Last updated Sep 1st, 2021
1889
কৈশোরে প্রবল আগ্রহ ছিল বেদে বা বাইদ্যা সম্প্রদায়ের জীবন যাপনের ওপর। নৌকার জীবন- এ ঘাট থেকে ওঘাট।
দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ানো; সাপের খেলা দেখানো; সর্বোপরি বেদে মেয়ের সাথে ঘর পাতানোর শখ। বড় হয়ে অবশ্য সেসব শখ হারিয়ে গেছে; রোমাঞ্চকর সেসব ভাবনার জায়গায় এসে জমাট বেঁধেছে তাদের কষ্টকর জীবনের কথা।
অবশ্য বেদে সম্প্রদায় সম্ভবত তাদের এমন যাযাবর জীবনকে কষ্টের মনে করেন না; তা না হলে যুগের পর যুগ তারা এভাবে জলের ওপর সংসার পেতে জীবন কাটাতেন না নিশ্চয়ই!
আরব অঞ্চলে এখনো বেশ কিছু যাযাবর জাতির সন্ধান পাওয়া যায়। আরবদের সাথে যাযাবরদের যেন এক ঐতিহাসিক সম্পর্ক আছে। কিন্তু আমাদের উপমহাদেশে যাযাবর সম্প্রদায়ের সংখ্যা খুবই নগণ্য।
আবার যেসব যাযাবর জনগোষ্ঠী এখনো বর্তমান আছে, তাদের অবস্থাও বেশ সঙ্কটাপন্ন। বেদে সম্প্রদায় ছাড়া আমাদের দেশে আর কোনো যাযাবর জনগোষ্ঠী আছে কি না জানা নেই।
তবে আজ আমরা বেদেদের নিয়ে আলোচনা করবো না; আজকে আলোচনা করবো আমাদের প্রতিবেশী দেশ নেপালের সর্বশেষ যাযাবর সম্প্রদায় ‘রাউতি’ আদিবাসীদের ইতিকথা।
বর্তমানে এই ঐতিহাসিক সম্প্রদায়ের সদস্য সংখ্যা মাত্র ১৫০ জনের কাছাকাছি। অর্থাৎ প্রায় বিপন্ন এক বনজ আদিবাসী সম্প্রদায়ের নাম রাউতি।
রাউতিরা বর্তমানে নেপাল সরকারের তালিকাভুক্ত আদিবাসী সম্প্রদায়। ঐতিহাসিকভাবে তাদের নির্দিষ্ট কোনো বাসস্থান নেই; কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা নেই; কোনো গৃহপালিত পশুপাখি নেই; খাদ্যের সংরক্ষণাগার নেই; পুরোপুরি বনের ওপর নির্ভরশীল এক যাযাবর জাতি।
ক্রমান্বয়ে স্থান পরিবর্তন করে বনের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে বসবাস করা তাদের ঐতিহ্য। লঙ্গুর ও ম্যাকক প্রজাতির বানর শিকার এবং বন্য আলু তাদের খাদ্যের প্রধান উৎস। এছাড়া বনের লতা-পাতা ও ফল-ফলাদিও তারা ভক্ষণ করে থাকে।
দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত অধিকাংশ জিনিসপত্র, যেমন- বাদ্যযন্ত্র, অলঙ্কার, পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদিও তারা বন্য গাছ ও লতাপাতার সাহায্যে তৈরি করে থাকে।
তবে সম্প্রতি স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে কিছু আধুনিক পোশাকপরিচ্ছদও সংগ্রহ করতে দেখা যায় তাদের।
বনের শুকনো কাঠ সংগ্রহ করে তাতে আগুন জ্বেলে অস্থায়ী চুলায় তারা রান্নাবান্না করে। রান্নার সময় পরিবারের অধিকাংশ সদস্য চুলার চারপাশ ঘিরে গোল হয়ে বসে; এটি তাদের একটি ঐতিহ্য।
একে অনেকটা গোত্রীয় বা পারিবারিক সংসদের সাথে তুলনা করা যেতে পারে; এ সময় তারা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে।
তারা কখনো বন্য সম্পদ বিক্রি করে না, যেহেতু বন তাদের আশ্রয় দেয়, তাই বনকে তারা ‘বাড়ি’ হিসেবে গণ্য করে। তাদের বিশ্বাস অনুসারে, বন্য সম্পদ বিক্রি করা মানে, নিজেদের বাসস্থান নিজেরা ধ্বংস করে ফেলা।
রাউতিদের নিজস্ব সংস্কৃতি, জীবনযাপনের পাশাপাশি তাদের নিজস্ব ভাষাও রয়েছে। তারা তাদের ভাষাকে ‘রাউতি ভাষা’ বলে থাকে।
রাউতিদের পারিবারিক প্রথায় নারী-পুরুষের শ্রম বিভাজন দেখা যায়। শিকার করা, খাদ্য সংগ্রহ করা, বাসস্থানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ ঘরের বাইরের কাজগুলো সাধারণত পুরুষরা করে থাকে।
ফসল খাওয়ার উপযোগী করা, রান্নাবান্না করা, সন্তান লালন-পালন করাসহ ঘরের যাবতীয় কাজগুলো নারীদের করতে দেখা যায়।
বিশিষ্ট ব্রিটিশ সাংবাদিক কেট হামবেল রাউতিদের নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করেন। সেই ডকুমেন্টারি তৈরির অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন,
তারা অত্যন্ত অরক্ষিত অবস্থায় জীবনযাপন করছেন। তাদের বর্তমান সদস্য সংখ্যা ১৫০ এর চেয়েও কম হবে। তারাই নেপালের সর্বশেষ যাযাবর আদিবাসী সম্প্রদায়। যে বন তাদের ঐতিহাসিক বাসস্থান হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে, সেই বন ধীরে ধীরে অদৃশ্য শক্তির নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। সরকারি কর্মকর্তাদের চাপের মুখে বাধ্য হয়ে এখন তাদের বনের একপার্শ্বে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে হচ্ছে; যা তাদের মতো যাযাবর সম্প্রদায়ের জীবনধারনের জন্য বেশ অস্বস্তির।
