতিনীতি, প্রথা, আচার-অনুষ্ঠান, পূজা-প্রার্থনা ও মূল্যবোধকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দিয়েছে ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে।
ত্রিপুরা সংস্কৃতি ও নৃত্যগীতে এই দেবতা অপদেবতার পূজা-পার্বণের ব্যাপক প্রভাব দেখা যায়। ত্রিপুরাদের প্রখ্যাত গরায়া নৃত্য, হোভাগরি নৃত্য, ঢোল নৃত্য ইত্যাদি দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত পূজা-পার্বণ উপলক্ষে সৃষ্ট।
ত্রিপুরা সমাজের বিভিন্ন গোত্র, উপগোত্র ও দফা ভেদে রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে কিছু কিছু ব্যতিক্রম ও তারতম্য লক্ষ করা যায়।
তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মধ্যে প্রচলিত ৩ সর্বজনীন কিছু গ্রহণযোগ্য প্রথা ও রীতিনীতি অনুসরণের বাধ্যবাধকতা সমাজে রয়েহে ত্রিপুরাদের প্রত্যেকটি দফায় আলাদা ধরনের ভাষার বাকরীতি, পরিচ্ছদ, অলংকার, ইত্যাদি রয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে দক্ষিণাংশে বসবাসরত চিথোত, উসুই গোত্রের ত্রিপুরা না প্রচুর পরিমাণে পুঁতির মালা পরিধান করেন।
তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য আদিবাসী নারীদের মতো ত্রিপুরা নারীদের মধ্যেও প্রচুর পরিমাণে নান্দনিক ডিজাইনের ফল অলংকার ব্যবহারের ঐতিহ্য আছে। জুমচাষ ত্রিপুরাদের আদি এবং প্রধান পেশা।
অপেক্ষাকৃত উঁচু পাহাড়ে তাদের গ্রামগুলো নির্মাণ করে বলে এগুলো সাধারণত না থেকে দূরে থাকে। পানি তোলা থেকে শুরু করে সমস্ত গহস্থালি কাজের প্রথম থাকে ত্রিপুরা নারীদের ওপর। তাছাড়া নারীরা জুমে, জমিতে উদয়াস্ত পুরুষের পাশাপাশি পরিশ্রম করে থাকেন।
কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ত্রিপুরা নারীরা উত্তরাধিকার প্রথাসহ অনেক ক্ষেত্রে অন্যান্য আদিবাসী নারীদের মতো পুরুষের সমান অধিকার ভোগ করে না।
বিয়ে
ত্রিপুরা জাতির এক জোড়া নর-নারীর বিয়েকে একটি পবিত্র বন্ধন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ত্রিপুরা সমাজে বিয়ে একটি সামাজিক অনুষ্ঠান, যা ‘কাইজালাইমা’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজে বৈধতা লাভ করে।
আনুষ্ঠানিক বিয়ে বা সমাজবীকৃত বিয়ের ক্ষেত্রে নিজ নিজ ধর্মীয় রীতি অনুসরণ এবং ‘কাইজালাইমং’ অনুষ্ঠান করা বাধ্যতামূলক। খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী উসুই ও রিয়াং গোত্রের ত্রিপুরার আদি বিয়েপ্রথার পাশাপাশি খ্রিষ্ট ধর্মীয় রীতিনীতি মোতাবেক বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে।
ত্রিপুরা সমাজে গোত্রগত বা আন্তঃগোত্র বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে কোনো বিধিনিষেধ নেই। তবে বিয়ের ক্ষেত্রে কিছু নিষিদ্ধ সম্পর্ক চিহ্নিত করা আছে।
বিয়ের ক্ষেত্রে যে সকল সম্পর্ককে নিষিদ্ধ বলে ধরা হয়, সেগুলো হলো একই গোত্রের মধ্যে রক্তসম্পৰ্কীয় তিন পুরুষের সদস্য, চাচাত/কাকাত ভাই-বোন, রক্তসম্পর্কীয় মাসি ও ভগনি, পিসি ও ভাইপো, কাকা-ভাইঝি, ছোট ভাইয়ের বউ ও ভাসুর, ছোট-বোনের স্বামী ও বড়ো বোন, বিমাতা ও একই পিতার ঔরশে ভিন্ন মাতার গর্ভজাত ছেলে-মেয়ে, ভ্রাতুস্পুত্র স্ত্রী ও ভাগিনার স্ত্রী এবং কাকি বা মাসি সম্পর্কীয় আত্মীয়।
