Last updated Oct 8th, 2025
3
বৃটিশ আমল
বৃটিশ আমলে আদিবাসীদের ভূমি সুরক্ষার জন্য বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহন করা হলেও ‘সংরক্ষিত বনাঞ্চল’ ঘোষণা এবং সেই বনাঞ্চলে বিদেশী জাতের বৃক্ষ রোপণ আদিবাসীদের আর্থ-সামাজিক জীবন ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনে। বৃটিশ আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘শাসন বহির্ভূত অঞ্চল’ ঘোষণা এক যুগান্তকারী ঘটনা ছিল। এই আইন যদি বর্তমান অবধি বহাল থাকতো তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরের লোকেরা আজ এই অঞ্চলে এসে আদিবাসীদের জায়গা জমি কেড়ে নিতে পারতো না। এই আইন মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরের লোকের পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমির মালিকানা স্বত্ব পাবার অধিকার ছিলো না। ভারতে এখনো এ ধরণের ব্যবস্থা ও আইন বহাল রয়েছে। ভারতের মিজোরাম, অরুণাচল, মেঘালয় ইত্যাদি রাজ্যে এ ধরণের আইন এখনো বর্তমান। মিজোরামে বা অরুণাচলে ভারতের অন্য কোন রাজ্য বা অঞ্চলের লোক যেতে চাইলে রাজ্য কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে এসব রাজ্যে ঢুকতে হয়। অন্যথায় রাজ্য কর্তৃপক্ষ আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। পাকিস্তান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে বৃটিশ প্রণীত এই আইন রহিত করার কারণে আজ আদিবাসীরা যেমন ভূমির মালিকানা হারাচ্ছে তেমনি জনসংখ্যা, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়েও প্রান্তিক অবস্থানে নিপতিত হয়েছে। অপরদিকে বৃটিশ কর্তৃক আদিবাসীদের জুমভূমিকে ‘সংরক্ষিত বনাঞ্চল’ ঘোষণার কারণে আদিবাসীরা একদিকে যেমন তাদের জুমভূমি হারিয়েছে তেমনি পরিবেশের দিক থেকে মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়েছে। বৃটিশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের বন ধ্বংস করে হাজার হাজার একর জায়গায় বিদেশী জাত সেগুন গাছের বাগান গড়ে তুলেছে। এতে দেশের যে বনাঞ্চল ছিল তা ব্যাপক পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে।
পাকিস্তান আমল
পাকিস্তান সরকার আদিবাসীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল না; বরং এ সরকার-
১. পার্বত্য চট্টগ্রামে ভারত থেকে আসা বাঙালিদের আইন লংঘন করে আদিবাসীদের জায়গায় পুনর্বাসন করেছিলো;
২. কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করার মধ্য দিয়ে-
(ক) লক্ষাধিক অদিবাসীকে নিজা বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করেছিলো
(খ) পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে উর্বর ভূমি ৫৪ হাজার একর ১ম শ্রেণীর জমি (যা পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট ভূমির ৪৮%) জলে নিমজ্জিত করেছিল।
৩. এই বাঁধের কারণে আদিবাসীদের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙে পড়েছিলো;
৪. এ বাঁধের কারণে জুমভূমি হ্রাস পেয়েছিলো
৫. এই বাঁধের কারণে বন ও জুমভূমি নষ্ট হলো
৬. পাকিস্তান সরকার পাহাড়ি পুলিশ বাহিনী বিলুপ্ত করেছিলো যা বৃটিশ আমলে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো;
৭. আদিবাসীদের ভূমি অধিকার সুরক্ষা সংক্রান্ত সনদ ‘শাসন বহির্ভূত এলাকা’ স্ট্যাটাস (Excluded Area Status) বাতিল করেছিলো;
বাংলাদেশ আমল
পাকিস্তান সরকার কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের বিরুদ্ধে ব্যাপক নিপীড়ন নির্যাতন ও কতগুলি ক্ষতিকারক উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুললে সে আন্দোলনে আদিবাসীরাও স্বতস্তভাবে অংশগ্রহণ করে। সমতল এলাকার পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীসহ আদিবাসী জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ১৯৭১ সালেস্বাধীনতা লাভ করে এবং ১৯৭২ সালে সংবিধান রচিত হয়। কিন্তু, দুখজনক হলেও সত্য আদিবাসী- বাঙালির রক্তে গড়া স্বাধীন দেশের এ সংবিধানে আদিবাসীদের স্বীকৃতি মেলেনি। আদিবাসীদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে স্বীকার করা হয়নি। আদিবাসীদের প্রথাগত ভূমি অধিকার সংবিধান কর্তৃক সরাসরি স্বীকৃত নয়। তবে বাংলাদেশ সরকার ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি’ বাতিল করেনি। এ শাসনবিধির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা ভূমিসহ অন্যান্য অধিকার সীমিত আকারে ভোগ করে আসছে। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন এবং পরবর্তীতে দেশে সামরিক শাসন জারীর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের জীবনে নেমে আসে এক কালো অমানিশা। জেনারেল জিয়ার শাসনামলে ৪ লক্ষাধিক সেটেলার বাঙালি পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসন করা হয়। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক দেশের অন্যান্য জেলা প্রশাসকদের নিকট দুটি গোপনীয় পত্র লেখেন। সরকার এসব অসহায় ও নিরীহ বাঙালিদের মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহারের জন্য সার্কুলার দিয়ে সংগ্রহ করে এবং তাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসন করে। সার্কুলারে প্রতিটি সেটেলার বাঙালি পরিবারকে নিম্নলিখিত সুবিধা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়-
ক্রমিক নং | একক | জমির পরিমাণ/ টাকার পরিমাণ | জমির ধরণ |
১ | পরিবার প্রতি | ২.৫ একর | সমতল কৃষি জমি |
২ | পরিবার প্রতি | ৪ একর | মিশ্র জমি |
৩ | পরিবার প্রতি | ৫ একর | পাহাড়ি জমি |
৪ | পরিবার প্রতি | এককালীন ৫০০ টাকা | মাসিক ২০০ টাকা ও ১২ সের খাদ্যশস্য |
প্রথম ৩০,০০০ পরিবারকে পুনর্বাসনের কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত সরকার ৮০,০০০ পরিবারকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসন করে।
৮০ হাজার পরিবারকে পুনর্বাসন করলে জমির পরিমান দাঁড়ায়-
ক্রমিক নং | জমির ধরণ ও পরিমাণ | জমির ধরণ | মোট জমির পরিমান |
১ | ২.৫ একর × ৮০,০০০ পরিবার | কৃষি জমি | ২০০,০০০ একর |
২ | ৪ একর × ৮০,০০০ পরিবার | মিশ্র জমি | ৩২০,০০০ একর |
৩ | ৫ একর × ৮০,০০০ পরিবার | পাহাড় জমি | ৪০০,০০০ একর |
পাকিস্তান সরকার ভূমির সংকটের জন্য কাপ্তাই বধের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের ভূমির পরিবর্তে ভূমি প্রদানের কথাথাকলেও প্রতিশ্রুতি মোতাবেক আমি দিতে পারেনি। অথচ দিয়া সরকার লক্ষ লক্ষ একর ভুমি প্রদানের। প্রতিশ্রুতি দিয়ে ও অন্যান্য প্রলোভন দেখিয়ে অসহায় ও নিরীহ বাঙ্গালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামে অভিবাসিত করে।
ফলশ্রুতিতে যা হবার তাই হয়েছে। সরকার কর্তৃক আদিবাসীদের ভূমির উপর সেটেলার বাঙালিদের বসতিস্থাপন শুরু করা হলে শুরু হয় আদিবাসী ও সেটেলারদের মধ্যেকার বিরোধ ও সংঘাত। এই বিরোধ ও সংঘাতকে কেন্দ্র করে পার্বত্য চট্টগ্রামে বহ গণহত্যা সংঘটিত হয়। এর মধ্যে লোগাং, রাম্বাদেবা, লংগদু ও কাউখালী গণহত্যা অন্যতম। এই গণহত্যায় শত শত আদিবাসীকে হত্যা করা হয়। আদিবাসীরা বাধ্য হয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে অশ্রয় গ্রহণ করতে হয় এবং বহু অদিবাসী গভীর জঙ্গলে আশ্রয় গ্রহণ করে। বর্তমানেও ভূমি বিরোধের কারণে পাহাড়ী বাঙালির মধ্যে প্রায়শ: সহিংস ঘটনা ঘটছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ছোট বড় যে সব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল সবই ভূমি বিরোধকে কেন্দ্র করেই হয়েছিলো।
