Last updated Oct 8th, 2025
1
পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস মূলত: লোক কাহিনীর ওপর নির্ভরশীল হলেও কয়েকজন ইতিহাসবিদ, লেখক পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য সম্বলিত বই লিখে গিয়েছেন, সে সব লিখিত তথ্যাবলীও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ইতিহাসের জন্য গুরত্বপূর্ণ। ১৫৫০ সালে Joao Baptista Lavanda কর্তৃক আঁকা মানচিত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানচিত্র পাওয়া যায়, সেই মানচিত্রে পার্বত্য অঞ্চলকে “Chacomos” নামে চিহ্নিত করা হয়।২ আবহমানকাল ধরে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে চাকমা৩ জনগোষ্ঠীসহ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্বা মারমা, ত্রিপুরা ,কুকি, ম্রো, বম, খিয়াং, চাক, পাংখো, খুমি ও তঞ্চঙ্গ্যারা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে বসবাস করছে।৪
মোঘল শাসকেরা যখন পার্বত্য চট্টগ্রামের পার্শ্ববৰ্তী অঞ্চল চট্টগ্রাম দখল করে নেয় তখনও পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের জনগণ মোঘলদের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল।৫ পরে মোঘলদের সাথে চাকমা রাজার ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্পর্ক গড়ে উঠে। তখন মুলত: কার্পাস তুলার বিনিময়ে দৈনন্দিন প্ৰয়োজনীয় ভোগ্য জিনিস (তৈল, লবণ ও শুটকি) চাঙমারা চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে আনতে পারবে এই শর্তে চাকমা রাজার সাথে মোঘলদের সদ্ধি হয়। পরবর্তীতে পার্বত্য অঞ্চল “কার্পাস মহল” নামে পরিচিতি লাভ করে।৬
১৭৫৭ বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক ভারত উপমহাদেশ দখল হওয়ার এক দশক পর রাজস্ব আদায়ের উদ্দেশ্যে বৃটিশরা পার্বত্য চট্টগ্রাম দখল করতে যায়। এতে চাকমা রাজা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ফলে তাদের সাথে বৃটিশদের যুদ্ধ হয় এবং এই যুদ্ধ আনুমানিক ১৭৭৮ সাল থেকে ১৭৮৭ পর্যন্ত চলে।৭ ১৭৮৭ সালে চাকমা রাজার সাথে বৃটিশদের সদ্ধি হয় এবং চাকমা রাজা বৃটিশদের কর (tribute) দিতে স্বীকার করেন। তবে তার পরিবর্তে পাহাড়িরা প্রয়োজনীয় খাদ্য, তেল ইত্যাদি সরবরাহ পাবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। তবে পরে বৃটিশ শাসকরা কখনো এই অঞ্চল সরাসরি শাসন করেনি। দীর্ঘ কয়েক দশক পরে, ১৮৬০ সালে বৃটিশ সরকার পার্বত্য অঞ্চলটি Chittagong Hill Tracts নামে জেলা ঘোষণা করে বৃটিশ প্রশাসনের সাথে অন্তর্ভুক্ত করে।৮
১৮৮৪ সালে বৃটিশ সরকার ‘ভাগ কর শাসন কর’ নীতি অনুসরণ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথাগত প্রশাসনিক বিচার ব্যবস্থাকে পাঁচটি সার্কেলে বিভক্ত করে। যথা চাকমা সার্কেল, মং সার্কেল, বোমাং সার্কেল, সাব ডিভিশন খাস মহল ও সাঙ্গু সাব ডিভিশনাল খাস মহল।৯ ১৯০০ সালে বৃটিশ সরকার পার্বত্য চটগ্রাম শাসনের জন্য “Chittagong Hill Tracts Regulation, 1900” আইন করে। এ আইনে পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রশাসনিক কাঠামো, বিচার, রাজস্ব ও ভূমি ব্যবস্থার বিষয়সমূহ উল্লেখ রয়েছে। এই আইনের পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর হলেও পাহাড়িদের প্রথাগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা হিসেবে রাজা বা চীফ ব্যবস্থা এবং হেডম্যান ব্যবস্থার স্বীকৃতি রয়েছে। ১৯১৯ সালে Government of India Act, 1919 অধীনে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘Backward Tract’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। পরবর্তীতে Government of India Act,হিসেবে চিহ্নিত হয় 1935 এর অধীনে পার্বত্য চট্টগ্রাম “Excluded Area”১০ হিসেবে চিহ্নিত হয়।
১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ হিন্দু ও মুসলিম ধর্মের তথা দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র গঠিত হয়। এই দ্বি-জাতিতত্বের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানের অংশে পড়লে পার্বত্য চট্টগাম অঞ্চলের পাহাড়ি নেতৃবৃন্দ ভারতের অংশে থাকার জন্য রাঙ্গামাটিতে ভারতের পতাকা উত্তোলন করে।১১ কিন্তু পাকিস্তান সরকার সরাসরি সামরিক কায়দায় রাঙ্গামাটি দখল করে। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। এই সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রামের “Excluded Area” মর্যাদা বলবৎ রাখা হয়। ১৯৬২ সালে পাকিস্তানের সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রামকে “tribal area” হিসেবে চিহিত করা হয়। ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান সংবিধান সংশোধন হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের Tribal Area Status তুলে নেয়া হয়।১২ এভাবে হারিয়ে যায় পার্বত্য চট্টগ্রামের সাংবিধানিক বিশেষ মর্যাদা। ইতিমধ্যে পাকিস্তান সরকার ১৯৫৮-১৯৬২ সালে কাপ্তাই এলাকায় কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য। এই বাঁধ নির্মাণের ফলে প্রায় ৫৪ হাজার একর সমতল ভূমি, পাহাড়িদের শতশত গ্রাম বাঁধের পানিতে তলিয়ে যায়। এমনকি ঢাকমা রাজবাড়িও এই বাঁধের পানিতে তলিয়ে যায়। এতে লক্ষ লক্ষ পাহাড়ি স্থানচ্যুত হয় এবং তাদের অধিকাংশ উদ্বাস্তু হয়ে ভারত এবং অনেকে বার্মায় আশ্রয় গ্রহণ করে।১৩ এসময় খুবই কম পাহাড়ি পরিবার ক্ষতিপূরণ পায়।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীনতার পরপরই পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশ সরকারের কাছে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য স্বায়ত্ত্বসাশন দাবী সম্বলিত প্রথাগত আইন-আদালত ও “Chittagong Hill Tracts Regulation, 1900” আইন সংরক্ষণ এবং পাহাড়িদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবী করে। কিন্তু তৎকালীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার তা প্রত্যাখান করে পাহাড়িদের বাঙালি হয়ে যেতে বলে।১৪ এর ফলে ১৯৭৩ সালে মানবেন্দ্ৰ লারমার নেতৃত্বে পাহাড়ি নেতৃবৃন্দ পার্বত্য চক্টগ্রামের জনগণের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি গঠন করে। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারা নিষিদ্ধ হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি তাদের সশস্ত্ৰ শাখা ‘শান্তিবাহিনী’ গঠন করে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে। একদিকে পাহাড়িদের অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন অন্যদিকে সরকার কর্তৃক আন্দোলন দমনের চেষ্টা, সবকিছু মিলিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে এক সংঘাতময় পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। সত্তর দশকের শেষে (১৯৭৯-১৯৮১ থেকে) বাংলাদেশ সরকার পাহাড়ি বিদ্রোহ দমনের কৌশল হিসেবে দেশের অন্যান্য সমতল অঞ্চল থেকে সরকারের গোপন সার্কুলারের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে লক্ষ লক্ষ বাঙালি এনে প্রথাগত ভূমির ওপর বসিয়ে দেয় (যারা সেটলার বাতলি নামে পাহাড়ে পরিচিত) এবং বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে আসে এবং কয়েকটি বড় বড় ক্যান্টনমেন্ট পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থাপন করে।১৫ ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সরকার “Chittagong Hill Tracts Regulation, 1900” এর কয়েকটি প্রয়োজনীয় বিধানাবলী সংশোধন আনে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার সেটলার বাঙালিদের বিশেষ বন্দোবস্তির মাধ্যমে ৪ বা ৫ একর করে ভূমি-টিলা হস্তান্তর করে।১৬
একদিকে সেটলার বাঙালিদের কর্তৃক পাহাড়িদের ভূমি বেদখল অন্যদিকে পাহাড়ের স্বায়ত্বশাসন আন্দোলন দমনের নামে সরকার পাহাড়ে সামরিক শাসন কায়েম করে এবং পাহাড়িদের ওপর চলে নৃশংস অত্যাচার-নির্যাতন, হত্যাযজ্ঞ, গণহত্যা ও নারী ধর্ষণ। সরকার পাহাড়িদের “ঘরবাড়ি জলিয়ে/পুড়িয়ে দেয়া নীতি ও ভাগকর শাসন কর নীতি” অনুসরণ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের অন্য সমতলের অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। সরকার দেশের জাতীয় পত্রিকা ও অন্যান্য মিডিয়ায় পার্বত্য চটগ্রামের খবর প্রচার নিষিদ্ধ রাখে। ১৯৮৬ সালের ১ মে সেটলার বাঙালিরা সেনাবাহিনীর সহায়তায় খাগড়াছড়ি সদর, দীঘিনালা, পানছড়ি, মহালছড়ি এলাকার পাহাড়িদের গ্রাম-ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। শত শত পাহাড়ি নির্যাতিত হয়, অনেক গুম হয় ও খুন হয় এবং নারী ধর্ষিত হয়। এই অবস্থায় হাজার হাজার পাহাড়ি ভারতে শরণার্থী হিসাবে আশ্রয় গ্রহণ করে। দীর্ঘ এক দশকের পর সেইসব জুম্ম শরণার্থী পার্বত্য চট্টগ্রামে ফিরে আসে। ইতিমধ্যে এরশাদ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে ঘোষণা করে। এজন্য ১৯৮১ সালে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে তিন জেলায় “পার্বত্য চট্টগ্রাম স্থানীয় সরকার পরিষদ’ ১৯৮৯” আইন প্রণয়ন করে। তবে পাহাড়িদের দাবীর সাথে সামঞ্জস্য না হওয়ায় পাহাড়িরা তা প্রত্যাখ্যান করে।১৭
