কাপ্তাই বাঁধ- সকল দুঃখের কারণ
663
ছােটবেলার স্মৃতি
বরপরং-এর জন্য আমি যখন আমার পরিবারের সাথে দেশ ছাড়লাম তখন আমি ৪ বাচ্চার মা ছেলে ৩টা মেয়ে ১টা। আমার বয়স যখন ১৫ বা ১৬ বছর তখন আমার বিয়ে হয়।
আমার স্বামীর নাম ইন্দ্ররাম চাকমা। বাবার নাম কেনা চান চাকমা মা কিনাবী চাকমা। আমাদের পুরােনাে গ্রামের নাম ছিল কেরেঙাছড়ি। আমার রাগ হাবা গােষ্ঠীর বংশধর।
অনেক বড় গ্রাম ছিল আমাদের। প্রায় ১০০ ঘরের গ্রাম। এই গ্রামের বাসিন্দারা সকলেই চাকমা। গ্রামে মন্দির ছিল প্রাইমারি স্কুল ছিল। আমি পড়াশুনা করিনি মানে মা বাবা স্কুলে পাঠাননি। তখনকার সময়ে আমাদের কাজ ছিল বাড়ির ছােট ছেলেমেয়েদের দেখে শুনে রাখা আর বেইন বুনতে শিখা। বেইন বুনতে না জানলে তাে মেয়েদের বিয়ে হয় না।
আর মেয়েরা একটু বড় হলেই বাবামা মেয়েকে বাজারেও নিয়ে যেতেন না। কিন্তু ছেলেরা পড়াশুনা করতাে। আমার তাে মনে হয় গ্রামে আমরা সকলেই সুখী ছিলাম।
জমি জিরাতের অভাব ছিল না। তাই কেউ কারাের কাছে হাত পাততাে না। কিন্তু কাপ্তাই বাঁধের কারণে গ্রাম ছাড়তে হলে আমরা রিজার্ভ ফরেস্টে চলে আসি। তখনই দুনিয়ার দুঃখ আমাদের শুরু হয়।
আমরা বাড়িতে পিনন খাদি পরতাম। এখনকার মতাে নানা রঙের ছিল না। লালকালাের সেই পিনন খাদিটাই ছিল । সােস মানে নীল সুতা দিয়ে রেইগুলাে করা। আর খবং* ছিল। মাথায় খবং পরতাম সবসময়।
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে চুল আঁচড়িয়ে মাথায় খবং দিতেই হতাে। তারপর ঘরের অন্য কাজ। আর রাতে খবং * এবং : চাকমা নারীদের পােষাকের অংশবিশেষ খুলে ঘুমানাে। এখন কেউ খবং দেয় না এমনকি আমি নিজেই এখন আর খবং ব্যবহার করি না।
কাপ্তাই বাঁধ
কাপ্তাই বাঁধ- তখন কি আর অত শত বুঝতাম। গ্রামে কয়েকজন বাঙালি চাকমা এসে লেবেল দেওয়া শুরু করার পরই আমরা শুনলাম কর্ণফুলি নদীতে বাঁধ দিয়ে পানি জমা রাখা হবে। সে জমা রাখা পানি লেবেল দেয়া পর্যন্ত ভরে যাবে। সেই পানিতে অনেক গ্রাম জায়গা জমি ডুবে যাবে সেটাই কাপ্তাই বাঁধ।
আমরা কেউ বিশ্বাস করিনি সত্যিকার অর্থে। এতদূর পানি কখনাে ওঠে- এই ছিল আমাদের কথা। কিন্তু সত্যি সত্যি যখন পানি এলাে ডুবিয়ে দিলাে সবকিছু তখন বিশ্বাস করতে হলাে। লেবেল দেওয়ার সাথে সাথে আবার গাছ কাটিংও শুরু হয়েছিল। বড় বড় লম্বা লম্বা গাছ কাটা হলাে আমাদের চোখের সামনে। চারিদিকে শুধু কাটা গাছ আর কাটা গাছ।
ভাবতেই আজো কেমন লাগে যে গাছগুলাে নিজের হাতে লাগিয়ে বড় করেছি ফল খেয়েছি সেগুলাে সব মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছে। তখন আমি অনেক কেঁদেছি। পানি তখন আসেনি তাই পানিকে নিয়ে ভয় ছিল না।