আয়তনের দিক দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের এক দশমাংশ হলেও চাষাবাদ ও বসবাসযোগ্য ভূমির পরিমান একেবারেই কম। পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ ভূমি হচ্ছে বনায়নযোগ্য ভূমি। ১৯৬৪-৬৬ সালে কানাডার ফরেষ্টল ফরেষ্ট্রি এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্টারন্যাশন্যাল লিমিটেড এর ভূমি জরিপ রিপোর্ট অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমির ধরণ ও পরিমাণ নিম্নরূপ –
শ্রেণী | ভূমির ধরণ | ভূমির পরিমাণ (একর) | শতাংশ |
এ | কৃষি জমি | ৭৬,৪৬৬ | ৩.১% |
বি | ঢালু জমি | ৬৭,৮৭১ | ২.৭% |
সি | উদ্যানচাষ উপযোগী জমি | ৩,৬৬,৬২২ | ১৪.৭% |
ডি | শুধুমাত্র বনায়নে উপযোগী | ১৮,১৬,৯৯৩ | ৭২.৯% |
সি-ডি | বন বাগান উপযোগী | ৩২,০২৮ | ১.৩% |
– | বাস্তুভিটা | ৬৫৩ | – |
– | জল ও নদী-নালা | ১,৩১,৬৩৭ | ৫.৩% |
– | মোট | ২৮,৯২,২৬৬ | ১০০% |
উপরোক্ত তথ্যানুযায়ী প্রমাণিত হয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ অত্যন্ত কম। এ ও বি শ্ৰেণীর জমিগুলো যদি সব ধরা হয় তাহলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৫.৮%। তন্মধ্যে ধান্য জমির পরিমাণ মাত্র ৩.১% তথা ৭৬,৪৬৬ একর। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংখ্যা যদি সরকারী উদ্যোগে বসতি প্রদানকারী রাজনৈতিক অভিবাসীদের বাদ দিয়ে শুধুমাত্র আদিবাসী জুম্ম ও পুরোনবস্তী স্থায়ী বাঙ্গালি মিলে একত্রে ৯ লক্ষ স্বায়ী অধিবাসী ধরা হয় তাহলে তাদের মধ্যে মাথাপিছু ধান্য জমির পরিমাণ দাঁড়ায় মাত্র ০.০৮ একর। এছাড়াও এ ও বি শ্রেণীর জমিগুলো একত্র করলে মোট ভূমির পরিমাণ দাড়ায় ১৪৪,৩৩৭ একর যা ৯ লক্ষ লোকের মাথাপিছু পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ০.১৬ একর (ধানী ও ঢালু জমি মিলে)। অথচ সমগ্র বাংলাদেশেও মাথাপিছু জমির পরিমাণ ০২০ একর। অপরদিকে এ, বি, সি ও সি-ডি শ্ৰেণী একত্রে ধরা হলে জমির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ৫৪২,৯৮৩ একর এবং ৯ লক্ষ জনসংখ্যার মধ্যে প্রতি পরিবারে ৫ জন জনসংখ্যা হিসেবে মোট ১৮০,০০০ পরিবারের পরিবার পিছু জমি পড়ছে ৩.০ একর (পাহাড় ও ধান্য জমি মিলে) – যা একটি পরিবারের ভরণ-পোষনের জন্য মোটেই পৰ্যাপ্ত নয়। সুতরাং পার্বত্য চট্টগ্রামে মাথাপিছু জমির পরিমাণ অত্যন্ত বেশী একথা সত্য নয়। অধিক পার্বত্য চট্টগ্রামের জমি দেশের সমতল জমির মতো উর্বর ও বহু ফসলী নয়।
ভূমি বিরোধ নিম্পত্তি আইন-২০০১ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ( ঘ) খন্ডের পুনর্বাসন, সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন ও অন্যান্য বিষয়াবলী অংশের ৪ নং -এ স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে-
১. পার্বত্য চট্টগ্রামের জায়গা-জমির বিরোধ নিষ্পত্তিকল্পে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে একটি কমিশন (ল্যান্ড কমিশন) গঠিত হবে;
২. পুনর্বাসিত শরণার্থীদের জমিজমা বিষয়ক বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তি করার জন্য এ কমিশন কাজ করবে;
৩. শরনার্থীদের জমিজমা বিষয়ক বিরোধ নিষ্পত্তি ছাড়াও এযাবৎ যেসব জায়গা-জমি ও পাহাড় অবৈধভাবে বন্দোবস্ত ও বেদখল হয়েছে সে সমস্ত জমি ও পাহাড়ের মালিকানা স্বত্ব বাতিল করার পূর্ণ ক্ষমতা এই কমিশনের থাকবে;
৪. ফ্রিঞ্জল্যান্ড বা জলেভাসা জমির ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য হবে।
সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভুমির বিরোধ নিষ্পত্তি করে ‘ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইন-২০০১’ প্রণয়ন করে। ২০০১ সালে এ সংক্রান্ত যে অইন প্রণীত হয় সে আইনে চুক্তিতে উল্লেখিত ভূমি সংক্রান্ত সব বিষয়াদি অন্তর্ভুক্ত হয়নি। ভুমি বিরোধ নিম্পত্তি আইন- ২০০১ এ শুধুমাত্র পাহাড়ী শরনার্থীদের জমিজমা বিরোধ নিষ্পত্তির কথা উল্লেখ আছে। জলেভাসা জমি এবং অন্যান্য বিরোধকৃত জমিজমা নিষ্পত্তির কথা এ আইনে উল্লেখ নেই। সেদিক থেকে ভূমি বিরোধ নিম্পত্তি আইন-২০০১ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সাথে বিরোধাত্মক। এই আইনটি একদিকে চুক্তি বিরোধী অপরদিকে অগণতান্ত্রিক ও বটে। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইন- ২০০১ এর ৭(৫) ধারায় উল্লেখ আছে যে, চেয়ারম্যান উপস্থিত অন্যান্য সদস্যদের সহিত আলোচনার ভিত্তিতে ধারা ৬(১)-এ বর্ণিত বিষয়টিসহ উহার এখতিয়ারভুক্ত অন্যান্য বিষয়ে সর্বসম্মতির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন, তবে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব না হলে চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তই কমিশনের সিদ্ধান্ত বলিয়া গণ্য হবে। চুক্তির সাথে বিরোধাত্মক বিষয়সহ এই অগণতান্ত্ৰিক বিষয়টিও সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। গণতন্ত্রের দেশে এ ধরণের অগণতান্ত্রিক আইন কোনভাবে কাম্য নয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এ প্রস্তাব দিয়েছে। বর্তমানে এটি সংশোধনের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানা যায়। এ ব্যাপারে সরকার ও আঞ্চলিক পরিষদ কাজ করে চলেছে বলে জানা যায়। তবে, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন- ২০০১ সংশোধন না করে ভূমি কমিশনের কাজ শুরু করা হলে ভূমি সমস্যা আরো জটিল আকার ধারণ করবে এতে কোন সন্দেহ নেই।
ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যানের উদ্যোগ এবং চুক্তি ও এ সংক্রান্ত আইন
মহাজোট সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের ভুমি বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে প্রাক্তন বিচারপতি খাদেমুল ইসলাম চৌধুরীকে ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান পদে নিযুক্তি প্রদান করে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইন- ২০০১ সংশোধন না করে ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান নিয়োগ করায় যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি। এ কারণে ভূমি কমিশনের কার্যক্রমে সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। ভূমি কমিশনের আইনে অগণতান্ত্রিক ও এককভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার বিধান থাকায় ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান এককভাবে ভূমি জরীপের ঘোষণা দেন, যা চুক্তির সাথে সাযুজ্যপূর্ণ নয়। তিনি ১৫ অক্টোবর ২০০৯ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ভূমি জরীপ শুরু করার ঘোষণা দিলেন। ৬ মাসের মধ্যে এ জরীপ সম্পন্ন করা হবে বলে তিনি জানালেন। ভূমি জরীপের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে পার্বত্য চট্টগ্রামে টেনশন শুরু হয়ে যায়। জনসংহতি সমিতি, আঞ্চলিক পরিষদ, সার্কেল চীফ, সরকারী দলের এম পি, বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলন, হেডম্যান এসোসিয়েশন ভূমি জরীপ ঘোষণার প্রতিবাদ জানায়। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন সংশোধন না করে ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান নিয়োগ সরকারের এক ভুল সিদ্ধান্ত হয়েছে। উচিত ছিল আগে চুক্তির বিরোধাত্মক ধারাসমূহ সংশোধন করা, অতঃপর চেয়ারম্যান নিয়োগ করা। অথবা চেয়ারম্যান কমিশনের দায়িত্ব গ্রহণ করেই আইন সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারতেন। তিনি তা না করে ভূমি জরীপের ঘোষণা দিলেন যা তাঁর এখতিয়ারভুক্ত নয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির (খ) খন্ডের পুনর্বাসন, সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন ও অন্যান্য বিষয়াবলী অংশের ২ সং এ স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে, সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর ও বাস্তবায়ন এবং উপজাতীয় শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উপজাতীয় উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের পর সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুযায়ী গঠিতব্য আঞ্চলিক পরিষদের সাথে আলোচনাক্রমে যথাশীঘ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জরিপ কাজ শুরু এবং যথাযথ
যাচাইয়ের মাধ্যমে জায়গা-জমি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করতঃ উপজাতীয় জনগণের ভূমি মালিকানা চুড়ান্ত করিয়া তাহাদের ভূমি রেকর্ডভুক্ত ও ভুমির অধিকার নিশ্চিত করিবেন। সুতরাং এটি পরিস্কার যে সরকার- ১. পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন, ২. উপজাতীয় শরনার্থী পুনর্বাসন, ৩. উপজাতীয় আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন করার কাজ সম্পন্ন করার পর, ৪. আঞ্চলিক পরিষদের সাথে আলোচনা করে ভূমি জরীপের কাজ শুরু করবে । ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি খাদেমূল ইসলাম চৌধুরী ভূমি জরীপ ঘোষণার আগে চুক্তি অনুসরণ করে আঞ্চলিক পরিষদের সাথে আলোচনা করেননি। ভুমি জরীপের যে ঘোষণা দিবেন একবারের জন্যও তিনি আঞ্চলিক পরিষদের সাথে আলোচনা করার প্রয়োজন বোধ করেননি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি থেকে ভূমি কমিশন আইন ও ভূমি কমিশনের জন্ম। ভূমি কমিশনের আইনের মধ্য দিয়ে ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যানের জন্ম। সুতরাং ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে অস্বীকার করার অর্থই হলো নিজের জন্মকে অস্বীকার করা। আমরা বিভিন্ন জনের কাছ থেকে জানতে পেরেছি তিনি একজন ভাল মানুষ। দেশের ভাল মানুষরাই যদি আদিবাসীদের প্রতি এরুপ আচরণ করেন তাহলে আমরা কোথায় যাবো? ভাল মানুষেরা যদি আদিবাসীদের প্রতি বিরূপ আচরণ করেন তাহলে যারা ভাল নয়- সাম্প্রদায়িক ও অগণতান্ত্রিক, তারা আদিবাসীদের প্রতি খুব খারাপ আচরণ করবে এটি ধরে নেয়া যায়। মূল সমস্যা হলো খাদেমূল ইসলাম চৌধুরীর মতো ভাল মানুষেরাও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থাকে বাস্তবে স্বীকৃতি দিতে চায় না। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসন ব্যবস্থার মূল প্রতিষ্ঠান আঞ্চলিক পরিষদ ও চুক্তির প্রতি তাঁর যদি নূ্ন্যতম শ্রদ্ধা থাকতো তাহলে তিনি এককভাবে ভূমি জরীপের যোষণা দিতে পারতেন না। খাদেমূল ইসলাম ৬ মাসের মধ্যে ভূমি জরীপ সম্পন্ন করার ঘোষণা দিলেন। অথচ এখনো ভূমি কমিশনের পূর্ণাঙ্গ অফিস হয়নি, সব কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োপ্রাপ্ত হয়নি, কমিশনের জন্য পরিসম্পদ ও তহবিল বরাদ্ধ করা হয়নি। তিনি খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার জেলা প্রশাসককে ভূমি কমিশনের সচিব নিয়োগ করলেন এককভাবে। ভূমি কমিশনের সচিব পদে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসককে নিযুক্তি প্রদানও বাস্তবসম্মত ও যথাযথ হয়নি। একজন জেলা প্রশাসকের কাজের শেষ নেই। তিনিএকজন ব্যস্ত মানুষ। অপরদিকে ভূমি কমিশনের কাজ হলো অত্যন্ত জটিল ও ব্যাপক। এমতাবস্থায় ৬ মাসে ভূমি জরীপ সম্পন্ন করা একেবারেই অবাস্তব ব্যাপার। ভূমি জরীপের সাথে সম্পৃক্ত বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য ৬ মাস নয় ৬ বছরেও পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি জরীপ শেষ করা যাবে না। চেয়ারম্যান খাদেমুল ইসলাম জেনে শুনে সুস্থ মস্তিষ্কে ভূমি জরীপের ঘোষণা দিয়েছেন। কারণ তাঁর আসল উদেশ্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করা নয়; চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে জটিল ও বাধাগ্রস্ত করাই তাঁর মূল উদ্দেশ্য। অন্তত: তাঁর কার্যক্রম ও কর্মকৌশল তারই ইঙ্গিত করে। তিনি একজন প্রাক্তন বিচারপতি। তিনি কি চুক্তির ভাষা বুঝেন না, না আইন বুঝেন না? তিনি সবকিছু বুঝেন এবং জানেন। জেনে শুনে সুস্থ মস্তিস্কে পরিকল্পনা হাতে নিয়ে তিনি ধাপে ধাপে এগিয়ে চলেছেন বলে আমার ধারণা। ভূমি কমিশনের অইনে কোথাও ভূমি জরীপের কথা উল্লেখ নেই। সুতরাং তিনি ভূমি জরীপের ঘোষণা দিতে পারেন না। ভুমি কমিশনের কাজ হলো পার্বত্য চট্টগ্রামের রীতিনীতি ও প্রথা পদ্ধতির ভিত্তিতে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করা এবং বেআইনী ও অবৈধভাবে বেদখলকৃত জায়গা জমি মূল মালিকের নিকট হস্তান্তর করা।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ:
ভূমি সমস্যা বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে জটিল সমস্যা। কারণ এ সমস্যার সাথে গভীরভাবে জড়িত বসতিস্থাপনকারী সেটেলার সমস্যা। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেটেলার বাঙালিদের বসতিস্থাপন শুরু হয় পাকিস্তান আমলে। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি মুসলিম অধুষিত অঞ্চলে পরিণত করার পরিকল্পনা গ্রহন করে। এই পরিকল্পনা ও যড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি’ লংঘন করে পাকিস্তান সরকার এ অঞ্চলে ভারত থেকে আসা বাঙালিদের পুনর্বাসন করেছিল। পরবর্তীতে ১৯৭৯-১৯৮৬ সালের মধ্যে জিয়াউর রহমান সরকার দেশের বিভিন্ন এলাকায় সার্কুলার দিয়ে ৪ লক্ষাধিক সেটেলার বাঙালিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি অদিবাসীদের জায়গায় পুনর্বাসন করে। এছাড়াও সরকার বনায়নের নামে, সেনা ক্যাম্প,সামরিক গ্যারিসন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্ৰ স্থাপন ও সম্প্রসারণের নামে হাজার হাজার একর পাহাড়ি আদিবাসীদের ভূমি অধিগ্রহন করছে। প্রতিষ্ঠান, আমলাসহ বিভিন্ন ব্যক্তিও পাহাড়ি আদিবাসীদের ভূমি দখল করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা চতুর্দিক থেকে ভূমি আগ্রাসনের শিকার। তাই ভূমি সমস্যাটি বর্তমান সময়ে এসে পাৰ্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে জটিল সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
