খিয়াং জনগোষ্ঠীর বিবাহ (ফিয়া চমক)

Jumjournal
Last updated Jan 18th, 2020

971

featured image

বিবাহের (ফিয়া চকম) সংজ্ঞাঃ

খিয়াং সমাজে পাত্র-পাত্রীর বিবাহকে একটি সামাজিক অনুষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা হয়। খিয়াং সমাজে স্বীকৃত বিবাহের পূর্বশর্ত হচ্ছে ‘লাকশোঙ’ অনুষ্ঠান। এই সামাজিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিবাহিত খিয়াং দম্পতি সমাজসিদ্ধভাবে একত্রে বসবাস ও দৈহিক মিলনের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের অধিকার লাভ করে।

এই সামাজিক রীতি অনুসরণ ব্যতীত খিয়াং সমাজে নর-নারীর দৈহিক মিলন ও সন্তান জন্মদান সমাজসিদ্ধ নয়। সমাজ স্বীকৃত বিবাহের ক্ষেত্রে খিয়াং সমাজে ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে ‘লাকশাঙে’ অনুষ্ঠানের কোনো প্রকার সামাজিক সম্পর্ক নেই।

বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা:

বিবাহ রীতি: পরিবারের গণ্যমান্য ব্যক্তি, নিকটাত্মীয় এবং সমাজের প্রবীণদের সাথে বিবাহের আয়োজন করা পাত্র-পাত্রী উভয়পক্ষের অভিভাবকের বেলায় বাধ্যতামূলক। অন্যথায় গ্রামের গণ্যমান্য ও প্রবীণ ব্যক্তিরা বিবাহ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে না।

এই রীতির সামাজিক উদ্দেশ্য হলো বিবাহ উপলক্ষে পাত্র-পাত্রীর পরিবারে কি ধরণের সাহায্য-সহযোগিতা প্রয়োজন তা নির্ণয় করা। এরপর পাত্রের পিতামাতা নিকটাত্মীয়সহ পাত্রীর বাড়ীতে গিয়ে আলোচনার মাধ্যমে বিবাহের দিন, তারিখ ধার্য করেন।

পূর্ণিমার সময়কার বুধ ও বৃহস্পতিবারকে বিবাহের জন্য শুভদিন হিসেবে গণ্য করা হয়। ভাদ্র ও কার্তিক মাসে খিয়াং সমাজে বিবাহ অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ।

বিবাহের দিন বর ও বরযাত্রী দল কনের বাড়ীতে পৌছুলে তাদেরকে বিয়ের অনুষ্ঠান স্থলে এনে বসানো হয়। আমন্ত্রিত সকল অতিথির সামনে বর-কনেকে বসিয়ে উভয়ের হাতের উপর হাত রেখে ‘লাকশোঙ’ অনুষ্ঠান করা হয়।

‘লাকশোঙ’ অনুষ্ঠানে বর-কনেকে মুখোমুখি বসানো হয়। কনের আসন হতে বরের আসন কিছুটা উচুতে হয়।

বর-কনের মাঝখানে একটি থালায় সিদ্ধ করা আস্ত একটি মুরগী, এক বোতল মদ ও ভাত রাখা হয়। বর প্রথমে মদ পান করার পর সিদ্ধ করা মুরগীর গলার নিচের অংশ টেনে বিবাহের শুভাশুভ যাচাই করে।

এরপর নবদম্পতি উপস্থিত গুরুজনদের প্রণাম করে আশীর্বাদ গ্রহণ করে। বিবাহ অনুষ্ঠানের পর বরের হাতে একটি দা এবং কনের হাতে একটি কাস্তে তুলে দেয়া হয়। এটাকে খিয়াং সমাজে সৎ জীবনযাপনের প্রতীক ও আশীর্বাদ হিসেবে গণ্য করা হয়।

বিবাহ অনুষ্ঠানের পর বরযাত্রীরা ফিরে গেলেও বরকে কনের বাপের বাড়ীতে তিন/পাঁচ/সাত দিন পর্যন্ত থাকতে হয়।

বউ নিয়ে নিজ বাড়ীতে ফিরে আসার পর পাত্রের বাড়ীতে একই রকমের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ‘লাইতু’ দলের খিয়াংদের বিবাহ রীতি অনুসারে বর ও কনে বিবাহ অনুষ্ঠান শেষে বরের বাড়ীতে ফিরে যায় এবং বরের বাড়ীতে পুনরায় ‘লাকশোঙ’ অনুষ্ঠান হয়।

“শিওরি পই’ সহ বিয়ে হলে কনের বাড়ীতে এক রাত অবস্থানের পর সকালে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে বর-কনে উভয়ে বরের বাড়ীতে ফিরে যায়। ‘শিওরি পই’ অনুষ্ঠানে বর ও কনের পাশে মদের (জু) জাবার কলসীর ভেতর পানি ঢেলে দিয়ে কলসীর মুখে দুটি সরু নল বসানো হয়। অনুষ্ঠানে আগত গণ্যমান্য অতিথিরা নল দিয়ে কলসী থেকে মদের জাবার পানি পান করে।

বিবাহ সম্পর্ক স্থাপনের কারণে কনের মায়ের বুকের দুধের দাবীস্বরূপ (পূর্বে ২টি রৌপ্য মুদ্রা) মূল্যবান কোনো সামগ্রী বা নগদ অর্থ বরপক্ষকে অবশ্যই দিতে হয়। খিয়াং ভাষায় এটিকে “চিই মন’ বলে। চিই মন বাবদ ১০১ টাকা পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়।

