চাকমা জাতির ইতিহাস চর্চা

Jumjournal
Last updated Sep 21st, 2021

2051

featured image

এক :

কোনাে দেশের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনায় দেশের সকল অঞ্চলের ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহ করা একান্ত প্রয়ােজন। ইতিহাস হল একটি অঞ্চলের অতীতের বিবরণী,“ভৌগােলিক বিবরণী, জনগােষ্ঠীর নৃ-তাত্তিক পরিচয়, তাদের সামাজিক রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান, আনন্দ-উৎসব, উৎপাদন রীতি, কৃষি, কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য, হাট-বাজার-মেলা, যােগাযােগ ব্যবস্থা, জনস্বাস্থ্য, শিক্ষাদীক্ষা, ভাষা ও সাহিত্য, স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা, ভূমি রাজস্ব প্রসাশন, বিশিষ্ট ব্যক্তির জীবনে, বিখ্যাত স্থানসমূহের বিবরণী প্রভৃতি বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনা-পর্যালােচনা।” ( রহমান ২০০৮:৭)

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে অবস্থিত রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় যে সকল ক্ষুদ্র নৃগােষ্ঠী বসবাস করেন, তাদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেন চাকমা। তারা কয়েক শতাব্দী ধরে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাস করছেন। নৃতাত্ত্বিক বিচারে তারা এশিয়াটিক মঙ্গোলীয় জনগােষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।

কিন্তু তাদের ভাষা মঙ্গোলীয় গােষ্ঠীভুক্ত নয়, ইন্দো-য়ুরােপিয়ান ভাষা পরিবারভুক্ত। ইতিহাস চর্চায় তারা খুবই মনােযােগী। ইতিহাস জ্ঞানে ও রচনায় অনেকেই নিবেদিত প্রাণ। জাতীয় ইতিহাস চর্চা, রচনা ও প্রকাশনায় তাদের এই সজ্ঞান প্রয়াস ও প্রচেষ্টা অবশ্যই প্রশংসনীয়।

পার্বত্য অঞ্চল ও এখানকার অধিবাসীদের সম্পর্কে উনিশ শতকে ইংরেজীতে লেখালেখি শুরু হলেও বাংলায় শুরু হয়েছে বিশ শতকে। ইংরেজিতে এই সম্পর্কে প্রথমে প্রবন্ধ লিখেন।

Colonel Sir A.Phayra. তাঁর প্রবন্ধগুলাে ১৮৪১ সালে এশিয়াটিক সােসাইটি অব বেঙ্গল-এর ইংরেজি মুখপত্রে প্রকাশিত হয়। এই অঞ্চল সম্পর্কে প্রকাশিত প্রথম পুস্তক হল Henry Ricketts- এর Report on the Wild Tribes of the Chittagong Frontier। বইটি ১৮৫৩ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়।

পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গােষ্ঠী সম্পর্কে লিখিত যে বইগুলাে সর্বাধিক প্রচলিত সেগুলাের লেখক পার্বত্য চট্টগ্রামের চতুর্থ ও ষষ্ঠ জেলা শাসক (১৮৬৬-৬৯, ১৮৭১-৭৪) Colonel Thomas Herbert Lewin, তাঁর রচিত গ্রন্থগুলাে হচ্ছে 1. The Hill Tracts of Chittagong and the Dwellers Therein (Calcatta 1869), 2. Wild Racus of Southern Eestern India (1870) Ges 3. A Fly on the Wheel (1885)

চাকমা জাতির ইতিহাস সম্পর্কে বাংলায় প্রথম প্রবন্ধ লিখেন গগনচন্দ্র বড়ুয়া। তাঁর প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় বিশ শতকের প্রথম দিকে চট্টগ্রামের “জ্যোতি”(বাংলাদেশের প্রথম দৈনিক পত্রিকা) পত্রিকায়।

সতীশচন্দ্র শেষ (১৮৮১-১৯২৯) রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত থাকাকালে চাকমাদের জীবনচর্চার বিভিন্ন উপাদান সংগ্রহ করে চাকমা জাতির ইতিহাস রচনা করেন। কলকাতার প্রবাসী ও ভারতী পত্রিকায় তা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।

১৯০৯ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, কলকাতা থেকে তাঁর ‘চাকমা জাতি’ এটি প্রকাশিত হয়। ১৯১১ সালে বইটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। (সেলিনা ১৯৯৭:৩০১) শতবর্ষ পরে ২০০৯ সালে গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেছেন সােনামনি চাকমা ও মমতা চাবমা নানা দোষ-ক্রটির কথা স্বীকার করেও একথা নির্দ্বিধার বলা যায় যে চাকমা জাতি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচনায় সূত্রপাত এ গ্রন্থ থেকেই শুরু। উল্লেখ্য ১৯০৯ সালে RHS Hntchinson সম্পাদিত chittagong Hill Tract District Gazzette প্রথম প্রকাশিত হয়।

Chakma Royal Palace, Rangunia
প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত রাঙ্গুনিয়ায় রাজানগরের চাকমা রাজবাড়ি, ছবি: কালেরকণ্ঠ

দুই :

চাকমা জাতির মধ্যে (এবং পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীদের মধ্যে ) ইতিহাস চচআর সূচনা করেন রাজা ভূবন মােহন রায় (১৮৭৬-১৯৩৩)। ১৯১৯ সালের ১৮ অক্টোবর তার লেখা “চাকমা রাজ বংশের ইতিহাস” প্রকাশিত হয়। বইটি চাকমা জাতির পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস নয়। এতে ধারাবাহিক ভাবে আটচল্লিশ জন চাকমা রাজার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি বর্ণিত হয়েছে। একই বছর লেখক পুস্তকটি ইংরেজী সংস্করণ History of the Chakma Raj Family প্রকাশ করেন।

রাঙ্গামাটি চাকমা রাজবাড়ি থেকে ১৩৪৩ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে (১৯৩৬ খ্রি:) প্রকাশিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের সাময়িক পত্রিকা “গৈরিকা”। এই পত্রিকায় এ অঞ্চলের ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিষয়ক কয়েকটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।