বৃটিশ সরকার থেকে শুরু করে বিশেষত: পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকার কর্তৃক অদিবাসীদের প্রথাগত ভূমি ব্যবস্থাপনা ও অধিকারকে অশ্রদ্ধা ও অস্বীকৃতিই হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিবিরোধের মূল কারণ। এখানে দেশপ্রেম না থাকা এবং জনগণের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে না পারার দিকটিও লক্ষ্যনীয়। সব সরকারের যদি দেশপ্রেম ও জনগণের স্বার্থের প্রতি কমিটমেন্ট থাকতো তাহলে হাজার হাজার একরের বন ধ্বংস করে সেখানে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বৃক্ষায়ন করতে পারতো না। বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারের আমলেও আদিবাসীদের জুমভূমি কেড়ে নিয়ে জুমভূমি ধ্বংস করে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বৃক্ষায়ন করা হয়েছে। সরকার ১৯৯২ সালে নতুন করে ২ লক্ষ ১৮ হাজার একর জুমভূমি সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করে। এসব নিয়ে বন বিভাগের সাথে অদিবাসীদের ভূমি ও ভূমির সম্পদ নিয়ে বিরোধ বাধে। বন বিভাগ হয়রানী ও ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য একটু সুযোগ পেলেই আদিবাসীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে।
বর্তমানে ভূমি বিরোধ সবচেয়ে চরম ও জটিল পর্যায়ে রয়েছে আদিবাসীদের সাথে সেটেলার বাঙালিদের। যারা যুগ যুগ ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করে আসছে, যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে পুরনোবন্তী বাঙালি নামে পরিচিত তাদের সাথে আদিবাসীদের ভূমি নিয়ে কোন বিরোধ নেই। কিন্তু যাদেরকে সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতির জন্য পাঠিয়েছেন তাদের সাথে অদিবাসীদের মধ্যেকার ভূমি বিরোধ চরমে। এছাড়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও হাজার হাজার একর আদিবাসীদের জুমভূমি ও সমষ্টিগত মালিকানাধীন ভূমি অধিগ্রহণ করে চলেছে। সেনাবাহিনী ক্যান্টনমেন্ট ও ক্যাম্প সম্প্রসারণ, সেনা গ্যারিসন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন ইত্যাদির নামে এসব ভূমি অধিগ্রহণ করছে। এসব হাজার হাজার একর জমি দখল করা হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের হাজার আদিবাসী নিজেদের বাস্তুভিটা থেকেও উচ্ছেদ হবে। এ সমস্যা বান্দরবান জেলায় অধিক পরিমানে পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বান্দরবান জেলার কর্তৃপক্ষের সাথে আদিবাসীদের মধ্যে এ নিয়ে বিরোধ চলে আসছে।
বানিজ্যিক ভিত্তিক ফলজ ও বনজ বাসান, রাবার চাষ এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য শত শত একর ভূমি ইজারা প্রদান করা হচ্ছে। জমি ইজারা দানের মধ্য দিয়েও পাহাড়ি জুমিয়ারা তাদের জুম ও সমষ্টিগত ভূমি হারাচ্ছে এবং এনিয়েও আদিবাসী ও লীজ মালিকদের মধ্যে একই ভূমি নিয়ে বিরোধ রয়েছে। আদিবাসীদের জুমভূমি কেড়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সামরিক-বেসামরিক আমলারাও পিছিয়ে নেই। জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ বিভিন্ন সামরিক-বেসামরিক আমলা ও ব্যক্তির নামে অদিবাসীদের ভূমি দখল করা হয়েছে ও হচ্ছে। এ ধরণের দখলের ভূমির পরিমানও হাজার হাজার একর হবে। জিবি হটিকালচার সেন্টার, ডেসটিনি, গ্লোব কোম্পানী, কসমিক খামার লিমিটেড ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন আদিবাসী জুমভূমি, সমষ্টিগত মালিকানাধীন জামি এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে আদিবাসী ব্যক্তির নামে বন্দোবস্তীকৃত জমি দখল করে বাগান বাগিচা করছে।
নিম্নে আদিবাসীদের ভূমি বেদখলের কয়েকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো-
দৃষ্টান্ত ১: বেসরকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক আদিবাসীদের ভূমি দখল
‘জিবি হর্টিকালচার লিমিটেড’ সমতল এলাকার অ-আদিবাসী কর্তৃক পরিচালিত একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় উপজেলার পাতাছড়া ইউনিয়নের নাভাঙ্গা মৌজার অসহায় ও দরিদ্র ত্রিপুরাদের শত শত একর জুম ও সমষ্টিগত ভূমি দখল করে মিশ্র ফলের বাগান করেছে। ‘জিবি হর্টিকালচার লিমিটেড’ বর্তমানে প্রায় ৪৫০ একর পাহাড় জমিতে বিভিন্ন ফলের বাগান করেছে। এসব ভূমিতে আদিবাসীরা যুগ যুগ ধরে জুমচার করে আসছিল। সরকার এসব জায়গা সেটেলারদের নামে বন্দোবস্ত প্রদান করে। তবে এসব বন্দোবস্ত বৈধ নয়। কারণ এতে স্থানীয় মৌজা প্রধানের কোন সুপারিশ নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামের জায়গা জমি বন্দোবন্তী দেওয়ার ক্ষেত্রে মৌজা প্রধানের সুপারিশ গ্ৰহন বাধ্যতামূলক। জানা যায় ‘জিবি হটিকালচার লিমিটেড’ সেটেলারদের নিকট থেকে ৪০ একর পাহাড় জমি ক্রয় করে। জিবি হর্টিকালচার লিমিটেড এই ৪০ একর জায়গার উপর বাগান করার কথা, কিন্তু সংস্থাটি বর্তমানে প্রায় ৪৫০ একর ভূমির উপর বাগান করেছে। জিবি হর্টিকালচার লিমিটেড সেটেলারদের নিকট ক্রয়কৃত ৪০ একর পাহাড়ি জমি ছাড়াও আরো ৪১০ একর পাহাড়ি ভূমি দখল করেছে। এগুলি বেশীরভাগ আদিবাসীদের জুমভূমি। তবে কিছু জমি আছে বন্দোবস্তীকৃত। নাভাঙ্গা মৌজার এসব আদিবাসীরা জীবন রক্ষার তাগিদে বাস্তভিটা ছেড়ে ভারতের ত্রিপুরারাজ্যে আশ্রয় গ্রহন করেছিলো। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পর তারা দেশে ফিরেছিলো এবং বর্তমান জিবি হর্টিকালচার লিমিটেড- এর দখলকৃত জায়গায় বসতি ও চাষাবাদ করেছিলো। চুক্তির পর সেটেলার বাঙালিরা রামগড় উপজেলা সদরে অবস্থিত আদিবাসীদের কয়েকটি গ্রাম পুড়িয়ে দেয়। তখন আবার নাভাঙ্গা মৌজার আদিবাসীরা ভয়ে মূল গ্রামে পালিয়ে যায়। এ সুযোগে সেটেলাররা আদিবাসীদের জায়গা দখল করে। পরবর্তীতে সেটেলাররা আদিবাসীদের সে সব জায়গা জিবি হর্টিকালচার লিমিটেড-এর নিকট বিক্রি করে দেয়। এভাবে জিবি হর্টিকালচার লিমিটেড প্রথমে সেটেলারদের নিকট থেকে ক্রয়কৃত ৪০ একর জায়গা দখল করে। পরবর্তীতে বাকী ৪১০ একর জায়গা ধীরে ধীরে দখল করে নেয়।
এ ব্যাপারে আদিবাসীরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনের নিকট দরখাস্ত প্রদান করে কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন সহযোগিতা পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে নাভাঙ্গা মৌজার হেডম্যান বলেন, এ জায়গা জমি বিক্রির ব্যাপারে তার কোন সুপারিশ নেই। তবে যারা জায়গা জমি হারিয়েছে সে সব ভুক্তভোগীরা তাদের জায়গা বেদখল হয়ে যাবার জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও হেডম্যানকে দায়ী করে।
দৃষ্টান্ত- ২: নুনছড়ি ও থলিপাড়ায় সেটেলার বাঙালি কর্তৃক ভূমি দখল
পার্বত্য খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার ১ নং খাগড়াছড়ি সদর ইউপি’র নুনছড়ি হেডম্যান পাড়া ও থলিপাড়ায় আদিবাসী ত্রিপুরাদের যুগ যুগ ধরে বংশ পরম্পরায় ভোগদখলীয় পাহাড় ভূমি বহিরাগত বাঙ্গালি কর্তৃক দখল হয়েছে। এলাকাবাসীর অভিযোগে জানা গেছে, বিগত ২০০৬ সালের মার্চ মাসে একদল সেটেলার বাঙ্গালি অতর্কিতভাবে আদিবাসীদের এলাকায় প্রবেশ করে স্থানীয় ত্রিপুরাদের জায়গা জমি জোরপূর্বক দখল করে। প্রথমে সেটেলাররা আদিবাসীদের জায়গাকে তাদের জায়গা দাবী করে জঙ্গল পরিষ্কার করার অজুহাতে ত্রিপুরাদের বাগানের বাঁশ, গাছ, শন, ফলজাত ইত্যাদি লুটপাট করে এবং বাগানে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। সেটেলারদের এসব কর্মকান্ডে জমিস্ত আদিবাসীরা প্রশাসনের কাছে আপত্তি করলেও প্রশাসন এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। সেটেলার বাঙালিরা ভূমি দখলসহ আদিবাসীদের উপর প্রতিনিয়ত নানাভাবে উপদ্ৰব চালায়। এমতাবস্থায়, ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন স্থানীয় বিজিতলা আর্মিক্যাম্পের জনৈক ক্যাম্প কমান্ডারের কাছে এ ব্যাপারে আপত্তি করলেও কোন প্রতিকার পায়নি। বরং সেটেলাররা আরো বেপরোয়া হয়ে এক দিনের মধ্যে ১৭/১৮টি ঘর তৈরী করে ভূমি দখল অব্যাহত রাখে। ভূমি দখল করে গৃহ নিৰ্মাণ করাকে আদিবাসীরা আপত্তি করলে সেটেলার বাঙালিরা আদিবাসীদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়।