কিন্তু গাছের জন্য চোখের পানি ফেলেছি। এসব গাছের ক্ষতিপূরণ পেয়েছি কিনা আমি জানি না, তবে জমি জিরাতের জন্য টাকা পেয়েছি। কিন্তু টাকা দিয়ে কি সবকিছু পূরণ হয় বলাে।
আমাদের গ্রামটা ছিল সামান্য পাহাড়ের ওপর, লাঙেল যাকে বলে। সমতলের মধ্যে সামান্য পাহাড়। আমাদের চোখের সামনেই কিন্তু আমাদের বাড়িটা ডুবে গেল।
আমার আজো মনে আছে প্রথমে একবার পানি এলাে আবার পানি নেমে গেল। পরের বার পানি বাড়তে লাগলাে আস্তে আস্তে করে। পানি ফুলে গেছে মানে পানি বাড়ছে। বেশি পানি বেড়ে গেলে আমরা নৌকায় উঠে রিজার্ভ ফরেস্টে চলে এলাম।
পুরােনাে জিনিস যা পেরেছি তাই এনেছি। কিন্তু একটা সংসারের জিনিস সব কি আনা সম্ভব একেবারে। সামান্য কিছু আনতে পেরেছি। বাকিগুলাে তাে বাড়ির সাথে ডুবে গেল পানির তলে।
যদিও প্রথম দিকে বিশ্বাস করিনি যে পানি এতাে বড়াে হবে। কিন্তু গ্রামের অন্যদের দেখাদেখি আমাদেরও সন্দেহ হওয়াতে আমি আর আমার স্বামী মিলে ঠিক করলাম ঘরের জিনিসপত্র গৃহপালিত পশু বিক্রি করে দেবাে।
রাউজান সাতকানিয়া চিটাগাং থেকে অনেক বাঙালি আসতাে তখন এসব জিনিসপত্র কিনতে। বিক্রি করছে সব চাকমারা কিনছে বাঙালিরা। সব চাকমাদের তাে একই কপাল।
পানি আসার পর আমরা রিজার্ভ ফরেস্টে চলে এলাম। আগেই বলেছি দুঃখ এখানেই শুরু। গ্রামে এমন কষ্ট করে কখনাে থাকতে ফসল ফলাতে হয়নি। কত সুন্দর জমি ছিল আমাদের আর ফসর ফলতো খুব। এখানে এসে কোনো সমতল বা চাষবাস করার জমি নেই। সব নিজেদের বানাতে হবে। প্রথম বছর হয়তো পুরো নরক।
কষ্টে দুঃখে মনে হতাে মরে গেলেই শান্তি। বড় গাছ কেটে আগাছ সাফ করে ঘরের জন্য ফসলের জন্য জমি তৈরি করা সহজ নয়। চারদিকে বাঘের শব্দ আর নানা রকম শব্দে গা ছমছম করা জঙ্গল। এসব আমাদের পুরনো গ্রামে দেখিনি শুনিনি। তাই মনে হতাে এই কোন নরকে আমাদের ফেলে দিলে ভগবান।
দেশ ছাড়ার পালা
হঠাৎ করে আবার মানুষেরা বলতে শুরু করলাে দেশ ছাড়তে হবে। কোথায় যাবে? ইন্ডিয়ার দেমাগ্রীতে। দেখি অনেকে চলে যাচ্ছে। আমরা শুনলাম যে ইন্ডিয়াতে গেলে জায়গা পাওয়া যাবে রেশন পাওয়া যাবে। সরকার সব চাকমাদের জন্য দরজা খােলা রেখেছে। শুনে শুনে আমরাও ভাবলাম চলে যায়।
এই রিজার্ভে তিন বছর তাে থাকলাম কিন্তু কিছুই হলাে না আমাদের। এই ভালাে ইন্ডিয়াতে চলে যাওয়া। শত শত লােকের সাথে আমরাও একদিন এই দেশকে ছেড়ে দেমাগ্রীর পথে রওয়ানা দিলাম।
আমাদের দলের নেতা কে ছিল আমার মনে নাই। আসলে একে অপরকে দেখাদেখি করে দেমাগ্রীতে সবাই যাচ্ছে। তাে একদিন দেমাগ্রীতে পৌছলাম। হাজার লােকের সাথে নিজেদের নামটাও ক্যাম্পের লিস্টে উঠালাম। এরপর কোনাে একদিন দেমাগ্রী থেকে নেফাতে নিয়ে গেল ভারত সরকার।