অন্যদিকে, ১৯৮৯ সালে ৪ মে সেনাবাহিনী ও সেটলার বাঙালিদের লংগদু উপজেলায় পাহাড়িদের কয়েকটি গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। এতে শত শত পাহাড়ি খুন, গুম ও অনেক নারী ধর্ষিত হয়। যা লংগদু গণহত্যা নামে পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিচিত। এরই প্রতিবাদে ১৯৮৯ সালে পাহাড়ি ছাত্ররা ঢাকায় মিছিল করে এবং “বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ” নামে ছাত্র সংগঠন গঠন করে গণতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু করে।১৮ এর ১৯৮৮ সালের ৮ মার্চ, পাহাড়ি নারীদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত পাহাড়ি ছাত্রীরা “ছিল উইমেন্স ফেডারেশন” নামে একটি নারী সংগঠন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠন করে। উভয় সংগঠন সম্মিলিতভাবে ঢাকা ও চট্টগ্রামে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের দাবীতে গণতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু করে। ইতিমধ্যে ১৯৯০ সালে স্বৈরচার এরশাদ সরকারের পতন হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী কর্তৃক পাহাড়িদের উপর নির্যাতন, নিপীড়ন ও দমনের ইতিহাস সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় এবং ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে দেশের জনগণ জানতে পারে। তখন থেকেই নিয়মতান্ত্রিকভাবে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, পাহাড়ি গণ পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনসহ বিভিন্ন সংগঠন এই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে পাহাড়ে এবং সমতলে তীব্ৰ গণআন্দোলন গড়ে তোলে। কিন্তু পাহাড়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত-দমন আগের মতো হয়ে যায়। আবার দীর্ঘ এক দশকের পর ১৯৯৭ সালে ডিসেম্বর মাসে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাথে তৎকালীন আওয়ামী লীগের সরকারের “পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি” হয় এবং এই চুক্তির মধ্য দিয়ে জনসংহতি সমিতির সদস্যবৃন্দ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে।১৯ এই চুক্তির ফলে স্থানীয় সরকার পরিষদ পরিবর্তন হয়ে তিন জেলায় তিনটি জেলা পরিষদ হয়, এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্তণালয় গঠন হয়।২০ এরপর সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ২০০১ সালে “ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১” আইন প্রণয়ন করে। ভূমি কমিশনও গঠন করা হয়। কিন্তু অদ্যবধি তা কার্যকর হয়নি।
ভূমি ব্যবহার ও ভূমি সমস্যার ইতিহাস
পার্বত্য চটগ্রাম পাহাড়-পর্বত বেষ্টিত একটি অঞ্চল। বৃটিশ শাসনের পূর্বে মোঘল আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল ‘কার্পাস মহল’২১ হিসেবে পরিচিত ছিল। পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়িরা মূলত জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল (Shifting cultivation) জুম চাষের ওপর ভিত্তি করে তাদের অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে উঠেছে। তবে ১৮০০ সালের প্রথম দিকে চাকমা রাজা ধঁরম বক্স খাঁ সর্বপ্রথম জুম চাষের পাশাপাশি সমতল ভূমিতে লাঙ্গল চাষ প্রবর্তন করেন।২২ তখন রাজা সমতল এলাকা থেকে কয়েকজন বাঙালি প্ৰজা এনে লাঙল চাষ পদ্ধতি চালু করেন। পরে ধীরে ধীরে পাহাড়িরা নিজেরাই জঙ্গল কেটে সমতল ভূমিতে লাঙ্গল চাষের মাধ্যমে চাষাবাদ শুরু করে। তবে ১৮৬৪ সালে সরকার প্রশাসনিকভাবে পাহাড়িদের সমতল ভূমিতে চাষ-বাসের আওতায় আনার নীতি গ্রহণ করে এবং এই নীতি বাস্তবায়নের জন্য পাহাড়িদের উৎসাহ প্রদান ও খাজনা মওকুফসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিতে থাকে। মূলত: রাজস্ব আদায় ও সব পাহাড়ি এক অভিন্ন প্ৰশাসনিক আওতায় এনে শাসন করার উদেশ্যে বৃটিশরা হাল চাষ পদ্ধতি গ্রহণ করার জন্য রাজাদের ওপর চাপ দিতো।