Last updated Aug 1st, 2020
5460
জেনেভা, সুইজারল্যান্ড ২৭-৩১, ১৯৯২
মাননীয় চেয়ারম্যান, কার্যদলের সম্মানিত সদস্যবৃন্দ ও বন্ধুগণ,
অসংখ্য ধন্যবাদ, আমাকে এতবড় প্লাটফর্মে কথা বলার সুযোগ প্রদানের জন্য। প্রথমেই আমি আমার পরিচয় দিয়ে শুরু করছি- আমি পার্বত্য চট্টগ্রামের বাসিন্দা যেটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত।
আমি আশা রাখব, আমার এই বক্তব্যের মাধ্যমে আদিবাসী বিষয়ক সংস্থাসমূহ আদিবাসীদের মূল সমস্যাগুলো বুঝতে পারবে এবং সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও ব্যবস্থা গ্রহণে যুগোপযোগী রূপরেখা প্রণয়নে সহযোগিতা করবে।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃস্থাপনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সাহায্য করলে ও তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতি খুবই নাজুক অবস্থায় রয়েছে।
বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী সেটেলারদের সাথে মিলে জুলাই থেকে ডিসেম্বর, ১৯৯১ এবং জানুয়ারি থেকে জুন, ১৯৯২ সালে যথাক্রমে ৬৬৩ ও ৬৫৬ টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটায়।
এরমধ্যে আদিবাসী গ্রাম দখল করার জন্য মানবতাবিরোধী সকল ধরনের অপরাধ যেমন-ডাকাতি,অগ্নিসংযোগ, বিনা অপরাধে আটক, মারধর, ধর্ষণ, ধর্মীয় নিপীড়ন, হত্যা, গণহত্যা ইত্যাদি অপরাধ সংঘটিত করে।
১৯৯২ সালের ১০শে এপ্রিল তেমনিভাবে লোগাং গুচ্ছ গ্রামে রাষ্ট্রীয়মদদে জুম্ম গ্রামে হামলা চালানো হয়। উক্ত হামলায় ১৫০০ জুম্ম পরিবারকে রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক উচ্ছেদ করা হয়।
বলা বাহুল্য, জুম্ম কৃষকদের কৃষি জমি ও ভূমি ইতোমধ্যে সেটেলারদের মাঝে বিতরণ করে নিরাপত্তা বাহিনী। তথাকথিত, জুম্ম বন্দীদের মুক্ত করার লক্ষ্যে সামরিক বাহিনী অজুহাত খুঁজতেছিল এবং সেজন্য তারা দু’জন সেটেলারকে লোগাং গুচ্ছ গ্রামে পাঠায় ও একজন জুম্ম নারীকে গরু চড়ানোর সময় ধর্ষণ করতে যায়।
নারীটি নিজেকে রক্ষার জন্য চিৎকার দেয় যার ফলে এক জুম্ম ভদ্রলোক সেখানে গিয়ে ধর্ষকদের প্রতিহত করার চেষ্টা চালায়, কিন্ত ধর্ষকরা বিপরীতে উক্ত লোকটিকে হামলায় মেরে ফেলে ও লাশটি সেখানে রেখে পার্শ্বর্বর্তী বিডিআর (বাংলাদেশ রাইফেলস) ব্যারাকে অবস্থান নেয়।
সেনাবাহিনী ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচার না করে অন্যদিকে ঘটনাকে মোড় দেওয়ার জন্য ধর্ষণের শিকার নারীকে আহত করে ও এর জন্য শান্তিবাহিনীকে দোষারোপ দেয়।
যার ফলস্বরূপ, শান্তিবাহিনী ধরার অজুহাত দিয়ে বাংলাদেশ নিরাপত্তা বাহিনী এবং সেটলাররা একযোগে লোগাং গুচ্ছগ্রামের অসংখ্য নিরীহ আদিবাসীদেরকে হত্যা করে সেদিন।
নিরাপদ আশ্রয় খোঁজার জন্য পালিয়ে যাওয়ার সময় ব্রাশফায়ারে মেরে ফেলা হয় অসংখ্য মানুষকে। আবালবৃদ্ধবনিতা সহ নারী ও শিশুদেরকে আক্রমনকারীরা ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের সূত্রে জানা যায়, ৮০০ ঘরবাড়ি ও প্রায় ১২০০ জনকে হত্যা করা হয়। প্রকৃতপক্ষে, গুচ্ছ গ্রামটিকে সমাধি ক্ষেত্রে পরিণত করা হয়। এই গণহত্যা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে আরেকটি জুম্ম শরণার্থীর ঢল পাঠায়।
বাংলাদেশ সরকার লোগাং গণহত্যার ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
গণহত্যা পরবর্তী সময়ে গোপনে মৃতদেহ সরানোর কাজ করে নিরাপত্তাবাহিনী; সেই সাথে গুচ্ছ গ্রামটিকে সিল গালা করে দেওয়া হয়।
উপরন্তু, ১২ই এপ্রিল, ১৯৯২ এ সংসদ সদস্যরা, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, সাংবাদিক, লেখক, আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী সহ বিশিষ্ট ২৩ জনকে সরকার আক্রান্ত গ্রামটি পরিদর্শনের অনুমতি দেয়নি।
গণমাধ্যমেও বিভ্রান্তিকর সংবাদ ছড়ায় সরকার। আন্তর্জাতিক মহলে এ ঘটনাকে নিয়ে অপপ্রচার চালায় বাংলাদেশ সরকার, এই ঘটনায় নাকি মাত্র ১১জন নিহত হয় এ ধরনের মিথ্যাচার চালায় বাংলাদেশ সরকার।
লন্ডনের বাংলাদেশ হাই কমিশন পুরো ঘটনাকে ভিত্তীহীন বলে উড়িয়ে দেয়।
২৫ শে এপ্রিল, ১৯৯২ এ ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মতিন চৌধুরী লোগাং গুচ্ছ গ্রামের ঘটনার জন্য শান্তিবাহিনীকে একতরফাভাবে দোষারোপ করেন।
পরবর্তীতে তিনি পদত্যাগ করলে ১৩ অক্টোবর, ১৯৯২ ইং তারিখ প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া পরিদর্শনে গিয়ে শান্তিবাহিনীকে দায়ী করে বিবৃতি দেন এবং শান্তিবাহিনী কর্তৃক কোন মুসলিম নিহত হলে এই ধরনের হামলা আরো হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন এবং সেই সাথে এ ঘটনার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে যে মদদ ছিল তার ইঙ্গিত দেন।
ভাগ্যক্রমে, সমবেদনাপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় লোগাং গণহত্যার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয় , ফলে বাংলাদেশ সরকারকে ঘটনার জন্য তদন্ত কমিটি গঠনে বাধ্য হয়।
কিন্তু তদন্তের জন্য বিচারপতি সুলতান হোসেন খানকে দায়িত্ব দেয়া হয় যিনি ছিলেন তৎকালীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী পার্টির পক্ষের লোক ও সরকারের সমর্থক। যার কারণে তদন্তে কোনো ধরনের সত্যতা উঠে আসেনি এবং প্রতিবেদনটি অসত্য, অবিশ্বাস্য ও মিথ্যা প্রমাণিত হয়।
তাছাড়াও তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য কঠোর পরিশ্রম করে স্পর্শকাতর বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়।
এমতাবস্থায় লোগাং গণহত্যা সম্পর্কে নিরপেক্ষ প্রতিবেদন পেতে আর কোনো সুযোগ নেই। উল্লেখ্য যে, ১৯৮০ সালে কাউখালি ও ১৯৮৯ সালে লংগদু গণহত্যা তদন্তের নিমিত্তে গঠিত কমিটির প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি।
রিপোর্ট করা হয় যে, লোগাং গণহত্যার বিষয়ে জনাব খানের দেওয়া প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার তার পদক্ষেপ নিয়েছে।
তাই লোগাং, লংগদু, মালয়, দীঘিনালা, বাঘাইছড়ি, মাটিরাঙা, কাউখালি, পানছড়িতে সংঘটিত হামলার ঘটনা তদন্তে আন্তর্জাতিক মহল থেকে যাতে কমিটি প্রেরণ করা হয় সেজন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহবান জানাচ্ছি।
বন্ধুগণ আপনাদের সবাইকে এতক্ষণ ধরে আমার বক্তব্য শোনার জন্য অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে আমার বক্তব্য এখানেই শেষ করছি।
– রামেন্দু শেখর দেওয়ান
পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের পক্ষে
রামেন্দু শেখর দেওয়ানের বক্তব্য ইংরেজিতে
অনুবাদকঃ অজমিদার ঠাকুর
প্রসঙ্গ:Chittagong Hill Tracts, CHT, Logang Massacre, Ramendu Shekhar Dewan, Refugee, রামেন্দু শেখর দেওয়ান, লোগাং গণহত্যা
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।