এছাড়া যে গ্রাম বা পাড়ায় বিবাহ হয় সেই গ্রাম বা পাড়ার হেডম্যান/কার্বারীকে পাত্র-পাত্রী উভয় পক্ষকে ‘চিরিপেইলা’ বাবদ (পূর্বে ৭ টাকা) বর্তমানে ১২ টাকা প্রদান করতে হয়। তবে ‘লাইতু’ দলের খিয়াংদের সমাজে ‘চিরিপেইলা’ রীতির প্রচলন নেই।

‘লাকশোঙ’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিবাহিত দম্পতি খিয়াং সমাজের স্বীকৃতি লাভ করে। খিয়াং সমাজের আদি বিবাহ রীতির বাইরে বর্তমানে বৌদ্ধ ও খ্রিস্ট ধর্ম অনুসারী খিয়াংরা নিজ নিজ ধর্মীয় রীতি অনুসরণের পাশাপাশি কিছু সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানও পালন করে। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী খিয়াং সমাজের বিবাহ অনুষ্ঠান চার্চের পুরোহিতের মাধ্যমে চার্চের রীতি অনুসারে হয়ে থাকে।

বিবাহের যোগ্যতা: খিয়াং সমাজে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রকার যোগ্যতার মাপকাঠি না থাকলেও বয়স সীমা প্রচলিত আইন অনুযায়ী নির্ধারিত হওয়া প্রয়োজন।

সাধারণতঃ কিশোর বয়সে পদার্পণ করার পর শারীরিক গঠনের উপর পাত্র-পাত্রীর বিবাহের যোগ্যতা নির্ভরশীল। খিয়াং সমাজে শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের ও বিবাহ হতে পারে, যদি পাত্রপাত্রী উভয়ের সম্মতি থাকে। তবে বাল্য বিবাহের প্রচলন নেই। যদিও বাংলাদেশে প্রচলিত সাবালকত্ব আইন ১৮৭৫, অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন ১৮৯০, বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন ১৯২৯, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ বাংলাদেশের সকল ধর্মীয় সম্প্রদায় ও জনগোষ্ঠীর উপর সমানভাবে প্রযোজ্য।

এ সকল আইনে অপরিণত বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ১৯২৯ সনের বাল্য বিবাহ নিরোধ আইনের ২(ক) ও ২(খ) ধারায় শিশু ও বালিকা বলতে যার বয়স পুরুষ হলে ২১ বছরের কম এবং নারী হলে ১৮ বছরের কম বুঝাবে।

খিয়াং জনগোষ্ঠীর গ্রামীণ সমাজে প্রচলিত কম বয়সের বিবাহ সংক্রান্ত বিষয়ে দেশের বিদ্যমান আদালতে যদি কোনো কারণে প্রশ্ন উত্থাপিত হয় এবং যদি প্রমাণিত হয় যে বিবাহিত পক্ষগণ নাবালক তাহলে খিয়াং সামাজিক প্রথামতে নাবালকের বিবাহ কার্য সমাজসিদ্ধ হলেও তার কোনো প্রকার আইনগত বৈধতা থাকবে না, বরঞ্চ তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়।

খিয়াং সমাজে বিবাহের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ সম্পর্কঃ ‘লাইতু’ ও ‘কংতু’ এদুইটি শাখায় বিভক্ত খিয়াং সমাজে মাত্র ১২টি  গোত্র আছে। এ সকল গোত্রের নাম মূলতঃ তাদের পেশা বা জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম ও সামাজিক অবস্থান কেন্দ্রিক হয়েছে। খিয়াং সমাজে বিবাহের ক্ষেত্রে বৈধ সম্পৰ্কীয়কে ‘আসাংশ’ বলে।

আসাংশ সম্পৰ্কীয় পাত্র-পাত্রীর বিবাহকে বৈধ বিবাহ হিসেবে গণ্য করা হয়। খিয়াং সম্প্রদায়ের বিবাহের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ সম্পর্ককে সাংআশ’ বলে। একই গোত্রের মধ্যে বংশানুক্রমিক তিন পুরুষ পর্যন্ত অতিক্রান্ত হলে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করা যায়।

ভিন্ন ধর্মাবলম্বী খিয়াংদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ককে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী খিয়াং সমাজ অনুমোদন করে না। তবে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী খিয়াংদের সাথে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী খিয়াংদের পাত্র-পাত্রীর মধ্যে বিবাহ সম্পর্ক স্থাপন স্বীকৃত। এক্ষেত্রে পাত্রীকে তার স্বামীর ধর্ম ও সামাজিক রীতিনীতি গ্রহণ করতে হয়।

খিয়াং সমাজে বিবাহের ক্ষেত্রে নিম্নবর্ণিত সম্পর্কগুলো নিষিদ্ধ (সাংআশ) সম্পর্ক হিসেবে গণ্য করা হয়ঃ

(ক) একই গোত্রের মধ্যে বংশানুক্রমিকভাবে তিন পুরুষ অতিক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত;

(খ) মামা-ভাগ্নীর মধ্যে;

(গ) পিসি-ভাইপোর মধ্যে;

(ঘ) স্ত্রীর আপন বড় বোনের সাথে;

(ঙ) কাকা-ভাইঝির মধ্যে;

(চ) মাসী-ভাগ্নের মধ্যে;

(ছ) বিমাতার সঙ্গে;