২৩ এভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে জুমচাষের পাশাপাশি পাহাড়িরা সমতল ভূমির জঙ্গল পরিস্কার করে চাষের উপযোগী অনেক ভূমি গড়ে তোলে। সাধারণত: পাহাড়িরা যে যত জঙ্গল-গাছগাছড়ি কেটে জমি পরিষ্কার করতে পারে সে ততটুকুই জমির অধিকার পায় অর্থাৎ জমির মালিকানা স্বত্ব বজায় হয়। তবে এই অধিকার বা মালিকানার উপর কোন রেজিস্ট্রেশন বা লিখিত দলিল হয় না। তারা জমির সীমানা বা চৌহদ্দি মূলে জমির দখলিস্বত্ব বজায় রাখে এবং সেই অনুসারে কারবারি বা হেডম্যানের কাছে জমির খাজনা পরিশোধ করে। এভাবে জমির অধিকার বা মালিকানা বংশ-পরম্পরায় চলতে থাকে। বলা যায় এটা পাহাড়িদের এক ধরণের প্রথা এবং ঐতিহ্য এই প্রথা এখনো বজায় রয়েছে। এর মধ্যে দেশের অন্য অঞ্চল থেকে বিভিন্ন আদিবাসী পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে চাষ-বাস এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের নামে চট্টগ্রাম অঞ্চলের বাঙালিদের আসা-যাওয়া বৃদ্ধি পেতে থাকে। অনেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে থেকে যায়। তাদের নিয়ন্ত্রণের জন্য বৃটিশ সরকার ১৯২৫ সালে বহিরাগতদের অভিবাসনের বিধি-নিষেধ সংক্রান্ত বিধি ৫১ ও ৫২ “পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন, ১৯০০” আইনে সংযোজিত করে।২৪ এর ফলে সেই সময়ে বাঙালিও অন্যান্য আদিবাসীদের অভিবাসন কমতে শুরু করে। তবে ১৯৩০ সালে রেগুলেশনের ৫২ বিধি প্রত্যাহার হলে বাঙালিদের ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে অভিবাসন প্রক্রিয়া পার্বত্যঞ্চলে ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
পাকিস্তান আমলে ভূমি সমস্যা
পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা মূলত: পাকিস্তানী শাসনের সময় থেকে শুরু হয়। এই সময়ে দুই ভাবে ভূমিসমস্যার উদ্ভব হয়।
1) পুনর্বাসন প্রক্রিয়া: ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত উপমহাদেশ ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি পৃথক রাষ্ট্র গঠিত হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। যদিও তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িরা এই অন্তর্ভুক্তির তীব্র বিরোধিতা করেছিল। ধর্মীয় তত্বে ভাগ হওয়ার কারণে ভারত থেকে আগত হাজার হাজার মুসলিমকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পুনর্বাসন করা হয়। সেই সময় পার্বত্য চট্টগ্রামেও কয়েক হাজার মুসলিমকে পুনর্বাসন করা হয়।২৫ এর ফলে সহজ সরল অনেক পাহাড়ি পূনর্বাসিত বাঙালিদের সাথে পাশাপাশি থাকতে না পেরে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয় এবং অনেকে ভয় শংকার মধ্যে বসবাস করতে থাকে। এসময় অনেক পাহাড়ির জমি বেদখল হয়ে যায়। এভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি সমস্যার উদ্ভব ঘটে।
2) কাপ্তাই বাঁধ প্রকল্প ও কর্ণফুলি পেপার মিল: ১৯৫৭-৬৩ সালে পাকিস্তান সরকার কাপ্তাই বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য কর্ণফুলি নদীতে বাঁধ দেয়। এর ফলে চাকমা ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর হাজার হাজার একর জমি, শতশত পাহাড়ি গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে যায়। এক জরীপে দেখা যায়, কাপ্তাই বাঁধের কারণে প্রায় ৫৬.০৬% অর্থাৎ ৫৪ হাজার একর সমতল আবাদি ভূমি পানিতে তলিয়ে যায়। অথচ, এর পরিবর্তে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয় খুবই নগণ্য এবং উদ্বাস্তুদের বন্দোবস্তি দেয়া হয় ১৮০০ একর ভূমি, যার মাধ্যমে শুধুমাত্র কয়েক’শত ক্ষতিগ্রস্থ পাহাড়ি পরিবার পূর্নবাসিত হয়।২৬ এই বাঁধের কারণে প্রায় এক লক্ষ চাকমা বাস্তুভিটা হারায় এবং এদের অধিকাংশই ভারতে চলে যায়। আবার অনেকে খাগড়াছড়ি, দাঘিনালা, মারিশ্য অঞ্চলে নিজেরা পাহাড় ও সমতলের জঙ্গল পরিষ্কার করে বসবাসের উপযোগী ভূমি গড়ে তোলে এবং সেখানে বসবাস করা শুরু করে। অন্যদিকে বাঁধ নির্মিত হওয়ার সময় পাকিস্তান সরকার গরিব বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশে উৎসাহিত করে। এর ফলে শত শত বাঙালি পরিবার পার্বত্য চটগ্রামে প্রবেশ করে।২৭ এছাড়া ১৯৬০ সালে চন্দ্রঘোনায় কর্ণফুলি পেপার মিল স্থাপিত হলে এই কারখানায় শত শত বহিরাগত বাঙালিকে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ফলে অনেক বাঙালি পরিবার চন্দ্রঘোনায় প্রবেশ করে। এতে অনেক পাহাড়ি বাঙালিদের সাথে থাকতে না পেরে অন্যত্র চলে যায়, এবং অনেক পাহাড়ির ভূমি বেদখল হয়ে যায়। এছাড়া, পেপার মিল গড়ে উঠলেও মিলে কাজে নিয়োগের ক্ষেত্রে পাহাড়িদের বঞ্চিত করা হয়। ফলে অনেকে আর চন্দ্রঘোনায় থাকেনি।