অপরদিকে, ২০০৬ সালে তৎকালীন সরকারী দলের খাগড়াছড়ি জেলার সাংসদ এসব সেটেলারদের নামে ৫০ বান্ডেল ঢেউটিন বরাদ্ধ দিয়ে খাগড়াছড়ি উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে বিলি বন্টন এবং ১নং খাগড়াছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে ভিজিএফ-এর রেশন দিয়ে সরকারীভাবে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে। সরকারী দলের উক্ত সাংসদ নুনছড়ি ও থলিপাড়া এলাকায় ৫০টি গৃহ নির্মাণে সহায়তাসহ ভূমি দখল কার্যকলাপে ইন্ধন যুগিয়েছিল।
নুনছড়ি এলাকার এক আদিবাসী বলেন, “আর্মিদের সহযোগিতায় সেটেলাররা আমাদের ভোগদখলীয় জায়গা জোর করে দখলে নেয়। আমরা প্রতিবাদ করলে সেটেলারা আমাদের বিরুদ্ধে আর্মিদের কাছে মামলা করে। তারা আমাদেরকে এলাকা ছাড়া করতে চায়। আর্মিদের অপারেশনে অনেক সময় পুরুষরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে থাকতে হয়।” সেটেলার কর্তৃক ভূমি দখলের শিকার হয়ে এলাকাবাসীর কেউ কোন আপত্তি বা প্রতিবাদ করলে সেটেলাররা তাদের বিরুদ্ধে বিজিতলা সেনা ক্যাম্প কমান্ডারের কাছে নানা রকম মিথ্যা অভিযোগ করে এবং সেনা সদস্যরা এলাকাবাসীকে নানাভাবে সাজানো ঘটনায় ফাঁসিয়ে হয়রানি, শারিরীক নির্যাতন ও জীবন নাশের হুমকি দেয়। খাগড়াছড়ি জোনের জনৈক মেজর কর্তৃক নির্যাতনের শিকার থলি পাড়া নিবাসী এক আদিবাসী জানান,“আমার ৪০ শতক ধান্য জমি নুনছড়ি গুচ্ছ গ্রামের সেটেলার হজরত আলী পিতা শামছু আলী জোর পূর্বক দখলে নিয়ে কলা গাছ লাগায়। এতে আমি আপত্তি করলে সে বিজিতলা জোনের জনৈক মেজরের কাছে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে। এরপর ওই মেজর আমার বাড়ীতে এসে আমাকে তলব করে। আমাকে বাড়ীতে না পেয়ে ওই দিন বিকাল ৪টার মধ্যে ক্যাম্পে আমাকে হাজির হওয়ার জন্য বলে যায়। আমি ক্যাম্পে গিয়ে হাজির হলে ওই মেজরের নির্দেশে মফিজসহ ২জন সেনা সদস্য আমাকে হাত পা বেঁধে মারধর করে এবং কারেন্ট শক দিয়ে শারিরীক নির্যাতন চালায়। উক্ত ক্যাম্পের মেজর আমাকে বলেন যে, নুনছড়ি থলিপাড়ায় ২০৮ একর জায়গায় বাঙ্গালিরা বসবে। খবরদার! তুমি এবং আরও অন্য কেউ কোন রকম প্রতিবাদ না করে চুপ করে থাকবে। নইলে ক্রসফায়ারে দেওয়া হবে”।
স্থানীয় ২৫৭ নং নুনছড়ি মৌজার হেডম্যান জানান, “তৎকালীন সরকার কর্তৃক সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে সমতল থেকে বাঙ্গালি সেটেলার পুনর্বাসন করা হয়। ১৯৮২ সালে সরকার এ প্রকল্পের আওতায় নুনছড়ি থলি পাড়ায় ৭৪টি বাঙ্গালি পরিবারকে পুনর্বাসিত করেছিল। ১৯০০ সালের চিটাগাং হিলট্রাক্টস রেগুলেশন এ্যাক্ট-কে পাশ কাটিয়ে হেডম্যান প্রতিবেদন ছাড়া সরকার প্রতি পরিবারের একজনের নামে ৫ একর করে ৫৩টি পরিবারকে বন্দোবন্তীর কবুলিয়ত দেয়। তবে এসব জায়গার সঠিক কোন চৌহদ্দি নেই। ফলে ভূমি সমস্যা আরও জটিল হয়েছে।
দৃষ্টান্ত নং-৩: প্ৰত্যাগত জুম্ম শরনার্থী ও জেএসএস সদস্য অদ্যাবধি পিতৃভূমি ফেরত পায়নি
শত শত দুৰ্ভাগা পাহাড়ী মানুষের মতো নব বিকাশ চাকমা ও আশ্নাময় চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতির শিকার। শাসকগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে ১৯৮৬ সালে অন্যান্য অঞ্চলের মতো দীঘিনালা অঞ্চলেও পাহাড়ি গ্রামগুলিতে পরিকল্পিতভাবে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় সেটেলার বাঙালিরা নব বিকাশ চাকমাদের গ্রাম পুড়িয়ে দেয়। নব বিকাশ চাকমারা প্রাণ রক্ষার জন্য গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যান। নব বিকাশ চাকমা ও আশ্নাময় চাকমা খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলার ৩০ নং বড় মেরুং মৌজার বাসিন্দা। আন্নাময় চাকমার পরিবার অন্যান্য পাহাড়িদের সাথে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে শরনার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহন করে। দীর্ঘ ১২ বছর ত্রিপুরা রাজ্যের শরনার্থী আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করে আর নব বিকাশ চাকমা সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহন করে। এ সুযোগ নিয়ে সেটেলার বাঙালিরা নব বিকাশ চাকমা ও আশ্নাময় চাকমার জায়গা দখল করে। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদিত হলে ২০ দফা প্যাকেজ চুক্তির আওতায় আত্মাময় চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রামে ফেরত আসে। ২০ দফা প্যাকেজ চুক্তির আওতায় জুম্ম শরনার্থীদের বেদখলকৃত জায়গা জমি ফেরত প্রদান করার কথা কিন্তু আশ্নাময় চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রামে ফিরে এসে তাদের পৈতৃক সম্পত্তি ফেরত পাননি। নব বিকাশ চাকমাও জে এস এস সদস্য হিসেবে তাদের পিতৃ সম্পত্তি ফেরত পাবার কথা। তিনিও তার জমি ফেরত পায়নি। নব বিকাশ চাকমা ও আশ্নাময় চাকমা তাদের জমি ফেরত পাবার জন্য খাগড়াছড়ি জেলার জেলা প্রশাসকের নিকট লিখিত আবেদন জানান। তাদের দুজনের আবেদনের প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক সেটেলার বাঙালিদের অবৈধভাবে দখলকৃত জায়গা ফেরত প্রদানের জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। কিন্তু সেটেলার বাঙালিরা জেলা প্রশাসকের নির্দেশ পালন করেনি। সেটেলার বাঙালিরা এখনো বহাল তবিয়তে আছে বেদলকৃত সে সব জায়গায়। জেলা প্রশাসক নব বিকাশ চাকমা ও আশ্নাময় চাকমার পৈতৃক সম্পত্তি থেকে দখলকারী সেটেলারদের উচ্ছেদ করার কোন ব্যবস্থা গ্রহন করেনি।
নব বিকাশ চাকমা ও আশ্নাময় চাকমা পিতৃভূমিতে দখল পাবার জন্যে মামলা দায়ের করেন। মামলার নম্বর হলো- বিবিধ মামলা নং- ১০৯/৯৮ খাগড়াছড়ি, তারিখ- ১৭/১১/২০০০ ইং স্মারক নং বিবিধ- ১৭/১১/২০০০ইং এবং বিবিধ- ১০৯/৯৮-৪৬৩/২০০০, তাং- ২৯/১১/২০০০ ইং। মামলাটি বর্তমানে খাগড়াছড়ি কোর্টে আছে। নব বিকাশ চাকমা ও আশ্নাময় চাকমা মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে আর্থিক ও মানসিকভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছে।
যারা নব বিকাশ চাকমা ও আশ্নাময় চাকমার জমি দখল করে রেখেছে তাদের নাম হলো- ১. আরব আলী পিতা-ইয়াদ আলী ২. খুরশেদ আলী পিতা-অজ্ঞাত, ৩. আইনুল হক পিতা-অজ্ঞাত, ৪. মোঃ রফিক পিতা-অজ্ঞাত, ৫. আলাউদ্দিন পিতা-মিয়াঁ বক্স, ৬. মো: মুসলেম পিতা-অজ্ঞাত, ৭. জয়নাল মুন্সী পিতা-অজ্ঞাত, ৮. সোনা মিঞা পিতা-অজ্ঞাত, ৯. সায়েদ আলী পিতা- অজ্ঞাত, ১০. রেজাউল করিম পিতা- অজ্ঞাত সর্বসাং- বড় মেরুং মৌজা, উপজেলা- দীঘিনালা, জেলা- খাগড়াছড়ি।
দখলকৃত জায়গার পরিমাণ- ১ম শ্রেণীর জমি একর (হোল্ডিং নং- ৩১৭, বড় মেরং মৌজা), ২য় শ্রেণীর জমি ৩.১৯ একর (হোল্ডিং নং-১৩৬, মৌজা-ঐ) এবং বসতভিটা ও বাগান-৩ একর।