প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যায় (কার্তিক ১৩৪৩ বঙ্গাব্দ) প্রকাশিত হয় রাজা নলিনাক্ষ রায়ের প্রবন্ধ A Brief Sketch of the History and Natural aspects of the Hill Tracts. চাকমা ভাষা ও সাহিত্যেও ইতিহাস বিষয়ক প্রথম প্রবন্ধ বিপুলেশ্বর দেওয়ানের (১৯১৬-?) চাকমা ভাষা ও সাহিত্যের একদিক’ প্রকাশিত হয় চতুর্থ বর্ষ পঞ্চম সংখ্যায় (অগ্রহায়ন ১৩৪৬ বঙ্গাব্দ)।

অষ্টম বর্ষ নবম সংখ্যায় (অগ্রহায়ন ১৩৫০ বঙ্গাব্দ) প্রকাশিত হয় কুমার কোকনদাক্ষ রায়ের প্রবন্ধ Chiefs of the chittagong Hill Tracts. প্রবন্ধটি এক বছর আগে ১৯৪২ সালের ৬ ডিসেম্বর কলকাতার The Sunday Stateman-এ প্রকাশিত হয়েছিল। নববর্ষ দশম সংখ্যায় (মাঘ ১৩৫১ বঙ্গাব্দ) প্রয়াত রাজা ভূবন মােহন রায়ের History of the Chakma Raj Family পুনঃ প্রকাশিত হয়।

দশম বর্ষ একাদশ সংখ্যায়। (মাঘ ১৩৫২ বঙ্গাব্দ) প্রকাশিত হয় নীরদ রঞ্জন দেওয়ানের প্রবন্ধ প্রাতঃস্মরণীয়া কালিন্দী রাণী । একাদশ বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যায় (অগ্রহায়ন ১৩৫৩) প্রকাশিত নীরদ রঞ্জন দে “পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীর আয় ব্যয়ের ধারা অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ” এখানকার অর্থনীতির ইতিহাস রচনার প্রথম সজ্ঞান প্রয়াস।

‘গৈরিকা’ সর্বশেষ সংখ্যায় (১৯৫১) প্রকাশিত হয় রাজেন্দ্র নাথ তালুকদারের প্রবন্ধ “চাকমাদের আদি বাসস্থান”। এই প্রবন্ধে সংক্ষেপে চাকমা জাতির আদি বাসস্থান সম্পর্কে আলােকপাত করা হয়েছে ।ওয়ানের প্রবন্ধ ক্যাপ্টেন রাজকুমার ত্রিদিব রায় (পরে রাজা) রচিত Tribal of the Chittagong Hill Tracts ১৯৫১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। (ইসহাক ১৯৭১: ২১৯)।

মাধব চন্দ্র চাকমা কর্মীর (১৮৯১-?) “শ্রী শ্রী রাজনামা বা চাকমা জাতির ইতিহাস’ ১৯৪০ সালে প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থে লেখক চাকমা জাতির প্রাচীন ইতিহাস, চাকমা নামের উৎপত্তি, চাকমা রাজবংশের হতিহাস, চাকমা জাতির প্রাচীন ধর্মশাস্ত্র, ধর্ম সংস্কার চাকমা জাতি ও শিক্ষা বিস্তার, ছাড়াও পার্বত্য ত্রিপুরায় (ত্রিপুরা রাজ্য, ভারত) বসবাসরত চাকমাদের সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।

জুম্ম জনগণের লড়াই সংগ্রাম
চাকমা রাজ্যের অবস্থান

তিন :

১৯৬২ সালে প্রকাশিত হয় নােয়রাম চাকমার (?-১৯৭৮) “পার্বত্য রাজপহরী”। লেখক চাকমা রাজন্য বর্গের ইতিহাস বিংশতি লহরে অর্থাৎ বিশ অধ্যায়ে সমাপ্ত করেছেন। চাকমা জাতির আদি ইতিহাস, প্রত্যেক শাসকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, রাজবংশ তালিকা, জাতীয় জীবনের উত্থান-পত্তন, দুঃখ-কষ্ট, বহিঃশত্রুর সাথে যুদ্ধ বিগ্রহ প্রভৃতি এ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। লেখকের বর্ণানাশক্তি ও সৃজনী প্রতিভার পরিচয় এ গ্রন্থে পাওয়া যায়।

১৯৬৬ সালে বান্দরবান থেকে প্রকাশিত হয় ত্রৈমাসিক ধারণা। এই পতিকার প্রথম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা (মার্চ ১৯৬৭) ও চতুর্থ সংখ্যায় (জুন ১৯৬৭) প্রকাশিত হয় বঙ্কিম কৃঞ্চ দেওয়ার (১৯১৭-১৯৯১) “চাকমা জাতির ইতিহাস”। প্রবন্ধটি আকারে নাতিদীর্ঘ হলেও সুলিখিত, তথ্যপূর্ণ ও সাবলীল রচনা।

১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে রাঙ্গামাটি থেকে প্রকাশিত হয় বিরাজমােহন দেওয়ান সম্পাদিত মাসিক “পার্বত্য বাণী” । এই সাময়িক পত্রে বিরাজ মােহন দেওয়ানের ইতিহাস বিষয়ক পাঁচটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।

প্রথম বর্ষ নবম সংখ্যায় (সেপ্টেম্বর ১৯৬৮) “চাকমা জাতির প্রাচীন সভ্যতা”; দ্বাদশ সংখ্যা (ডিসেম্বর ১৯৬৮) ও দ্বিতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যায় (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯) “চাকমা জাতির পরিচয়”; দ্বিতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা (মার্চ ১৯৬৯) থেকে ষষ্ঠ সংখ্যায় (জুলাই ১৯৬৯) “চাকমা জাতির পরিচয় ক্ষেত্রে তথ্যমূলক বিবরণ; দ্বিতীয় বর্ষ অষ্টম সংখ্যায়।