ত্রিপুরা সমাজে প্রধানত দুই ধরনের বিয়ের প্রচলন রয়েছে। যেমন; ১. সামাজিক নিয়মিত বিয়ে ও ২. পলায়ন/অনিয়মিত বিয়ে।
সামাজিক/নিয়মিত বিয়ে: কোনো ত্রিপুরা পাত্র-পাত্রী বিবাহযোগ্য হলে নিকটাত্মীয় বা জাসুক (ঘটক)-এর মাধ্যমে পাত্রীর অভিভাবকের কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো হয়।
পাত্রপক্ষের প্রস্তাব, পাত্রীপক্ষের সম্মতি, কাথারক পূজা ও কাইজালাইমুং অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সামাজিক রীতিনীতি ও প্রথা অনুসারে সামাজিক বা নিয়মিত বিয়ে সম্পন্ন হয়।
প্রথমে একজন অচাই (ওঝা) দ্বারা কাথারক পূজা দিয়ে বিয়ের শুভ্যশুভ নির্ণয় করে পাত্রীর অভিভাবকের কাছে ২/৩ বোতল মদসহ প্রস্তাব নিয়ে যেতে হয়।
এতে পাত্রীপক্ষ সম্মতি জানালে দ্বিতীয়বার পাত্রীর বাড়ি গিয়ে কনেপণ বা দাফার পরিমাণ ও কনের মায়ের দুধের দাম পরিশোধসহ বিয়ের কথাবার্তা পাকাপাকি হয়।
বিয়ের দিন দ্বিতীয় দফা কাথারক পূজা দিয়ে বরযাত্রী কনেবাড়ি যাত্রা করে। কনেবাড়িতে পৌঁছালে বিয়ের নানা অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বোতল নৃত্য-গীত পরিবেশন করা হয়।
ওই বোতলনৃত্য বর ও কনেপক্ষের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়। যে পক্ষের মাথা থেকে আগে বোতল পড়ে, তারা হার মেনে নেয়। এরপর কনেকে বরের বাড়ি এনে বিয়ের আসরে কনেকে বরের বাম পাশে বসিয়ে উভয়কে নতুন চাদর দিয়ে জড়ানো হয়।
এসময় বরের পাশে দুজন বারো বছরের বালক ও কনের পাশে দুজন দশ বছরের বালিকা থাকে। এ দুজন বর ও কনের সহচর। এজন্য বালক-বালিকার পিতা-মাতার সপত্নীক ও সধবা হওয়া আবশ্যক।
বিবাহ পরিচালনাকারী অচাই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি ও মুরব্বিদের উপস্থিতিতে চন্দ্র-সূর্য, নক্ষত্র ও বসুমতিকে সাক্ষী রেখে বর-কনেকে জড়ানো চাদরের দুই প্রান্তে বেঁধে (জোড়াবন্ধন) বিবাহ সম্পন্ন করেন।
এভাবে রীতি অনুযায়ী কাইজালাইমুংসহ অন্যান্য অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করার পর ত্রিপুরা বরকনের বিয়ে সমাজে বৈধতা লাভ করে।
উসুই ত্রিপুরাদের সামাজিক বিয়ের ক্ষেত্রে ৬টি ধাপে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয়। পারিবারিক পূজা ‘চুমলীখাইম’ সম্পন্ন করার সময় বরকে সুগন্ধি দ্রব্য মাখিয়ে ৫ হাত দীর্ঘ সাদা পাগড়ি, ৭ হাত দীর্ঘ গায়ের চাদর ও একটি তলোয়ার দিয়ে সাজানো হয়।
বরযাত্রীর সংখ্যা বিজোড় হতে হয়। বরযাত্রীদের সঙ্গে বাঁশের তৈরি দাঁত মাজার ব্রাশ, সিঁদল, শুটকি, লাল রিনাই, বিসা কচাও ও ১২ থেকে ১৪ বোতল মদ প্রভৃতি সামগ্রী নিয়ে যেতে হয়।
তবে বর্তমানে খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী উসুইরা এসব রীতি তেমন পালন করে না।
পলায়ন/অনিয়মিত বিয়ে: পিতা-মাতা বা অভিভাবকের সম্মতি ছাড়া যুবক-যুবতি প্রণয়াসক্ত হয়ে ঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে পরস্পরকে স্বামী-স্ত্রীরূপে গ্রহণ করলে তাকে ত্রিপুরা সমাজে পলায়ন/অনিয়মিত বিয়ে বলে।
এরূপ বিয়ের ক্ষেত্রে তৃতীয় ব্যক্তি বা বন্ধুকে অচাই হিসেবে সাক্ষী রেখে বিয়ে করতে হয়। তবে এ সময় পাত্র-পাত্রীর যৌনমিলন নিষিদ্ধ।