দৃষ্টান্ত নং ৪ : মহালছড়ি উপজেলার একজন অসহায় নারীর বাগান বাগিচা ও জায়গা দখল
পনেমালা ত্রিপুরা স্বামী বিভীষণ ত্রিপুরা খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ি উপজেলার সিন্দুকছড়ি মৌজার মুড়া পাড়া নামক গ্রামের একজন অসহায় মহিলা। স্বামী অশিক্ষিত ও অসুস্থ। সেটেলার কর্তৃক দখলকৃত তার জায়গাটি এই সিন্দুকছড়ি মৌজায় অবস্থিত। পনেমালা ত্রিপুরার পূর্বপুরুষ উক্ত পাহাড়টিতে যুগ যুগ ধরে জুমচাষ করে এসেছে। জুমচাষে এখন আর আগের মতো লাভ নেই। তাই লোকের দেখাদেখি ভোগদখলীয় পনেমালা ত্রিপুরা পাহাড়ি জুমচাষ না করে ফলজ ও বনজ বাগান গড়ে তুলেছে। এসব ফলজ বাগান থেকে উৎপাদন পাওয়া যাচ্ছে। পনেমালা ত্রিপুরা গ্রামের শিক্ষিত ব্যক্তিদের পরামর্শে পাহাড়ের জায়গাটি রাষ্ট্রের আইন মোতাবেক স্থানীয় হেডম্যানের সুপারিশ নিয়ে বন্দেবন্তীর জন্য জেলা প্রশাসকের বরাবরে আবেদন করে। বন্দোবস্তীর কাজ প্রক্রিয়াধীন ছিলো। কিন্তু বন্দোবস্তী প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পনেমালা ত্রিপুরা তার ভোগ দখলীয় জায়গাটি আর বন্দোবন্তী করে নিতে পারেনি। বন্দোবস্তী প্রক্রিয়া নূতন করে শুরু হলে পনেমালা ত্রিপুরা উক্ত জায়গাটি বন্দোবস্তী পাওয়ার কথা, যেহেতু এই জায়গাটি তার পূর্বপুরুষের জুমভূমি এবং মৌজার হেডম্যানও জায়গাটি তার বলে সুপারিশ করেছেন।
পনেমালা ত্রিপুরার জায়গাটি দখলের প্রথম প্রচেষ্টা ২০০৬ সালে। তখন আঞ্চলিক পরিষদ ও সিভিল সোসাইটির ভূমিকার কারণে প্রথমবারের মতো সেটেলার বাঙালিদের অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়। তবে সেসময় সেটেলার বাঙালিরা পনেমালা ত্রিপুরার বাগান বাগিচা ব্যাপকভাবে নষ্ট করে দেয়।
সেটেলার বাঙালিরা আবার নূতন করে পনেমালা ত্রিপুরার বাগান বাগিচা নষ্ট ও জায়গা কেড়ে নেয়ার চেষ্টা চালায়। এ বছরের (২০০৯) মে মাসের ১০ তারিখে সেটেলার বাঙালিরা পনেমালা ত্রিপুরার জায়গা দখল করার জন্য সদলবলে যায় এবং বাগান বাগিচা নষ্ট করে। এক পর্যায়ে সেটেলার বাঙালিরা পনেমালা ত্রিপুরার সৃজিত ফলজ বাগান ধ্বংস করে সে জায়গায় নূতন করে গাছের চারা রোপন করে।
এ অবস্থায় পনেমালা ত্রিপুরা স্থানীয় এমপি ও টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা [ভূমি মন্ত্রনালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য] কে লিখিতভাবে জানায়। মাননীয় এমপি গত ২৫ মে, ২০০৯ ইং তারিখে মহালছড়ি থানার ইউএনও-কে জরুরী ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য লিখে পাঠান। ইউএনও কানুনগোকে সরেজমিনে দেখার জন্য ঘটনাস্থলে পাঠান। কিন্তু কানুনগো নামে মাত্র গিয়ে মহালছড়িতে ফিরে আসে এবং ইউএনও পরবর্তীতে এ ব্যাপারে আর কোন ব্যবস্থা গ্রহন করেননি। প্রশাসন নিরপেক্ষ নয় এবং প্রশাসন আদিবাসীদের প্রতি আন্তরিক নয় তাই ইউএনও পনেমালা ত্রিপুরার জায়গা বেদখলকারীদের বিরুদ্ধে কোন ধরণের ব্যবস্থা গ্রহন করেননি এবং সে কারণে বেদখলকারী সেটেলার বাঙালিরা আদিবাসীদের ভূমি বেদখলে উৎসাহিত হচ্ছে। ইউএনও এমপি-র নির্দেশ পালন না করার মত ধৃষ্ঠতা দেখাচ্ছে।
প্রশাসন নিরপেক্ষ নয় এবং সম্পূর্ণরূপে সেটেলারদের পক্ষে এর জ্বাজল্য প্রমান হলো পণেমালা ত্রিপুরার প্রতি প্রশাসনের আচরণ। গত ৩ সেপ্টেম্বর ২০০৯ ইং তারিখে সেটেলার বাঙালিরা পণেমালা ত্রিপুরাকে হত্যা করে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহায়তা ও উস্কানী থাকার কারণে সেটেলার বাঙালিরা পণেমালা ত্রিপুরাকে হত্যা করার সাহস পেয়েছে। প্রশাসন এতোদিন পর্যন্ত সেটেলারদের পক্ষালম্বন করার কারণে পণেমালা ত্রিপুরার বাগান বাগিচা নষ্টকারী সেটেলার বাঙালিদের কিছুই হয়নি। স্থানীয় আদিবাসী এম পি কর্তৃক ভূমি দখলকারী ও বাগান নষ্টকারী সেটেলারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান সত্ত্বেও প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। বর্তমানে পণেমালা ত্রিপুরাকে যারা হত্যা করেছে এবং হত্যার জন্য যারা নির্দেশ দিয়েছে তারা হাটে ঘাটে অবাধে বিচরণ করছে। প্রশাসন এসব চিহ্নিত হত্যাকারীদের গ্রেফতার করছে না। পণেমালার মৃত্য, পণেমালার প্রতি আচরণ এবং সেটেলার বাঙালিদের প্রতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগিতার মধ্য দিয়ে প্রশাসনের ভূমিকা বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়।
দৃষ্টান্ত নং-৫: আমলা কর্তৃক ভূমি দখল
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার রামগড় উপজেলার সহকারী কমিশনার ছিলেন জনাব এম এম মহীউদ্দিন কবীর (মহিন)। তিনি প্রমোশন নিয়ে বর্তমানে মানিকছড়ি উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী অফিসারের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি রামগড় উপজেলায় থাকাকালীন সময়ে অর্থাৎ ২০০৮ সালে ৫০ পরিবার সেটেলারদের নিকট থেকে ৪০০ একর জায়গা ক্রয় করেন। সেটেলারদের এসব জায়গার কাগজপত্র দেওয়া হয়েছিল ১৯৮০-৮১ সালে। তবে সেটেলারদের এসব জমির কাগজপত্র বৈধ নয়। কারণ এসব জমি বন্দোবস্তী প্রদানের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের আইন অনুসরণ করা হয়নি। জনাব মহীউদীন গত বছর (২০০৮ সালে) এই ৪০০ একর পাহাড় জমির উপর মিশ্র ফলের বাগান করেছেন। এই ব্যক্তি সেটেলারদের নিকট থেকে ক্রয়কৃত আদিবাসীদের জুমভূমি দখল করার পর আদিবাসীদের বন্দোবস্তীকৃত ভূমিও দখল করছে। এভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকরীরত আমলারা প্রশাসনের ক্ষমতা অপব্যবহার করে এবং চট্টগ্রামের আইন লংঘন করে আদিবাসীদের ভূমি দখল করছে।
২০০০ সালে বান্দরবান জেলার তৎকালীন জেলা প্রশাসক ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ ও পার্বত্য জেলা পরিষদের আইন লংঘন করে তাঁর আত্মীয়স্বজন, বান্দরবান জেলা পুলিশ সুপার, পার্বত্য জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব), অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সাধারণ)-এর আত্মীয়স্বজন-এর নামে প্রত্যেকের জন্য ২৫-৫০ একর জমি লীজ প্রদান করেন। এই জমিগুলি জেলার সুয়ালক মৌজা ও তুমব্রু মৌজায় অবস্থিত।
দৃষ্টান্ত নং- ৬: বন বিভাগ কর্তৃক ভূমি দখল
খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলার বন বিভাগ কবুলিত একটি মৌজার নাম ‘আলুটিলা’ মৌজা। এই মৌজার জুমচাষীদের জুমভূমি বন বিভাগ কর্তৃক দু’বার কবুলিত হয়। প্রথমবার কবুলিত হয় ১৯৮৪-৮৫ সালে এবং দ্বিতীয় বার ১৯৯৩-৯৪ সালে। বন বিভাগ বরাবরের মতো আলুটিলা মৌজার আদিবাসীদের জুমভূমির ওপর ১৯৮৪ সাল থেকে সেগুন গাছের বৃক্ষায়ন করে চলেছে। আলুটিলা মৌজার বন ধ্বংস করে বন বিভাগ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বলে বিবেচিত বিদেশী জাত সেগুনের বৃক্ষায়ন করছে এবং এ বৃক্ষায়ন চলছে সম্পূর্ণ মনোকাল্টিভেশনের ভিত্তিতে। এ ধরণের এক জাতের বৃক্ষায়ন পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর যেখানে বর্তমানে সারা পৃথিবীতে আবহাওয়া পরিবর্তন, পরিবেশ নিয়ে হৈ চৈ হচ্ছে সেখানে আমরা এখনো জেনে শুনে পরিবেশ ও আবহাওয়ার জন্য ক্ষতিকর কাজ করে চলেছি। যারা এসব ক্ষতিকর কাজ করছে তাদের বিরুদ্ধে সরকারের তরফ থেকে কোন প্রকার আইনী ব্যবস্থা গ্রহন করা হচ্ছে না। যার কারণে তারা নতুন করে ক্ষতিকর কাজ করার উৎসাহ পাচ্ছে।