(সেপ্টেম্বও ১৯৬৯) “চাকমা জাতির প্রাচীন রাজবংশের ইতিহাস” এবং নবম সংখ্যায় “সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকের পার্বত্য চট্টগ্রাম” প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ১৯৬৯ সালেই চাকমা জাতি সম্পর্কে প্রথম সুলিখিত ও বিস্তারিত গ্রন্থ বিরাজ মােহন দেওয়ানের (১৯০১-১৯৭৬) “চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত” প্রকাশিত হয়।

গ্রন্থটি বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ কর্তৃক পুরস্কৃত হয়। “চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত” গ্রন্থের চারটি অধ্যায়ে পরিচ্ছেদ সংখ্যা যথাক্রমে ৪+৪+৩+৪=১৫টি। গ্রন্থের ভূমিকায় তৎকালীন চাকমা চীফ রাজা ত্রিদিব রায় লিখেছেন, “চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত-নামে যে বইটি তিনি রচনা করিয়েছেন, তাহাতে রাজবংশের প্রাচীন ইতিহাসের সহিত জাতির প্রাচীন ঘটনাগুলি সংযােজিত হওয়ায় জাতির ইতিহাসের গুরুত্ব বৃদ্ধি করিয়াছে এবং জাতীয় কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও জাতীয় চরিত্রের ভাবগুলি মূর্ত হইয়াছে।”

গ্রন্থের সূচনায় আছে “পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার ভৌগােলিক বিবরণ”। প্রথম অধ্যায়ে আলােচিত হয়েছে চাকমা জাতির প্রাচীন সভ্যতা, চাকমা বর্ণমালা, জাতীয় পরিচয়, শারীরিক গঠন, চাকমা জাতির পরিচয় সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ, চাকমা জাতির পরিচয় ক্ষেত্রে তথ্যমূলক বিবরণ এবং চাকমা জাতির শ্রেণী বিভাগ।

দ্বিতায় অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে চাকমা জাতির প্রাচীন রাজবংশের ইতিহাস, রাজ্য বিজয় ও বিস্তৃতি; রাজা অরুণযুগের পতন, রাজা মানেকগিরি, বাঙ্গলা ‍ও আরাকান সীমান্তর ইতিহাস, রাজা কদম যংজা, রাজা রদংসা, রাজা তৈন সুরেশ্বরী, রাজা জনু, রাজা সাত্তুয়া, রাজা ধাবান, রাজা ধরম্য, রাজা মোগল্য, রাজা সুলভ খাঁ, রাজা ফতে খাঁ এবং রাজা সেরমুস্ত খাঁ। তৃতীয় অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকের পার্বত্য চট্টগ্রাম, বৃটিশ শাসন, রাজা শুকদের রায়, রাজা সের দৌলত খাঁ, রাজা জানবক্স খাঁ, রাজা টব্বর খাঁ, রাজা জব্বর খাঁ,

রাজা ধরমবক্স খাঁ, রাজমহিষী রাণী কালিন্দী, রাজা হরিচন্দ্র রায়, রাজা ভূবন মােহন রায়, রাজা নলিনাক্ষ রায়, পাকিস্তান, মেজর রাজা ত্রিদিব রায়, রাজা দেবাশীষ রায় (এই অংশ দ্বিতীয় সংস্করণে প্রকাশক সংযােজন করেছেন), এবং জুমচাষ।

চতুর্থ অধ্যায়ে আলােচিত হয়েছে বংশধারা, থানমানা পুমা, বুর পারাপুমা, চুগুলাং পুজা, বিবাহ, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, হাড়ভাসান, শ্রাদ্ধ, রথটাানা, ভাদ্যা, জাতীয় চরিত্র, জাতীয় পােশাক পরিচ্ছদ, খেলাধুলা ও বিবিধ, ধাঁধা, প্রবচন, চড়া ও প্রাচীন গণনা পদ্ধতি, মাদকদ্রব্য, প্রাচীন লােকসাহিত্য গােজেন লামা বা গোঁসাই পালা, গান কবিতাবলী, বারমাসী-মেয়াধী বারমাস, চাটিগাং ছাড়া পালা, পকথা সুদুত্তপি ও খচ্যবেঙ, জামাই সারনী উপাখ্যান, ধর্ম, আগরতারা (প্রাচীন ধর্ম শাস্ত্র), সংক্ষেপে তারাগুলির ব্যবহার। নির্দেশ ত্রিপিটক, ঘর (বাড়ী)। বইটির কিছু বিষয়ে মতভেদ থাকলেও চাকমা জাতি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থের প্রথম রচয়িতা হিসেবে বিরাজমােহন দেওয়ান স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত” গ্রন্থের পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত দ্বিতীয় সংস্করণ লেখক নিজে তৈরী করে গেলেও তা প্রকাশিত হয়েছে ২০০৫ সালে। লেখকের আত্মজ ডাক্তার উদয় শংকর দেওয়ান গ্রন্থটি প্রকাশ করেছেন। গ্রন্থের লেখক নিজেই পঞ্চম অধ্যায় সংযােজন করে দিয়ে। পান্ডুলিপি তৈরী করেছিলেন।

পঞ্চম অধ্যায় আলােচিত হয়েছে উপজাতীয় প্রধান চীফ (রাজা), দেওয়ান (রােয়াজা) ও হেডম্যান; চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চল শাসনার্থ নিয়মাবলীর সংশােধন পত্র, চাকমা চীফ, দেওয়ান ও হেডম্যানদের সংক্ষিপ্ত জাতীয় আইন এবং সমাজবিধি, চাকমার জাতীয় বিচার ও সমাজবিধির সংক্ষিপ্ত বিবরণ এবং চাকমা জাতীয় প্রথামতে বিত্ত সম্পত্তির প্রথা। গ্রন্থের পরিশিষ্টতে আছে প্রাচীন রাজবংশের ঘটনাপঞ্জী।