একদিকে, কাপ্তাই বাঁধের কারণে নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ হওয়া, অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্নভাবে এতে ব্যাপকভাবে বাঙালি প্রবেশের কারণে পাহাড়িরা ভয়-ভীতি নিয়ে বসবাস করতে শুরু করে। অনেক বাঙালির সাথে পাহাড়িদের ভূমি বিরোধ দেখা দিতে থাকে। এই সব সমস্যা সহজ সরল পাহাড়িরা ভালোভাবে নিতে পারেনি এবং এই জন্য অনেকে গভীর পাহাড়ের দিকে চলে যায়। অনেকের জমি বেদখলে চলে যায়। এভাবে ভূমি সমস্যা পাহাড়ে বৃদ্ধি হতে থাকে। পরবর্তীতে এই ভূমি সমস্যা পাহাড়িদের অস্তিত্বের হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়।
বাংলাদেশে ভূমি সমস্যা
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ও স্বাধীনতার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম সীমান্তের আশে পাশের এলাকা থেকে, বিশেষ করে রামগড়-মানিকছড়ি সীমান্ত দিয়ে হাজার হাজার বাঙালি পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে।২৮ মারমা ও ত্রিপুরা অধ্যুষিত হিসেবে পরিচিত রামগড়, মানিকছড়ি ও মাটিরাঙ্গা অঞ্চলে বাঙালিরা বসতি গড়ে তোলে। এইসময় সহজ-সরল শত শত পাহাড়ি পরিবার নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে অন্যত্র যেতে বাধ্য হয় এবং অনেক পাহাড়ি পরিবার ভয়, ভীতি মধ্যে বসবাস করলেও পরবর্তীতে তারা নিজেদের জমি হারিয়ে ফেলে। তখন প্রশাসনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগিতায় পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি প্রবেশের স্রোত ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়।
১৯৭৯ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি বসতিকরণের জন্য তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সরকার এক গোপন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।২৯ সিদ্ধান্ত মোতাবেক, সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৭৯-১৯৮০ সালে এক লক্ষ সেটলার বাঙালি, ১৯৮১ সালে এক লক্ষ এবং ১৯৮৩ সালে এক লক্ষ সেটলার বাঙালি সর্বমোট চার লক্ষ সেটলার বাঙালি পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসন করা হয় (জীবন আমাদের নয়: পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন)।৩০ এই পুনর্বাসন প্রক্রিয়া ক্রমাগত চলতে থাকে সেনাবাহিনী ও সিভিল প্রশাসনের সরাসরি তদারকির মাধ্যমে। পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় প্রতিটি সেটলার বাঙালি পরিবারকে বিশেষ ব্যবস্থায় ৪ বা ৫ একর ভূমি বন্দোবস্তির নথি ও ৩০০০ টাকা দেওয়া হয় এবং তাদের জন্য রেশনের ব্যবস্থা করা হয়।৩১ অধিকাংশ সেটলার বাঙালিদের জমি বন্দোবস্তি দেওয়া হয় খাগড়াছড়ি, মাটিরাঙ্গা, পানছড়ি, মানিকছড়ি, দীঘিনালা, মহালছড়ি, রাঙ্গামাটি, কাউখালি, লংগদু, বরকল, নানিয়ারচর, অলিকদম, লামা প্রভৃতি জায়গায়। মূলত: পাহাড়িদের আইনানুগ বন্দোবস্তিকৃত জমি বা বংশ পরম্পরায় ভোগ-দখলকৃত খাস দখলীয় জমিতে এই সব সেটলারদের বন্দোবস্তি দেওয়া হয়। সেটেলমেন্টের প্রক্রিয়াটি প্রথমে কৌশলে করা হয় যেমন, প্রথমত: এই বন্দোবস্তি প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ গোপনে করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে বন্দোবস্তি প্রক্রিয়ায় যে প্রচলিত নিয়ম বিধি অর্থাৎ রাজস্ব ও জরিপ কর্মকর্তার সারেজমিন তদন্ত করা ও হেডম্যানের সুপারিশসহ যে বিধি রয়েছে তা অনুসরণ করা হয়নি। দ্বিতীয়ত: যেখানে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প রয়েছে বা মিনি ক্যাম্প রয়েছে, সেই ক্যাম্পের আশে-পাশে সেটারদের গুচ্ছগ্রাম করে বসতি করানো হয়। সেইসময় যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করার কারণে প্রথমে তাদেরকে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হতো।তবে, যেসব এলাকা সেনাক্যাম্পের অধীনে রয়েছে সেসব এলাকার পাহাড়িদের ভোগ-দখলীয় ভূমিতে সেটলারদের পুনর্বাসন করা হয়। পরবর্তীতে কিছু কিছু পরিবারদের তাদের কবুলিয়তকৃত জায়গায় বসিয়ে ভূমি দেওয়া হয় এবং এতে কোন সমস্যা দেখা দিলে সেখানে সেনা ক্যাম্প স্থাপন করা হয়।