৩/৪ দিনের মধ্যে উভয়ের পিতামাতাকে জানানো হয়। যুবক-যুবতী নিষিদ্ধ সম্পর্কভুক্ত না-হলে এবং বরের পিতা সম্মত হলে কনের পিতার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো হয়। প্রস্তাবে কনের পিতা সম্মত হলে কনের বাড়িতে কাইজালাইমুং অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে বিয়ে সমাজসিদ্ধ করা হয়।
যদি পিতা-মাতা বিয়েতে মত না-দেন, তাহলে পলাতক যুবক-যুবতীকে সামাজিক বিচারের সম্মুখীন হতে হয়।
বিচারে পাত্র-পাত্রীর বক্তব্য, বিয়েতে অচাই হিসেবে তৃতীয় ব্যক্তির সাক্ষ্য ও অন্যান্য প্রচলিত রীতিগুলো পূরণ হয়েছে বলে প্রমাণিত হলে এবং পাত্র-পাত্রী বিয়ের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ সম্পর্কের আওতামুক্ত হলে সামাজিকভাবে বিয়ের সম্মতি দেয়া হয়।
সেক্ষেত্রে কনের বাবা কনেপণ দাবি করতে পারেন। দাবি অনুসারে কনেপণ দিতে নাপারলে পাত্রকে শশুরবাড়িতে ঘরজামাই হিসেবে থেকে কায়িক শ্রমের বিনিময়ে শ্বশুরের কনপণ শোধ করার নজির আছে।
পাত্র-পাত্রী অবৈধ বা নিষিদ্ধ সম্পর্কের আওতাভুক্ত হলে গোপন বিয়েকে স্বীকৃতি দেয়া হয় না, বরং সমাজচ্যুত করা হয়। উক্ত দুই প্রকারের বিবাহরীতি ছাড়াও ত্রিপুরা সমাজে ঘরজামাই তুলে বিয়ের রীতি সামাজিকভাবে স্বীকৃত।
তবে এ ধরনের বিয়ে অনাড়ম্বর হয় এবং পাত্রের কাছে কোনো কনেপণ দাবি করা হয় না। পাত্রীর বাড়িতে ঘরজামাই হিসেবে ওঠার পর সামাজিক নিয়মে বিয়ে সম্পন্ন হয়। সাধারণত পুত্রসন্তানের অভাব, সংসারের কাজকর্মের প্রয়োজনে ঘরজামাই তোলা হয়।
ত্রিপুরা সমাজে বিধবার বিয়ে করায় কোনো বাধা নেই। বিপত্নীক যেমন পুনরায় বিয়ে করতে পারেন, তেমনি বিধবাদের ক্ষেত্রেও পুনরায় বিয়ে সমাজসিক্ত।
ত্রিপুরা সমাজে পুরুষের মধ্যে বহুবিবাহ এবং মিশ্র বিয়েরও প্রচলন দেখা যায়। তবে খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী ত্রিপুরাদের মধ্যে বহুবিবাহ সমাজা অনুমোদিত নয়।
বহুবিবাহ: ত্রিপুরা সামাজিকপ্রথা অনুযায়ী একজন ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর পুরুষ স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থায়ও একাধিক বিয়ে করার অধিকারী হন।
ত্রিপুরা নারী স্বামী বর্তমান পাকা অবস্থায় একাধিক বিয়ে করার অধিকারী নন; তবে স্বামী-স্ত্রীর বিবাহবিচ্ছেদের পর স্ত্রী পুনরায় বিয়ে করার অধিকারী হন।
মিশ্র বিয়ে: ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর কোনো যুবতী মনোমালিন্য বা সম্মতিতে ত্রিপুরা ব্যতীত অন্যান্য জনগোষ্ঠীর আদিবাসী পুরুষের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলে, কনে যে সম্প্রদায় থেকে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর সমাজব্যবস্থায় পর্দাপণ করেছেন, সেই পিতৃকুলের ধর্ম, গোত্র ও পারিবারিক মর্যাদার অধিকার হারান এবং স্বামীর ধর্মীয় বিশ্বাস, গোত্র ও পারিবারিক মর্যাদায় অধিকারী হন।
ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর কোনো পুরুষ মনোমালিন্য বা সম্মতিতে ধর্মান্তর ব্যতীত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কোনো নারীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলে পিতৃকুলের ধর্ম, গোত্র ও পারিবারিক ধর্মীয় বিশ্বাসের অধিকার থেকে পুরুষকে বঞ্চিত হতে হয় না।