১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয় কামিনী মােহন দেওয়ানের (১৮৯০-১৯৭৬) আত্মকথা “পার্বত্য চট্টলের এক দীন সেবকের জীবনকাহিনী”। গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে চাকমা জাতির সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত বর্ণিত হয়েছে।

রাজপ্রতীক সমেত বর্তমান চাকমা রাজ কার্যালয়ের নাম ফলক, রাজবাড়ি, রাঙামাটি। ছবিটি লেখক কর্তৃক তোলা।
চিত্র ৬.২ : রাজপ্রতীক সমেত বর্তমান চাকমা রাজ কার্যালয়ের নাম ফলক, রাজবাড়ি, রাঙামাটি। ছবিটি লেখক কর্তৃক তোলা।

চার :

স্বাধীনতা উত্তরকালে ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ বেশ কয়েকটি প্রকাশিত হয়েছে। তথ্যপূর্ণ প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়েছে।

সমর গিরি (তারাচরণ চাকমা)-এর “স্মৃতির আলােকে” গ্রন্থে “পার্বত্য চট্টগ্রামের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত” নামে একটি অধ্যায় স্থান পেয়েছে।

সুগত চাকমা (জন্ম ১৯৫১) তরুণ বয়সেই ইতিহাস চর্চায় আত্মনিয়ােগ করেন। তাঁর প্রবন্ধ “শাক্য থেকে চাকমা, মগধ থেকে রাঙ্গামাটি প্রকাশিত হয়েছে চট্টগ্রামের অর্থনীতি বিভাগের একুশে সংকলন “উদ্ভাসিত বিষাদ”-এ।

এ প্রবন্ধ লেখক চাকমা শব্দের ও চাকমা ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে নিজস্ব অভিমত প্রকাশ করেছেন। লেখকের “চাকমাদের ইতিহাস” প্রবন্ধ চট্টগ্রাম বিশ্ববদ্যালয় বার্ষিকীতে (১৯৭৫) প্রকাশিত এবং ১৯৭৮ সালে সাপ্তাহিক “বনভুমি” পত্রিকায় পূর্ণমুদ্রিত হয়েছে। “বনভূমি”তে প্রকাশিত সুগত চাকমার আরাে দুটি উল্লেখযােগ্য প্রবন্ধ হচ্ছে।

“ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে চাকমাদের চাদিগাঙ ছারা পালা (১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর ১৯৭৮) এবং পবিত্য চট্টগ্রামের পাহাড় ও নদী শব্দগুলির উৎপত্তি কথা (২৬ মার্চ ১৯৭৯)।

ইতিহাস বিষয়ক সুগত চাকমার আরও কয়েকটি উল্লেখযােগ্য প্রবন্ধ হল- ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস’ (উপজাতীয় গবেষণা পত্রিকা ১৯৮৪), ‘চাকমাদের ইতিহাস’ (গিরিবার্তা ১১-১৮ নভেম্বর ১৯৮৪), ‘ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে রাঙ্গামাটির নামকরণ’ (সাপ্তাহিক রাঙ্গামাটি, ৩১ মে ১৯৮৫), ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির রূপরেখা’ (গিরিনির্ঝর ১৯৮৮) এবং ড. জাফর আহমদ খান সম্পাদিত ‘রাঙ্গামাটি বৈচিত্র্যের ঐক্যতান’ (২০০৮) গ্রন্থে ‘সংস্কৃতি উৎসব ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড’ ইত্যাদি।

তাঁর মুক্তিযুদ্ধ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম (জাক’র বর্ষপূর্তি সংকলন ২০০৪) প্রবন্ধে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্যবাসীদের অবদান সংক্ষেপে ব্যক্ত হয়েরছ। সুগত চাকমার কয়েকটি গ্রন্থের কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখযােগ্য। তাঁর ‘চাকমা পরিচিতি(১৯৮৩) গ্রন্থে আলােচিত হয়েছে ক. চাকমা পরিচিতি, খ. ইতিহাস ও ইতিকথা, গ. সমাজ ও সংস্কৃতি এবং ঘ. ভাষা ও সাহিত্য।

চাকমা জাতির সমাজ, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ভাষা ও সাহিত্যে ও ইতিহাস রচনায় সুগত চাকমা নিবেদিতপ্রাণ লেখক। তাঁর বাংলাদেশের উপজাতি’ (১৯৮৫) গ্রন্থটি বাংলা একাডেমী প্রকাশিত ভাষা শহীদ গ্রন্ত্রমালার অন্তর্ভুক্ত। এই গ্রন্থে চাকমা জাতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও পরিচিতি স্থান পেয়েছে। তার পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি ও সংস্কৃতি (১৯৯৩) বাংলাদেশের উপজাতি ও আদিবাসীদের সমাজ সংস্কৃতি,আচার ব্যবহার (২০০০) গ্রন্থে। ও চাকমা জাতি সম্পর্কে দীর্ঘ আলােচনা আছে।

পার্বত্য অঞ্চলে চাকমাদের পাশাপাশি বাস করে একটি ক্ষুদ্র নৃগােষ্ঠী ‘চাক’। অনেকে চাকদের চাকমা বলে ভুল করেন। এই দুই সম্প্রদায়ের নাম ও ইতিহাস নিয়ে বিভ্রান্তি দূরীকরণের চেষ্টা পরিচালিত হয় সুগত চাকমার “চাকমা ও চাক ইতিহাস আলােচনা” (২০০০) গ্রন্থে।

গ্রন্থের আলােচ্য বিষয় হল-শাক চাকমা এবং চাকদের নামগত সম্পর্ক আলােচনা, শাক্যদের নৃতাত্বিক পরিচয়, শাক শব্দের উৎপত্তি এবং চাকমাদের নৃতাত্বিক সাংস্কৃতিক দল ভাষা ও ঐতিহ্যের পরিচয়; শাক্যদের ইতিকথা; চাকদের ইতিকথা; চাকদের আদিবাস ও য়ুনানের জিনু ও পশ্চিমী সাক (১০ম শতাব্দী থেকে ১৪শ শতাব্দী পর্যন্ত); চাকদের পূর্বদলের সাথে আরাকানের সংঘর্ষ এবং আরাকান কর্তৃক সাধেংগিরি বিজয়; চাকমাদের সাক নানা লেখকের মতামত ও চাকমা আদি বাসস্থান সম্পর্কে কিংবদন্তি; চাকমা ইতিহাস (ষােড়শ শতাব্দী) এবং “চাকমা ইতিহাস” (অষ্টাদশ শতাব্দী)।