এছাড়া,সেনাবাহিনী শান্তিবাহিনী বিদ্রোহ দমনের নামে সাধারণ পাহাড়িদের ওপর চালায় বিভিন্নভাবে অত্যাচার, নির্যাতন, ভয়, ও হুমকি দিতে থাকে। তাদের মাধ্যমে পাহাড়ি হত্যা-গুম-নারী ধর্যর্ণ প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকে। সেনাবাহিনীর সহায়তায় সেটলার বাঙালিরা পাহাড়িদের গ্রাম আক্রমণ করে অথবা বিভিন্ন কৌশলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটায়। এতে পাহাড়িরা নিজ ভিটা থেকে উচ্ছেদ হতে বাধ্য হয়। যে এলাকা থেকে পাহাড়িরা উচ্ছেদ হয় তখনি সেটলার বাঙালিদের সেখানে পুনর্বাসন করা হয়। এছাড়া, সেনাবাহিনীর ক্যান্টনমেন্ট, ক্যাম্প ও বিডিআর, আনসার, ও পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন এবং সম্প্রসারণ হওয়ার কারণে পাহাড়িদের জমি বেদখল হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে বেদখলকৃত জমির ক্ষতিপূরণও দেওয়া হয় না। এভাবে শত শত পাহাড়ি পরিবারকে তাদের ভূমি থেকে প্রতিনিয়ত উচ্ছেদ এবং অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য করা হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে বর্ধিষ্ণু পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অঞ্চল ছিল মাটিরাঙ্গার ফেনী তাইদং অঞ্চল। ১৯৭৯-৮১ সালে মাটিরাঙ্গা থানার ফেনী অঞ্চলে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় সেটলার বাঙালিরা পাহাড়িদের গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ার ফলে হাজার হাজার পাহাড়ি ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়। অনেককে অন্যত্র সরে যেতে বাধ্য করা হয়। এরপর সেটলার বাঙালিরা পাহাড়িদের সকল জমি বেদখল করে নেয়। এমনকি, মাটিরাঙ্গার কয়েকটি মৌজার হেডম্যান পদও বেদখল করে নেয়। কয়েক বছর পর ভারত থেকে পাহাড়ি শরণার্থীরা ফিরে আসলেও তাদের গ্রাম বা জায়গা ফিরে পায়নি। ১৯৭৯ সালে লংগদু, কাউখালি, ১৯৮৪ সালে ভূবনছড়া, হরিণা, পানছড়ি, ১৯৮৬ সালে খাগড়াছডি, দীঘিনালা, পানছড়িতে সেটলার বাঙ্গালিরা সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পাহাড়িদের এাম জ্বালিয়ে দেয়, হত্যা-গুম ও নারী ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটায়। ফলে ৭০ হাজারেরও বেশী পাহাড়ি ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।৩২ সেই সময় পাহাড়িদের অনুপস্থিতিতে সেটলার বাঙালিরা পাহাড়িদের বাস্তুভিটা ও জমি বেদখল করে নেয়। এইসব ক্ষেত্রে প্রশাসনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা ছিল।
১৯৮০-৮১ এবং ১৯৮৪ সালে সেনাবাহিনী কর্তৃক গণহত্যার ঘটনার ফলে যেসব পাহাড়ি ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে তাদের পুনর্বাসনের জন্য সরকার নিরাপত্তা ও বাস্তুভিটা ফেরতসহ বিভিন্ন কিছু আশ্বাস দেয় কিন্তু সরকার পুনর্বাসনের নামে তাদের ফেরত আনলেও তারা কিন্তু আজো নিজেদের বাস্তুভিটায় ফেরত যেতে পারেনি। একারণে ১৯৮৬-৯২ সালে যেসব পাহাড়ি ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল তারা পুনর্বাসনের জন্য সরকারের কাছে ১৬ দফা দাবীনামা পেশ করে এবং ১৯৯৪ সালে তৎকালীন সরকার ১৬ দফা মেনে নিলে কয়েক হাজার শরণার্থী দেশে ফিরে আসে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় অনেক পাহাড়ি শরণার্থী এলাকায় ফিরে আসলেও তারা নিজ জায়গায় ফিরে যেতে পারেনি।৩৩ একারণে আবার পাহাড়ি শরণার্থীরা ২০ দফা দাবী সরকারের কাছে পেশ করে। ১৯৯৭ সালে তৎকালীন সরকার ২০ দফার ভিত্তিতে শরণার্থীদের পুনর্বাসন করা হবে বলে ঘোষণা করে। ১৯৯৮ সালে ২০ দফার ভিত্তিতে শরণার্থীরা ফিরে আসে কিন্তু অধিকাংশ শরণার্থী নিজেদের ভিটায় ফিরে যেতে পারেনি, নিজেদের জমি ফেরত পায়নি। এখনো সেটলার বাঙালিরা বেদখল করে রেখেছে অথবা সেনা ক্যাম্পের অধীনে তাদের জমি বেদখল রয়েছে। শরণার্থীদের ২০ দফার মধ্যে ছিল শরণার্থী বিষয়ক টাস্কফোর্স গঠন করা।
এই টাস্কফোর্স ভারত থেকে প্রত্যাগত শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ শরণার্থীদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া বিষয়ে কাজ করবে।৩৪ কিন্তু এই টাস্কফোর্স ১৯৯৮ সালে গঠন হলেও ১৯ দফা ভিত্তিক এখনো কাজ করতে পারেনি। এখনো আভ্যন্তরীণ শরণার্থী বিষয়েও কোন সমাধান করতে পারেনি। ফলে ফিরে আসার দশ-বছর পরও শরণার্থীরা তাদের জমি ফিরে পায়নি এবং নিজেদের জায়গায় যেতে পারেনি। এখনো শত শত পাহাড়ি পরিবার স্কুল ঘরে বসে মানবেতর জীবন যাপন করছে। অনেকে অন্য কোন আত্মীয়ের বাসায় থেকে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। সরকারের অসহযোগিতার কারণে তারা নিজেদের বাস্তুভিটায় যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না।