বিবাহবিচ্ছেদ: সামাজিক আদালতে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণিত হলে স্ত্রীর চরিত্র সংশোধনের জন্য ১৫ দিন অন্তর তিনবার সুযোগ প্রদান করা হয়ে থাকে। তিনবার সুযোগ প্রদানের পরও স্ত্রী চরিত্র সংশোধনে ব্যর্থ হলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদের অনুমতি দেওয়া হয়।
সামাজিক আদালতে স্ত্রীর চরিত্রহীনতার প্রমাণ পাওয়া গেলে এক বস্ত্রে স্ত্রীকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে হয়। সামাজিক আদালতে স্ত্রী কর্তৃক স্বামীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণিত হলে স্ত্রী বিবাহবিচ্ছেদের অনুমতি পান।
তবে কতিপয় নির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপন করে স্ত্রী বিবাহবিচ্ছেদের জন্য সামাজিক আদালতে দাবি করতে পারেন। এগুলো হলো:-
- স্বামী যৌনমিলনে অক্ষম;
- পুরুষত্বহীন;
- স্বামী পরকীয়া বা ব্যভিচারে লিপ্ত;
- স্বামী দীর্ঘদিন যাবৎ নিরুদ্দেশ;
- স্বামী পাগল;
- স্বামী দীর্ঘদিন ধরে কারাদণ্ডভোগী; এবং
- স্বামী নিষ্ঠুর আচরণ করেন।
বিধবা বিবাহ: ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর সমাজব্যবস্থায় বিধবা বিবাহ প্রচলিত আছে। একজন বিধবা তার স্বামীর মৃত্যুর পর স্বামীর সম্পত্তি থেকে ভরণপোষণ পাবার অধিকারী।
তবে বিধবা দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করলে স্বামীর সম্পত্তির ওপর থেকে ভরণ পোষণের অধিকার হারান। এক্ষেত্রে বিধবা পুনরায় বিয়ে করতে সম্মত হলে দ্বিতীয় বিবাহকার্যটি নিজ পিতা বা ভাইয়ের বাড়িতে সম্পন্ন করতে হয়।
নাবালকের অভিভাবক: ত্রিপুরা সামাজিক রীতি অনুযায়ী নাবালকের স্বামী ও সম্পত্তির অভিভাবক পিতাই হন।
সামাজিক আদালতের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ নাবালক সন্তানের শরীরের অভিভাবক হন মাতা। তবে মাতা দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করলে নাবালক সন্তানের অভিভাবকত্বের অধিকার লোপ পায়।
নাবালক সন্তানের দালাল অর্জনের পর সন্তানের অভিভাবক পিতা হন এবং সন্তান পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন।
দত্তক: ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর প্রথা অনুসারে নিঃসন্তান পিতা-মাতা, অবিবাহিত, বিপত্নীত বিধবা, পুত্রহীন হলে কোনো ব্যক্তি দত্তক গ্রহণ করতে পারেন।
তবে এক্ষেত্রে দত্তক গ্রহণের জন্য জন্মদাতা পিতা-মাতার সম্মতি থাকতে হয়। এরূপে দত্তক গ্রহণ করা হলে ত্রিপুর সমাজে দত্তক সন্তান স্বীকৃতি লাভ করে।
উত্তরাধিকার: ত্রিপুরা সমাজে প্রথাগতভাবে নারীরা আইনের দিক থেকে স্থাবর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন। পুত্রসন্তানরাই একমাত্র পরিবারের স্থাবর সম্পত্তির আইনি অধিকারী।
তবে ত্রিপুরা জাতির কোনো কোনে গোত্রে কন্যাসন্তানরা অস্থাবর সম্পত্তির পাশাপাশি স্থাবর সম্পত্তিরও অধিকার ভোগ করে থাকেন; যেমন যাদুঙ, দেনদাউ, গাবিং ইত্যাদি গোত্রে মেয়েসন্তানরা মায়ের বংশ পরিচয়ে পরিচিত হন।
এসব গোত্রে মেয়ে সন্তানরাই উত্তরাধিকারী হিসেবে মায়ের সম্পত্তি ভোগ করে থাকেন। কোনো কোনো পরিবারের মাতা-পিতা কন্যাসন্তানদেরও সম্পত্তির ভাগ দিয়ে থাকেন।
বর্তমানে অধিকাংশ পরিবারেই এই রীতি অনুসৃত হচ্ছে। তবে কন্যাসন্তানদের অধিকার পুত্রসন্তানদের সমান নয়। মা-বাবার দয়ার ওপরই নির্ভর করে যে, কন্যা সন্তানরা স্থাবর সম্পত্তির কত ভাগ পাবেন।