সগত চাকমার “বাংলাদেশের চাকমা ভাষা” সাহিত্য (২০০২) চাকমা জাতির ভাষা ও সাহিত্যের। ইতিহাস বিষয়ক একমাত্র গ্রন্থ। গ্রন্থে চাকমা ভাষা পরিচিতি, লােকসাহিত্য, কবিতা, নাটক ও গল্প সম্পর্কে আলােচনা আছে।

তাঁর “পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি” (২০০৯) গ্রন্থে আলােচিত হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল পরিচিতি; পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ইতিকথা; পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিসমূহের নাম জনসংখ্যা ও বসতি এলাকা; পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি ও কুকি চীন ভাষাভাষী উপজাতিসমূহ; পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপজাতিসমূহের সমাজব্যবস্থা ও সামাজিক কাঠামাে এবং উপজাতিদের ভাষা।

বাংলাদেশ এশিয়াটিক সােসাইটি প্রকাশিত “আদিবাসী জনগােষ্ঠী” (বাংলাদেশ সংস্কতিক রীক্ষামালা-৫,২০০৭) গ্রন্থের অন্যতম সম্পাদক সুগত চাকমা। ঐ গ্রন্থের “চাকমা” অধ্যায়টি তাঁর রচিত।

যামিনী রঞ্জন চাকমা ১৯৭৮ সালে “সাপ্তাহিক বনভূমি’তে ইতিহাস বিষয়ক দুটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন। তাঁর প্রবন্ধ দুটি হচ্ছে “রাজর্ষি সাধেংগিরি ও চাকমা জাতি” (প্রথম পর্ব-ইতিবৃত্ত; ১৫ ও ২২ অক্টোবর) এবং “রাজর্ষি সাধেংগিরির সঙ্গে চাকমা জাতির সম্পর্ক” (২৯ অক্টোবর, ৫ ও ১১ নভেম্বর)। তিনি ১৯৯৩-১৯৯৬ সালের মধ্যে “চাকমা দর্শন” নামে একটি পুস্তকের চার খন্ড প্রকাশ করেছেন। শেষ বয়সে তিনি ইতিহাস চর্চায় নিয়ােজিত থেকে সফিল্য অর্জন করেছেন।

মুরাল্যা লিটারেচার গ্রুপ (আলবেরুনী হল, জাহঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়) প্রকাশিত “কজলি” (১৯৭৮) সংকলণে প্রকাশিত হয়েছে সিচিকো চাকমার প্রবন্ধ “চাকমাদের ইতিকথা” সুহৃদ চাকমা (১৯৫৮-১৯৮৮) “চাকমাদের চম্পক নগর, দৈহিক নৃতত্ত্ব ও নন্দন ও সংস্কৃতি গবেষণা এবং কিছু বিভ্রান্তিকর সমস্যা” (বনভূমি ১৪,২১ও ২৮ মে ১৯৭৮) প্রবন্ধে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিস্তারিত আলােচনা করেছেন।

তাঁর “চাকমা জাতির ইতিহাসে মােগল প্রভাব” (জাহঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় বার্ষিকী ১৯৮১) প্রবন্ধটি ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযােগ্য রচনা। লেখকের নিরপেক্ষ ও নির্মোহ বিশ্লেষণ প্রশংসনীয়। তাঁর “চাকমা সাহিত্যের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ” (আলবেরুনী হল বার্ষিকী ১৯৮০) চাকমা সাহিত্যের ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে পথ প্রদর্শক।

বঙ্কিমকৃঞ্চ দেওয়ান-এর “চাকমা জাতীয় বিচার পদ্ধতি প্রবন্ধটি নন্দলাল শর্মা সম্পাদিত “অঙ্কুর” (রাঙ্গামাটি সাধারণ পাঠাগার ১৯৮১) সংকলনে প্রকাশিত হয়। তাঁর “চাকমা জাতীয় বিচার” প্রকাশিত হয় “উপজাতীয় গবেষণা পত্রিকা”(১৯৮২) য়। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর গ্রন্থ “চাকমা জাতীয় বিচার পদ্ধতি ও উত্তরাধিকার প্রথা”।

সলিল রায়ের “চাকমাদের গঝা ও গত্তি প্রসঙ্গ” ১৯৮১ সালে “অঙ্কুর”-এ প্রকাশিত হয়। জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমার “চাকমাদের উত্তরাধিকার প্রথা প্রবন্ধটিও ১৯৮১ সালে “অঙ্কুর”-এ প্রকাশিত হয়। ১৯৯১ সালে প্রকাশিত হয় জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমার গ্রন্থ “তিন পার্বত্য জেলায় স্থানীয় সরকার পরিষদ ব্যবস্থা: ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতা” (১৯৯১)।