১৯৯৭ সালে তৎকালীন আওয়ামী সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদন করে।৩৫ এই চুক্তির ফলে অনেকে আশা করেছিল ভূমি সমস্যা আর বাড়বে না এবং বিদ্যমান ভূমি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু এখনো ভূমি সমস্যার সমাধানতো হয়ইনি বরং এই সমস্যা দিন দিন জটিল রূপ ধারণ করছে। ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ অনুযায়ী ১৯৯৯ সালে ভূমি কমিশন গঠন হয় এবং একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু কার্যভার গ্রহণ করার আগে তিনি মৃত্যু বরণ করেন । ২০০০ সালেও আরেকজন বিচারপতিকে কমিশনে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনিও পরে পদত্যাগ করেন। অত:পর ২০০১ সালে “ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১” প্রণয়ন করা হয়। এই আইনানুযায়ী ভূমি কমিশন গঠিত হয় এবং কমিশনে একজন বিচারপতি নিয়োগ হলেও তিনি কোন কাজ করতে পারেননি। ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ অনুযায়ী ভূমি কমিশন গঠন করার কথা থাকলেও তৎকালীন সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সাথে আলোচনা না করে একতরফাভাবে “ভূমি কমিশন আইন” প্রণয়ন করে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ভূমি কমিশন আইন চুক্তি অনুযায়ী সংশোধন করার জন্য সরকারের কাছে দাবী জানিয়ে আসছে। এই অবস্থায় কমিশন এখনো কাজ শুরু করতে পারেনি।৩৬ একারণে বিদ্যমান ভূমি সমস্যা এখনো বিদ্যমান। তবে ভয়ের বিষয় হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পরেও এখনো বিভিন্নভাবে সরকার বা সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগিতায় সমতল এলাকা থেকে বাঙালি পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করছে এবং প্রশাসন বিভিন্ন সময়ে সমতলের বাঙালি শিল্পপতিদের কাছে হাজার হাজার একর ভূমি-পাহাড় লীজ দিয়ে যাচ্ছে। ফলে পাহাড়িদের প্রথাগত ব্যক্তি ও যৌথ মালিকানাধীন ভূমি বিভিন্নভাবে বেদখল হয়ে যাচ্ছে। এভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি সমস্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে মোট ভূমি হচ্ছে ৩২,৮৫,০০০ একর এবং জনসংখ্যা ৯,৭৪,৪৪৫ (নিচে: সারণী ৩) । অনুপাত আপাতদৃষ্টিতে, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি ও জনসংখ্যা দেখে মনে হতে পারে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে মাথাপিছু ভূমি ব্যবহার দেশের অন্যান্য অংশের তুলনায় বেশী। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি ব্যবহার ও ভূমি প্রকৃতি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, ভূমির পরিমাণ দেশের অন্যান্য অংশের চেয়ে কম। যেমন সারণী ১. থেকে দেখা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে সব কাজের উপযোগী ভূমি মাত্র ৩.১% অর্থাৎ ১,২৪,১৬০ একর। এছাড়া, কিছু পরিবর্তনের মাধ্যমে আরো ১৮.৭% জমি অর্থাৎ মোট ৭,৫৫,৮৪০ একর জমি চাষযোগ্য করা যায়। বাকী ৭২.৯% জমি বন করার উপযোগী। অথাৎ ধরে নেয়া যায় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ২১.৮% একর ভূমি ব্যবহার করা যায়। ১৯৯২ সালে সারণী ২. অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি ব্যবহার হচ্ছে মাত্র ৩৭.৭%। অথচ দেশের অন্য অংশে ভূমির ব্যবহার হচ্ছে ৮৮.২%। এই হিসাবে দেখা যায় পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি ব্যবহারের অনুপাত তুলনামূলকভাবে অনেক কম। এছাড়া, দিন দিন অস্বাভাবিক হারে বাঙালি জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে দেশের সমতলের তুলনায় জনসংখ্যার ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। সারণী ৩. থেকে দেখা যায়, ১৯০১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি বাঙালির জনসংখ্যার অনুপাত ৯৩:৭, ১৯৫১ সালে ৯১:৯, ১৯৮১ সালে ৫৯:৪১ এবং ১৯৯১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি বাঙালি জনসংখ্যার অনুপাত ৪৯:৫১। এভাবে বাঙালির জনসংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকলে ভূমি সমস্যা ও দিন দিন বৃদ্ধি পাবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অধ্যুষিত বৈশিষ্ট্য হারিয়ে যাওয়া সময়ের ব্যাপার হবে মাত্র।
সারণি: ১
পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি প্রকৃতির বিবরণী
শ্রেণী | আয়তন (একর) | ভূমি প্রকৃতি | % |
এ | ১২৪,১৪০ | সব কাজের উপযোগী | ৩.১% |
বি | ১১০,০৮০ | থাক কাটার পর কৃষি বা উদ্যান চাষের জন্য উপযোগী | ২.৭% |
সি | ৫৩৯,৯২০ | উদ্যান বা বন করার উপযোগী | ১৮.৭% |
ডি | ২৯৪৩,৩৬০ | বন করার উপযোগী | ৭২.৯% |
সি-ডি | ৫১,৮৪০ | বন করার উপযোগী, তবে পর্যাপ্ত থাক করার পর উদ্যান চাষ উপযোগী | ১.৩% |
সেটেলমেন্ট ও পানি | ২১৪,৪০০ | ৫.৩% | |
মোট | ৩৯৮৩,৭৪০ | ১০০% |
উৎস: পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্থনীতির রূপরেখা-একটি পর্যালোচনা; বি এইচ সোহরোয়ারদী; ভিশন-১৯৯৫, রাঙ্গামাটি
