Jumjournal Logo

Search

Menu

“ত্রিপুরা” জাতির পূর্ব-পরিচয় (লেখক ~ সলিল রায়)

Jumjournal

Last updated Sep 7th, 2025

10

featured image

॥ এক ॥

(ত্রিপুরা নামের ইতিকথা)

 

“উপজাতি” নামে আখ্যায়িত যে ডজন খানেক মংগোলীয় জনগোষ্ঠী এই পার্বত্য চট্টগ্রামে বাস করে, তাদের মধ্যে আমার আজকের আলোচনার লক্ষ্য “ত্রিপুরা” জনগোষ্ঠী লোকসংখ্যা বিচারে তৃতীয় স্থানের দাবীদার । ১৯৫১ ইং সনের আদমশুমারী মতে এই জিলায় চাকমা, মারমা এবং ত্রিপুরা জনসংখ্যা যথাক্রমে ১২৪,৭৬২ জন, ৬৫৮৮৭ জন ও ৩৭,২৪৬ জন । এর পরে উপজাতি-ভিত্তিক লোকগণনা আর হয়নি, হয়েছে-ধর্ম ভিত্তিতে । তাই কোন্ জনগোষ্ঠীর প্রকৃত লোকসংখ্যা এখন কতো, তা সঠিকভাবে জানা যায় না । পরবর্তী লোকগণনা গুলিতে দেখা যায়, এই জিলায় প্রতি বৎসর লোক বেড়েছে গড়ে প্রতি শতে প্রায় তিনজন। সেই হিসাবে, এখন এখানে ত্রিপুরা জনসংখ্যা আনুমানিক সত্তর হাজারের মত ধরে নেয়া যায় । “ত্রিপুরা” জনগোষ্ঠীর মূল জনসংখ্যা বাস করে ভারতের অন্তর্গত পার্শ্ববর্তী “ত্রিপুরা” রাজ্যে এবং সেখানে তার জনসংখ্যা অবশ্যই কয়েক লক্ষ। এখানকার জনসংখ্যা নিঃসন্দেহে অতীতকালে এই মূল জনসংখ্যার সাথে সংযুক্ত ছিলো।

 

“ত্রিপুরা” রাজ্য এই পূর্বাঞ্চলীয় শক্তিবিচারে অতীতে বিশেষ প্রতিপত্তিশালী ছিলো। তার রাজশক্তির আধিপত্য অথবা প্রভাব এই পার্বত্য অঞ্চলসহ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন স্থানে অতীতে বিস্তার লাভ করেছিলো । এই উপমহাদেশের মহা প্রভাবশালী মোগল সম্রাট আকবরের অন্যতম সভারত্ন আবুল ফজলের রচিত “আইন ই-আকবরী” পুস্তকে এই রাজ্যাধিপতি বিজয়মাণিক্যের কথা স্থান পেয়েছে। এ ছাড়াও অনেকের ধারণা- বাংলার বার ভূঁইয়াদের অন্যতম ঈশা খাঁ মোগল সেনাপতি শাহবাজ খাঁর হাতে পরাজিত হয়ে কিছুকাল যাবত এই রাজ্যাধিপতির অধস্থে সেনাপতিরূপে চট্টগ্রাম অঞ্চলে অবস্থান করেছিলেন।

 

“ত্রিপুরা” রাজ্যের নিজস্ব ইতিহাস পাওয়া যায়। তার মুদ্রিত রূপ “রাজমালা” ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে প্রকাশিত হলেও দাবী করা হয়েছে-তার ভিত্তি হস্তে লিখিত “রাজাবলী’র তথ্য পঞ্চদশ শতকেই দু’জন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত শুত্রেশ্বর ও বাণেশ্বর দ্বারা সংগৃহীত হয়ে সংস্কৃত ভাষায় ধারাবাহিকভাবে রক্ষিত হয়েছে এবং পরবর্তী পর্যায়ের তথ্যাবলীও অন্যান্য পণ্ডিতেরা সযত্নে রক্ষা করে গেছেন। “রাজমালা” ত্রিপুরা রাজ্যের বহু অতীত তথ্যে সমৃদ্ধ। কিন্তু এতে কল্পনাবিলাস অতিরঞ্জণ এবং পক্ষপাতদুষ্টতাও নির্বিচারে স্থান পেয়েছে। তাই দেখা যায়-এতে দাবি করা হয়েছে যে, ত্রিপুরাধিপতি ত্রিলোচন ‘মহাভারত’- কাব্যে বর্ণিত প্রথম পাণ্ডব যুধিষ্ঠিরের সমসাময়িক ছিলেন । এর মানে-অন্যান্য কথা বাদ দিয়ে আনুমানিক সাড়ে তিন হাজার বৎসর পূর্বেও এই রাজ্যের অস্তিত্ব ছিলো । অথচ তার সমর্থনে মোটেই কোন প্রমাণ নেই ৷

 

কেউ কেউ মনে করেন— “ত্রিপুরা” রাজ্য “পাত্তিকারা” নামেও অভিহিত হতো । বর্মি “রাজা ওয়েং” পুস্তকে বলা হয়েছে, সেখানকার “পেগান” রাজ্যের রাজকুমার আলংছিছু এই “পাত্তিকারা” রাজ্যের রাজকন্যাকে বিয়ে করেছিলেন দ্বাদশ শতকের দিকে । এই সময় নির্দেশ কতোখানি ঠিক বলা দুস্কর। “রাজা ওয়েং” রচিত হয়েছে এর বহু পরবর্তী কালে এবং এতেও কল্পনাবিলাস, অতিরঞ্জণ ও পক্ষপাতদুষ্টতার মোটেই অভাব নেই । যাই হোক, “রাজা ওয়েং”-এর উক্ত সময় নির্দেশ যদি ঠিক হয়ে থাকে, তবে আমার মতে-দ্বাদশ শতকেও “ত্রিপুরা” রাজ্যের অস্তিত্ব ছিলো বলে অন্ততঃ ধরে নেয়া যায় । কারণ, “ত্রিপুরা” ও “পাত্তিকারা” এক হওয়া অবশ্যই সম্ভব । “ত্রিপুরা” নামের একটি কথ্যরূপ- “তিপারা” এই শব্দের অন্তর্গত “প” বর্ণের উচ্চারণ কোন কোন আঞ্চলিক বা জনগোষ্ঠী ভিত্তিক অভ্যাসহেতু “ক” বর্ণের রূপ ধারণ করতে পারে। যেমন-বাংলা “পূর্ব” (“পূর্ব” দিক অর্থে) শব্দ চাকমা উচ্চারণে- “পূক” বা “পূগ” এবং “চামা” (ফুল) শব্দের মারমা/আরাকানী উচ্চারণ- “চাংগা” বা “চাইংগা”। এতে “তিপারা” শব্দ “তিকারা” হতে বাধা নেই এবং বস্তুতপক্ষে নোয়াখালি অঞ্চলের বহু ব্যক্তিকে এখনো “তিপারা” জনকে “তিকরা” বা “তিকরাই” নামে অভিহিত করতে দেখা যায়। এই সূত্রে- পাত+তিকরা পাততিকরা বা পাত্তিকারা নামের উদ্ভব হতে পারে বৈকি । (পাত বা পাট=রাজ্য, দেশ, স্থান, পাতশা/ বাদশা=রাজ্যের অধীশ্বর। উদাহরণ- “নাহি মানে পাতশায়, নাহি কর দিতে চায়, ভয়ে যতো ভূপতি দ্বারস্থ”- ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর)। 

 

এছাড়াও ত্রিপুরাদের একটি বৈশিষ্ট্য এই-তারা নিজ ভাষায় কথা বলতে বরাবরই “দেশ” বা “রাজ্য” (তাদের ভাষায় “হা”) শব্দকে আগে বসিয়েই কোন দেশের নাম উল্লেখ করে, এতে তাদের ধরণে “বাংলাদেশ” হয় (“হা বাংলা”) এবং “ত্রিপুরা- রাজ্য” হয় “রাজ্য ত্রিপুরা” (“হা ত্রিপুরা”)। সম্ভবতঃ এই মিশ্র প্রতিক্রিয়ার ফলশ্রুতিতে “দেশ তিকরা” অর্থে “পাত-তিকরা” বা “পাত্তিকারা” নামের ব্যবহার চালু হয়ে থাকবে। উল্লেখ্য যে, “পাত্তিকারা” রাজ্য যে এদেশের কুমিল্লা-চট্টগ্রাম অঞ্চলের নিকটবর্তী স্থানেই কোথাও অবস্থিত ছিলো, এ সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে প্রায় দ্বিমত দেখা যায় না এবং অনেকের ধারণা-বর্তমান চট্টগ্রামের অন্তর্গত “পটিয়া” এলাকা এবং কুমিল্লার অন্তর্গত “পাইতকারা স্থান এই “পাত্তিকারা” নামের ই স্মৃতি বহন করছে ।

যাই হোক, “ত্রিপুরা রাজ্যের নামোল্লেখ-যুক্ত দলিল ভিত্তিক প্রমাণ ষোড়শ শতক থেকে পরিষ্কার। ডঃ লুসিয়ান বার্ণো বলেন-প্রাচীন পর্তুগীজ টোম-গ্রাই-এর বর্ণনায় ১৫১২-১৫ খৃঃ অব্দেই এই রাজ্যের নামোল্লেখ পাওয়া যায় এবং এতে এই রাজ্য বাংলার নবাব আলাউদ্দিনের (১৪৯৯-১৫২১ খৃঃ) করদ বলে কথিত । লাভানা কর্তৃক অংকিত ১৬১৫ খৃঃ অব্দের বাংলাদেশের মানচিত্রেও “রেইনো দি তিপেরা” বিদ্যমান বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। এছাড়া ষোড়শ শতকের পর্যটক রালফ্ ফিচের বর্ণনাতেও এই নামের উল্লেখ রয়েছে।

“ত্রিপুরা” নামের উৎপত্তি সম্পর্কে বিতর্কের সীমা নেই । এতে দেখা যায়- (১) “ত্রিপুর” নাম-ধারী তাদের কোন প্রাচীন রাজার নাম থেকে “ত্রিপুরা” (২) কুমিল্লা (কমলাংক), চট্টগ্রাম (চট্টল) ও ব্রহ্মনক (আরাকান)-এই তিন দেশ বা “পুর” নিয়ে “ত্রিপূর” (৩) “তোয়-গ্রা” নাম থেকে “ত্রিপুরা” (“তোয়”-জল, নদী, “প্রা”- সংগমস্থান । অর্থাৎ তারা একদা কোন নদী-সংগম স্থানে বাস করতো এই অর্থে), (৪) “তিপেতরাও” শব্দ থেকে “তিপেরা” ইত্যাদি ইত্যাদি। (“তিপেত”- তিব্বত “রাও”-দল । অর্থাৎ তারা তিব্বত থেকে আগত এই অর্থে)।

 

উল্লেখিত যে কোন সূত্র ধরে যে “ত্রিপুরা” বা “তিপেরা/তিপারা” নামের উৎপত্তি ঘটতে পারে না এমন কথা নয় । তবে সম্ভাবনা বিচারে এই অভিমতগুলির স্থান বহু দূরে বলেই আমার ধারণা । কারণ— “তিপুর” শব্দ বিজড়িত তাদের কোন প্রাচীন রাজা ছিলেন, এমন কোন বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ নেই । তেমনি কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও আরাকান- এই সম্মিলিত অঞ্চল যে একদা “ত্রিপুর” নাম ধারণ করেছিলো, তারও কোন অকাট্য প্রমাণ নেই । কারণ আরাকানে ত্রিপুর রাজশক্তির অভিযান ঘটে থাকলেও সেখানে তার আধিপত্য বিস্তারমূলক দীর্ঘস্থায়ী অধিকারের অবশ্যই প্রমাণাভাব রয়েছে । বরং ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়-ত্রিপুর শক্তির চেয়ে আরাকানশক্তিই কোন কোন ক্ষেত্রে অধিকতর কার্যকর ভূমিকা প্রদর্শন করেছে এবং শেষ পর্যন্ত ত্রিপুর শক্তি আরাকানের

হাতে চূড়ান্ত মার খেয়েছে।  

 

অন্যদিকে, ত্রিপুর শক্তির প্রভাব এই তিন দেশ বা পুরকে নিয়েই সব সময় সীমাবদ্ধ থাকে নি, কোন কোন সময়ে নোয়াখালি প্রভৃতি বিভিন্ন স্থানে এবং আসাম অঞ্চলেও কোথাও প্রভাব বিস্তার করেছিলো। আর বর্তমান পার্বত্য ত্রিপুরাতে তার দীর্ঘ-স্থায়ী অধিকার তো থাকারই কথা । এতে কেবল কুমিল্লা, চট্টগ্রাম এবং আরকানকে নিয়ে “ত্রিপুর” নাম গড়ে উঠার কোন যৌক্তিকতা যেমন দেখা যায় না, তেমনি এই নাম থেকে একটি জনগোষ্ঠী আখ্যা গড়ে উঠাও অতি অস্বাভাবিক মনে হয়। “তোয় গ্রা” বা নদী-সংগম স্থানে এই জনগোষ্ঠীর কোন কালে বসবাস অসম্ভব না হলেও এই বসবাসের স্মৃতি এমন কি কৃতিত্ব বা বিশেষত্বের দাবীদার যে তদানুসারে তাদের নাম পর্যন্ত গড়ে উঠবে ? সুতরাং এই ধারণাও কেবল কষ্ট কল্পনাতেই গ্রহণ করা যেতে পারে ।

 

“ত্রিপুরা” জনগোষ্ঠীর মধ্যে অবশ্যই তিব্বতী জনেরা মিশে গেছে । এর প্রমাণ-তাদের ভাষায় এখনো কিছু তিব্বতী শব্দ সরাসরি বা বিকৃতভাবে খুঁজে পাওয়া যায় । এ ঘটনা দু’ভাবে সম্ভব । (১) ডঃ নীহার রঞ্জন রায় বলেন- সপ্তম শতকের মাঝামাঝি থেকে নবম শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত কামরূপ বাংলা বিহার এবং নেপাল-কাশ্মীর বার বার তিব্বতী পরাক্রমের সম্মুখীন হয়েছিলো এবং কামরুপের ভাস্কর বর্মার রাজবংশ যে মোহ রাজ কর্তৃক বিনষ্ট হয়েছিলো, তিনি তিব্বত রাজ স্রং-ৎসন গাম-গো হওয়া বিচিত্র নয় (গামপো-৬০০-৬৫০) খৃঃ) এর কামরূপের শালভক্ত রাজারা ও তদবংশীয়েরা যে ভোট-বর্মি ছিলেন, এতে সন্দেহ নেই। তাঁর ধারণা বংগ-তিব্বত ইতিহাসের বিরোধ-মিলন পর্ব অস্পষ্ট হলেও মাৎস্যন্যায় পর্বের একশত বৎসর ধরে যে রাষ্ট্রীয় দুর্যোগ বাংলার আকাশ সমাচ্ছন্ন করেছিলো তার খানিকটা ঝড় যে তিব্বত থেকে বয়ে এসেছিলো এতে সন্দেহ নেই । সুতরাং সেই ক্ষেত্রে কামরূপ-আসাম-ত্রিপুরা ভোট- বর্মি শক্তির করতলগত হওয়া অসম্ভব নয়; এই সূত্রে এ কথাও আমি উল্লেখ করবো যে, কামরূপ কামবোজা প্রভৃতি নামের মূলে “কাম” শব্দের অস্তিত্ব তিব্বতীদের “কাম্পা” বা “গাম্‌পা” আখ্যার স্মারক কিনা বিবেচনার দাবি রাখে এবং এ দেশীয় ইতিহাসে তিব্বতী সৈন্য বা ব্যক্তিরা বহু ক্ষেত্রে ‘কামরূপ’ ও ‘কামবোজা’ নামের উৎপত্তি যথাক্রমে ‘কাম-রৌক” এবং “কাম্পা-ছা” শব্দ থেকে হওয়া সম্ভব (‘রৌক=দল; ছা-সন্তান) । 

 

অপর দিকে দেখা যায়—উল্লেখিত “কামবোজা” রাজ্য “কামতা” নামেও বহুক্ষেত্রে বর্ণিত হয়েছে। আশ্চর্য্যের বিষয় এই-কুমিল্লা অঞ্চলেও অনুরূপ একটি “কামতা” নামধারী রাজ্য ছিলো এবং এর প্রমাণ এখনো ঘোষণা করছে-কুমিল্লার অন্তর্গত “বড় কামতা” / “ছোট কামতা” প্রষ্যতি স্থান। এতে এই তথ্যই প্রকাশ করে- আসাম-ত্রিপুরা-কুমিল্লা- স্থান একদা ‘কাম্পা’ বা কামজনদের করারত্ব ছিলো । বস্তুত পক্ষে, খুঁজে দেখলে তার পাশাপাশি এলাকাগুলিতেও সরাসরি না হলেও পরিবর্তিত আকারে ‘কাম’ বা ‘কাম্পা’ নামের ভুরি ভুরি নিদর্শন মিলে । কুমিল্লার ‘কুম’, চট্টগ্রামের অন্তর্গত ‘কুমিরা’র ‘কুম’, ‘গুমতী’ নদীর ‘গুম’ (‘কুম’ থেকে ‘গুম’ হওয়া সম্ভব । ‘ক’ বর্ণ ‘গ’ বর্ণে রূপান্তর ঘটে । কুম-তোয় = কুম-তি—এমতি), ‘কর্ণফুলী’ নদীর স্থানীয় নাম ‘কানাচি’র (চট্টগ্রামীদের কাছে ‘কাইনচা’) ‘কান’ “কাম” থেকে “কান”, “ম”

বর্ণ “ন” বর্ণে রূপান্তরিত হয় । সাম (জাতি) = সান (বর্মি উচ্চারণ) । কাম-তোয় = কামতি=কানচি “ত” বর্ণ ও “চ” বর্ণেও পরস্পর স্থান বিনিময় হয়। ডঃ লীচের অভিমত— “কামতি = কানতি=কানচি” এই তিন শব্দই এক ও অভিন্ন রূপে এদেশে

উচ্চারিত হয়)। এছাড়াও চাকমাদের মধ্যে এক ‘গঝা’ বা ক্ল্যানের নাম- “কান্তি” এবং ত্রিপুরারা লুসাইদিগকে বলে- “সিকাম” ও পাংখুইদের কাছে চাকমারা হলো- “তাকাম’ বা “তিকাম”। অর্থাৎ এদের মধ্যেও তিব্বতী বা কাম্পা জনেরা মিশে

রয়েছে। (২) ব্রহ্ম দেশের বিস্তীর্ণ এলাকাই হলো প্রধানতঃ চীন, তিব্বতী ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে আগত বিভিন্ন মংগোলীয় জনগোষ্ঠীর প্রাচীন মিলন – কেন্দ্র । ডাঃ ওঢাডেল বলেন- তাঁর বর্মি ভাষা জানা থাকাতে তিব্বতী ভাষা আয়ত্ব করা জলবৎ তরলং হয়ে যায়, এর কারণ বর্মি ভাষার সাথে তিব্বতী ভাষার ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র রয়েছে। অপরদিকে, ভাষাতত্ত্ববিদ ডঃ ভেনসী বার্নো বলেন-ত্রিপুরা ভাষা ও বর্মি ভাষাও বহু ক্ষেত্রে পরস্পর কাছাকাছি । সুতরাং ত্রিপুরাদের মধ্যে তিব্বতীজনের মিশ্রণ ব্রহ্মদেশীয় সূত্র ধরেও সম্ভব এবং তাদের ভাষায় তিব্বতী শব্দের অনুপ্রবেশ সেখানেও ঘটতে পারে । 

 

এসূত্রে উল্লেখ্য যে, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বহু “দফা” বা ক্লানের নাম গড়ে উঠার মূলে বর্মি-আরাকানী শব্দ বিদ্যমান । এতে তাদের সম্পর্ক ব্রহ্মদেশের সংগেই অধিকতর ঘনিষ্ঠ বলে ধরে নেয়া যায়। উপরোক্ত তথ্যাদি থেকে এ কথা পরিষ্কার যে, তিব্বতীজনেরা প্রধানতঃ “কম্পা” বা “কাম” নামেই এদেশে প্রখ্যাত ছিলো- “তিপেত রাও” নামে নয় । “ত্রিপুরা” নামের মূলে “তিপেত-রাও” আখ্যার ভিত্তি একেবারেই বাতিল করা চলে । এছাড়াও বাংলা- ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলসহ ব্রহ্ম-আরাকানের যতোগুলি মংগোলীয় জনগোষ্ঠীর নাম বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া যায়, এতে কোথাও- ‘তিপেত-রাও’ ধরণের আখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না।

 

 সুতরাং যোগসূত্রহীন এই আখ্যার অস্তিত্ব কোনকালে ছিলো কিনা তাতেও প্রচুর সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। অপরদিকে আমরা জানি- ‘ত্রিপুরা’ জনেরা ‘বরো’ বা ‘বরোক’ জনশক্তির অন্তর্ভূক্ত । তারা নিজ ভাষাকে ‘কো-বরো’ বা ‘কোক-বরোক’ (কো বা কোক= ভাষা) নামে

অভিহিত করে। “বরো” বা “বরোক” জনশক্তি এই উপমহাদেশে উল্লেখযোগ্য । তার শাখা-প্রশাখাও

অনেক । ত্রিপুরা, কাছারি, দিমাছা, কোচ, মেচ, রাভা, রাজবংশী, গারো, হাজং প্রভৃতি জনগোষ্ঠীরা “বরো” বা “বরোক” বলে কথিত। 

 

এছাড়া অনেকেই লালুং, চুতিয়া, মোরাণ, সোনোয়াল ও আরো বহু জনগোষ্ঠীকে “বরো” বা “বরোক” জন মনে করেন । আমার ধারণা— এই পার্বত্য চট্টগ্রামেও “ম্রো” জনগোষ্ঠী মূলতঃ “বরো” জন এবং অগণিত ‘বরো’ জন এখানকার বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে মিশে একাকার হয়ে

গেছে । ‘বরো’ নামের উৎপত্তি সম্পর্কেও বহু অভিমত বিদ্যমানঃ (১) মধ্য তিব্বতের নাম-

‘পোদ’ বা ‘পৈাদো’; এ স্থান থেকে আগত বলে তারা ‘পোদো’ বা বোদো’ । ‘প’ বৰ্ণ ‘ব’ বর্ণ হয় এবং ‘দ’ বর্ণ আবার ‘র’ বর্ণ হয় (যেমন-পালংক (বাংলা) – বালং (পালি) পুরী (বাংলা) = বুরী (থাইল্যাণ্ড) পিলাক (অসমীয়া) = বিলাক (অসমীয়া) = অর্থ- সকল । আবার, বৃদ্ধ = বুড্ডা = বুড়া, অর্দ্ধ= আধা-আড়া বা আরা, গর্ত=গাতা=গাঁরা ইত্যাদি)। এতে ‘পোদো’ = বোদো = বোরো বা বরো-রূপ ধারণ করেছে (২) তারা একদা ‘বৌদ্ধ’ ধর্মাবলম্বী ছিলো; এই ‘বৌদ্ধ’ আখ্যাই বৌদ্ধ = বোদ্দ = বোদো বা বোরো অথবা বরো হয়ে গেছে (৩) তারা নিজেকে বৃহৎ বা ‘বড়’ মনে করতো । এই ‘বড়’ শব্দ ই ‘বরো’ হয়েছে (৪) ‘বরো’ শব্দের মূল ‘বদ্র’ শব্দ, যার অর্থ— ‘পাহাড়’ (বদ্র = অদ্র; বদ্রিনাথ = অদ্রিনাথ)। এই ‘বদ’ শব্দই ‘বদরো’ হয়ে ‘দ’ লুপ্তির মাধ্যমে ‘বরো’ রূপ নিয়েছে যেমন— ‘বদরী’ ফল = ‘বরী’ বা ‘বরোই ফল অর্থাৎ- . কুল)। (৫) তারা ‘বরাক’ নদীর তীরে বাস করতো; এতেই তাদের নাম ‘বরোক’। 

 

উপরোক্ত যে কোন সূত্র ধরে তাদের নাম ‘বরো’ বা ‘বরোক’ হতে পারে না এমন কথা নয় । তবে সম্ভাবনা বিচারে এগুলির স্থান বহু পশ্চাতে বলেই আমার ধারণা । কারণ এদের চেয়ে অধিকতর সম্ভাবনাপূর্ণ সূত্র অবশ্যই রয়েছে ।

 

ডঃ লীচ বলেন— চৈনিক সূত্রে জানা যায়, আসামের নিকটবর্তী উচ্চ ব্রহ্মের ‘কচিন’

(হকাকু= কোকু= কোকিন = কচিন; হকাকু = (নদীর উর্দ্ধাঞ্চল) এলাকায় ৩৫০ থেকে ১০০০ খৃঃ অব্দের মধ্যে ‘বুয়োক্’ নামে এক দুর্ধর্ষ পাহাড়ী জনশক্তি বাস করতো । এই কচিন এলাকার লোক এখনো চৈনিক জনদের কাছে ‘পু’ নামে পরিচিত এবং এই ‘পু’ নাম লিখিত হয় ‘বুয়োক’ নামের ধরণেই। এছাড়া, এই এলাকাবাসী ‘জিংপো’ জনেরা পোক’ নামেও অভিহিত এবং ‘জিংপো’ নাম চিং-পোক’ রূপেও লিখা চলে। 

 

সুতরাং এতে বুঝতে কষ্ট হয় না-বুয়োক-পুয়োক-পোক পু একই নামেরই বিভিন্ন রূপ । ৮ম শতকে কচিন এলাকা ‘নানচাও’ রাজ্যের প্রভাবাধীন হয় । আবার, ব্রহ্ম এবং চৈনিক সূত্রে জানা যায়- প্রাচীনকালে ব্রহ্ম দেশে তিনটি প্রধান

জনশক্তি বাস করতো- পিউ, সাক ও কানরাণ । চৈনিক সূত্রে ‘পিউ’ নাম ‘পিয়াও’ বলে উল্লেখিত । ‘পিউ’ দের একটি রাজ্য ছিলো । এই রাজ্যও ৮ ‘নানচাও’ রাজ্য দখল করে নেয় । এই ‘নানচাও’ অধিকৃত রাজ্যেই একাদশ শতকের দিকে ‘পেগান’ রাজ্যের রূপ নেয় বলে ডঃ লীচ উল্লেখ করেছেন (পিউ + বান = পেবান = পেগান ? ‘ব’ বৰ্ণ ‘গ’ বর্ণে রূপান্তরিত হতে পারে; যেমন-চামপা (ফুল) = চাংগা / চাইংগা আরাকানি)। বান=সেচবতঃ = এলাকা/দেশ), যেমন- মাতাবান, তাইবান তাইওয়ান । পিউ/পেগান ‘বৌদ্ধ’ ছিলো। ‘পিউ’দের কিছু পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন ব্রহ্মের ‘গ্রোম (বর্মি / অঞ্চল থেকে নাকি পাওয়া গেছে । এতে দেখা যায়- তাদের ভাষা বর্মি ধরণের হলেও তাদের সংস্কৃতি অপেক্ষাকৃত উন্নত ধরণের ছিলো এবং এতে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাব বিদ্যমান৷ 