আসলে অনেকটা সময় কেটে গেছে জীবনে। অনেক কিছু ভুলে গেছি। তবে মনে আছে দেমাগ্রী থেকে আইচলে (আইজল) আসার পথে হাঁটতে হয়েছে অনেকদিন। আমার তিনটা ছেলে থেকে ২ জন হাঁটতে পারে যে হাঁটতে পারে না তাকে পিঠে বেঁধে আর মাথায় একটা বােচকা নিয়ে দিনের পর দিন হেঁটেছি। হেঁটেছি না, হাঁটতে বাধ্য হয়েছি।
এছাড়া আর কোনাে পথ ছিল না আমাদের। ফেরার উপায় ছিল না তখন। রাস্তায় রাস্তায় ক্যাম্প বানিয়ে দিয়েছিল সরকার। অবশেষে একদিন আইজলে পৌছলাম। সেখান থেকে আমাদেরকে গাড়িতে করে ‘দোলাহ ক্যাম্প পর্যন্ত আনা হয়।
এই ক্যাম্পটি ছিল একটা ছড়ার পাশে। এখানে অনেক দিন থাকতে হয়েছে। রেশন পেয়েছি। এখানে এসে রেশন পেয়ে একটু শান্তি পেয়েছি। এবার একট জিরােতে পারবাে। অনেকদিন পর আবার আমাদের নেফার জন্য গাড়িতে উঠানাে হলাে। দোলাই ক্যাম্প থেকে বদলপুর, আসাম সেখান থেকে ট্রেনে করে লীড়ু ক্যাম্প তারপর এখান থেকে মিউতে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়। এই মিউতেই আমাদের বস্তি করানাে হলাে চাকমা বস্তি। মিউ’র স্থানীয় বাসিন্দা হচ্ছে চিম্পুইরা। তাদের সাথে আমরা রয়ে গেলাম।
আসলে প্রথম যখন দেমাগ্রীতে আমরা চলে আসি তখন কেউ নেফার কথা জানতাম না। এখানে আসার পর নেফার কথা শুনি। নেফাতাে এখন অরুণাচল। এখানে আসার পর প্রথম দিকে ত্রিপুরা থেকে বাবু স্নেহকুমার চাকমা, বাবু অদংগ মনি এবং বাবু প্রাননাথরা এসেছিলেন আমাদের দেখতে।
তখন তাদের সব বলেছি। বয়সের সাথে সাথে এখন সব ভুলে বসে আছি। বয়সেরই দোষ বলা যায়। কিন্তু তারপরও পুরােনাে জায়গার কথা মনে পরে খুব। আমি ছাড়া আমার সব ভাইবােন এখনাে দেশে থাকে।
৪৫ বছর পর দেশে ফেরা
১৯৬৪ সালে দেশ ছেড়েছি। আবার দেশে ফিরেছি ফেরা বললে ভুল হবে, দেশে বেড়াতে গেছি ২০০৮ সালে। আমার ভাইবােনদের চেহারা প্রায় ভুলে গেছি বললেই চলে। তাদেরও আমার চেহারা মনে নেই। নামেই শুধু চিনে। তারা শুনেছে যে আমি দেশে গেছি। তাে যাদের সাথে দেশে ফিরলাম তারাই আমার ভাইবােনদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাে আমাকে। সেসময়ের অনুভূতি বলে বােঝানাে যাবে না।
আমাদের সে কি কান্না তখন! আমার ভাই বােনদের নাম খুব সুন্দর- যামিনী মােহন, কামিনী মােহন আর রবি বালা। সেবছর আমি ১ বছর দেশে ছিলাম। নিজের দেশ নিজের জন্মভূমির প্রতি ভালােবাসা অন্যরকমের।
যখনই দেশে যাওয়া হয় তখন একপ্রকার উড়ে উড়ে যাই। কিন্তু ফিরে আসার সময় হলেই নাকের পানি চোখের পানি একত্র হয়ে ঝড়ে পরে। এই তাে গত মাসে আমি বেরিয়ে আসলাম এইবার তিন মাস ছিলাম দেশে। এখন তাে বয়স হয়ে গেছে।
কম করে হলেও এখন আমার বয়স ৭০-এর কাছাকাছি। আবার যেতে পারবাে কিনা জানি না। তাই বেড়িয়ে এলাম । হয়তাে এটাই আমার শেষ দেশে যাওয়া।
এখানে কেমন আছি?