(জ) একই পিতার ঔরসে ভিন্ন ভিন্ন মায়ের সন্তানগণের মধ্যে;

(ঝ) ভাইপোর স্ত্রীর সঙ্গে;

(ঞ) ভাগ্নের স্ত্রীর সঙ্গে;

(ট) মামী সম্পর্কীয় আত্মীয়;

(ঠ) কাকী সম্পর্কীয় আত্মীয়;

(ড) তালতো ভাইয়ের সাথে আপন কন্যা;

(ঢ) দত্তক কন্যার সাথে আপন পুত্রের;

(ণ) আপন কাকা ও জ্যেঠার ছেলে-মেয়ের মধ্যে;

(ত) ছোট ভাইয়ের বিধবা স্ত্রীর সঙ্গে।

বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের কতিপয় অনুসরণীয়/পালনীয় রীতিনীতি:

(ক)সাধারণভাবে একজন খিয়াং পুরুষ একজন খিয়াং মহিলাকে বিবাহ করে;

(খ) পাত্র-পাত্রীকে বিবাহ নিষিদ্ধ সম্পর্কের আওতা বহির্ভূত হতে হয়

(গ) পাত্র-পাত্রীকে রক্ত সম্পর্কজনিত বিধি নিষেধ মেনে বিয়ে করতে হয়;

(ঘ) পাত্র-পাত্রীকে সাবালকত্ব অর্জন করতে হয়;

(ঙ) পাত্র-পাত্রীকে জোড়া বন্ধন ‘(লাকশোঙ)’ সম্পাদন করতে হয়।

বিবাহের (ফিয়া চমক) প্রকারভেদঃ খিয়াং সমাজে সচরাচর দুই প্রকার বিবাহের অস্তিত্ব রয়েছেঃ- যথাঃ- (ক) সামাজিক নিয়মিত বিৰাহ (খ) পলায়ন/অনিয়মিত বিবাহ। বিধবা বিবাহ ও বহু বিবাহের ক্ষেত্রে সমাজের দাবী পুরণ করতে হয়।

নিষিদ্ধ বা অননুমোদিত বিবাহের ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রীকে কঠোর দন্ড দেয়া হয় । খিয়াং সমাজে বিধবা বা বিপত্নীক এর বিবাহ ও বহু বিবাহের ক্ষেত্রে সমাজের অনুমোদন নিতে হয়। আধুনিক ও শিক্ষিত সমাজে কোর্ট ম্যারেজ ও মিশ্র বিবাহের কিছু প্রবণতা ইদানীং দেখা গেলেও সামাজিক রীতি ও প্রথা অনুসারে সমাজসিদ্ধ করা ব্যতিরেকে খিয়াং সমাজ তা অনুমোদন করে না।

রক্ত সম্পৰ্কীয় নিষিদ্ধ বিবাহের ক্ষেত্রে দম্পতিকে সমাজচ্যুত করা হয়। খিয়াং সমাজ নিষিদ্ধ বা অননুমোদিত বিবাহকে স্বীকৃত বিবাহ হিসেবে গণ্য করে না।

সামাজিক/নিয়মিত বিবাহ (ঙিয়েইউলা-নক্স): খিয়াং সমাজে অভিভাবকের মতামত সাপেক্ষে পাত্র-পাত্রীর বিবাহ ঠিক করা হয়। পাত্রপক্ষ বা ছেলের বাবা নিজ গোত্রের গণ্যমান্য ব্যক্তির মাধ্যমে তাদের পছন্দের পাত্রীর অভিভাবকের নিকট সরাসরি বিবাহের প্রস্তাব পাঠান। প্রস্তাবে পাত্রীর অভিভাবক রাজী হলে বিবাহ সংক্রান্ত পরবর্তী আলাচোনার জন্য উভয়পক্ষ দিন তারিখ নির্ধারণ করে।

সামাজিক নিয়মিত বিবাহের আইনগত ফলাফলঃ সামাজিক আচার অনুষ্ঠান ও রীতিনীতি অনুসরণ করে বিবাহিত একজন যুবক (পুরুষ) এবং একজন যুবতী (মহিলা) স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বসবাস করার সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করে, যা খিয়াং সমাজের বিবাহ প্রথা অনুযায়ী সমাজসিদ্ধ হিসেবে গণ্য।

বিবাহিত দম্পতির দৈহিক মিলনের ফলে যে সন্তান জন্ম লাভ করে, সে বৈধ সন্তান ও পিতা-মাতার উত্তরাধিকারী হিসেবে গণ্য হয়। স্বামী-স্ত্রী হিসেবে তাদের একজনের উপর অপরজনের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় ।

একজনের ভাল-মন্দ দেখার দায়িত্ব অপরজনের উপর বর্তায়। স্বামী-স্ত্রী হিসেবে তাদের একজনের উপর অপরজনের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এমনকি একজনের ভাল-মন্দ দেখার দায়িত্ব অপরজনের উপর বর্তায়। স্ত্রী তার স্বামীর নিকট থেকে ভরনপোষণ, সামাজিক মর্যাদা ও স্বামীর পারিবারিক পদবীর অধিকারী হয়।

পলায়ন/অনিয়মিত বিবাহ (এচেনেইস)ঃ সমাজে প্রচলিত নিয়মের বাইরে প্রেমঘটিত কারণে যুবক-যুবতী উভয়ে ঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে পরস্পরের মননমিলনে নিজেদেরকে স্বামী-স্ত্রী রূপে গ্রহণের মাধ্যমে পলায়ন/অনিয়মিত বিবাহ সম্পন্ন করে।