বন বিভাগের বাগান থেকে কোন গাছ হারালে গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। এভাবে আলুটিলা মৌজার বন বিভাগের বৃক্ষ বাগানের পাশ্ববর্তী গ্রামগুলির আদিবাসীরা মামলা দায়েরসহ আর্থিক ও মানসিক হয়রানির শিকার হচ্ছে। অথচ এটি দিবালোকের মত পরিস্কার যে, বন বিভাগের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কর্মচারী, অসাধু ব্যবসায়ী ও প্রশাসনের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কর্মচারী মিলে বন বিভাগের হাজার হাজার ফুট গাছ কেটে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে পাচার করছে। আদিবাসীদের অবস্থা হল- ‘মরার উপর খারার ঘা এর মত’। বন।বিভাগ কর্তৃক জবরদখলের কারনে আদিবাসীরা একদিকে জুমভূমি হারাচ্ছে অপরদিকে, বন বিভাগের সৃজিত বাগানের গাছ হারালেই পার্শ্ববতী গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হচ্ছে। এভাবে আদিবাসীরা বিভিন্নমুখী হয়রানি ও নিষ্পেষণের শিকার হচ্ছে। বৃটিশ আমল থেকে আদিবাসীদের জুমভূমি জোরপূর্বক কেড়ে নিয়ে হাজার হাজার একরে বৃক্ষায়ন চলছে। ২০০৯ সালে সরকার বৃক্ষায়নের জন্য আবার ২ লক্ষ ১৮ একর জুমভূমি সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করেছে। এভাবে বন বিভাগ লক্ষ লক্ষ একর আদিবাসীদের জুমভূমি কেড়ে নিয়ে একদিকে দেশের বন ধ্বংস করছে, অপরদিকে আদিবাসীদের জীবন-জীবিকার উপর আঘাত হানছে।
দৃষ্টান্ত নং-৭: সেনাবাহিনী কর্তৃক ভূমি দখল
স্বাধীনতার পর পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্যান্টনমেন্ট গড়ে তোলে। এসব ক্যান্টনমেন্ট গড়ে তোলা হয় আদিবাসীদের সমষ্টিগত মালিকানাধীন জমি দখল করে। ১৯৭৯ সালের পর পার্বত্য চটগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় আদিবাসীদের জায়গার উপর ক্যাম্প গড়ে তোলা হয়। আদিবাসীদের জায়গা দখল করে ক্যাম্প সম্প্রসারণ, প্রশিক্ষন কেন্দ্র ও গ্যারিসন স্থাপন ইত্যাদি উদ্যোগ এখনো চলছে। বর্তমানে সেনাবাহিনী-
১. রুমা সেনাবাহিনী গ্যারিসন স্থাপনের জন্য ৯৫৬০ একর
২. বান্দরবান সদর ব্রিগেড সম্প্রসারণের জন্য ১৮৩ একর
৩. বান্দরবানে আর্টিলারী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য- ৩০,০০০ একর
৪. বান্দরবানে বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য ২৬,০০০ একর
৫. পানছড়ি জোন সম্প্রসারণের জন্য ১৪৩ একর
আদিবাসীদের ভূমি দখল করতে চলেছে।
এসব জায়গা অধিগ্রহণ করা হলে হাজার হাজার আদিবাসী তাদের জন্মভূমি হারাবে। আদিবাসীদের বহু গ্রাম উচ্ছেদ হয়ে যাবে এবং হাজার হাজার আদিবাসী পরিবার নিজ বাবভিটা থেকে উচ্ছেদ হবে।
রুমা ক্যান্টমেন্টের সীমানা সম্প্রসারণ করা হচ্ছে: আদিবাসীরা উচ্ছেদ আতংকে
স্বাধীনতার পর রুমা ক্যান্টনমেন্ট তৈরি করা হয়। বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার সদর ইউনিয়নের সেংগুম মৌজায় সাংগু নদীর পাড় ঘেঁষে এর অবস্থান। প্রথম যখন এ ক্যান্টনমেন্ট তৈরি করা হয় তখনও পাহাড়ী আদিবাসীদের জুমভূমি দখল করেই তা করা হয়েছিলো। সরকার আবারো এ ক্যান্টনমেন্ট সম্প্রসারণের জন্য ৯,৫৬০ একর জমি দখলের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখছে। রুমা ক্যান্টমেন্টের জন্য এই ৯,৫৬০ একর জমি অধিগ্রহনের প্রথম প্রচেষ্টা চলে ২০০৫ সালের মার্চ মাসে। এ সময় সেনাবাহিনী ও বান্দরবান জেলার রাজস্ব বিভাগ কর্তৃক জারীপ কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়। রুমা ক্যান্টনমেন্ট সম্প্রসারণের জন্য যে পরিমান জমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে এর মধ্যে ৩টি মৌজার ১৩টি আদিবাসী গ্রাম রয়েছে। এই ১৩টি গ্রামেপ্রায় ৫০০০ আদিবাসী বাস করে। এই ১৩ গ্রামের আদিবাসীরা সবাই জুমচাষী। আদিবাসীদের এই ৯,৫৬০ একর জমি দখল করা হলে এই এলাকার ৫০০০ আদিবাসী নিজ বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ হবে এবং শত শত বছরের ১৩টি আদিবাসী গ্ৰাম ধ্বংস হয়ে যাবে। উপরন্তু, এই হাজার হাজার আদিবাসী মানুষেরা ভূমিহীন হয়ে পড়বে। এটি তাদের আর্থ-সামাজিক জীবনে বড় রকমের বিপর্যয় ডেকে আনবে।
রুমা গ্যারিসনের জন্য নতুন প্রস্তাবিত জায়গা অধিগ্রহন করার বিপক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও বান্দরবান জেলা পরিষদ। উল্লেখ্য যে, পার্বত্য জেলা পরিষদের আইন মোতাবেক পার্বত্য জেলাধীন কোন জায়গা জমি বন্দোবস্তী, লীজ বা অধিগ্রহন করতে গেলে জেলা পরিষদের পূর্বানুমোদন প্রয়োজন। রুমা ক্যান্টনমেন্ট কর্তৃপক্ষ পার্বত্য জেলা পরিষদের অনুমোদন ব্যতিত রুমা গ্যারিসনের জন্য এই প্রস্তাবিত জায়গা দখল করার পায়তারা চালাচ্ছে। উপরন্তু কল্পরঞ্জন চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে আদিবাসীদের এ জমি রুমা গ্যারিসনের জন্য অধিগ্রহণ না করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তথাপি রুমা ক্যন্টনমেন্টের কর্তৃপক্ষ গ্যারিসনের জন্য প্রস্তাবিত জায়গা দখলের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অতি সাম্প্রতিক কালেও রুমা ক্যান্টনমেন্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রস্তাবিত ভূমি দখলের প্রচেষ্টা প্রতীয়মান হওয়ায় স্থানীয় আদিবাসীরা রুমায় প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে। এই বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় ২০০৯ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে।
উল্লেখ্য যে, সরকার বান্দরবান জেলার সুয়ালকে গোলন্দাজ ও পদাতিক বাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের জন্য ১১,৪৪৫ একর আদিবাসীদের জমি অধিগ্রহন করে। এ জমি অধিগ্রহনকালে সুয়ালকের ৪০০ আদিবাসী পরিবার উচ্ছেদ হয়। বর্তমানে এসব আদিবাসী মানবেতর জীবন যাপন করছে। শত শত বছর ধরে গড়ে তোলা ৪০০ পরিবারের কয়েকটি গ্রাম ধ্বংস হয়ে গেছে। আদিবাসী এসব পরিবার নিজেদের জুমভূমি হারিয়ে বর্তমানে তাদের বেশীরভাগই অন্যের কাছে শ্রম বিক্রি করে জীবন ধারণ করছে।
দৃষ্টান্ত নং ৮ : সেটেলার কর্তৃক লংগদুতে আদিবাসী ভূমি দখলের বার বার অপচেষ্টা এবং পাহাড়ি বাঙালি সহিংস ঘটনার সম্ভাবনা
সম্প্রতি তিন পার্বত্য জেলার বিভিন্ন এলাকার ন্যায় রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাধীন লংগদু উপজেলায়ও আবার নতুন করে ভূমি দখলের অপচেষ্টা বৃদ্ধি পেয়েছে। তন্মধ্যে লংগদু উপজেলার ২৫নং সোনাই মৌজাধীন দুলুছড়ি এলাকায় একদল সেটেলার জোরপূর্বক আদিবাসীদের ভূমি দখলের অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
দখল প্রচেষ্টা-১
গত ৬ মার্চ ২০০৯ মোঃ ইউসুফ আলী খানের নেতৃত্বে দুলুছড়ি এলাকার পার্শ্ববর্তী ইসলামাবাদ নামক এলাকার ১০/১২ জনের একদল সেটেলার বাঙালি প্রথমে দুলুছড়ি এলাকার আদিবাসীদের রেকর্ডভূক্ত ও ভোগদখলীয় ভূমিতে আসল পরিষ্কার শুরু করে। আদিবাসীরা তাদের ভূমিতে সেটেলার কর্তৃক জঙ্গল পরিষ্কারের প্রতিবাদ জানায়। অপরদিকে সেটেলার বাঙালিরা ভূয়া কাগজপত্র দেখিয়ে হুমকীমূলক কথ বলে এবং তাদের জঙ্গল কাটার কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। সেটেলার বাঙালিরা বলে যে, তারা এই জায়গা ক্রয় করেছে এবং সেখানে তারা বাগান গড়ে তুলবে। এক পর্যায়ে সেটেলার বাঙালিরা প্রায় ২০ একর ভূমিতে জঙ্গল পরিষ্কার করে। ভূমি দখল-বেদখলাকে কেন্দ্র করে জায়গার মালিক আদিবাসী পাহাড়িদের দখলকারী সেটেলার বাঙালিদের মধ্যে সহিংস ঘটনা সংঘটিত হবার পরিস্থিতি উদ্ভব হয়। এই সমস্ত ভূমির মালিক আদিবাসী পাহাড়িরা হলেন- (১) পূৰ্ণিমা রঞ্জন চাকমা (৪২), পিং – সোনারাম চাকমা (সোনামন), (২) দীগম্বর চাকমা (৩৫), পিং-বৈয়নাথ চাকমা, (৩) কৈলাস চন্দ্ৰ চাকমা, (৪) অনঙ্গলাল চাকমা (৩৫), পিং- সুদৰ্শন চাকমা।
সহিংস ঘটনা এড়াবার লক্ষ্যে জমির মালিকেরা গত ২৩ মার্চ ২০০৯ সেটেলার বাঙালি কর্তৃক ভূমি বেদখল বন্ধের দাবী জানিয়ে সদ্য নির্বাচিত লংগদু উপজেলা চেয়ারম্যানের বরাবরে আবেদন জানায়। উপজেলঅ চেয়ারম্যান ছাড়াও এই আবেদন পরের অনুলিপি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান, বাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার জেলা প্রশাসক, চাকমা সার্কেলের চীফ রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়, লংগদু জোনের ২৫ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনা জোন কমান্ডারের বরাবরে প্রেরণ করা হয়।
এর কয়েকদিন পর উপজেলা চেয়ারম্যান তফাজ্জল হোসেনের উদ্যোগে উভয় পক্ষের মুরুব্বীদের নিয়ে একসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে এই মর্মে সিদ্ধান্ত হয় যে, উভয়পক্ষের কেউ আপাতত উক্ত ভূমিতে হস্তক্ষেপ করবে না।
২৮ মার্চ ২০০৯ উপজেলার মাসিক আইন শংখলা সমন্বয় সভায়ও উপজেলা চেয়ারম্যান ঘোষণা দেন যে, উক্ত জায়গায় উভয়পক্ষের হস্তক্ষেপ বন্ধ থাকবে। এভাবে আদিবাসীদের রেকর্ডভূক্ত ও ভোগদখলীয় প্রায় ২০ একর ভূমি সেটেলার বাঙালিদের কর্তৃক ষড়যন্ত্রমূলক দখলের অপচেষ্টার মুখে পড়েছে এবং আদিবাসীরা তাদের নিজস্ব ভূমি ব্যবহার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
দখল প্রচেষ্টা-২
গত ১১ এপ্রিল ২০০৯ একই এলাকার অপর অংশে দক্ষিণ দিকে উক্ত সেটেলার বাঙালিরা আবার জঙ্গল কাটা শুরু করে। প্রায় ১০ একর এলাকায় জাঙ্গল কাটা হয় এবং আগুনে পুড়িয়ে পরিষ্কার করা হয়। প্রিয় রতন কার্বারী ও বর্তমান ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য দেবকুমার চাকমার নেতৃত্বে কয়েকজন আদিবাসী এ ব্যাপারে লংগদু থানার ওসির কাছে অভিযোগ করে।
এরপর ১৮ এপ্রিল ২০০৯ সেটেলার বাঙালিরা গাড়ী নিয়ে জঙ্গল কাটা এলাকা থেকে লাকড়ী আনতে যায়। এ সময় আদিবাসীরা ফেরার পথে বাঙালিদের থামায় এবং তাদের কাছ থেকে এই মর্মে লিখিত প্রতিশ্রুতি আদায় করে যে, বাঙালিরা আর সেখানে লাকড়ি আনতে যাবে না। ২১ এপ্রিল ২০০৯ অধিবাসীরা এই নতুন ঘটনটিও উপজেলা চেয়ারম্যানকে জানায়। চেয়ারম্যান এক সপ্তাহের মধ্যে ঘটনাস্থল তদন্ত করবে বলে কথা দেন। কিন্তু তিনি আর সেখানে যাননি এবং কোন পদক্ষেপ নেননি।
গত ২ মে ২০০৯ তারিখ আবার সেটেলার বাঙালিরা লাকড়ি আনতে যায়। ফলে আদিবাসীদের ভোগদখলীয় আরও ১০ একর ভূমি সেটেলার বাঙালিরা দখল করার অপচেষ্টা চালিয়ে যায়। এ নিয়ে লংগদু এলাকায় পাহাড়ি বাঙালির মধ্যে টেনশন সৃষ্টি হয়। এই এলাকায় এমন পরিস্থিতি বিরাজ করছে প্রশাসন সতর্ক না হলে এবং যথাযথ ভূমিকা পালন না করলে সেটেলার ও আদিবাসী পাহাড়ীদের মধ্যে যে কোন সময় দাঙা-হাঙ্গামা বা যে কোন ধরণের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে।
উল্লেখ্য, লংগদু এলাকাটি পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম সেটেলার অধ্যুষিত ১৯৭৯, ১৯৮০ও ১৯৮১ সালে তৎকালীন সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য এলাকার ন্যায় এই লংগদু এলাকায়ও হাজার হাজার সেটেলার পুনর্বাসন করা হয় এবং জোরপূর্বক আদিবাসীদের ভোগদখলীয় ও রেকর্ডভূক্ত ভূমি দখল হয়। বর্তমানে লংগদু এলাকায় আদিবাসীরাই সংখ্যালঘু এবং আদিবাসীর জনসংখ্যা উপজেলার মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশেরও কম।
দৃষ্টান্ত নং- ৯ : বাঘাইছড়ি উপজেলার বাঘাইহাট ইউনিয়নের সেটেলার বাঙালি কর্তৃক আক্রান্ত সব আদিবাসী পরিবার নিজ গ্রামে ফিরে যেতে পারেনি
২০ এপ্রিল ২০০৮ পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার বাঘাইহাট ইউনিয়নে আদিবাসীদের ৮টি গ্রাম সেটেলার পুড়িয়ে দেয়। ঘটনার সূত্রপাত ভূমিকে কেন্দ্র করে। আদিবাসীদের গ্রামে গিয়ে সেটেলার জোরপূর্বক ঘর তোলার চেষ্টা করে। দীর্ঘদিন ধরে প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। এ নিয়ে আদিবাসী পাহাড়ি ও সেটেলার বাঙালিদের মধ্যে স্নায়ু বিরোধ চলে আসছে। জরুরি অবস্থার সুযোগ গ্রহন করে প্রশাসনের সহায়তায় সেটেলার বাঙালিরা আদিবাসী গ্রামের ভেতরে জোরপূর্বক খুপড়ি তোলে। এ নিয়ে আবার পাহাড়ি ও বসতিস্থাপনকারীদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি ও বাদানুবাদ চলে। ২০ এপ্রিল ২০০৮ তারিখে সেটেলার বাঙালিরা আদিবাসীদেরকে তাদের গ্রাম ও বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে আদিবাসী গ্রামগুলিতে আগুন লাগিয়ে দেয়। এভাবে আদিবাসীদের ৮টি গ্রাম ধ্বংস হয় এবং গ্রামবাসীরা আর্থিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গ্রামবাসীরা প্রাণ রক্ষার তাগিদে জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। পরবর্তীতে তারা আত্মীয় স্বজনের গ্রামে আশ্রয় গ্রহণ করে। গ্রামবাসীদের যারা পালিয়ে গিয়েছিলো এবং অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছিলো তারা সবাই গ্রামে ফিরে আসতে পারেনি। এখনো এ গ্রামের উদ্বাস্তু বহু পরিবার আত্মীয়স্বজনের গ্রামে বসবাস করছে। উক্ত ঘটনা পরিদর্শনে যান পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক আন্তর্জাতিক কমিশনসহ জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী ও মানবাধিকার কর্মী। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক আন্তর্জাতিক কমিশন সফরের পরপরই সেটেলার বাঙালিরা লাদুমনি চাকমাকে হত্যা করে। কারণ নিহত লাদুমনি চাকমা ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে আদিবাসী গ্রাম পুড়িয়ে ফেলার ঘটনা সম্পর্কে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক আন্তর্জাতিক কমিশনের প্রতিনিধির নিকট বিস্তারিত বিবরণ বর্ণনা করেছিলেন।
উল্লেখ্য যে, স্থানীয় প্রশাসন দীর্ঘদিন ধরে সাজেক এলাকায় রাস্তা নির্মাণ এবং রাস্তার দু’পাশ্বে সেটেলার পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া চালিয়ে আসছে। এরই অংশ হিসেবে গত ২০ এপ্রিল ২০০৮ ইং তারিখে এই গ্রামের লোকজনের উপর আক্রমন করা হয় এবং ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এধরণের আক্রমন ও ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার উদেশ্য হলো উক্ত গ্রাম থেকে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা এবং সেই গ্রামে স্থায়ীভাবে সেটেলার বসতি গড়ে তোলা। সাজেক রিজার্ভ এলাকায় রাস্তা তৈরীর আরেকটি উদ্দেশ্য হলো এই এলাকায় যেসব বড় বড় গাছ রয়েছে সেগুলি ঢাকা-চট্টগ্রামে রপ্তানী করা। এ ধরণের কাজে সামরিক-বেসামরিক আমলা, বন বিভাগের কর্মকর্তা এবং অসাধু কতিপয় কাঠ ব্যবসায়ী মিলে মিশে ভাগ-ভাটোয়ারার কাজ সম্পন্ন করে থাকে।
প্রসঙ্গ:পার্বত্য চট্টগ্রাম, ভূমি সমস্যা
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।