প্রথম প্রথম এখানে আসার পর অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। এখানে তাে প্রচণ্ড ঠান্ডা। আমাদের দেশের সাথে মিলে না। থাকার জায়গাও এতাে ভালাে পাইনি আমরা। তবুও বলবাে এখানে আপাতত ভালােই আছি। বাংলাদেশে কোনাে শান্তি নেই।
আমরা এখানে অনেক শান্তিতে থাকি। যদিও নাগরিকত্ব আজো মেলেনি। এখনাে আমাদের ছেলেমেয়েরা পড়তে পারে না ত্রিপুরার মিজোরামের নাগরিক হিসাবে লেখাপড়া শিখে চাকরি করতে। আমার মেঝাে ছেলে এই ত্রিপুরাতেই শিক্ষকতা করছে। আমার বিশ্বাস একদিন আমরা নাগরিকত্ব পাবো।
কিন্তু দেশ শুধু একটা কারণেই টানে। আমার আত্মীয় স্বজনদের কারণে। শ্রদ্ধেয় নন্দপাল ভান্তে এখানে একটি বনবিহার করেছেন। দায়নের জোছনাপুর এলাকায়। এই শেষ বয়সে এটা আমাদের বিশেষ পাওয়া।
কাপ্তাই বাঁধ না হলে কি হতাে?
কাপ্তাই বাধ না হলে আমাকে দেশ ছাড়তে হতাে না, ভাইবােনদের থেকে এতদূরে থাকতে হতাে না। সেই কতদূরে ছিটকে পরে গেলাম এই কাপ্তাই বাঁধের কাজ আমার তাে মনে হয় আমাদের দেশ ছাড়ার জন্য এই কাপ্তাই বাঁধ দায়ী। বাঁধ না হলে পানি হতাে না পানি না হলে আমাদের জায়গা জমি ডুবে যাবার প্রশ্নই ওঠে।
আর পানিতে যদি আমাদের বাড়ি গ্রাম জায়গা জমি ডুবে না যেতাে তাহলে আমরা দেশ ছাড়তাম না। (দীর্ঘশ্বাস)।
আজো স্বপ্নে, একা বসে থাকলে কাপ্তাই বাঁধের পানির নিচে ডুবে যাওয়া আমাদের সেই লাঙলের পিঠের বাড়িটা গ্রামকে দেখতে পাই।
শেষ বয়সে এসে ভাবি যে কর্মফলের কারণে আমাদের আজ এই দুরবস্থা, বর্তমানের পূণ্যের ফলে আমাদের এই কষ্টকর জীবন যেন এই জীবনে শেষ হয়ে যায়।
লেখকঃ আনন্দ মুখি চাকমা মিউ, অরুণাচল, ভারত।
তথ্যসুত্রঃ “কাপ্তাই বাঁধ: বরপরং – ডুবুরীদের আত্মকথন” – সমারী চাকমা।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।