খিয়াং সমাজে পলায়ন/অনিয়মিত বিবাহের প্রচলন রয়েছে। খিয়াং সমাজে এ ধরণের বিবাহকে ‘এচেনেইস’ বলে।

(ক) খিয়াং পুরুষ ও মহিলা পরস্পরের সম্মতিতে ঘর থেকে পালিয়ে যায়। কিছুদিন পর সমাজে ফিরে এসে বিবাহের ক্ষেত্রে গোত্রগত নিষিদ্ধ সম্পর্ক না থাকলে সামাজিক আদালত বা সমাজপতির সিদ্ধান্ত অনুসারে ‘লাকশোঙ’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের বিবাহকে সমাজসিদ্ধ করে।

খিয়াং সমাজের রীতি অনুসারে পাত্র-পাত্রী পালিয়ে গিয়ে যে পাড়াতে আশ্রয় নেয় সেই পাড়াতেই তাদের বিয়ে হতে হয়। পালিয়ে যাবার সময় পাত্র-পাত্রীর সাথে সাক্ষী হিসেবে তৃতীয় পক্ষ কেউ না থাকলে সেটাকে সমাজে ব্যভিচার হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং সামাজিক আদালতে পাত্র-পাত্রী উভয়কে শাস্তিস্বরূপ শূকর জরিমানা দিতে হয়।

(খ) পলায়ন/অনিয়মিত বিবাহের ক্ষেত্রে খিয়াং সমাজে ভিন্ন জনগোষ্ঠীর পাত্রীর সাথেও বিবাহ হয়। খ্রিস্টধর্মাবলম্বী পাত্রপাত্রীর সাথে বিবাহ হলে তা বৈধ হিসেবে গণ্য হয়।

তবে ভিন্ন জনগোষ্ঠীর মহিলার সাথে বিবাহ হলে সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে স্ত্রীকে ‘লাকশোঙ’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গোত্রভুক্ত করা হয়। এ ধরণের বিবাহে স্ত্রীকে খিয়াং জনগোষ্ঠীর ধর্ম ও গোত্রের মর্যাদা ও পদবী ধারণ করতে হয়।

কোর্ট ম্যারেজঃ কোর্ট ম্যারেজ মূলতঃ আদালতের কোনো প্রকার আদেশ নয়। আধুনিক খিয়াং সমাজে ইদানীং পরিবারের অসম্মতিতে বিবাহে ইচ্ছুক পাত্র-পাত্রী উভয়ে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট অথবা নোটারী পাবলিক-এর সম্মুখে নিজদেরকে আইনতঃ স্বামী-স্ত্রী হিসেবে শপথ পূর্বক ঘোষণা প্রদানের মাধ্যমে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে দেখা যায়।

এক্ষেত্রে বলা চলে প্রাচীনকালের মনোমিলনে পলায়ন বিবাহের আধুনিক সংস্করণ হচ্ছে কোর্ট ম্যারেজ, যদিও এটি নিছক একটি শপথনামা মাত্র। তাই এ বিবাহ অলক্ষনীয়ও নয়।

তবে বিবাহিত পাত্র-পাত্রী এক্ষেত্রে সাবালক হলেও বিবাহ নিষিদ্ধ সম্পর্কীয় নিকটাত্মীয় হলে সম্পাদিত কোর্ট ম্যারেজ সামাজিকভাবে বৈধ হয় না। সর্বোপরি এ ধরণের কোর্ট ম্যারেজ প্রথাসিদ্ধ নয়, তা অসামাজিক বিবাহ।

ব্যাখ্যাঃ মূলতঃ কোর্টে কোনো বিবাহ হয় না। পরস্পরের প্রতি প্রণয়াসক্ত পাত্র-পাত্রীকে স্বেচ্ছায় কোর্টে আসার পূর্বে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হয়। পরে কোর্টে এসে উভয়ে ম্যাজিস্ট্রেটর সম্মুখে এই প্রকার Love Marriage-এর সমর্থনে একটি শপথ সম্বলিত বিবৃতি Affidavit দেয় এবং এভাবে বিবাহের সমর্থনে একটি দলিল সৃষ্টি করে। কার্যতঃ এই প্রকার শপথ সম্বলিত বিবৃতি অর্থাৎ এফিডেবিটের যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে।

“অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রণয়ঘটিত বিবাহগুলো উভয়পক্ষের অভিভাবকদের অসম্মতিতে হয়ে থাকে। এরূপ বিবাহিত দম্পতিকে বিবাহের অব্যবহিত পরেই কোর্টে গিয়ে তাদের বিবাহের সমর্থনে একটি দলিল সৃষ্টি করতে হয়, যাতে যে কোনো পক্ষের অভিভাবকের উদ্যোগে থানায় অথবা কোর্টে তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা দায়ের হলে এই দলিল তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনে সহায়ক হয়”। (সূত্রঃ- হিন্দু আইনের ভাষ্যঃ গাজী শামছুর রহমান)

পরস্পরের প্রতি প্রণয়াসক্ত হয়ে খিয়াং যুবক-যুবতী কোর্টে আসার আগে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় না। কোর্টে এসে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে ‘আমরা পরস্পরকে বিবাহ করলাম মর্মে বিবৃতি (হলফনামা) সম্পাদন করে দেয়।

অর্থাৎ তারা কোর্টেই একে অপরকে বিয়ের ঘোষণা দেয় মাত্র। কোর্টে আসার আগে বিয়ে করে না। আগেই বলা হয়েছে যে, কোর্টে কোনো বিয়ে হয় না। পূর্বে সম্পন্ন হওয়া বিয়ের ঘোষণা কোর্টে এসে ঘোষণা দেয়া হয় মাত্র।

সুতরাং খিয়াং, যুবক-যুবতী উভয়ে হলফনামার মাধ্যমে বিয়ে হয়েছে বলে যা বুঝাতে চায়, তা মোটেই সমাজসিদ্ধ বিয়ে নয়। খিয়াং সমাজসিদ্ধ বিবাহের পূর্ব শর্ত হচ্ছে ‘লাকশোঙ’ অনুষ্ঠান সম্পাদন করা ।

মিশ্র বিবাহঃ খিয়াং সমাজে অতীতে মিশ্র বিবাহের প্রচলন ছিল না। এরূপ বিবাহকে সামাজিক অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে দন্ড দেয়া হতো। তবে বর্তমান আধুনিক খিয়াং সমাজ মিশ্র বিবাহকে অনুমোদন করে।

পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসী জনগোষ্ঠী ছাড়াও দেশের অন্যান্য অঞ্চলের আদিবাসীসহ বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টধর্মাবলম্বী পাত্র-পাত্রীর সাথে খিয়াং জনগোষ্ঠীর পাত্র-পাত্রীর মনোমিলনে বা সম্মতিতে ‘লাকশোঙ’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অথবা নিজ নিজ ধর্মীয় রীতি অনুসারে সম্পন্ন হওয়া মিশ্র বিবাহের ক্ষেত্রে খিয়াং সমাজের স্বীকৃতি নিতে হয়।

এরূপ বিবাহের ক্ষেত্রে স্ত্রী যে জনগোষ্ঠী হতে খিয়াং সমাজে আসে তার সেই পিতৃকুলের ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, মর্যাদা ও পারিবারিক পদবী তার লোপ পায় এবং স্ত্রী তার খিয়াং স্বামীর পরিবারের প্রচলিত ধর্মীয় বিশ্বাস, বর্ণ, গোত্র, মর্যাদা ও পদবীর অধিকারী হয়।

অনুরূপভাবে খিয়াং সমাজের কোনো মহিলার সাথে অন্য জনগোষ্ঠীর পুরুষের বিবাহ হলে এবং ধর্মান্তরিত হয়ে অন্য জনগোষ্ঠীভুক্ত হলে সেই বিবাহিত মহিলা খিয়াং সমাজের উত্তরাধিকারসহ পদবী হারায়।

পলায়ন/অনিয়মিত বিবাহের (পালিয়ে গিয়ে গোপনে বিয়ে করা)আইনগত ফলাফলঃ পলায়নের পর প্রেমিক-প্রেমিকাকে সামাজিক আদালতে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়। পাত্রীর অভিভাবক এরূপ পলায়ন/অনিয়মিত বিবাহ মেনে না নিলে নবদম্পতি পাত্রীর পিতার বাড়ীতে যাবার অধিকার হারায়।

কিন্তু পাত্রের পিতা বা অভিভাবকের এরূপ বিবাহে অমত থাকলেও সমাজের লোক কর্তৃক তা মেনে নিতে অনুরোধ করা যায় যা সাধারণত মেনে নেওয়া হয়; মেনে নিতে পাত্রের অভিভাবককে সামাজিকভাবে বাধ্য করা হয়।

প্রেমিক-প্রেমিকা এভাবে পলায়নের কারণে সামাজিক বিচারে জোর করে অপহরণ করার অভিযোগে পাত্রকে অপরাধী সাব্যস্ত করা না হলে এবং প্রেমিকার পিতা-মাতা সেই পাত্রের সাথে বিয়ে দিতে রাজি হলেও পলাতক অবস্থায় বিবাহ বহির্ভূতভাবে দৈহিক মিলনের সামাজিক অপরাধের জন্য সাজাভোগ করতে হয়, যেমনঃ- শূকর, মোরগ, মদ ও নগদ টাকা জরিমানা প্রদান সাপেক্ষে তাদের মধ্যে বিয়ে হয়, যা সমাজ কর্তৃক অনুমোদিত বলে গণ্য হয়।

সমাজে অনুমোদিত হলে পাত্র-পাত্রীর বিবাহ বহির্ভূত দৈহিক মিলনের দ্বারা জন্মগ্রহণকারী সেই সন্তানও বৈধ সন্তান হিসেবে গণ্য হয় এবং পিতা-মাতার উত্তরাধিকারী হয়ে পূর্ণ সামাজিক মর্যাদা ভোগ করে।

প্রেমিক বা প্রেমিকার পিতা-মাতার অসম্মতির কারণে প্রেমিক যুগলের বিয়ে না হয়ে যদি পলাতক অবস্থায় উভয়ের দৈহিক মিলনের কারণে প্রেমিকা গর্ভবতী হয় তাহলে তার ভূমিষ্ট সন্তান অবৈধ সন্তান হিসেবে গণ্য হয়।

সন্তান যার ঔরসে জন্মলাভ করেছে/করে সেই পিতার উত্তরাধিকারী এবং পিতার পারিবারিক মর্যাদার অধিকারী হয়, যদি সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে সন্তান পিতার অধিকারে থাকে, অন্যথায় হয় না।

