অশোক কুমার দেওয়ানের চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার প্রসঙ্গে কিছু কথা
747
বর্তমানে যে এলাকাটি খাগড়াছড়ি জেলা শহর – যেখানে এই লেখকের জন্ম ও বেড়ে ওঠা – একদা ছিল স্রেফ প্রত্যন্ত এলাকার একটি কৃষিনির্ভর জনপদ, যা ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত প্রশাসনিকভাবে ছিল রামগড় মহকুমা ও মহালছড়ি থানার আওতাধীন।
সেইরকম একটি জায়গায় আমার শিক্ষাজীবনের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্বে বিরল কিছু ব্যক্তিত্বকে পেয়েছিলাম শিক্ষক হিসাবে, যাঁদের একজন ছিলেন অশোক কুমার দেওয়ান।
এই প্রেক্ষাপটে ছোটবেলার শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসাবে লেখা একটা নিবন্ধে[২] আমি তাঁর সম্পর্কে নিচের কথাগুলি লিখেছিলাম:
[খাগড়াছড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ে] অশোক কুমার দেওয়ানকে [সরাসরি] শিক্ষক হিসাবে পেয়েছিলাম স্বল্প সময়ের জন্য, ক্লাস নাইনে। আমরা জানতাম তিনি কলকাতার গ্র্যাজুয়েট, ছিলেন সুদর্শন, এবং তাঁর বেশভূষা (ধুতি পরতেন), বাচনভঙ্গী, জ্ঞান, মেধা সব কিছু মিলিয়ে তিনি সম্ভবত ছিলেন খাগড়াছড়ির মত জায়গায় কলকাতা-কেন্দ্রিক বিদ্বৎসমাজের একজন অপ্রত্যাশিত কিন্তু অনন্য প্রতিভূ। বয়স ছোট বলে তাঁর প্রজ্ঞা, গবেষক মনন ও ইতিহাসমনস্কতা স্কুলে পড়ার সময় ঠিকমত উপলব্ধি করতে পারি নি, সেটা বুঝেছি আরো বড় হয়ে, তাঁর কিছু লেখা পড়ে।
অশোক কুমার দেওয়ানের লেখালেখির যেসব নমুনা পড়ে তাঁর সম্পর্কে উল্লিখিত উপলব্ধি প্রকাশ করেছিলাম, সেগুলির অন্যতম ছিল চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার বইটি।
তবে প্রিসিলা রাজ (২০১৬) রচিত চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার ও অশোক কুমার দেওয়ান বইটি হাতে পাওয়ার পর, এবং এটি নিয়ে কিছু বলার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে, আমি দুইভাবে উপকৃত হই।
প্রথমত, আমার কাছে বাবার সংগ্রহ থেকে নিজের কাছে নিয়ে রাখা অশোক কুমার দেওয়ানের চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার শিরোনামের যে বইটি ছিল (১ম খণ্ড, ১৯৯১ সালে প্রকাশিত), সেটি নতুন করে পড়তে গিয়ে আবিষ্কার করি, আমার প্রাক্তন শিক্ষক সম্পর্কে আমার একটা পূর্বধারণা ভুল ছিল।
যেমনটা নিজের লেখা থেকে তুলে দেওয়া উপরের উদ্ধৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি কলকাতার (অর্থাৎ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের) গ্র্যাজুয়েট বলে আমরা জানতাম, কিন্তু তাঁর বইয়ে সংযুক্ত পরিশিষ্ট নতুন করে খুঁটিয়ে পড়তে গিয়ে জানতে পারি, তিনি কলকাতায় স্নাতক পর্যায়ে পড়াশুনা শুরু করলেও তা শেষ করেন নি, বরং পরে অনিয়মিত পরীক্ষার্থী হিসাবে বি.এ. ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
প্রিসিলা রাজের বইটি পড়তে গিয়ে দ্বিতীয় যেভাবে আমি উপকৃত হয়েছিলাম তা হল, চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার নামের বইটি যে আসলে দুই খণ্ডে প্রকাশিত একটি গবেষণাকর্ম, তা জানতে পারি। বিষয়টি আগে আমি খেয়াল করি নি, যেহেতু আমার হাতের কাছে বা চোখের সামনে থাকা বইটির (১ম খণ্ডের) প্রচ্ছদে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য বা ইঙ্গিত ছিল না, আর ভেতরের সবকিছু খুঁটিয়ে পড়ার উপলক্ষও আগে আসে নি।
এই প্রেক্ষাপটে প্রিসিলা রাজের গ্রন্থ পড়তে গিয়ে লক্ষ্য করি যে, তিনি বিভিন্ন জায়গায় অশোক কুমার দেওয়ানের চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার বইটিকে দুই খণ্ডে সম্পন্ন একটি গবেষণাকর্ম হিসাবে তুলে ধরেছেন, এবং এ সূত্রেই বইটির দ্বিতীয় খণ্ডের (অশোক কুমার দেওয়ান ১৯৯৩) কথা আমি জানতে পারি, যা পরে খুঁজে বের করি।
অশোক কুমার দেওয়ানের গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাকর্ম সম্পর্কে বৃহত্তর পাঠক সমাজকে অবহিত করার যে উদ্যোগ প্রিসিলা রাজ নিয়েছিলেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয় ছিল।
আমার বিশ্বাস, চাকমা সমাজ ও ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছেন বা জানতে আগ্রহী, এমন পাঠকেরা ছাড়াও অন্য আরো অনেকে আলোকিত-অনুপ্রাণিত বোধ করবেন অশোক কুমার দেওয়ানের গবেষণাকর্ম ও এতে প্রতিফলিত তাঁর মেধা-মননের সাথে পরিচিত হয়ে।
আমার এই বক্তব্যের সমর্থনে তাঁর বই থেকে একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরব এই লেখার শেষ অংশে, তবে তার আগে আমরা একটু নজর দেব ইতিহাস ও নৃবিজ্ঞান চর্চা সংক্রান্ত কিছু সাধারণ বিষয়ের উপর।
এক্ষেত্রে যে প্রেক্ষাপটে প্রিসিলা রাজ অশোক কুমার দেওয়ানের গবেষণাকর্মকে সামনে নিয়ে এসেছেন, সেটিও আমরা বিবেচনায় নেব।
নৃবিজ্ঞান ও ইতিহাস চর্চার পরিবরর্তনশীল গতিপ্রকৃতি
একটা সময় ছিল, যখন নৃবিজ্ঞান – বা অতীতে বাংলায় ‘নৃতত্ত্ব’ নামে অধিকতর পরিচিত জ্ঞানকাণ্ড – বলতে বোঝানো হত ‘আদিম’ নামে অভিহিত বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর অধ্যয়ন, যেখানে অধ্যয়নকারীরা আসতেন ঔপনিবেশিক প্রভুত্ব বিস্তারকারী সমাজ থেকে, আর অধীত জনগোষ্ঠীদের বাস ছিল বিভিন্ন উপনিবেশের প্রান্তিক সীমানায়।
কিন্তু বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে এসে নৃবিজ্ঞানের এই বিশেষায়ন ভেঙে পড়তে থাকে রাজনৈতিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক, উভয় দিক থেকে।[৩] ফলে এখন নৃবিজ্ঞান বলতে কোনোভাবেই আর শুধুমাত্র ‘আদিম’, ‘আদিবাসী’, ‘উপজাতীয়’ প্রভৃতি নামে চিহ্নিত জনগোষ্ঠীদের অধ্যয়ন বোঝায় না।
অধিকন্তু এসব বর্গ যদি সমকালীন নৃবিজ্ঞানীদের আলোচনায় উঠে আসেও, সেগুলিকে তাঁরা আর বিনা প্রশ্নে ব্যবহার করতে পারেন না, বরং অতীতে কোন প্রেক্ষাপটে এগুলির চল শুরু হয়েছিল, বর্তমানে এগুলির ব্যবহারের রাজনৈতিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক তাৎপর্য কী, এ বিষয়গুলিই সবার আগে সামনে চলে আসে।
অন্তত আমি নিজে এভাবেই আমার একাধিক লেখায় বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।[৪] এই প্রেক্ষাপটে প্রিসিলা রাজ যখন তাঁর গ্রন্থের ‘ভূমিকার বদলে’ অংশে আমাদের জানান, “নৃতত্ত্ব সম্পর্কে উৎসাহী হয়ে ওঠার সেই কালে [১৯৯৪ সালের দিকে] দেশের আদিবাসী জাতিগুলোর ইতিহাস নিয়ে বেশ মেতে উঠেছিলাম” (২০১৬:ix), তখন পাঠকের মনে একটা প্রশ্ন জাগতেই পারে, নৃতত্ত্ব বলতে লেখক কী বুঝেছেন?
এটির সাথে ‘আদিবাসী’ জাতিসমূহের ইতিহাসের সম্পর্ক কি? ‘আদিবাসী’ বর্গটি নিয়ে নিচে আমরা আলাদা করে আলোচনা করব, তবে তার আগে ‘ইতিহাস’ নিয়ে দুটি কথা বলে নেওয়া যাক।
পাঠকের জানা থাকতে পারে, এককালে ‘ইতিহাস’ বলতে বোঝাত রাজা-বাদশাদের কেন্দ্র করে বর্ণিত বিভিন্ন বৃত্তান্ত, তবে সাম্প্রতিক সময়ে এসে এই ধারায় অনেক পরিবর্তন এসেছে।
এখন ইতিহাস আলোচনায় শুধুমাত্র ক্ষমতাধর ব্যক্তিবর্গের কীর্তিগাঁথা আর বোঝায় না, বরং বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের কর্মকাণ্ড, এবং আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিভিন্ন বিষয়াদির আলোচনাও অবধারিতভাবেই উঠে আসে।
তথাপি সমকালীন বিশ্বের ইতিহাস চর্চা এখনো অনেকাংশে জাতি-রাষ্ট্রের ধারণাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। এই ধারাবাহিকতাতেই আমাদের দেশে বাংলাদেশের ইতিহাস আর বাঙালির ইতিহাস এখনো প্রায় সমার্থক হয়ে রয়েছে, যেখানে ‘অন্য’রা একেবারেই প্রান্তিক বা অদৃশ্য অবস্থানে থাকে।