এ পর্যন্ত দেখা গেছে, কন্যা সন্তানরা পুত্র সন্তানের সমপরিমাণ স্থাবর সম্পত্তি পান না।
- ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর উত্তরাধিকার রীতি অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে তার রেখে যাওয়া স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী পুত্রসন্তান বা পুত্র সন্তানরাই হন;
- মৃত ব্যক্তির পুত্রসন্তানের উপস্থিতিতে কন্যাসন্তানরা মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি থেকে কেবল ভরণপোষণ পাবার অধিকারী হন। বিয়ের পর সেই ভরণপোষণ পাবার অধিকারও খর্ব হয়। তবে মৃত ব্যক্তির পুত্রসন্তান না-থাকলে কন্যাসন্তান বা কন্যাসন্তানরা সমানভাবে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন;
- ভিন্ন ধর্ম বা সমপ্রদায়ের কোনো ব্যক্তির সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলে কন্যাসন্তান পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন না;
- স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার বন্টন-
ক. ত্রিপুরা সামাজিক রীতি অনুযায়ী স্বামী-স্ত্রীর বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকাকালে স্ত্রীর মৃত্যুতে স্বামী মৃত স্ত্রীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন;
খ. স্বামী মৃত্যুবরণ করলে স্ত্রী মৃত স্বামীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন না। স্ত্রী কেবল মৃত স্বামীর সম্পত্তির ওপর জীবনস্বত্ব ভোগের অধিকারী হন। স্ত্রী দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করলে মৃত স্বামীর সম্পত্তির ওপর জীবন স্বত্বের অধিকারও হারান।
রক্তসম্পর্কের ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার: ত্রিপুরা সামাজিক রীতি অনুসারে মৃত ব্যক্তির স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, পিতা, মাতার কেউই যদি জীবিত না-থাকেন বা জন্মগ্রহণ না-করেন, তবে মৃত ব্যক্তির ভ্রাতা, ভ্রাতার পুত্র, কন্যা, তাদের অবর্তমানে মৃতের বোন, বোনের পুত্রকন্যারা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন;
পদ ও পদবির ক্ষেত্রে-
ক. ত্রিপুরা সমাজের সামাজিকপ্রথা অনুযায়ী রোয়াজা/নারায়ণ পদ জ্যেষ্ঠপুত্রের জন্য নির্ধারিত থাকে;
খ. জ্যেষ্ঠপুত্র যোগ্য হলে তাকে হেডম্যান বা কার্বারি পদে নিয়োগ প্রদান করা হয়। পুত্রের অবর্তমানে জ্যেষ্ঠ কন্যা সন্তানকে হেডম্যান বা কার্বারি পদে নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে।
অবৈধ সন্তানের স্বত্ব: ত্রিপুরা সমাজের সামাজিক প্রথা অনুসারে কোনো পুরুষ ও নারীর অবৈধ যৌনমিলনের ফলে সন্তান জন্ম নিলে নারী কর্তৃক সামাজিক আদালতে উপস্থাপিত প্রমাণ সাপেক্ষে সন্তানের পিতৃ পরিচয় নির্ধারিত হয়।
অবৈধ সন্তান পিতার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী দাবি করতে পারে না। তবে অবৈধ সন্তান মায়ের নামে থাকা সম্পত্তি উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হয়।
তথ্যসূত্রঃ প্রথাগত আইনে আদিবাসী পাহাড়ী নারীর অবস্থান (সুস্মিতা চাকমা)।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।