একসময় বন ছিল রাউতিদের জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ। ফলে তারাও ছিলেন স্বনির্ভর। কিন্তু দিন দিন বন উজার আর দখল হয়ে যাওয়ায় তারা পড়েছেন বিপাকে।
বর্তমানে তারা বাধ্য হয়ে সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা গ্রহণ করছেন। তবে এই সাহায্যকে কখনই তারা ইতিবাচকভাবে নেননি; তারা চেয়েছেন তাদের আবাসস্থল বনের ওপর পূর্ণ অধিকার; কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য শক্তি তাদের এই সাহায্য গ্রহণ করতে বাধ্য করছে; বিনিময়ে কেড়ে নিচ্ছে তাদের ঐতিহাসিক আবাসস্থল ঘন বনাঞ্চল।
তাদের এই দুঃখ সমতলের কিংবা আধুনিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত কোনো মানুষের পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন কেট।
রাউতিদের নিয়ে গভীরভাবে গবেষণা করছেন বাটসক নামের এক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া গবেষক। জানা গেল, বাটসকের এই গবেষণার কাজটি মোটেও সহজ নয়।
তিনি একটি খনিজ সম্পদ খনন কোম্পানিতে একমাস কাজ করেন এবং সেখান থেকে প্রাপ্ত অর্থ নিয়ে চলে আসেন রাউতিদের নিবাসে।
তারপর তাদের সাথে একাকার হয়ে গিয়ে অনুসন্ধান করেন রাউতিদের আনন্দ-বেদনা ও ঐতিহ্যের ইতিহাস। বাটসক তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন,
এসব যাযাবর পরিবারের সাথে বসবাস করতে গিয়ে আমার দুটি জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে; প্রথমত, নিঃসন্দেহে এমন জীবনযাপন করা অত্যন্ত কঠিন; দ্বিতীয়ত, তাদের জীবনযাপন যতই অদ্ভুত হোক না কেন, ভাগ্য তাদের সাথে আছে। তা না হলে প্রকৃতির নিষ্ঠুরতা বহু আগেই হয়তো তাদের নিঃশেষ করে দিত। আমি তাদের ঐতিহ্যের চেতনা এবং আত্মনির্ভরশীল মানসিকতা দেখে মুগ্ধ হয়েছি। আমি তাদেরকে অবনত চিত্তে সম্মান জানাই।
বাটসক আরও বলেন-
আমি আরও একটি বিষয় গভীরভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছি: তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি এবং আত্মপরিচয় রক্ষার লড়াই-ই তাদের এই লড়াকু মানসিকতা গড়ে দিয়েছে; যা আমাদের মতো সাধারণ পরিবেশে জীবনযাপনে অভ্যস্ত মানুষের পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব নয়।
তবে কীসের ভিত্তিতে রাউতিরা বারবার স্থান পরিবর্তন করে- এটি নিয়ে উৎসুকদের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে।
ব্রিটিশ সাংবাদিক কেট হামবেলের অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, যখন তাদের মধ্য থেকে কেউ মারা যায়, তখন তার সৎকার শেষে তারা সেই স্থান পরিত্যাগ করে অন্য জায়গায় চলে যায়।
এছাড়া যখন আবাসস্থলের আশেপাশে বেঁচে থাকার অবলম্বনের সংকট দেখা দেয়; শিকার কমে আসে, বৃক্ষ কমে যায়, তখন তারা সেই স্থান পরিবর্তন করে।
আরেকটি কারণ জানা যায়, যা রহস্যময়- কখনো কখনো তাদের ওপর স্থান ত্যাগের দৈব ইশারা আসে, তখনও তারা তাদের স্থান পরিবর্তন করে।
যে কথাটি বলা হয়নি, তা হলো তাদের এই বনের নাম আকহাম। ইতিমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, কোনো এক অদৃশ্য শক্তির কারণে তারা তাদের বনের দখল হারাচ্ছে।
আগ্রাসনের বর্তমান পর্যায়ে তারা আকহাম বনের ‘মিডল হিলস’ নামক স্থানে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। সেখানেই এখন তারা বসবাস করছেন।
জায়গাটি সমতল ভূমি হলেও অত্যন্ত বিপদজনক; কেননা এর পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশ্বের সর্বোচ্চ উচ্চতার বরফাচ্ছাদিত পর্বত হিমালয়। কিছুদিন আগেও এক ভূমিধ্বসে ক্ষতিগ্রস্থ হয় রাউতিরা।
এখন তারা তাদের অস্তিত্ব নিয়ে বড় ধরনের সংকটে আছে। যেকোনো মুহূর্তে একটি ভয়ানক প্রাকৃতিক দুর্যোগ চিরতরে মুছে দিতে পারে ছোট্ট এই আদিবাসী সম্প্রদায়ের অবশিষ্ট সদস্যদেরকে।
তথ্যসূত্রঃ রোর বাংলা
প্রসঙ্গ:আদিবাসী, নেপাল, নেপালের আদিবাসী, যাযাবর আদিবাসী, রাউতি, রাউতি আদিবাসী
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।