চাকমা জাতির এক মহীয়সী নারী চাকমা রাণী কালিন্দী

Jumjournal
Last updated Mar 10th, 2020

1827

featured image

চাকমা রাণী কালিন্দী কে নিয়ে সকলের মুখে প্রায়ই শোনা যায় যে চাকমা রাণী কালিন্দীর কারণে চাকমা জাতি রাজ্যহারা।

তারই ভুলের জলন্ত আগুনের মশালে দহনীয় সমগ্র চাকমা জাতি। রাণী কালিন্দীর বিরুদ্ধে সবার মাঝে যে ধারণা সেই বিষয় নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা।

বৃটিশ আমলে উপমহাদেশের মহীয়সী নারীদের বীরত্ব গাঁথা কিংবা সমাজে তাঁদের অবদানের কথা বললে আমাদের চোখে ভেসে ওঠে নবাব ফয়জুন্নেসা, বেগম রোকেয়াদের কথা।

কিন্তু তাঁদের জন্মেরও পূর্বে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে আরেক মহীয়সী নারীর কথা ক’জনইবা জানেন! উনিশ শতকের প্রথমদিকে রাস্তাঘাটহীন দূর্গম পার্বত্য এলাকার কুদুকছড়ির সাধারণ এক চাকমা জুমিয়া পরিবারে জন্মেছিলেন কালাবি চাকমা।

পরবর্তীতে চাকমা রাজা ধরম বক্স খাঁ’র সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তিনি ‘কালিন্দী রাণী’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

সাধারণ পরিবারে বেড়ে ওঠলেও তিনি স্বশিক্ষিত ছিলেন এবং তাঁর প্রাজ্ঞ দিয়ে রাজপরিবারের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

কালিন্দী রাণী শুধু বৈষয়িক বুদ্ধিতে কিংবা রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দূরদর্শিতায় প্রাজ্ঞ ছিলেন না, এর পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক এবং ধর্মীয় ক্ষেত্রেও যে অবদান তিনি রেখে গেছেন তা আজও কালের সাক্ষী হয়ে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন।

তিনি বৌদ্ধ ধর্মকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা ও প্রচারের জন্য চট্টগ্রামের রাজানগরে বর্তমান মহামুনি বৌদ্ধ মন্দিরটি স্থাপন করেন (বাংলা ১২৭৩ সন)। তিনি এই মন্দিরকে ঘিরে প্রতি বছর ‘মহামুনি মেলা’র প্রবর্তন করেছিলেন, যা আজও উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে থাকে।

সেই সময়ে ‘বৌদ্ধ রঞ্জিকা’ প্রকাশেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তাছাড়া হিন্দু ও মুসলমান ধর্মের প্রতিও তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা ও ভক্তি ছিল।

Chakma Royal Palace, Rangunia
রাঙ্গুনিয়ায় রাজানগরের চাকমা রাজবাড়ি, ছবিঃ সমকাল

তৎকালীন রাজধানী রাজানগরে হিন্দুদের জন্য মন্দির ও মুসলমানদের মসজিদ নির্মাণের জন্য রাজভান্ডার হতে খরচ নির্বাহের ব্যবস্থা করেছিলেন।

তাই তিনি পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ছাড়াও হিন্দু-মুসলমানদের কাছেও সমানভাবে গ্রহণযোগ্য ও শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন।

চাকমা রাজা ধরম বক্স খাঁ ২০ বছরকাল রাজত্ব করার পর ১৮৩২ সালে মৃত্যুবরণ করলে অপুত্রক রাজার উত্তরাধিকারী হিসেবে ইংরেজ কোম্পানী তৃতীয় রাণীর একমাত্র কন্যা মেনকা ওরফে চিকনবীকে রাজ্যভার প্রদান করেন।

কিন্তু প্রথমা রাণী কালিন্দীর আপত্তির কারণে সেই সিদ্ধান্ত স্থগিত করে ইংরেজ কোম্পানীর পক্ষ থেকে শুকলাল দেওয়ানকে রাজ্যের ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।

ইতিমধ্যে ১৮৩৭ সালে রাণী কালিন্দী ইংরেজ কোম্পানীর কাছ থেকে দুই বছরের জন্য রাজ্য ইজারা গ্রহণ করেন।

পরবর্তীতে আইনি অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের পর ইংরেজ কোম্পানী ১৮৪৪ সালে কালিন্দী রাণীকে স্বামীর যাবতীয সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হিসেবে রায় ঘোষণা করে।

মূলতঃ কালিন্দী রাণী ১৮৪৪ সালে সরকারিভাবে রাজ্য শাসনের উত্তরাধিকারী হলেও পরে তিনি রাজা ধরম বক্স খাঁ’র মৃত্যুর পর ১৮৩২ সাল হতে রাজ্য শাসন করা শুরু করেছিলেন।

রাণী কালিন্দী ১৮৪৪ সাল হতে ১৮৭৩ সাল পর্যন্ত প্রায় তিন দশক রাজ্য শাসন করেছিলেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে রাজাদের রাজ্য শাসনের মধ্যে রাণী কালিন্দীর শাসনকালটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর আমলেই বৃটিশ কোম্পানী পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর প্রত্যক্ষ আধিপত্য স্থাপন করে।

১৮৬০ সালের আগ পর্যন্ত ইংরেজরা চট্টগ্রাম থেকেই দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের শাসনকার্য পরিচালনা করতো। ফলে বাস্তবিক অর্থে প্রত্যক্ষ বৃটিশ শাসন এই অঞ্চলে ছিল না।

১৮৬১ সালের পর হতে পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য অস্থায়ীভাবে বিভিন্ন সময়ে কয়েকজন সুপারিন্টেডেন্ট নিয়োগ পেলেও মূলতঃ ১৮৬৬ সাল হতে ক্যাপ্টেন টি. এইচ. লুইন নিয়মিত শাসনকর্তা হিসেবে আর্বিভূত হন।

ক্যাপ্টেন লুইন দায়িত্ব গ্রহণের পর ১৮৬৯ সালের ১লা জানুয়ারী চন্দ্রঘোনা হতে রাঙ্গামাটিতে প্রশাসনিক হেডকোয়াটারকে স্থানান্তর করেন। ক্যাপ্টেন লুইনের মূল উদ্দেশ্য ছিল নতুন রাজ্যে বৃটিশের স্থায়ী অধিকার ও প্রাধান্য বিস্তার করা।

অপরদিকে রাণী কালিন্দী ছিলেন এর ঘোর বিরোধী। কাজেই অচিরেই ঝানু কূটকৌশলী লুইনের সাথে তেজস্বিনী রাজমহীয়সী রাণী কালিন্দীর বিরোধ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

ক্যাপ্টেন লুইন প্রথম অবস্থা থেকে রাণীর প্রতি সন্দিহান ছিলেন। ক্যাপ্টেন লুইনের মতে, একজন অশিক্ষিতা বিধবা নারীর পক্ষে কীভাবে রাজ্যের শাসন পরিচালনা সম্ভব? কিন্তু রাণী কালিন্দী ছিলেন বুদ্ধিমতী, নিষ্ঠাবান, সদালাপী ও অতিথি পরায়ণ।

ফলে রাজ্য শাসনের ক্ষেত্রে এসব গুণাবলী তাঁকে অনেক বেশী সুরক্ষিত ও নিরাপদ রেখেছিল। এছাড়া তৎকালীন সময়ে রাজ্যে এমন কোন প্রতিদ্বন্দ্বী দেওয়ান বা সর্দ্দার ছিলেন না যারা সিংহাসনে বসে নিরাপদে রাজত্ব চালাবেন।

কারণ সেই সময়ে দেওয়ান বা সর্দ্দারগণ আধিপত্য নিয়ে নিজেদের মধ্যে কলহে ব্যস্ত ছিল।

Chakma Royal Palace, Rangunia
প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত রাঙ্গুনিয়ায় রাজানগরের চাকমা রাজবাড়ি, ছবিঃ কালেরকণ্ঠ

সুচতুর ও ধূর্ত লুইন প্রায়ই নানাভাবে রাণী কালিন্দীর মাতাকে খর্ব ও অপদস্ত করার চেষ্টা চালাতেন। এ লক্ষে পার্বত্য এলাকার এক একটা উপত্যাকাভূমিকে প্রতিপত্তিশালী দেওয়ানগণকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত গ্রহণের জন্য প্রলুব্ধ করতে লাগলেন।

এতে চাকমা রাজ্যের প্রায় অর্ধেক রাণীর হাতছাড়া হয়ে যেত। কিন্তু রাণীর প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে দেওয়ানগণের কেউ এ প্রস্তাবে সম্মত হননি।

ক্যাপ্টেন লুইন যখন দেখলেন তাঁর এ উদ্দেশ্য সফল হল না তখন তিনি চাকমা রাজ্যকে শাসনের সুবিধার অজুহাত দেখিয়ে চাকমা রাজ্যকে দু’ভাগে ভাগ করার প্রস্তাব করে প্রাদেশিক গভর্ণরের কাছে রির্পোট পেশ করেন।