উপরে উল্লেখ করা পটভূমিতে চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার ও অশোক কুমার দেওয়ান গ্রন্থটি অনুসন্ধিৎসু পাঠকদের এটা বুঝতে সহায়তা করতে পারে যে, বাংলাদেশের ইতিহাস শুধু বাঙালির ইতিহাস নয়, বরং সংখ্যায় যাই হোক না কেন, এখানে অন্য আরো বহু জাতির বসবাস রয়েছে, যাদের প্রত্যেকের রয়েছে নিজস্ব ইতিহাসবোধ ও ঐতিহাসিকতা, যেগুলিকে আমলে না নিলে বাংলাদেশের ইতিহাস তার বাঙালিকেন্দ্রিকতা থেকে মুক্ত হবে না।
তবে এই বিষয়টি কতটা সচেতনভাবে বিবেচনায় রেখে প্রিসিলা রাজ তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থটি লিখেছেন, তা স্পষ্ট নয়। অবশ্য এ ধরনের ক্ষেত্রে অশোক কুমার দেওয়ানের চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার বা এ ধরনের যে কোনো একক জাতি-কেন্দ্রিক বইয়ের একটা সম্ভাব্য সীমাবদ্ধতাও আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে।
যদি আমরা সমকালীন বাংলাদেশকে বুঝতে ও তুলে ধরতে চাই বহুজাতির একটি দেশ হিসাবে, তাহলে এখানে বসবাসরত বিভিন্ন জাতির ইতিহাস কিভাবে কতটুকু সমকালের মোহনায় এসে মিলিত হয়েছে, কিভাবে তাদের সবার মিলিত দ্বন্দ্ব-সহযোগিতা-কল্পনা-অস্বীকৃতির মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে নতুন ইতিহাস রচিত হয়েছে, হচ্ছে, সেসবের প্রতি নজর দেওয়া দরকার।
আর তা করতে গেলে বাঙালি-কেন্দ্রিক ইতিহাস অনুসন্ধান যেমন খুব একটা কাজে দেবে না, তেমনি শুধু চাকমা বা একক অন্য যে কোনো জাতিকে কেন্দ্র করে ইতিহাস চর্চার ধারা থেকে আমাদের সরে আসতে হবে।
অশোক কুমার দেওয়ানের গ্রন্থে যেমন এই সমকালীন তাগিদ খুব একটা স্পষ্ট নয়, তেমনি তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে প্রিসিলা রাজও এ বিষয়ে খুব মনোযোগ দিয়েছেন বলে মনে হয় নি আমার।
সমকালীন বিভিন্ন বর্গের ভিত্তিতে এবং একরৈখিক ভাবে ইতিহাস চর্চার সমস্যা
প্রিসিলা রাজ (২০১৬) তাঁর গ্রন্থের ‘ভূমিকার বদলে’ অংশে একটা বিশেষ তথ্য উল্লেখ করেছেন যেটির উপর তিনি যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন।
তিনি লিখেছেন, “বইটা পড়ার সময় দু’একজন চাকমা বন্ধুর কাছে শুনেছিলাম অশোকবাবু তাঁর এই লেখার জন্য চাকমা সমাজের বিরাগভাজন হয়েছিলেন, কারণ তিনি জাতির আদি নিবাস আরাকান-পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার বাইরে উপমহাদেশের উত্তর-উত্তরপূর্বে আসামের দিকে নির্দেশ করেছিলেন।
এতে করে বাংলাদেশ সরকার ও সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পাহাড়িদের ভূমি-সম্পদ হাতানোর যে বিরাট বাঙালি চক্রটি পার্বত্য চট্টগ্রামে গেঁড়ে বসেছে তাদের হাতে আরো একটি হাতিয়ার তুলে দেওয়া হয়েছে বলে তাঁর সমালোচকরা মনে করেন” (পৃষ্ঠা xi)।
এরপর “অশোকবাবুর মতামতকে এদেশের আদিবাসীদের সম্পদ ভক্ষণকারী অংশটি যাতে নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থের হাতিয়ার করতে না পারে সেজন্য সতর্কতা হিসাবে কিছু বিষয় পরিষ্কার করার দরকার আছে,” এই কথাগুলি বলে নিয়ে সাধারণ পাঠকের জন্য “Indigenous peoples” শব্দগুচ্ছ ও এই অর্থে “আদিবাসী” শব্দের ব্যবহার নিয়ে বেশ লম্বা একটা আলোচনার অবতারণা করেছেন প্রিসিলা রাজ (২০১৬:xii- xviii)।
‘আদিবাসী’ ধারণা নিয়ে প্রিসিলা রাজের আলোচনাটি এমনিতে অপ্রাসঙ্গিক নয়, কিন্তু এটাও স্পষ্ট হওয়া দরকার যে অশোক কুমার দেওয়ানের বইটির মূল বিষয়ের সাথে এ ধারণার কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই।
এখানে উল্লেখ্য যে, শেষোক্ত লেখক যে সময়ে তাঁর বইটি লিখেছিলেন, তখনও ‘আদিবাসী’ বর্গটি রাজনৈতিক দাবি উত্থাপনের একটি হাতিয়ার হিসাবে বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় নি, বরং শব্দটি বাংলায় নেতিবাচক ব্যঞ্জনাই বহন করত (প্রশান্ত ত্রিপুরা ১৯৯৩)।
যাই হোক, এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে অশোক কুমার দেওয়ান নিজে তাঁর বইয়ের কোথাও চাকমাদেরকে ‘আদিবাসী’ বা ‘উপজাতি’ হিসাবে বর্ণনা করেন নি।
প্রকৃতপক্ষে, এই শব্দগুলি তিনি তাঁর লেখালেখিতে খুব বেশি ব্যবহার করেছেন, এমন কোনো প্রমাণ চোখে পড়ে না।[৫] তিনি নিজে যেহেতু ‘উপজাতীয়’ হিসাবে অভিহিত একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, অন্তত ‘উপজাতি’ শব্দটি তাঁর লেখায় ঘুরেফিরে আসতেই পারত।
কাজেই আমার মনে হয় অশোক কুমার দেওয়ানের লেখায় এটির আপেক্ষিক অনুপস্থিতি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ, যে ব্যাপারে তাঁর ব্যাখ্যা – যদি কোথাও তিনি সেটা প্রকাশ বা ইঙ্গিত করে থাকেন – জানা গেলে ভালো হত। এটি ভবিষ্যতে আগ্রহী গবেষকদের অনুসন্ধানের একটি ক্ষেত্র হতে পারে।
প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে যে, তিন পার্বত্য জেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ‘উপজাতীয়’ তকমাযুক্ত যেসব সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭০ দশকের শেষভাগে, নিকটতর অতীতে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন, ২০১০’-এর মাধ্যমে সেগুলিতে ‘উপজাতীয়’ শব্দটি পাল্টে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর’ বসানো হয়।
রাঙ্গামাটিস্থ এরকমই একটি প্রতিষ্ঠানে পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন অশোক কুমার দেওয়ান। মজার ব্যাপার হল, তাঁর এককালের ছাত্র ও উত্তরসূরি সুগত চাকমা – যিনিও একই পদে কিছুকাল দায়িত্ব পালন করেছিলেন – নিজের লেখা একাধিক বইয়ে ‘উপজাতি’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন (যেমন সুগত চাকমা ২০০৯, ২০১২)।
অন্যদিকে একই প্রতিষ্ঠানের আরেকজন সাবেক পরিচালক সুপ্রিয় তালুকদার তাঁর একটি বইয়ের নাম রেখেছেন চাকমা ভাষা, জাতি ও অভিবাসন (২০১৩)।
এখানে আমরা বিরাজ মোহন দেওয়ানের ১৯৬৯ সালে প্রথম প্রকাশিত চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত (২০০৫) বইটির কথাও স্মরণ করতে পারি। এটাও উল্লেখ্য যে, আরো আগে, ১৯০৯ সালে, সতীষচন্দ্র ঘোষ লিখিত ও কলকাতা থেকে প্রকাশিত বইয়ের নামও ছিল চাকমা জাতি (যে বইটির বিশদ পর্যালোচনা রয়েছে অশোক কুমার দেওয়ানের গবেষণাকর্মে)।
উপরের আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা ধরে নিতে পারি যে, ব্রিটিশ আমলে এসে ইংরেজি ‘ট্রাইবাল’ বর্গটি চাকমা নেতৃবৃন্দের অনেকে আইনগতভাবে ও আত্মপরিচয়ের অংশ হিসাবে ব্যবহার করতে শুরু করেছিলেন বটে, কিন্তু বাংলা ‘উপজাতি’ অনেকের কাছে নিশ্চয় আপত্তিকর মনে হয়েছিল এতে ব্যবহৃত উপসর্গের কারণে।
তথাপি বাংলা শব্দটিও কালক্রমে বহুল-প্রচলিত হয়ে ওঠে সরকারিভাবে আরোপিত হওয়ার সুবাদে। এ প্রসঙ্গে লক্ষ্যণীয় যে, ‘উপজাতি’ শব্দযুক্ত সুগত চাকমার বইগুলি ছিল সরকারি খরচে প্রকাশিত, পক্ষান্তরে ‘জাতি’-যুক্ত শিরোনামের অন্য বইগুলির সবই ছিল বেসরকারি উদ্যোগে প্রকাশিত।
অশোক কুমার দেওয়ান যদি তাঁর চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার বইটি ‘উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট’ থেকে প্রকাশ করতে চাইতেন, তিনি সে অনুমতি পেতেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়।
উল্লেখ্য, বাংলা একাডেমিসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শিরোনামে ‘উপজাতি’ সম্বলিত বহু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, যেগুলির সাম্প্রতিক সংস্করণগুলিতে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ পদটি শোভা পাচ্ছে, কিন্তু এসব ক্ষেত্রে ‘জাতি’ শব্দযুক্ত কোনো শিরোনাম খুঁজে পাওয়া যায় না।
এখানে যে বিষয়টি ভেবে দেখার মত তা হল, অশোক কুমার দেওয়ানের সময়ে বা আরো আগে চাকমা বা অন্য জাতিদের ‘জাতি’ হিসাবে উল্লেখ করার চল থাকলেও কালক্রমে কিভাবে যেন ‘জাতি’ শব্দটির ব্যবহার মূলত বাঙালিদের জন্য সংরক্ষিত করে ফেলা হয়েছে।
বাঙালি বাদে এদেশের অন্য জাতিদের কী নামে ডাকা যেতে পারে – উপজাতি, জাতিসত্তা, জনজাতি, নৃ-গোষ্ঠী, আদিবাসী নাকি অন্য কিছু – এমন আলোচনাতে প্রায় সময়ই সচেতন বা অসচেতনভাবে ‘জাতি’ শব্দটাকে বিবেচনার বাইরে রাখা হয়।
এই প্রেক্ষাপটে ‘চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার’ শিরোনামের একটি বই নিয়ে যে আমরা আলোচনা করছি, তার একটা ইতিবাচক দিক আছে বলে আমি মনে করি।
এমন চর্চাকে আরো ছড়িয়ে দেওয়ার দরকার রয়েছে, যাতে ‘উপজাতি’ ও ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’র মত একাধারে অবমাননাকর ও বিভ্রান্তিকর বর্গের ব্যবহার কমে গিয়ে ‘চাকমা জাতি’, ‘সান্তাল জাতি’, ‘ম্রো জাতি’, ‘গারো জাতি’ ধরনের শব্দগুচ্ছের কাম্য প্রয়োগ প্রতিষ্ঠিত হয়।
‘জাতি’ শব্দটিকে শুধু বাঙালিদের ক্ষেত্রে ব্যবহারের সাম্প্রতিক প্রবণতা থেকে মুক্ত করার বিপরীতে ‘নৃ-গোষ্ঠী’ পদটিকে অবাঞ্ছিত হিসাবে তুলে ধরা বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের একটি সামষ্টিক কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ এটি বা এর আরেকটি রূপ ‘নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’ বর্গটি ইংরেজি ‘রেইস’ (race) ধারণার প্রতিশব্দ হিসাবে বাংলাদেশে চালু হয়েছে। আসলে খোদ রেইস ধারণা (এবং এর সাথে সম্পর্কিত ‘মঙ্গোলীয়’ ধরনের বর্গ) বাংলাদেশের জাতিগত বৈচিত্র্যের আলোচনা থেকে মুছে ফেলার দরকার আছে।
[৬] কাজেই অশোক কুমার দেওয়ান যখন ‘ইন্দো-মঙ্গোলয়েড’ বর্গ ব্যবহার করে কিছু বলেন, বা সেই প্রেক্ষাপটে প্রিসিলা রাজ মন্তব্য করেন, “তিনি যা বলেছেন ভারত উপমহাদেশে বসবাসকারী মঙ্গোলয়েড জাতিগোষ্ঠীগুলো সম্পর্কে সাধারণভাবে তা খাটে” (২০১৬:৩৭), এসব জায়গার আলোচনা সতর্কতার সাথে পরীক্ষা করে দেখার দরকার আছে, এবং সাধারণভাবে সেগুলির পুনরুৎপাদন পরিহার করাই বাঞ্ছনীয় হবে।
আমাদের আলোচনা শেষ করার আগে চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার করতে গিয়ে অশোক কুমার দেওয়ান যে ধরনের তাত্ত্বিক কাঠামো ও পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন, সে সম্পর্কে একটু মন্তব্য করতে চাই। ইতিহাস বা ভাষাবিজ্ঞানে তাঁর বিশেষ কোনো উচ্চতর প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ হয়তবা ছিল না, কিন্তু এসব বিষয়ে তাঁর যে যথেষ্ট আগ্রহ ছিল এবং তিনি নিজেকে স্বশিক্ষিত করে তুলেছিলেন তা বোঝা যায়।
আর সাধারণভাবে তিনি সবক্ষেত্রেই প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত-সূত্র যাচাই বাছাই করে একাধিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার্য বিষয়ের বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন প্রশ্নের যুক্তিসিদ্ধ মীমাংসায় আসতে চেষ্টা করেছেন।
এদিকে তাঁর ইতিহাস অনুসন্ধানে একটা প্রচ্ছন্ন অনুমান কাজ করেছে বলে মনে হয় যে, ‘চাকমা জাতি’ মূলত একক উৎস থেকে আসা একটি গোষ্ঠী, যা শুধু ঠিকানা ও সাংস্কৃতিক পোশাক পাল্টেছে কালের পরিক্রমায়।
বাস্তবে পৃথিবীর প্রায় সকল জাতির উৎপত্তিই অধিকতর জটিল একটি প্রক্রিয়া, যেখানে সতত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও ‘রক্তধারা’র মিশ্রণ ঘটেছে নানাভাবে।
উল্লেখ্য, ভাষা ও সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানের মিল বা অমিলের ব্যাখ্যা একেক তাত্ত্বিক ধারায় একেকরকম হতে পারে।
যেমন ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানে রয়েছে বিভিন্ন ভাষাকে একটি বৃক্ষের বিবিধ শাখা-প্রশাখা হিসাবে ব্যাখ্যা করার একটি তাত্ত্বিক ধারা (tree model), যার বিপরীতে রয়েছে ‘তরঙ্গ তত্ত্ব’ নামে পরিচিত আরেকটি ধারা (wave model বা wave theory), যেখানে একাধিক ভাষার সম্পর্ক এবং মিল-অমিলকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়।
আবার সময়ের পরিক্রমায় এগুলির আপেক্ষিক গুরুত্ব পাল্টেছে, এবং মিশ্র বা নতুন তাত্ত্বিক ধারাও প্রবর্তিত হয়েছে, যেগুলি বিবেচিত হতে পারে চাকমা ভাষার উৎস নিরূপণেও।
এ নিয়ে বিস্তারিত কোনো আলোচনায় না গিয়ে বিষয়টি এখানে আমি শুধু উল্লেখ করলাম এ কারণে যে, প্রিসিলা রাজ তাঁর গ্রন্থের একেবারে উপসংহার অংশে গিয়ে আমাদের জানাচ্ছেন যে, অশোক কুমার দেওয়ানের বইয়ের প্রতি তাঁর বিশেষ আগ্রহ জন্মানোর একটা কারণ ছিল ভাষাসংক্রান্ত তাঁর ব্যক্তিগত একটি কৌতূহল।
তাঁর ছোটবেলার পরিচিত রংপুরি ধাঁচের ভাষার সাথে চাকমা, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী প্রভৃতি ভাষার মিল তাঁকে আগ্রহী করেছিল সেগুলির সম্ভাব্য ঐতিহাসিক যোগসূত্র সম্পর্কে আরো জানতে, যাঁর অংশবিশেষ অশোক কুমার দেওয়ানের গবেষণায় উদঘাটিত হয়েছে বলে তাঁর মনে হয়েছিল (প্রিসিলা রাজ ২০১৬:১০৬-১০৭)। তবে এই যোগসূত্র ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে ঠিক কী ধরনের অনুমান-তত্ত্ব-পদ্ধতি অনুসৃত হয়েছে, এবং সমকালীন প্রেক্ষাপটে সেগুলি কতটা গ্রহণযোগ্য, তা তলিয়ে দেখার অবকাশ রয়েছে।
অশোক কুমার দেওয়ানের যেসব কথা ব্যাপক মনোযোগ দাবি করে
ইতিহাস চর্চা যে একটি নিরন্তর অনুশীলনের বিষয়, এবং এতে তথ্যপ্রমাণ যে খুব গুরুত্বপূর্ণ, যেগুলি শ্রম দিয়ে নিষ্ঠার সাথে খুঁজে বের করার বিষয়, এ ব্যাপারে অশোক কুমার দেওয়ান সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন।
তবে তিনি বলেন নি যে ইতিহাস চর্চায় অনুমানের কোনো স্থান নেই, বরং তিনি একভাবে এটাই বলেছেন যে, কোনো অনুমান যদি যুক্তিতর্কের মাধ্যমে বা বিপরীত তথ্যপ্রমাণের কারণে বাতিলও হয়ে যায়, সেটির একটা ইতিবাচক দিক আছে এই অর্থে যে, তা নতুন অনুসন্ধানের তাগিদ এনে দেয়।
বিষয়টি তিনি নিজের ভাষায় যেভাবে প্রকাশ করেছেন তাঁর চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার বইটির দ্বিতীয় খণ্ডের শেষ দিকে, তা আমরা নিচের উদ্ধৃতি থেকে দেখে নিতে পারি (১৯৯৩:১০৯):
জাতির অন্ধকারাচ্ছন্ন অতীত থেকে ইতিহাসের সত্য উৎঘাটন করা কঠিন। বিস্মৃত অতীতে সত্যিই কি ঘটেছিল অনুমান করা আর অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়া একই কথা। কিন্তু অনন্যোপায় হয়ে তবু আমরা ঢিল ছুঁড়েছি। সেই নিক্ষিপ্ত ঢিল লক্ষ্য ভেদ করেছে কিনা জানি না, অথবা লক্ষ্যের কাছাকাছি গিয়েছে কিনা জানি না। যে কথা অনেকের মনে ঘোরে, কথায় কথায় ফেরে, আমরা তা’ লিখে প্রকাশ করেছি মাত্র। লাভ? হয়ত কিছুই নেই। হয়ত আছে। এভাবে যে, তা’ অন্যের চিন্তাকে উজ্জীবিত করবে, জানার আকাঙ্খাকে তীব্রতর করবে, তাদের নবতর গবেষণায় প্ররোচিত করবে।
অশোক কুমার দেওয়ান তাঁর চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার গ্রন্থের প্রথম খণ্ড যে কথাগুলি দিয়ে শেষ করেছেন, সেগুলি বর্তমান আলোচনার সমাপ্তি টানার জন্য যথার্থ মনে হয়।
নিচে উদ্ধৃত তাঁর বক্তব্য পড়ার পর আপনিও নিশ্চয় সহমত হবেন যে, এসব কথা ব্যাপক মনোযোগ দাবি করে। চাকমা জাতির ইতিহাসের প্রচলিত একাধিক বৃত্তান্তের পর্যালোচনা শেষে অশোক কুমার দেওয়ান তাঁর প্রথম খণ্ডের উপসংহার টেনেছেন নিম্নরূপভাবে:[৭]
দেখা যায় যে, [আমাদের পর্যালোচিত] দেড় হাজার বছরের ইতিহাস অধিকাংশই ফাঁকা। [এতে] গভীর হতাশায় মুহ্যমান [হতে] হলেও এটিই নির্মম সত্য। এই কঠিন বাস্তবতাকে অস্বীকার করার আমাদের কোন উপায় নেই। দিগভ্রান্ত পথিকের ন্যায় দীর্ঘ ক্লান্তিকর পরিব্রাজন শেষে এতদিনের পরিক্রান্ত পথটিকে যদি নিতান্ত ভুল বলে প্রতীয়মান হয় তবে বিষাদ ক্লিষ্ট [লাগা] স্বাভাবিক। কিন্তু সত্য রূঢ় এবং অপ্রিয় হলেও কখনও অসুন্দর নয়, অশুভ নয়। এতদিনের বালুকায় গড়া সৌধমালা যদি এক নিমিষে ধূলিসাৎ হয় তথাপি তাতে আক্ষেপ করার কিছু নেই। বরং এই ভেবে আনন্দ করা উচিৎ যে, এতদিনের একান্ত মিথ্যা, প্রবঞ্চনা, এতদিনের বিভ্রম আজ ধরা পড়েছে।
আশা করি, ধূলি লুণ্ঠিত ইতিহাসের জঞ্জাল স্তূপ পরিষ্কার করে আগামী দিনের নবীন স্থপতিরা নূতন করে ইতিহাসের ধবল প্রাসাদের ভিত্তি রচনায় ব্রতী হবেন। দিগভ্রষ্ট পূর্বসূরীগণ যে পথ দিয়ে এগিয়েছেন সে পথ পরিত্যাগ করে নূতন ভাবে আবার ইতিহাসের পথের রেখা খুঁজে নিতে হবে। সে পথের রেখা যতই ক্ষীণ হউক, যতি অস্পষ্ট হউক, যতই দুর্লক্ষ্য হউক, আশা করি প্রয়োজনীয় শ্রম এবং যথার্থ নিষ্ঠা সহকারে অনুসন্ধান চালানো হলে সঠিক পথের রেখা একদিন খুঁজে পাওয়া যাবেই। অলীক স্বপ্ন দিয়ে গড়া মায়ার ভুবনে কৃত্রিম স্ফটিকে নির্মিত মনোহর ভবনে বাস করার চাইতে বাস্তব পৃথিবীর কঠিন মাটিতে পত্র পল্লবে ছাওয়া পর্ণকুটিরে বাস করা অনেক শ্রেয়।
উপরে উদ্ধৃত প্রজ্ঞাময় কথাগুলি ঘটনাক্রমে ‘চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার’ করতে গিয়ে বলা হলেও, এগুলি যে কোনো পরিসরে যে কারো ইতিহাস অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে অবশ্য স্মরণীয় ও শিরোধার্য।
একটি গণতান্ত্রিক ও বৈচিত্র্যসমৃদ্ধ দেশ তথা বিশ্বব্যবস্থার স্বপ্ন সামনে রেখে যাঁরা ইতিহাসের চর্চা করেন, তাঁদের সবার অনুসন্ধানের একটি অভিন্ন লক্ষ্য হোক প্রয়োজনে বাস্তবতার ‘পর্ণকুটির’কেই নিজেদের ঠিকানা হিসাবে মেনে নেওয়া। অশোক কুমার দেওয়ানের ইতিহাসচিন্তা এই দিকনির্দেশনাই আমাদের দেয়।
টীকা
[১] এই পোস্টটি ২০১৬ সালের মে-তে রচিত ও প্রকাশিত একটি নিবন্ধের সংক্ষেপিত ও হালগানাগকৃত ভাষ্য। মূল নিবন্ধটির শিরোনাম ছিল ‘অশোক কুমার দেওয়ান: বাস্তবতার পর্ণকুটিরে স্বজাতির ঠিকানা খোঁজায় মগ্ন এক ইতিহাস গবেষক’, যা ছিল ১৩ মে, ২০১৬ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে অনুষ্ঠিত প্রিসিলা রাজ (২০১৬) রচিত চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার ও অশোক কুমার দেওয়ান গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান আলোচক হিসাবে উপস্থাপিত আমার বক্তব্য। লেখাটি arts.bdnews24com-এ ১৯ মে, ২০১৬ তারিখে প্রকাশিত হয়েছিল স্বজাতির ঠিকানা খোঁজায় মগ্ন এক ইতিহাস গবেষক শিরোনামে।
[২] ফেলে আসা দিনগুলির আলোর দিশারীরা শিরোনামের নিবন্ধটি এই ব্লগে রয়েছে, যা লেখা হয়েছিল ২০১২ সালের জানুয়ারিতে পারিবারিকভাবে আয়োজিত একটি আলোচনা অনুষ্ঠানের জন্য।
[৩] এ প্রসঙ্গে দেখুন, ঔপনিবেশিকতার ছায়ায় বাংলাদেশ (প্রশান্ত ত্রিপুরা ২০২০) গ্রন্থে সংকলিত ‘ইতিহাসের মুখোমুখি: নৃবিজ্ঞানের উত্তরঔপনিবেশিক সংকট’ শীর্ষক নিবন্ধ।
[৪] উদাহরণ হিসাবে দেখা যেতে পারে ঔপনিবেশিকতার ছায়ায় বাংলাদেশ (প্রশান্ত ত্রিপুরা ২০২০) গ্রন্থে সংকলিত ‘পাহাড়িপরিচয়ের ঔপনিবেশিক ভিত্তি’ ও ‘জুমিয়া থেকে জুম্ম: পাহাড়ি পরিচয়ের উত্তর-ঔপনিবেশিক রূপান্তর’ শীর্ষক নিবন্ধসমূহ।
[৫] অশোক কুমার দেওয়ানের লেখালেখিতে ‘উপজাতি’ বা ‘উপজাতীয়’ শব্দগুলি যে একেবারে চোখে পড়ে না, কথাটা আমি বলেছিলাম তাঁর চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার বইটির শুধুমাত্র প্রথম খণ্ড পড়ার ভিত্তিতে। তবে দ্বিতীয় খণ্ডে একটু ব্যতিক্রম চোখে পড়েছে, যেখানে এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, “‘জুম’ পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়দের একটা সাধারণ কৃষি পদ্ধতি। এই কৃষি পদ্ধতিকে ব্রহ্মদেশে বলে ‘টঙ্গ্যা’, আরাকানীরা বলে ‘ইয়া’, ত্রিপুরারা বলে ‘হোক’। অন্যান্য উপজাতীয়দের মধ্যে নিজস্ব শব্দ প্রচলিত। চাকমারা ছাড়া এ অঞ্চলে কেউ জুমকে জুম বলে না” (অশোক কুমার দেওয়ান ১৯৯৩:২৫)। এরপর একই পৃষ্ঠায় ‘চাকমা জাতি’ কথাটি দুইবার চোখে পড়ে, যেমনটা তাঁর বইয়ের সবখানেই দেখা গেছে। পক্ষান্তরে ‘চাকমা উপজাতি’ কথাটি তিনি কোথাও ব্যবহার করেছেন, এমন একটি নমুনাও আমার চোখে পড়ে নি।
[৬] এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখা যেতে পারে লেখকের বহুজাতির বাংলাদেশ (প্রশান্ত ত্রিপুরা ২০১৫) গ্রন্থে অন্তর্গত একাধিক প্রবন্ধ, এবং ঔপনিবেশিকতার ছায়ায় বাংলাদেশ (প্রশান্ত ত্রিপুরা ২০২০) গ্রন্থে সঙ্কলিত ‘‘বাঙালির ‘নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ ও ‘হাজার বছরের ইতিহাস’ খোঁজার ইতিবৃত্ত’ শীর্ষক নিবন্ধ।
[৭] অশোক কুমার দেওয়ানের বই থেকে যে উদ্ধৃতি এখানে তুলে ধরা হয়েছে, সেটির অংশবিশেষ আমি উল্লেখ করেছিলাম আমার বন্ধু পুলক জীবন খীসার একটি ফেসবুক পোস্টে। ‘চাকমাজাতির আদিনিবাস সন্ধানে-১’ শীর্ষক সেই পোস্টে মন্তব্য করতে গিয়েই আমি অশোক কুমার দেওয়ান ও তাঁর চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার বইয়ের উপর আমার আগের লেখাটি নতুন করে পড়ে দেখেছিলাম, এবং এতে আমার মনে হয়েছে, লেখাটিকে হালনাগাদ করে আমার ব্লগে দেওয়া যেতে পারে সম্ভাব্য পাঠকদের সুবিধার্থে।
লেখকঃ প্রশান্ত ত্রিপুরা
তথ্যসূত্রঃ
অশোক কুমার দেওয়ান (১৯৯১) চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার [প্রথম খণ্ড], মিসেস দিপীকা দেওয়ান, খাগড়াছড়ি।
—–(১৯৯৩) চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার [দ্বিতীয় খণ্ড], শ্রীমৎ প্রজ্ঞানন্দ মহাথের, রাঙ্গামাটি।
প্রশান্ত ত্রিপুরা (১৯৯৩) আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ ও বাংলাদেশের আদিবাসী জনগণ, ‘আন্তর্জাতিক বিশ্ব আদিবাসী বর্ষ’ উপলক্ষে ডিসেম্বর ১৮, ১৯৯৩-তে ঢাকায় অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারে পঠিত মূল প্রবন্ধ।
—–(২০১৫) বহুজাতির বাংলাদেশ: স্বরূপ অন্বেষণ ও অস্বীকৃতির ইতিহাস, সংবেদ, ঢাকা।
—–(২০২০) ঔপনিবেশিকতার ছায়ায় বাংলাদেশ: এক নৃবিজ্ঞান শিক্ষার্থীর চোখে দেখা স্বদেশের ছবি, সংবেদ, ঢাকা।
প্রিসিলা রাজ (২০১৬) চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার এবং অশোক কুমার দেওয়ান, তাওহিদ উদ্দিন আহমদ, ঢাকা।
বিরাজ মোহন দেওয়ান (২০০৫) চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত [দ্বিতীয় সংস্করণ; প্রথম প্রকাশ ১৯৬৯], উদয় শংকর দেওয়ান, রাঙ্গামাটি।
সুগত চাকমা (২০০৯) পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি, গবেষণা ও প্রকাশনা শাখা, উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, রাঙ্গামাটি।
—–(২০১২) বাংলাদেশের উপজাতি ও আদিবাসীদের সমাজ সংস্কৃতি ও আচার ব্যবহার [তৃতীয় মুদ্রণ; প্রথম প্রকাশ ২০০০], নওরোজ কিতাবিস্তান, ঢাকা
সুপ্রিয় তালুকদার (২০১৩) চাকমা ভাষা, জাতি ও অভিবাসন, মিসেস টুকু তালুকদার, চম্পকনগর, রাঙ্গামাটি।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।