 

বুঝতে কষ্ট হয় না- “পিউ”/“পিয়াও” নামেরই পরিবর্তিত রূপ হলো- পু = পোক =  = পুয়োক = বুয়োক । তারা সম্ভবতঃ ব্রহ্মের বিভিন্ন স্থানে বাস করতো এবং তাদের কেউ ছিলো অপেক্ষাকৃত উন্নত সংস্কৃতির অধিকারী (যেমন-প্রোম এলাকাবাসীরা) আর কেউ ছিলো অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর (যেমন-কচিন এলাকাবাসীরা) । কিন্তু উভয় ধরণের লোকেরাই অনগ্রসর (যেমন-কচিন এলাকাবাসীরা)। কিন্তু উভয় ধরণের লোকেরাই ৮ম/৯ম শতকে “নানচাও” রাজ্যের প্রভাবাধীন “সান” বা “সাম” জনশক্তির সাথে মিশে গিয়ে মিশ্র রূপ লাভ করে (থাইল্যাণ্ড-এর প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ডঃ রাজাধন বলেন- “নানচাও” প্রকৃতপক্ষে “সানচাও”। এই রাজ্য “সান” বা “সাম”- সংস্কৃতিধারী ছিলো।) অপরদিকে, ইতিপূর্বেই “পিউ” জনদের সাথে তিব্বতী জনের মিশ্রণ ঘটা স্বাভাবিক । কারণ-অনেকেই বলেন-কয়েক হাজার বৎসর পূর্ব-কাল থেকেই ব্রহ্ম এবং অন্যান্য স্থানে তিব্বতী-জনেরা ছড়িয়ে পড়তে থাকে৷ 

 

হিমালয় প্রদেশের বর্তমান “ভূটান” রাজ্যের নামের সাথে “পু”/“বু” নাম জড়িত আছে কিনা গবেষণা সাপেক্ষ। অপরদিকে, পূর্বোক্ত “কামরাণ” জন-গোষ্ঠীর নাম “কামরাং” (“কাম”- “কাম্পা’ শব্দ-জাত এবং “রাং”- “রৌক” শব্দ জাত) বা “তিব্বতী জল” অর্থে-সৃষ্ট হওয়া সম্ভব । এই “কামরাং” বা “কানরাণ” নামই সম্ভবতঃ এখন “কেরেন” বা “কারেন” ।

 

আমরা জানি-পার্বত্য এলাকাবাসী প্রায় সকল মংগোলীয় জনগোষ্ঠীই পার্বত্যকৃষির অনুসারী। এই পার্বত্য কৃষি-যা ইংরাজীতে “সিফটিং-কালটিভেশান” এবং এ স্থানে ও আসামে “জুম” নামে অধিক পরিচিত, এক অতি প্রাচীন কৃষি পদ্ধতি । বিজ্ঞানীদের  ধারণা-এই কৃষির বিকাশ ঘটতে থাকে আনুমানিক খৃষ্ট জন্মের ১৩,০০০ থেকে ৩,০০০ বৎসর জুড়ে-পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে । এই কৃষি জীবিকা মানবজাতির ফলমূল আহরণ সহ পশুপাখী শিকারজীবি জীবনযাত্রা এবং স্থিতিশীল কৃষি ভিত্তিক জীবন যাত্রার মধ্যবর্তী একটি পর্যায়রূপে বিবেচনা করা হয় । এ কৃষির একটি প্রধান দোষ একস্থানে বার বার ভাল ফসল ফলানো যায় না। পাহাড়ী জমি সহসাই অনুর্বর হয়ে পড়ে । এই কারণে দেখা যায়-এই কৃষিজীবিরা প্রায় একস্থান থেকে অন্য স্থানে সরে গিয়ে নতুন নতুন জমিতে ফসল ফলায় ; এতে তাদের জীবন যাত্রাও হয়ে উঠে যাযাবরের সামিল। সম্ভবতঃ প্রধানতঃ এই কারণেই, (অবশ্য এর সাথে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক খরাজনিত দুর্দ্দিন, বিজয়ী জনগোষ্ঠীর কাছে দাসত্ব, ভয় এবং আক্রমণাত্মক অভিযান ইত্যাদি কারণও থাকা স্বাভাবিক) -তিব্বত-চীন – ব্ৰহ্মদেশ এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য বহু এলাকা থেকে বিভিন্ন যুগে ও বিভিন্ন পার্বত্য পথ ধরে অগণিত মংগোলীয় দল/উপদল এই উপমহাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে সম্প্রসারিত হতে থাকে । নিঃসন্দেহে বলা চলে – এদের মধ্যে ব্রহ্মদেশ থেকে বহু পু=পোক =পুয়োক=বুয়োক দল/উপদলও পাড়ি জমিয়ে থাকবে । এদের সকল দল / উপদলকে শত শত বা হাজার হাজার বৎসর পরে এখন সঠিকভাবে চিহ্নিত করা অবশ্যই দুষ্কর। কারণ এই দীর্ঘকালের বুকে বিভিন্ন স্থান থেকে আগত এবং স্থানীয় অগণিত জনগোষ্ঠীর সাথে বিরোধমিলন হেতু তাদের কতো ভাঙ্গাগড়া ঘটে গেছে এবং এতে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি কতোবার পাল্টে গেছে, তার ইয়ত্বা নেই । তবু এদের পূর্ব পরিচিতির ধ্বংসাবশেষ খুঁজে দেখলে এই উপমহাদেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে এখনো পাওয়া যায় বৈকি । 

 

আসাম-মিজোরাম – পার্বত্য ত্রিপুরা পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রভৃতি বিস্তীর্ণ অঞ্চলে – পয়, পই, পুইয়া, পইতেই, পুকান, পুমা পুমা প্রভৃতি জনগোষ্ঠী / ক্ল্যান / উপাধি উল্লেখিত “পিউ”/ “পু” নামেরই বিভিন্ন রূপ । এ ছাড়াও আমার ধারণা = সম্ভবতঃ এ দেশে যারা “বরো” = বরোক = “বরোক” নামে পরিচিত, তাদের ব্রহ্ম দেশীয় ‘বুরোক’ বলে উল্লেখিত। এর কারণ – শব্দ মধ্যস্থিত “র” বর্ণ ব্রহ্মদেশে “য়” রূপ ধারণ করে” এতে “বার্মা বা “বারমা” নাম তাদের উচ্চারণে – “বায়মা” এবং “আপ্রমা” নামের উচ্চারণ – “আপিওমা” । পূর্বেই বলেছি – বুয়োক বা ‘বুরোক’ নামের মূল – “পু” বা “পিউ” শব্দ পুয়োক=বুয়োক, পুরোক= বুরোক। রৌক=দল (তিব্বতী)। সুতরাং “পুরৌক” বা “বুরৌক” মানে – “পু- দল” বা “পিউ দল”। “রৌক’ শব্দের পরিবর্তিত রূপ- রো, রু, রা, রুং, রাং ইত্যাদি। “ম্রো” বা “ম – রো” । (পাঃ চঃ), ম-রু (উঃ অঃ), মৈ- রা (আসাম), মৈ- রাং (মনীপুর), মু-রুং (পাঃ চঃ) প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর নামের সাথে  এই পরিবর্তিত রূপগুলি দেখা যায়। ম, মৈ, মু ইত্যাদি শব্দ ‘ মানুষ” বাচক। এখানকার “ত্রিপুরা” জনেরা “বরো”= “বরোক’ = “বুরোক” বলে স্বীকৃত। উচ্চ ব্রহ্মের উল্লেখিত “বুয়োক” = পুয়োক= পোক= পুঃ জনদের সাথে তারা যে একদা সংযুক্ত ছিলো, শত শত বা হাজার বৎসরের বিবিধ পরিবর্তনের পরেও তার কিছু কিছু প্রমাণ সম্ভবতঃ এখনো খুঁজে পাওয়া যায় । যেমন – ধান-মাই (ত্রিপুরা) / মাহ্ (কচিন – উঃ ত্রঃ) দেবতা-মাতাই (ত্রিঃ)/মাদাই (কচিন-উঃত্রঃ) স্বর = নু/নুক (ত্রিঃ)/ তিংনু দল নেতার স্বর-কচিন, উঃ ত্রঃ), অভীব = করই (ত্রিঃ)/ করই (কচিন – উঃ এঃ) ইত্যাদি৷  

 

ত্রিপুরাদের একটি বিশিষ্ট নাচের নাম- ‘গরইয়া’ । এই নাচ তারা নাচে চৈত্র বৈশাখে, ‘বিষুব সংক্রান্তিকে বুকে করে । তারা বলে – মহাদেব পত্নী ‘গৌরী’র উদ্দেশ্যেই এই নাচ; তাই এর নাম ‘’গহরা বা গরইয়া’৷ 

 

আমরা জানি, চৈত্রের খরা দিনগুলির পর মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বৈশাখের দিকে বৃষ্টিপাত হয় । পার্বত্য কৃষিজীবিরা এই সময়ে নিজ নিজ “জুম” বীজ বপনের জন্য তৈরী করে পর্য্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের আশায় দিন গুণে । বলার অপেক্ষা রাখে না – পার্বত্য কৃষি সব সময় বৃষ্টিপাতের উপর নির্ভরশীল, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, অপর্যাপ্ত বা বিলম্বে বৃষ্টি -কোনটাই এর জন্য ভাল নয়৷  

 

আমরা ধারণা – ত্রিপুরাদের এই “গরাইয়া” নাচ মূলতঃ প্রাচীনকালে পার্বত্য-কৃষির উৎকর্ষে সময়মতো বা পরিমিত বৃষ্টিপাতের প্রার্থনাতেই আকাশ দেবতার উদ্দেশ্যে প্রচলিত হয়েছিলো। এমনি বৃষ্টি আহ্বানের নাচ এই উপমহাদেশে এবং পৃথিবীর বহুস্থানে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে এখনো দেখা যায়। “গরইয়া” নাচ খোলা জায়গাতেই হয়ে থাকে এবং এর নাচে অংশ গ্রহণকারীরা গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে নেচে বেড়ায়, যার ধরণ বহুলাংশেই “বৃষ্টি” আহ্বানমূলক ধরে নেয়া যায়। কিন্তু ত্রিপুরারা এখন হিন্দু ধর্মাবলম্বী বিধায় তাদের এই নাচ মহাদেব পত্নী “গৌরীর” নামের সাথে জড়িত হয়ে গেছে। উচ্চ ব্রহ্মের কচিনদের আকাশ দেবতার নাম – “করই-ওয়া” (ওয়া-দেবতা) ।  এই দেবতা শক্তিশালী বলে বিবেচিত । কারণ – এর কোপদৃষ্টি মানেই – “অভাবের দেবতা”। সুতরাং আমার ধারণা – “করই ওয়া” নামই উচ্চারণের হেরফেরে এখানে ‘গরইয়া’ রূপ ধারণ করেছে।

 

‘বরো’ = “বরোক” = “বুরোক” নামের সম্ভাব্য ভিত্তি এবং বুৎপত্তিগত অর্থসহ ব্রহ্ম দেশের “পিউ’ = “পু” = পোক = পুয়োক=বুয়োক লোকের সাথে এখানকার ত্রিপুরাদের সম্পর্ক ভাষা ও সংস্কৃতি ভিত্তিক – কিছু নিদর্শন যেহেতু এখনো বিদ্যমান, সেহেতু তাদের “ত্রিপুরা” নামের মূলেও ‘পিউ”/“পু” নামের কোন প্রভাব আছে কিনা তলিয়ে দেখা দরকার । 

 

“পিউ” নাম জাত “পু” শব্দের সাথে তিব্বতী ত্রিপুরা “রৌক” শব্দের পরিবর্তিত রূপ “রা” বা “রো” যোগে “পু-রা” বা ‘পু-রো” শব্দ পাওয়া যায়, যার অর্থ হলো – “পিউ” দল বা “পু – দল” । এর সাথে পূর্ব – সংযুক্তি “তি” বসলেই “তি-পুরা” বা “তি পু-রো” নাম পাওয়া যায়। কিন্তু এই “তি” শব্দের অর্থ কি হতে পারে ? আমার মতে – এর প্রধান সম্ভাবনা নিম্নরূপঃ 

 

(১) “তোয়” বা “তুই” শব্দ থেকে “তি” আসতে পারে। “তোয়” বা “তুই” ত্রিপুরা ও মিজো ভাষায় – “জল” এবং “নদী” । মিজোরা চাকমাদিগকে “তুই – ছেক” এবং ত্রিপুরাদিগকে (বিশেষতঃ তাদের এবং দফা বা ক্ল্যান – “রিয়াং” দিগকে) “তুই-কুক” নামে অভিহিত করে। এই দুটি আখ্যায় অর্থ-যথাক্রমে “জলতীরবাসী “সাক”/ “কুকি”। এর কারণ- ‘মিজো” রা / “মি”=মানুষ” জো=পাহাড়, মিজো=পাহাড়ী মানুষ) প্রধানতঃ “পার্বত্যবাসী” এবং – চাকমা ও ত্রিপুরারা অপেক্ষাকৃতভাবে “জলতীরবাসী”। পার্বত্যবাসী/জলতীরবাসী এবং “উদ্বাঞ্চলবাসী/নিম্নাঞ্চলবাসী আখ্যাগুলি মূলতঃ এবং এবং অভিন্ন অর্থে কোন জনগোষ্ঠীর অবস্থান বিবেচনায় প্রয়োগ হতে দেখা যায় । একারণেই “মিজো = পর্বতবাসী, “রি-হাম”=জলতীরবাসী=(রি=জল) “টং-থা (ছা)”=

পর্বতের সন্তান, থ্যাং=থা=নদী সন্তান “হাকু”=উদ্বাঞ্চলবাসী এবং “হা-নাম” =নিম্নাঞ্চলবাসী – ইত্যাদি আখ্যার সৃষ্টি

হয়েছে।

 

“তুই-কুক”/“তুই-ছেক” ইত্যাদি আখ্যার মতো “তি” বা “তা” যোগে আর একটি আখ্যার সন্ধান পাওয়া যায়, যা পাংখু / বনযোই/মিজোরা চাকমাদের প্রতি প্রয়োগ করে থাকে । এটি হলো-“তি-কাম” বা “তা-কাম”। এই “তি” বা “তা” শব্দের মূল “তোয়” বা “তুই” শব্দ যার অর্থ-জল। “কাম” শব্দ “কাম্পা” শব্দজাত – যার অর্থ পূর্বেই বলেছি- তিব্বতীজন। যাই হোক তুই-কুক” (কুক=কুকি; হাকু=কোকু : কোকি=কুকি, অর্থ -উদ্বঞ্চলবাসী)/“তুই ছেক” / “তি-কাম” বা “তা-কাম” বা “তা- কাম” বা “তা-কাম” ইত্যাদি আখ্যার বিদ্যমানে “তিপুরা” নামের সাথেও অনুরূপ পূর্ব সংযুক্তি “তি” (জল) জড়িত থাকা মোটেই অসম্ভব নয় । যদি তাই হয়ে থাকে, তবে “তিপুরা” নামের অর্থ হয় – “জলতীরবাসী পু-দল” (২) “তাই” শব্দ থেকে “তি” আসতে পারে। পূর্বেই উল্লেখ করেছি – “পিউ” বা “পু” জনেরা “নানচাও” – এর প্রভাবাধীন হয়ে পড়াতে “সান” বা “সাম” লোকদের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে উঠে । “সান” বা সাম” জনেরা – “তাই বলেও পরিচিত এবং তাদের ভাষায় নাম – “তাই” উচ্চ ব্রহ্মের “সা” জনেরা – “তাই -ইয়াই” এবং থাইল্যাণ্ড বা সাম দেশের “সাম” জনেরা – “তাই – নোই”। ব্রহ্মদেশের “পিউ” বা “পু” জনেরা যদি এখানে এসে  থাকে, তবে নিঃসন্দেহে “সান” বা “তাই” জনেরাও এখানে এসেছিলো। ইতিহাস বলে –ত্রয়োদশ শতকের প্রথম থেকে মধ্য ভাগে ‘সান’ বা ‘সাম’ জনেরা বর্তমান আসাম এলাকা দখল করে নিয়েছিলো এবং তাদের নাম থেকেই ‘আসাম’ নামটি গড়ে উঠে ( হা – সাম = আসাম; হা = দেশ (বরো শব্দ)। আমার ধারণা -এই বিজয় অনুপ্রবেশ করেছিলো বিশেষতঃ পার্বত্য কৃষির খাতিরে, এবং এখানে তাদের অভিযান সংঘটিত হওয়ার বহু আগেই ‘সান’/সাম’/‘তাই’ জনেরা এই উপমহাদেশে  অনুপপ্রবেশ করেছিলো  – বিশেষতঃ পার্বত্য কৃষির খাতিরে এবং এখানে তাদের আভ্যন্তরীণ সহযোগিতা ছিলো বলেই হয়তো ‘আসাম’ অঞ্চল অধিকার করতে বেগ

পেতে হয়নি । সুতরাং মিশ্র ‘তাই’ ও ‘পু’ দল অর্থে – ‘তাই – পু – রা’ নামের সৃষ্টি হতে পারে এবং এই শব্দ থেকে ‘তিপুরা’ নামের উৎপত্তি ঘটতে পারে । মিজোদের অন্তগর্ত ‘পইতেই’ ক্ল্যানের নাম এই ক্ষেত্রে পথ নির্দেশক কিনা কে বলবে। তাই যদি হয়ে থাকে তবে এখানে ‘তাই’ শব্দের পরিবর্তিত রূপ ‘তেই’ শব্দ অন্ত্যসংযুক্তি বলতে হবে । অনুরূপভাবে একই শব্দ পূর্ব ও অন্ত্য – সংযুক্তি হয়ে থাকে, যেমন – মিজো । (মি=মানুষ, জো=পাহাড়)! খুই -মি; (খুই = কুকুর, মি (৩) 

 

সরাসরি ‘তি’ যোগে/তি’ চৈনিক শব্দ অর্থ-দেবতা, চৈনিক ‘(তা-তি’ এবং থাই ‘চাও- তি’ এবং থাই ‘চাও- তি’ – ‘বাস্তু দেবতা’ / অনেকের ধারণা – ‘থিবস্ – থিস্- থি-তি’ রূপেই এর উদ্ভব । ‘থিবস’ শব্দের অর্থ মূলতঃ ‘স্বর্গ’ হলেও চৈনিকদের কাছে নাকি নিজ মাতৃভূমি-‘চীন দেশ/সম্ভবতঃ তিব্বত’ নামের সাথেও এই ‘তি’শব্দ জড়িত দেবতারা উর্দ্ধলোকে অবস্থান করেন বলেই সকলের ধারণা/ এ কারণে দেবাদিদেব ‘শিব’ বা ‘মহাদেব’ এর অধিস্থান ‘কৈলাস’ বা হিমালয়েই কল্পনা করা হয় । যাই হোক ‘তিব্বত’-এর নামের সাথে যদি তি – ‘দেবতা অর্থে জড়িত ধরা হয়, তবে তিব্বত নামের অর্থ হয় – ‘দেরস্থান’ (’বত – বা ‘বাত’ – বাস্তু শব্দ – জাত, বাস্তু – বস্তু – বত- বা বাত)’ সেই সূত্রে তি-পুরা নামের অর্থও হয় ‘দেবস্থানের /স্বর্গ স্থানের অর্থাৎ তিব্বতের / চীনের পু-দল’ / এ ক্ষেত্রে অবশ্য গবেষণা সাপেক্ষ-তিব্বত/ চীনে ‘পুত নামের জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব ছিলো কিনা এবং তারা সেখান থেকে ব্রহ্মদেশে এসেছিলো কি না/ ‘তাই’/সান’/‘সীম’ জনেরা মূলতঃত চৈনিক/চীনের সানচি/’ সান হি’ প্রভৃতি স্থান থেকেই তারা ব্রহ্মে প্রবেশ করে ।

 

উল্লেখিত তিনটি সূত্রে থেকে আমি প্রথম সূত্রই ‘তি-পুরা’ নামের অধিক সম্ভবনাময় মনে করি । খুব সম্ভব ‘জলতীরবাসী পু-দল’ অর্থেই-তি-পুরা’ নামের উদ্ভব ঘটেছিলো / পরবর্তীভাবে তা ‘ত্রিপুরা’ রূপে গৃহীত হয়ে যায়/ এর মূলে মনে হয় – তিনটি ‘পুর’ নিয়ে ‘ত্রিপুর’ এই ভ্রান্ত ধারণা হিন্দু পণ্ডিতদের কারসাজিতে বিশেষ কাজ করেছে।

এ কারণে অন্যান্য স্থানের ত্রিপুরাজনেরা কেউ কেউ ‘ত্রিপুরা’ আখ্যাও ব্যবহার করে থাকেন৷ 

 

৷৷ দুই ৷৷

(উপমহাদেশীয় সুত্রে “ত্রিপুরা” নামের আত্মীকরণ বা সংস্কৃতায়ন – “ক্ষত্রিয়’ রূপে স্বীকৃতি) 

 

পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে আলোচ্য ‘তিপুরা/ত্রিপুরা/” জনগোষ্ঠী এই উপমহাদেশের বৃহত্তর ‘বোদো/বোরো/বোরাক/বুরোক’ জনশক্তির একটি অংশ বিশেষ এবং উচ্চ ব্রহ্মে ‘বুয়োক’ (বুরোক/বুয়োক) নামে এই জনশক্তির কথা ৩৫০-১০০০ খৃষ্টাব্দের মধ্যে বিভিন্ন চৈনিক বর্ণনায় উল্লেখিত ।

 

সুতরাং যে জনশক্তির অস্তিত্ব উচ্চব্রহ্মে আজ থেকে প্রায় ১৬৩০ বৎসর ছিলো, সেখানে তার অভ্যুদয় নিঃসন্দেহেই আরো সুদূর অতীতের বুকে । কারণ কোন জনশক্তি এবং তার নাম হঠাৎ করে গজিয়ে উঠেনা; তার উৎপত্তিতে সুদীর্ঘকালের দৃঢ় ভিত্তি ও পটভূমি থাকে । এতে অনায়াসেই ধরে নেয়া যায়- খৃষ্ট জন্মের বহু আগে থেকেই ব্রহ্মদেশের ‘বুরোক/বুয়োক’ জনশক্তির অস্তিত্ব ছিলো এবং সেক্ষেত্রে পূর্বোক্ত কারণাদিতে তার কোন কোন দল/উপদল খৃষ্ট জন্মের পরে তো বটেই তার আগেও- এই উপমহাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে খুব সম্ভবতঃ বিস্তার লাভ করে থাকবে ।

 

অপর দিকে, ‘বুরোক/বুয়োক’ নামের মূলে যেহেতু ‘পিউ/পু” নাম বিদ্যমান এবং এই ‘পিউ/পু’ জনেরা ব্রহ্মদেশের অতি প্রাচীন তিনটি-জনশক্তির একটি বলে ব্রহ্ম-চৈনিক সূত্রে কথিত, ধরে নিতে বাঁধা নেই,  ‘পিউ/পু’ জনশক্তির অভ্যূদয় সেখানে ঘটেছিলো আরো বহু বহু প্রাচীন কালে – হয়তো বা কয়েক হাজার বৎসর আগেই । সে ক্ষেত্রেও, আলোচ্য ‘তিপুরা/ত্রিপুরা’ জনগোষ্ঠীর নামের সাথে যেহেতু – ‘পু/পিউ’ নাম জড়িত রয়েছে এবং অনেকের মতে তারা এই উপমহাদেশে ‘আদি মংগোলীয় ‘(Paleo Mongoloid), সেহেতু গভীরভাবে বিবেচনা করা দরকার – তাদের পূর্ব পুরুষেরা এই উপ-মহাদেশে ‘পিউ/পু’ জনরূপে এসেছিলো, না – ‘বুরোক/বুয়োক’ জনরূপে । উল্লেখ্য যে – এই উপমহাদেশে সাধারণতঃ ‘আদি মংগোলীয়রূপে তাদেরকেই নির্দ্দেশ করা হয়। যারা খৃষ্ট জন্মের আগেই এখানে এসেছে বলে ধরে নেয়া হয়, অবশ্য এই সময়-সীমারেখা স্থানীয় মানসিকতা প্রসূত নয় – বিদেশী লেখক বা নৃবিজ্ঞানীদেরই প্রদত্ত।

 

‘বুরোক/বুয়োক’ জনশক্তির এই উপমহাদেশীয় ও ব্রহ্মদেশীয় যোগসূত্র ও প্রাচীনত্বের কথা আগেই বলা হয়েছে। এ নামের উৎপত্তি সম্পর্কেও আমার ধারণা ব্যক্ত করেছি- পু+রৌক (দল-তিব্বতী শব্দ)/বু-রৌক (প’ বর্ণের উচ্চারণ অনায়াসে ‘ব’ বর্ণের রূপ ধারণ করে) = ‘পু-দল/পিউদল’ । এখানে লক্ষণীয় যে, ‘পু/বু’ নামের সাথে যেহেতু তিব্বতী শব্দ ‘রৌক’ অন্ত্যসংযুক্তি ঘটেছে, সেহেতু -তাতে তিব্বতী ভাষার প্রভাব অবশ্যই সূচিত হচ্ছে, যার মানে -বুরোক /বূয়োক জনগোষ্ঠীকে তিব্বতী জনের সম্পর্ক ঘটেছে অর্থাৎ ‘পিউ/পু ‘এবং তিব্বতী জনের মিশ্রণেই সম্ভবতঃ ‘বুরোক/ বুয়োক ‘জনশক্তির অভ্যুদয়। অবশ্য এক্ষেত্রে বলে রাখা প্রয়োজন – “পিউ/ পু’ জনশক্তি মূলতঃ কোন সূত্র ধরে ব্রহ্মদেশে গড়ে উঠেছিলো, সে তথ্য অনিশ্চিত। কেউ বলেন – তারা ভারতীয় সূত্রে আগত, যেহেতু, ‘প্রোম’ অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত তাদের পুরাতাত্বিক নিদর্শনগুলিতে ভারতীয় সংস্কৃতির ছাপ বিদ্যমান। বিরুদ্ধবাদীরা বলেন- ভাষাগত প্রমাণে তারা অবশ্যই – চৈনিক সূত্র আগত এবং ‘পিউ/পু’ নাম চৈনিক ‘পিয়াও/পিয়াউ ‘নামেরই পরিবর্তিত রূপ মাত্র ।

 

‘ তিপুরা/ত্রিপুরা’ নামের অস্তিত্ব ব্রহ্মদেশে অনুপস্থিত ‘পু’ নামের সাথে ‘রা’ অন্ত্য- সংযুক্তি যোগে ‘পু রা’ নাম পাওয়া যায় – যার অর্থ ‘পু দল’ / তার সাথে পূর্ব সংযুক্তি ‘তি’ যুক্ত করলেই ‘তিপুরা’ নামের উৎপত্তি ঘটে । উক্ত ‘তি’ শব্দ পূর্ব সংযুক্তির ক্ষেত্রে যে ‘তিনটি’ সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছি, তন্মধ্যে ‘তোয়’ বা তৈ’ (‘জল/নদী’ অর্থে) থেকেই তার – উৎপত্তিকে আমি প্রথম প্রাধান্য দিয়েছি। সেক্ষেত্রে ‘তি-পুরাত নামের অর্থ হয় – “জলতীর/নদীতীরবাসী-পু-দল ‘দল’ অথেই ‘বৌ’ বা রৌক শব্দের পরিবর্তিত রূপ এবং সেক্ষেত্রেও তিব্বতী প্রভাব সম্বলিত। অপর দিকে, ‘তোয়’ বা তৈ’ শব্দ ‘জল’ অর্থে আর্য্য ভাষার অন্তগর্ত সংস্কৃত ভাষাতে বিদ্যমান । ‘পুণ্য তোয়া (গংগা’) থাকাতে এই উপমাদেশীয় সূত্র থেকেই – গৃহীত বলে ধরে নেয়া যেতে পারে । এ ক্ষেত্রে আরো লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো- ‘পিউ/পু’ নাম অবশ্যই ‘বুরোক/ বুয়োক নামের ভিত্তি এবং প্রাচীনতর: আলোচ্য তিপুরা/ত্রিপুরা’ জনগোষ্ঠী বর্তমানে বুরোক/ বোরোক/বোরো/বোদো’ জনশক্তির অংশ বলে বিবেচিত হলেও, সরাসরি ‘পু’ নামটি – রক্ষা করছে, যেখানে ‘বুরোক/বুয়োক’ নামের ক্ষেত্রে তা পরিবর্তিত হয়ে গেছে । ‘রৌ’ বা ‘রৌক’ শব্দের সংক্ষিপ্ত/ রূপান্তরিত ব্যবহার রো/রু/রাং/রা ইত্যাদি শব্দ ব্রহ্মদেশীয় এবং এই উপমহাদেশীয় বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপকভাবে বিদ্যমান । সুতরাং ‘পু’ নামের সাথে ‘রা’ অন্ত্য-সংযুক্তি ব্রহ্মদেশে বা এই উপমহাদেশে উভয় স্থানেই সম্ভব । আবার, উল্লেখ্য যে -কেবল তিপুরা/ত্রিপুরা’ নামের সাথেই সরাসরি ‘পু’ শব্দ তাদের মধ্যে রক্ষিত নয় – বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভিক কালে পর্য্যন্ত স্থানীয় ‘তিপুরা/ত্রিপুরা’জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ- ‘দলপতি’ (বৃটিশ শাসকদের নিযুক্ত ‘মৌজার হেডম্যান’) ‘পু -মাং ‘আখ্যাধারী (স্বর্গীয় সতীশ চন্দ্র ঘোষের ‘চাকমা জাতি’ (১৯০৮/ ০৯ খৃঃ) পুস্তকে সন্নিবেশিত ‘হেডম্যানগণের তালিকা দ্রষ্টব্য)। ‘মাং’ বা ‘মং’ শব্দ – বর্মি/আরাকানীতে ‘রান্না/শাসক’ ইত্যাদি। এখনও তাদের মধ্যে ‘পুমাং আখ্যা বলবৎ -যদিও এই আখ্যাধারীরা সকলেই আর এখন ‘শাসক’ বা ‘দলপতি’ নেই । 

 

উল্লেখিত সম্ভাবনায় “তিপুরা/ত্রিপুরা’ জনগোষ্ঠী-ভূক্ত কোন কোন আদি / প্রাচীন জন বা দল-উপদল এই উপমহাদেশে ‘বুরোক/বুয়োক’সূত্রে আগত না হয়ে সরাসরি পিউ/ পু’ রূপেও অনুপ্রবেশ করে থাকতে পারে বৈকি। সেক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি অবশ্যই বিবেচনার দাবী রাখে :

 

উর্দ্ধাঞ্চলবাসী  ‘বুয়োক/বুরোক’ নামে অভিহিত ‘পিউ/পু’ জনেরা জীবনযাত্রার মানে বহুলাংশেই ছিলো অনগ্রসর । তাদের প্রধান জীবিকা ছিলো – ‘টঙ্যা’ বা পার্বত্য কৃষি, প্রকৃতির আশীর্বাদের উপর নির্ভরশীল এবং অন্যদিকে, একস্থানে বসবাসের পরিপন্থি এতে তাদের অর্থনীতি এবং জীবনযাত্রা যথাক্রমে ‘জীবন নির্বাহ’ ভিত্তিক ও বহুলাংশে ‘যাযাবর’ মানসিকতাসম্পন্ন হওয়া স্বাভাবিক প্রধানত: এ কারণে তাদের বিভিন্ন দল উপদলের পক্ষে বিভিন্ন সময়ে ‘টঙ্যা’ বা পার্বত্য কৃষি’র জন্য – এই উপমহাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে সম্প্রসারিত হওয়া সম্ভব । যদিও এর সাথে আনুসংগিক বহু কারণ থাকতে পারে যা ইতি পূর্বেই সংক্ষেপে ইংগিত করা হয়েছে।

 

চৈনিক সূত্রে বলা হয়েছে – তারা ছিলো দুর্ধর্ষ ও আক্রমনাত্মক । এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য – সুদূর চীন দেশ থেকে এই উপমহাদেশে যাতায়াত বা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে একটি পার্বত্য পথ আনু: ১২৮ খৃ: পূ: থেকে উচ্চ ব্রহ্মের মধ্য দিয়ে বিস্তৃত ছিলো এবং সেই পথের বিভিন্নস্থানে যাতায়াতকারীদের উপর তারা হামলা করতো। এ কারনে দেখা যায় – অষ্টম শতাব্দীর দিকে মান / চৈনিক প্রভাবান্বিত নাম চাও / সানচাও’ সরকার এই উচ্চ ব্রহ্মে (কচিন এলাকায়) তার আধিপত্য বিস্তার করে এবং ‘নান চাও / সান চাও নেতা কো – লো – ফেং (৭৫, খৃ:) এ পথের বিভিন্ন স্থানে নিরাপত্তার জন্য সৈন্য বস্তি স্থাপন করেন। ভ:লী চুল-ছেন – মিঃ পেলিওটের গবেষণা থেকে জানা যায়, অনুরূপ উত্তর-শায়ী দুটি রাস্তা পূর্ব থেকে পশ্চিমে মোটামুটি মুক্ল য়ূং চাং, তেওয়ে, সাদন, ওয়েং মউ (মিৎকিনা) মো গং, সোম্রা ট্র্যাক্ট (নাগা পাহাড়), কোহিমা, দিমাপুর ও গৌহাটি স্পর্শ করেছিলো । কোলোফেং অনুরূপ একটি রাস্তা পিউ/পু’ রাজ্য পর্য্যন্ত ও স্থাপন করেন।

 

বুয়োক/বুরোক জনশক্তির উল্লেখিত দুধর্ষতা ও আক্রমণাত্মক ভূমিকা অতি স্বাভাবিক । তারা তখন ছিলো বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলীয় সংগঠনে বিভক্ত এবং তাদের মধ্যে দলে দলে বিরোধ -মিলন পর্ব প্রায় হামেশাই লেগে থাকতো । বৃটিশ অধিকারের পূর্বকাল পৰ্য্যন্ত উচ্চব্রহ্মে ‘দাস প্রথা’ চালু ছিলো । এতে অনুমান করতে বাঁধা নেই, তারা সুযোগ মতো বিরুদ্ধবাদী দলের বা নিজেদের কাছে অসম্পর্কীয় অপরিচিত দুর্বলতর জনশক্তির উপর হামলা বা অভিযান চালাতো, যার মূখ্য উদ্দেশ্য – ‘দাস’ সংগ্রহ ও লুঠ-তরাজের মাধ্যমে ‘বিত্ত’ আহরণ । এ কারণে উল্লেখিত চীন-ভারত বিস্তৃত বাণিজ্য পথে পথচারী ও বণিকদের কাছে তারা সন্ত্রাসী হয়ে উঠেছিল, এ ছাড়াও, দেখা গেছে= উচ্চব্রহ্মর অধিবাসীদের একটি ব্যাপক ঐতিহ্য এই, তারা প্রাচীনকাল থেকে অপর শক্তির ভাড়াটিয়া সৈন্যরূপে – কাজ করতো এবং এই মানসিকতা এমন বিস্তৃত হয়ে পড়েছিলো যে এতে কোন কোন জনগোষ্ঠীতে উত্তরাধিকার প্রথাকে পর্য্যন্ত প্রভাবান্বিত করে তুলেছে যার ‘ফলশ্রুতিতে তাদের মধ্যে কণিষ্ঠ পুত্রই পিতার উত্তরাধিকারী হয়ে উঠে । এর মূলে বাস্তব কারণ ছিলো এই বয়ষ্ক পুত্র সন্তানেরা প্রায়ই যুদ্ধের ডাকে অন্যত্র চলে যেতো, হতাহত হয়ে বা বিজিত/নূতন স্থানে বসতি স্থাপনের দরুণ আর প্রায়ই ফিরতো না । সুতরাং এই মানসিকতা অন্যান্যদের সাথে বুয়োক / বুরোক জনশক্তিতেও যে প্রাচীনকালে বলবৎ ছিলো তা সহজেই অনুমেয়। অন্যদিকে দেখা যায় – নদীর নিম্নাঞ্চল বা অপেক্ষাকৃত সমতলবাসী “পিউ/ পু” জনশক্তি উন্নত চাষাবাদ ও ব্যবসা বাণিজ্য গড়ে তুলেছিলো এবং উল্লেখযোগ্যভাবে জীবনযাত্রার মানে অগ্রগতি লাভ করেছিলো । তারা একটি সার্বভৌম ‘পিউ/পু’ রাজ্য দীর্ঘকাল যাবৎ পরিচালনা করেছিলো যার রূপ ৮৩২ খৃষ্টাব্দের দিকে ‘নান চাও/ মানচাও’ শক্তির আক্রমণে বদলে গিয়েও ১০৫০ খৃষ্টব্দের দিকে শক্তিশালী পেগান/ পেগু’ রাজ্যে পরিণত হয় ।

 

‘বুয়োক/বুরোক’ ও ‘পিউ/পু’ জনের উল্লেখিত অবস্থান যখন আপন জনশক্তির শাখা- প্রশাখা ব্রহ্মদেশের নিকটবর্তী স্থান এই উপ-মহাদেশের অন্তর্গত আসাম প্রভৃতি অঞ্চলে ‘টঙ্যা’ এবং পূর্বে বর্ণিত কারণগুলিতে বিস্তার লাভ করেছিলো, তখন ব্রহ্মদেশ থেকে আপন জনশক্তির টানে বা তাদের উপর প্রভুত্ত করার উদ্দেশ্যে কোন রাজশক্তি বা শাসন-কার্য্যে জড়িত সামর্থ্যবান ব্যক্তি বা দলনেতার পক্ষে এতদ্বঅঞ্চলে আধিপত্য স্থাপনের প্রচেষ্টা গ্রহণ অতি স্বাভাবিক। সেই ক্ষেত্রে কোন কোন ‘বুয়োক/বুরোক’ দলপতি যদি কোন অভিযান করেও থাকে, তবে তার মুখ্য উদ্দেশ্য ‘বিত্ত’ ও ‘দাস’ সংগ্রহমূলক হওয়ারই সম্ভাবনা বেশী; কারণ স্থায়ী আধিপত্য-বিস্তারে রাজ্য পত্তনের মানসিকতা ও সামর্থ্য তাদের কাছে খুব সম্ভবত: ছিলো না – যেহেতু তারা নিজ বাসভূমি উচ্চব্রহ্মেই কোন রাজ্য পত্তনে অক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে, অথনিম্নাঞ্চলবাসী ‘পিউ/পু’ জনশক্তি তা গঠন করেছিলো। সুতরাং অনুরূপ উদ্যোগ গ্রহণ ব্ৰহ্মদেশীয় সূত্রে যে কোন পক্ষ থেকেই ঘটে থাকুক না কেন, তার উদ্যোক্তা নিঃসন্দেহেই ছিলেন রাজশক্তি বা শাসন কার্য্যে সংশ্লিষ্ট ও সামর্থ্যবান ব্যক্তি । যিনি নিজ দলীয় শক্তি ছাড়াও প্রয়োজনে ‘বুয়োক/বুরোক’ ভাড়াটিয়া সৈন্যও সঙ্গে নিয়ে আসা স্বাভাবিক এক্ষেত্রে, এই উপমহাদেশে সম্প্রসারিত ‘বুরোক/বুয়োক’ জনশক্তি যেহেতু মূলতঃ ‘পি/ পু’ জন সেহেতু এই উদ্যোগ ‘পিউ/পু’ পক্ষ থেকে আসাই অধিকতর স্বাভাবিক ও সম্ভাবনাময় । এমনকি, এই উদ্যোগ গ্রহণ এই উপ-মহাদেশে সম্প্রসারণকারী – আপন জনশক্তির আহ্বানের ভিত্তিতেও হতে পারে, যেহেতু -স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে বিরোধ সম্প্রসারণ ক্ষেত্রে অতি স্বাভাবিক এবং সেক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত আপন ও সামর্থ্যবান শক্তির হস্তক্ষেপ, আধিপত্য বা আশ্রয় অবশ্যই আহ্বানীয় । অস্বীকার করার উপায় নেই – ইতিহাস সেক্ষেত্রে অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং সে কারণে অন্ধকারের বুকে কোথাও ক্ষীণতম আলোকবিন্দুর দেখা পাওয়া যায় কিনা অনুমানের ভিত্তিতেই এগিয়ে চলার একটা পথের রেখা বেছে নিতে হবে । এতে ভুলভ্রান্তি বা পদ-ঙ্খলনের সম্ভাবনা প্রচুর; কিন্তু হয়তো বা ঘুরে ফিরে প্রার্থিত আলোকের দিশা পাওয়া যেতে পারে৷ 