সারণি: ২
ভূমি ব্যবহার (১৯৯০-১৯৯১) (একর)
পার্বত্য চট্টগ্রাম | % | বাংলাদেশ | % | |
মোট ভূমি | ৩২৮৫০০০ | ১০০% | ৩৬৬৭০০০০ | ১০০% |
চাষযোগ্য নয় এমন জমি | ৭৫৫০০০ | ২২.৯৮% | ৭৯৫৮০০০ | ২১.৭০% |
বন | ২০৪৭০০০ | ৬২.৬১% | ৪৬৯৩০০০ | ১২.৮০% |
Current Weast | ১৭২০০০ | ৫.২% | ১৪৪২০০০ | ৩৯.৩% |
চাষযোগ্য জমি কিন্তু এই বৎসর অব্যহৃত | ৯৭০০০ | ৩% | ২৩৭৯০০০ | ৬.৪৯% |
এক ফসলা জমি | ৯৭০০০ | ৪.৩৫% | ৮১৪০০০০ | ২২.২০% |
২ ফসলা জমি | ৫৬,০০০ | ১.৭০% | ৯,৬৩৪,০০০ | ২৬.২৭% |
৩ ফসলা জমি | ১৫,০০০ | ০.৪৬% | ২৪২,৪০০ | ৬.৬১% |
মোট চাষযোগ্য জমি | ৩০০০০ | ৯% | ৩৪,৭৮৪,০০০ | ৯৪.৮৬% |
নীল চাষযোগ্য জমি | ২১৪০০০ | ৬.৫% | ২০১৯৮০০০ | ৫৫.০৮% |
উৎস: পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্থনীতির রূপরেখা-একটি পর্যালোচনা; বি এইচ সোহরোয়ারদী; ভিশন-১৯৯৫, রাঙ্গামাটি
সারণি: ৩
পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংখ্যা (১৮৭২-১৯৯১)
পরিসংখ্যান বৎসর | ১৮৭২ | ১৯০১ | ১৯৫১ | ১৯৮১ | ১৯৯১ |
পাহাড়ি | ৬১,৯৫৭(৯৮%) | ১১৬,০০(৯৩%) | ২৬১,৫৩৮(৯১%) | ৪৪১,৭৭৬(৫৯%) | ৫০১,১১৪(৫১%) |
বাঙালি | ১০৯৭(২%) | ৮,৭৬২(৭%) | ২৬,১৫০(৯%) | ৩০৪,৮৭৩(৪১%) | ৪৭৩,৩০১(৪৯%) |
মোট | ৬৩,০৫৪ | ১২৪,৭৬২ | ২৮৭,৬৮৮ | ৭৪৬,৬৪৯ | ৯৭৪,৪৪৫ |
উৎস: পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্থনীতির রূপরেখা-একটি পর্যালোচনা; বি এইচ সোহরোয়ারদী; ভিশন-১৯৯৫, রাঙ্গামাটি
২দেখুন, Ven Schendal, May, Dewan (2001), Map 1;
৩ চাকমা জনগোষ্ঠী নিজেদের ‘চাঙমা’ হিসাবে পরিচয় দিতে ভালবাসে। এজন্য এই গবেষণায় কোন কোন ক্ষেত্রে ‘চাঙমা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।
৪ দেখুন, প্রদীপ্ত খীসা, প্রসঙ্গ: পার্বত্য চট্টগ্রাম; লেখক-সিদ্ধার্থ চাকমা।
৫ Raja Tridev Roy (2003); সুপ্রকাশ রায় (১৯৯৬) পৃ: ৬৬-৬৭:
৬ সুপ্রকাশ রায় (১৯৯৬)
৭ প্রাগুক্ত
৮ দেখুন, প্রদীপ্ত খীসা
৯ Rules for territorial circles in CHT, 1984
১০ জীবন আমাদের নয় (২০০১); প্রদীপ্ত খীসা (১৯৯৬); Amena Mohasin (2003); Qanugo, Suniti Bhusahan (1998); Raja Devasish; Challenging for Juridical Pluralism and Customay Laws of Indegenous People: the Case of the Chittagong HIll Tracts (Published in Roy, Chandra K, Edited by (2004); Defending Diversity: Case Studies : the Saami Council, Sweedish Section).
১১ জীবন অামাদের নয় (২০০১); পদীপ্ত খীসা (১৯৯৬); Amena Mohasin(2003);
১২ জীবন আমাদের নয়; ও প্রাগুক্ত;
১৩ প্রাগুক্ত
১৪ প্রাগুক্ত
১৫ প্রাগুক্ত
১৬ পদীপ্ত খীসা (১৯৯৬); Amena Mohasin (2003);
১৭ পদীপ্ত খীসা; Amena Mohasin (2003);
১৮ জীবন অামাদের নয় (২০০১); পদীপ্ত খীসা (১৯৯৬); Amena Mohasin(2003);
১৯ জীবন অামাদের নয় (২০০১); Amena Mohasin(2003);
২০ জীবন অামাদের নয় (২০০১); Amena Mohasin(2003);
২১ ‘কার্পাস’ মানে এক ধরণের তুলা যা পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ে চাষ করা হয়। জুম চাষের পাশাপাশি এই তুলা উপাদন হতো।
২২ দেখুন, প্রদীপ্ত খীসা;
২৩ পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি ও ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থায় উদ্ভব এবং ক্রমবিকাশ (বাংলা অনুবাদ); অনুবাদক: এডভোকেট জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা
২৪ Chittagong Hill Tracts Regulation, 1900
২৫ প্রসঙ্গ: পার্বত্য চট্টগ্রাম; লেখক- সিদ্ধার্থ চাকমা; প্রদীপ্ত খীসা;
২৬ প্রাগুক্ত
২৭ প্রাগুক্ত
২৮ জীবন আমাদের নয়: পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন; প্রদীপ্ত খীসা;
২৯ প্রসঙ্গ: পার্বত্য চট্টগ্রাম; লেখক- সিদ্ধার্থ চাকমা; প্রদীপ্ত খীসা; প্রাগুক্ত
৩০ জীবন আমাদের নয়: পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন
৩১ প্রাগুক্ত;
৩২ জীবন আমাদের নয়: প্রদীপ্ত খীসা;
৩৩ পার্বত্য চট্টগ্রাম সংকট ও সম্ভাবনা; সম্পাদনায় মেসবাহ কামাল ও শারমিন মৃধা।
৩৪ প্রাগুক্ত
৩৫ জীবন আমাদের নয়: পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন ও প্রগুক্ত
৩৬ প্রাগুক্ত; দেখুন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে; ২ ডিসেম্বর, ২০০৮; পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি।
।
প্রসঙ্গ:পার্বত্য চট্টগ্রাম
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।