এ রির্পোটের ভিত্তিতে পরবর্তীতে ১৮৮১ সালের ১লা সেপ্টেম্বর ইংরেজ কোম্পানী পার্বত্য চট্টগ্রামকে তিনটি সার্কেলে (চাকমা, বোমাং ও মং সার্কেল) বিভক্ত করে দিয়েছিল।

ক্যাপ্টেন লুইন রাণী কালিন্দীকে নানাভাবে ঘায়েল করার চেষ্ঠা করেও যখন কোনভাবেই ধরাশায়ী করতে পারছিল না তখন রাণীর সাথে সাক্ষাতে প্রস্তাব দিয়ে তাঁকে সামাজিকভাবে প্রজা সাধারণের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা চালান।

কারণ সেসময় সমাজ ব্যবস্থা ছিল অনেক রক্ষণশীল। নারীরা আরও বেশি পর্দানশীল ও অন্ত:পুরবাসী ছিলেন। রাণীর এ দূর্বলতার দিককে কাজে লাগাতে ক্যাপ্টেন লুইন রাণীর সাথে প্রত্যক্ষ সাক্ষাতের প্রস্তাব পাঠান।

কিন্তু রাণী লুইনের এ প্রস্তাবে রাজী না হওয়ায় লুইন আরও ক্ষুব্ধ হয়ে যান এবং কয়েকশ সৈন্যসামন্ত নিয়ে তৎকালীন রাজধানী রাঙ্গুনিয়ায় উপস্থিত হয়ে চাকমা রাজবাড়ী আক্রমণের চেষ্টা চালান।

কিন্তু হিন্দু-মুসলমান, চাকমা নির্বিশেষে স্থানীয় সকল প্রজারা ক্যাপ্টেন লুইনকে প্রতিহত করে পিছু হটিয়ে দেয়। চাকমা রাণীর অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের কারণে পাহাড়ী-বাঙালি নির্বিশেষে সকলের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল তুলনাহীন।

রাণীর উদারতা ও বিচণতা এবং প্রজা সাধারণের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার কারণে লুইনের শত ষড়যন্ত্রের পরও তিনি দৃঢ়হাতে সকল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে রাজ্য শাসন করেছিলেন।

রাণী কালিন্দী চাকমা রাজ পরিবারের দীর্ঘদিনের পুরুষতন্ত্রের ধারাবাহিকতাকে ভেঙে সিংহাসনে আরোহণ করে রাজ্য শাসন করেছিলেন।

তিনি ছিলেন একাধারে স্বশিক্ষিত, নিষ্ঠাবান ও বিনয়ী। রাণী কালিন্দী তিন দশক রাজ্য শাসন করে এটাই প্রমাণ করে দিয়েছেন নারীরা ক্ষমতার শীর্ষেও তাঁদের মেধা ও যোগ্যতার স্থান রাখতে সক্ষম।

Old Chakma Royal Palace, Rangamati (Ramatti)
বর্তমানে জলনিমগ্ন রামাত্তির (রাঙ্গামাটির) চাকমা রাজবাড়ি, ছবিঃ Walk Bangladesh

রাণী কালিন্দী পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম গিরিতে নারী নেতৃত্ব ও নারী অধিকারের যে মশাল জ্বেলে দিয়ে গেছেন আজও সেই জাগরনের মশাল জ্বলছে।

তবে কালিন্দী রাণীর সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত পাহাড়ি নারীর ক্ষমতায়ন ও নেতৃত্বের জায়গাটি এখনও সংকীর্ণ রয়ে গেছে।

তিনি অতিশয় তেজোস্বিনী ও মেধাবী ছিলেন এবং স্বীয় কুলগৌরব ইতিহাস প্রসিদ্ধ রাজপুত মহিলাদের ন্যায় তাঁর নিকট রাজ্যাপেক্ষা এমনকি প্রাণাপেক্ষা অধিক প্রিয় ছিলো।

এই কারণে সেসময় ডেপুটি কমিশনার ক্যাপ্টেন লুইন তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে পারেননি। তাতে ক্যাপ্টেন লুইন রাণীর প্রতি অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ হন এবং চাকমা রাজ্যের অধঃপতনের সূত্রপাঠ করে যান।

মানে বিশাল রিজার্ভ গঠন, কর্ণফুলী নদীর বহু আয়কর টেক্স, গভর্নমেন্ট কর্তৃক খাসকরণ ইত্যাদি ক্যাপ্টেন লুইনের প্রতিহিংসার কার্য।

১৮৭৩ খ্রিঃ (১২৩৫ মঘী ১২৮০ বাঙ্গালা) ১৫ আশ্বিন, মহিয়ষী এই নারী বাত রোগে রাঙ্গুনিয়ার রাজানগর রাজপ্রসাদে মারা যান।


লেখক : ইলিরা দেওয়ান

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা