Jumjournal Logo

Search

Menu

তঞ্চঙ্গ্যা জাতির আদ্যোপান্ত

Alo Jyoti Chakma

Last updated Oct 8th, 2025

3

featured image

তঞ্চঙ্গ্যা জাতির বসতি, অঞ্চল ও জনসংখ্যা

বসতি ও অঞ্চল

পার্বত্য চট্টগ্রাম বসবাসকারী আদিবাসী জুম্ম জনগােষ্ঠীর মধ্যে তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠী অন্যতম। তারা দেশভেদে তঞ্চঙ্গ্যা’ ও দাইনাক নামে পরিচিতি। বস্তুত তঞ্চঙ্গ্যা ও দাইনাক নামে পাহাড়ে বসবাসকারী এই দুটি জনগােষ্ঠীকে আলাদা জনগোষ্ঠী হিসেবে মনে করা হলেও তারা একই জনগােষ্ঠীর লােক। তারা তিবেতাে-বর্মন ভাষাভাষী নৃগােষ্ঠীর মানুষ, যদিও বর্তমানে তাদের ভাষা ভারতীয় আর্য ভাষার অন্তর্ভুক্ত।

তঞ্চঙ্গ্যারা ভারত, বাংলাদেশ ও মায়ানমার এই তিনটি দেশের পার্বত্য সীমানা সংলগ্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায় তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রধান বসতিগুলাে রয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া থানার উত্তর-পূর্বাংশে এবং কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় তাদের উল্লেখযােগ্য সংখ্যক বসতি রয়েছে।

ভারতে উত্তরপূর্বাঞ্চলের ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ অঞ্চল (দক্ষিণ ত্রিপুরা) এবং মিজোরাম রাজ্যের চাকমা স্বশাসিত জেলা পরিষদ (সিএডিসি) অঞ্চলে রয়েছে তাদের প্রধান প্রধান বসতি। মায়ানমারে তঞ্চঙ্গ্যাদের মূল বসতি ছিল, বর্তমানে আকিয়াবের সিত্তুয়ে জামপুই হিলের দক্ষিণে কলদান নদীমুখ অবধি তাদের বসতি বিস্তৃত।

বাংলাদেশ ও আরাকানের সিত্তুয়ে উভয় অঞ্চলের উপকূলীয় সমতল ভূমি অনেকটা উঁচু-নিচু টিলা ও সুউচ্চ পাহাড়ে যেন সাগরের ঢেউয়ের ন্যায় বিরাজিত। সুদূর হিমালয় পর্বতমালার শাখা ক্রমশ উচ্চতা হারিয়ে দক্ষিণ পূর্বদিকে প্রসারিত হয়ে এখানে পৌঁছে গিয়েছে।

এই শাখা আবার অনেক প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রলম্বিত । কোথাও কোথাও এই প্রশাখাগুলাে উত্তর-পূর্ব থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত নদী উপনদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। পাহাড়ের পাদদেশ ধৌত করে প্রবাহিত নদী উপনদীগুলাের তীরবর্তী সমতল ভূমিগুলো প্রচুর বাঁশ, গাছ এবং লতাগুল্মে আবৃত। এসব পাহাড়-পর্বতময় জনপদে তঞ্চঙ্গ্যাদের আবাসভূমি।

 

 

জনসংখ্যা

তঞ্চঙ্গ্যাদের  জনসংখ্যা সম্পর্কে সরকারি বিভিন্ন আদমশুমারিতে কিছু কিছু উল্লেখ রয়েছে। বর্তমানে তঞ্চঙ্গ্যাগণ প্রধানত পার্বত্য চট্টগ্রামেই অধিকাংশ বসবাস করে । পার্বত্য চট্টগ্রামে তঞ্চঙ্গ্যাদের ৪৭% শতাংশ লােক, দক্ষিণ ত্রিপুরায় ৩.৩% মিজোরামের এসব সিএডিসি ও সিএডিসি’র বাইরে ৯.৭% শতাংশ লােক বাস করে । অবশিষ্ট ৫০% লােক মায়ানমারে বসবাস করে। নিম্নে সরকারি আদমশুমারি অনু্যায়ী জনসংখ্যার তথ্য উল্লেখ করা গেল—

১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী

 (রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ কর্তৃক প্রদর্শিত তঞ্চঙ্গ্যা জনসংখ্যা) 

জেলা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান পার্বত্য চট্টগ্রামে সংশোধিত জনসংখ্যা
রাঙ্গামাটিবান্দরবানচট্টগ্রামকক্সবাজারমোট ১৩,৭১৮৫৪৯৩১৮৪৬৫৮২২১,৬৩৯ ১৩,৭১৮৫,৪৯৯–১৯,২১৭

সরকারি হিসাব মতে বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমারে তঞ্চঙ্গ্যা জনসংখ্যা

সাল ১৯৩১ ১৯৬১ ১৯৯১ ২০০১ ২০০৫
পার্বত্য চট্টগ্রামচট্টগ্রাম কক্সবাজারদক্ষিণ ত্রিপুরাসিএডিসিমিজোরাম( সিএডিসি’র বাইরে) সিত্তুয়ে (আরাকান)মোট গণনা হয়নি–১৫০১০০-


৬,৩৫৫৬,৬০৫
গণনা হয়নি–৬২৭গণনা হয়নি-


-৬২৭
১৯,২১৭১,৮৪৬৫৮২১,৬৩২৫,৩৪২-


-২৮,৫২৯
২৮,৪৪১–২,২৫৭৬,৪৬৫-


-৩৭,১৬৩
৩৫,২৬৭–২,৪৬৭৬,৩৮৭৯২৫


৩০,০০০৭৫,০৪৬

সরকারি আদমশুমারি প্রতিবেদনে প্রদত্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে তঞ্চঙ্গ্যা জনগণের সংখ্যা সঠিক নয় বলে তঞ্চঙ্গ্যাদের ধারণা। বান্দরবানে, বিশেষত নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকায় কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় বসবাসরত তঞ্চঙ্গারা যার মুঅ গসা, ধন্যাগসার লােক, তারা সবাই চাকমা নামে পরিচয় দেয় এবং অন্য সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের চাকমা নামে অভিহিত করে। এই সকল এলাকায় সরকারি আদমশুমারিতে তঞ্চঙ্গ্যাগণকে চাকমা নামে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলায় জরিপ চালিয়ে উপরােক্ত তথ্যাবলি সংগ্রহ করেছে। উক্ত সংস্থার জরিপ অনুসারে বাংলাদেশে মোট তঞ্চঙ্গ্যা জনসংখ্যা নিম্নরূপ-

অঞ্চল ২০০৮ সাল অনুযায়ী
পার্বত্য চট্টগ্রামকক্সবাজারচট্টগ্রামবাংলাদেশে সর্বমোট ৪১,৯৭৩৫,৬০০৪,২০০৫১,৭৭৩

অঞ্চল ও বিভিন্ন দেশে জনসংখ্যার বন্টন

অঞ্চল বর্তমান জনসংখ্যা
পার্বত্য চট্টগ্রামকক্সবাজার জেলাচট্টগ্রাম জেলাদক্ষিণ ত্রিপুরাসিএডিসিমিজোরাম(সিএডিসির বাইরে)সিত্তুয়ে আরাকান(মায়ানমার)সর্বমোট ৪১,৯৭৩৫,৬০০৪,২০০২,৪৬৭৬,৩৮৭৯২৫৪০,০০০১,০১,৬৫২

পার্বত্য চট্টগ্রামে (খাগড়াছড়ি জেলা ব্যতীত) উপজেলাভিত্তিক তঞ্চগ্যা জনগােষ্ঠীর সংখ্যা নিম্নে প্রদান করা হলাে –

জেলা উপজেলা জনসংখ্যা
রাঙ্গামাটি ১। রাঙ্গামাটি সদর২। কাউখালি৩। কাপ্তাই৪। বিলাইছড়ি৫। রাজস্থলি৬। জুরাছড়িমোট ৩,২০০১,০০০৬,২০০১১,০০০৪,০৬৩১,৫০০২৬,৯৬৩
বান্দরবান ১। বান্দরবান সদর ২। রোয়াংছড়ি৩। আলিকদম৪। নাইক্ষ্যংছড়ি৫। অন্যান্যমোট ৩,০১০৬০০০২,৯০০১,৯০০১,২০০১৫,০১০
  সর্বমোট রাংগামাটি ও বান্দরবান ৪১,৯৭৩

 

 

স্থানান্তরের প্রক্রিয়া

দাইনাক বা তঞ্চঙ্গ্যাদের বর্তমান বসতি স্থানসমূহের দিকে লক্ষ করলে অনুমান করতে কষ্ট হয় না যে, তারা দীর্ঘকাল আগে থেকে তাদের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছে। বার্মার ইতিহাস, দা্ন্যাওয়াদি আরে তবুং বা আরাকান ইতিহাস (অনেকে লেখেন দেঙ্গ্যাওয়াদি আরেদ ফুং) অনুসারে এবং নৃ-তাত্ত্বিকদের গবেষণা থেকে এই সিদ্ধান্ত পাওয়া গিয়েছে যে, তঞ্চঙ্গ্যাগণ দাইনাক পরিচয়ে দান্যাওয়াদির (আরাকান) মূল অধিবাসী ছিল।

ব্রহ্মদেশের প্রাচীন ইতিহাস বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগােষ্ঠীর উৎপত্তি, বিলয় এবং স্থানান্তরের কাহিনীতে পরিপূর্ণ। দীর্ঘকাল ধরে ব্রহ্মদেশের রাজশক্তি ও আরাকান রাজশক্তির মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহ সংঘটিত হয়েছিল। এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগােষ্ঠীগুলি কোনাে না কোনাে পক্ষ অবলম্বন করে তারাও যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত হতে বাধ্য হয়েছিল।

এ রকম যুদ্ধ বিগ্রহের ঝামেলা, বিদ্যমান রাজশক্তির প্রভাবমুক্ত হওয়া এবং সর্বোপরি নিরুদ্বিগ্ন শান্তিপূর্ণ জীবনযাত্রা নির্বাহের আকাঙ্ক্ষায় সেসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতির নিরাপত্তার অনুসন্ধান করে ইতস্তত ছড়িয়ে পড়েছিল বলে ধারণা করা হয়।

দাইনাকগণ এতদঞ্চলে স্থানান্তরিত হওয়ার জন্য উপরে বর্ণিত ঘটনাও অন্যতম কারণ হতে পারে। তারা প্রথমে মাতামুহুরী নদীর উপনদী তৈনছং-এ (তৈনছড়ি-মারমাদের তৈনছং) প্রথম বসতি স্থাপন করে। সেখান থেকে কালক্রমে তারা মাতামুহুরী অববাহিকা ধরে পশ্চিম দিকে সরে গিয়ে কিছু দক্ষিণে এবং কিছু পশ্চিমে চট্টগ্রামের দিকে ছড়িয়ে পড়ে।

সেখান থেকে উত্তর-পূর্বদিকে স্থানান্তর গ্রহণ করে রাঙ্গুনিয়া অঞ্চল এবং অবশেষে পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে স্থায়ী হয়ে যায়। সেখান থেকে সর্বপ্রথম ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে ঘিলামােইন থেকে দেবিচরণ তঞ্চঙ্গ্যার নেতৃত্বে চৌদ্দ পরিবারের মতাে মৌগসা তঞ্চঙ্গ্যা দক্ষিণ লুসাই হিলে চলে যায় বলে জানা যায়।

এটা ডামদেব ভিলেজ কাউন্সিল(নতুন জগনাছড়ি-১) এর প্রাক্তন ভাইস চেয়ারপার্সন ৮১ বছর বয়সী সুরতচোগা তঞ্চঙ্গ্যা (মৃত দেবিচরণ তঞ্চঙ্গ্যার ছেলে) থেকে জানা যায়।

১৯৫১-৫২ খ্রিস্টাব্দে চন্দ্রঘােনায় (১০০ ওয়াজ্ঞা মৌজা) কর্ণফুলির নদীর তীরে কর্ণফুলি কাগজ কল প্রতিষ্ঠার জন্য ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়। ফলে ৩০ হতে ৪০ টি তঞ্চঙ্গ্যা পরিবার (কাররােয়া গসা) উদ্বাস্তু হয়ে দক্ষিণ ত্রিপুরায় চলে যায়।

বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে, জনসংখ্যার তুলনায় পাহাড় এবং জমির পরিমাণ আনুপাতিক হারে কমে গেছে। তাই জুম বা কৃষির পরিবর্তে ব্যবসা ও চাকরি বিকল্প পেশা হয়ে দাড়িয়েছে। বর্তমানে শিক্ষিতের হার বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়ায় এবং উচ্চ শিক্ষা লাভের ফলে অনেকে চাকরিজীবী হয়ে শহরমুখী হচ্ছে।

কেউ কেউ ছোট ব্যবসার উপর নির্ভর করেও শহরমুখী হচ্ছে। এসব কারণে এবং জীবিকার সন্ধান অন্যত্র গমনের কারণে গ্রাম বা পাড়া ক্রমশ ভেঙে যাচ্ছে। পূর্বের ন্যায় শত ঘরের সমন্বিত পাড়া বা গ্রাম বর্তমানে চোখেই পড়ে না।

 

 

তঞ্চঙ্গ্যা জাতির ঐতিহাসিক পটভূমি

তঞ্চঙ্গ্যা জাতির উৎপত্তির পটভূমি

তঞ্চঙ্গ্যা জাতির উৎপত্তির ইতিহাস এযাবৎ বিতর্কিত এবং অস্পষ্ট ছিল। এযাবত তঞ্চঙ্গ্যাদের উৎপত্তি সম্পর্কে যেসব তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে, দীর্ঘদিন অনুসন্ধানের মাধ্যমে নতুন তথ্য অর্জনের ফলে সেসব তথ্যসমূহের বিতর্ক ও অস্পষ্টতার নিরসন হয়েছে।

চাকমা জাতির ইতিহাস লেখকগণ তঞ্চঙ্গ্যা বা দাইনাকদেরকে চাকমা জাতিরই একটি শাখা বলে বারবার উল্লেখ করে এসেছেন। আবার কেউ কেউ চাকমা জাতিকে চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা এবং দাইনাক এই তিন শাখায় বিভক্ত বলেও উল্লেখ করে থাকেন! আসলে তঞ্চঙ্গ্যাগণকে মারমা, রাখাইন ও বর্মীরা দাইনাক বলেন! সেই জন্য মায়ানমারে ‘তঞ্চঙ্গ্যা’ নামে কোনাে জনগােষ্ঠী নেই।

অন্যান্য নৃ-তাত্ত্বিক জনগােষ্ঠীর সঙ্গে দাইনাকরা সেখানে অন্যতম (পৃথক) জনগােষ্ঠী বলে স্বীকৃত। বর্তমানে যারা তঞ্চঙ্গ্যা নামে অভিহিত, এককালে দাইনাক পরিচয়ে তারা আরাকান বা মায়ানমার থেকে এতদঞ্চলে এসেছিল। সেই দাইনাকদেরই এখানে তঞ্চঙ্গ্যা নামে অভিহিত করা হয়েছে।

আর যেহেতু তঞ্চঙ্গ্যারা তাদের পূর্বেকার পরিচয় দাইনাক নামে মায়ানমার বা আরাকান থেকে এসেছিল, কাজেই তঞ্চঙ্গ্যাদের উৎপত্তির ঐতিহাসিক পটভূমি মায়ানমার বা আরাকানের সূত্র ধরেই অনুসন্ধান করতে হবে ।

এতদঞ্চলে বিদেশিদের মধ্যে যার লেখায় প্রথম দাইনাকদের সম্পর্কে পাওয়া যায় তিনি হচ্ছেন কর্ণেল এ পি ফেইরি (১৮৪১), তিনি An account of Arakan নামক নিবন্ধে দাইনাকদের কথা প্রথম উল্লেখ করেন এভাবে- ‘The remaining hill tribes are Daingnak and the Murung. They both inhabit the upper course of Mayu river.

The language of the first is a corrupt Bengali. They call themselves “khen-banago”. Of their descent I could learn nothing , probably they may be the offspring of Bengalees carried into the hills as slaves ,where their physical appearance has been modified by change of climate .In religion they are Buddhist”.

রাঙ্গামাটি উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট এর প্রাক্তন পরিচালক অশােক কুমার দওয়ান তাঁর প্রকাশিত ‘চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার’ গ্রন্থে ফেইরির উপরােক্ত বিবতিকে মন্তব্য করেছেন—“চাকমাদের একটি দল দৈংনাকেরা (দাইনাক) দীর্ঘকাল পূর্ব থেকে আরাকানে বসবাস করে আসছে।

দীর্ঘদিন যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন থাকায় তাদের কথা আমরা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। তাদের কথা নতুনভাবে স্মরণ করিয়ে দেয় স্যার আর্থার ফেইরি তাঁর ১৮৪১ সালে প্রকাশিত An Account of Arakan নামক নিবন্ধে।

ফেইরি বলেছেন যে, দৈংনাকেরা নিজেদের ‘খেইমবা-নাগাে’ বলে পরিচয় দেয়। এই ‘খেইমবা-নাগাে’ কথাটির অর্থ কী? খোঁজ নিয়ে জানা গেছে আরাকানি ভাষায় বা প্রতিবেশী কোনাে নৃ-তাত্ত্বিক জনগােষ্ঠীর ভাষায় শব্দটির কোনাে অর্থ হয় না। সুতরাং আমাদের কেবল অনুমানের উপর নির্ভর করতে হয়।

অনুমান হয় যে, ফেইরির সঙ্গে আলাপ করার সময় তারা আসলে নিজেদের চম্পকনগরের লােক বলেই পরিচয় দিয়েছিল। ফেইরি সেই সময় ছিলেন লেফটেন্যান্ট পদমর্যাদার একজন তরুণ অফিসার। সেই তরুণ বয়সে তিনি আরাকানি ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন বলে মনে হয় না।

সম্ভবত কোনাে আরাকানি দোভাষীর মাধ্যমেই তাদের কথাবার্তা চলেছিল। আরাকানি ভাষায় শব্দের শেষে হলন্ত ব্যঞ্জন উচ্চারিত হয় না। অতএব চম্পকনগর শব্দটির উচ্চারণ আরাকানি দোভাষীর উচ্চারণে ‘চেইমপানগাে’ হওয়াই স্বাভাবিক। সম্ভবত এই চেইমপানগাে শব্দটিকে শােনার ভুল হােক, বা নােট করার ভুলে হােক, ফেইরি ‘খেইমবানগাে’ লিখেছেন। এটা  নিছক অনুমান।

এই অনুমান ছাড়া দৈংনাকেরা নিজেদের ‘খেইমবানগাে’ হিসেবে পরিচয় দেওয়ার আর কী অর্থ হতে পারে আমরা ভেবে পাই না। দৈংনাকদের মধ্যে বরাবরই চম্পকনগরের বিজয়গিরির রাজ্যাভিযান সম্পর্কিত জনশ্রুতি প্রচলিত, এই ধারনার কারণ এই যে, আরাকানবাসী দৈংনাকদেরই প্রত্যাগত তংচঙ্গ্যা (তঞ্চঙ্গ্যা) সম্প্রদায়ের প্রতিটি লােকই আজ পর্যন্ত সেই একই বিশ্বাসে গভীরভাবে বিশ্বাসী।

দৈংনাকদের সঙ্গে এ অঞ্চলের জনগণের যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে কম করে হলেও প্রায় ৩০০ বছর।রাজা বিজয়গিরির নেতৃত্বে চম্পকনগর থেকে দক্ষিণাভিমুখে যুদ্ধ অভিযানে আসার পর তারা আর পূর্ব স্থানে ফিরে না গিয়ে এই অঞ্চলেই বসতি স্থাপন করেছিল। দৈংনাকগণসহ চাকমা তঞ্চঙ্গ্যাদের সে বিশ্বাসের মূলে অবশ্যই ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে।

ফেইরি বলেছেন, দৈননাকেরা (দৈংনাকও লেখা হয়) বৌদ্ধ এবং তারা মায়া নদী (মায়ু) উর্ধ্বভাগে বসবাস করে। তাদের ভাষা বিকৃত বাংলা বিধায় তিনি অনুমান করেন যে, তারা দাসরূপে আনীত বাঙালিদের উত্তর পুরুষ হওয়া সম্ভব। সেখানে দীর্ঘদিন বসবাসের ফলে জলবায়ুর পরিবর্তনে দৈহিক গঠন, আকৃতি ও চেহারার পরিবর্তন ঘটেছে।

ফেইরির এই অনুমান সঠিক নয়। কেননা জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে কোনাে জনগােষ্ঠীর শারীরিক গঠন, আকৃতি ও চেহারার পরিবর্তন কোনােদিন সম্ভব হতে পারে না। মঙ্গোলীয় নৃ-তাত্ত্বিক জনগােষ্ঠীর লােকের সঙ্গে একই জলবায়ুতে পাশাপাশি শত শত বছর বাস করেও কোনাে বাঙালির (অমঙ্গোলীয়) দৈহিক গঠন, আকৃতি ও চেহারার পরিবর্তন হয়ে মঙ্গোলীয় নৃগােষ্ঠীতে রূপান্তরিত হয়েছে বলে এমন কোনাে দৃষ্টান্ত কোথাও দেখা যায়নি।

চাকমা জাতির ইতিহাস রচয়িতা সতীশ চন্দ্র ঘােষ, মাধব চন্দ্র চাকমা কর্মী, বিরাজ মােহন দেওয়ান প্রভৃতি তাদের পূর্বসূরি কর্নেল এ পি ফেইরি (১৮৪১), ক্যাপ্টেন টি এইচ লুইন (১৮৬৯), স্যার রিজলি (১৮৯১) প্রমুখ এতদঞ্চলের শাসক ও গবেষক প্রমুখ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্যের উপর ভিত্তি করে চাকমা জাতির ইতিহাস দাঁড় করিয়েছেন এবং চাকমা জাতির উৎপত্তি সম্পর্কে বহু তথ্য সমাবেশ করেছেন।তাঁদের    সকলের একই মতাে যে, চাকমারা শাক্য বংশীয় এবং তারা চম্পকনগরের অধিবাসী ছিল এককালে ।

দাইনাকদের উৎপত্তি সংক্রান্ত যে বিবরণ চাকমা জাতি (১৯০৯) ইতিহাস গ্রন্থ প্রণেতা সতীশ চন্দ্র ঘােষ যে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন তাতে দেখা যায় যে, ১৩৩৩-৩৪ খ্রিস্টাব্দে আরাকানাধিপতি (কোনাে কোনাে গ্রন্থে ব্রহ্মসম্রাট) মেংগলি মনিজগিরির (মইচাগিরি) রাজা ইয়ংজকে সুকৌশলে আক্রমণ করলে ইয়ংজ পরাজিত হন এবং দশ সহস্র প্রজাসহ (মতান্তরে সৈন্যসহ) তিনি বন্দি হন।

সেই দশ সহস্র প্রজা বা সৈন্যগণকে এংখ্যং বা ইয়ংখ্যং নামক স্থানে বসবাস করার অনুমতি দেয়া হয় এবং তাদের পূর্বতন উপাধি পরিবর্তন করে দাইনাক আখ্যা প্রদান করা হয়। এভাবেই দাইনাকদের উৎপত্তি হয়েছে বলে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন।

আবার চাকমা ঐতিহাসিকগ্ণ উল্লেখিত রাজা ইয়ংজকে চাকমা রাজা অরুণ যুগ বলে শনাক্ত করেছেন। ফলে দাইনাকগণ চাকমা জাতির একটি অংশ বলে বিশ্বাস করা হয়। আবার দাইনাক ও তঞ্চঙ্গ্যারা যে একই জাতির লােক, তাই তঞ্চঙ্গ্যাদের উৎপত্তিও চাকমা জাতি হতে ঘটেছে বলে মনে করা হয়।

এই তথ্যটিই দাইনাক বা তঞ্চঙ্গ্যাদের উৎপত্তির পটভূমি হিসেবে বরাবরই চাকমা জাতির ইতিহাস রচয়িতাগণ   প্রামাণ্য দলিল স্বরূপ উপস্থাপন করে আসছেন। কিন্তু দাইনাকদের উৎপত্তি উল্লিখিত অনুরূপ আর একটি কাহিনীর বিবরণ পাওয়া যায় চাক জাতির উৎপত্তির ক্ষেত্রেও।

এ দুটো কাহিনীর মিল দেখে অশােক কুমার দেওয়ান তার চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার (৬৪ পৃষ্ঠা, প্রথম সংস্করণ) গ্রন্থে বলেছেন, তাহলে দেখা যায় এই যাবৎকাল পর্যন্ত প্রচলিত চাকমা জাতির ইতিহাসের এই অধ্যায়টি চাক জাতিও নিজেদের বলে দাবি করেছেন।

হয়তাে এই কারণেই বাবু বিরাজ মােহন দেওয়ান তাঁর চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত গ্রন্থে চাকরাও চাকমাদের একটি অংশ বলে দাবি করেছেন। উল্লিখিত রাজা ইয়ংজ আসলেই কি চাকমা রাজা অরুণ যুগ? তিনি কি দাইনাক আখ্যাধারীদের রাজা? নাকি চাকদের রাজা? 

রাজা ইয়ংজ যে চাকমা রাজা অরুণ যুগ,এর নিশ্চিত প্রমাণের সাপেক্ষে চাকমা ঐতিহাসিকগণ তেমন ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণ হাজির করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। নতুবা অশােক কুমার দেওয়ানকে তার চাকমা জাতির ইতিহাস বিচারগ্রন্থে আক্ষেপ করে বলতে হতাে না, ‘এই কাহিনী কি চাকরা আমাদের কাছ থেকে চুরি রেছে? নাকি আমরা তাদের কাহিনী আমাদের বলে চালিয়ে দিচ্ছি?’

অশোক কুমার দেওয়ান আরও উল্লেখ করেছেন যে, আরাকান ইতিহাসে মেংগদির রাজত্বকাল ১২৭৯ খ্রি. থেকে ১৩৮৪ খ্রি. পর্যন্ত (অবিশ্বাস্যভাবে দীর্ঘ ১০৬ বছর)। এই মেংদির সময়েই দেঙ্গ্যাওয়াদির (দান্যাওয়াদি আরেতবুং-আরাকানের ইতিহাস) বর্ণিত ১৩৩৩ খ্রিস্টাব্দের মেচাগিরি পতনের ঘটনা ।

কিন্তু ফেইরির ব্রহ্ম ইতিহাসে আরাকান রাজ মেংগাদ কতৃ্ক সাকরাজ্য জয়ের কোনো বিবরণ নেই-বরং মাইন সেইং-এর শান জাতি কর্তৃক উল্টো আক্রমণেরই উল্লেখ আছে। দুটি পুস্তকে দু ধরনের সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং বিপরীতধর্মী বক্তব্য ধাঁধার সৃষ্টি করে। বিভিন্ন সূত্র পর্যালোচনা করে এই কাহিনী চাকদেরই দাবি করে সহজ বলে অশোক কুমার দেওয়ান মন্তব্য করেন।

“বর্তমানে চাক জাতি নানা কিছুর বিচারে উচ্চ ব্রহ্মের কাদু জনগােষ্ঠীর একটি শাখা বলে অনুমিত হয়। সে কারণে চাকমা পক্ষেই সাক পরিচয় দেওয়া অধিকতর যুক্তিযুক্ত এবং যদিও ইয়ংজ কাহিনীর যথার্থতা সম্বন্ধে গভীর সন্দেহ আছে,তবুও সে কাহিনী তাদেরই দাবি করা সহজ। 

স্যার আর্থার ফেইরি (১৮৪১), ক্যাপ্টেন টি এইচ লুইন (১৮৬৯) এবং স্যার রিজলি(১৮৯১) ব্রক্ষ্মদেশ এবং আরাকান গিয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে গবেষণা করেছিলেন এবং সেই দেশের রাজ্য, সাম্রাজ্য এবং বিভিন্ন জাতি  সম্পর্কে লিখেছিলেন। তাঁদের সেসব লেখায় দাইনাক সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়। কাজেই দাইনাক জাতিও একটি পৃথক নৃ-তাত্ত্বিক জাতি তা অনায়াসে প্রমাণিত হয়।

প্রাচীন আরাকান ইতিহাস ‘দান্যাওয়াদি আরে তঁবুই’-এর মধ্যেই দাইনাক শব্দের পরিচয় নিহিত আছে। শব্দগত বিচারেও দান্যাওয়াদি ও দাইনাককে একটি অপরটির সাথে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত বলে মনে হয়। দুটোই বিশেষ্য পদ, একটি নামবাচক বিশেষ্য (অঞ্চলের নাম) এবং অপরটি জাতিবাচক বিশেষ্য (অধিবাসীদের নাম) ! নামবাচক (অঞ্চল) বিশেষ্য পদের সাথে জাতিবাচক বিশেষ্য পদের সম্পর্ক চিরকালীন।

একটি জনগােষ্ঠীর উৎপত্তি ও বিকাশ যে অঞ্চলে ঘটে, সাধারণত সে অঞ্চলের নামানুসারেই সেই জনগােষ্ঠীর নামকরণ হয়ে থাকে। যেমন : বাংলা ভূখণ্ডে যে জনগােষ্ঠীর উৎপত্তি বা বসতি ও বিকাশ সাধিত হয়েছে, তারা বাঙালি নামে অভিহিত হয়েছেন।

ড. খিন মং নগুনি গি তাঁর হিস্টোরি অফ মায়ানমার গ্রন্থে দান্যাওয়াদি অধ্যায়ে যে তথ্যের উপস্থাপনা করেছেন, তাতে দান্যাওয়াদি এবং দাইনাকদের সঙ্গে কপিলাবস্তুর শাক্যবংশের নিবিড় যােগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। তার উল্লেখিত গ্রহে দান্যাওয়াদি অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন, খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২৫ অব্দ থেকে ৭৮৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বর্তমান আরাকান ভূখণ্ডে দান্যাওয়াদি তিনটি পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

প্রথম দান্যাওয়াদি যিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তার নাম মারায়ু। তিনি কপিলাবস্তুর শাক্য বংশীয় রাজপুত্র ছিলেন। কিছু রাজনৈতিক কারণে অনুসারীসহ বর্তমান আরাকান ভূখণ্ডে গমন করেন এবং সেখানে দান্যাওয়াদি নামক একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে তিনি এক শক্তিশালী মুরুং (ম্রো) নৃগোষ্ঠীর প্রধানের কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন। মারায়ুর পরে তার বংশের আরো ৫৪ জন রাজা দান্যাওয়াদিতে সফলভাবে শাসন করেছিলেন বলে জানা যায়।

দ্বিতীয় দান্যাওয়াদি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, উচ্চবক্ষের তগুং রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা আবিরাজা-এর জ্যৈষ্ঠপুত্র কংরাজাগ্রী তগুং রাজ্যের আবিরাজের মৃত্যুর পর তার দুই পুত্র কংরাজাগ্রী বা কংরাজাঞী -এর মধ্যে যুদ্ধ লেগে যায়। যুদ্ধে বড় ভাই কংরাজাগ্রী পরাজিত হন এবং তার অনুসারীসহ দান্যাওয়াদি প্রতিষ্ঠা করেন।

ইতিহাসে দেখা যায়, আবিরাজা উচ্চব্রক্ষ্মে তার প্রতিষ্ঠিত রাজ্যের নাম দিয়েছিলেন সাংগাচ্ছানারা তিনি কপিলাবস্তুর শাক্য বংশীয় রাজা ছিলেন। একদা কপিলাবস্তুর  রাজ্যের সাথে পার্শ্ববর্তী পাঞ্চালা রাজ্যের যুদ্ধ বাধেঁ এবং যুদ্ধে কপিলাবস্তুর রাজা আবিরাজা পরাজিত হলে তার অনুসারীসহ তিনি তগুং অঞ্চলে পালিয়ে আসেন এবং সেখানে সাংগাচ্ছানাগারা নামে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।

কংরাজাগ্রী দ্বিতীয় দান‍্যাওয়াদি প্রতিষ্ঠার পর অত্যন্ত সফলতার মধ্য দিয়ে দান্যাওয়াদি শাসন করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তার বংশীয় আরাে ২৮ জন রাজা দান্যাওয়াদি দক্ষতার সাথে শাসন করেছিলেন বলে ইতিহাসে উল্লেখ পাওয়া যায় । কংরাজাগ্ৰী বংশের শেষ রাজাকে পরাজিত করে তৃতীয় দান্যাওয়াদি প্রতিষ্ঠা করেন সুরিয়া (সূর্য) বংশের প্রতিষ্ঠাতা চান্দা সুরিয়া (মতান্তরে চন্দ্র-সূর্য)। 

উল্লিখিত দান্যাওয়াদির ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যায় প্রথম পর্যায়ের দান্যাওয়াদি প্রতিষ্ঠিত ও শাসিত হয়েছিল মারায়ু ও তাঁর বংশের রাজাদের দ্বারা এবং দ্বিতীয় পর্যায়ের দান্যাওয়াদি প্রতিষ্ঠিত ও শাসিত হয়েছিল আবিরাজার পুত্র কংরাজাগ্রী ও তাঁর বংশধর রাজাদের দ্বারা এবং তৃতীয় পর্যায়ের দান্যাওয়াদি প্রতিষ্ঠিত ও শাসিত হয়েছিল চান্দা সুরিয়া ও তাঁর বংশীয় রাজাদের দ্বারা।

তাঁদের সম্মিলিত শাসনকাল ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২৫ অব্দ থেকে ৭৮৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। উল্লিখিত সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত তিনটি পর্যায়ের দান্যাওয়াদি নগরী একই স্থানে, নাকি ভিন্ন ভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সে ব্যাপারে বার্মা ইতিহাস এখনাে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেনি।

তবে মনে করা হয়, তিন বংশের রাজারা নিজেদের সভ্যতায় গড়ে তুলেছিলেন বলে হয়তাে একই দান্যাওয়াদি নগরীর তিনটি আমলকে তিনটি পর্যায় বলে ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া বার্মার প্রত্নতত্ত্ব কেবল একটি দান্যাওয়াদির অস্তিত্বই আবিষ্কার করতে পেরেছে।

আবিস্কৃত দান্যাওয়াদি নগরীর অবস্থান বর্তমান সিত্তোয়ে শহর থেকে কলদান নদী বরাবর ৬০ মাইল উজানে ৬ মাইল পশ্চিমে। খনন কাজের ফলে দেখা গেছে এ  নগিরীটি কলদান নদীর অববাহিকায় অবস্থিত ছিল। নগরটি ভেতর ও বাহিরের দুটি অংশে বিভক্ত ছিল। শত্রুর আক্রমণ ও বন্যা থেকে নগরী ও শস্য ক্ষেত্র রক্ষা করার জন্য চতুর্দিকে মাটির দেয়াল-ব্যুহ তারা গড়ে তুলেছিলেন। এ দান্যাওয়াদিই হচ্ছে আরাকান ভূখণ্ডের প্রাচীনতম নগরী এবং এখানেই গড়ে উঠেছিল আরাকানের প্রথম সভ্যতা।

দান্যাওয়াদি নগরীর প্রতিষ্ঠা এবং দানাওয়াদির অধিবাসী দাইনাকদের ভিন্ন ভিন্ন ইতিহাস গবেষকদের মধ্যে এরকম বিবরণ পাওয়া যায়। রাঙ্গামাটি উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন পরিচালক সুপ্রিয় তালুকদার কর্তৃক প্রকাশিত ‘চম্পক নগরের সন্ধানে : বিবর্তনের ধারায় চাকমা জাতি’ গ্রন্থে তিনি The Tai aid the Tai Kingdom by Padmeswar Gogoi গ্রন্থের ১০৪ নং পৃষ্ঠা উল্লেখ করে গ্রন্থকার নিম্নলিখিত তথ্য বিবরণী প্রদান করেছেন।

যা খুবই প্রণিধানযােগ্য। ‘আরাকানের প্রাচীন ইতিহাস সূত্রে জানা যায় যে, ৫৬৮ খ্রিস্টপূর্বে ভারতের বিহার বা প্রাচীন মগধ হতে চন্দ্র-সূর্য (canda-suriya) নামক একজন ভারতীয় এক সামন্ত , আদিম জড়ােপাসক জনগােষ্ঠী অধ্যুষিত দেশ চট্টগ্রাম আরাকান অধিকার করত রাজ্য স্থাপন করেছিলেন এবং তিনি সেখানকার রাজা হয়েছিলেন।

তাঁর রাজধানীর নাম ছিল ধন্যাবতী। তিনিই আরাকানে প্রথম বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেছিলেন এবং আরাকানে মহামুনি বুদ্ধমূর্তি ও মহামুনি প্যাগােডা নির্মাণ করেছিলেন।

এ প্রসঙ্গে হার্ভে  উল্লেখ করেন, “The City of Dhangyawati on the bank of Gaba river now Kaladan in Arakan was raised by the king Aug-dza-na the son of Kapilawat of Magadha and of this race fifty kings reigned over a period of 1800 years. Then came the king Tsandathooreeya, who was not a different dynasty, but in his reign the Boodh Goutoma; having been born in Magadha, visited Arakan.

The Pious king built the famous temple of Mahamuni, in his honour, this still exists. The ruins of the ancient temple of Mahamuni built entirely of stone, the site of the former cities, shown by the ruins of tanks and ruins of pagodas, the extensive stone walls at the old capital, certainly tell more of flourishing kingdom then what the British found it..

হার্ভে তাঁর প্রদত্ত বিবরণে চান্দা-সুরিয়ার আরাকানে আগমনের পূর্বে কলদান নদী তীরবর্তী দান্যবতী (অনেকে লিখেছেন ধন্যাবতী) নগরীর রাজার নাম Ang-dza-na the son of Kapilawat of Magadha উল্লেখ করেছেন। Ang-dza-na আমাদের পূর্ববর্ণিত দান্যাওয়াদি অধ্যায়ের (তৈনগাং-০৬) কংরাজাগ্রী বংশেরই শেষ রাজা। কাজেই দেখা যাচ্ছে দান্যাওয়াদির তিন পর্যায়ে এর অনুক্রমিক ইতিবৃত্ত মিলে যাচ্ছে।

কোন পর্যায়ের দান্যাওয়াদির সাথে দাইনাকদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, সে ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত করে বলা যায় না। প্রাচীন আরাকানে দাইনাকদের বসতি ছিল তা প্রাচীন আরাকান ইতিহাসে পাওয়া যায়। আব্দুল হক চৌধুরী কর্তৃক প্রণীত বাংলা একাডেমী ঢাকা কর্তৃক জানুয়ারি ১৯৯৪ প্রকাশিত ‘প্রাচীন আরাকান, রােয়াইঙ্গা হিন্দু ও বড়ুয়া বৌদ্ধ অধিবাসী’ গ্রন্থের ‘আরাকানের জনগােষ্ঠী’ নামক অধ্যায়ে দাইনাকদের  নাম পাওয়া যায়। যথা : প্রাচীন আরাকান রাজ্য ছিল মােঙ্গল, তিব্বত ব্রক্ষ্ম জনগােষ্ঠী ও মুরুং, খুমী, চাক, মিন, সেন্দুজ, ম্রো, খ্যাং ডইনাক, মারু মিউ প্রভৃতি কিরাত উপজাতি অধ্যুষিত দেশ।

বার্মার রাখাইন ইতিহাসের আলােকেও ধারণা পাওয়া যায় দাইনাকদের উৎপত্তি ঘটেছে বার্মা ভূখণ্ডের আরাকানে অবস্থিত প্রাচীন দান্যাওয়াদিতে। দান্যাওয়াদির অধিবাসী বলে তারা দাইনাক নামে অভিহিত হয়েছেন। প্রাচীন দান্যাওয়াদির সেই অধিবাসীদের উত্তরসূরী দাইনাকদের একটি অংশ কোনাে এক সময় আরাকান ভূখণ্ড থেকে (তাদের আবাসভূমি থেকে) পার্শ্ববর্তী নাফ নদী অতিক্রম করে, সীমান্ত পার হয়ে বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডের সর্ব দক্ষিণে, বার্মার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বসবাস করতে শুরু করে।

ইতিহাসে দেখা যায়, চট্টগ্রামের সেই অঞ্চলটি বিভিন্ন সময়ে আরাকানের করতলগত ছিল। ‘পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে চট্টগ্রাম আরাকান রাজ্যের অন্তর্গত ছিল প্রায় দেড়শ বছর।’এছাড়াও এ অঞ্চলটি তৎকালীন দান্যাওয়াদির সন্নিকট ও ভূ-প্রকৃতিগতভাবে প্রায় সমরূপ অঞ্চল বিধায় সুদূর অতীতকাল হতে বার্মা বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অঞ্চলসমূহে দাইনাকদের বসবাস শুরু হতে পারে।

এতদঞ্চলে এসে মাতামুহুরী নদীর আদরের তৈনগাঙ (মারমারা বলেন তৈনছং) তাদের সর্বপ্রথম বসতি গড়ে উঠে বলে জনশ্রুতি আছে। কালক্রমে তারা সেখান থেকে পশ্চিম ও উত্তর দিকে বিস্তার লাভ করে এবং তৈনছং-এর অধিবাসী বলে তৈনছংগ্রা (তঞ্চঙ্গ্যা) নামে সবাই ডাকতে আরম্ভ করে এভাবেই তারা তঞ্চঙ্গ্যা নামে পরিচিত হয়ে উঠে। তবে মারমা, রাখাইন এবং বর্মীরা এখনাে তাদের দাইনাক নামেই ডাকে।

 

 

বর্তমান ভূখণ্ডে বসতি স্থাপনের ইতিহাস

দাইনাকদের মূল ভূখণ্ড আরাকান বা ব্রহ্মদেশ থেকে এতদাঞ্চলে কিভাবে আগমন ঘটল সেই সম্পর্কে তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে একটি কাহিনী প্রচলিত আছে। এটা অবশ্য উত্তর ব্রক্ষ্মে অবস্থানকালে দাইনাকদের মধ্যে প্রথম প্রচলিত হয়। একদিন মংসুই ও অংসুই নামে সহােদর দুই ভ্রাতা (দুই দলের দুই দলপতি) সেই দেশের অক্সা (বার্মা) রাজার অত্যাচার থেকে মুক্ত থাকতে পারবে এমন একটি শান্তিপূর্ণ দেশের অনুসন্ধানে দলবল নিয়ে বহির্গত হল।

কয়েকদিন চলার পর একসময় এক বিশাল বনাঞ্চলে পৌছে বিশ্রামের জন্য থামল উভয় দল। মংসুই-এর লােকেরা ছোট ছড়া থেকে ছােট ছােট চিংড়ি (ইছা মাছ) মাছ ধরে রান্না করে পরিতৃপ্তির সঙ্গে তা আহার করল। ছােট ভাই অংসুই-এর লােকেরা নদী থেকে বড় বড় চিংড়ি মাছ ধরে তা সেসব রান্না করার সময় অংসুই লাল চিংড়িগুলাে দেখে মনে করল চিংডিগুলে রক্ত অধিক থাকায় সিদ্ধ হচ্ছে না।

কেননা সিদ্ধ হলেই চিংড়িগুলাে সাদা হয়ে যাবে। তাই যাতে চিংড়িগুলাে তাড়াতাড়ি সিদ্ধ হয়ে সাদা হয়ে যায়, চুলায় আরো লাকড়ি দিয়ে দীর্ঘক্ষণ রান্না করার জন্য তার লােকদের আদেশ করল । তাদের এই বিলং দেখে মংসুই তার দলবল নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলাে এবং তার ছােটভাই অংসুইকে ডেকে বলল,

আমাদের বনাঞ্চল ফেলে অনেকদূর যেতে হবে, এখন রওনা না দিলে রাত্রি হবার আগে এই বনাঞ্চল অতিক্রম করতে পারব না। আমরা অগ্রসর হচ্ছি। তােমরা তােমাদের সময় হলে রওনা দিও। আমরা যেই পথে অগ্রসর হই কলাগাছ কেটে চিহ্ন রেখে যাব, তােমরা সেই চিহ্ন দেখে আমাদের অনুসরণ করিও।’ এই বলে তারা চলে গেল।

দীর্ঘক্ষণ চিংড়ি মাছ রান্না করে অংসুই-এর লােকেরা ভাত খেতে খেতে রাত হয়ে গেল। রাত্রে মুষলধারে বৃষ্টি হল। ফলে মংসুই-এর লােকেরা যাবার পথে যে কলাগাছ কেটে গেছে, সেই কলাগাছের আগায় ‘ডিগ’ উঠে বেশ লম্বা হয়েছে। সেসব দেখে অংসুই এবং তার লােকেরা ভাবল, অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে, মংসুই এর দলকে তারা নাগাল পাবে না। তাই তারা বনের অন্য প্রান্তে গিয়ে পুনরায় পূর্বেকার জায়গায় ছড়িয়ে গেল এবং অন্য কোথাও বিস্তৃত হয়ে গেল।

জনশ্রুতি অনুসারে জানা যায়, এই মংসুইকে চাকমা এবং তঞ্চঙ্গ্যারা (দাইনাক) মইসাং রাজা বলে। দান্যাওয়াদি আরেতবুং-এ বলা হয়েছে মংসােয়ে। মংসােয়েম পুত্র মারেক্যজ হচ্ছে আরাকান ত্যাগী পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথম প্রবেশকারী সাক (কি চাকমা?) দলের নেতা।

পঞ্চদশ শতাব্দীর গােড়ার দিকে উত্তর আরাকানের সাকদের একটি দল চট্টগ্রামের বড়ুয়াদের (বাঙালি বৌদ্ধ) সঙ্গে একত্রিত হয় এবং আরাকান রাজ্যের অরাজকতার সুযােগে কলদান নদীর উজানে সংঘবদ্ধভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে চেষ্টা করে। দাইনাকেরাও সাক এবং বাঙালি বৌদ্ধদের সঙ্গে একতাবদ্ধ হয়। এই সংঘবদ্ধ তিনটি দল অক্সা (বার্মা) রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যায় । কিন্তু অক্সা রাজার কাছে

তারা পরাজিত হয় এবং তাদের উপর নিষ্ঠুর অত্যাচার নেমে আসে। অত্যাচার থেকে আত্মরক্ষার জন্য অনেকেই আরাকান ত্যাগ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে চলে আসে।তঞ্চঙ্গ্যাদের  প্রচলিত কাহিনী থেকে জানা যায়, যেই সকল লােক পার্বত্য চট্টগ্রামে মাতামুহুরী অববাহিকায় প্রথম প্রবেশ করে তারা সাপ্পেই (সাপ্রেই)। উল্লেখ্য যে, তঞ্চঙ্গ্যাদের ধন্যাগসা, মেলংগসা, লাংগসা লােকদিগকে এখনা সাপ্পেই বলা হয়।

১৪১৮ সালে, সাপ্পেই গােত্রীয়সহ আরাকান থেকে একদল লােক গভীর জঙ্গল অতিক্রম করে আলিকদমে প্রবেশ করে। সেই সময় চট্টগ্রামের শাসনকর্তা ছিলেন জামালউদ্দিন। তিনি আরাকান থেকে আগত লােকজনকে মাতামুহুরী অববাহিকায় বারটি গ্রামে বসবাস করার অনুমতি প্রদান করেন।

ঐ বারােটি গ্রামকে বারাে তালুক নামে অভিহিত করা হয়। আবার এই বারাে তালুক দাইনাকদের বারাে গসা’র (গৌঝা) নামে নামকরণ করা হয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে তাদের সর্বপ্রথম বসতি স্থান হচ্ছে মাতামুহুরী নদীর অদূরের উপনদী তৈনছং (মারমারা তৈনছং বলেন) বা তৈনছড়ি।

এই তৈনছড়ি নামের তাদের বসতি স্থানের নাম হতেই তাদের তৈনচংগ্যা (তঞ্চঙ্গ্যা) নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত পাওয়া গিয়েছে। তবে মারমা, রাখাইন ও বর্মীদের কাছে এখনাে দাইনাক নামেই পরিচিত । দান্যাওয়াদির দাইনাকেরা এভাবে তৈনছং এর অধিবাসী বলে ‘তঞ্চঙ্গ্যা’ নামে পরিচিত হয়ে গেল।

পঞ্চদশ হতে সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যে তঞ্চঙ্গ্যাগণ আলিকদম বা মাতামুহুরী অবাহিকা থেকে পশ্চিম দিকে বিস্তার লাভ করে। কেউ কেউ দক্ষিণে নাক্ষ্যংছড়ি, উখিয়া, টেকনাফ গিয়ে থিতু হয়। অধিকাংশ ক্রমে ক্রমে শঙ্খ নদীর অববাহিকা এবং চট্টগ্রামের পূর্বাঞ্চল এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের মধ্য ও দক্ষিণ অঞ্চলে বসতি গড়ে তােলে।

বর্তমানে বান্দরবান জেলার রােয়াংছড়ি, চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনীয় থানা, পার্বত্য চট্টগ্রামের রাইনছং (রাইংখ্যং), রাজস্থলি, হােয়াগ্না, রাঙ্গামাটি সদর প্রভৃতি অঞ্চলে তারা বসবাস করছে। জুরাছড়ি উপজেলার দুমদুম্যাতেও তাদের বসতি আছে।

 

 

ঐতিহাসিক ভূমিকা

জনশ্রুতি আছে, আছে এদেশে দাইনাকদের দ্বিতীয়বারের মতাে ১৮১৯ সালে আগমন ঘটে। আরাকান হতে ৪০০০ তঞ্চঙ্গ্যা তাদের দলপতি ফাপ্রুর নেতৃত্বে রাজা ধরম বক্স খাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তারা চাঁদা সংগ্রহ করে চট্টগ্রাম শহরে পর্তুগিজ বণিকদের থেকে একটি কুঠিবাড়ি ক্রয় করে রাজা ধরম বক্স খাঁকে শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ উপহার প্রদান করেন।

কিন্তু ৪০০০ তঞ্চঙ্গ্যা তাদের  দলপতি ফাপ্রুকে দলপতি মেনে নেবার জন্য রাজা ধরম বক্স খাঁর নিকট আবেদন করলে রাজা ধরম বক্স খাঁ তাদের দাবি না মানায় তাদের মধ্য থেকে অনেকেই আরাকান ফিরে যায়। রাজা ধরম বক্স খাঁকে উপহার প্রদত্ত কুঠি বাড়ি এখন কমিশনারের বাংলাে রূপে টিকে আছে।

১৯৫২ সালে বাঙালিদের ভাষা আন্দোলনের সময় এই প্রবন্ধের লেখক বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা দক্ষিণ রাঙ্গুনীয়া শিলক উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণীর ছাত্রাবস্থায় ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি বিদ্যালয়ের ছাত্রদের সংগঠীত করে (অন্যান্য ছাত্র নেতৃবৃন্দের সহযােগে) ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ এই স্লোগান দিয়ে রাস্তায় মিছিল করেন। তিনি তখন থেকে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চা করেন।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণে বান্দরবানে কালামন তঞ্চঙ্গ্যা শহীদ হন। বর্তমানে ১০০ ওয়াগ্না মৌজার প্রাক্তন ইউপি চেয়ারম্যান অনিল তঞ্চঙ্গ্যা একজন মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ আরম্ভ হলে, পাকিস্তানি সৈন্য ও পাঞ্জাবি পাঠানদের অত্যাচারে লাখো লাখো বাঙালি দেশ ত্যাগ করে ভারতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে।

বহু নর-নারী ভারতের পূর্বাঞ্চল মিজোরাম রাজ্যে আশ্রয় লাভের লক্ষ্যে রাজস্থলী, বান্দরবান, রাইংখ্যং বনাঞ্চল অতিক্রম করে সেখানে গমন করে। এই সমস্ত পথ তঞ্চঙ্গ্যাদের অধ্যুষিত স্থান। তঞ্চঙ্গ্যা গণ এসব অসহায় শরণার্থীদের খাদ্য-দ্রব্য ও আশ্রয় প্রদান করে এবং তাদের পথ প্রদর্শন করে নিরাপদ স্থানে পৌঁছতে সহায়তা করেছিল।

ষাটের দশকে পাকিস্তান সরকার আওয়ামী লীগ নেতা স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় প্রধান আসামী করে গ্রেপ্তারি পরােয়ানা জারি করেছিল,তখন তিনি কক্সবাজারের উখিয়া থানার তঞ্চঙ্গ্যা পাড়া ফেল্যা রােয়াজা (কার্বারী) এর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই কথা এলাকার সবাই জানে এবং এখনাে বলে থাকে। গ্রামের নাম শিলছড়ি।এই সংবাদ দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।

দেশ স্বাধীন হবার পর ফেল্যা রােয়াজা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে ঢাকায় গিয়ে সাক্ষাৎ করেন। বঙ্গবন্ধুর সহায়তায় ফেল্যা রােয়াজা স্থানীয় প্রভাবশালী আহম্মদ মাতব্বর, কালাচান সিকদার কর্তৃক বেদখলকৃত তাঁর জায়গা জমি ফেরত পান। রামু থানার মণ্ডলপাড়া নিবাসী কক্সবাজার মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর ওসমান সরওয়ার।

১৯৯৬ সালে নির্বাচিত সেই এলাকার এমপি (সাংসদ) প্রফেসর ওসমান সরওয়ার ফেল্যা রােয়াজার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আগরতলা ষড়যন্ত্রের আসামী অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ফেল্যা রােয়াজা নিজের জীবন বাজি রেখে আপন গৃহে আশ্রয় দিয়েছিলেন তজ্জন্য স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীগণ ফেল্যা রােয়াজার প্রতি কৃতজ্ঞ বলে জানা গেছে। এলাকার এই ঘটনার কথা সবাই জানে।

সম্প্রতি তিনি উক্ত এলাকা ভ্রমণ করে এই তথ্য সংগ্রহ করেছেন। ফেল্যা রোয়াজার পৌত্র বাবু চানের ছেলে শৈচাঅং তঞ্চঙ্গ্যা, চাইলাঅং তঞ্চঙ্গ্যা, রুইম্রাঅং এখনাে বেঁচে আছে।

 

 

তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সামাজিক সংগঠন

গােত্র 

তঞ্চঙ্গ্যাদের বংশ পরিচয় পিতসূত্ৰীয়। তঞ্চঙ্গ্যাদের সর্বমােট বারােটি গােত্র আছে।কথায় গােত্রকে ‘গসা’ বলা হয়। এই হিসেবে মােট বারােটি গসা রয়েছে এগুলি হচ্ছে ১. মােঅ গসা, ২, কারওয়া গসা, ৩. ধন্যা গসা, ৪. লাং গসা, ৬. মংলা গসা, ৭. অঙ্য গসা, ৮. তাসসি গসা, ৯. রাঙা গসা, ১১. মুলিমা গসা এবং ১২. ওয়াহ্ গসা। এই গসাগুলি আবার গুত্তিতে বিভক্ত। সেগুলি নিম্নরূপ-

 

ক্রম গসা গুত্তি 
মোয় গসা তাসি গুত্তি,দাল্লোয়া গুত্তি,আগারা গুত্তি, কুরুগা গুত্তি,গন্যা গুত্তি,আগা গুত্তি, খুসসা গুত্তি, কবাল্যে গুত্তি
কারওয়া গসা আরওয়া গুত্তি, গসাল্যা গুত্তি, বলা গুত্তি, বাংগাল্যে গুত্তি, ফ্রাংসা গুত্তি ,লাম্বায়া গুত্তি,বকচারা গুত্তি,বুং গুত্তি,লাপস্যা গুত্তি, যৌ গুত্তি
ধন্যা গসা পিসো গুত্তি, পোসোই গুত্তি,বাংগাল্যা গুত্তি, বলাহ গুত্তি,বান্দব্যা গুত্তি, রাংগা গুত্তি,কালামেলা গুত্তি,কালাথংসা গুত্তি,রাংগাকাংগারা গুত্তি , বউ গুত্তি, কালাংসা গুত্তি , পন্ডিত গুত্তি, কাট্টল্যা গুত্তি,দাল্লোয়া গুত্তি, পন্ডিত গুত্তি,কাট্টল্যা গুত্তি, দাল্লোয়া গুত্তি, তান্ন্যাবো গুত্তি, আমিলা গুত্তি, বগা গুত্তি,বন্দুগ গুত্তি
৪ = লাংবাসা গসা সক্যা গুত্তি ,বলাহ গুত্তি,লাম্বাইয়া গুত্তি,কারু গুত্তি, বেদাব গুত্তি, আবাংগ্যা গুত্তি, পায়া গুত্তি
মেলং গসা আমিলা গুত্তি , টেমেলে গুত্তি, আলু গুত্তি, পাকতা গুত্তি, রানদাঙ্গর গুত্তি
মংলা গসা পালংসা গুত্তি , ভাবুন্যা গুত্তি,কালাইয়া গুত্তি,দেবা গুত্তি,নালাবা গুত্তি, নাবানা গুত্তি
অঙ্গয়া গস্য
তাসিস গস্য
রাংগ্যা গসা
১০ লাপোস্যা গসা
১১ মুলিমা গসা
১২ ওয়া গসা

 

পরিবারের ধরন 

তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর মধ্যে একক ও যৌথ পরিবার লক্ষ করা যায়। তবে যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে যৌথ পরিবার এখন নেই বললেই চলে। পরিবারের ধরন কী রকম তা নিম্নে বর্ণনা করা গেলঃ

১। স্বয়ং/ কর্তা ,স্ত্রী, এবং অবিবাহিত পুত্র কন্যাগণ।

২। স্বয়ং/ কর্তা, অবিবাহিত পুত্রকন্যা, নির্ভরশীল পিতামাতা এবং অবিবাহিত আত্মীয়গণ (যদি থাকে)।

৩। স্বয়ং/কর্তা, স্ত্রী, বিবাহিত একজন পুত্র ও তার স্ত্রী পুত্র কন্যাগণ।

৪। বিবাহিত আত্মীয়গণ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত নহে।

৫। তঞ্চঙ্গ্যা পরিবার পিতৃতান্ত্রিক।

একই ছাদের নিচে বসবাসরত সাধারণ একটি তঞ্চঙ্গ্যা পরিবারের নমুনা বা ধরন হচ্ছে এরূপ। গৃহকর্তা, তার স্ত্রী এবং তার অবিবাহিত সন্তান-সন্ততি । বিবাহিত একটি পুত্র (যদি থাকে)। তারা সকলেই পরিবারের জন্য কাজ করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে, গৃহকর্তার বয়স্ক বা নির্ভরশীল পিতামাতা এবং অসহায় আত্মীয় স্বজন ও পরিবারের অন্তর্ভুক্ত থাকে।

তবে নাবালক পুরুষ আত্মীয় গনের মধ্যে বিবাহ হয়ে গেলে তারা অন্যত্র ঘর বাঁধে বা পরিবার গঠন করে। গৃহকর্তার একাধিক পুত্রসন্তান থাকলে একটি মাত্র বিবাহিত সন্তান তার পরিবারে থাকে; অন্যান্যরা (বিবাহিত) অন্যত্র ঘর তুলে বসবাস করে। এর কারণ হয়ত বসতি ঘরের গঠন প্রণালীর কারণে, ঘরের নমুনা অনুসারে ঘরে থাকার জায়গা সমস্যার হেতুতে বিবাহিত একাধিক সন্তান একই ঘরে বসবাস করতে পারে না।

তবে গৃহকর্তা, ঘর থেকে চলে যাওয়া বিবাহিত পুত্রদের ঘর করার জন্য নিজস্ব জমিতে (যদি থাকে) তাদের ভূমি প্রদান করে। গৃহে বসবাসরত বিবাহিত পুত্রের সন্তান-সন্ততি এবং ‘বেলক’ (পৃথক) হয়ে যাওয়া বিবাহিত পুত্রদের সন্তান-সন্ততি পরবর্তী প্রজন্ম হয়ে জন্মায়।

অবিবাহিতা কন্যারা ও পিতামাতা বা পরিবারের অন্যান্যদের সঙ্গে জুম অথবা অন্যান্য ক্ষেত্রে (জীবিকা অবলম্বনের জন্য যেই বৃত্তি অবলম্বন করা হয়) কাজে সহায়তা করে। বিবাহের পর সে স্বামীর ঘরে চলে যায় এবং স্বামীর পরিবারের একজন সদস্য হয়ে যায়।

 

 

ব্যক্তির জীবন চক্র

 ক. জন্ম : মাতৃজঠরে সাধারণত দশমাস অবস্থানের পর একটি তঞ্চঙ্গ্যা শিশু ভূমিষ্ঠ হয়। গর্ভবতী মহিলার সন্তান প্রসবের সময় হয়ে আসলে ,যদি ধাত্রী ( তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় ‘অসা মেলা’ বা ‘ অসাবুড়ি’) পাড়ায় বা কাছাকাছি না থাকে তাহলে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সম্ভাব্য দিন তারিখের আগে থেকে বাড়িতে এনে রাখাঁ হয়।

গর্ভবতী মহিলার সন্তান প্রসবের কয়েকদিন আগে পর্যন্ত সংসারের গৃহস্থালি ( রান্নাবান্না ইত্যাদি) হাল্কা কাজ করে থাকে। সেসময় তাকে গৃহ থেকে দূরে যেতে দেয়া হয় না।

সন্তান প্রসবের দিন গর্ভবতী মহিলার প্রসব বেদনা শুরু হলে তাকে লাগোয়া বধিত ঘরের কোন কক্ষে (এই বর্ধিত ঘরটি সাধারণত শস্যাদি এবং গৃহস্থালী সরঞ্জামাদি রাখার জন্য নির্মাণ করা হয়) পরিচ্ছন্ন বিছানায় যেতে  দেয়া হয়। গৃহে অবস্থানকারী ‘অসামেলা’/’অসাবুড়ি’ (গ্রামের ধাত্রী) তাড়াতাড়ি তার কাছে যায়।

সন্তান প্রসবের সময় হলে ঘরের কিংবা প্রতিবেশী অপর মহিলা অসামেলাকে সহায়তা করে থাকে। পুরুষেরা সেখানে সাধারণত থাকে না, তারা ঘরের বাইরে থাকে। হবু সন্তানের পিতা অসহায় দর্শক হয়ে অপেক্ষা করতে থাকে এবং নবজাত শিশুর ক্রন্দন ধ্বনি ও পুত্র বা কন্যা এ দুটো শব্দের যে কোনাে একটি শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে। পুত্র সন্তান সব সময় প্রত্যাশা করা হয়। কেননা সে বড় হলে পিতৃগৃহের কর্মীদের সহায়তা করবে।

শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গর্ভাশয় থেকে পৃথক করার জন্য একটি দুলুক’ (বাঁশের ধারালো নিল) দিয়ে  নবজাতকের নাড়ী কর্তন করে দেয় অসামেলা এবং এই নাড়ীর কর্তিত স্থানে সুতা পাকিয়ে দড়ি বানিয়ে বেঁধে দেয়া হয়। গর্ভাশয় পৃথক করে একটি মাটির পাত্রে রেখে অনতিবিলম্বে ঘরের মাচাং এর নিচে (আমত্তলে) অথবা সাঁকোর বা ঘরের সিঁড়ির গোড়ায় মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়।

গর্ভাশয়ের তঞ্চঙ্গ্যাদের কথায় ‘ঘরপাদা’ বলে এবং তঞ্চঙ্গ্যাদের বিশ্বাস, যদি এটা ঘরের থেকে দূরে পুঁতা হয়, নবজাতক বড় হলে ভবঘুরে হবে। সেজন্য ঘরপাদা ঘরের সীমানার মধ্যে পুঁতে ফেলা হয়।শিশু ভূমিষ্ঠ হবার সঙ্গে সঙ্গে ঈষৎ উষ্ণ জলে স্নান করিয়ে শুকনাে এবং পরিষ্কার কাপড়ে জড়িয়ে শিশুকে শুকনো এবং উষ্ণ রাখা হয়।

তারপর প্রসূতি ও শিশুকে ছিমছাম বিছানায় থাকতে দেয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রসূতির পাশে ঘরের মাচাং এ মাটি তুলে উনুনশাল বানিয়ে সেখানে আগুন রাখার ব্যবস্থা করা হয়। যাতে প্রসূতি শীত নিবারণ এবং শরীর বা কাঁকালের ব্যথা দূর করতে পারে।

 যতদিন পর্যন্ত নবজাতকের নাড়ি খসে না পড়ে এবং ‘ঘিলা কোজোই’ (ঘিলা শাঁস) পানি দিয়ে শুদ্ধ সাঙ্গ এবং নদীতে স্নান করে পবিত্র না হয়, ততদিন পর্যন্ত মা ও সন্তান অশুচি হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। প্রসূতি ততদিন পর্যন্ত পরিবারের ব্যবহৃত হাঁড়ি পাতিল ও অন্যান্য দ্রব্যাদি স্পর্শ করতে পারে না এবং রান্নাবান্না কাজো দূরের কথা।

ঘিলাকোজোই পানি দিয়ে শুদ্ধসাঙ্গ (শুচি) হয়ে প্রসূতি অসামেলার সঙ্গএন্দীতে গিয়ে স্রোতে স্নান করে পরিশুদ্ধ হয়ে ঘরে ফিরে এসে ঘিলাকোজাই, সোনা রুপা ভিজানো পানি ( অনেকে কাঁচা হলুদের টুকরা ঐ পানিতে রাখে) প্রসূতির মাথায়,দেহে ছিটিয়ে দিয়ে শুচি করলে,প্রসূতি গৃহস্থালির সকঅল কাজে হাত দিতে পারে এবং তার স্পর্শ করা দ্রব্যাদি অপরে গ্রহন করতে পারে।

অসামেলা একটি ‘রাদাকুড়া’ বা আস্ত মােরগ প্রাপ্য হয় । সঙ্গে এক বা একাধিক ধেনোমদ-এর বোতল প্রাপ্য। বোতলগুলো বড় ‘চারপাত্তেয়া’ (চারকোণা বিশিষ্ট) হতে হয়। পূর্বে অসামেলাকে মাত্র একটি রৌপ্য মুদ্রা দেওয়ার রেওয়াজ ছিল বা বলা হতো‘না-ই-কাবা-টেঙা’ অর্থাৎ নাড়ী কাটা টাকা।

এটা অসামেলার পক্ষে খুব সম্মানসূচক ব্যাপার। বর্তমানে রৌপ্য টাকা প্রায় দুষ্প্রাপ্য, তাই কাগজের নোটে এই সম্মানী দেওয়া হয়। তবে পরিমাণে অনেক বেশি। সন্তান পুত্র বা কন্যা যাই হােক, দম্পতির মনোবাঞ্ছা অনুযায়ী হলে অনেকে অসামেলাকে খুশিমতো পুরস্কৃত করে থাকেন। কোজোই পানি ল-না উপলক্ষে বুড়াে-বুড়ি, আত্মীয়-স্বজন এবং প্রতিবেশী লােকজনকে ভুঁড়ি ভোজে আপ্যায়িত করা হয়।

 

খ. শৈশব : নবজাতকের নাম রাখার সময় অনেকেই সাধ্যমত আনুষ্ঠানিকতা করতে দেখা যায়। অনেক পিতা-মাতা কন্যা সন্তান হলে সেই সন্তানের পিনুইন, খাদি পরিধানের সময় হলে আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে প্রতিবেশী লোকজনদেরকে সাধ্যমত ভােজনের দ্বারা আপ্যায়ন করার জন্য মানত করে।

সেরকম কন্যার কর্ণে ‘রাজজুর’ বা অন্য অলংকার পরিধানের জন্য কানে ছিদ্র করার মানতও করে থাকে। আবার পুত্র সন্তান হলে ধুতি পরিধানের বয়স হলে ধুতি পৌই (আনুষ্ঠানিকভাবে ধুতি পরিধান করানো) এর মানত করে। বলাবাহুল্য এই অনুষ্ঠানেও প্রতিবেশী লোকজনদিগকে সাধ্যমত খাওয়ানো হয় এবং কন্যা সন্তান কে পিনুইন পোই , খারি পোই , কানবেড়া পৌই বলা হয় ।

তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে একটি বিশেষ প্রথা অদ্যাবধি প্রত্যন্ত অঞ্চলে চালু আছে। এই প্রথাটি তঞ্চঙ্গ্যাদের  সমগোত্রীয় (একই শাক্য গােত্রীয়) চাকমাদের কিংবা এতদঞ্চলে  বসবাসরত নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে দেখা যায় না। প্রথাটি হচ্ছে এই, যদি কোনো বধূ তার প্রথম সন্তান ভাদ্র মাসে জন্ম দেয়, তাহলে সেই সন্তান কে প্রকৃতির কাছে উৎসর্গ করতে হয় নদীতে ভেলার উপর তুলে ভাসিয়ে দিয়ে।

এর কারন কোনো নববধূর প্রথম সন্তান ভাদ্র মাসে জন্মগ্রহণ করলে বিশ্বাস করা হয় যে , সেই সন্তান দুর্ভাগ্য নিয়ে জন্মগ্রহন করে। এজন্য বাঁশের ভেলা কিংবা কলাগাছের ভেলার উপর তুলে দূর্ভাগ্য হরণের (অপনোদনের) লক্ষ্যে গঙ্গা মায়ের ( গংগাদেবী) উদ্দেশ্যে ভাসিয়ে দেয়া হয়।

সন্তানের মা যদি তাতে অসম্মত হয়, তাহলে মাকেও সন্তানের ভেলায় তুলে দিয়ে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। আগে থেকেই কোনো না কোন ব্যাক্তিকে কিংবা অসামেলাকে ঠিক করে রাখা হয় যাতে সে ভেলা কিছুদূরে ভেসে যাওয়ার পরে নদী( বিশেষত ছোট স্রোতস্বিনী ) থেকে ভেলা ( মা ও সন্তান সহ ) উদ্ধার করে।

যদি এরকম পূর্ব থেকে ঠিক করা না থাকে , তাহলে  অপর কোনো ব্যক্তি যে প্রথম ঐ ভেলাকে দেখতে পায় এবং উদ্ধার করে , সেই ব্যাক্তিই এই  মা ও শিশুকে দাবী করতে পারে। সে তার ইচ্ছেমত মা ও শিশুকে নিজের কাছে রাখতে পারে অথবা কারো কাছে অর্পন করতে পারে।

সাধারণত এরকম অবস্থায় বধূটির আইনগত স্বামী উদ্ধারকারীকে উপযুক্ত সম্মানী/ ক্ষতিপূরন দিয়ে স্ত্রী ও সন্তাঙ্কে ফিরিয়ে নিতে পারে । এভাবে দুর্ভাগ্য নিয়ে ভাদ্র মাসে জন্ম গ্রহনকারী শিশু দুর্ভাগ্য হতে মুক্তি লাভ করে সৌভাগু স্পর্শ করে বলে তঞ্চগ্যা সমাজে বিশ্বাস প্রচলিত আছে । 


গ. বিবাহ ব্যবস্থা : তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে বিবাহ রীতি বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে স্বীকৃত বিবাহের পূর্বশর্ত হচ্ছে ‘জড়া বানা’ (জুর গেট) এবং চুমুলাঙ পূজা অনুষ্ঠান। এই সামাজিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিবাহিত তঞ্চঙ্গ্যা দম্পতি একত্রে বসবাস ও জৈবিক মিলনের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের অধিকার লাভ করে।

তঞ্চঙ্গ্যা পুরুষ বিবাহযােগ্য হলে বিবাহের পূর্বে তাকে অবশ্যই ন্যূনপক্ষে তিনদিন শ্ৰমন হয়ে (প্রবজ্যা গ্রহণ) শ্ৰামন্য ধর্ম পালন করতে হয় ।তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবার জন্য পাত্র-পাত্রীর বেলায় সুনির্দিষ্ট কোনো বয়সসীমা বা কোনাে সুনির্দিষ্ট যােগ্যতার মাপকাঠি নেই।

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে প্রচলিত ধ্যান-ধারণা অনুসারে বিবাহের ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রীর  ১. সাবালক বা প্রাক্ত বয়স্ক হতে হবে, ২. শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ হতে হবে এবং ৩. শারীরিক অসামর্থ্য, যেমন কানা, বোবা, খোঁড়া নর-নারী অবশ্য বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ পারবে যদি বিবাহের ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রী উভয়ের বিয়েতে সম্মতি থাকে।

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে সাবালকত্ব অর্জনের মাপকাঠি সমাজের অনুমান বা ধারণার ঊপর সচরাচর নির্ভরশীল। সাধারণত পাত্র নিজের শ্রম দ্বারা বা উপার্জনের মাধ্যমে ভরণপোষণ করার সামর্থ্যবান হলে বিয়ের উপযুক্ত বয়স হয়েছে বলে বিবেচনা করা হয়। পাত্রীর বেলায় রজঃ প্রবৃত্তি হওয়া এবং ঘরকন্না।

বুনন বা জুম ও  ক্ষেতের কাজ করার যোগ্য হলে তাকে বিয়ের উপযোগী বলে বিবেচনা করা হয়। তঞ্চঙ্গ্যাদের গ্রামীন সমাজে ১৫ হতে ১৮ বছর বয়সে বিয়ের প্রবণতা লক্ষ করা যায়, তবে সমাজে বাল্য বিবাহের প্রচলন নেই। বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য কতিপয় অনুসরণীয়/ পালনীয় রীতিনীতি আছে। যথা-

ক। সাধারণভাবে একজন তঞ্চগ্যা পুরুষ একজন তঞ্চগ্যা মহিলাকে বিবাহ করবে।

খ। পাত্র-পাত্রীকে বিবাহ নিষিদ্ধ সম্পর্কের আওতা বহির্ভূত করতে হবে।

গ। পাত্র-পাত্রীকে রক্ত সম্পর্কিত বিধি-নিষধ মেনে বিয়ে করতে হবে।

ঘ। পাত্র-পাত্রীকে জোড়া বন্ধন ( ল্লাত্তং বানা/ জুর গেট/ ফংগরানা) অবশ্যই সম্পন্ন করতে হবে।

তঞ্চগ্যা সয়াজে বিবাহের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ সম্পর্ক পাত্র-পাত্রীর মধ্য বিবাহ হতে পারে না । নিম্ন বর্ণিত আত্মীয় সম্পর্কের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক নিষদ্ধ বলে গণ্য করা হয়। যেমন-

ক। একই গোত্রের(গুত্তি) যে কোনো আত্মীয়ের মধ্যে গোত্র বিশেষে তিন পুরুষ অতিক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত ; 

খ। মামা-ভাগ্নির মধ্যে; 

গ। পিসি-ভাইপাের মধ্যে;

 ঘ। কাকা-ভাইঝির মধ্যে;

 ঙ। মাসি-ভাগিনার মধ্যে;

 চ। স্ত্রীর আপন বড় বােনের সাথে;

 ছ।বিমাতার সাথে

 জ।একই পিতার ঔরসে ভিন্ন ভিন্ন মায়ের গর্ভজাত ছেলে-মেয়ের মধ্যে (সৎ ভাই ও বােনের মধ্যে);

 ঝ। ভ্রাতুস্পুত্রের স্ত্রীর সঙ্গে; 

ঞ। ভাগিনার স্ত্রীর সঙ্গে;

 ট। মামি সম্পকীয় আত্মীয়ার সঙ্গে;

 ঠ।কাকি/জেঠি সম্পর্কীয় আত্মীয়ার সঙ্গে; 

ড।তালতাে ভাইয়ের সঙ্গে আপন কন্যার এবং

 ঢ।দত্তক পুত্রের/কন্যার সাথে আপন পুত্র কন্যার বিবাহ নিষিদ্ধ।

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে  সাধারণত তিন প্রকার বিবাহ পদ্ধতি চালু আছে। যথা : ক। কন্যার গৃহে বরকে নিয়ে (সামাজিক/নিয়মিত) বিবাহ;

 খ। মনমিলনে পাত্র- পাত্রীর পলায়নের মাধ্যমে (অনিয়মিত) বিবাহ এবং

 গ। রানী মেলার সাঙা অর্থাৎ বিধবা বিবাহ।

 

ক. কন্যার গৃহে বরকে নিয়ে সামাজিক বা নিয়মিত বিবাহ : তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে যত প্রকার বিবাহ পদ্ধতি চালু থাকুক ,উহাদের মধ্যে একটি মাত্র সামাজিক প্রথাসিদ্ধ বিবাহ রীতি হল আলাপ আলোচনার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে বিবাহকর্ম সম্পাদন করা। ছেলের জন্য বৌ আনয়নের সময় হলে ছেলের বাবা কোনো এক মনোনীত করা।

ছেলের জন্য বৌ আনয়নের সময় হলে ছেলের বাবা কোনো এক মনোনীত মেয়ের বাবা বা অভিভাবকের কাছে খবর দেন যে, তিনি মেয়ের বাবা বা অভিভাবকের কাছে এক পিলাং মদ ( মদ বোতল) উপস্থাপন করতে চান। এই কথায় মেয়ের বাবা বা অতিতাৰ বুঝতে পারেন যে, তাদের মেয়েকে জন্য বৌ নিতে চায়।

মেয়ের পক্ষ ওদের ঘরে বিবাহ দেবার ইচ্ছা থাকলে ওই প্রস্তাবে সম্মতি প্রকাশ করেন। অতপর ছেলের বাবা বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য পরপর তিনবার মেয়ের বাবার গৃহে যাতায়াত করেন। এই তিনবার যাতায়াতের মধ্যে পাত্র-পাত্রীর বিবাহের কথা পাকাপাকি হয় । বলাবাহুল্য প্রত্যাক বারে পাত্রীর গৃহে আত্মীয়-স্বজন ,পাড়ার মুরব্বিগণ উপস্থিত থাকেন।

তাদের সবার পরামর্শ আলোচনার মাধ্যমে বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়। সেই সময় বিবাহে কিছু ধরাবাঁধা হয় এবং পাত্রী বা কনের জন্য পোশাক ,অলংকার ইত্যাদি সম্পর্কেও দাবি-দাওয়া করার নিয়ম আছে।

অতপর বিবাহের দিনে বরকে সাজিয়ে কনের গৃহে নেওয়া হয়। বরের পেছনে বরের ছােট বােন অথবা ঐ সম্পর্কের পাড়ার কোনাে কিশােরী অথবা যুবতী মেয়ে বরের মাথার পাগড়ির এক প্রান্ত হস্তে ধারণ করে মাথায় ‘ফো কালং’-এ ভরে কনের গৃহে যাত্রা করে। ‘ফো কালং’ অর্থ কনের জন্য নতুন পোশাক ও গহনা পত্রাদি ভর্তি একটি শিল্প সম্মত, কারুকার্য খচিত বেতের ঠুরুং বিশেষ।

যথাসময়ে বরপক্ষ কনের গৃহে পৌঁছলেও তাদেরকে সরাসরি গৃহে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। বরপক্ষ পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে কনেকে গৃহের মধ্যবর্তী কোনাে এক কক্ষে কাপড়ের আড়ালে রাখা হয়। এটাকে বলা হয় ‘বৌ লুগানা’ অর্থাৎ বৌ লুকানাে। কনের সাথে আরও দু-একজন যুবতী মেয়ে যারা কনের বান্ধবী, লুকানো অবস্থায় থাকে।

মজার ব্যাপার, যতক্ষণ কনেকে গােপন কক্ষে লুকানাের কাজ সম্পন্ন না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত বরপক্ষকে গৃহের উঠানেই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। কনে লুকানাের কাজ শেষ হলে, কনে পক্ষের একজন (কনের বড় ভগ্নিপতি সম্পর্ক) এসে বরের মাথার সামান্য উপর ভাগে হাতে ধরা একটা মুরগির ডিম শূন্যের বেশ কয়েকবার ঘুরিয়ে দিয়ে ডিমটা বরের পেছনের দিকে দূরে ছুড়ে ফেলে।

এবং বরের হস্তে ধারণ করে যেখানে কনেকে লুকানাে হয়েছে, তার পাশ্বে পাতানো বিছানায় বরকে বসিয়ে দেয়। এটাকে বলা হয় ‘জামাই তুলা’।

অতপর ‘ফো কালং’ থেকে যাবতীয় পোশাক ও গহনা পত্রাদি বের করে একটি কুলায় স্থাপন করে কনে পক্ষকে উপস্থাপন করা হয় এবং বিয়ের কথা পাকাপাকি করার সময় কনের জন্য পােশাক ও অলংকারাদি যে রকমের ঠিক করা হয়েছিল সেই রকমের ঠিক ঠিক হয়েছে কিনা তা দেখতে অনুরােধ জানানাে হয়।

কনে পক্ষ পোশাক ও অলংকার মনোমত বা পছন্দমত হলে বরপক্ষকে তাদের বৌ সাজানোর জন্য সানন্দে অনুমোদন প্রদান করে। কনেকে বর পক্ষের আনীত বস্ত্র ও গহনাদি দ্বারা সজ্জিত করত চুল আঁচড়িয়ে ভালােভাবে খোঁপা বেঁধে দিয়ে ‘বৌ সাজানাে’ সম্পন্ন করা হয় ।

অতঃপর কনের সংগে লুকানো মেয়ের কোনো একজন কাপড় উন্মোচন করত কনেকে সর্বসমক্ষে প্রকাশ করা দেয়। বরকে এমন স্থানে বসানো হয় যাতে কাপড় উন্মোচন করা সত্ত্বেও সে কনেকে দেখতে না পায়। বরকে যে ব্যাক্তি উঠান থেকে বিবাহ বাসরে আনয়ন করে এবং বরপক্ষের যে মেয়েটি কনেকে বৌ সাজায় তাদেরকে বলে ‘ছাবালা’ । উক্ত ছাবালাদ্বয় বিবাহের যাবতীয় অনুষ্ঠানাদি পরিচালনা করে থাকে।

ছাবালাদ্বয় মিলে এবার বর ও সজ্জিত কনেকে পাশাপাশি বসায়। একখণ্ড শ্বেত বস্ত্র দ্বারা ( সাধারণত সাত হাত দীর্ঘ হয়) বর ও কনেকে কোমরে জড়িয়ে দেয়। কনে সাধারণত বরের বাম পার্শ্বে থাকে। জড়ানাে কাপড়ে একটি গিট দিয়ে ছাবালাদ্বয় উপস্থিত গণ্যমান্য লোকদের উদ্দেশ্যে বলে

“ও বুড়াবুড়ি পাড়াল্যা গণ্যমান্য লোক,মুরব্বিগণ, অমুক এবং অমুকীর ল্লাত্তং বানি দিত্তে, তানে ফং গুরি দিবার হুগুম আগেনে নাই? অর্থাৎ ‘হে পাড়ার বৃদ্ধ বৃদ্ধা, গণ্যমান্য লােক, মুরব্বিগণ, অমুক অমুক বিবাহে জোড়া বেঁধে দিচ্ছি আপনাদের হুকুম অর্থাৎ সম্মতি আছে কি নাই? (ল্লাত্তং অর্থাৎ চাকমাদের জুরগেট-ফং অর্থে একত্রিত করা। ঐতিহ্যগতভাবে এই ল্লাত্তং বানা (জুরগেট) তঞ্চঙ্গ্যা বিবাহের গুরুত্বপূর্ণ শর্ত।

উক্ত প্রকারে তিনবার প্রশ্ন করা হয় বা হুকুম প্রার্থনা করা হয়, কিন্তু কেবল মাত্র শেষের বারে একবার ‘আগে’ (আছে) বলে উত্তর দিলেও চলে। এরপর পুরুষ ছাবালা বরকে এবং জড়িয়ে ধরে বর কনের বসা অবস্থাতেই ৭ বার উঠানাে বসানাে করে। একে বলে বর কনে নাচানো, ‘নাচে দেনা’।

এর অর্থ হলাে বিবাহে সম্মতি প্রাপ্ত হওয়ায় বর-কনের আনন্দে নৃত্য করা। অতপর বর ও কনের ডান হাত একত্রিত  করে দিয়ে মঙ্গল ঘটের পানি সিঞ্চন করে দেওয়া হয় এবং বরের বাম হাতে ও কনের ডান হাতে ভাত, সিদ্ধ ডিম, কলা গাছের তরকাৃ গুঁজে দিয়ে উভয়ের পিছন দিক ঘুরিয়ে বর ও কনেকে ভাত খাওয়ানোর মহড়া করা হয়।

এরপর বৈদ্য বা ‘অসা’ দ্বারা চুমূলাঙ পূজা অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হলে বর ও কনেকে  উপস্থিত বয়ােবৃদ্ধদের নিকট নিয়ে গিয়ে একজন একজন প্রণাম করতে দেওয়া হয়। ঐ সময়ে বয়ােজ্যেষ্ঠরা ‘পৈদাং’ থেকে তুলা ও তন্ডুলল সহযােগে বর-কনের মাথায় ‘খবঙে’ (পাগড়িতে) গুঁজে দিয়ে আশীর্বাদ করেন।

এটাকে তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় বলা হয় ‘সেফদেনা’ অর্থাৎ আশীর্বাদ দেওয়া। বিবাহের পর বরকে ৭ দিন যাবত শ্বশুরালয়ে নব পরিনীতা বধূসহ অবস্থান করার নিয়ম আছে। অতপর কনেকে নিয়ে বর নিজে প্রত্যাবর্তন করে। বর্তমানে অবশ্য এই নিয়ম শিথিল হয়ে গেছে।

 

খ. মনমিলনে পাত্র-পাত্রীর পলায়নের মাধ্যমে (অনিয়মিত) বিবাহঃ মনমিলনে পলায়নের মাধ্যমে বিবাহ পদ্ধতি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। যেমনঃ কোন যুবক-যুবতীর বিবাহের উদ্দেশ্যে রাতে কিংবা দিনের বেলায় গােপনে কোথাও বা ছেলের গৃহে পালিয়ে যায়। উহাকে বলে ‘ধেইযানা’। ধেইযানা অর্থ পালিয়ে যাওয়া।

পরের দিন ওদের পালিয়ে যাওয়ার সংবাদ মেয়ের বাবা মায়ের নিকট পৌছানো হয় এবং সেদিন অথবা অন্য আর একদিন ছেলের বাবা কিংবা বাবার অভাবে তাভিজাত বাবার গৃহে ‘পৈ’ গুছাতে যায়। এখানে ‘পৈ’ অর্থ সম্মান প্রদর্শনের বর্জিত একটা সেদ্ধ করা গােটা মােরগ ও দুই বােতল মদ উপঢৌকনকে বুঝায়। 

বাবা মা বা অভিভাবক মেয়েকে বিবাহ দেবার ইচ্ছা থাকলে উক্ত ‘পৈ’ গ্রহণ করেন। নতুবা উক্ত ‘পৈ’ প্রত্যাখ্যান করেন এবং তাদের মেয়েকে ফেরত দিতে বলেন। উভয় পক্ষে মতৈক্য না হলে পাড়া কার্বারী, মৌজার হেডম্যান এমনকি রাজার আদালতের সালিশের মাধ্যমে জাতীয় বিচারে নিষ্পত্তি করা হয় ।

পলায়নের যে বিবাহ হয়, উহাকে বলে ‘ছিনালী সাঙা’ । ছিনালী সাঙা অর্থ দুষণীয় বিবাহ। এই জাতীয় পলায়নের ছেলে মেয়ের বিবাহ হোক বা না হোক উভয়কেই দণ্ড ভোগ করতে হয়। মেয়ের পক্ষ রাজি হলে বিবাহ দেয়া হয়। বিবাহ কর্ম সম্পাদিত হয় মেয়েদের পিতৃগৃহে। বিবাহ কোনোরূপ আড়ম্বর থাকে না।

ছেলে ও মেয়ে পলায়নের পর মেয়ের বাবা ও মা ইচ্ছা করলে বিচারের দিন মেয়েকে ফেরত নিতে পারেন। এতে কেউ বাধা দিতে পারে না। কিন্তু পর পর যদি ছেলে ও মেয়ে একত্রে মিলে তিনবার পালিয়ে যায় তৎক্ষেত্রে শেষবারে বাবা মা তাদের মেয়ের উপর আর কোনাে দাবি করতে পারে না। বিচারের আগে ছেলে ও মেয়ে যতবার পালিয়ে যাক না কেন, তাদের কেবল একবারই জরিমানা দিতে হয় ।

 