দেশের প্রচলিত আইনে আদালতে মামলা ও সাজা হওয়ার আশঙ্কাঃ প্রেমিকপ্রেমিকার বিয়েতে তাদের অভিভাবকের সম্মতি না থাকলে পলায়নের খবর জানাজানি হবার পর প্রেমিকার পিতা প্রেমিকের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর আওতায় মামলা দায়ের করতে পারে।

আদালতে এ ধরণের মামলার ফলে প্রেমিক গ্রেপ্তার ও বিচারে সাজা পায়। আর প্রেমিকা যদি নাবালিকা হয় অথবা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে অপহরণ ও দৈহিক মিলনে বাধ্য করা হয়েছে বলে সে আদালতে জবানবন্দি দেয়, তাহলে প্রেমিকের ১৪ বছর থেকে যাবজ্জীবন পর্যন্ত কারাদন্ড হতে পারে।

নিষিদ্ধ বা অননুমোদিত বিবাহ (সাংআশ): বিবাহ নিষিদ্ধ আত্মীয় সম্পর্কীয় সমগোত্রের মধ্যে খিয়াং সমাজে কোনো প্রকার বিবাহ হলে তা নিষিদ্ধ বা অননুমোদিত বিবাহ বলে গণ্য হয় এবং সন্তানগণ অবৈধ সন্তান হিসেবে সমাজে পরিচিতি পায়।

এই ধরণের দম্পতিকে পাড়া এবং খিয়াং সমাজ হতে সমাজচ্যুত করা হয়। নিষিদ্ধ সম্পর্কের বিবাহিত দম্পতির ভূমিষ্ট সন্তানও পিতা-মাতার অনুরূপ সমাজচ্যুত হিসেবে বিবেচিত হয়।

নিষিদ্ধ বা অননুমোদিত বিবাহের আইনগত ফলাফলঃ খিয়াং সমাজে বিবাহ নিষিদ্ধ সম্পর্কের আত্বীয়ের সাথে বিয়ের অপরাধের জন্য বিবাহ বিচ্ছেদ অপরিহার্য। নিষিদ্ধ সম্পর্কিত বিবাহের ক্ষেত্রে সামাজিক বিচারে সাধারণতঃ ৫০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা ধার্য করা হয় ও পাত্র-পাত্রীকে মদ ও শূকর জরিমানা করা হয়।

নিষিদ্ধ সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্ব অনুসারে অপরাধের শান্তি নির্ধারণ করা হয়। ঘনিষ্ঠ আত্মীয় সম্পর্কের হলে পাত্র-পাত্রীকে শাস্তি প্রদানের পরেও স্বামী-স্ত্রীরূপে বসবাসের অনুমতি দেয়া হয় না।

পাত্র-পাত্রীকে শূকর স্বহস্তে রান্না করে মদসহ গ্রামবাসীকে পরিবেশন করতে বাধ্য করা হয়। পাত্র-পাত্রী উভয়কে শুকরের খোয়ারে বসে খেতে হয়। দন্ড আদায়ের পর সামাজিক রীতি অনুসারে অবৈধ বিবাহিত দম্পতিকে ৩০ কলসী পানি ঢেলে আমন্ত্রিত অতিথিদের সম্মুখে পরিশুদ্ধ হতে হয়।

খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা চার্চের পুরোহিতের কাছে এবং বৌদ্ধরা বৌদ্ধভিক্ষুর কাছে শুদ্ধ হয়ে সমাজভুক্ত হয়। সামাজিক বিচারের জরিমানা আদায় বা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত অপরাধী দম্পতি যদি কখনো পৈত্রিক বাড়ীতে প্রবেশ করে, সেক্ষেত্রে ঘরের তিন অংশের মধ্যে কেবল অন্দর মহলের বাইরে বৈঠক ঘর (দাঙক্রা) পর্যন্ত প্রবেশ করতে পারে, কিন্তু দিন বা রাত যাপনের জন্য অবস্থান করতে পারে না।

যদি অপর দুই অংশে প্রবেশ করে বা অবস্থান করে সেক্ষেত্রে অপরাধী দম্পতির পিতা-মাতাকেও সামাজিক বিচারের সম্মুখীন হয়ে দন্ড দিতে হয়। অন্যথায় অপরাধীর পিতা-মাতাও সমাজচ্যুত হয় এবং সামাজিক প্রথা অনুসারে শাস্তিস্বরূপ শূকর (জরিমানা) দিতে হয়।

পাত্র-পাত্রীর ‘সাংআশ’ সম্পর্কের কারণে দন্ড দেয়া শূকরের মাংসও সমাজের কেউ কেউ খাবার জন্য গ্রহণ করে না। অন্যদিকে গোপনে বিয়ে করে সামাজিক স্বীকৃতি ছাড়া স্বামী-স্ত্রী রূপে বসবাস করার অপরাধের শাস্তি হচ্ছে অর্থদন্ড। এরপরেও উক্ত দম্পত্তি যদি দাম্পত্য জীবন অক্ষুন্ন রাখে তবে তাদেরকে সমাজচ্যুত করে এক ঘরে’ করা হয়।

কিন্তু খিয়াংদের জনসংখ্যা কম হওয়ার কারণে সামাজিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জরিমানা প্রদান সাপেক্ষে সমাজভুক্ত করা হয়। এক্ষেত্রে সামাজিক আদালত-এর সিদ্ধান্ত মতে সামাজিক ও ধর্মীয় রীতি অনুসারে অথবা খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় রীতিনীতি অনুযায়ী চার্চ এল্ডারের বাড়ীতে ‘লাকশোঙ’ অনুষ্ঠান সম্পাদন করা বাঞ্চনীয়।