গ্রন্থটির পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে “ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পার্বত্য স্থানীয় সরকার পরিষদ” নামে ১৯৯৩ সালে। গ্রন্থে আলােচিত বিষয়-পার্বত্য অঞ্চলের ঐতিহাসিক পটভূমি কাপ্তাই বাঁধ ও কাপ্তাই কৃত্রিম জলাশয়, মাটি ও ভূমি ব্যবহার জরিপ; পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন প্রকল্প, মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রাম, জুম্ম জাতীয়তাবাদ ও জনসংহতি সমিতির উত্থান, সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে সরকারী উদ্যোগ, শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জেনারেল এরশাদের উদ্দ্যোগ, জনসংহতি সমিতির সাথে আলােচনার সরকারী উদ্দ্যোগ, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন প্রকল্প (বহুমুখী) : প্রেক্ষাপট, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বাের্ডের কার্যক্রম, পুনর্বাসিত বাঙ্গালী ও উপজাতীয়দের মধ্যে বিরােধের সূত্রপাত, সমস্যা সমাধানের জন্য উপজাতীয় নেতাদের উদ্যোগ, সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে সংলাপ, উপজাতীয় নেতাদের সাথে জাতীয় কমিটির সংলাপ, স্থানীয় সরকার পরিষদ ব্যবস্থা, তত্ত্ব ও প্রয়ােগ, জনসংহতি সমিতির পাঁচ দফা দাবী এবং স্থানীয় সরকার পরিষদ ব্যবস্থার তুলনামূলক আলােচনা এবং ৯ই জুন ১৯৯১ ইং তারিখের পরবর্তী অবস্থা।

ইতিহাস বিষয়ে জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমার প্রকাশিত আরাে দুটি উল্লেখযােগ্য প্রবন্ধ হচ্ছে “চাকমাদের ইতিহাস ; ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি চেতনা” (শিঙোর, জাক বিঝু সংকলন ২০০১) এবং “চাকমাদের অভিজাত শ্রেণীর উদ্ভব, বিকাশ ও বিবর্তন” ত্যেঠা (জাক বিঝু সংকলন ২০০৮)।

প্রয়াত প্রানহরি তালুকদার (প্রকৃত নাম প্রানেন্দ্র মােহন তালুকদার )-এর “চাকমা জাতি ও চাকমা রাজবংশের ইতিহাস” ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থে আলোচিত বিষয়-চাকমা জাতির উৎপুত্তি: রাজা ভীমজয় ও সেনাপতি কালাবাঘ : যুবরাজ বিজয়গিরি, অরুণযুগ ইত্যাদি।

অশােক কুমার দেওয়ান (১৯২৬-১৯৯১)-এর গবেষণা প্রবন্ধ “চাকমা জাতির ইতিহাসে অষ্টাদশ শতক” ১৯৮২ সালে উপজাতীয় গবেষণা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯৯১ সালে তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়েছে তাঁর গ্রন্থ “চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার” (প্রথম খন্ড) গ্রন্থে আলােচিত বিষয়ভূমিকা, চাকমা জাতির ইতিবৃত্তকারগণ, ঐতিহাসিক উপাদানের অভাব, চাকমা জাতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, ইতিহাসের সূত্র, সূত্রগুলির দুর্বলতা, আরাকান কাহিনী, বামনী লিপি ও হাতে লিখা বিজক, কাহিনী স্রষ্টা ব্রাহ্মণ পন্ডিত, ইতিহাসের অসম্মতি, কুলগৌরব ও সভাকবির ভূমিকা, পৌরাণিক কাহিনী, ইতিহাসে পুরানের প্রভাব, ইতিহাস বনাম পুরাণ কাহিনী, বিজয়গিরির রাজ্যভিযান ও লােকগাথা রাধামহন-ধনপুদির রচনাকাল, বিজয়গিরি আখ্যোয়িকার ঐতিহাসিক মূল্য, রাজা সিরিত্তমা প্রসঙ্গ, ব্রহ্ম আরাকান ইতিহাস ও দেক্ষ্যাওয়াদি আরেদ ফুং, পুগান রাজা আলংছিসুর বিরুদ্ধে চাকমাগণের যুদ্ধ, ব্রহ্মরাজ আলম প্রা’র বাঙ্গালী বিজয়, মাতামুহুরী মােহনার যুদ্ধ, রাজা ইয়াংজ বা অরুণ যুগ, চাকমা জাতির ইতিহাস, চাকমা, চাক ও সাক পরিচয়, বাংলার আরাকান সীমান্তে এবং ইতিহাস সমীক্ষার ফলাফল। গ্রন্থটির দ্বিতীয় খন্ড ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে।

চাকমা জাতির ইতিহাস চর্চায় তার সাফল্য প্রশ্নাতীত। অতীতের ভুলভ্রান্তি নিরসন করে। তিনি নতুন আলাে প্রক্ষেপণ করে চাকমা জাতির ইতিহাস চর্চায় নতুন সুর সংযােজন করেছেন।

উপজাতীয় গবেষণা পত্রিকায় (১৯৮২) প্রকাশিত অমরেন্দ্র লাল খীসার “পার্বত্য চট্টগ্রামে জুমচাষ : অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ” এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক ইতিহাস চর্চার এক মূল্যবান দলিল।

সুপ্রিয় তালুকদারের ‘চাকমা সংস্কৃতির আদিরূপ প্রবন্ধ ‘গিরিনিৰ্বর’- এ প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে। লেখকের ‘চাকমা সংস্কৃতির আদিরূপ’ (১৯৮৭) গ্রন্থ আলােচিত হয়েছে-নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে চাকমা জাতি; ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতি; ঐতিহাসিক কিছু তথ্য এবং উপসংহার ।

পরবর্তী কালে সুপ্রিয় তালুকদার চাক্‌মা জাতির ইতিহাস বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থটির নাম ‘চম্পকনগর সন্ধানে: বিবর্তনের ধারায় চাকমা জাতি’ (১৯৯৯)। এতে আছে চারটি অধ্যায়। প্রথম অধ্যায়ে আলােচিত হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও তার আদিবাসী, পৌরণিক উপাখ্যান ও নৃবিজ্ঞান, শাক্য বংশের উৎপত্তি ও বিস্তৃতি, নির্ভরযােগ্য তথ্য ও ঘটনা প্রবাহ, চাক ও চাকমা এবং চাকমা রাজ বংশ।

দ্বিতীয় অধ্যায়ে ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতি; তৃতীয় অধ্যায়ে চাকমা জাতির। পরিচয় ও ঘটনাপঞ্জি এবং চতুর্থ অধ্যায়ে জীবন বৈচিত্র্য-সমাজ ব্যবস্থা ও বিচার কাঠামাে, খাদ্যভাস, জুমচাষ, প্রবাদ, বাসগৃহ; সামাজিক আচার অনুষ্ঠান গঝা ও গুত্তি, নৃত্য ও গীত, বাদ্যযন্ত্র, অলংকার এবং খেলাধুলা আলােচিত হয়েছে। ২০০৪ সালে জেলা প্রশাসন প্রকাশিত ‘রাঙ্গামাটির বৈচিত্র্যের ঐক্যতান’ গ্রন্থে তিনি ঐ জেলার বৈচিত্র্য ও জনজীবন বিষয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন।

সঞ্জয় চাকমার ‘শাক্য থেকে চাকমা বাংলাদেশের উপজাতি’ প্রবন্ধটি ১৯৮৪ সালে বিজয় দিবস সংকলন ‘গিরিসূর্য’ তে প্রকাশিত হয়েছে।

হরি কিশাের চামা সভ্যতার ক্রমবিকাশ : চাকমা জাতি প্রেক্ষিত’ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে। জাক- এর বিঝু সংকলন ‘এক ঝাঁক বিজোল রােদ’ (১৯৮৬)- এ।

ডাক্তার ভগদত্ত খীসার ‘চাকমা তালিক চিকিৎসা’ (১৯৯৬) গ্রন্থটি চাকমা জাতির চিকিৎসা শাস্ত্র বিষয়ক গ্রন্থ। চাকমা জাতির ঐতিহ্যের একটি অনালােচিত ও অনালােকিত দিককে তিনি গ্রন্থিত করে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন।

চিত্রসেন খীসা (?-১৯৮৩) সংকলিত ‘বেগ গােজা বগিলা গােষ্ঠীর পরিচয় ১ম খন্ড’ (১৯৯৬) প্রকাশ করেছেন লেখকের পুত্র আদিরতন খীসা। পারিবারিক ইতিহাস হিসেবে গ্রন্থটি উল্লেখযােগ্য। গ্রন্থে চা গােজা ও গােষ্ঠীর উৎপত্তি, বগিলা গােষ্ঠীর আদিপুরুষ পরিচয় এবং নয়ন খাঁ খীসার পাঁচ পুত্রের বংশ পরিচয় এবং আদল খাঁ খীসার বংশ পরিচয় স্থান পেয়েছে।

বঙ্কিমচন্দ্র চার ‘চাকমা সমাজ ও সংস্কৃতি’ (১৯৯৮) গ্রন্থটি চাকমা জাতির ইতিহাস চর্চায় একটি মূল্যবান সংযােজন। গ্রন্থে আলােচিত হয়েছে চাকমার বৈশিষ্ট্য, চাকমাদের ধর্ম, বিঝু বা বিঝু উৎসব, চাকমাদের তালিক শাস্ত্র, চাকমা ভাষা, চাকমার অক্ষর বা বর্ণমালা, চাকমাদের লােক সাহিত্য, শিল্প, পােষাক-পরিচ্ছেদ, অলংকার, ব্যবসা-বাণিজ্য, জীবিকা, খারা (খেলাধুলা), বাদ্যযন্ত্র, নাচ ও গান, পিদা (নাস্তা), মদ, জগরা, আরম অস্ত্র ও রান্নার সামগ্রী, ঢেঙি (টেকি), চাকমা জাতির শ্রেণীবিভাগ, চাকমাদের গােজা-গােষ্ঠী (গােত্র), জ্ঞাতি সম্পর্ক, বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের বিধান, অবৈধ বিবাহ, বিবাহ পদ্ধতি, চুমুলাঙ, বিবাহ ঘটিত ও অন্যান্য অপরাধ ও শাস্তি, ছাড়াছাড়ি বা বিবাহ বিচ্ছেদ, অবৈধ বিবাহ ঘটিত জাতীয় বিচার পদ্ধতি, অভিভাবক নির্ণয়, উত্তরাধিকার নীতি, শবদাহ বা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, সাতদিন্যা বা সাপ্তাহিক ক্রিয়া বা শ্রাদ্ধ, গাড়িটানা, বজরি (বাৎসরিক শ্রদ্ধ), মালেইয়্যে ডাকা, রাস্তাঘাট নিয়ন্ত্রণ, নােয়া বা নতুন ভাত, ছেলেমেয়েদের জন্মােৎসব, সুচিতা, ফি বলা (অমঙ্গল), নরম ও ছােট ডিম পাড়া, ভারাল (অন্ত্র), শুভাশুভ নির্ণয়, চন্দ্র গ্রহণ ও সূর্যগ্রহণ এবং রাজ শাসন পদ্ধতি।

কুমুদ বিকাশ চাকমা (জন্ম ১৯৩৫) এর ‘শিক্ষাঙ্গনে চাকমা জাতির অগ্রগতি’ (১ম খন্ড) গ্রন্থটি ১০০২ সালে প্রকাশিত হয়েছে । পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষার ইতিহাস বিষয়ে এটি একমাত্র গ্রন্থ। গ্রন্থের পাঁচটি অধ্যায়ে আলােচিত বিষয় যথাক্রমে বৃটিশ শাসন আমলে শিক্ষার ব্যবস্থা, পাক শাসন আমলে শিক্ষার অগ্রগতি, স্বাধীন বাংলাদেশে শিক্ষার অগ্রগতি, শিক্ষাদীক্ষায় চাকমাদের জাতীয় রের্কড় এবং অগ্রতম স্থান।

শরদিন্দু শেখর চাকমা (জন্ম- ১৯৩৭) সরকারি কর্ম থেকে অবসর গ্রহণের পর অনেকগুলাে গ্রন্থ রচনা করেন। ইতিহাস বিষয়ক তাঁর উল্লেখযােগ্য গ্রন্থ হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের একাল সেকাল (২০০২), ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের ইতিকথা এবং তাদের স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন (২০০২) এবং মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রাম’ (২০০৬)।

দ্বিতীয় গ্রন্থের আলােচ্য বিষয় – ভৌগােলিক অবস্থান পরিচিতি, বিভিন্ন জনগােষ্ঠী, পাকিস্তান আমল, পার্বত্য চট্টগ্রামবাসী লক্ষ লােকের মরণ ফাদ কাপ্তাই বাঁধ, স্বাধীনতার সংগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বয়ান, জনসংহতি সমিতি গঠন, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য, বঙ্গবন্ধু ও পার্বত্য চট্টগ্রাম, জেনারেল জিয়া ও এরশাদের আমল, জেলা পরিষদ, খালেদা জিয়ার শাসন আমল এবং হাসিনা সরকারের আমল। জগৎ জ্যোতি চাকমার ‘ব্রিটিশ আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসন ব্যবস্থার অবকাঠামাে প্রবন্ধটি ২০০১ সালে বিপ্লব চাক্‌মা সম্পাদিত ‘শুভলং’ সংকলনে প্রকাশিত হয়।

ফজলে এলাহি সম্পাদিত ‘পার্বত্য পুরাণ’ (রাঙ্গামাটি ২০০৩) সংকলনে প্রকাশিত হয়েছে ভুমিত্র চাকমার প্রবন্ধ ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষা: অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ’ এবং জগৎজ্যোতি চাকমার প্রবন্ধ পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজস্ব ব্যবস্থা’।

জগৎজ্যোতি চাকমার ইতিহাস বিষয়ক অন্যান্য প্রকাশিত প্রবন্ধ হচ্ছে- ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থার বিকাশ (২০০৪ বিপ্লব চাকমা সম্পাদিত ‘শুভলং’) এবং ‘ব্রিটিশ আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনিক বিবর্তন পর্যালােচনা’ (জাক’র ২৫ বর্ষ পূর্তি সংকলন ২০০৫)।

গবেষণাধর্মী শেষ প্রবন্ধটিতে আলােচিত বিষয় হল- ভূমিকা, আয়তন ও সীমা, চাকমা রাজ্য ও সরকার, ব্রিটিশদের আগমন; আধুনিক প্রশাসক ব্যবস্থার সূচনা, পার্বত্য বিধিমালা শাসন বহির্ভুত এলাকার মর্যাদা, প্রশাসনিক বিবর্তন ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, ডিস্ট্রিক্ট অ্যাডভাইজরি কাউন্সিল, সার্কেল, সাবডিভিশন বা মহকুমা ও থানা, মৌজা, তালুকদার ও বাজারফান্ড ইত্যাদি।

রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসন প্রকাশিত ‘রাঙ্গামাটি বৈচিত্র্যের ঐকতান(২০০৪) গ্রন্থে এ জেলার শিক্ষা, গাইডিং ও স্কাউটিং সম্পর্কে প্রবন্ধ লিখেছেন অঞ্জুলিকা খীসা। ঐ গ্রন্থে ‘বিশেষ আইন ও ঐতিহ্যবাহী বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রবন্ধ লিখেছেন প্রতিম রায় পাম্পু।

প্রতিম রায়ের ‘আদিবাসীদের প্রথাগত ভূমি অধিকার পার্বত্য বন ও পরিবেশ বান্ধব অবদান প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে সি.ডি.এল প্রকাশিত ‘জুম পাহাড়ের জীবন’ (২০০৮) গ্রন্থে।

সুগম চাকমার পার্বত্য চট্টগ্রাম: পাকিস্তান আমল প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে জাক-এর বিঝু সংকলন “কাওয়াং” (২০০৪)-এ। জাক’র ২৫ বর্ষপূর্তি সংকলনে (২০০৫) প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর মুক্তিযুদ্ধ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রবন্ধ । তাঁর সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ পার্বত্য চট্টগ্রাম (১৯৭১-১৯৭৫) প্রকাশিত হয়েছে জাক-এর বিঝু সংকলন “টঙ্”-এ ২০০৬ সাল।

দেওয়ানের “পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি ১৯০০: অতীত প্রেক্ষাপট ও বর্তমান অবস্থা” প্রবন্ধটি ২০০৪ সালে বিপ্লব চাকমা সম্পাদিত “শুভলং” সংকলনে প্রকাশিত হয়েছে।

সি.ডি.এল প্রকাশিত “জুম পাহাড়ের জীবন” (২০০৮) সংকলনে প্রকাশিত হয়েছে মঙ্গল কুমার চাকমার “আদিবাসী জুম্ম জনগণের অর্থনৈতিক অবস্থা ও উন্নয়ন” এবং গৌতম কুমার চাকমার “পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা”।

পার্বত্য অঞ্চলের সাধারণ মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনীতিক পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস এখনও কাশিত হয়নি। আশাকরি তরুণ গবেষকগণ একাজে এগিয়ে আসবেন।

তথ্য নির্দেশ :

গ্রন্থ :
নন্দলাল শর্মা : প্রকাশক পার্বত্য চট্টগ্রাম ও উপজাতি, ১৯৮৩ সেলিনা হােসেন ও নুরুল ইসলাম সম্পাদিত : বাংলা একাডেমী অভিধান (২য় সংস্করণ), ১৯৯৭ Mahammad Ishaq Edited : Bangladesh District Gazette Chittagong Hill Tracts, 1971.

প্রবন্ধ :
নন্দলাল শমী : পার্বত্য অঞ্চল ও সেখানকার আদিবাসী সম্পর্কিত গ্রন্থপঞ্জী । বাংলা একাডেমী পত্রিকা, বৈশাখ-আশ্বিন ১৩৯৪ বঙ্গাব্দ (১৯৮৭)।
মাহবুবর রহমান, ড. স্থানীয় ইতিহাস। স্থানীয় ইতিহাস সংখ্যা ১, মার্চ ২০০৮; হেরিটেজ আর্কাইভস অব বাংলাদেশ হিষ্ট্রি ট্রাস্ট, রাজশাহী।

লেখক : নন্দলাল শর্মা।

তথ্যসূত্র : কেদাকতুক বৈসুক-সংগ্রাই-বিঝু-বিষু-বিহু সংকলন।

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা