তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর বিবাহ বিচ্ছেদ (সা-চি)
1077
তঞ্চঙ্গ্যা বিবাহ বিচ্ছেদ
তঞ্চঙ্গ্যা পরিবারে স্বামী ও স্ত্রীর বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করাকে ‘সা-চি’ বলা হয়।
বিবাহ বিচ্ছেদের বিভিন্নি পদ্ধতি: স্বামী কিংবা স্ত্রী যে কোনো একজনের মৃত্যুতে তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত একটি দাম্পত্য জীবন তথা বিবাহিত জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। তবে সামাজিক রীতি ও আইন স্বীকৃত উপায়ে নিম্নবর্ণিত কারণে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে জীবদ্দশায় বৈবাহিক সম্পর্কের পরিসমাপ্তি বা ‘সা-চি’ হতে পারেঃ-
ক) স্বামী/স্ত্রী/যে কেউ সামাজিক আদালতের দ্বারস্থ হয়ে সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘সা-চি’ সম্পাদন করতে পারে।
খ) সামাজিক আদালত বা বিচার বিভাগীয় কার্যক্রমের আওতায় ‘সা-চি’ করা যায়।
গ) ইদানীং শিক্ষিত সমাজে স্বামী বা স্ত্রী কর্তৃক বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট/নোটারী পাবলিক-এর নিকট হলফনামা সম্পাদন করে ‘সা-চি’ হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে সম্পাদিত হলফনামার কপি একপক্ষ তার নিযুক্ত আইনজীবির মাধ্যমে অপরপক্ষকে প্রেরণ করে থাকে (যদিও তা সামাজিক প্রথাসিদ্ধ নয়)।
কোন কোন ক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রী ‘সা–চি’ দাবী করে থাকে: নিম্নোক্ত কারণে তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে স্বামী বা স্ত্রী ‘সা-চি’ প্রদানের অধিকার লাভ করেঃ
ক) স্বামী যদি দৈহিক মিলনে অক্ষম বা পুরুষত্বহীন হয় বা স্ত্রী গর্ভধারণে অক্ষম হয়, সেক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন যথোপযুক্ত ডাক্তারী পরীক্ষার সনদপত্র দ্বারা ‘সা-চি’ দাবী করতে পারে।
খ) স্বামী বা স্ত্রী যদি পরকীয়া কিংবা ব্যভিচারে বা নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে লিপ্ত হয় এবং এ ধরণের অপরাধের জন্য যে কোনো একজন যদি তাদের সামাজিক আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয় তাহলে অপরজন ‘সা-চি’ দাবী করতে পারে।
গ) স্ত্রীর সম্মতি বা অনুমতি ব্যতিরেকে স্বামী দ্বিতীয়বার বিবাহ করলে, সেক্ষেত্রে সতীনের সাথে একত্রে বসবাসে অসম্মত হয়ে প্রথমা স্ত্রী ‘সা-চি’ দাবী করতে পারে।
ঘ) স্বামী বা স্ত্রী উভয়ের যে কেউ একজন নিরুদ্দেশ হলে এবং বহু বছর যাবৎ উভয়ের মধ্যে কোনো প্রকার দাম্পত্য সম্পর্ক বা পারিবারিক যোগাযোগ না থাকলে, সেক্ষেত্রে যে কোনো একপক্ষ তাদের সামাজিক আদালতে একতরফাভাবে ‘সা-ছি’ সম্পাদন পূর্বক দ্বিতীয় বিবাহে আবদ্ধ হতে পারে।
ঙ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন মানসিক বিকারগ্রস্ত অথবা বিকৃত রুচির হলে, সেক্ষেত্রে অপর পক্ষ সামাজিক আদালতের মাধ্যমে ‘সা-চি’ হতে পারে।
চ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একপক্ষ জঘন্য অপরাধের জন্য দণ্ডিত হয়ে যদি দীর্ঘদিন সাজা ভোগ করে, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ সামাজিক আদালতের মাধ্যমে একতরফাভাবে ‘সা-চি’ দাবী করতে পারে।
ছ) যদি স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন বৌদ্ধ পুরোহিত বা সাধুমা (হ্লুদমা) হয়, সেক্ষেত্রে অপর পক্ষ একতরফাভাবে সামাজিক আদালতের মাধ্যমে ‘সা-চি’ সম্পাদন করতে পারে।
জ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একপক্ষ যদি নিষ্ঠুর প্রকৃতির, অহেতুক সন্দেহ প্রবণ, মাদকাসক্ত, নির্যাতনকারী হয়, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ সামাজিক আদালতের মাধ্যমে ‘সা-চি’ সম্পাদন করতে পারে।
ঝ) স্ত্রী যদি স্বামীর সংসারে প্রাপ্য ভরনপোষণ, ন্যায্য অধিকার, চিকিৎসা-সেবা ও পারিবারিক মর্যাদাসহ স্ত্রীর অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, সেক্ষেত্রে সামাজিক আদালতের মাধ্যমে ‘সা-চি’ সম্পাদন করতে পারে।
ঞ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একপক্ষ যদি অবিশ্বস্ত বা অবাধ্য হয়, পারিবারিক দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রতিপালনে অনিচ্ছুক বা উদাসীন হয়, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ সামাজিক আদালতের মাধ্যমে ‘সা-চি’ হতে পারে। তবে দোষী সাব্যস্ত হলে প্রথমবারের মতো সংশোধনের সুযোগ প্রদান করা হয়ে থাকে।