গ. রানী মেলার সাঙা অর্থাৎ বিধবা বিবাহ : তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় বিধবা রমণীকে  রানী বা ‘রানী মেলা’ বলা হয়। যদি কোনাে বিধবা রমণী পুনঃ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চায় (পাত্র বা বর অকৃতদার অথবা বিপত্নীক যেই হােক) তৎস্থলে অতি সাধারণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সেই বিবাহ কর্ম সম্পাদন করা হয়।

উল্লেখ্য যে, তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে কোর্ট ম্যারেজ-এর প্রচলন দেখা যায় না। পাত্র-পাত্রীর মনােমিলনে কোথাও পালিয়ে গিয়ে বিবাহ করার রীতি থাকায় সম্ভবত (পাত্র-পাত্রী) কোর্টে গিয়ে বিবাহ করার প্রয়ােজন হয় না। তাই এই পথে কোনো পাত্র-পাত্রী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে আগ্রহী হয় না।

 

ঘ)বৃদ্ধাবস্থাঃ বৃদ্ধাবস্থায় পিতা-মাতা পুত্রদের পরিবারে স্থান পায়। পুত্রের অবর্তমানে কন্যার গৃহে স্থান পেয়ে থাকে। পুত্র কন্যার নাতি- নাতনী কিংবা ভ্রাতুস্পুত্র বা  এরকমের আত্মীয় সম্পর্কীয় ব্যক্তির পরিবারে স্থান পায়। আত্মীয়-স্বজনহীন কোনো নারী পুরুষ বা অনাথদের বৃদ্ধ বয়সে আশ্রয় নেবার মতাে সরকারি কিংবা সামাজিকভাবে বৃদ্ধ নিবাস নেই। পুরুষেরা কেউ কেউ বৃদ্ধ বয়সে অসহায় অবস্থায় অধিকাংশ  ক্ষেত্রে প্রব্রজ্যিত হয়ে বাকি জীবন বিহার বা ক্যাঙে অতিবাহিত করে ।

 

 

মৃত্যু বা সৎকার পদ্ধতি

কোন ব্যক্তির স্বাভাবিক মৃত্যু হলে তার আত্মীয়-স্বজনদের খবর দেয়া হয় । দূরে অবস্থানকারী আত্মীয়-স্বজন তাদের মৃত আত্মীয়কে শেষ বারের মতাে যেন দেখতে পারে, তার সুবিধা অনুযায়ী মৃত ব্যাক্তিকে একদিন বা একাধিক দিন গৃহে রাখা হয়। পরিবারের কারাে মৃত্যু হলে বন্দুকের (যদি থাকে) ফাঁকা আওয়াজ (ফগা-আবাইত) করত মৃত্যুর সংবাদ সবাইকে জানিয়ে দেওয়ার নিয়ম ।

এই শুধু শুধু বন্দুকের আওয়াজ শুনলে অনেকেই কারাে মৃত্যুর কথা অনুমান করে এবং বন্দুকের আওয়াজ যে ঘর থেকে করা হয়েছে সেখানে সমবেত হয়। চাকমা সমাজেও ঘরে কারাে মৃত্যু হলে ঢােলক বাজানাে হয়; তবে ঢােলকের তালে বৈশিষ্ট্য অবশ্যই থাকে যাতে ঢােলকের আওয়াজ শুনে বুঝতে পারে কারাে মৃত্যু হয়েছে।

মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মৃতের মুখের ভিতর একটি রৌপ্য মুদ্রা প্রবেশ করানাে হয়। তার পর মৃতদেহ স্নান করিয়ে নতুন বস্ত্র পড়ানো হয়। পুরুষ হলে ধুতি/লুঙ্গি/প্যান্ট এবং জামা আর মহিলা হলে পিনুইন, খাদি, ব্লাউজ বা কোবােই সালুম পরিধান করিয়ে বাঁশের তৈরি পাচ কিংবা সাত স্তর এবং বিশিষ্ট ‘সামাইন ঘরে’ শায়িত করে সাদা কাপড় ঢেকে দেয়া হয়।

এই ‘সামাইন ঘর’ হচ্ছে অস্থায়ী একটি বাঁশের কাঠামো, মৃত মহিলার জন্য সাত স্তর এবং মৃত পুরুষের জন্য পাঁচ স্তর বিশিষ্ট গােটা গােটা বাঁশের দ্বারা নির্মিত  আধার বিশেষ । সামাইন ঘরের উপর শায়িত মৃতদেহের উপর শ্বেত বস্ত্র ঢেকে দিয়ে চার কোণায় চারটি বাঁশের খুঁটির সঙ্গে একটি চাঁদোয়া বেঁধে দেয়া হয় ।

পাশে মােমবাতি, ধূপকাঠি প্রভৃতি সারাক্ষণ জ্বালিয়ে দেয়া হয়ে থাকে।মৃতদেহ যেদিন শ্মশানে দাহ করা হবে, সেদিন ভােরে চিতা (রূবা-কুড়) সাজাবার জন্য প্রথম খুঁটি বা লাকড়ি মৃতের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় দ্বারা স্থাপন করতে হয়। লাকড়ির স্তর মৃত পুরুষের জন্য এবং সাত স্তর মৃত মহিলার জন্য চিতা সাজাতে হয়।

শ্মশানে নেবার পূর্বে গৃহে ভিক্ষু সংঘ আমন্ত্রন করে এনে ভিক্ষু সংঘের পাশে মৃত দেহকে ‘আলং’- এ (কফিন) স্থাপন করে ভিক্ষু সংঘের পার্শ্বে রেখে উপস্থিত সবাই পঞ্চশীল গ্রহন এবং পরিত্রান ও মঙ্গল সূত্র শ্রবন করে। এসব মাঙ্গলিক কাজ সম্পন্ন হলে মৃতদেহ স্থাপিত ‘আলং’ ঘরের সঙ্গে একটি মুরগির ছানা পায়ে সুতা বেধেঁ যুক্ত করা হয়।

একজন বয়স্ক ব্যক্তি মুরগির ছানা স্পর্শ করে জিজ্ঞেস করে ‘মরা জেদা ফারক গরানার হুগুম আঘে নে নাই” অর্থাৎ জীবিত ও মৃতের পৃথক করার হুকুম বা সম্মতি আছে কি নেই?’ তখন কেউ কেউ বা দু একজন ‘ফারক গরানার হুগুম আঘে’’ (পৃথক করার হুকুম আছে) বলে এবং ঐ ব্যক্তি আলংঘর এর সঙ্গে বাঁধা মুরগি ছানার সুতা ছিড়ে দেয়।

তারপর মৃতদেহ স্থাপিত আলংঘর আত্মীয় কিংবা অপর জনেরা কাধে করে বহন করে শশানে নিয়ে যায়। সেখানে পৌছে চিতায় তিনবার টু মারিয়ে (স্পর্শ ক রিয়ে) চিতার উপর স্থাপন করা হয়। মৃতের মাথা উত্তর দিকে রেখে আলংঘর চিতায় স্থাপন করা হয়। অতঃপর মৃতের পাশে. আলঙঘরের ভিতরে সঙ্গে আনীত মৃতের জন্য রান্না করা ভাতের তিনজরা (তিন মুঠি) ও বাঁশের চোঙায় আনীত পানি মৃতের মুখে স্পর্শ করিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয়।

মৃত দেহের সঙ্গে আনীত বালিশ, লেপতােষক সব বাইরে ছুড়ে ফেলে দেয়া হয় তবে মৃতদেহের পরিধেয় পােশাক তার সঙ্গে থাকে। এরপর প্রত্যেকের হাতে চন্দনের (চন্দন কাঠের টুকরা দেয়া হয়। সবাই বাঁশের কঞ্চিতে আগুন ধরিয়ে হাতে নেয় । মৃতের ছেলে বা মেয়ে কিংবা নিকট আত্মীয় চিতায় প্রথম আগুন ধরিয়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গে সবাই চন্দন কাঠি সহযোগে চিতায় আগুন ধরিয়ে দেয়।

মৃতদেহে আগুন ধরিয়ে অনেকেই স্থান ত্যাগ করে চলে যায়। তবে কয়েকজন লোক থাকে, তারা মৃতদেহ পুড়ে নিঃশেষ হওয়া অবধি থাকে। পরদিন সকালে পরিবারের এক বা একাধিক লােক, আত্মীয় কিংবা প্রতিবেশীদের নিয়ে শ্মশানে এসে সব ছাই কুড়িয়ে পানিতে ফেলে দেয়।

মৃত ব্যক্তির কয়েকটি হাড় সংরক্ষণ করা হয়। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মৃত ব্যক্তির মুখে যে রৌপ্য টাকা প্রবেশ করানাে হয়েছিল, সেই রােপ্য মুদ্রাটি মৃত ব্যক্তির অতি প্রিয়পাত্রই চিতাভন্মের মধ্যে খুঁজে পায়। শ্মশানে চতুষ্কোণ, ঘেরা দিয়ে একটি সাদা কাপড় চাঁদোয়ার মতাে টানানাে হয় এবং চার কোনায় চারটি উচু বাঁশে ও টাংগােন (সাদা কাপড়ের ব্যানার) টাঙ্গিয়ে দেয়।

মৃতদেহ দাহ করার সপ্তম দিবসে সাপ্তাহিক ক্রিয়া অনুষ্ঠানে মৃতের উদ্দেশ্যে ধর্মীয় কাজ সম্পন্ন করা হয় । ভিক্ষু সংঘ আমন্ত্রণ করে এবং আত্মীয়-স্বজন,পাড়া প্রতিবেশী, অতিথি অভ্যাগতসহ মৃতের উদ্দেশ্যে সংঘদান, অষ্ট-পরিস্কার দান, বুদ্ধমূর্তি দান, মঙ্গলসূত্রাদি শ্রবণ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়।

সাধ্যমতো অতিথি অভ্যাগতদের জন্য খাদ্যভােজন এবং ভিক্ষু সংঘকে পিন্ডদান করে মৃতের পারলৌকিক সদগতি কামনা করা হয়। উল্লেখ্য যে, পরিবারের কারাে মৃত্যু হলে সেদিন থেকে শ্রাদ্ধ বা সাপ্তাহিক ক্রিয়া অনুষ্ঠান পর্‍্যন্ত আত্মীয়রা মাছ, মাংস, ডিম, মদ বা আমিষ ত্যাগ করে।

যষ্ঠ দিবসের সন্ধ্যায় পরিবারের কেউ পান-সুপারি নিয়ে শাশানে ঐ চতুষ্কোণ ঘরের সুতা ছিড়ে দিয়ে আমন্ত্রণ জানায় মৃত ব্যক্তিকে। এই রকম বলে, ‘কাল তােমার উদ্দেশ্যে শ্রাদ্ধ দেওয়া হবে তমি বাড়িতে এসাে, পরিবারের সঙ্গে তােমার শেষ ভােজন করার  আমন্ত্রন জানাচ্ছি ।

উল্লেখ্য যে, মৃতদেহ চিতায় জ্বালানাের পরদিন শ্মশানে চতুষ্কোণ ঘেরার চারপাশে সাদা সুতা সাত নাল বাঁধা হয়। এতে বিশ্বাস করা হয় ,মৃত ব্যক্তিকে সেখানে আবদ্ধ করে রাখা হয় যাতে সাপ্তাহিক ক্রিয়া বা শ্রাদ্ধের পূর্বে সে কোথাও না যায়। শ্রাদ্ধের আগের দিন শ্মশানে কেউ গিয়ে সুতার নাল ছিন্ন করে মুক্ত করা হয় যেন শ্রাদ্ধের দিন বাড়িতে এসে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শেষ ভােজন সম্পন্ন করতে পারে ।

 

অস্বাভাবিক মৃত্যু

কোনাে মহামারি কলেরা, বসন্ত রােগে কারও মৃত্যু হলে সেক্ষেত্রে মৃতদেহ গৃহে সংরক্ষণ করার নিয়ম নেই। আত্মীয় স্বজনের জন্যও অপেক্ষা করা হয় না। মৃতদেহ স্নান করিয়ে বাজার থেকে ক্রয় করা নতুন পাটি দ্বারা মুড়ে যতদূর সম্ভব তাড়াতাড়ি শ্মশানে নিয়ে সমাহিত করা হয়। এক্ষেত্রে মৃতদেহ দাহ করা হয় না।

মায়ের বুকের দুগ্ধপায়ী শিশু (দাঁত উঠার পূর্বে) মৃত্যু হলে তাকে সমাহিত করা হয়। তাদের জন্য আলাদা কফিন বা আলংঘর ব্যবহার করা হয় না। পিতা-মাতা কাপড় কিংবা পাটির অংশ দিয়ে জড়িয়ে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে অনাড়ম্বর ভাবে মাটিতে পুঁতে ফেলে।

একজন গর্ভবতী মহিলার মৃত্যু হলে উদর হতে গর্ভাশয় বের করে ভ্রুণটি দূরবর্তী স্থানে মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়। কিন্তু মৃত মাকে চিতায় স্বাভাবিক মৃত জনের রীতি অনুসারে দাহ করা হয়।

যদি কেউ বাঘ কিংবা হিংস্র বন্য জন্তু দ্বারা নিহত হয়, তাহলে সেই ব্যক্তির গােষ্ঠীর (গুত্তির) লােকেরা সকলেই ‘বুরপারা’ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে হবে। এই বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে, তা না হলে তাদের গােষ্ঠীর মধ্যে আরাে অন্য কেউ এরকম দুর্ভাগ্যের শিকার হতে পারে। বৃক্ষ বা উচ্চ স্থান থেকে পতন, কিংবা জলে ডুবে মৃত্যু হলে, অগ্নিদগ্ধ কিংবা আত্মহত্যা জনিত মৃত্যু হলে সাধারণ আলং ঘর বহন করে চিতায় দাহ করা হয়। তবে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তির ন্যায় তারও শ্রাদ্ধাদি সম্পন্ন করতে হয় যথাযথ ধর্মীয় এবং সামাজিক প্রথা অনুসারে।


 

ঐতিহ্যগত প্রতিষ্ঠান, প্রশাসনিক ও বিচারিক ব্যবস্থা 

সাধারণত একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির উদ্যোগে কোনাে সুবিধাজনক করে তঞ্চঙ্গ্যা পাড়ার পত্তন ঘটে। সেই পাড়ায় ভিন্ন ভিন্ন গুত্তির (গোষ্ঠী) পরিবার থাকতে পারে। তবে প্রধানত একই গসার (গােঝার) লােকদের পরিবার নিয়েই পাড়া বা গ্রাম গঠিত হয়। এরকম কয়েকটি পাড়ার সমন্বয়ে গ্রাম এবং মৌজা গঠিত। 

প্রত্যেক পাড়ায় কার্বারী উপাধিধারী একজন প্রতিনিধি থাকেন। তিনি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত নহেন, বরঞ্চ মৌজার হেডম্যান কর্তৃক মনােনীত। কয়েকটি পাড়ার সমন্বয়ে যে গ্রাম, সেই গ্রামে আবার একাধিক কার্বারী হেডম্যান কর্তৃক এবং সার্কেল চিফ বা রাজার অনুমতি বা সম্মতিক্রমে মনােনীত হয়ে থাকেন। প্রত্যেকে পাড়ার কার্বারীদের পরামর্শক্রমে পাড়া বা গ্রামের লােকদের সামাজিক সালিস। বিচার করে থাকেন।

মৌজার হেডম্যান সরকারের প্রতিনিধি রূপে মৌজার প্রশাসনিক কাজ সম্পন্ন করে এবং কার্বারীদের সহায়তা গ্রহণ করেন এই ব্যাপারে। কার্বারীদের সহায়তায় হেডম্যান মৌজাবাসী বা প্রজাদের ছােটখাটো মামলার নিষ্পত্তি করে থাকেন। এই জাতীয় বিচার বা সালিশে কার্বারী ব্যতীত গ্রামের শিক্ষিত, বয়স্ক গণ্যমান্য ব্যক্তিগণকেও পরামর্শক হিসেবে আমন্ত্রণ জানানাে হয়।

 

 

তঞ্চঙ্গ্যা জাতির অর্থনৈতিক সংগঠন 

ঐতিহ্যগত উৎপাদন ব্যবস্থা  

প্রাচীনকাল হতে তঞ্চঙ্গ্যাদের জীবিকা নির্বাহের উপায় বা কৌশলাদি জুমকে ঘিরেই কেন্দ্রীভূত ছিল। মূলত জুমই ছিল তাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্রিটিশ শাসন কায়েমের পূর্বে ক্ষুদ্র জাতিসমূহের বিকাশ আরম্ভ হচ্ছিল। এতদঞ্চলের টিলাগুলি এবং উর্বর অপরিসর নিচু, সমতল জমি খণ্ডগুলাে ধান ও বিবিধ ফলাদি চাষের জন্য ব্যবহৃত হতে থাকে।

জমি চাষের জন্য অবশ্য সমতল ভূমি (চট্টগ্রাম এলাকা) থেকে বাঙালিরা আগমন করেছিল। অথচ পাহাড়ি পরিবারগুলাে জুম চাষই পছন্দ করত এবং জুম চাষেই তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিবদ্ধ ছিল। ব্রিটিশেরা নদী অববাহিকায় বসতিকারী পাহাড়িদের লাঙল চাষে উদ্বুদ্ধ করেও সফল হয়নি।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে পাহাড়িরা লাঙল চাষে মন দেয়। বর্তমানে যেই তঞ্চঙ্গ্যা পরিবারগুলাে রাঙ্গুনীয়া, উদালবন্যা, রমতিয়া প্রভৃতি জায়গায় বসবাস করছে তাদের পূর্ব পুরুষেরা অনেকেই পদুয়া, রাঙ্গুনীয়া প্রভৃতি স্থানে জমি চাষ করত । কিন্তু পাকিস্তান আমলে সেসব সমতল জমি তাদের হাত ছাড়া হয়ে যায়।

অনেকেই এসব এলাকা থেকে দেশের বাইরে চলে যায়। বর্তমানে তাদের বংশধরদের কিছু কিছু দক্ষিণ ত্রিপুরা, মিজোরামের চাকমা স্বশাসিত জেলা পরিষদ এলাকায় খুঁজে পাওয়া যায়। সেখানে তারা প্রধানত জুমচাষ অবলম্বন করেই পরিবারের অর্থ সংস্থান করে বেঁচে আছে।

স্থিতিশীল কৃষিতে অনেক সুবিধা। তাতে কৃষকেরা উপযুক্ত পরিবেশে চাষ অবলম্বন করলে তাদের স্থায়ী অর্থনৈতিক অবস্থা বজায় রাখতে সুযােগ হয়। বেঁচে থাকার জন্য চাষি পরিবারগুলাের একটা মানদণ্ড সৃষ্টি হয়। কিন্তু অসুবিধা হচ্ছে উর্বর সমতল জমিগুলাে, যেসব তাদের স্থিতিশীল কৃষির ভিত্তি ছিল, সেসব জমি তাদের দখলে নেই।।

জুম চাষে স্থিতিশীল অর্থনৈতিক অবস্থার কোনাে নিশ্চয়তা নেই। জুম ক্ষেতের উর্বরতা, নিয়মিত বৃষ্টি, সুষম জলবায়ু, সময়মত ক্ষেত পরিচর্যা এবং কঠোর পরিশ্রমই জুম চাষের সাফল্য নির্ভর করে। পূর্বকালে জুম চাষে জীবিকা অর্জনে অনেকটা সহজসাধ্য ছিল।

কিন্তু বরাবরই উর্বর জুম পাহাড়ের সন্ধানে স্থান পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে পড়ায়, স্থিতিশীল বসতি (স্থাপন) দীর্ঘদিন স্থায়ী হতে পারে না আর এজন্য শিক্ষা  অর্জনের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলাও সম্ভব হয় না। সেই কারণে জুমচাষিদের আর্থ-সামাজিক স্থিতাবস্থা নেই বললেই চলে। 

কয়েক দশক ধরে ঐতিহ্যগত জুম চাষের পাশাপাশি বা জুমভূমিতে তঞ্চঙ্গ্যারা অর্থকরী ফসলাদির উৎপাদন, ফলজ ও মূল্যবান বৃক্ষের বাগানাদি সৃষ্টির কাজে মনােনিবেশ করেছে। সেগুন, গামার, কড়ই প্রভৃতি গাছ বাগান গড়ার কাজ আরম্ভ করেছে। ফসল হিসাবে জুমে ধানের সঙ্গে তিল, কার্পাস, লাউ, মিঠা লাউ, মারফা, চিনার ও অন্যান্য শাকসবজির উৎপাদন করে।

 

 

আর্থ-সামাজিক অবস্থা

১৯৫২-৫৩ সালে চন্দ্রঘােনার কর্ণফুলি পেপার মিল প্রতিষ্ঠার সময় সেখানকার বহু তঞ্চঙ্গ্যা পরিবারের ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়। বারােঘোনিয়া এলাকা থেকে ভূমি হারানোর ফলে বহু তঞ্চঙ্গ্যা পরিবার ত্রিপুরা রাজ্যে (তখন পার্বত্য ত্রিপুরা বলত) চলে যায়। বতমানে দক্ষিণ ত্রিপুরায় তাদের অনেকেই বসবাস করছে।

১৯২৬ সালে ঘিলামােইন থেকে দেবীচরণ তঞ্চঙ্গ্যার নেতৃত্বে চৌদ্দ পরিবার তঞ্চঙ্গ্যা লুসাই হিলের (বর্তমান মিজোরাম) দক্ষিণ দেমাগ্রীর বড় কবাখালি নামক স্থানে চলে যায়। সম্ভবত নতুন জুমভূমির আশায় তাদের এই স্থানান্তর ঘটতে পারে।  বর্তমানে দক্ষিণ ত্রিপুরা, সিএডিসি’তে (মিজোরাম) তঞ্চঙ্গ্যাদের লােকসংখ্যা বৃদ্ধি পায় তা এই প্রবন্ধের প্রথম অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।

১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে কাপ্তাই বাঁধের সময় সামান্য উজানে রাইনছং নদীর অববাহিকা বাঁধের জলে ডুবে যায়। ১২২ কুতুবদিয়া,১১৯ ভার্‍্য্যাতলী, ১১৭ কৌশল্যাঘােনা, ১৩০ বারুদগােল্লা, ১২১ কেঙড়াছড়ি, ১২০ ছাক্রাছড়ি, ১৩১ বল্লালছড়া,১২৬ বিলাইছড়ি, ১২৭ কেরণছড়ি, ১২৪ নারাইছড়ি প্রভৃতি মৌজাগুলি জলমগ্ন হয়ে যায়।

এই সব মৌজায় বসবাসরত তঞ্চঙ্গ্যাদের রাইংখং সংরক্ষিত বনাঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করে। অনেকেই রাজস্থলি, বান্দরবান ,রোয়াংছড়ি,রুমা, থানচি এবং আলীকদমে বসতি স্থাপন করে ।

কাপ্তাই বাঁধ সৃষ্টির পূর্বে রাইনছং অববাহিকায় ১২২ কুতুবদিয়া, ১৩০ বারুদগোলা, ১৩১ বল্লালছড়া, ১২০ ছাক্রাছড়ি, ১২৬ বিলাইছড়ি এবং ১২১ কেঙড়াছড়ি পাশাপাশি এই কয়টি মৌজায় সংঘবদ্ধভাবে তঞ্চঙ্গ্যাদের বসতি ছিল। পঞ্চাশের দশকে তাদের এলাকায় শিক্ষায়তন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান (ক্যাং) প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে।

১২২ কুতুবদিয়া ও ১২১ কেঙড়াছড়ি, ১২০ ছাক্ৰাছড়ি মৌজায় প্রচুর চাষযােগ্য জমি থাকায় তঞ্চঙ্গ্যাদের বহু সচ্ছল পরিবার গড়ে ওঠে। রাইনছং সংরক্ষিত বনাঞ্চল কাছে থাকায় বনজ দ্রব্যাদি (বাশ, গাছ প্রভৃতি) তাদের অনেক ব্যবসায়ী ব্যবসায়ে যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করে।

লেখাপড়া শেখার ক্ষেত্রে ১২২ কুতুবদিয়া ও ১২১ কেঙড়াছড়ি মৌজার তঞ্চঙ্গ্যারা অগ্রণী এবং তাদের মধ্য থেকেই তঞ্চঙ্গ্যাদের সর্বপ্রথম ম্যাট্রিক পাশ, বিএ পাশ, এলএলবি পাশ, তৎকালীন ইপিসিএস ২৭ এবং পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ারিং, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিগ্রি প্রাপ্ত লােকের আবির্ভাব ঘটে। ষষ্ঠ সংগীতিকারক চাকমা রাজগুরু শ্রীমৎ অগ্রবংশ মহাথের ১২২ কুতুবদিয়ার অধিবাসী ছিলেন। কাপ্তাই বাঁধের ফলে উন্নয়নের সকল সম্ভাবনা চিরকালের জন্য তিরােহিত হয়ে যায়।

চাকমা সার্কেলের রাইনছং (রাইংখ্যং) রাঙ্গামাটি সদরের কিছু এলাকায়,কাপ্তাই থানা এলাকায় এবং বােমাং সার্কেলের সীমান্তবর্তী এলাকায় তঞ্চঙ্গ্যাদের বসবাস রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলার এমন সুবিধাজনক ভূমি তাদের মালিকানায় নেই, যেখানে স্থিতিশীল এবং সংঘবদ্ধভাবে গ্রাম পত্তন করে কৃষি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি চর্চা করে তারা সমৃদ্ধিশালী হতে পারে।

এর মধ্যে অন্যান্য ক্ষুদ্র ক্ষুত্র জাতিসত্তা যথা- পাংখােয়া, লুসাই, বম, খিয়াং, উসই, ম্রো, চাক প্রভৃতিও তঞ্চগ্যাদের অঞ্চলের ফাঁকে রয়েছে। তদুপরি বাঙালি পুনর্বাসন সমগ্র পার্বত্য এলাকায় জালের মতাে বিস্তৃত । ফলত আদিবাসীদের বসতি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পরিণত হয়েছে।

রাইংখ্যং অববাহিকার দক্ষিণাংশে যা সরকারি সংরক্ষিত বনাঞ্চল, সেখানে (ফারুয়া এলাকা) তঞ্চঙ্গ্যাদের দশ হাজার লােকসংখ্যা সম্বলিত একটি বৃহৎ দল বসবাস করছে। তবে সেখানে স্বল্পসংখ্যক মারমা, ত্রিপুরা, পাংখােয়া এবং চাকমা বসবাস আরম্ভ করেছে। সরকারি বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী, কর্ণফুলি কাগজ কলের কর্মকর্তা- কর্মচারী এবং কেপিএম-এর শ্রমিকসহ বাঙালি পরিবারও এখানে বসবাস করে।

তঞ্চঙ্গ্যা এবং অন্যান্য সকলেই সংরক্ষিত বনাঞ্চলের আওতাধীন ভূমিতে বসবাস করছে। ভূমির ওপর তাদের কোনাে অধিকার নেই। রাইংখ্যং নদীর অববাহিকায় উঁচু-নিচু জমি সমতল করে, ছােট ছােট ছরা বা স্রোতস্বিনীর গতিপথ পরিবর্তন করে, সুবিধামত স্থানে বাঁধ দিয়ে, খাদ ভরাট করে চাষােপযােগী জমি তৈরি করে এখন ধানসহ তারা নানান জাতীয় ফসল উৎপন্ন করছে।

মৌসুমি ফসল উৎপাদন করে কিছু আর্থিক সচ্ছলতা দেখতে পাচ্ছে সত্য, কিন্তু এসব খুবই অস্থায়ী ব্যবস্থা। কেননা বর্তমানে তারা সমতল জমি চাষ করলেও প্রকৃতপক্ষে তারা ভূমিহীন। বান্দরবান সদর, রমতিয়া (বাঙ্গালহালিয়া), রইস্যাবিল, নােয়াপতং, বাগমারা, রােয়াংছড়ি স্বল্প সংখ্যক পরিবার কিছু কিছু চাষযােগ্য জমির মালিক, কিন্তু তাদের সংখ্যা নিতান্তই কম।

কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় বসবাসরত তঞ্চঙ্গ্যারা জুমের পাহাড় ও চাষযােগ্য জমির অভাবে এখন সমুদ্রে মৎস্য শিকারের পেশা অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছে। সমুদ্রে জোয়ারের পানিতে শামুক, শঙ্খ, মৃত সামুদ্রিক জীবের কঙ্কাল ভেসে এসে চরে জমা হয়। ভাটার সময় সমুদ্রের পানি নেমে গেলে সেসব আবর্জনা সংগ্রহ করত স্থানীয় খামারগুলিতে হাঁস মুরগির খাদ্য হিসেবে বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করে। এভাবে অতীব কষ্টে সেখানকার তঞ্চঙ্গ্যাদের জীবিকা অর্জন করে বাঁচতে হচ্ছে।

 

 

ভূমি মালিকানা ও প্রথাগত অধিকার

পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী জনগােষ্ঠী ব্রিটিশ আমলের পূর্বকাল থেকেই পাহাড় ভূমিতে যথা ইচ্ছা বাড়িঘর তৈরি করে বসবাস করে আসছে। এমনকি বসতবাড়ির আশপাশে কোনাে জমিতে ফলজ বাগান তােলা কিংবা অন্যান্য ফসল উৎপাদনে ব্যবহার করলেও বিনা বন্দোবস্তিতে চিরকাল ভােগ দখল করে আসছে।

বাৎসরিক নামমাত্র ছয় টাকা খাজানা দিয়ে যত্রতত্র পছন্দ মতাে জায়গায় জুম করে জীবিকা সংস্থানের   ব্যবস্থা করে আসছে। গ্রাম বা পাড়াবাসীরা সম্মিলিতভাবে বনজ সম্পদ ব্যবহারের নিমিত্ত পার্শ্ববর্তী পাহাড়ে তারা বন সংরক্ষন করে। সেখান থেকে ব্যবহারের যথেচ্ছা বনজ দ্রব্যাদি ব্যবহার করে আসছে।

এসব জমি ব্যাক্তগত কারাে ্মালিকানাধীন নহে। কারাে নামে সরকারের নিকট হতে বন্দোবস্তি বা ইজারা নেওয়া হয় না। এগুলাে প্রথাগতভাবে সমষ্টিগত মালিকানাধীন ভূমি হিসেবে বিবেচিত।

পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী জনগােষ্ঠী ভূ-সম্পত্তি, প্রাকৃতিক সম্পত্তি, নদ-নদী, পানি সম্পদ, বনজ সম্পদ ইত্যাদি জীবনধারণের এসব বস্তুসম্পদ সমষ্টিগত মালিকানায় বিশ্বাসী। এসব ব্যক্তিগত সম্পত্তি রূপে তারা ধারণা করতে  অনিচ্ছুক। একসংগে বসবাস করছে বলে সকলেই এইসব সম্পত্তি সকলের সামগ্রিক বলে ধারণা করে থাকে।

আদিবাসী বসতির (পাড়া গ্রাম) পার্শ্ববর্তী ছড়ায়  মৎস্যাদি আহরণ, জঙ্গলে পশু শিকার প্রত্যেক জনগােষ্ঠীই সমানভাবে অধিকার ভোগ করে। জঙ্গল হতে বনজ সম্পদ আহরণ ও পশুচারণের অধিকার সব জনগােষ্ঠীরই একই সমান অধিকার। 

কিন্তু তঞ্চঙ্গ্যাসহ পাহাড়িদের এসব প্রথাগত অধিকারকে তােয়াক্কা না করে উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ব্রিটিশ আমলে ভূমি বন্দোবস্তি প্রথা প্রবর্তিত হয়। তঞ্চঙ্গ্যারাও ব্রিটিশের প্রজা হিসেবে স্ব স্ব এলাকায় লাঙল চাষের উদ্দেশ্যে সমতল জমি সরকার হতে কবুলিয়ত সহকারে বন্দোবস্তি গ্রহণ করতে থাকে।

জুমচাষে স্থিতিশীল অর্থনৈতিক অবস্থার নিশ্চয়তা নেই, বরঞ্চ কৃষিকাজে সেই তুলনায় অর্থনৈতিক অবস্থার স্থিতিশীলতা আসতে পারে। তাই সমতল জমির মালিকানা লাভের জন্য তারা সচেতন বা সচেষ্ট হয়ে ওঠে। 

পাকিস্তান আমল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি পুনর্বাসন শুরু হয়। ভারত বিভাগের পর আসামের (ভারত) করিমগঞ্জ জেলা থেকে রিফুজি নামে অনেক বাঙালি বর্তমান রাঙ্গামাটি জেলার নানিয়ারচর এলাকা এবং বান্দরবান জেলার লামা এলাকায় পুনর্বাসন করা হয়।

তাছাড়া পাকিস্তান আমল থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামের যত্রতত্র বাঙালিদের বসতি স্থাপনের কারণে আদিবাসীদের ভূমি হারানাের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাপ্তাই বাঁধ হওয়ার ফলে জমিজমা হ্রদের জলে নিমজ্জিত হয়ে চাষযােগ্য জমিসহ বসতভিটা পানির নিচে হারিয়ে গেছে।

সরকারের বিভিন্ন বিভাগের প্রয়ােজনে (অফিসাদি নির্মাণ) প্রায় সময়ই আদিবাসীর বসতি এলাকাতে জমি অধিগ্রহণ করা হয়। একারণেও ভূমি হারানাের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

পাহাড়িদের প্রথাগত অধিকার স্বীকৃতির অভাবের কারণে তঞ্চঙ্গ্যাসহ এই  অঞ্চলের আদিবাসীরা ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে পড়ছে। তাদের ভূমি ও বংশ পরম্পরায় বসবাস করে আসা বাস্তুভিটা ও শস্যক্ষেত্র সরকারি খাস ভূমি হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। নিজ বাস্তুভিটা ও আবাদি জমি উচ্ছেদের ফলে তাদের অর্থনৈতিক দুর্গতি অঞ্চলে বাড়ছে। এক্ষেত্রে তঞ্চঙ্গ্যা জনগােষ্ঠীও এর ব্যতিক্রম নয়। বরঞ্চ ক্ষুদ্র জঙ্গোষ্ঠী হিসেবে তারা অধিকতর বঞ্চনার শিকার হয়ে আসছে।

 

 

উত্তরাধিকার আইন ও সম্পত্তির মালিকানা

পার্বত্য জেলাসমূহে বসবাসকারী তঞ্চঙ্গ্যা সমাজব্যবস্থায় জুম চাষ অদ্যাবধি তাদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান অবলম্বন বলে বিবেচনা করা হয়। ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রামের বিধি ৪২ নং বিধি মতে, পাহাড়ে জুমচাষের জন্য জমির মালিকানাস্বত্ব প্রয়োজন হয় না, যার কারণে তঞ্চঙ্গ্যা সমাজের স্থাবর সম্পত্তি তথা ভূমি বন্দোবস্তি বা স্থায়ী মালিকানা স্বত্ব অর্জনের প্রচেষ্টা অতীতে তেমন একটা ছিল না বললেই চলে।

এমতাবস্থায় সম্পত্তির উত্তরাধিকার লাভের প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে পার্বত্য জেলাসমূহে বসবাসকারী তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে অতীতে তেমন সুস্পষ্ট ধারনা গড়ে উঠেনি। ইদানীংকালে জুম চাষের জন্য নতুন নতুন জমির অপ্রতুলতা এবং বংশানুক্রমিক পর্যায়ক্রমে অবস্থানের কারণে তঞ্চঙ্গ্যা জনগােষ্ঠীর মধ্যে লাঙল চাষ ও উদ্যান কৃষির প্রতি মনােযােগ বৃদ্ধির পাশাপাশি ভূ-সম্পত্তির ওপর স্থায়ী মালিকানা স্বত্ব অর্জনের প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে ধারণার উদ্ভব হচ্ছে।

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজভুক্ত একটি পরিবারের কেউ মারা গেলে তার অন্তেস্ট্রিক্রিয়া সম্পাদনের দায়িত্ব পালন,  মৃতের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবার সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং পারিবারিক কর্তব্য হিসেবে সমাজে স্বীকৃত। চাকমা ও বােমাং সার্কেলে (মং সার্কেলে তঞ্চঙ্গ্যা বসতি অদ্যাবধি পাওয়া যায়নি) তঞ্চঙ্গ্যা মৃত ব্যক্তির পুত্র, তার (মৃত ব্যক্তির) অপ্রতিরােধ্য আইনগত উত্তরাধিকারী।

পুত্র বর্তমানে অন্য সকল নিকট আত্মীয়ের অধিকার খর্ব হয়ে যায়। সন্তান বলতে ঔরসজাত পুত্রকে যেমন বুঝায়, তেমনি দত্তক হিসেবে গৃহীত সন্তানকেও বুঝায়। পুত্রের মৃত্যুজনিত কারণে মৃত পুত্রের সন্তানগণ আইনগত উত্তরাধিকারী হিসেবে গণ্য হবে। তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে পিতা বা স্বামীর মৃত্যুর পর পুত্র সন্তান ও (নিঃসন্তান অবস্থায়) স্ত্রী উত্তরাধিকারী হবে। 

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে কন্যা সন্তান সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয় না। তবে পুত্র সন্তান না থাকলে কন্যা সন্তানরা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। মাতা-পিতারা স্বেচ্ছায় প্রদান করলে বা উইল করে গেলেও কন্যাসন্তানরা সম্পত্তির অধিকারী হয়।

 

 

পেশার প্রকারভেদ

 আদিকাল থেকে তঞ্চঙ্গ্যারা জুমচাষের উপর নির্ভরশীল হয়ে জীবন ধারণ করে আসছে। ক্রমশ জুমের পাহাড় কমে আসার কারণে জীবিকা অবলম্বনের জন্য নিত্য নতুন পেশার প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। কৃষিকাজ অর্থাৎ সমতল ভূমি চাষ ছাড়াও ফলজ বৃক্ষের বাগান, মূল্যবান গাছের বাগান এবং বাঁশ বাগান করার দিকে ঝুঁকে পড়ছে।

ঢালু পাহাড় বেছে নিয়ে আদা, হলুদ এবং শুষ্ক জমিতে ইক্ষু ব্যাপকভাবে করতে শুরু করেছে। বর্তমানে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রসারের ফলে উচ্চ শিক্ষিতরা সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে যােগদান করছে। সংক্ষেপে বলা যায় বর্তমানে তঞ্চঙ্গ্যা ছেলেরা শুধু নয় মেয়েরা জুম, জমি ও অফিসে সর্বত্র পদচারণা করছে।

ধরতে গেলে জুম ছেড়ে জমিতে, জমি ছেড়ে অফিসে এখন তাদের পেশা অবলম্বন করেছে। কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফ এলাকায় সমুদ্রে মৎস্য শিকারের মতাে ঝুঁকিপূর্ণ পেশাও গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে ।

সরকারি বেসরকারি চাকরি গ্রহণ এবং ব্যবসা অবলম্বন করার ফলে যারা এসব পেশার সঙ্গে জড়িত তারা জেলা ও উপজেলা সদরে বা বিভিন্ন মহানগর এলাকায় বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে। এভাবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তঞ্চঙ্গ্যাদের শহরমূখী প্রবণতা লক্ষ করা যায়।

 

 

বাসস্থানের ধরন

তঞ্চঙ্গ্যাদের ঐতিহ্যগত বাসগৃহ সাধারণত বাঁশের তৈরি মাচাংঘর এবং শন বা বাঁশপাতা অথবা কুরুপ পাতা দিয়ে ছাউনি দেওয়া হয়। তবে ঘরের খুঁটিগুলি শক্ত গাছের খুঁটি হয়। সাধারণত কড়ই, কুম্ভী, গােদা, গুটগুটিয়া ইত্যাদি শক্ত গাছ বেছে বেছে ঘরের খুঁটি (খাম) জোগাড় করা হয়।

তঞ্চঙ্গ্যা ঘরের একটি নির্দিষ্ট ডিজাইন আছে যা প্রত্যেক গৃহস্থ অবশ্যই অনুসরণ করে থাকে। তাই ঘর দেখলেই চেনা যায়। ১. মূল ঘর, ২. চা-না, ৩. ইচর ও ৪. ইচরের পার্শ্বে সরঞ্জামাদি রাখার জন্য একটি ঘর এবং ইচরের শেষ মাথায় ইচর থেকে কিঞ্চিৎ উচ্চতায় টংঘর ।

এই টংঘর অভ্যাগতদের থাকার জন্য করা হয়। ঘরের কোনাে জানালা রাখা হয় না, তবে ছােট ছােট খুপড়ি রাখা হয়। যেগুলি গ্রীষ্মকালে সুশীতল বায়ু সরবরাহ করে। নিম্নে ঘরের  যে নকশা দেওয়া হলাে একটি তঞ্চঙ্গ্যা ঘরের ঐতিহ্যবাহী নমুনা ঠিক এই রকম।

 

 

ধর্মীয় অবস্থা

তঞ্চঙ্গ্যারা আদিকাল থেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। ব্রহ্মদেশে (মায়ানমার) প্রথম অবস্থায় দাইনাক নামে পরিচিত থাকার সময়েও বৌদ্ধ ধর্ম ছিল তাদের একমাত্র ধর্ম। স্যার আর্থার ফেইরির An Account of Arakan গ্রন্থেই তার উল্লেখ পাওয়া যায় ।

তঞ্চঙ্গ্যারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হিসেবে বৌদ্ধ ধর্মের স্থিতি ও উন্নয়নে তাদের অবদান বিশ্ব বিখ্যাত। তঞ্চঙ্গ্যারা থেরবাদী ধর্মীয় গােষ্ঠীভুক্ত। তঞ্চঙ্গ্যারা নিজ ধর্মের প্রতি অত্যন্ত ধর্মভীরু। তাদের মধ্যে অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার নজির নেই।

রাইংখ্যং কুতুবদিয়া নিবাসী রুদ্রসিং কার্বারীর (তঞ্চগ্যা) পঞ্চম সন্তান ফুলনাথ তঞ্চগ্যা প্রবজ্যা গ্রহন করে শ্রীমৎ অগ্রবংশ শ্রমন নামে পরিচিত হন। তিনি চল্লিশের দশকে উপসম্পদা গ্রহন করে শ্রীমৎ অগ্রবংশ ভিক্ষু নামে বৌদ্ধ শাস্ত্র ও পালি ভাষায় উচ্চশিক্ষা অর্জনের আশায় ১৯৪৮ সালে বার্মার (বর্তমানে মায়ানমার) রেংগুনে গমন করেন।

সেখানে তিনি লেঠপেদাং বিশ্ববিদ্যালয় ও কামাইয়েথা বিশ্ববিদ্যালয়ে পালি  ও ত্রিপিটক শাস্ত্রে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। শ্রীমৎ অগ্রবংশ ভিক্ষু ১৯৫৪-৫৬ সালে রেংগুনে অ্নুষ্ঠিত ষষ্ঠ বৌদ্ধ ধর্ম সংগীতি’তে (সম্মেলনী) সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করেন। ধর্ম সংগীতির মূল কমিটি ‘ত্রিপিটক বিশােধক কমিটির’ সদস্য হিসেবে তাঁর অবদানের জন্য ষষ্ঠ সংগীতি আয়ােজক কমিটি ’বুদ্ধ শাসন কাউন্সিল’  শ্রীমৎ অগ্রবংশ স্থবিরকে (তখন স্থবির) ‘অজ্ঞ মহাপণ্ডিত’ উপাধি প্রদান করেন।

১৯৫৭ সালে শ্রীমৎ অগ্রবংশ স্থবির স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলে চাকমা রাজা মেজর ত্রিদিব রায় তাঁকে চাকমা রাজগুরু পদে ৫ জানুয়ারি ১৯৫৮ সালে যথাযােগ্য ধর্মীয় মর্যাদায় বরণ করেন। আশি ও নব্বই-এর দশকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঘষ্ঠ সংগীতিকারক শ্রীমৎ অগ্রবংশ মহাস্থবিরকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি ও বৌদ্ধ শাস্ত্রে পিএইচডি পরীক্ষার পরীক্ষক নিয়ােগের মাধ্যমে সম্মানিত করেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধ ধর্মের স্থিতি ও উন্নয়নের জন্য শ্রীমৎ অগ্রবংশ মহাস্থবির অমর হয়ে থাকবেন।

 

 

ধর্মীয় উৎসব

বৈশাখী পূর্ণিমা উপলক্ষে প্রধান ধর্মীয় উৎসব পালন করা হয়। সিদ্ধার্থ বােধিসত্ত্বের জন্ম (মাতৃজঠর হতে ভূমিষ্ঠ), গৃহত্যাগপূর্বক সাধনার এক পর্যায়ে বুদ্ধত্ব লাভ এবং পঁয়তাল্লিশ বছর ধর্ম প্রচারের পর আশি বছর বয়সে কুশিনারায় বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ লাভ। এই তিনটি স্মৃতি বিজড়িত বৈশাখী পূর্ণিমা বৌদ্ধ তঞ্চঙ্গ্যাগণের প্রধান ধর্মীয় উৎসব।

ক। আষাড়ী পূর্ণিমাঃ সিদ্ধার্থের ২৯ বছর বয়সে গৃহত্যাগ ও তপস্যা আরম্ভ ,বুদ্ধগয়ায় বুদ্ধত্ব লাভের পর সারনাথে প্রথম ধর্ম প্রচার এসব ঘটনার স্মৃতি স্মরণে এবং ভিক্ষু সংঘের বর্ষাবাস আরম্ভ।

খ। ভাদ্র পূর্ণিমাঃ এটা মধু পূর্ণিমা নামে খ্যাত। এই সম্য তথাগত বুদ্ধ পারিল্যেয় বনে অবস্থাঙ্কালে শাখামৃগ( এক বানর) তথাগত বুদ্ধকে মধুদান করে। এই তিথিতে ভগবান বুদ্ধের উদ্দেশ্যে  মধুদান দান করা হয়।

গ। আশ্বিনী পূর্ণিমাঃ ভিক্ষুগনের বর্ষা বাঁশ এই পূর্ণিমাতে সমাপ্ত হয়। প্রবারণা অনুষ্ঠান করা হয়। এই পূর্ণিমার পর দিন থেকে পরবর্তী পূর্ণিমা ( কার্তিকী) ভিক্ষু সংঘের উদ্দেশ্যে কঠিন চীবর দান করা হয়। এটা সারম্বরে ও ধর্মীয় গুরুত্বসহকারে পালন করা হয়।

ঘ।মাঘী পূর্ণিমা : এই পূর্ণিমাতে তথাগত বুদ্ধ আশি বছর বয়ঃক্রম কালে বৈশালী নগরীর চাপালচৈত্যে অবস্থানের সময় পরবর্তী বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে পরিনির্বাণ লাভ করবেন এই মর্মে ঘোষনা দিয়েছিলেন। এই পূর্ণিমায় তঞ্চঙ্গ্যার গ্রামে শলাঘর, ব্যুহচক্র মেলা, জাদিমেলা প্রভৃতি ধর্মীয় মেলার আয়োজন করে থাকে।

ঙ।ফাল্গুনী পূর্ণিমা : তথাগত বুদ্ধ শ্রাবস্তী হতে প্রথম যখন কপিলাবস্তুতে আগমন করেন তখন ছিল ফান্ধুনী পূর্ণিমা তিথি । কপিলাবস্তুতে পিতা শুদ্ধোধন, বিমাতা গৌতমী, প্রাক্তন স্ত্রী যশােধরা এবং পুত্রসহ অন্যান্য আত্মীয়দের সাথে সাক্ষাত হয়েছিল বলে এই পূর্ণিমা তিথিকে জ্ঞাতি সম্মেলন তিথি বলা হয় । এই পূর্ণিমা উপলক্ষে তঞ্চঙ্গ্যারা গ্রামে শলাঘর, ব্যুহচক্র, চেরাগ ঘর নির্মাণপূর্বক ধর্মীয় মেলার আয়ােজন করে থাকে।

 

 

সামাজিক উৎসব 

তঞ্চঙ্গ্যাদের সামাজিক উৎসবের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিষু উৎসব, রাজপুণ্যাহ, নবান্ন উৎসব, আলপালনী উৎসব ইত্যাদি। বিশেষ করে চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষ উপলক্ষে বিষু উৎসব অত্যন্ত ধুমধামের সাথে পালন করা হয়। তঞ্চঙ্গ্যাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য জনগােষ্ঠীও ভিন্ন নামে একইভাবে এ উৎসব পালন করে। বিষু উৎসব বলা যায় পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগােষ্ঠীর জাতীয় সামাজিক উৎসব।

 

বিষু উৎসব 

বিষু উৎসব ফুলবিষু, মূলবিষু ও নয়া বছর মােট তিন দিন পালন করা হয়। বিষুর দিনে বনজ ফুল লতাপাতা দিয়ে ঘরদোর সাজিয়ে ছিমছাম করে রাখে প্রত্যেক পরিবার। সকালে ছােট ছােট, কিশাের-কিশােরী, যুবক-যুবতীরা নদীতে ফুল ভাসিয়ে দেয় মা গঙ্গার উদ্দেশ্যে।

তাতে মা গঙ্গা নাকি সন্তুষ্ট হয় এবং সারা বছর আশীর্বাদ করে থাকে এই বিশ্বাস তাদের মনে বদ্ধমূল । এই দিনে বয়স্কদের স্নান করানাে হয় এই বিশ্বাসে যে, বিগত বছরের সব গ্লানি মুছে যাবে এবং নতুন বছরে মঙ্গল বয়ে আনবে।

মূল বিষুর দিন সকল ঘরের দুয়ার সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে । এদিন অতিথি অভ্যাগতদের যথাসাধ্য পিঠা ; ফল্মূল দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। প্রত্যেক তঞ্চগ্যা পরিবারে রসমালাইয়ের ন্যায়

বিনি চাউলের গুড়ি দিয়ে মু-পিঠা তৈরি করে পরিবেশন করা হয়ে থাকে। বিষুর সময় মু-পিঠা দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করা তঞ্চঙ্গ্যাদের বেলায় অপরিহার্য মনে করা হয় । বিনি চাউলের গুড়ি গােল করে গরম দুধে সিদ্ধ  করা হয়। দুধে চিনি অথবা গুড় দিয়ে মিষ্টি করা হয়। নারকেলের কুচি, বাদাম প্রভৃতি সমন্বয়ে সিদ্ধ করে ঠিক রসমলাইয়ের ন্যায় এই মু-পিঠা সুস্বাদু হয়ে ওঠে।

নতুন বছরের প্রথম দিন সবাই ক্যাঙে গিয়ে দানধর্ম সম্পন্ন করে। বয়স্করা কয়েকদিন আগে থেকে ক্যাঙে গিয়ে অষ্টশীল পালন করে থাকেন ।পূর্বকালে বিষুর দিনগুলিতে মদ, জগড়া, কাঞ্চি নামক নেশা ব্যবহার ব্যাপক ছিল। অনেকে বিষুর দিনগুলিতে এখনাে মদ্য পান করে।

 

রাজপুণ্যাহ

তঞ্চঙ্গ্যা জাতির মধ্য হতে কোনাে সার্কেল চিফ বা রাজা না থাকায় তাদের গােষ্ঠীগত রাজপূন্যাহ অনুষ্ঠানের কোনাে অবকাশ নেই। তবে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় তঞ্চঙ্গ্যা জাতিসত্তা চাকমা জাতির একটি শাখা বলে বিশ্বাস ও ধারণা থাকায় চাকমা রাজার পুণ্যাহের উৎসবটি নিজেদের মনে করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যােগদান করে।

 

 

ভাষা, লােক-সংস্কৃতি ও সাহিত্য 

ভাষা ও বর্ণমালা

তঞ্চঙ্গ্যা জাতিসত্তার নিজস্ব ভাষা আছে। জার্মান পণ্ডিত বিশিষ্ট ভাষাতাত্ত্বিক ড. জি এ গিয়ারসন তাঁর ১৯০৩ সালে প্রকাশিত ‘লিঙ্গুয়েস্টিক সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’ নামক বিখ্যাত গ্রন্থে চাকমা ভাষা ও তঞ্চঙ্গ্যা ভাষাকে পৃথকভাবে উল্লেখ করেছেন এবং উভয় ভাষাকেই আর্য-হিন্দু বা ইন্দো-এ্যারিয়ান ভাষার অন্তর্ভুক্ত বলে মত ব্যক্ত করেছেন।

তঞ্চঙ্গ্যারা ইন্দো-আর্য শাখার পৃথক একটি ভাষায় কথা বলেন যা দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় আঞ্চলিক বাংলার (চট্টগ্রাম অঞ্চল) সাথে একই অঞ্চলভুক্ত হলেও তিবেতাে-বর্মন কিছু বৈশিষ্ট্য ধারণ করেছে।

চাকমারা তঞ্চঙ্গ্যাদের অধিকাংশ কথাই বুঝতে পারে না বলে দাবি করে। এর কারন  প্রাথমিকভাবে তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন গােঝা (গসা) ও গােষ্ঠী (গুত্তি) ভিত্তিক উপভাষার শব্দগত পরিবর্তনের ফল। কারওয়া গসার কথা অনেকটা চাকমাদের কথার কাছাকাছি। এটাই তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে অন্য গসা (গােঝা) যেমন : মো গোশা, মেলাং গসা, লাং গসা ও ধৈন্যা গসার কথ্যভাষা বুঝতে সাহায্য করে ।

তঞ্চঙ্গ্যাদের নিজস্ব লিপি রয়েছে। তঞ্চঙ্গ্যাদের লিপি অনেকটা বার্মিজ লিপির কাছাকাছি। এর মূল উৎপত্তি হয়েছিল ‘মন’দের থেকে। বর্তমানে তঞ্চঙ্গ্যা বর্ণমালা যেটা বলা হচ্ছে তা দাইনাক বর্ণমালাই! তঞ্চঙ্গ্যাদের সহজাত স্বরবর্ণ উচ্চারণ আকারান্ত। তুলনামূলকভাবে তঞ্চঙ্গ্যা বর্ণমালার চেয়ে চাকমা বর্ণমালা বার্মিজ বর্ণ হতে বেশি নেওয়া হয়েছে।

তঞ্চঙ্গ্যা বর্ণমালা দাইনাক বর্ণমালাকে চান ‘ছালাম্যা বর্ণ’ (যার অর্থ গোলাকার) বলা হয়েছে। তঞ্চঙ্গ্যা বা দাইনাক কথায় বলে ছালাম্যে আঘর । উল্লেখ্য যে, ট বর্গের আলাদা উচ্চারণ নেই! অক্ষরগুলোকে ত বর্গের মতো করে উচ্চারণ করা হয়ে থাকে এবং ণ ও ন-এর উচ্চারণও একই রকম।

এই ছালাম্যা বর্ণ আদিকাল থেকে তঞ্চঙ্গ্যাদের দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে বলে জানা যায়। বিশেষত বৈদ্য ও ওঝা গণ এই বর্ণে তাদের চিকিৎসা শাস্ত্রের বনজ গাছ-গাছড়া, শিকড়, লতা পাতা ইত্যাদি বনৌষধির তালিকা এবং আং ও তন্ত্রতন্ত্র এই বর্ণে ‘তাল্লিক’ নামক গ্রন্থে সংরক্ষণ করে থাকে।

চিঠিপত্রাদিও এই বর্ণে লেখালেখি করে। উবোগীত, পালা গান, বানাহ (ধাঁধা), পচ্ছন এই বর্ণে লিখে রাখা হয়। কাজেই এর ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। গ্রামাঞ্চলে এর ব্যবহার প্রচলন হলেও শহর অঞ্চলে ব্যবহার কম, তবে ইদানীং শিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যে এটার প্রচলন বেড়ে যাচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে ৩৩% শতাংশ লােক এই বর্ণমালা ব্যবহার করে বলে জানা যায়।

বর্তমানে এই বর্ণমালা উন্নয়নের জন্য ইউএনডিপি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বিভিন্ন জাতির মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষাদান প্রকল্পের মাধ্যমে ভাষা কমিটি গঠন করে এই বর্ণমালার উন্নয়ন, এই বর্ণমালায় কবিতা, ছড়া, গল্প ইত্যাদি রচনায় ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। যেখানে শিক্ষিত তঞ্চঙ্গ্যারা অংশগ্রহণ করছেন।

 

গান

তঞ্চঙ্গ্যাদের লোক-সংস্কৃতি যথেষ্ট সমৃদ্ধ। তঞ্চঙ্গ্যাদের নিজস্ব গান বলতে উভাগীতকে বােঝায়। উভাগীতের অপর নাম হচ্ছে সাপ্প্যেগীত। তঞ্চঙ্গ্যাগণ সাপ্প্যে নামক তাদের প্রাচীন আবাসভূমির স্মরণে এই গীত গায় বা চর্চা করে তবে পালা গান ও উভাগীত সাধারণত প্রেমের গান হয়ে থাকে।

এই উভাগীতের সুরে     মহীলারা খেংগ্রং নামক বাঁশের ফালি দিয়ে তৈরি যন্ত্র (মাউথ অর্গান) বাজায়। আর পুরুষেরা বাঁশের তৈরি বাঁশি বাজায়। গীঙলী বা গেঙ্গুলীরা বেহালা বাজিয়ে উভাগীত, পালাগান গেয়ে থাকে।

চাকমা জাতির ইতিহাস ভিত্তিক রচিত পালা গান, রাধামন ধনপুদি পালা, চাদিগাংছাড়া পালা তঞ্চঙ্গ্যা  গেঙ্গুলীরা বিভিন্ন সামাজিক উৎসবে বেহালা বাজিয়ে সুর তুলে গেয়ে থাকেন।পালাগানের ফাঁকে ফাঁকে উভাগীতও তারা গেয়ে থাকেন । বিখ্যাত সাধক শিবচরণের রচিত গােজেন লামা তঞ্চঙ্গ্যা পরিবারে ভক্তির সাথে পঠিত হয়ে থাকে।

গীঙুলীরাও গানের আসরে গোজেন লামা গেয়ে শ্রোতাদের আনন্দ দিয়ে থাকে। শিবচরণের আবির্ভাব ১৭৭০-১৭৮২ সালের মাঝামাঝি ! তার জন্মস্থান বর্তমান রাজস্থলি উপজেলার অন্তপাতি হ্নারা খালের মুখে ! তাঁর বসতি স্থান এবং গােজেন লামার ভাষা লক্ষ করে অনেকে মনে করেন শিবচরণ তঞ্চঙ্গ্যা জনগােষ্ঠীর লােক ছিলেন।

 

নাটক 

তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে নাট্যচর্চা উল্লেখ করার মতো। বিংশ শতাব্দীতে রাঙ্গামাটি ও রাজস্থলিতে কয়েকটি নাটক লেখা হয়েছে ! ১৯৬৭ সালে তথাগত বুদ্ধের জীবনী ভিত্তিক তিন অঙ্কের নাটক ‘অমিতাভ’ বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা কর্তৃক রচিত হয় এবং রাঙ্গামাটির কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত মৈত্রী বিহার ক্যাম্পাসে সাফল্যের সঙ্গে মঞ্চস্থ হয়েছিল।

কবিরত্ন কার্তিক চন্দ্র কর্তৃক রচিত পঞ্চাঙ্ক নাটক ‘মঘমানবক’। ‘বিজয়গিরি’ প্রকাশিত না হলেও বিখ্যাত বলে জানা যায়। আশির দশকে তাঁর রচিত ‘মানুষ দেবতা’ নামক নাটকটি রাজস্থলি বাজারে সাফল্যজনকভাবে অভিনীত হয়েছিল। ১৯৭১ সালে বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা কর্তৃক রচিত চাকমা ভাষার নাটক ‘মুরা যেক্কেনে কানে’ মাওরুম-এর (নান্যাচর উপজেলা অন্তর্গত) কৃঞ্চমাছড়ায় স্কুলের প্রাঙ্গণে সাফল্যের সাথে মঞ্চস্থ হয়েছিল।

১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে কবিরাজ পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা বোধিসত্ত্বের ধর্মধ্বজ জাতক কাহিনী অবলম্বনে পয়ারছন্দে একটি ধর্মীয় গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশ করেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে এটাই সর্বপ্রথম প্রকাশিত ধর্মীয় গ্রন্থ। গ্রন্থটির নাম ‘ধর্মজ জাতক’।

 

নৃত্য

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে প্রাচীনকাল থেকে মন্দির নৃত্য প্রচলিত রয়েছে। ঐ নৃত্য সাধারণত মন্দিরে ,শালঘরে,জাদীর ( স্তুপ) চতুষ্পর্শে অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমানে জুম নৃত্য এবং দৈনন্দিন জীবনের নান্দনিক ঘটনার উপর ভিত্তি করে কম্পোজ করা নৃত্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরিবেশন করতে দেখা যায়।

 

সাহিত্য 

কবিতা, গান, গল্প (পচ্ছন) ইত্যাদি যদি সাহিত্যের অঙ্গ হয়, তাহলে তঞ্চঙ্গ্যাদের সাহিত্য খুবই  সমৃদ্ধ। বর্তমানে তঞ্চঙ্গ্যা প্রবীণ ও নবীন লেখকদের দ্বারা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা, প্রাণবন্ত সাহিত্য কর্মের সৃষ্টি হচ্ছে।

কলাত্তুর কন্যা, বাঘ ও শূকরের গল্প, তেজ্ঞেরার পচ্ছন, দুলুকুমারী ইত্যাদি উল্লেখযােগ্য রূপকথা ও লােককাহিনী প্রচলিত আছে। তঞ্চঙ্গ্যা ‘রূপকথা লােককাহিনী-কিংবদন্তি’ নামে একটি এই সম্পর্কীয় গ্রন্থ ইতােমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। এতে লােককাহিনী, কিংবদন্তি রূপকথা মিলে আটটি গল্প স্থান পেয়েছে ।

 

পােশাক পরিচ্ছদ

তঞ্চঙ্গ্যাদের পােশাকে বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। তঞ্চঙ্গ্যা মহিলাদের পরিধানের বস্ত্র টির নাম পিনুইন। কেউ কেউ বলে পেনুইন। এটা কোমর থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত প্রলম্বিত। দৈর্ঘ্য ৪ হাত। দেখতে রঙধনুর মতাে।

চাকমা মহিলাদের পিনুইনের মতাে তঞ্চঙ্গ্যা পিনুইনের দুই প্রান্ত অনুভূমিকভাবে কালো ও ভিতরের দিকে লাল রঙের মাঝখানে লাল ও হলুদে একই মাপের দুই বর্ডার থাকে।

কয়েক নাল সবুজ, বেগুনি, আকাশি রঙ মিশ্রিত প্রশস্ত প্লাটফরম থাকে। কিন্তু চাকমাদের পিনুইনের মতাে উলম্বভাবে কোনো চাবুগি থাকে না। 

তঞ্চঙ্গ্যা মহিলাদের পিনুইন সম্পর্কে একটি চিত্তাকর্ষক কিংবদন্তি অদ্যাবধি মিজোরামের চাকমা স্বশাসিত জেলা পরিষদ অঞ্চলে প্রচলিত রয়েছে। উত্তর ব্রহ্ম ও আরাকানে উৎপন্ন কাহিনী যা দাইনাকদের মধ্যেও প্রচলিত আছে।

কাহিনীটি এরূপ—দাইনাকরা যখন উত্তর ব্রহ্মের অধিবাসী ছিল, তখন মিরু নামে একটি জায়গার নাম ও মংসুই নামীয় এক ব্যক্তির নাম খুবই আলােচিত ছিল তাদের মধ্যে। মংসুই নামীয় ঐ লােকটি হ্যাংলা, রােগা এবং দুর্বল ছিল। তা সত্ত্বেও সে ছিল খুবই উচ্চাভিলাষী এবং রাজা হবার স্বপ্ন দেখত।

তার বন্ধু-বান্ধব বা আশপাশের লােকজনেরা তাকে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করে বলত ‘তুমি এমন রােগ এবং দুর্বল লােক, কীভাবে রাজা হবে?’ কিন্তু সে জোর দিয়ে বলত যে, সে একদিন না একদিন নিশ্চয়ই রাজা হবে। তখন সবাই বলত “ঠিক আছে, যদি তুমি রাজা হবে তাহলে আকাশ থেকে রঙধনু ছিনিয়ে এনে প্রমাণ দিতে হবে।

কাছাকাছি অবস্থানকারী বনদেবতা তাদের এই কথােপকথন শুনেছেন। রাত্রে সেই দুর্বল অথচ উচ্চাকাঙ্ক্ষী যুবককে স্বপ্নে দর্শন দিয়ে বনদেবতা উপদেশ দিলেন ‘তুমি আগামীকাল মিরুতে যাও, সেখানে পৌছেই দেখতে পাবে এক বৃদ্ধ মহিলা অক্লান্তভাবে দিবারাত্র কেবল কাপড় বয়ন করতেছে এবং তুমি তার কাছে গিয়ে সেই বৃদ্ধ মহিলা থেকে এক খণ্ড মনােরম কাপড় নিয়ে আসবে।’

যুবক স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে আন্তরিকভাবে আশ্বস্ত হলাে এবং পরদিন ভোরে মিরুর উদ্দেশে রওনা দিল কাউকে কিছু না বলে মিরুতে পৌছে সত্যই দেখতে পেল এক বৃদ্ধ মহিলা অক্লান্ত ভাবে এক রংধনুর ন্যায় মনােরম কাপড় বুনছে। কাপড়ের থেকে উজ্জ্বল রশ্মি যেন বের হচ্ছে।

যুবকটি বৃদ্ধ মহিলার নিকট তার বয়ন করা বস্ত্র ঢাইলে বৃদ্ধ মহিলা সন্তুষ্ট চিত্তে দিয়ে দিলাে। যুবকটি সেই মনােরম বস্ত্র খণ্ড গুটিয়ে এনে তার বন্ধুদের প্রদর্শন করে বলল, “দেখ, আমি এই বস্ত্রখণ্ড এর মধ্যে রংধনুকে বেঁধে ফেলেছি। এখন থেকে তােমরা রংধনুকে দেখবে যখন আমি এই কাপড়টি গোটানো অবস্থায় থেকে খুলে দেব।’ 

তার বন্ধুরা তার কথা সত্য বলে বিশ্বাস করল। কেননা তারা তৎপূর্বে এরকম রঙের সুন্দর বস্ত্র কোনদিন দেখেনি। পরবর্তীতে সেই যুবকটি সত্যিই রাজা হলাে এবং রাজা হবার পর তার জাতির মহিলাদের মধ্যে সেই বস্ত্র কেটে বণ্টন করে দেয়। তখন থেকেই দাইনাক (বর্তমানে তঞ্চঙ্গ্যা) রমণীগণ এরকম মনােহর নকশার বস্ত্র (পিনুইন) পরিধান করার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন।

কোনাে গসা কী কী পােশাক পরিধান করে—

ক্রম গসা পোশাক
কারওয়া গসা পিনুইন,খাদি, ফারর দুরি(কোমর বন্ধনী),মাথার খবং, সাদা কোবোই,সালুম এবং রৌপ্য অলংকারাদি।
মুঅ গসা পিনুইন,খাদি,(ফুল খাদি) কালা কোবোই সালুম,ব্লাউজ এবং অলংকার
ধৈংনা গসা পিনুইন ,খাদি, ব্লাউজ,খবং,ফারর দুরি এবং অলংকার
মংগলা গসা পিনুইন,খাদি,ব্লাউজ এবং অলংকার
মেলং গসা পিনুইন, খাদি,ব্লাউজ , কালা কোবোই সালুম, খবং এবং অলংকার
লাং গসা পিনুইন ,কাদি ব্লাউজ, খবং এবং অলংকার
অঙ্গা গসা পিনুইন ,কাদি ব্লাউজ, খবং এবং অলংকার

উল্লেখ্য যে, তঞ্চঙ্গ্যাদের বিভিন্ন গসার মহিলাদের পােশাকের অনুষঙ্গ হিসেবে মাথার খবং (পাগড়ি), ফারদ্দরী (কোমর বন্ধনী), ব্লাউজ বা কোবােই সালুম ভিন্ন ডিজাইনের হলেও পিনুইন ও খাদি সকল গসার মহিলাদের অবশ্যই একই রকম ডিজাইনের হয়ে থাকে।

 

অলঙ্কার

পূর্বে রূপার অলঙ্কারই প্রচলিত ছিল। বর্তমানে স্বর্ণালঙ্কার ব্যবহৃত হওয়ায় পূর্বের রৌপ্য অলঙ্কারের বিলােপ ঘটতে আরম্ভ করেছে। তঞ্চঙ্গ্যা মহিলারা পায়ে, হাতের (কনুই), বাহুতে, গলায়, কানে, চুলের খােপায় অলঙ্কার ব্যবহার করে। পায়ে রূপার তৈরি মল (ঠেঙর খাড়ু) করে।

এগুলাে ওজনে ৪০ থেকে ৬০ তােলা । ৮০ তোলা হতেও দেখা যায়। কনুই বা হাতে রূপা বা সােনার তৈরি কুচি খাড় (বেড়েইয়া খাড়ু), বাঘাের, কিঞ্চিক, বাঙড়ী বা চুড়ি ব্যবহার করে। বাহুতে বাজু বন্ধ বা তাজজোড় এবং কানে রাজ জোড়, ঝংগা ব্যবহার করে। গলায় চন্দ্রহার, হাঁসুলি (সিকিছড়া সংযুক্ত), রূপার টাকার ছড়া (মালা) এবং চুলের খোপায় রূপার তৈরি চুলের কাঁটা ব্যবহার করে। সঙ্গে রূপার তৈরি চেইনও থাকে।

 

তৈজসপত্র

জুমচাষ ও কৃষি কাজে যে সমুদয় সরঞ্জাম প্রয়োজন হয় সেসব সরঞ্জাম হলাে সুচ্যাং তাগল (সূচালো দা), একধাৰ্য্যা তাগল (এক ধারওয়ালা দা) বা দিধাৰ্য্যা তাগল, কাস্তে, কোদাল, খন্টা ইত্যাদি। তৈজসপত্রের মধ্যে কুরুম, কাল্লোং, ডিঙারা, বারেং, কুলা, চালােইন, মেচাং, পাত্ত্যং ইত্যাদি রয়েছে।

বুনন কাজের জন্য ব্যং থুরচুমা, বগলা, সাম্মেয়া, ফুলবারেং, তলই ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। আগের দিনে মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিল প্রচলন ছিল। বর্তমানে এসব জিনিসের স্থান দখল করে নিয়েছে এ্যালুমিনিয়ামের তৈরি হাঁড়িপাতিল ও স্টিলের তৈজসপত্র।

 

খাদ্যাভ্যাস 

পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মতাে তঞ্চঙ্গ্যাদেরও শুটকি প্রিয় খাদ্য। চিংড়ি শুটকি, ছুরি শুটকি, হাঙ্গর শুটকি নিত্যদিনের অপরিহার্য। সিদ্ধ তরকারি মরিচ বাটা (নাপ্পি বা চিদল প্রয়ােগে) তঞ্চঙ্গ্যাদের খাদ্য তালিকায় অপরিহার্য। সিদ্ধ তরকারিকে ‘উসুনা চন’ বলা হয়। ‘উসুনা চন’ তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রতিবেলা আহারে যথাসাধ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

 

প্রবাদ প্রবচন 

তঞ্চঙ্গ্যাবাংলা অনুবাদ  উরিংঅ লগে চঙা (চঙরা) পাগল হরিণের সঙ্গে সঙড়া (বড় হরিণ) পাগল ।মেলা রাক্ষস পেলা ধাঙর নারী রাক্ষস (পেটুক হলে) তার হাড় পাতিল বড় হয়। আইত আলে গাইত তগাতগিহাতি সামনে পড়লে ওঠার জন্য বৃক্ষ খোঁজ করে। অর্থাৎ বিপদ আসলেই চেতন হওয়া। বরগাংঅ চায় ফা-কাবর ধর ফা এক ঢিলে দুই পাখি মারা।

 

আদিবাসী জ্ঞান

এ্যালােপ্যাথি, হােমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত হবার আগে তঞ্চঙ্গ্যারা সর্ববিধ রােগের চিকিৎসা তাদের নিজস্ব চিকিৎসা পদ্ধতিতে বৈদ্য,ওঝাদের দ্বারা সম্পন্ন করে এসেছে। বনজ গাছ-গাছড়া, শেকড়, লতাপাতা ইত্যাদি  বনৌষধি নানা প্রকার রােগ নিরাময়ে সহায়ক।

বৈদ্যগণ এই সমস্ত বনৌষধির তালিকা তাদের লিপিবদ্ধ তাল্লিকে সংরক্ষণ করত। বিভিন্ন তন্ত্রমন্ত্র, আঙ ডালি ইত্যাদি দ্বারা নানা রােগের চিকিৎসা করত। প্রত্যন্ত অঞ্চলে রােগ চিকিৎসায় এবং স্বাস্থ্য রক্ষায় বৈদ্যগণই একমাত্র সম্বল।

 

বন ব্যবস্থাপনা

তঞ্চঙ্গ্যাগণ পাড়া বা গ্রাম পত্তন করে সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে অভ্যস্ত । তারা সমষ্টিগতভাবে সকলের প্রয়োজন মেটানোর জন্য বনজদ্রব্য সংগ্রহের সুবিধার জন্য বন সংরক্ষণ করে থাকে। এটাকে সামাজিক বন ব্যবস্থাপনা বলা যেতে পারে। এই সম্পর্কে তাদের অভিজ্ঞতা প্রশংসিত।

 

 

শিক্ষা

তঞ্চঙ্গ্যারা প্রধানত অর্থনৈতিক কারণে ও বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারণে যথাযথভাবে শিক্ষা গ্রহণ করতে সক্ষম হচ্ছে না। বিশেষত তাদের এলাকায় পর্যাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায়, দূরবর্তী স্থানে বিদ্যালয়ে গমন কিংবা তথায় অবস্থান করে শিক্ষা গ্রহণ সহজসাধ্য নয় বিধায় তারা শিক্ষার ক্ষেত্রে পশ্চাদপদ রয়েছে। নিম্নে তাদের শিক্ষার হার প্রদান করা হলোঃ

অঞ্চল শিক্ষার হার
পার্বত্য চট্টগ্রামদক্ষিন ত্রিপুরা
সিএডিসি(মিজোরাম)
২৪%৩১%
৩৮%

তঞ্চঙ্গ্যা জনগােষ্ঠীতে উচ্চ শিক্ষাপ্রাপ্ত ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় শিক্ষিত লােক আছে। উল্লেখযােগ্য পরিমাণে না হলেও বিসিএস ক্যাডারভুক্ত, প্রকৌশল, চিকিৎসা, আইন, শিক্ষা বিভাগ, সাংবাদিকতা, সাহিত্য, চারুকলা বিভাগে তঞ্চঙ্গ্যাদের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। 

অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, বিভিন্ন প্রতিকূলতা শিক্ষা লাভের প্রধান প্রতিবন্ধক। পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মতাে তঞ্চঙ্গ্যাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা হিসেবে কাজ করে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার অভাব ।

মাতৃভাষায় শিক্ষা অনুপস্থিতির কারণে অনেক তঞ্চঙ্গ্যা শিশু প্রাথমিক স্তরে বিদ্যালয় থেকে ঝরে যায়। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার বিধান। থাকলেও তা এখনো কার্যকর করা হয়নি। একমাত্র সরকারি সহায়তা পাওয়া গেলে শিক্ষা ক্ষেত্রে তাদের অগ্রগতি সম্ভব বলে তঞ্চঙ্গ্যারা মনে করে।

 

 

নারীর অবস্থা

 তঞ্চঙ্গ্যা নারীরা পুরুষের সঙ্গে সমভাবে ক্ষেতে কাজ করে। তবে গৃহস্থালি কাজ নারীরা একা সম্পন্ন করে। পুরুষের সমমর্যাদা অনেক ক্ষেত্রে ভােগ কম। সামগ্রিকভাবে প্রধানত পুরুষের পরেই সমাজে নারীর স্থান নির্ধারিত হয় । তা সমাজের মতাে নারীর উপর নানা সামাজিক বৈষম্য বিদ্যমান।

সমাজে এ কন্যা সন্তানের চেয়ে পুত্র সন্তান বেশি কামনা করা হয় এবং পরিবারে ও সমান পুত্র সন্তানের চেয়ে কন্যা সন্তানের প্রতি কম প্রাধান্য দেয়া হয়। শিক্ষা ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীরা পিছিয়ে আছে। তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে সাধারণত নারীরা মাতা-পিতার সম্পত্তি ভাগ পায় না।

ইদানীং কতক ক্ষেত্রে মা-বাবারা কনব সন্তানকেও সম্পত্তির অংশ দিয়ে থাকে। কিন্তু সেটা কতিপয় ক্ষেত্রে লক্ষণীয়। সামাজিকভাবে এখনাে তা রীতিতে পরিণতি লাভ করেনি।তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে সমাজ সিদ্ধ নিয়মে একজন বিবাহিত স্ত্রী তার স্বামী হতে ভরণপোষণের অধিকারী হয়।

একজন তঞ্চঙ্গ্যা নারী বিবাহের পূর্বে বা পরে স্বামীর সংসার কিংবা পৈতৃক অথবা মাতৃক সূত্রে কিংবা তার আত্মীয় কর্তৃক দান বা উপহার হিসেবে কিংবা স্ব উপার্জিত অর্থে সম্পত্তি ক্রয় অথবা লাভ করতে পারে। বিবাহের পূর্বে অর্জিত কোনো সম্পত্তির উপর আইনত নিরঙ্কুশ মালিকানা স্বত্ব ও অধিকার স্ত্রীর থাকে।

স্বামী নিষ্ঠুর প্রকৃতির হলে, স্ত্রী শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করলে, স্বামী দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণের কারণে সতিনের সাথে একসঙ্গে সংসারে অবস্থান বা বসবাসে অসম্মত হলে, সেক্ষেত্রে প্রথমা স্ত্রী স্বামীর ভিটায় নিরাপদ অবস্থানে থেকে স্বামীর নিকট হতে ভরণপােষণ লাভের অধিকারী হয় অথবা সামাজিক আদালতের মাধ্যমে গৃহীত সিদ্ধান্তে পিত্রালয়ে অবস্থান করে স্বামীর নিকট হকে খােরপােষ লাভের অধিকারী হয়।

বিবাহের পর স্বামী বৈবাহিক সম্পর্ককে অগ্রাহ্য বা অব্যাহত না রাখলে অথবা ভরণপােষণ প্রদানে বিরত থাকলে স্ত্রী তার দাম্পত্য সম্পর্ক ও দাবি পুনরুদ্ধারের জন্য সমাজপতি বা কার্বারীহেডম্যান আদালতে মামলা করার অধিকার রাখে। স্বামীর দ্বিতীয় বা একাধিক বিবাহের ক্ষেত্রে স্ত্রী আপত্তি করার অধিকার রাখে।

পক্ষান্তরে স্বামী যদি পুরুষত্বহান বা নপুংসক হলে অথবা দুরারােগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে কিংবা মানসিক ভারসাম্যহীন হলে সেক্ষেত্রে স্ত্রী সমাজপতি বা কার্বারী-হেডম্যান আদালতের | মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকারী হয়।

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে নারীরা নানা ক্ষেত্রে তাদের পদচারণা শুরু করেছে। শিক্ষিত নারীরা সরকারি-বেসরকারি চাকরি গ্রহণ করে স্বাবলম্বী হচ্ছে। পরিবারের ভরণপােষণে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে।

তা সত্ত্বেও তঞ্চঙ্গ্যা নারীরা এখনাে অনেক পিছিয়ে পড়ে আছে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে তঞ্চঙ্গ্যা নারীরা পরিবারে পরুষের নানা নিপীড়ন ও অবহেলার শিকার হয়। মদ্যপান করে অনেক স্বামী তাদের স্ত্রীদের উপর শারীরিক নির্যাতনেরও ঘটনা চোখে পড়ে। 

পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য আদিবাসী জনগােষ্ঠীর নারীর মতাে তঞ্চঙ্গ্যা নারীরাও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা থেকে মুক্ত নয়। আশির দশকে রাঙ্গামাটি সদর উপজেলায় ১০ জন তঞ্চঙ্গ্যা কিশােরীকে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য কর্তৃক গণধর্ষণের ঘটনা দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলােড়ন সৃষ্টি করে।

 

 

রাজনৈতিক সংগঠন 

পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনীতিতে কিংবা দেশের জাতীয় রাজনীতিতে তঞ্চঙ্গ্যাদের অনেক ব্যক্তি নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য জেলা পরিষদ, অধুনা পুনপ্রবর্তিত উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদে অনেক তঞ্চঙ্গ্যা নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি নির্বাচিত হয়ে এ অঞ্চলের রাজনীতি ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ও জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলােতেও তঞ্চঙ্গ্যা জনগােষ্ঠীর অনেক ব্যক্তি নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হচ্ছে। জেলা পর্যায়ে জাতীয় রাজনীতির সভাপতি পদেও আছেন। 

১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মােতাবেক প্রবর্তিত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে অন্যান্য আদিবাসী জনগােষ্ঠীর মতাে তঞ্চঙ্গ্যাদের জন্যও আসন সংরক্ষিত রয়েছে। এর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদে তঞ্চঙ্গ্যা ও মুরং জনগােষ্ঠীর জন্য ১টি সদস্যপদ সংরক্ষিত আছে।

রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদে তঞ্চঙ্গ্যাদের জন্য ২টি সদস্যপদ এবং বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদে ১টি সদস্যপদ সংরক্ষিত আছে। এছাড়া উক্ত পরিষদসমূহের চেয়ারম্যান পদ সকল আদিবাসী জনগােষ্ঠীর জন্য উন্মুক্ত বিধায় আগ্রহী তঞ্চঙ্গ্যারাও ঐ পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে।

পার্বত্য জেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়ায় ৩৪ সদস্যের পরিবর্তে ৫ সদস্যক অন্তর্বর্তী জেলা পরিষদের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। এতে তঞ্চঙ্গ্যাদের সকল সদস্যপদের প্রতিনিধিত্ব নেই। জেনারেল এরশাদের আমলে জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে মালতী তঞ্চঙ্গ্যাকে মনােনীত করা হয়।

 অপরদিকে ২০০৪ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তিন পার্বত্য জেলায় মােট ৪ টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে তঞ্চঙ্গ্যা জনগােষ্ঠী থেকে ৪ জন চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছে। পক্ষান্তরে ২০০৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নিন পার্বত্য জেলায় ২৫টি উপজেলা পরিষদের মধ্যে তঞ্চঙ্গ্যা জনগােষ্ঠী থেকে ১ (এক জন চেয়ারম্যান পদে, ১ (এক) জন পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যান পদে এবং ১ (এক) জন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছে।

মিজোরামের চাকমা স্বশাসিত জেলা পরিষদে তঞ্চঙ্গ্যা জনগােষ্ঠী থেকে মুখ্য নির্বাহী এবং চেয়ারম্যান পদ লাভের দৃষ্টান্ত আছে।তবে সাধারণ তঞ্চঙ্গ্যারা এখনাে রাজনৈতিকভাবে তেমন সচেতন নয়। প্রথমত ক্ষুদ্র জনসংখ্যা, দ্বিতীয় শিক্ষা ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া এবং তৃতীয়ত রাজনৈতিকভাবে সাধারণ তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে আশানুরূপভাবে সচেতনতা গড়ে না উঠা এর মধ্যে অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এছাড়া সংখ্যালঘিষ্ঠতার কারণে বর্তমান গণতান্ত্রিক কাঠামােয় ভােটের রাজনীতি তাদের অনুকূলে নয়।

লেখক- বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা

টীকা

১. Sittwe

২  Ethnographic Study of Tanchangya of CHT, CADC, Sittwe and South

Tripura by Rupak Debnath, 2008.

 ৩. Census of India (1931, 1961, 1991), Census of Bangladesh 1991 (Revised figures Hill District Council, Rangamati) Office Registrar General, Tripura & Directorate of Census Operations, Tripura and 2005 survey by the author, The figures for CHIT 2001 and 2005 are calculated in terms of growth rate 1.48 as proposed by PEDP while ‘Tanchanhgya population of Sittwe is the mean of the native’s own estimate 40,000 and that of the non native 20,000.

৪. Ethnographic Study of Tanchangya of CHT, CADC, Sittwe and South Tripura by Rupak Debnath, 2008. 

৫ Lient Phayere, An Account of Aracan, Journal of the Asiatic Society of  Bengal 1841, সুত্র : তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি প্রথম প্রকাশ, ১৯৯৫ 7, ১৪, ৫ তঞ্চগ্যা মহাসম্মেলন : রাঙ্গামাটি। 

৬. প্রাগুক্ত

৭. প্রাগুক্ত

৮ History of Burma, Dr. Khim Moung Nguni Gi, P-76 

৯. Myin saing

১০. চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার, অশােক কুমার দেওয়ার, পৃ. ৬৭, প্রথম সংস্করণ।

১১. Dannawady

 ১২. Tagaung 

১৩. Abhiraja 

১8. Conrajagri Elder Canraj 

১৫ Canrajange Younger Canraj

১৬. Sangassanagara 

১৭. Kapila Vasthu 

১৮. Panchala 

১৯. Suriy dynasty 

২০. Canda Suriya

 ২১. তৈনগাঙ : আদিবাসী দিবস সংখ্যা-০৬, প্রকাশকাল ৯ আগস্ট ২০০৬ সম্পাদক : মৃণাল কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা, পৃষ্ঠা : ১৩, ১৪। 

২২. Harvey 

২৩/ British Rule in Burma by Harvey, vol. 10, চম্পক নগরের সন্ধানে : বিবর্তনের ধারায় চাকমা জাতি : সুপ্রিয় তালুকদার, প্রথম প্রকাশ, রাঙ্গামাটি ১৯৯৯ ইং, পৃষ্ঠা :২৪,২৫

 ২৪. প্রাগুক্ত 

২৫. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, মাহবুবুল আলম, পৃ. ৭৭ 

২৬। রনি তঞ্চঙ্গ্যা, এনজিও কর্মী।

 ২৭।. EPCS — East Pakistan Civil Service

 ২৮।. Ethnographic study of Tanchangya of CHT, CADC, Sittwe and south Tripura- Rupak Debnath- 2008, P. Kalikata. 

২৯। Ethnographic Study of Tanchangya. * ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুসারে।

তথ্যসূত্র 

১. Debanath, Rupak, Ethnographic Study of Tanchangya of CHT, CADC, Sittve and South Tripura, Kreativemind, 60cc/3 Anupama Housing Complex,VIP Road, Kolkata 7000 052, 2008. 

২. তালুকদার, সুপ্রিয়, চম্পক নগর সন্ধানে : বিবর্তনের ধারায় চাকমা জাতি, উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট; রাঙ্গামাটি, ১৯৯৯।

৩. দেওয়ান, অশােক কুমার, চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার, ১ম খণ্ড ও ২য় খণ্ড, উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, রাঙ্গামাটি, ১৯৯১।

 ৪. তঞ্চঙ্গ্যা, বীর কুমার, তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি, তঞ্চঙ্গ্যা মহাসম্মেলন—বান্দরবান, রাঙ্গামাটি,১৯৯৫।

৫. তঞ্চঙ্গ্যা, জ্যোতি বিকাশ, তৈনগাঙ, আদিবাসী দিবস সংখ্যা-০৫, তৈনগাঙ লিটারেচার ফোরাম’, ২০০৬।

৬. চাকমা, এডভােকেট জ্ঞানেন্দু বিকাশ রায়, এডভােকেট প্রতিম; দে, শৈলেন, তঞ্চঙ্গ্যা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন, কপে সেবা সংঘ, আদালত সড়ক, বনরূপা, রাঙ্গামাটি, সেপ্টেম্বর ২০০৭। 

৭.Muhammad Ishaq (editor), Bangladesh Disrict Gazetteers, Chittagong Hill Tracts, Ministry of Cabinet Affairs, Establishment Division, Government of Bangladesh, Dacca, 1971

 ৮. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, মাহবুবুল আলম, পৃ. ৭৭।

প্রসঙ্গ:আদিবাসী, তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠী, তঞ্চঙ্গ্যা জাতি, তঞ্চঙ্গ্যা জাতির ইতিহাস

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা

তঞ্চঙ্গ্যা জাতির আদ্যোপান্ত