ব্যাখ্যাঃ নিষিদ্ধ সম্পর্কের আত্মীয়ের সাথে বিয়ে হওয়া খিয়াং সমাজে একেবারে বিরল ঘটনা নয়। অতীতে যেমন ছিল, বর্তমানেও এ ধরণের কিছু কিছু বিয়ের নজির খুঁজে পাওয়া যায়। সামাজিক রীতি অনুযায়ী অনুষ্ঠিত বিয়ের বৈধতা বা অস্তিত্ব নিয়ে সাধারণতঃ কোনো প্রশ্ন উথাপিত হয় না।

তবে পালিয়ে গিয়ে ‘লাকশোঙ’ ছাড়া ভিন্ন এলাকায় গিয়ে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বসবাসকালে স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন বিয়ের কথা অস্বীকার করলে তখন বিয়ের অস্তিত্ব প্রমাণ করার প্রয়োজন। দেখা দেয়। সচরাচর খিয়াং সমাজে এমন ঘটনা ঘটে না।

বিধবা বিবাহঃ খিয়াং সামাজিক প্রথামতে বিধবা বিবাহ অনুমোদিত। একজন বিপত্নীক যেমন বিয়ে করতে পারে, তেমনি একজন বিধবা মহিলাও বিয়ে করতে পারে। একজন বিধবা যদি তার স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তান-সন্ততিসহ স্বামীর পরিবারে বা শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে একত্রে বসবাস করে তাহলে স্বামীর সম্পত্তি থেকে উক্ত বিধবা আমৃত্যু ভরনপোষণ পাবার অধিকারী। কিন্তু দ্বিতীয়বার বিয়ে করে যদি স্বামীশশুরের পরিবার থেকে বিছিন্ন হয়ে যায়, তাহলে স্বামীর সম্পত্তি থেকে ভরনপোষণ পায় না।

শ্বশুরের পরিবারে যদি আর কোনো পুত্র সন্তান না থাকে তাহলে বিধবার প্রথম পক্ষের স্বামীর ঔরসজাত পুত্র সন্তান সম্পত্তির অংশীদার হয়। খিয়াং সমাজে একজন বিধবা মহিলার দ্বিতীয় বিবাহ সামাজিকভাবে প্রথাসিদ্ধ।

তবে মহিলাকে পিতার বা ভাইয়ের বাড়ীতে থেকে দ্বিতীয় বিবাহ করতে হয়। ‘লাইতু’ খিয়াং দলে কোনো বিধবা মহিলা বা বিপত্নীক পুরুষের বিবাহের ক্ষেত্রে এক বোতল মদ, একটি শুকর অথবা সমপরিমাণ টাকা সমাজকে দিতে হয়।

বহু বিবাহ (উনুং ফিয়া নঃতিহ): খিয়াং সমাজে বহু বিবাহ নিষিদ্ধ নয়, তৰে বহু বিবাহ সচরাচর লক্ষ্য করা যায় না। বিশেষতঃ খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী খিয়াং সমাজে বহু বিবাহের প্রচলন নেই। তবে একজন বিবাহিত খিয়াং স্বামী তার স্ত্রীর জীবদ্দশায় স্ত্রীর সাথে দাম্পত্য সম্পর্ক ছিন্ন না করে সামাজিক আদালতে স্ত্রীর সম্মতিতে নিম্নোক্ত কারণে বহু বিবাহে আবদ্ধ হতে পারেন।

তবে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী খিয়াং সমাজে স্ত্রীর পূর্ব অনুমতি গ্রহণের বাধ্যবাধকতা নেই। কোনো বিবাহিত পুরুষ দ্বিতীয় স্ত্রীরূপে কোনো বিধবা মহিলাকে বিয়ে করলে তাকে এক বোতল মদ, একটি শূকর অথবা সমপরিমাণ টাকা সমাজকে দিতে হয়।

কারণসমূহঃ

(ক) সন্তানহীন দম্পতির বংশ রক্ষার তাগিদে;

(খ) স্ত্রী দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে;

(গ) স্ত্রী উন্মাদ বা অপ্রকৃতিস্থ হলে;

(ঘ) স্ত্রীর অনুমতি বা সম্মতি সাপেক্ষে;

(ঙ) স্ত্রী যদি কোনো কারণে স্বামীর অমতে দীর্ঘ সময় পিত্রালয়ে বা দেশান্তরে থাকে;

(চ) স্ত্রী যদি ব্যাভিচারে কিংবা পরকীয়াতে লিপ্ত হয় এবং এ ধরণের অপরাধে সামাজিক আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়।

মন্তব্য: বহু বিবাহ বলতে প্রথম স্ত্রী জীবিত থাকা অবস্থায় আরও এক বা একাধিক মহিলাকে বিয়ে করা বুঝায়। প্রথম স্ত্রী মারা গেলে বা প্রথম স্ত্রীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ হলে সব সমাজেই দ্বিতীয়বার বিয়ে করার রীতি আছে।

বহু বিবাহের আইনগত ফলাফল: খিয়াং সমাজে বহু বিবাহ অনুমোদিত। তাই কোনো ব্যক্তি একাধিক মহিলাকে বিয়ে করলেও সমাজ তাতে মাথা ঘামায় না।