 

‘রাজমালা’ পুস্তকের লেখক কৈলাস চন্দ্র সিংহের অভিমত (২য় ভাগ, ১ম অঃ পৃ:-৮ ) ব্রহ্মদেশীয় ‘শ্যান’ (‘সান’ বা ‘সাম’ জাতি) বংশের একটি শাখা কামরূপের (বর্তমান আসাম) পূর্বাংশে একটি স্বতন্ত্র রাজ্যস্থাপন করেন। তার অধিপতিরা ‘ফা’ উপাধি ধারণ করতেন ‘ফা’ বংশীয়গণ পার্বত্য মানবদিগের দ্বারা বিতাড়িত হলে রাজ্যভ্রষ্ট নরপতির জ্যেষ্ঠপুত্র আধুনিক নাগা পর্বতে প্রাচীন বা কৃত্রিম ‘হেড়ম্ব’ রাজ্য (দিমাপুর প্রাচীন রাজধানী) এবং কনিষ্ঠ পুত্র আধুনিক কাছাড় প্রদেশের উত্তরাংশে আর একটি রাজ্য স্থাপন করেন। ইহাই প্রাচীন ‘তৃপুরা’ বা ‘ত্রীপুর’ রাজ্য এবং এই ‘তৃপুরা’ বা ত্রীপুর’ শব্দ থেকেই আধুনিক ‘ত্রিপুরা নামের উৎপত্তি । পরবর্ত্তী ‘রাজমালা’ পুস্তকের লেখক কালী প্রসন্ন সেন কৈলাস বাবুর এই অভিমতে প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন যে – “শ্যাম জনেরা বহু পরবর্তী কালেই কামরূপ বা আসামে এসেছিলো। ‘ত্রিপুরু’ বা ‘ত্রিপুরা নাম অতি পুরাতন এবং বহু প্রাচীন গ্রন্থাবলীতেও এ নাম উল্লেখিত। তিনি আরো বলেন – সর্ব প্রাচীন ‘রাজমালা’ (শুক্রেশ্বর ও বানেশ্বর কর্তৃক পৌরাণিক বাংলায় পঞ্চদশ শতাব্দীতে রচিত বলে দাবীকৃত) ও ‘রাজরত্মাকর’ ‘(হস্তেলিখিত সংস্কৃতভাষার পুথি) পুস্তকে ‘ত্রিপুরা’ রাজ্য কিরাত’ দেশের অংশ বলে উল্লেখিত এবং এই রাজ্যে জন্ম বলেই প্রাচীন ত্রিপুরাধিপতি দৈত্য নিজ পুত্রের নাম ‘ত্রিপুর’ রেখেছিলেন।

 

কৈলাসবাবু কামরূপ বা আমাদের পূর্বাংশে রাজ্যস্থাপনকারী বংশকে ‘শ্যান’ (সান/ সাম) সম্ভুত বলে উল্লেখ করাতেই কালী প্রসন্ন বাবু প্রতিবাদের সুযোগ পেয়েছিলেন । কারণ উক্ত ‘শ্যান (সান/সাম) জনশক্তির আসাম আক্রমণ ও অধিকার ইতিহাসবিদগণ ত্রয়োদশ শতাব্দীতে (কারো মতে ১২১৫ খৃঃ আর কারো মতে -আনু: ১২৫০ খৃ:) সাব্যস্থ করেছেন। অথচ ‘ত্রিপুরা’ রাজ্যের অভ্যূদয় সম্ভবত: তার বহু আগেই ঘটেছিলো । কেননা,ব্ৰহ্ম-ইতিহাস ‘রাজ্য-ওয়েং’ পুস্তকে উল্লেখিত ও পূর্বে আলোচিত ‘পাত্তিকারা’ ও ‘ত্রিপুরা’ রাজ্য যদি এক হয়ে থাকে, তবে দ্বাদশ শতাব্দীর দিকেই ‘পৈগান/পেগু’ রাজকুমার আলংছিছু ‘পাত্তিকারার’ রাজকন্যাকে বিয়ে করেছিলেন বলা আছে ; সেই ক্ষেত্রে ‘পাত্তিকারা বা ‘ত্রিপুরা’ রাজ্যের অস্তিত্ব একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীতেই পরিস্কার এবং ‘পাত্তিকারা’ রাজ্য যে একদা ‘ত্রিপুরা’ রাজ্য হতে পারে, তারই স্মারকরূপে কুমিল্লার বর্তমান “পাইত কারা’ চট্টগ্রামের ‘পটিয়া’ ইত্যাদি স্থানের নাম উল্লেখযোগ্য ও আমার পেশকৃত পূর্বোক্ত যুক্তি অনুধাবনযোগ্য । 

 

কৈলাসবাবুর তথ্য প্রদানকারীর তথ্যে আংশিক ভ্রান্তি থাকা অস্বাভাবিক নয় ।

বিশেষত: কামরূপের বা আসামের পূর্বাংশে উল্লেখিত রাজ্যপ্রতিষ্ঠা সম্পর্কে যেখানে সময় কাল অনিশ্চিত বা অনির্দিষ্ট এবং প্রাচীন ঘটনার ক্ষেত্রে আলোকপাত করতে গেলে সে রকম -ভূল-ত্রুটি-কিছু না কিছু ঘটে থাকে বৈকি। সুতরাং কামরূপ বা আসামে ‘শ্যান’ (সান/সাম) জনশক্তির আক্রমণ ও অধিকার বিস্তার সম্পর্কে ইতিহাসবিদগণ – যেখানে ত্রয়োদশ শতাব্দী সাব্যস্ত করেছেন ; সেখানে অন্য কোন

শক্তির দ্বারা তার পূর্বেই এই রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো বলে ধরে নিতে হবে এবং এই রাজ্য পুনরায় অন্য কোন পার্বত্য মানব শক্তির দ্বারা পরবর্তীভাবে অধিকারও একান্তই সম্ভব; যার ফলশ্রুতিতে রাজ্যচ্যুত রাজপুত্র-দ্বয় সরে গিয়ে আধুনিক আধুনিক নাগা পাহাড়ে ও কাছাড়ে অনুগত জনশক্তির মধ্যে প্রাচীন ‘হেরম্ভ’ ও ‘তৃপুরা’ বা ত্রিপুর’ রাজ্যের পত্তন করতে পারে। 

 

সেই ক্ষেত্রে পূর্বোক্ত ‘পিউ/পু’ জনশক্তির অন্তর্ভূক্ত বুরোক/বুয়োক ‘জনগোষ্ঠীর আসাম প্রভৃতি অঞ্চলে বহু পূর্বকাল হতেই সম্প্রসারণের কারণে উল্লেখিত পূর্ব-আসামে প্রতিষ্ঠিত রাজ্য এবং তার পতনে রাজপুত্র-দ্বয় কর্তৃক প্রারম্ভিত প্রাচীন ‘হেরম্ভ’ ও ‘তৃপুরা’ বা ‘ত্রীপুর’ রাজ্য – পিউ/পু’ ভিত্তিক হওয়াই স্বাভাবিক/ আমার মতে – ‘হেরম্ভ’ ও ‘তৃপুরা/ত্রীপুর’ বা ‘তি-পুরা/ত্রিপুরা’ এই উভয় নামের সাথেই পরিবর্তিত /অপরিবর্তিত আকারে ‘পো/পিউ’ বিদ্যমান। ‘হিরম্ভ/হেরম্ভ নামোৎপত্তির মূলে কিরান্ত (কিরাত) ও পো’ শব্দ জড়িত বলেই মনে হয় । কিরান্ত + পো= ‘কিরান্ত – পো’ বা ‘কিরাম্পো – > হিরাম্পো – > হিরাম্বো > হিরম্ব বা হেরম্ভ । ‘কিরাত’ মংগোলীয় জন বলেই কথিত এবং উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলেই যে তাদের অবস্থান ছিলো এতে সন্দেহ নেই। মার্কণ্ডেয়পুরাণ, মহাভারত এবং পাশ্চাত্য ভৌগলিক টলেমিও (তাঁর প্রদত্ত নাম ‘Chivvhadac”) এই জনশক্তিকে ভারতের পূর্বাঞ্চলবাসী বলেছেন। ব্রহ্মদেশ ও কাম্বোজ থেকে পঞ্চম/ষষ্ঠ শতাব্দীর যে সকল

শিলালিপি পাওয়া গেছে, এতে দেখা যায় – হিমালয় অঞ্চলবাসী জন থেকে ব্রহ্ম ও চীন সমুদ্রের তীরবর্তী কম্বোজ পর্যন্ত বসবাসকারীজনকে ব্যাপকভাবে কিরাত বা কিরান্ত আখ্যায় অভিহিত করা হয়েছে । নেপালে এখনো ‘কিরান্তি’ বা ‘করান্তি’ আখ্যা প্রচলিত এবং আমার ধারণা’- মি-কির, ‘মি-হির্ প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর নামের সাথে এই নাম এখনো জীবিত (মি = মানুষ)। 

 

উল্লেখ্য যে – বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর উচ্চারণ ‘ক’ বৰ্ণ সহজেই ‘হ’ বা- ‘অ’ বর্ণে রূপান্তরিত হয় (চট্টগ্রামী উচ্চারণে -বাকল> বা অল (হ>অ), উচ্চব্রহ্মে কাকু =হাক) অন্য দিকে, ‘তিপুরা/তিপুরো’ বা তৃপুরা/ ত্রীপুরা’ নামোৎপত্তির সম্পর্কে আমার প্রধানতম ধারণা (অন্যান্য সহ) পূর্বেই ব্যক্ত করেছি যে – ‘পু’ + ‘রা’ বারো (দল – ‘অর্থে)। “পুদল” বাচক এবং এর সংগে তি পূৰ্বসংযুক্তি তৈ’ বা ‘তোয়’ (জল/নদী-অর্থে) শব্দ জাত। এতে ‘তি-পু-রা/তি-পু-রো নামের সম্পূর্ণ অর্থ-‘জল/ নদী-তীর বাসী পু দল’ ভাবার্থে -, নিম্নাঞ্চলের পু দল’ / সুতরাং, ধরে নেয়া যায় – উভয় রাজ্যই নিজেদেরকে ‘পিউ/পু/পো’ স্বীকৃতি দিচ্ছে – কেউ বলছে নিজেকে “কিরান্তি বা কিরাতী পু/পো’ আর কেউ বলছে নিজেকে ‘নিম্নাঞ্চলের পু-দল’ ।

এখানে অবশ্যই বিচার্য্য যে – ‘পু-রা/পু-রো’ নামের সাথে পুনরায় তৈ’ (‘তোয়’ শব্দ জাত ‘তি’ পূর্ব সংযুক্তির প্রয়োজনীয়তা কি ছিলো । পূর্বেই বলেছি – নদীর ‘উদ্ধাঞ্চলবাসী’ ও ‘নিম্নাঞ্চলবাসী’ এই ধারণা বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে অতি ব্যাপক আকারে বিদ্যমান এবং এরই ফলশ্রুতিতে ‘কাকু/হাকু’(উদ্ধাঞ্চলবাসী এবং ‘হা-নাম’ (নিম্নাঞ্চলবাসী) ইত্যাদি স্থুল অবস্থান ভিত্তিক আখ্যার সৃষ্টি হয়েছে। সম্ভবতঃ তিপুরা তিপুরো’ বা কৈলাস বাবুর উল্লেখিত প্রাচীন ‘তৃপুরা ত্রীপুর’ রাজ্যের জনশক্তি নিম্নাঞ্চল বাসী – পু/পিউ প্রধান ছিলো এবং এতেই’ তৈ- পরা / তিপুরা/ তিপুরো’ ‘আখ্যার ভিত্তি’, রচিত হয়েছে। এই ধারণার সমর্থনে বলা যেতে পারে- কালীপ্রসন্ন বাবুর অভিমত, ‘হালাম’ জনের কাছ থেকেই বর্তমান ত্রিপুরা রাজ্যের কর্তৃত্ব কেড়ে নেয়া হয়েছে এবং প্রাচীন রাজগণের বহু নামসহ আরো বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সাথে এখনো ‘হালাম’ সংস্কৃতির ছাপ বিদ্যমান। ‘হালাম’ শব্দ ‘হা-নাম ‘ শব্দেরই পরিবর্তিত রূপ, যার অর্থ – ‘নিম্নাঞ্চলবাসী’। ‘তৈ/তোয়’ শব্দেও তা বুঝায় । পু রা/পু -রো’ (পু -দল) নামের সাথে ‘তৈ/তোয়’ শব্দজাত ‘তি’ (জল/নদী বা নিম্নাঞ্চলবাসী অর্থে) পূর্ব-সংযুক্তির এখানেই যথার্থতা বিদ্যমান ।

 

কালীপ্রসন্ন বাবুর ‘ত্রিপুর/ত্রিপুরা’ নামের উপর প্রাচীনত্বের দাবী অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য । এই উপমহাদেশে আদি মংগোলীয় জনের অস্তিত্ব সন্দেহাতীতভাবে স্বীকৃত। স্থূল ‘কিরান্তি/কিরাত’ নামে ছাড়াও তারা বিভিন্ন জনগোষ্ঠীগত / রাজ্যগত নামে পরিচিত থাকা স্বাভাবিক । ‘মহাভারত’ কাব্য ও ‘ভবিষ্য পুরাণ’ বহু প্রাচীন গ্রন্থ বলে গৃহীত । এতে ত্রৈপুর / স্ত্রৈপুর’ এবং ‘হেরম্ভ’ নামসহ প্রাগ জ্যোতিষ (আসাম), মেক্‌লৈ

(মনিপুর) বরেন্দ্র (উত্তর বংগের একাংশ); লোহিত্য (ব্রহ্মপুত্র) জয়ন্তা (জয়ন্তিয়া) প্রভৃতি নাম বিদ্যমান৷ 

 

“দ্রোনা দন্তরং যত্তো ভগদত্তঃ প্রতাপবান ।

 মাগধৈশ্চ কলিঙ্গৈশ্চ পিশাচৈশ্চ বিশাম্পতে ॥

প্রাগ জ্যোতিষাদনু নৃপং কৌশেল্যো হয় বৃহদ্বল ।

 মেকলৈ করুবিন্দৈশ্চ ত্রৈ পুবৈশ্চ সমন্বিত:।” 

মহাভারত, ভীষ্ম পর্ব – ৮৭ আঃ ৮/৯ শ্লোক ।

 

বরেন্দ্র তাম্রলিপ্তঞ্চ হেড়ম্ব মণিপুরকম্ ।

লোহিত্য স্ত্রৈপুরং চৈব জয়ন্তাথ্যং সুসঙ্গকম’॥ 

ভবিষ্য পুরাণ – ব্রহ্মখন্ড ।

 

এই স্থান / দেশ রাজ্যগুলি এই পূর্বাঞ্চলেরই বুকে অবস্থিত। সুতরাং তাদের প্রাচীনত্বকে অবশ্যই উড়িয়ে দেয়া যায় না, যদিও তাদের অভ্যুদয়ের সঠিক সময় কাল নির্দ্ধারণ এখন ঐতিহাসিক তথ্যের অভাবে প্রায় অসম্ভব বলা চলে ।

 

এ সূত্রে উল্লেখ্য যে – কাব্য পুরান কে অবশ্যই ইতিহাস বলা চলে না । কারণ এতে

কল্পনা -বিলাস, অতিরঞ্জন ও পৌরাণিক বিশ্বাস বা অবৈজ্ঞানিক চিন্তা ভাবনা প্ৰাধান্য লাভ করা স্বাভাবিক । তৎসত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট কবি বা রচয়িতার গ্রন্থে বিনা কারণে উপরোক্ত স্থান / দেশ / রাজ্যের নাম উল্লেখিত হবে কেন? সুতরাং এর মূলে নিশ্চিতই কোন কারণ বা ভিত্তি যেমন আছে তেমনি গুরুত্বও আছে বৈকি! এক্ষেত্রে এই সত্যকেই সহজ সরলভাবে মেনে নেয়া উচিত যে উল্লেখিত স্থান/দেশ/রাজ্যগুলির অস্তিত্ব কবি রচয়িতার আমলে কিম্বা তার প্রাপ্ত তথ্যাবলীতে অবশ্যই ছিলো এবং তাদের অবস্থান সম্পর্কেও তার সম্যক বা স্থুল ধারণা বিদ্যমান ছিলো । কিন্তু সে ক্ষেত্রেও অসুবিধা হলো এই – ‘মহাভারত’ কাব্য বা ভবিষ্য পুরাণ কবে ঠিক রচিত হয়েছিলো তার সঠিক সময় কাল নির্দ্ধারণ দুষ্কর। আর অনেকের অভিমত যুগে বিভিন্ন রচয়িতা বহু পরিবর্তন পরিবর্দ্ধন করে গেছেন এবং তারই পরিমার্জিত বা শিশুরূপ আজ আমাদের হাতে এসেছে। হস্তে লিখিত প্রাচীন গ্রন্থের ব্যাপারে তাদের এই অভিমতকে সরাসরি অস্বীকার করার উপায় অবশ্য নেই। কিন্তু এই পূর্বাঞ্চলে আদি মংগোলীয় জনের বসবাস বিবেচনায় উল্লেখিত স্থান / দেশ/রাজ্যগুলির অস্তিত্বও যে প্রাচীনকালে ছিলো তা মেনে নিলে সত্য থেকে খুব বেশী বিচ্যুতি ঘটবে, আমি মনে করিনা। ‘আদি- মংগোলীয়’ বলতে সাধারণতঃ খৃষ্টের জন্ম পূর্বকালে আগত জনকেই ধরা হয়। এই উপ-মহাদেশীয় আৰ্য ভাষার বিবর্তনের ধারা বিবেচনা করলে বহু প্রাচীন গ্রন্থের সার্বিক বা আংশিক মূল রচনা সংস্কৃত ভাষায় দু’হাজার/আড়াই হাজার বৎসর পূর্বেও রচিত হওয়া সম্ভব । ডঃ শহীদুল্লাহ’র মতে ভগবান বুদ্ধ যখন ‘পালি’ ভাষায় ধর্ম প্রচার করছিলেন, তাঁর একটা সাহিত্যিক ভাষা ছিলো – যার রূপ -‘সংস্কৃত” । তিনি এর সময় কাল বলেছেন -১০০ থেকে ৬০০ খৃ: পূ: । সুতরাং উক্ত গ্রন্থগুলির মূল রচনাতে এই রাজ্যগুলির উল্লেখ থাকা মোটেই অসম্ভব নয় । সেই সূত্রে প্রাচীন তৈপুরো/তৈপুরা/ তিপুরো/তিপুরা, বা কৈলাসবাবুর ‘ত্রীপুর/তৃপুরা’ অবশ্যই আদি মংগোলীয় জনের একটি রাজ্য রূপে ধরে নেয়া যায় । যদিও তার প্রাচীন অবস্থান ও আধুনিক অবস্থান এক না ও হতে পারে।

 

তৈপুরো/তৈপুরা/তিপুরো/তিপুরা’ নাম এই উপমহাদেশীয় প্রাচীন গ্রন্থাদিতে ‘ত্রৈপুর/ স্ত্রৈপুর/ত্রিপুর’ ইত্যাদি রূপে আত্মীকরণ বা সংস্কৃতায়নের অবশ্যই কারণ আছে ৷ ‘পুর’ শব্দের অতি প্রাচীন এবং ‘পুরনন্দর’ শব্দ বৈদিক গ্রন্থে পাওয়া যায় । দেবরাজ ইন্দ্রের একটি নামও ‘পুরন্দর’। ‘পুর’ ও ‘পুরন্দর’ শব্দ যথাক্রমে ‘দুর্গ বা সুরক্ষিত স্থান ও তার অধিপতি’ অর্থেই মূলত’ দেখা যায় । কিন্তু ‘পুর’শব্দের সম্প্রসারিত অর্থ – রাজ্য/ দেশ/স্থান/ জনপদ / গ্রাম ইত্যাদির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য৷ 

 

 পৌরাণিক গ্রন্থানুযায়ী আবার – ‘অসুর বা দৈত্য’ কূলের তিনটি ‘পুর’ বিদ্যমান, যার অপর নাম ত্রিপুরা/অসুর/দৈত্য’ বা ‘ত্রিপুর’ অধিবাসীদের সাথে দেবতাদের বিরোধ হেতু দেবাধিদেব শিব বা মহেশ্বরের অপর নাম – ‘ত্রিপুর – অরি’ বা ‘ত্রিপুরারি’। ‘শুর/অসুর’ বা দেবতা/দৈত্য’ ধারণা অতি প্রাচীন এবং বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীগুলিই এর প্রমাণ । মূলতঃ এই ধারণা দু’টি বিপরীত শক্তির কল্পনাতেই সৃষ্ট এবং রূপক অর্থে ব্যবহৃত। স্থুলভাষ্যে ‘দেব’ কাৰ্য্যাবলী ‘প্রশংসাই’ এবং অসুর/দৈত্য’ কার্য্যাবলী – ‘নিন্দাই’ । অসুর কার্যাবলী যেহেতু ‘নিন্দাই’ – সেহেতু ‘নিন্দাই’ কার্য্যকারক যে কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টিই নিন্দনীয় অর্থে – অসুর / দৈত্য/দানব/ রাক্ষস / পিশাচ/বর্বর’ ইত্যাদি রূপে আখ্যায়িত। এই মানসিকতা এখনো আমাদের মনে বিদ্যমান এবং প্রাচীনকালে তার প্রবণতা যে আরো অধিক ছিলো, তা সহজেই অনুমেয়। এর উজ্জ্বল প্রমাণ -‘রামায়ণ’ ; যাতে লংকাধিপতি রাবণ ও তার দেশবাসী- ‘রাক্ষস’ রূপেই আখ্যায়িত।

 

মংগোলীয় জনশক্তির এই উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে অনুপ্রবেশ, সম্প্রসারণ ও কর্তৃত্ব বিস্তারে স্বাভাবিক ভাবেই স্থানীয় জনসাধারণ হুমকির মুখোমুখী হয়েছিলো এবং সম্প্রসারণকারীদের পক্ষ থেকেও অন্যায় অধিকার, জোর জুলুম ইত্যাদি ঘটে থাকবে । এতে স্থানীয় জনগণের চোখে নিঃসন্দেহেই তারা নিন্দাই’ বা ঘৃণার পাত্র রূপে ‘অসুর/দৈত্য/রাক্ষস/দানব পিশাচ/বর্বর’- বলে প্রতিভাত হওয়া স্বাভাবিক । তদুপরি তারা ছিলো বিজাতীয় এবং অন্য চেহারার মানুষ। এ সূত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে, ডঃ এনামূল হকের মতে -আরাকানবাসীদের “রাখাইং’ নামের উৎপত্তি নাকি ‘রক্ষ’ (রাক্ষস) শব্দ থেকে। যদি তাই হয়ে থাকে, এই নামের ভিত্তিমূলেও ওই একই ভাবধারা জড়িত ছিলো বলতে হবে এবং তাঁর উৎপত্তি সম্ভবতঃ ঘটেছিলো এই উপমহাদেশীয় সূত্র ধরেই৷ 

 

সূতরাং এইক্ষেত্রে বিজাতীয় জনের প্রতিষ্ঠিত রাজ্যের নামও যেখানে তৈপুরো/ তৈপুরা’ – যা অসুর/দৈত্য’ শক্তির অবস্থান ‘ত্রিপুরা’ নামের সাথে একেবারেই নিকট সাদৃশ্যে বিদ্যমান, সেখানে এই উপমহাদেশীয় জনসাধারণের পক্ষ থেকে এবং তাদের বিভিন্ন পৌরাণিক গ্রন্থাবলীতে তৈপুরো/তৈপুরা’ নামকে ত্রৈপুর/স্ত্রৈপুর/ত্রিপুর’ ল রূপে আত্মীকরণ বা সংস্কৃতায়ণ করে নেয়া অতি স্বাভাবিক ধরণেই সম্ভব। অবশ্য আমার ধারণা – বিশেষতঃ পৌরাণিক গ্রন্থাবলীতে এই আত্মীকরণ বা সংস্কৃতায়ন ঘটেছিলো কিছু পরবর্তীকালেই এবং এমনি এক পর্যায়ে যখন আগত মংগোলীয় জনশক্তি এই উপমহাদেশের অধিবাসীরূপে গৃহীত হয়ে তার রাজনৈতিক/ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বা ভাবধারার সাথে বিভিন্ন সূত্রে জড়িত হয়ে পড়েছে । ‘মহাভারত থেকে দ্রৌনাচার্য্য বা দুৰ্য্যোধনের প্রতি সমর্থন এই ইংগিতই দিচ্ছে এবং সেই ক্ষেত্রে ও

লক্ষণীয় এই যে -তাদেরকে ধর্মরাজ যুধিষ্টিরের বিরুদ্ধবাদীদেরই দলভুক্ত করা হয়েছে। 

 

মংগোলীয় রাজশক্তি বা জনগণ এই উপমহাদেশের বুকে প্রতিষ্ঠা লাভের পরে তো বটেই – তার আগে থেকেও এই উপমহাদেশীয় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ আর্য্য সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসা সম্ভব । কারণ আর্য্য সংস্কৃতির প্রভাব অতি সূদূর প্রসারী এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মংগোলীয় প্রধান বিভিন্ন এলাকাসহ সুদূর চীনদেশের বুকেও বহু বহু প্রাচীনকাল থেকেই ধাবমান। যাই হোক, বুঝতে কষ্ট হয় না – বিশেষতঃ এই উপমহাদেশে এসে তাদের পূর্ব সংস্কৃতি ও মানসিকতায় ধীরে ধীরে প্রভুত পরিবর্তন ঘটতে থাকে এবং তারা কালে কালে স্থানীয় সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়ে। এই কারণে আর্য্য সংস্কৃতির মূল প্রবক্তা হিন্দু ব্রাহ্মণেরা রাজানুগ্রহ লাভে সমর্থ হয় । এতে সাধারণ জন শক্তিতেও তৎকালীন আর্য্য বা হিন্দু সংস্কৃতির প্রসার বাড়তে থাকে। অবশ্যই এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে – সাধারণ জনশক্তিতে এই গ্রহণ বর্জনের ধারা দীর্ঘকাল ব্যাপী চললেও (এখনো চলছে) সর্বত্র তা সমান নয় এবং অনেক ক্ষেত্রে স্থূলভাবেই কার্য্যকরী হয়েছে। এতে তাদের আপন আপন পূর্ব সংস্কৃতির রূপ বহুক্ষেত্রে পাল্টে গেলেও পরবর্তীভাবে বিভিন্ন মিশ্র সংস্কৃতির রূপ ধারণ করেছে। এ কারণে দেখা যায় – এই উপমহাদেশে বসবাসকারী মংগোলীয় জনসম্ভূত বিভিন্ন জনগোষ্ঠী প্রায়ই এই উপমহাদেশীয় সূত্র ধরে হিন্দু/ বৌদ্ধ ইত্যাদি ধর্ম গ্রহণ করেছে বটে, তবু তাদের মধ্যে সম্পূর্ণ এমন সব আচার অনুষ্ঠান, সামাজিক রীতিনীতি ও মানসিকতা এখনো বিদ্যমান, যা হিন্দু / বৌদ্ধ ইত্যাদি ধর্মীয় বিধানানুযায়ী নয় । এক্ষেত্রে পরবর্তীকালে আগত মংগোলীয় জনশক্তিও যে আদি মংগোলীয় জনের সমান তালে গ্রহণ বর্জন করতে পারেনি, তার প্রমাণ বিদ্যমান। অন্যদিকে, একটু তলিয়ে দেখলেই বুঝা যাবে, জনসাধারণের চেয়ে বিভিন্ন মংগোলীয় রাজন্যবর্গ বা তাদের বংশাবলীতেই আৰ্য্য বা হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাব অধিকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। এর মূলে হিন্দু-ব্রাহ্মণদের তৎপরতা অবশ্যই বিদ্যমান। তারা রাজশক্তির সন্তুষ্টি অর্জনের তাদেরকে রাজকীয় সম্মানসহ উচ্চতর সামাজিক অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করতে থাকে এবং এতে দেখা যায় – কালে কালে এই উপমহাদেশীয় প্রায় মংগোলীয় রাজবংশই ক্ষত্রিয়’ পর্যায়ে স্বীকৃত হয়ে গেছে বা তার দাবীদার হয়ে উঠেছে। কোন কোন ‘রাজবংশ’ এমন কি ‘আৰ্য্য’ দাবী নিয়েও এগিয়ে গেছে এবং একই মানসিকতায় কোন কোন জনগোষ্ঠীতে ক্ষত্রিয়ত্বের দাবীও সমুদ্যত । এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত – আলোচ্য ‘ত্রিপুরা/তিপুরা’ রাজবংশ, ‘যাসিয়া/ জয়ন্তিয়া’ রাজবংশ এবং নেপালের “ছেত্রী” জনগোষ্ঠী (ছেত্রী>ক্ষেত্ৰি>ক্ষত্রিয়। ‘ত্রিপুরা/তিপুরা’ রাজবংশ ‘চন্দ্র’ বংশীয় ‘ক্ষত্রিয়’ এবং ‘যাসিয়া / জয়ন্তিয়া’ রাজবংশ ‘ইন্দ্র’ বংশীয় ‘ক্ষত্রিয়’ বলে দাবীদার – বহু ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত কর্তৃক স্বীকৃত ও বটে । এই ক্ষেত্রে উভয় পক্ষেরই একটি স্থুল সুযোগ ছিলো এই যে, এই উপমহাদেশীয় পৌরাণিক ভাবধারায় এবং কোন কোন প্রাচীন গ্রন্থাবলীতে ‘ক্ষত্রিয়’ বলে তারাই বিধৃত, যারা রাজকীয় শাসনকার্য্য এবং যুদ্ধকার্য্য ইত্যাদিতে জড়িত । সেই সূত্রে এই দাবী পেশাগত বা কর্ম ভিত্তিক; সুতরাং অনুরূপ অবস্থায় কেউ দাবী করতে বা আর কেউ স্বীকার করতে বাঁধা কোথায় ?

 

এই কারণে দেখা যায়-‘ত্রিপুরা’ রাজবংশের ইতিহাস সংস্কৃত ‘রাজরত্নাকর’ বা বাংলা রাজমালা’ দুইজন ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত শুক্রেশ্বর ও বানেশ্বর কর্তৃক ত্রিপুর-রাজ পুরোহিত চন্তাই দুল্লভেন্দ্র সহযোগে এমনভাবে রচিত হয়েছে যে, এতে ‘ত্রিপুর রাজবংশ ‘ক্ষত্রিয়’ তো বটেই ‘মহাভারত’ কাব্যে উল্লেখিত রাজা ‘যযাতির’ পুত্র ‘দ্রুহু’র বংশ বলে দাবী করা হয়েছে। বুঝতে ভুল হয় না – এর মূলে ‘মহাভারত’ সহ অন্যান্য পৌরাণিক গ্রন্থের প্রভাব বিদ্যমান এবং এই দাবীর প্রধানতম উদ্দেশ্য ‘ত্রিপুর- রাজবংশ’কে এই উপমহাদেশীয় ভাবধারায় সম্পূর্ণ আত্মীকরণ ও সংস্কৃতায়নের মাধ্যমে তার গুরুত্ব, প্রাচীনত্ব কর্তৃত্ব ও সম্মান উচ্চতর পর্যায়ে অধিস্থাপন। আর সংগে সংগে রচয়িতা পণ্ডিত বর্গের পক্ষে বৃহত্তম রাজানুগ্রহও যে এতে অর্জিত হয়েছিলো, সন্দেহ নেই ।

 

‘মহাভারত’ পৌরাণিক গ্রন্থ হলেও ‘ইতিহাস’ নয়- মহাকাব্য’ । মহাকাব্য বা কাব্য মূলতঃ কল্পনা ও অতি রঞ্জন ভিত্তিক, যদিও তাতে বর্ণিত কালের রাজনৈতিক / সামাজিক/সাংস্কৃতিক ইতিহাসের কিছু তথ্যাবলী অবশ্যই পাওয়া যেতে পারে । এতে ‘মহাভারত’ কাব্যে উল্লেখিত সমুদয় ভাষ্য বা তথ্যই সত্য বলে গ্রহণ করা দুষ্কর । অপর দিকে, ‘মহাভারত’ কাব্য যে আরো পৌরাণিক গ্রন্থ দ্বারা প্রভাবান্বিত, তার প্রমাণ – রাজা যযাতির কাহিনী পৃথিবীর প্রাচীনতম গ্রন্থ বলে গৃহীত ‘ঋগ্বেদ সংহিতায়ও বিদ্যমান । সুতরাং এই কাহিনী যে ‘মহাভারত’ কাব্যে অধিগ্রহণের মাধ্যমে নবাকারে পরিবেশিত, তা বলাই বাহুল্য । এই কারণেই কৈলাসবাবু তাঁর ‘রাজমালা’য় মন্তব্য করেছেন, “জগতের আদি গ্রন্থ ঋগ্বেদ অপেক্ষা প্রাচীন দ্রুহু ও তাঁহার পুত্র কিরূপে ত্রিপুরায় উপনিবিষ্ট হইয়াছিলেন, তাহা অবধারণ করা মানব বুদ্ধির অগম্য” । পরবর্তী ‘রাজমালা’ পুস্তকের লেখক কালী প্রসন্ন বাবু ‘মহাভারত’ ও ঋগ্বেদ’ – এর রাজা যযাতি এক না ও হতে পারেন, এই মন্তব্য যেমন রেখেছেন, তেমনি যযাতি বা দ্রুহু যে বহু যুগে আবির্ভূত হতে পারেন, আধ্যাত্মিক দিক থেকে তাঁ প্রমাণেও প্রয়াস পেয়েছেন। আমি কৈলাস বাবুরই সমর্থক। তবে এই ধারণাও পোষণ করি যে শুক্রেশ্বর/ বানেশ্বর/চন্তাই দুর্লভভেন্দ্র রচিত ‘রাজমালা’য় ‘মহাভারত’ কাব্যে বর্ণিত ‘দ্রহু’ বংশের সাথে ‘ত্রিপুর’ রাজবংশের কাল্পনিক যোগাযোগ স্থাপনের মূলে পূর্বোক্ত বিভিন্ন ধরণের স্বার্থ সিদ্ধির কারণ ছাড়াও আর একটি স্থুল অনুমান বা বিশ্বাস এতে কাজ করেছে।

 

‘মহাভারত’ কাব্যের যযাতি ‘চন্দ্ৰ-বংশীয় ক্ষত্রিয়’। আদি ‘চন্দ্র’ থেকে তার স্থান ৬ষ্ঠ অধস্তনে। তাঁর দুই মহিষী -দেবযানী ও শমিষ্ঠা, যারা যথাক্রমে ‘দৈত্য’ রাজগুরু শুক্রাচার্য্য ও ‘দৈত্য’ রাজবৃষ পর্ব্বার দুহিতা। ‘দ্রুহু’ শর্মিষ্ঠার পুত্র। 

 

পূর্বেই উল্লেখ করেছি – এই উপমহাদেশীয় ভাবধারায় দৈত্য/অসুর’ ইত্যাদি আখ্যায় বিজাতীয় শক্তি মংগোলীয় জনেরা প্রাচীনকালে অভিহিত হওয়া স্বাভাবিক এবং এই উপমহাদেশে আদি মংগোলীয় জনের বা রাজশক্তির অস্তিত্বও বিদ্যমান ছিলো । সুতরাং রাজা যযাতি’র সাথে ‘দৈত্য’ দুহিতাদের বৈবাহিক সম্পর্কে য্যাতি – শর্মিষ্ঠা পুত্র ‘দ্ৰুহু’কে ‘দৈত্য’ বা মংগোলীয় জন বা ‘ত্রিপুর’ রাজবংশের আদিজন বলে বিশ্বাস বা অনুমান করতে বাঁধা কোথায় ? এ কারণে, রাজপুত্র দ্রুহু ‘ পিতা কর্তৃক ‘কিরাত

অর্থাৎ মংগোলীয় জনের কর্তৃত্বে প্রেরিত হয়েছিলেন বলে ‘রাজমালা’ গ্রহণ করেছে। যুগে – রাজ্য শাসন, যুদ্ধকার্য্যে জড়িত ব্যক্তিরা ব্যাপকভাবেই দাবীদার। এতে আবার উল্লেখ্য যে, যযাতি চন্দ্রবংশীয় ‘ক্ষত্রিয়’ রূপেই চিত্রিত এবং ক্ষত্রিয় বলতে সে ‘ত্রিপুরা’ রাজবংশও অবশ্যই ‘ক্ষত্রিয়’ রূপে দাবীকৃত এবং দ্রুহু’র সংগে কাল্পনিক সম্পর্ক স্থাপনে ‘চন্দ্র বংশীয় ক্ষত্রিয়’ রূপেই কথিত (মূল ‘ক্ষত্রিয়’ এর উৎপত্তি ব্রহ্মার ‘বাহু’ থেকেই বলা হয়েছে)।

 

পৌরাণিক ভাবধারায় যা-ই বলুক, ‘চন্দ্ৰ’ অবশ্যই কাল্পনিকজন, আদিম মানুষের ‘টোটেম’ ধারণার ফলশ্রুতি । এমনি টোটেম ধারণা পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই এককালে বিরাজিত ছিলো বলে নৃবিজ্ঞানীদের বিশ্বাস এবং এ বিশ্বাস অন্যত্রও বিশেষতঃ এই উপমহাদেশে বসবাসকারী বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর দল/ উপদল/গোত্র ইত্যাদির নাম গঠনে যে ব্যাপকভাবে কাজ করেছে তার প্রমাণ বিস্তর । চীনের আদি নৃপতি ও মিশর- বেবিলনের বহু প্রাচীন নৃপতিও অনুরূপভাবে ‘সূৰ্য্য’ তনয় বলে কথিত। উচ্চ ব্রহ্মে ও বহু শাসক বংশ বিশ্বাস করে = তারা ‘বরেণ’ বা ‘কুমীর’ থেকে সৃষ্ট এবং তারা তাদের পূর্ব পুরুষদের দীর্ঘ তালিকাও তুলে ধরে। ডঃ লীচ বলেছেন – এই তালিকা সত্য –

মিথ্যায় প্রণীত; কিন্তু সত্য কোনখানে গিয়ে মিথ্যা হয়ে গেছে তা স্থির করা দুষ্কর । আলোচ্য ত্রিপুর রাজবংশের ক্ষেত্রেও সম্ভবতঃ একই কথা প্রযোজ্য, যেহেতু এতে ‘চন্দ্ৰ’ থেকে মহারাজ বীরবিক্রম পর্য্যন্ত ১৮৪জন রাজার নাম সন্নিবেশিত।

 

উৎস : বরেণ ত্রিপুরা সম্পাদিত ‘পূব-ই-রাবাইনি সাল’ (১৯৮১)৷ 

 

প্রসঙ্গ:ত্রিপুরা জাতি, সলিল রায়

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা

“ত্রিপুরা” জাতির পূর্ব-পরিচয় (লেখক ~ সলিল রায়)