বিবাহ বিচ্ছেদের আইনগত ফলাফল:
ক) সমাজ স্বীকৃত পদ্ধতিতে সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘সা-চি’ হলে স্বামী-স্ত্রী যে কেউ পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে।
খ) ‘সা-চি’ হবার পর স্বামী বা স্ত্রী এমনকি উভয়ের সম্মতিতে দৈহিক মিলন অবৈধ হয়। এরূপ দৈহিক মিলনজাত সন্তান অবৈধ বা জারজ হিসেবে গণ্য হয়।
গ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো পক্ষ দ্বারা ‘সা-চি’ সম্পাদনের পর পারস্পরিক পূনঃ সমঝোতা ও আস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে পুনরায় দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপনের জন্য লাসং/ফং গয়ানা, খানা সিয়ানা’ এ সকল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সামাজিক স্বীকৃতি অর্জন করতে হয়।
ঘ) ‘সা-চি’ হওয়ার পর স্বামী ও স্ত্রী পারস্পরিক অধিকার এবং কর্তৃত্ব হারায়।
ঙ) ‘সা-চি’ সম্পাদনের পর স্ত্রী তার পূর্ব স্বামীর উত্তরাধিকারসহ পারিবারিক পদবী ও মর্যাদা হারায়।
চ) ‘সা-চি’ সম্পাদনের পর স্বামীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিসহ প্রাপ্য ভরনপোষণ হতে স্ত্রী বঞ্চিত হয়। স্ত্রীর অর্জিত স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের ওপর স্বামীর অধিকার থাকবে না। স্বামী সরকারী চাকুরীজীবি হলে তার মৃত্যুর পর ‘সা-চি’ প্রাপ্ত স্ত্রী পেনশন সুবিধা হতে বঞ্চিত হয়।
ছ)‘সা-চি’ সম্পাদনের সময় সামাজিক আদালতে পক্ষগণের | দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ সাপেক্ষে কনেপণ সংক্রান্ত পরস্পরের দেনা-পাওনা পরিশোধ করতে হয়।
‘সা–চি’ সম্পাদনকালে স্ত্রীর গর্ভবতী অবস্থা :
ক) ‘সা-চি’ বা বিবাহ বিচ্ছেদের সময় স্ত্রী যদি গর্ভবতী অবস্থায় থাকলে অনাগত সন্তানের দায়-দায়িত্ব থাকে অথবা ‘সা-চি’ হওয়ার পর স্ত্রীর দ্বিতীয় বিবাহ সত্ত্বেও যদি ধাত্রী বিদ্যামতে প্রমাণিত হয় যে, বিচ্ছেদ পূর্ব সময়ে স্ত্রী গর্ভবতী ছিল সেক্ষেত্রে ভিন্ন কিছু নিশ্চিত প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত বিচ্ছেদ প্রাপ্ত স্বামীকে উক্ত সন্তানের পিতৃত্বের দায় মেনে নিতে হয়।
উক্ত সন্তান অবৈধ বা জারজ বলে গণ্য হয় না। উক্ত সন্তান তার পিতার নিকট হতে ভরনপোষণ পায় এবং আইনগত উত্তরাধিকারী হয়। বিচ্ছেদকালে গর্ভবতী স্ত্রীকে সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে ১ হতে ৩ বছর পর্যন্ত ভরনপোষণসহ সন্তান প্রসবকালীন যাবতীয় খরচ স্বামীকে দিতে হয়।
তবে সন্তান সাবালক না হওয়া পর্যন্ত বিচ্ছেদ প্রাপ্ত স্ত্রীর হেফাজতে রাখার অধিকার থাকে। বিচ্ছেদ প্রাপ্ত স্ত্রীর অন্যত্র বিবাহ হলে এবং সন্তান যদি তখন মাতৃদুগ্ধ পান না করে তাহলে সন্তানের জন্মদাতা পিতা সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে নাবালক সন্তানের অভিভাবক হয়।
খ) বিবাহ বিচ্ছেদ বা ‘সা-চি’ এর তারিখ হতে পরবর্তী ২৮০ দিন পর বিচ্ছেদপ্রাপ্ত স্ত্রীর গর্ভে ধারণ করে, সেক্ষেত্রে ভিন্ন কিছু নিশ্চিত প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত উক্ত সন্তান অবৈধ বা জারজ বলে গণ্য হয় এবং বিচ্ছেদপ্রাপ্ত স্বামী উক্ত সন্তানের পিতৃত্ব গ্রহণে বাধ্য। তবে ‘সা-চি’ সম্পাদনের পর স্ত্রীর পূনঃ বিবাহ হলে তখন গর্ভজাত সন্তানের পিতৃত্বের বিষয়টি ধাত্রী বিদ্যামতে বা সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে নির্ধারিত হয়।
গ) তঞ্চঙ্গ্যা সমাজের রীতি অনুসারে স্বামী নিজে তার স্ত্রীর সাথে ‘সা-চি’ করলে বিচ্ছেদপ্রাপ্ত স্ত্রী সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে স্বামীর সম্পত্তির অংশ এবং স্বামীর দেয়া জরিমানার অর্থ পায় । ঐ স্ত্রীর দ্বিতীয় বিবাহ না হলে বিচ্ছেদদাতা স্বামীর নিকট হতে খোরপোষ পায় ।
তথ্যসূত্রঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আদিবাসীদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন (গ্রন্থনা ও সম্পাদনা – এডভোকেট জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, এডভোকেট প্রতিম রায়, সুগত চাকমা)।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।