কারণ একজন পুরুষের একাধিক স্ত্রী থাকার ফলে পরিবারে যে অশান্তির সৃষ্টি হয়, তার প্রভাব সমাজে খুব  একটা পড়ে না। অবশ্য উপরোক্ত (ঙ)নং শর্ত ব্যতীত অবশিষ্ট ৬টি কারণেও যদি দ্বিতীয় বিবাহে স্বামী তার স্ত্রীর অনুমতি বা সম্মতি গ্রহণ না করে তবে বাংলাদেশ দন্ডবিধি ৪৯৪ ও ৪৯৫ ধারামতে তা দন্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। সেক্ষেত্রে সমাজে প্রচলিত বিধান অকার্যকর বলে গণ্য হয় এবং অপরাধ প্রমাণিত হলে ৭ হতে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড হতে পারে।

 মন্তব্য: খিয়াং সামাজিক প্রথামতে একাধিক বিয়ে করা যায়। এই প্রথা না মেনে কোনো স্ত্রী, স্বামীর বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইনের আওতায় মামলা করলে স্বামীর শাস্তি হতে পারে। অবশ্য সেই বিচার খিয়াং সমাজ সম্মত নয়।

বর্তমানে প্রচলিত কোনো প্রথা দ্বারা সমাজের বৃহত্তর অংশের ক্ষতিসাধিত হলে তা অবশ্যই সংশোধন করা যায়। এক্ষেত্রে খিয়াং সমাজের বিচার কাঠামোর বাইরে গিয়ে প্রতিকার চাওয়া এবং খিয়াং প্রথাগত আইন মেনে চলা এক নয়।

বিবাহের প্রমাণঃ খিয়াং সমাজে বিবাহ একটি সামাজিক অনুষ্ঠান । বিবাহ নিবন্ধনের কোনো প্রকার সামাজিক ব্যবস্থা কিংবা স্বীকৃত কোনো প্রকার সামাজিক রীতি কিংবা স্বীকৃত কোনো প্রথার প্রচলন নেই।

বর্তমানে খ্রিস্টধর্মাবলম্বী খিয়াং সমাজের বিবাহ অনুষ্ঠান চার্চে হবার সুবাদে তাদের বেলায় চার্চের স্বীকৃতি পত্র লাভের সুযোগ রয়েছে। সাধারণতঃ বিবাহের সত্যতা বা অস্তিত্ব প্রমাণ হয় নিম্নমতেঃ

ক) ‘লাকশোঙ’ অনুষ্ঠানে উপস্থিত গণ্যমান্য ব্যক্তির সাক্ষ্য। খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে চার্চের স্বীকৃতি পত্র বা সাক্ষ্য;

খ) ‘লাকশোঙ’ অনুষ্ঠানে উপস্থিত সমাজপতি/কার্বারীর সাক্ষ্য;

গ) স্বামী-স্ত্রী উভয়ের বাবা-মায়ের স্বীকৃতি;

ঘ) সমাজ স্বীকৃত পন্থায় স্বামী ও স্ত্রী হিসেবে একত্রে বসবাস;

ঙ) স্ত্রীর গর্ভে স্বামীর ঔরসজাত সন্তানের পিতৃত্ব স্বীকার;

চ) স্বামী-স্ত্রী হিসেবে পরস্পর-পরস্পরকে স্বীকৃতি প্রদান;

ছ) সমাজপতি/পাড়া প্রধান, কার্বারী, হেডম্যান বা সার্কেল চীফ কর্তৃক বিবাহ সংক্রান্ত বিষয়ে ‘চিরিপেইলা’ বাবদ প্রাপ্ত অর্থ সংক্রান্ত বিষয়ে প্রদত্ত সিদ্ধান্ত বা সনদপত্র;

জ) ‘লাকশোঙ’ অনুষ্ঠানের প্রামাণ্য ছবি ।

উপরোক্ত উপাদানগুলো বিয়ের অস্তিত্ব সরাসরি প্রমাণ করে ।

বৈবাহিক কর্তব্য :

(ক) স্ত্রী তার স্বামীর সাথে বসবাস করে এবং স্বামীর ন্যায়সঙ্গত নির্দেশ ও পরামর্শ মেনে চলে।

(খ) স্বামী তার স্ত্রীর সাথে বসবাস করতে ও তার ভরনপোষণ দিতে বাধ্য।

(গ) উভয়ে পারিবারিক ও সাংসারিক দায়-দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠাবান থাকে।

আইনসঙ্গত বিবাহে স্বামী-স্ত্রীর অধিকার এবং দায়িত্ব :

(ক) বিয়ের পর স্ত্রীর উপর স্বামীর অভিভাবকত্বের দায় বর্তায়।

(খ) বিয়ের পর স্ত্রীকে অবশ্যই স্বামীর ইচ্ছানুযায়ী স্থানে স্বামীর সাথে বসবাস করতে হয় এবং স্বামীর সকল প্রকার ন্যায়সঙ্গত নির্দেশ অনুযায়ী চলতে হয়। অনুরূপভাবে স্বামীকেও স্ত্রীর মর্যাদায় স্ত্রীকে তার সাথে রাখতে হয় এবং পারিবারিক মর্যাদা ও সামর্থ্য অনুযায়ী ভরনপোষণ দিতে হয় ।

তথ্যসূত্র

১। Majority Act, 1875.

২। Guardians and Wards Act, 1890.

৩। Child Marriage Restraint Act, 1929.

৪। নারী ও শিশু নির্যাতন আইন, ২০০০


তথ্যসূত্রঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আদিবাসীদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন (গ্রন্থনা ও সম্পাদনা – এডভোকেট জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা,  এডভোকেট প্রতিম রায়, সুগত চাকমা)।

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা