Last updated Oct 8th, 2025
1
বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে আবহমানকাল হতে বসবাসরত ১১টি আদিবাসীর মধ্যে চাক একটি ক্ষুদ্র আদিবাসী গোষ্ঠী। বান্দরবান পার্বত্য জেলার ৭টি উপজেলার মধ্যে সর্বদক্ষিণ প্রান্তে মায়ানমারের আরাকান প্রদেশের সীমানা বরাবর অবস্থিত নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা, যার আয়তন ৬৬৩.৬১ বর্গ কিলােমিটার, ঐখানেই চাকদের আবাসস্থল।
এই উপজেলাটি ভূ-মানচিত্রে প্রায় ২১°১১ ও ২১°৪০ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯২°০৮ ও ৯২°২৩ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত। এই উপজেলায় ৪টি ইউনিয়ন ও ১৭টি মৌজা রয়েছে। তন্মধ্যে ৩টি ইউনিয়নের ৫টি মৌজায় ছড়িয়েছিটিয়ে ছােট-বড় মােট ১৫টি চাক বসতি রয়েছে। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি প্রতিবেদন অনুসারে চাকদের লােকসংখ্যা ২,০০০ জন। তবে বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা বেশি হতে পারে। চাক নৃগােষ্ঠীর জনপদ কেবল নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় রয়েছে।
বর্তমানে এই দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন জেলায়, বিভাগীয় সদরে সরকারি, আধাসরকারি ও বেসরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান সমূহে প্রায় শখানেক চাক নারী পুরুষ চাকরিরত আছে । জীবন-জীবিকার তাগিদে শহরমুখী প্রবণতা সে যাচ্ছে। এই প্রবণতা ক্ষুদ্র জাতির জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক বটে।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার উত্তরে লামা ও আলীকদম উপজেলা, দক্ষিণে কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলা, পূর্বে আরাকান প্রদেশ এবং পশ্চিমে কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলা। ছােট-বড়, উঁচু-নিচু, মাঝারি আকারের অসংখ্য পাহাড়ের সমারােহে গঠিত এই উপজেলা সমুদ্রের সাথে মিশে গেছে।
তাছাড়া ফারিয়াল ও গর্জন খাল এবং ছড়া-ঝিরি ও উপত্যকা বিদ্যমান। হালচাষের উপযােগী জমির পরিমাণ প্রায় ২ শতাংশ, জুম ও ফলাদি চাষের উপযােগী জমির পারিমান ৩৭ শতাংশ এবং অবশিষ্ট জমি উঁচু ও খাড়া পাহাড়।বাংলাদেশের বাইরেও বিভিন্ন দেশে যেমন ; ভারতের মনিপুর ও অরুণাচল, মায়ানমারের আরাকান প্রদেশ, মধ্য বার্মা (রােহমা পর্বতের পাদদেশে), উত্তর ও দক্ষিণ বার্মা এবং লাওসে বিচ্ছিন্নভাবে চাক জনগােষ্ঠীর বংশভুক্ত প্রাচীন আদিবাসী আছে।
বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জায়গায় চাকরা চাক, কদু-কানাং, মালিন, আন্দ্রো, চেক নামে পরিচিত। ঐসব দেশে নানান কারণে বিভিন্ন সময় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বর্তমানে চাক ভাষাভাষী জনসংখ্যা আনুমানিক প্রায় ৬০ হাজারের মতাে হবে।
চাকদের ভাষায় ‘চাক’ শব্দের অর্থ দাঁড়ানাে। এটি একটি ক্রিয়াপদ। চাকরা নিজেদেরকে ‘আচাক’ বলে। চাকরা নিজেদের নামের শেষে ‘চাক’ লিখলেও আরাকানিরা চাকদেরকে সাক (sak) এবং কখনও কখনও ‘মিসাক’ বলে ডাকে। অন্য দিকে বান্দরবান বােমাং সার্কেলের বােমাং রাজবংশের রাজ পুস্তিকায় রাজ্য অভিষেক অনুষ্ঠানে চাকরা ‘মিৎসাক’ নামে তালিকাভুক্ত আছে।
এদেরকে আবার ‘thek’ বা ‘থেক হিসাবেও অভিহিত করা হয়। যার স্পষ্ট উল্লেখ আছে G. H. Luce-447 Journal of Barma Research Society-60 Note on Peoples of Barma in the 12th-13th Century নামক প্রবন্ধে । উল্লেখ্য যে, পূর্বে চাকদের নামের শেষে কোনাে জাতি পরিচিতি বা উপাধি লেখা হতাে না ।
১৯৬৬ সনে মং মং চাক কলেজে অধ্যয়নের জন্য ভর্তির সময়ে নামের শেষে জাতির পরিচিতি বা উপাধি হিসাবে ‘চাক’ লেখেন। তখন থেকে সকলেই নামের শেষে ‘চাক’ লেখা শুরু করে এবং অদ্যাবধিও লিখে আসছে।
ইতিহাসে জানা যায় যে, হিমালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের পামির মালভূমি চাকদের উৎপত্তিস্থল। একসময় তারা পামির মালভূমিতে ছিল এবং ঐখান থেকে কালক্রমে প্রথমে উত্তর ভারতে এসে পৌঁছে। ঐখানে বহু বছর অবস্থানের পর কালের আবর্তে বর্তমান ভারতের ব্রহ্মপুত্র নদীর উপত্যকায় বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে বসতি স্থাপন করে।
গবেষক ও ইতিহাসবিদ উ অংসাউ তার ‘রাখাইন রাজাওয়ান’ (বাংলায় হন ইতিহাস) নামক পুস্তকের প্রথম অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন যে, গৌতম বুদ্ধের জন্মের প্রায় ৬ হাজার বছর পূর্বে চাকরা মণিপুরে ছিল । বিখ্যাত গবেষক ও অধ্যাপক থােয়াইশৈ খাইন তাঁর এক গবেষণামূলক পুস্তকে (কেবল চাকের উপর গবেষণা) বর্ণনা করেন যে, প্রায় হাজার বছর আগে চাকরা (বড় কান জাতি) বর্তমান চীনের ইউনান প্রদেশে ও ভারতের বর্তমান অরুণাচল প্রদেশে ছিল। মহিলারা কানের ছিদ্র বড় করে গােলাকার রিং পরিধান করত । তাই তাদেরকে বড় কান জাতি নামে কোনাে কোনাে ইতিহাসবিদরা আখ্যায়িত করেছেন।
ইতিহাস গবেষক উ অং সাউ তার ‘রাখাইন রাজাওয়ান’ ও ‘ধাঞাওয়াতি আরেতােপুং’ দুটি পুস্তকে বর্ণনা করেছেন যে, অন্তর্দ্বন্দ্ব ও আন্তঃকলহ এবং নানাবিধ রেষারেষির কারণে চাকরা বহুধা বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং ফলশ্রুতিতে এক বিচ্ছিন্ন দল মণিপুর হতে পূর্ব দিকে সরে এসে সুদূর চীনের বর্তমান ইউনান প্রদেশে চলে যায় এবং ঐ দল ইউনান হতে বর্তমান মায়ানমারের উত্তর সীমান্ত অঞ্চল হুগল.. অবস্থান নিয়েছিল এবং ঐখান থেকে উরু নদীর উজানে অবস্থিত চিংখং পর্বত অতিক্রম করে হ্নীংখং, চিংলুইন উপত্যকায় এসে পৌঁছে।
তিনি আরাে বর্ণনা করেন যে, স্থায়ী জীবন-জীবিকার অনুসন্ধানে চাকরা ফীংখং, চিলুইন উপত্যকা হতে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে তগাে, কাসা নামক স্থানে যেখানে চাষাবাদ করার মতাে জমি দেখতে পায় সেখানে বসতি স্থাপন শুরু করে। সেখান থেকে পরবর্তীতে ইরাবতী নদীর উপত্যকায় এসে জুম চাষের সাথে হাল চাষ ও বিভিন্ন ক্ষেত-খলা শুরু করে ।
ইতিহাস গবেষকদের মতে, গৌতম বুদ্ধের জন্মের আনুমানিক তিন হাজার বছর আগে হতে ব্রহ্মদেশ ও আরাকানের মাটিতে সর্বপ্রথম পদার্পণ করেছিল পিউ, কেঙয়েং ও সাক (চাক) নামে তিনটি নৃগােষ্ঠী। ঐ সময় পিউরা খুব সমৃদ্ধ ছিল। এখন পিউ ও কেঙয়েং-এর অস্তিত্ব আর নেই। হয়ত ওরা অন্যদের সাথে মিশে বিলীন হয়ে গেছে। তবে বাংলাদেশের বাইরে মায়ানমারের উত্তর বার্মা, মধ্য বামা, পূর্ব-দক্ষিণ সীমান্ত এবং আরাকানের বিভিন্ন স্থানে চাকদের জনপদ বিদ্যমান।
চাকরা বার্মা ও আরাকান রাজ্যের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত রােহমা পার্বত্যাঞ্চলের সারাক প্রেনামক স্থানে ১৩৩৩ খ্রিস্টাব্দে যখন অবস্থান করছিল তখন তাদের রাজধানী ছিল মিচ্ছাগিরি এবং চাক রাজা ছিলের যােংচো। চাক রাজা যােংচো-এর চোচুং, চোরু ও চোতুং নামে তিন পুত্র ছিলেন।
ঐ সময়কার আরাকানি রাজা মাংথী- এর রাজগুরু সু ওয়েন্না তার রচিত ‘লােবাসারা প্যহ আফ্রে অভিদান’ নামক অং উল্লেখ রয়েছে এভাবে যে, আরাকান রাজা মাংথি ও তাঁর প্রধান উজির একদিন এ বৈঠকে বসে সারাক প্ৰে-এর চাক রাজা যােংচোর সাথে কৌশলে যুদ্ধ করার পনিকল্পনা করেন।
উক্ত পরিকল্পনা অনুসারে প্রচুর সৈন্য-সামন্ত সজ্জিত ৪টি সেনাদল রাজপ্রাসাদের চারদিকে পাঠালেন। প্রটি সেনাদলের সেনাপতির হাতে একই সারমর্ম সম্বলিত এক একটি চিঠি দেওয়া হলো। চিঠির সারমর্ম হলো : ‘যুদ্ধ আপনি সম্মত হলে রাজা মাংথির ভাগ্নি ব্রাহমীকে আপনার পত্নী হিসেবে উপহার দিতে প্রস্তুত’।
আরকান রাজা মাংথির প্রধান উজির সাংগ্রা সুযোগ বুঝে চাক রাজধানী মিচ্ছাগিরির চতুর্দিকে সৈন্য মোতায়েন করে অবরোধ করে ফেলে এবং জ্ঞানে-গুনে অদ্বিতীয় একজন সেনাপতি রে অং-এর উপর এ দায়িত্ব দেয়া হলো। চিঠিসহ ব্রাহমিকে চাক রাজার য়োংচোর নিকট নিয়ে গিলেন।
রাজা য়োংচো যারপরনাই খুশি হয়ে ব্রাহমিকে পত্নী হিসেবে সাদরে গ্রহণ করলেন। ঐ দিকে মিচ্ছাগিরি চারদিকে মোতায়েনরত আরাকানি সৈন্যরা ঐ রাত্রে হঠাৎ রাজাপ্রসাদ অক্রমণ করে বসে। এতে রাজা য়োংচো অনন্যোপায় হয়ে আরাকানি সৈন্যের হাতে সস্ত্রীক বন্দি হন এবং ৩ পুত্র, ২ স্ত্রী ও এক কন্যা চোমে খাইনসহ আরাকান রাজা মাংথির সান্নিধ্যে চলে যান। এইভাবে ১৩৩৩ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে চাক রাজ্যের পতন ঘটে।
চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতাব্দীতে ব্রহ্মদেশ ও আরাকানের বর্মী ও রাখাইনদের মধ্যে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে এক ভয়ানক সংকটময় অবস্থা দেখা দিয়েছিল। এ দুটি সমপ্রদায় (বর্মী ও রাখাইন) তাদের নিজ নিজ অবস্থান শক্তিশালী করা ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অতীত ঘটনাবলির জের টেনে একে অন্যের উপর প্রতিশােধমূলক আক্রমণ পাল্টা আক্রমণ করেছিল।
ইতিহাস গবেষকদের মতে, ঐ অস্থিতিশীল রাজনৈতিক সংকটের সময় চাকরা ব্রহ্মদেশ ও আরাকানে ছিল বিধায় পরিস্থিতির শিকার হয়ে অবর্ণনীয় জানমালের ক্ষতি হয়েছিল। তখনকার ঐ অবস্থায় নিজেদের অনিরাপদ মনে করে একদল চাক তাদের পূর্ব আবাসস্থল মণিপুর ও অরুণাচলের উদ্দেশ্যে চলে যায় এবং একদল বর্তমান বাংলাদেশের পার্বত্যাঞ্চলের দিকে চলে আসে।
পরবর্তীতে এই দল মদুক হয়ে কালক্রমে বর্তমান লামা উপজেলার রংছা নামক স্থানে এসে পৌঁছে। ঐখান থেকে আবার দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং অতপর ত্রিশঢেবা হয়ে বাকখাল নদীর উজানে বাদুরঝিড়ি, বক ঝিড়ি, বাখালের উপত্যকা, বাইশারী, নাইক্ষ্যংছড়ি, চাকবয়ঠা ইত্যাদি স্থানে বসতি স্থাপন করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে চাকরা অভাবনীয় খাদ্য সংকটে পড়ে। এতে উল্লেখযােগ্য সংখ্যক চাক বিশেষ করে ছােট বাচ্চারা প্রাণ হারায় এবং অনেকে আবার আরাকানের অভিমুখে চলে যেতে বাধ্য হয়।
ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে চাকরা বাংলাদেশের পার্বত্যঞ্চলে বসতি গড়ে তোলে। প্রায় তিনশত বছর আগে (সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথামার্ধ্বে) ক্যউ বলী নামে এক পরাক্রমশীল চাক ব্যক্তির নেতৃত্বে গুটি কয়েক পরিবার নিয়ে বর্তমান বাইশরীতে চাষাবাদ ও ক্ষেত-খামার শুরু করে।
পরবর্তীতে ম্রাসাঅং চাক প্রমুখ ব্যক্তিগণও বাইশারীতে এসে ক্যউ বলীর সাথে একত্রিত হয় এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্ম আজ পর্যন্ত ঐখানে বসবাস করছে। বোমাং সার্কেলের প্রজা হিসেবে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে চাক জগোষ্ঠী বসবাস করে আসছে।
এদেশের অধিবাসী হিসেবে দেশের রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রাম তথা ঐতিহাসিক ঘটনাবলি প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে চাক জনগােষ্ঠীকে প্রভাবিত করে। ১৯৭১ সালে এদেশের বীর মুক্তিকামী জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামেও তার ব্যাতিক্রম ঘটেনি। প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে ১৯৭১ সালের মুক্তি সংগ্রামে দেশের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ছােট্ট ভূখণ্ডে বসবাসকারী চাক জনগােষ্ঠীও যথাসাধ্য ভূমিকা পালন করে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালাে রাতে যখন পাকবাহিনী নিরস্ত্র ও নিরীহ জনগণের উপর অতর্কিতে ঝাপিয়ে পড়লাে তখন থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে অধিবাসী প্রতিবেশী ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করার জন্য সীমান্তবর্তী অঞ্চলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এ সময় দেশের পরিস্থিতি দ্রুত অস্থিতিশীলতার দিকে ধাবিত হতে থাকে।
১৯৭১ সালের মে মাসে বাইশারী হতে প্রায় ২৪ কিলােমিটার দূরে আরাকান রােডের পার্শ্বে অবস্থিত পাল পাড়ার আনুমানিক ২০০ হিন্দু পরিবার (কিছু মুসলিম পরিবারও ছিল) জীবন রক্ষার তাগিদে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাইশারী মৌজার চাক পাড়ায় এসে আশ্রয় নেয়। চাক পাড়ায়ও তাদের জীবন নিরাপদ ছিল না।
তাই তখনকার ইউনিয়ন কাউন্সিলের (বর্তমান ইউপি) চেয়ারম্যান প্রয়াত সংখ্যাই চাক ও মংমং চাক দুজনে মিলে চাক জুমচাষিদের সহযােগিতায় এক সুবিধাজনক রাত্রে জঙ্গলাকীর্ণ পথে ঐ পরিবারগুলােকে বার্মার আরাকান সীমান্তের ওপারে পার করে দেয়।
ইতােমধ্যে সারাদেশে পুরােদমে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। বর্তমানে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার পার্শ্ববর্তী এলাকা তথা বড়বিলের স্বনামধন্য ব্যক্তি রশিদ আহম্মদ মাতবর-এর ছােট ভাই প্রয়াত এমদান আহম্মদ, যিনি এককালে ছাত্রলীগেরও নেতা ছিলেন, হাতে ১টি রাইফেল নিয়ে গভীর রাতে মংমং চাকের বাড়িতে এসে হঠাৎ উপস্থিত হন। এ সময় মংমং চাক মুক্তিযােদ্ধাদের অনেক তথ্য সংগ্রহ করে দিয়ে সহায়তা প্রদান করেন। এভাবে চাক জনগােষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধের সময় নানাভাবে ভূমিকা পালন করে।
চাকদের জন্ম-মৃত্যু এবং বিবাহের ক্ষেত্রে গোত্র ও গোষ্ঠীর ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী চাকদের মধ্যে প্রধানত দুটি যেমন : ১. আন্দাে ও ২. ঙারেক গোত্র দেখা যায়। এই দুটি প্রধান গোত্র আবার কতগুলো উপগোত্রে বিভক্ত।আন্দো উপগোত্রগুলো হচ্ছে- আর আন্দো, অনাং আন্দো, পেমুং ও তাবাংদেং এবং ঙারেক গোত্রের উপগোত্রগুলো হচ্ছে- উপ্রা, উতলু, উচ্ছি, কেংকাজিক ও কেংকাবেং।
চাকরা পুনর্জন্ম বিশ্বাস করে। কোনো দম্পতির জীবনে সন্তান জন্মলাভ করলে পূর্বপুরুষের কেউ না কেউ তার কাছে এসেছে বলে তারা মনে করে। তাই এক্ষেত্রে তাদের পরিবারের অনুমতি পূর্ব পুরুষের নামের সাথে মিল রেখে ঐ নবজাতকের নাম রাখার রেওয়াজ প্রচলিত।
কোন গর্ভবতী মহিলার সন্তান প্রসবের সময় হলে তাকে ঘরের প্রধান কামরায় অথবা ঘরের সংযুক্ত ‘কাবাক’ (মাচাং) এ আলাদা করে একটা কামরায় রাখতে হয়। চাকদের ভাষায় ঐ বিশেষ কামরাটির নাম ‘আঃতং’। শিশুর জন্ম হওয়ার পর দাই ‘ছারামাহ’ নবজাতককে এক টুকরো লাল কাপড় জড়িয়ে নেয় এবং ঘন্টাখানেকের মধ্যে স্নান করায়
। এরপর একটি পাত্রে কিছু ভাত ও পানি নিয়ে ঐ পাত্রে একটি জ্বলন্ত অঙ্গার ফেলে দেওয়া হয়। এরপর একদল বুড়ি উক্ত পাত্রে আঙ্গুল ডুবায় এবং ঐ আঙ্গুলটি নবজাতকের হাতে ও পায়ে স্পর্শ করায়। এই অনুষ্ঠানটিকে চাকরা ‘পুক রং বুত্তয়ে’ বলে।
নবজাতকের জন্মের ঐ বিশেষ কামরা ‘আঃতং’ এ ৭ দিন যাবৎ অবস্থানের পর প্রথম যেদিন নবজাতক শিশুটিকে নিয়ে তার মা ঐ বিশেষ কামরা থেকে বেরিয়ে আসে সেসময় শাশুড়ি বা নিকট আত্মীয় কোনো এক বৃদ্ধ মহিলা শিশুটির গায়ে পবিত্র পানি ছিটিয়ে দেয়। এর ফলে ভবিষ্যত তার রোগ ব্যাধি কম হবে বলে চাকদের বিশ্বাস।
বর্তমানে অধিকাংশ চাক পরিবার মহিলার সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে সরকারী-বেসরকারী হাসপাতাল বা ক্লিনিকের সন্তান প্রসবের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করে থাকেন। সত্তর দশকের আগে চাকদের মধ্যে সন্তান প্রসূতির মা ও শিশু মৃত্যুর সংখ্যার বেশি ছিল।
১৯৮০ সালের মাঝামাঝি থেকে চাকদের কিছু শিক্ষা সচেতনতার ফলে প্রসূতি মা ও শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস পেতে থাকে। জ্যোতিষী তত্ত্ব অনুসারে জন্মবার, সময়কে প্রাধান্য দিয়ে রাশিচক্র দেখে নাম রাখা হয়। প্রথম না রাখার দায়িত্ব বর্তায় ছেলে/মেয়ের দাদা-দাদি বা নানা নানির উপর।
নবজাতক শিশুর রামকরণের দিনেই সাধারনত বাচ্চাকে নতুন দোলনায় তোলা হয় এবং এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে দাই (ধাত্রী), আত্মীয়-স্বজন, বুড়ো-বুড়িদের নিমন্ত্রণ করে খানাপিনার আয়োজন করা হয়। আমন্ত্রিত অতিথিগণ সকলেই সামর্থ্য অনুসারে টাকা, কাপড়-চোপড় ইত্যাদি উপহার দিয়ে থাকে এবং নবজাতকের সুস্থ শরীর, দীর্ঘায়ু কামনা করে আশীর্বাদ করে। নবজাতক যদি প্রথম সন্তান হয় তাহলে নামের আগে ‘উ’ আর কনিষ্ঠ সন্তান হয়ে ‘থুই’ যুক্ত করা হয়।
এক এক উপগোত্রে এক এক গোষ্ঠী। একই গোত্রের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ অর্থাৎ আন্দো গোত্রভুক্ত ছেলে ঙারেক গোত্রভুক্ত মেয়েকেই বিয়ে করতে হয়। অনুরূপভাবে ঙারেক গোত্রের বেলায়ও একই নিয়ম প্রযোজ্য।
কোনো ছেলের বিয়ের উপযুক্ত বয়স হলে তার মা-বাবা নিজেরাই অথবা অন্য কারোর মাধ্যমে সম্পর্ক স্থাপনের সূচনা অর্থাৎ আন্দো গোত্রের ছেলে হলে ঙারেক গোত্রের মেয়ে এবং বিপরীতক্রমে ঙারেক গোত্রের ছেলে হলে আন্দো গোত্রের মেয়ে খোঁজ-খবর নেওয়া শুরু করে। কারণ চাক সমাজে স্ব-গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ।
প্রচলিত চাক সামাজিক রীতিনীতি অনুসারে বর পক্ষকে কনে পক্ষের ঘরে তিনবার যেতে হয়। প্রথমবারের ছেলের মাতা-পিতা শুধুমাত্র বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে মেয়ের পিতা-মাতার কাছে যায়। সাথে অবশ্য রীতি অনুযায়ী এক বোতল মদ, পিঠা ইত্যাদি নিয়ে যায়। দ্বিতীয়বারে ছেলের মা-বাবা তাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন ও কয়েকজন মুরব্বিকে সঙ্গে নিয়ে মেয়ের মা-বাবার নিকট যায়।
সে সময় সাথে করে লেম্রং বোতলের মদ, হলুদ ও লবণ দিয়ে সিদ্ধ করা একটি আস্ত মুরগিকে বেটে তৈরি একটি পহদাং (আসন) অথবা একটি পবিত্র পাত্রে সাজিয়ে মেয়ের মা-বাবার সামনে সম্মানের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দিতে হয় এবং আবেদন বরা হয় যে, ‘অমার আজ আমাদের পুত্র (নাম অবশ্যই বলতে হবে) অমুক ও আপনাদের মেয়ে (নাম বলতে হবে) অমুকের সাথে বিবাহের মাধ্যেমে মিলিয়ে দেখার জন্য এসেছি’।
এই বলে এক কাপ করে মদ মেয়ের বাবার হাতে তুলে দিতে হয়। যদি দেখা যায়, ছেলে ও মেয়ের কুষ্ঠি অর্থাৎ উভয়ের জন্ম তারিখ, দিনক্ষণ ও রাশি ঘর-সংসার করার জন্য মিলছে এবং সাথে নিয়ে যাওয়ার মুরগির (১টি ছেলে ও ১টি কনের উদ্দেশ্যে) ‘আচাংগা’ ও ভালো তাহলে ঐ বারেই বিয়ের কথা পাকাপোক্ত করা হয়।
মোরগ-মুরগির জিহ্বার গোড়ার আঁটা দুটির মাঝখানে একটি ছোট আঁটু থাকে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়ে যাওয়া মোরগ-মুরগি দুটি আঁটা ও আঁটু সামনের দিকে নুইয়ে থাকলে তাকে ভালো অচাংগা বা ভালো লক্ষণ বলে তাদের বিশ্বাস।
তৃতীয়বার যখন বরে পিতা-মাতা কনের বাড়িতে যায় তকন তারা বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে অসে। ঐ দিন কনের পক্ষে নিমন্ত্রিত অত্মীয়-স্বজন ও সামাজিক মুসব্বিদের (রোয়াজ ও কার্বারিসহ) উপস্থিত কনে পক্ষের কোনো দাবি-দাওয়া থাকলে তা ফয়সালা করে থাখে।
তৃতীয়বারে কনের বাড়িতে যাওয়ার সময় বর পক্ষের সাথে করে ১০০ থেকে ৫০০টি সিদ্ধ ডিম নিয়ে যাওয়ার রেওয়াজ আছে। বরপক্ষের নিয়ে যাওয়া ডিমগুলো অবশ্যই নে পক্ষের আত্মীয়-স্বজনদের ভাগ দিতে হয়। তার অর্থ হলো অমুকের মেয়েকে অমুকের ছেলের সাথে বিয়ে চূড়ান্ত হয়ে গেছে। ঐ মেয়েকে আর অন্য কারো বৌ দেখা সামাজিকভাবে অপরাধ।
এই সময় কনে পক্ষে আছোয়াং (পণ) দাবি করে। এই দাবি-দাওয়াগুলোর মধ্যে পাইংছা (হাতের বালা), নাতং (কান ফুল, কানের রিং), পনের বাটা, লম্বা দা, বাসন-কোসন, কাপড়-চোপড় ও অন্যান্য অলংকার হতে পারে। চাক সমাজে সাধারণত স্বাভাবিক বিবাহের ক্ষেত্রে নগদ টাকা দাবি করা হয় না।
তবে বিয়ের দিনে বর পক্ষের সামর্থ বিবেচনা করে একটি শূকর বিয়ের অনুষ্ঠানে ভুড়িভোজনের জন্য কনে পক্ষ দাবি করতে পারে। তাছাড়া কনের দাদু-দাদিমা জীবিত থাকলে তারা বরের মাতা-পিতার কাছে এক বা একাধিক বিশেষ ম্যাকমান বা স্মৃতি স্বরূপ উপহার দাবি করতে পারে।
বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হয়ে গেলে নির্দিষ্ট তারিখে বরের নিকট আত্মীয়দের মধ্য হতে স্বামী-স্ত্রী ১ জোড়া ও বিপরীত গোত্রের স্বামী-স্ত্রী ১ জোড়া ‘আঞোইং মেহেকা’ অর্থাৎ নির্মল ২ জোড়া বরের মাতা-টিতার প্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন প্রকার অলংকার নিয়ে বউ আনতে যান এবং সাথে আন্দো গোত্রের ২ জন যুবক-যুবতী ও ঙারেক গোত্রের ২ জন যুবক-যুবতী মোট ৪ চন যুবক-যুবতী প্রতিনিধির সাথে যেতে হয়। তাদেরকে চাক ভাষায় ‘প্রেংছৃছা’ বা ‘নাং লা লুহ্’ বলা হয়। অবশ্য তাদের সাথে অন্যলোকও যেতে পারে। তবে তাদেরকে ‘নাংলা লুহ্’ এর দায়িত্ব প্রাপ্ত প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য করা হয় না।
অপরপক্ষে বিয়ের তারিখ ঠিক হয়ে যাওয়ার পর নিকটতম আত্মীয়-স্বজন বেশ কিছুদিন ধরে কনেকে আনুষ্ঠানিক নিমন্ত্রণ দিয়ে ভাত খাওয়ার এবং নতুন ঘর সংসার সম্বন্ধে সার্বিক ধারণা দেওয়া হয়ে থাকে। অবশ্য এই রীতি আজকাল আর প্রচলন নেই। আগের দিনে চাকদের বিয়েতে সচরাচর বর ও কনে উভয়ের বাড়িতে ৩ দিন ধরে বিয়ের উৎসব উদযাপন করা হতাে।
কনে বিয়ের গানের মাধ্যমে দাদু-দাদি, পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন ও আমন্ত্রিত সকলের কাছে ক্ষমা এবং আশীর্বাদ চাওয়ার অনুষ্ঠান শেষ হলে পর ‘নাংলা লুহ্’ দল কনেকে বরের বাড়িতে নিয়ে যায়। এদিকে অপেক্ষমান বরের পিতা-মাতা কনেকে মাথায় ছাতা দিয়ে গানে গানে আনন্দে মুখরিত পরিবেশে পা ধুইয়ে পবিত্র পানি ছিটিয়ে বাড়িতে তােলে। ঐ রাত্রে অথবা তার পরদিন সকালে শুভ বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়।
প্রথম সন্তান লাভের পর স্বামী নিয়ে অথবা শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে মদ, মুরগি, পিঠা প্রভৃতি খাদ্যদ্রব্য নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পিতা-মাতার বাড়িতে বেড়াতে যায়। এ আনুষ্ঠানিক গমনকে চাক ভাষায় ‘আরাক চিক প্রাইঙ চিক প্রাইঙ’ বলা হয়। এ সময় কন্যা সন্তান পিতা-মাতার কাছে তার প্রাপ্য অংশের সম্পত্তি দাবি করে। পিতামাতার সামর্থ্য অনুযায়ী গরু, মহিষ, অলংকারাদি, নগদ টাকা কন্যা সন্তানকে দিয়ে থাকে। এ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা না হলে পরবর্তী সময়ে এক পর্যায়ে মামা-ভাগ্নের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি হয়। মেয়েকে সাধারণত জমির অংশ দেওয়া হয় না।
আধুনিকতার ছোঁয়ায় চাক সমাজে বিবাহের ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। চাকদের মধ্যে ৩ ধরনের বিবাহ অর্থাৎ কনের পিতা-মাতার অজান্তে চুরি করে ছেলের বাড়িতে তুলে বিবাহ করা এবং ছেলে ও মেয়ের পছন্দ অথবা প্রেম করে বিবাহ করা নিয়ম ব্যতীত অন্য দু ধরনের বিবাহের ক্ষেত্রে সরাসরি ছেলের ঘরে তােলা সামাজিকভাবে অপরাধ হিসেবে গণ্য।
ছেলের ঘরে তােলার আগে ঘনিষ্ঠ এক বা একাধিক ব্যক্তির মাধ্যমে ছেলের মা-বাবাকে জানাতে হয়। মা-বাবার সম্মতি পাওয়ার পরই মেয়েকে ছেলের বাড়ি/ঘরের উঠানে এসে বসাবে। মা-বাবা ও অথবা অন্যের মাধ্যমে পাড়ার কার্বারী, রােয়াজা ও আত্মীয়-স্বজনদের ডেকে এনে কনে তাদের সামনে বসিয়ে সাক্ষী বা পাড়ার মুরব্বিরা কয়েকটি প্রশ্ন করেন,
১. সে স্বেচ্ছায় অমুকের ছেলে অমুকের ঘরে এসেছে কিনা অথবা তাকে জোর করে আনা হয়েছে কিনা; ২. সে (কনে) তার পিতার কোনো মূল্যবান জিনিস বিশেষভাবে সোনা, রূপা, নগদ টাকা, অলংকার সাথে করে নিয়ে এসেছে কিনা; ৩. সে তার বাবার ঘর থেকে এভাবে চলে আসার সম্বন্ধে কোনো ব্যাক্তিকে জানিয়ে এসেছে কিনা ইত্যাদি। এসব প্রশ্নের জবাব উপস্থিত মুরব্বিগণ সন্তুষ্ট হলে পরে কনের সালাম গ্রহণ করবেন এবং ছেলের ঘরে তোলার অনুমতি দেবেন। ঘরে তোলার পর চাক সামাজিক রীতি অনুযায়ী বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়।
পরে অবশ্য ছয় মাস অথবা এক বছরের মধ্যে বর ও কনে উভয় পক্ষ ‘কাংবোয়েং’ বা আশীর্বাদ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। স্বামী-স্ত্রী সামাজিকভাবে স্বীকৃতি লাভের জন্য চাকদের ‘কাংবোয়েং’ অনুষ্ঠান বাধ্যবাধকতা একটা সামাজিকভাবে রীতি।
চাক সমাজে বহু বিবাহ সাধারণত দেখা যায় না। তবে নিষেধও নেই। চাকদের বিবাহ বিচ্ছেদ রীতি আছে। তবে সুনির্দিষ্ট গ্রহণযােগ্য কারণ থাকতে হবে। উল্লেখযােগ্য কারণগুলাের মধ্যে বন্ধ্যাত্ব, পৌরুষত্বহীনতা, কাজে অক্ষমতা, কারাের কোনাে সংক্রামক রােগ থাকলে সামাজিক রীতিনীতি অনুযায়ী বিবাহ বিচ্ছেদ হতে পারে।
পারিবারিক ও সামাজিক আনুষ্ঠানিক কার্যাদিতে গােত্র ও উপগােত্রের দায়িত্ব অপরিসীম। চাকদের মধ্যে কোনাে পুরুষ লােকের মৃত্যু হলে তার মরদেহকে দাহ করার ভার আপন মামার উপর বর্তায়। অথবা মায়ের বংশের কাউকে তার সত্ত্বার ক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। চাকদের মামা-ভাগ্নে সম্পর্ক তাৎপর্যপূর্ণ ও অন্যতম পালিত প্রথা এবং অবর্জনীয় দায়িত্ব। তবে কোনাে মহিলার মৃত্যু হলে তার মরদেহ সৎকার করার দায়িত্ব তার স্বামীর বংশের নয়, বরঞ্চ পিতৃ বংশের উপর বর্তায়।
স্বভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে মৃতব্যক্তির মাথায় তেল মাখিয়ে গোত্র মৃতদেহকে স্নান করানো হয় এবং পরিচ্ছন্ন কাপড় পরিয়ে বাড়ির সয়যুক্ত খোলা মাচায় (চাক ভাষায় কাবাব) অথবা যে পথ বা দরজা দিয়ে মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হবে ঐ দরজায় কামরায় একটা কাঠের কফিনে শুইয়ে রাখা হয়।
মৃতদেহ যতদিন ওভাবে রাখা হবে ততদিন ধর্মীয় পুস্তক পাঠ, মং ঢোল বাজিয়ে পরিবেশকে মূখর করে রাখা হয়। এরপর নির্দিষ্টি দিনে মরদেহকে একটা বাঁশের তৈরি রংবেরং-এর ‘তালাহ’ করে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়। শ্মশানে সমবেত সকলকে এক বা একাদিক ভান্তের উপস্থিতিতে মৃতের পক্ষে পঞ্চশীল নেওয়া হয় এবং এরপর মৃত ব্যক্তির মাথা হতে মাটি পর্যন্ত একটা পরিচ্ছন্ন কাপড় টেনে মৃতের সদগতি কামনা করে পানি ঢেলে উৎসর্গ করা হয়।
প্রথমে নিকটতম আত্মীয়-স্বজন, ছেলে-মেয়ে, পরিবার-পরিজন আগুন ধরিয়ে দেয় এই বলে যে, ‘তুমি আবার আমাদের মাঝে এসো, ভালো জায়গায় জন্ম লাভ কর’। তোমার নামে আমরা পুণ্য করছি, সেই পুণ্যের অংশ তুমি লাভ কর, অপজীব হতে মুক্তি পাও’।
এক্ষেত্রে মৃতদেহের সৎকার ক্রিয়া সম্পন্ন করার দায়িত্ব চাকদের বিশেষ রীতি ‘আপেংজা’ বা দেহ অধিকার প্রথা রয়েছে। এই রীতি অনুযায়ী কোনো ব্যক্তির মৃত্যু হলে তার মৃতদেহ দাহ করার দায়িত্ব বর্তায় তার মায়ের বংশের উপর। সেই জন্য চাকদের মামা-ভাগ্নের সম্পর্ক ও তাৎপর্য অপরিসীম।
মামা ভাগ্নের সম্পর্ককে চাক ভাষায় ‘লিকশিক পাগিং’ বলা হয়। এই সম্পর্ক অব্যাহত রাখার জন্য পিতা-পিতামহ মৃত্যুর আগে পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি পরামর্শ দিয়ে থাকেন বা মরার সময় বলে যান; কোনো মহিলার মৃত্যু হলে এক্ষেত্রে ঐ মহিলার পিতৃবংশের ভাই, ভ্রাতুষ্পুত্ররা তার মরদেহ সৎকার করে।
মৃত ব্যক্তির সাত দিনে তার পরিবার-পরিজন, আত্মীয় ও পাড়াবাসী একত্রে বৌদ্ধ মন্দিরে বা নিজ বাড়িতে ভিক্ষুদের ফাং (আমন্ত্রণ) করে ভাত, সাত প্রকারের তরিতরকারি রান্না করে সাত দিনের ভাত বা ছোয়েং দান কনা হয় এবং মৃতব্যক্তির আত্মার সদগিত কামনা করাহয়। এই অনুষ্ঠানকে চাক ভাষায় ‘সীকফ্রে’ বলা হয়।
চাকদের মধ্যে যৌথ বা একান্নবর্তী পরিবার দেখা যায়। এক্ষেত্রে একাধিক ছেলে সস্ত্রীক পিতা-মাতার সাথে একই পরিবারে দীর্ঘদিন থাকে না। একপর্যায়ে একজন বিবাহিতা ছেলে তার স্ত্রী ও সন্তান-সন্তুতিদের নিয়ে বৃদ্ধ মাতা-পিতার সাথে থেকে যায় এবং অন্য বিবাহিত ছেলেরা তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে আলাদা হয়ে যায়।
চাকরা বৃদ্ধপিতা-মাতাকে লালন-পালন ও সেবা-শুশ্রূষা করা এবং মৃত্যুর পর সৎকার ক্রিয়া সম্পন্ন করা, স্বাভাবিকভাবে মৃত পিতা বা মাতার পুনর্জন্ম কামনা করা, বুদ্ধের নিকট ভালো জীবন লাভের জন্য প্রার্থনা করা, আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-পড়শীদের সাথে একত্রে মৃতের সদগিত কামনা করা ইত্যাদি কার্য সম্পাদন করতে পারলে সেই পুত্র সন্তান নিজেকে ধন্য মনে করে।
চাক সমাজে সামাজিক বিষয়াদির কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা বৌদ্ধ বিহার। বলতে গেলে বৌদ্ধ বিহারকে কেন্দ্র করে চাক সমাজ গড়ে ওঠে। তাই চাক বসতি অঞ্চলে প্রতিটি পাড়ায় অন্তত ছোট হলেও একটি বৌদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়। এমনকি কিছু আগে পর্যন্ত শিক্ষা ক্ষেত্রেও কেন্দ্রবিন্দু ছিল বৌদ্ধ বিহার। বৌদ্ধ বিহারের বার্মিজ বর্ণমালা শিক্ষা দেয়া হতো। নিজেদের মধ্যকার সামাজিক বিষয়াদি ও সমস্যাবলি বৌদ্ধ বিহারকে কেন্দ্র করে সমাধনের চেষ্টা করা হয়।
এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মতো চাক জনগোষ্ঠীর মধ্যেও ঐতিহ্যবাহী হেডম্যান-কার্বারী প্রথাও রয়েছে। চাকরা বোমাং সার্কেলের প্রজা তাই সমাজ সংক্রান্ত সকল ক্ষেত্রে চূড়ান্তভাবে তারা বোমাং সার্কেলের প্রজা হিসেবে বোমাং রাজার দ্বারস্থ হয়।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা ৫টি মৌজার ১৫টি চাক বসতি অঞ্চলে ২টি মৌজার হেডম্যান চাক জনগোষ্ঠী থেকে আর বাকি ৩টি মৌজার হেডম্যান মারমা জনগোষ্ঠী থেকে। প্রথাগতভাবে সামাজিক সমস্যাবলি প্রাথমকিভাবে গ্রমের কর্বারী বা রোয়াজার নেতৃত্বে সমাধানের চেষ্টা করা হয়। কার্বারী বা রোয়াাজা স্তরের পর ঊর্ধ্বতন স্তর হিসেবে মৌজার হেডম্যান নেতৃত্ব রয়েছে। সর্বোচ্চ স্তর হিসেবে রয়েছে বোমাং রাজা।
সত্তর দশক পর্যন্ত জুম চাষ ও হাল চাষ চাকদের জীবনধারণের একমাত্র অবলম্বন ছিল। তাছাড়া তারা রবি শস্য চাষ, পান চাষ, চাতাই বুনানো ইত্যাদি চাকদের কর্মজীবন উল্লেখযোগ্য দৈনিন্দিন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বলা হয়। সে কারণে এককালে তাদের পারিবারিক অবস্থা সচ্ছল ছিল বলা যায়।
প্রত্যেক পরিবারে কম-বেশি গরু, মহিষ, মোরগ-মোরগি, ছাগল ইত্যাদিতে পরিপূর্ণ থাকতো। সেই সময় চাকদের অর্থনৈতিক অবস্থা মোটামুটি সচ্ছল ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে আশি দশক থেকে চাকদের আর্থিক অবস্থা দিন দিন দুর্বল হতে থাকে।
জুম চাষে উৎপাদন হ্রাস, বিভিন্ন কারণে হাল চাষে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির ফলে নিরুৎসাহিত হওয়া, ফলবাগান চাষিদের উপযুক্ত বাজারজাতকরণ ও পণ্যবহনের রাস্তার অভাবের কারণে বাগানে উৎপাদিত ফলাদির ন্যায্যমূল্য রা পাওয়া, পর্যাপ্ত পূঁজির অভাবের ব্যবসা-বাণিজ্যে সফল হতে না পারা ইত্যাদি কারণে চাক জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিবক অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে উঠে।
অন্যদিকে নািইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় ব্যাপাকহারে ব্যক্তিগত মালিকনাধীন রাবার বাগান গড়ে ওঠার কারণে চাক জুমচাষিদের জুমভূমি সংকুচিত হয়ে আসতে থাকে। জুম চাষের শেষে জুমচাষিরা পূর্বে যেভাবে গাছ-বাঁশসহ বিভিন্ন বনজ সামগ্রি বিক্রি করে বাগতি আয়-রোজগার করত তাও এখন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকে দিনমজুরি করে জীবন নির্বাহ করতে বাধ্য হচ্ছে বলা যায়, বর্তমানে চাকদের প্রায় ৮৫% পরিবার দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করতে বাধ্য হচ্ছে।
চাক জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিকভাবে অবনতির অন্যতম কারণ হচ্ছে তাদের চিরায়ত জুমভূমি সংকুচিত হওয়া এবং বিস্তৃত এলাকা বেহাত হয়ে যাওয়া। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা বিস্তৃত জায়গা-জমিতাদের ভোগদখণে ছিল। কিন্তু দিন দিন সেসব জায়গা-জমি তাদের বেহাত হয়ে গেছে বা এখনো যাচ্ছে।
ইতোমধ্যেই বহিরাগত বাঙালিদের বসতি স্থাপনের ফলে অসংখ্য চাক বসতি হারিয়ে গেছে। চাক পরিবারগুলো তাদের বসতি ও চিরায়ত জমিজমা হারিয়ে আরো অধিকতর দুর্গম পাহাড়ি ও জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলে স্থানান্তর হতে বাধ্য হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে নাইক্ষ্যংছড়ির চাকঢালার তুনখ্যং, চাংম্রো ও অওয়াফ্রেং পাড়া, বাকখালীর চাক পাড়া ও পূর্ব বাকখালী পাড়া, লংগদুর চাক পাড়া, মংনামাক ও বকঝিরি (চাক ভাষায় ব্যাংরাং) পাড়া ইত্যাদি উল্লেখ করা যেতে পারে।
পাকিস্তান আমলে চাকঢালার তুনখ্যং ও চাংম্রোর চাক পরিবারগুলো উচ্ছেদ হয়ে পড়ে। আর আশি দশকে উচ্ছেদ হয় আওয়াফ্রেং পাড়ার চাক পরিবারগুলো। এককালে কেবলমাত্র আওয়াফ্রেং পাড়ায় বসতি ছিল প্রায় শ’ খানেক চাক পরিবারের। বিগত আশি দশকে মায়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গা মুসলিম পরিবার ও প্রতিবেশী সমতল অঞ্চল (কক্সবাজার জেলার) থেকে আগত বাঙালিনরা এ পাড়ার জমিজমা চাকদের কাছ থেকে ছলে-বলে-কৌশলে দখল করে নেয়।
ফলে এ পাড়ায় চাক পরিবারের আর কোনো অস্তিত্ব নেই। বাকখালীর চাক পাড়ায়ও প্রায় ৫০ পরিবার চাক জনগোষ্ঠীর ছিল। সত্তর দশকে রাবার বাগান প্রকল্পের নামে এবং নানা ছুতোয় তাদেরকে সেই গ্রাম থেকে সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করা হয়। এমনকি রাবার বাগান কর্তৃপক্ষ কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের কারে নানাভাবে হয়রানি করে থাকে।
অতি সম্প্রতি ২০০৮ সালে লংগদু চাক পাড়ায় ১১ পরিবার চাক জনগোষ্ঠী উচ্ছেদ হয়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়। তাদের জুমভূমিগুলোতে জুমচাষে প্রতিবেশী এলাকার বাঙালিদের বাধাদান ও উৎপাতের ফলে তারা উচ্ছেদ হতে বাধ্য হয়। পশু-সম্পদ বিভাগও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা সদরের অনতিদূরে পশু পালন খামান প্রতিষ্ঠার জন্য আনুমানিক প্রায় পনের একর আবাদি জমি অধিগ্রহণ করেছে। এতে কিছু চাক পরিবার ক্ষতিপূরণ পেলেও এলাকা থেকে উচ্ছেদ হয়ে পড়েছে।
সাম্প্রতিক কালে চাক জনগোষ্ঠীর শিক্ষার সচেতনতা বৃদ্ধিপেয়েছে। ইতোমধ্যে কিছু কিছু ছেলেমেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষাও সমাপ্ত করেছে। কিন্তু উপযুক্ত সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও নীতিমালা না থাকার কারণে স্বল্প জনসংখ্যাসম্পন্ন চাক জনগোষ্ঠীর এসব শিক্ষিত বা অর্ধ-শিক্ষিত চাক যুবক-যুবতীরা বেকার জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে।
সরকারি, আধা-সরকারি, এনজিও এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে গুটিকয়েক চাক যুবক-যুবতী জাকরি গ্রহণ করেছে। কিন্তু বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি দিনে পরিবারের ভরণপোষণ, বৃদ্ধ মাতা-পিতাকে লালন-পালন সম্ভব হয়ে উঠে না।
পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মতো চাক জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশও এখনো ঐতিহ্যবাহী জুমচাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। ১৫টি বসতি অঞ্চলে মধ্যে ৬টি গ্রামের জাকরা লাঙ্গল চাষ করে আর বাকি সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রামগুলোর চাকরা জুমচাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে।
এককালে জুমচাষ করে প্রচুর ধান ও অন্যান্য ফলন উৎপাদন করা যেতো। বলা যায় অত্যন্ত সুুখেই ছিল জুমচাষিদের জীবন=-জীবিকা। কয়েক আড়ি পরিমাণ জুম চাষ করে সারা বছরের খোরাকি অনায়াসে উৎপাদন করা যেতো। বর্তমানে কিন্তু জুমচাষে আগের সেই অবস্থা আর নেই। জুমচাষে আগের মতো ফলন আর পাওয়া যায় না।
চুমচাষে জুমভূমির বিরতি কাল হ্রাস পাওয়া এর মধ্যে অন্যতম কারণ। একবার চাষ করার পর সাধারণত ৭ থেকে ১০ বছর বিরতি দিতে হয় জুমক্ষেত্রের উর্বরতাশক্তি বৃদ্ধির জন্য। এখন ২/৩ বছর অন্তর একই জুমভূমিতে চাষ করতে হয়। এর পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে জুমভূমি সংকুচিত হওয়া।
সরকার আদিবাসী প্রথাগত অধিকারকে লঙ্ঘন করে নানা উন্নয়ন প্রকল্প ও অস্থানীয় বাঙালিদের নিকট জুমভূমি অধিগ্রহণ ও ইজারা প্রদানের কারণে জুমচাষের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে এসছে। ফলে জুমচাষি চাক পরিবারগুলোর অবস্থা দিন দিন শোচনীয় হয়ে উঠেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনাহার, অর্ধাহার, পুষ্টিহীনতা ইত্যাদি তাদের জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চাক সমাজে ভূমি মালিকানা স্বত্ব প্রথাগত পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়ে আসছে। কোনো জমিতে কেউ একবার ভোগদখল করলে তার অনুমিত ছাড়া কেউ ঐ জমি দখল করতে বা চাষ করতে যায় না। এভাবেই তাদের ভূমি মালিকানা স্বত্ব বংশ পরস্পরায় যুগ যুগ ধরে পরিচালিত হয়ে আসছে।
তাই চাক জনগোষ্ঠীর মধ্যে অধিকাংশ জমি-জমা ও বাস্তুভিটা প্রথাগতভাবে মালিকানা স্বত্ব লাভ করে ভোগদখল করে আসছে। সরকারি রেজিস্ট্রেশনের কোনো প্রয়োজনই হয়নি। এ নিয়ে চাকদের মধ্যে কোনো সমস্যাও তৈরি হয়নি।
আর এলাকার বিস্তৃত জুমভূমি চাকদের মধ্যে সমষ্টিগত মালিকানা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ঐ জুমভূমি তারা জুম চাষ করতে পারে, গো চারণ ভূমি হিসেবে ব্যবহার করতে পারে, ঐ ভূমি থেকে গৃহস্থালি কজে বনজ সম্পদ আহরণ করেত পারে ইত্যাদি প্রথাগত অধিকর তারা ভোগ করে অসছে।
লাঙলচাষি চাকদের মধ্যে অধিকাংশের নিজ নামে জায়গা-জমি নেই। তারা অধিকাংশ বর্গাচাষি হিসেবে চাষাবাদ করে। এছাড়া কিছু সংখ্যক রয়েছে ফলবাগান চাষি। তাদের বাস্তুভিটা ও ফলবাগানগুলো অধিকাংশই প্রথাগত আইন অনুসারে ভোগদখল করে আসছে।
চাকদের সমাজ পিতৃসূত্রীয় সমাজ। পুত্র সন্তানরাই পিতার ভূ-সম্পত্তির সমান অংশ পায়। কন্যা সন্তানরা সাধারণত পিতার ভূ-সম্পত্তির ভাগ পায় না। দাবিও করতে পারে না। কোনো চাক ব্যক্তির সম্পত্তি যেমন : হাল চাষযোগ্য জমি, গরু ইত্যাদি পিতা নিজে তা ভাগ করে দেয়।
তবে যে পুত্র সন্তান মা-বাবার সাথে থাকে তাহলে তার অংশ পিতার হেফাজতে থাকে। কোনো পুত্র সন্তান বিবাহিতা এবং পিতার সাথে একান্নভুক্ত অসস্থায় তার মৃত্যু ঘটলে এবং সে এক বা একাধিক সন্তান রেখে গেলে ঐ ছেলে সন্তানরাই তাদের পরলোকগত পিতার ভূ-সম্পত্তির উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করে।
ভূ-সম্পত্তি ভাগ-বাটোয়ারা করার সময় মাতা-পিতা নিজেদের জন্য এক অংশ হাতে রেখে দেয়। যে সন্তান আজীবন মা-বাবাবে লালন-পালন করে সেই সন্তান মা-বাবার জমির অংশ পায়। অস্বাভাবিক বা পুঙ্গ-বিকলাঙ্গ বা পাগল এ ধরণের পুত্রও তার পিতার ভূ-সম্পত্তির অংশ পায়। তবে এই ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে সম্পত্তির কম অংশ দেওয়া হয়ে থাকে।
যে ভাই বাবোন বা নিকট আত্মীয় কিংবা অন্য কেউ ঐ পুঙ্গ বা বিকলাঙ্গ বা অস্বাভাবিক বা পাগল ছেলেকে আজীবন লালন পালন করে সেই ব্যক্তি তার সম্পত্তি পায়। আপন কন্যাও দত্তক পুত্র বা দত্তক মেয়েকে কোরো ব্যক্তি তার ভূ-সম্পত্তির অংশ দিতে চাইলে তাহলে তার পুত্র সন্তানদের সম্মতি সাপেক্ষে বা আইন-আদালতে উইলের মাধ্যমে দিতে পারে।
চাকরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তারা জন্মান্তরবাদী এবং এদের মধ্যে জ্যোতিতত্ত্বের প্রভাব লক্ষণীয়। চাকরা পুনর্জন্ম বিশ্বাস করে কেবল তাই নয়, কোনো দম্পতির সন্তান জস্মলাভ করলে তার পূর্বপুরুষের কেউ না কেউ তাদের কাছে এসেছে বলে তারা মনে করে।
চাকরা হীনযান বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী। মানুষরূপে এই পৃথিবীতে জন্ম লাভ করা অতীত জীবনের কর্মফল বলে চাকদের বিশ্বাস। তারা এটাও বিশ্বাস করে যে, চোখে দেখা-অদেখা অগণিত অসংখ্য জীব সকলই এ জগতে সাময়িক জীবন লাভের ফলে প্রাপ্ত কর্মফল।
চাকরা গৃহত্যাগী বা ভিক্ষুকে বৌদ্ধ ধর্মের ধারক ও সংরক্ষক হিসেবে মান্য করে। তারা শুভ-অশুভ সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে নিজ বৌদ্ধ বিহারে পূজিত ভিক্ষু বা অন্য বিহারের ভিক্ষুকে ফাং (আমন্ত্রণ) করে এনে ধর্মীয় নিয়ম অনুসারে সম্পন্ন করে থাকে। চাকরা জীবনে যেমন কর্ম ও আচরণ করে দেহ ত্যাগের পর তাকে সেই কর্ম ও আচরণের ফল ভোগ করতে হয় বলে বিশ্বাস করে।
ইদানীংকালে কিছু কিছু চাক ছেলে দারিদ্রের তাড়নায় খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হচ্ছে। এই জনগোষ্ঠীর গণ্যমান্য ব্যক্তিরা খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। কারণ চাকরা ছোট নৃগোষ্ঠী, নিজেদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি হলে অস্তিত্বের বিলুপ্তি অবশ্যম্ভাবী।
চাক জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে রয়েছে ওয়াছো (আষাঢ়ী পূর্ণিমা), ওয়াক্যেয়েত (আশ্বিনী পূর্ণিমা), তেংছংমং লাব্রে (অগ্রহায়ণ পূর্ণিমা), কাছুং লাব্রে (বৌদ্ধ পূর্ণিমা) ইত্যাদি।
ক. ওয়াছো (আষাঢ়ী পূর্ণিমা) : ওয়াছো লাব্রে উৎসব (আষাঢ়ী পূর্ণিমা) চাকদের অতি পবিত্র দিবস। দিবসটি তারা অতি উৎসাহের সাথে পবিত্রতার মধ্য দিয়ে পালন করে থাকে। এ দিনে চাকরা ঘরের বাইরে কাজ করে না, প্রাণী হত্যা করে না, গৃহপালিত পশু ও পক্ষীদের বিশেষ যত্ন নেয়।
ওয়াছো লাব্রে উৎসব ঘনিয়ে আসতে থাকলে বয়োঃবৃদ্ধ দায়ক-দায়িকাগণ বৌদ্ধ বিহারে অবস্থানরত ভিক্ষু সংঘের জন্য দানের উদ্দেশ্যে নিজ নিজ ক্ষেদের উৎপাদিত ফলাদি সংগ্রহ করে সযত্নে রাখতে শুরু করে। পূর্ণিমার একদিন আগের সন্ধ্যা হতে বয়স্ক দায়ক=দায়িকাগণ যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী ‘তারাবৈ’ পালন করে।
খ. ওয়াগ্যোই উৎসব (প্রবারণা পূর্ণিমা) : ওয়াগ্যোই উৎসব (আশ্বিনী বা প্রবারণা পূর্ণিমা) বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বিদের অন্যতাম শ্রেষ্ঠ ধর্মীয় উৎসব। ‘ওয়গ্যোই’ এর আবিধিনিক অর্থ হচ্ছে উপবাসের পরিসমাপ্তি বা ত্রৈমাসিক বর্ষাব্রতের শেষ অধিষ্ঠান। আষাঢ়ী পূর্ণিমার পরদিন থেকে তিন মাস ব্যাপি বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ ‘ওয়া’ বর্ষাব্রত পালন শুরু করেন এবং প্রবারণা পূর্ণিমার দিন তা শেষ হয়।
বর্তমারে এই ওয়াগ্যোই উৎসব দুইদিনব্যাপী চলে। বর্ষাব্রত তিন মাসের প্রত্যক পূর্ণিমা ও অমাবস্যা তিথিতে চাক লোকেরা বয়স্ক উপোসথ অষ্টশীল পালন করে থাকে। প্রবারণা পূর্ণিমার দিন চাকদের বয়স্ক নারী-পুরুষ ‘ক্যাং বা বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়ে উপোসথ অষ্টশিল পালন করে ধাকে।
এই দিনে চাকদের প্রতিটি ঘরে পিঠা বানানোর ধুম পড়ে যায়। চাক কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী, দায়ক-দায়িকা ও উপাসক-উপাসিকারা এইদিন নতুন জামা-কাপড় পরে সমবেত হয় বৌদ্ধ বিহারে। এই ছোট-বড় সবাই বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে ভগবান বুদ্ধের উদ্দেশ্যে ফুল, পিঠা ও পিণ্ড দান করে থাকে।
রাত্রে ক্যাং এবং ‘জাদি’ (প্যাগোডা তে গিয়ে প্রদীপ পূজা করে থাকে। এরপর ‘ঙাংগাছামিক’ (ফানুস বাতি) আকাশে উড়ানো হয়। এই ‘ঙাংগাছামিক’ উড়ানোর সময় বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র ‘বাইক-পুন’, ‘হ্নে’ (এক ধরনের বাঁশি) এবং ‘লাংহোয়াক’ (ঝাজ) বাজানো হয়।
ওয়াগ্যোই উৎসবের দ্বিতীয় দিনে চাক যুবক-যুবতীরা বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়ে ভগবানের উদ্দেশ্যে এবং বৌদ্ধ ভিক্ষু,শ্রমণ ও উপাসক উপাসিকাদের নানা রকমের ফলমূল পিঠা, মিষ্টান্ন এবং অন্নদান করে থাকেন। প্রবারনা পূর্ণিমার পরদিন হতে মাসব্যাপী প্রতিটি বৌদ্ধ মন্দিরে ‘কাথিং পোয়ে’ (কঠিন চীবের দান) উৎসব চলতে থাকে।
গ. কাথিং পোয়ে (কঠিন চীবর দান) উৎসব : দানোত্তম কঠিন চীবর দান উৎসব হচ্ছে সংঘ সদস্যদের চীবর (ভিক্ষুদের ব্যবহার বিশেষ বস্ত্রাদি) প্রদানের অনুষ্ঠান। বৌদ্ধ ভিক্ষুর পরিধেয় রং বস্ত্রকে বলা হয় ‘চীবর’। জগতে যত প্রকার দান আছে, তার মধ্যে বুদ্ধ দর্শন মতে ভিক্ষুকে উল্লিখিত সময়ের চীবর দান করাটা সর্বোত্তম।
প্রত্যেক বছর আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে তিন মাস একটানা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বর্ষাবাস উদযাপনের সংগে সংগে এই চীবর দানের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। আশ্বিনী পূর্ণিমার পরদিন থেকে কার্তিকী পূর্ণিমা পর্যন্ত একমাস সময়ের মধ্যে গৃহীগণকে কঠিন চীবর দান করতে হয়। অন্য সময় চীবর সেলাই করে দান করা, আ.পূর্বে প্রস্তুতকৃত চীবর দিয়ে দান করা ই. সাদা কাপড় দিয়ে চীবর করে ও রং করে দান করা।
চাক আদিবাসিরা বর্তমানে দ্বিতীয় প্রাণালীতেই আনুষ্ঠানিকভাবে এই কঠিন চীবর দানোৎসব পালন করে থাকে। এই উৎসবের সময় বাঁশের কঞ্চি ও রঙ্গিন কাগজ দিয়ে একটি কল্পতরু গাছ তৈরি করা হয়। চাক ভাষায় এই কল্পতরু গাছকে বলে ‘প্যাডেছা’ অর্থাৎ স্বর্গীয় গাছ বিশেষ।
টাকা-পয়সা, সোনা-রূপা, বই-কলম, আসবাবপত্র, ছাতা, রুমাল ইত্যাদি ঐশ্বর্য লাভের আশায় ‘প্যাডেছা’-তে দান করা হয়। কঠিন চীবর দান উৎসবের দিন প্যাডেছা, চীবর, অন্তর্বাস (পরনের চীবর), পিণ্ড পাত্র ,ক্ষুর-সুই-সুতা ও কটিবন্ধনী নিয়ে ধর্মীয় শোভাযাত্রা সহকারে বৌদ্ধ মন্দিরে বা নির্দিষ্ট কঠিন চীবর অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া তহয়।
শোভাযাত্রা অগ্রভাগে একজন বয়স্ক পুরুষ ঐ কলাপরু গাছ বহন করে এবং আরেকজন পুরুষ ‘ছাইনজ’ বা কাঁসার ঘণ্টা বাজাতে থাকে। একদল যুবকশোভাযাত্রার শেষভাগে ধর্মীয় গান গেয়ে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে থাকে। এই ধর্মীয় শোভাযাত্রাটি নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছার পর আগে ক্যাং-এর চারিদিকে তিনবার প্রদুক্ষণ করা হয়।
তখন প্রচুর আতশবাজি ফাটানো হয়। অতপর ঐ ধর্মীয় শোভাযাত্রা অনুষ্ঠান অংশগ্রহণকারীরা মণ্ডপে প্রবেশ করে বৌদ্ধ ভিক্ষুগণকে প্রণাম পাঠ করেন এবং শুরু হয় চীবর দান, ধর্মীয় দেশনা ও দানীয় বস্ত্রগুলি উৎসর্গীকরণ। রাতে হাজার প্রদীপ পূজাও করে থাকে। কিন্তু ইদানিং অসচ্ছলতার কারণে এ জাতীয় অনুষ্ঠান চাক সমাজে তেমন দেখা যায় না।
চাকরা ধর্মের পাশাপাশি দেব-দেবতার অস্তিত্ব ও মানবজীবনে তাদের প্রভাব বিদ্যমান থাকে বলে বিশ্বাস করে। তাই তারা কায়িক, বাচনিক ও মানসিকভাবে খারাপ কাজ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখায় সচেষ্ট থাকে। চাকদের দেবে-দেবতার পূজা-পার্বণে উল্লেযোগ্য অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে ‘ঠিং কানাইত্’ অর্থাৎ নদী বা ছড়া রক্ষীকে পূজা করা অন্যতম।
এ পূজা প্রতি বছরের প্রথম বর্ষায় একবার ও শেষ বর্ষায় একবার বছরে দুবার সমাজবদ্ধভাবে পালন করে থাকে। তাছাড়া ঘরের কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসা করে সুস্থ হয়ে নাউঠলে বা কোনো বাচ্চা অস্বাভাবিকভাবে কান্না করলে বা সে রাত্রে ছটফট করলে বা মায়ের দুধ না খেলে ‘কিংরাছু’ অর্থাৎ গৃহ লক্ষ্মীকে উদ্দেশ্য করে পূজা দিয়ে থাকে।
চাক জনগোষ্ঠীর অন্যতম সামাজিক উৎসব হলো সাংগ্রাইং বা নববর্ষ উৎসব ও নবান্ন উৎসব।
বৈসুক, সাংগ্রাইং ও বিজু উৎসব পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের অতি তাৎপর্যপূর্ণ ও ঐতিহ্যবাহী উৎসব। এ উৎসবকে ত্রিপুরা ভাষায় ‘বৈসুক’, মারমা ও চাকরা ‘সাংগ্রাইং’ এবং চামারা ‘বিজু’ হিসেবে বাংলা বৎসরের শেষ দুদিন এবং নববর্ষে প্রথম দিরসহ মোট তিদিন যথাযোগ্য মর্যাদার প্রতিবচল পালন করে থাকে। যদিও এই উৎসব তিনদিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় কিন্তু এর রেশ বেশ কয়েকতিন পর্যন্ত চলতে থাকে।
বৈসুক, সাংগ্রাইং ও বিজু মীলত একই সময়ের উৎসব হলেও অঞ্চল ও নৃগোষ্ঠী ভেদে প্রত্যেকে নিজস্ব সংস্কৃতির আলোকে এ উৎসব পালন করে। চাকদের মাঝেও আবহমান কাল হতে প্রতি বছর নিজস্ব অনুযায়ী এ সময় উৎসব পালিত হয়ে আসছে। সাংগ্রাইং উৎসব চাকদের ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনে এমনি একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। এ উৎসবের মাধ্যমে চাক সমাজের প্রচলিত সামাজিক আচার-আচরণ, রীতি -নীতি, প্রথাি-বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণার বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
এই শুভ ‘সাংগ্রাইং’ উৎসব প্রতিপালনের মধ্য দিয়ে চাকরা সকল হিংসা-দ্বেষ ভুলে গিয়ে একে অন্যকে সম্ভাষণ জানায় এবং সমস্ত সংকীর্ণতা পরিহার করে অহিংসায় দীক্ষিত হয়ে এ উৎসবের সময় তাদের মাঝে বেড়ে যায় বৌদ্ধ মন্দিরে অসা-যাওয়া পূজা পার্বণের ব্যস্ততা, বয়স্ক-বৃদ্ধ-অক্ষম ব্যক্তিদের সেবা শুশ্রূষা ও পরিচর্যা, জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন, পুরোনো বছরকে বিদায় এবং নববর্ষকে সাদর সম্ভাষণ জানায়।
চাকদের সাংগ্রাইং উৎসব বর্মী সনের দিন ও তারিখ অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হয় এবং এতে বর্মী সংস্কৃতি কিছুটা প্রভাব দেখা যায়। সাংগ্রাইং চলাকালীন বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ‘ছোঁয়াইং’ (ভাত ও নানা প্রকার তরকারি) রান্না করে দান করা হয়ে থাখে। যে খাদ্য সামগ্রী ভিক্ষু, শ্রমণ ও উপাসক-উপাসিকাদেরকে দার করা হয় তাকে চাক ভাষায় ‘ছোঁয়াইং’ বলে। মাছ, মাংস, শাক-সবজি ও ভাত ছোঁয়াইং-এর প্রধান উপকরণ।
ক. প্রাক-সাংগ্রাইং : ‘সাংগ্রাইং’-এর আগমনী বার্তার সাথে জাকদের প্রতিটি গ্রাম ও পাড়ায় বয়ে যাায় ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের চঞ্চলতার ও অনন্দ-উল্লাস। ঘরে ঘরে বিছানাপত্র, কাপড়-চোপড়, ঘর-দোর পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করার জন্য ব্যস্ততার ধুম পড়ে যায়। কারণ সাংগ্রাইং সন্নিকেট।
আবার গ্রামের প্রতিটি আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই একত্র হয়ে লেগে যায় বিভিন্ন রাস্তা-ঘাটের সংস্কার, ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান, বৌদ্ধ মন্দির, জাদি (প্যাগোডা). পালিটোল ইত্যাদি পরিচর্যা ও সংস্কার কাজে। সাংগ্রাইং -এর ঠিক একদিন আগে পাড়ার যুবক-যুবতীরা দলে দলে কলসি নিয়ে মহানন্দে বৌদ্ধ মন্দির (ক্যাং) ধৌত করে থাকে।
আরো দেখা যায় কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী ও বৃদ্ধ সবার মাঝে নানা রঙের নতুন পোশাক কেনাকাটার রেওয়াজ। সাংগ্রাইং আগমনের পূর্বাভাস চাক শিশু-কিশোরদের দ্বারাও প্রবলভাবে প্রকাশ পায়। এরা বিভিন্ন রকমের আতশবাজি ফুটিয়ে হৈ চৈ করে পাড়া-গ্রাম তোলপাড় করে তোলে।
খ. সাংগ্রাইং-এর প্রথম দিন : পাইংছােয়েত : সাংগ্রাইং উৎসবের প্রথম দিনকে চাকরা ‘পাইংছােয়েত’ (ফুল দিবস) বলা হয়। পাইছােয়েত-এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে ‘ফল তোলা’। ফুল চাকদের কাছে পবিত্র বস্তু । এই দিনে আনন্দমূখর পরিবেশে ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে ও যুবক-যুবতীরা দল বেঁধে নানা প্রকার ফুল সংগ্রহ করে থাকে।
‘কাইনকো পাইন’ (নাগেশ্বর ফুল) চাকদের খুব প্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী ফুল। তাই এ দিনে চাক যুবক-যুবতীরা দলবদ্ধ হয়ে দূরবর্তী জঙ্গরে গিয়ে হলেও ‘কাইনকো পাইন’ সংগ্রহ করে থাকে। বিকালে বৌদ্ধ মন্দির (ক্যাং)-এ গিয়ে কাইনকো পাইন ফুল গুলো বুদ্ধ পূজার পাত্রে সুন্দরভাবে সাজিয়ে ভগবান বুদ্ধের নিকট দান করে সারা বৎসরের জন্য সখ-শান্তি ও মঙ্গল কামনা করে থাকে।
এদিন প্রাতঃকালে চাক বয়স্ক, বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা উপােসথ শীল (অষ্টশীল) গ্রহণ ও উপবাস যাপনের জন্য বিভিন্ন দানীয় সামগ্রী নিয়ে বৌদ্ধ বিহারে মূল সাংগ্রাইং-এর তিন দিনের জন্য বিছানাপত্রসহ অবস্থান গ্রহণ করে থাকে। এই উপােসথ শীল পালনকারীদেরকে চাক ভাষায় ‘উনবুকছিলা’ বলা হয়।
এই সময় ধর্মালয়ে সারিবদ্ধভাবে ভক্তিচিত্তে দায়ক-দায়িকা, উপাসক উপাসিকাগণ পবিত্র মনে ধ্যানে মগ্ন হয়ে থাকে। এ দিনে পানি খেলাসহ বিভিন্ন খেলাধুলার আয়ােজন করা হয়। তারমধ্যে ‘পেকো’ (ঘিলা), ‘গ্যাং’ (লাটিম), ‘খােকছি’ ও ‘মাইকানিকছা’ (কানামাছি) উল্লেখযােগ্য খেলা।
গ. সাংগ্রাইং-এর দ্বিতীয় দিন : আক্যাই : সাংগ্রাইং উৎসবের দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ মূল সাংগ্রাইং উৎসবের দিনকে চাকরা ‘আক্যাই’ বলে। এই দিন ভাের রাত্রে বৌদ্ধ বিহারের ভিক্ষু, শ্ৰমণ এবং উপাসক-উপাসিকাদের জন্য আরুণ ছােয়াইং পরিবেশন করা হয়।
এ দিনে পাড়ার যুবক-যুবতীগণ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাইক’ (ঢোল), লাংহােয়াক’ (ঝজ) এবং ‘হ্নে’ (এক ধরনের বাঁশি) বাজিয়ে বৌদ্ধ মান্দরে (ক্যাং) গিয়ে শ্ৰমণ এবং উপাসক-উপাসিকাদের প্রণাম করে গােসল করায়। এই সময় পাড়ায় বয়স্ক লোকদেরও ঘরে ঘরে গিয়ে গোসল করানো হয়। তখন বয়স্ক লোকদের কেউ কেউ তাদের আশীর্বাদ স্বরূপ কিছু টাকা দিয়ে থাকে।
এই দিনের দ্বিতীয় পর্বে থাকে বুদ্ধ পূজা ও পঞ্চশীল গ্রহণ। বিকালবেলা পাড়ার প্রতিবেশী, ছেলে-মেয়ে, ছোট-বড় সবাই নির্দিষ্ট একটা স্থানে একত্রিত হয়ে শৃঙ্খলার সাথে লাইনে দাঁড়িয়ে বুদ্ধ পূজা ও পঞ্চশীল গ্রহণের উদ্দেশ্য বিহারের অভিমুখে রওনা হয়। তখন পাড়ার যুবকগণ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাইক’ (ঢােল), ‘হ্নে’ (এক ধরনের বাঁশি), লাংহােয়াক’ (ঝাঁজ) বাজাতে থাকে।
সাথে সাথে যুবতীদের হাতে ‘নাইংছা-ই’ (পবিত্র চন্দন পানি), দুধ, ‘তারাবৈ’ (চাল, কলা, নারিকেল, সুপারি, দুধ, চিনি, চা পাতা মোমবাতি ও দিয়াশলাইসহ বিভিন্ন দানীয় সামগ্রী) একজন বয়স্ক পুরুষ ‘ছাইনজু’ (কাঁসার ঘণ্টা) বাজাতে থাকে। তখন ছোট ছোট ছেলে ও যুবকরা বিভিন্ন ধর্মীয় গান করতে থাকে।
বৌদ্ধ বিহারে পৌঁছার পর বিহারের চারদিকে তিনবার প্রদক্ষিণ করে। ‘বুংছি’ নামক বিভিন্ন প্রকারের বাজি তখন ফুটানো হয়। পরে যুবতীদের আনা ‘নাইংছা-ই’ (চন্দন পানি) ও দুধ দিয়ে বুদ্ধকে স্নান করানো হয়। তারপর বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কাছ থেকে ‘ঙাবাছিলা’ (পঞ্চশীল) গ্রহণ করে এবং দানীয়সামগ্রী ‘তারাবৈ’ ও ‘প্যাডেছা’ গুলো (কল্পতরু) বৌদ্ধ ভিক্ষুর নিকট ধর্মীয় নিয়ম মতে দান করা হয়। এই দানের মাধ্যমে জন্ম-জন্মান্তরে ও নতুন বছরের জন্য সুখ-শান্তি ও উন্নতি কামনা করা হয়।
সর্বশেষে ভিক্ষুগণ উপস্থিত পুণ্যার্থীদেরকে বিভিন্ন ধর্মীয় জাতক ও ধর্ম দেশনা শুনিয়ে থাকেন। বিভিন্ন নৃত্য, সংগীত ও নাট্যানুষ্ঠানের প্রতি চাকরা খুব আগ্রহী। তাই এই দিনে সারারাত গ্রামে গ্রামে ‘জাইভ’ (নাট্যানুষ্ঠান) মঞ্চস্থ হয়। উল্লেখ্য যে, আগেকার দিনে চাকদের নাচ, গান ও নাট্যানুষ্ঠান অধিকাংশই বর্মী ও রাখাইন ভাষায় মঞ্চস্থ করা হতাে কিন্তু বর্তমানে চাকরা কিছুটা শিক্ষিত হওয়ার কারণে তা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
বরঞ্চ চাকরা এখন নিজস্ব ভাষায় নাচ, গান ও নাটক মঞ্চস্থ করে থাকে এই শুভ সাংগ্রাইং দিনে। চাকদের এই সংস্কৃতির উপর কবে কখন থেকে বর্মী সংস্কৃতির প্রভাব তা জানা নেই। তবে ধারণা করা যায়, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শাসনাধীনে থাকার সময় থেকে হয়তাে বর্মী জাতির প্রভাবের সূচনা হতে পারে। এমনিভাবে নাচ-গান, নাট্যানুষ্ঠানের মাধ্যমে শেষ হয়ে যায় চাকদের মূল সাংগ্রাইং উৎসব।
ঘ. সাংগ্রাইং-এর তৃতীয় দিন : আপ্যাইং : মূল উৎসবের পরবর্তী দিনকে অথাৎ সাংগ্রাইং-এর তৃতীয় দিনকে চাকরা আপ্যাইং বলে। এই দিন নববর্ষ উপলক্ষে বিভিন্ন রকমের পিঠা, সেমাই ও মিষ্টান্ন বৌদ্ধ বিহারে ভিক্ষু, শ্ৰমণ ও উপাসক-উপাসিকাদেরকে দান এবং তৎপরে পাড়া প্রতিবেশী ও আমন্ত্রিত অতিথিদেরকে আপ্যায়ন করা হয়।
আবার এই দিন থেকে কয়েকদিন পর্যন্ত ছােট-বড় সবাই মিলে এক পাড়া থেকে অন্য পাড়াতে বুদ্ধ পূজার উদ্দেশ্যে যায়। চাক ভাষায় একে ‘ফারা রিক্ষ্যে’ বলা হয়। সাথে যুবতী ও গৃহিণীরা মূল সাগ্রাইং দিনের মতাে ‘নাইংছা-ই (চন্দন পানি), ‘তারাবৈ’ (দান সামগ্রী) এবং ‘প্যাডেছা’ (কল্পতরু) নিয়ে যায়।
বৌদ্ধ মন্দির (ক্যাং)-এ পৌছার পর শৃঙ্খলার সাথে সারিবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন বাজিয়ে ছােট ছেলে ও যুবকরা ধর্মীয় গান গেয়ে ক্যাং-এর চারিদিকে তিনবার প্রদক্ষিণ করে। এরপর বুদ্ধ মূর্তি, ভিক্ষ, শ্ৰমণ ও উপাসক-উপাসিকাদেরকেও স্নান করানাে হয় এবং পঞ্চশীল গ্রহণ করা হয়। এই সময় এক পাড়ার সাথে আরেক পাড়ার যুবক-যুবতীদের মধ্যে পানি খেলা খেলতে দেখা যায়। এতে তাদের এক এলাকা হতে অন্য এলাকায় পরস্পরের সাথে পরিচয় এবং ভাব বিনিময়ের মাধ্যমে সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে ওঠে। সবশেষে ভাত ও বিভিন্ন খানা-পিনা পরিবেশেন করা হয়। এভাবে কয়েকদিন ধরে চলা চাকদের সাংগ্রাইং উৎসবের সমাপ্তি হয়।
আংনাইবুক পাে (নবান্ন উৎসব) চাকদের অন্যতম সামাজিক উৎসব। প্রায় চাকদের ঘরে ঘরে বৎসরে একবার নতুন ফসল উঠানাের পর এই উৎসব পালন করে থাকে। চাকদের অনেকে জুম চাষি, আবার অনেকে হাল চাষে নির্ভর। তাই সচরাচর জুম চাষিরা ভাদ্র মাসে করে থাকে।
যে কোনাে চাষাবাদের আগে বা কাজ শুরুর প্রথম দিন এবং ফসল তােলার/ধান কাটার প্রথম দিন জ্যোতিষী তত্ত্বের ভালো/শুভ দিনক্ষণ দেখে কাজ শুরু করে থাকেন। নবান্ন উৎসবে আত্নীয়-স্বজন পাড়া প্রতিবেশীদের সাধ্যমত নিমন্ত্রণ করে থাকে।
নতুন শূকরের মাংস, মুরগির মাংস ও তরিতরকারি, ধানের চাল পাড়ার যুবক-যুবতীরা আনন্দ মুখর পরিবেশে রান্না করে এবং রান্নার শেষে প্রথমে বৌদ্ধ বিহারে ছােয়েং দেয়ার পর পরই আমন্ত্রিত অতিথিদের পরিবেশন করা হয়। আমন্ত্রিত গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ নবান্ন ভাত খাওয়ার আগে যে ঘরে নবান্ন উৎসব সেই ঘরের আগামী দিন ও অনাগত দিনের জুম চাষ বা কৃষি কাজে আরাে উত্তরােত্তর ফসল ভালাে ফলনের কামনা করে আতিথেয়তা গ্রহণ করে থাকেন। নবান্ন উৎসবে মদও পরিবেশন করা হয়।
চাকদের নিজস্ব ভাষা আছে তবে নিজস্ব বর্ণমালা নেই। গবেষকগণ কেউ কেউ চাক কথিত ভাষাকে লুই ও তিব্বতি বর্মী ভাষা বলে আখ্যায়িত করেছেন। চাকদের ভাষা প্রায় ৬০-৬৫% বর্মী ও আরাকানি ভাষার শব্দ মিশ্রিত আছে। পূর্ব পুরুষের কাছ থেকে জানা যায়, বহু বছর আগে চাকদের বর্ণমালা ছিল।
চাকরা বৌদ্ধ মন্দিরে ভিক্ষুদের কাছ থেকে বার্মিজ বর্ণমালা শিখে থাকে। বার্মিজ বর্ণমালায় চাক ভাষা লিখে থাকে। যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে বৌদ্ধ বিহারে শিক্ষার এই প্রথা বর্তমানে প্রায় উঠে যাচ্ছে।
বর্তমানে চাক ভাষার বর্ণমালা তৈরির প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মংমং চাক। চাকদের এনে কথিত ভাষার উচ্চারণ অনুসারে স্বরবর্ণ ১১টি ও ব্যঞ্জনবর্ণ ৩৪টি ইতিমধ্যে তিনি তৈরি করেছেন। আবার ইকার উকারের ব্যবহারের উচ্চারণ তৈরি করেছেন। গণনায় ব্যবহারের জন্য সংখ্যাও তৈরি করেছেন।
ইতােমধ্যে চাক সমাজে এ নিয়ে বেশ আগ্রহ ও আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছে। চাক ভাষা নিজস্ব বর্ণমালায় লিখিত আকারে সংরক্ষণ করতে না পারলে আগামীতে বর্তমান মুখের ভাষা বিলুপ্তি ঘটবে এবং সাথে সাথে এ নৃগােষ্ঠীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না বলে চাকদের ধারণা।
বিশেষ করে চাক ভাষার উপর বাংলা ভাষা ও বৃহত্তর মারমা জনগােষ্ঠীর ভাষা দ্রুত গতিতে প্রভাব বিস্তার করছে। এই বিশ্বায়নের যুগে অতি স্বল্প জনসংখ্যাসম্পন্ন চাক জনগােষ্ঠীর ভাষা রক্ষা করা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। নিম্নে বঙ্গানুবাদসহ চাক ভাষার কয়েকটি শব্দ দেয়া গেল
চাক | বঙ্গানুবাদ |
ফুংফাং ক্র তাগো পাছি থিং তালুং তানা পুক কাইং তাছালং মাইংছা উকছা ইছা আং কুছাইক্ আসাইং আহুসিং আছাকানু আহুব লাকমং রাং ক্রাইকাছি চাউছি আ নিভ মুঙ প্রী ঙা ক্রুখ স্নীং আ-চাইখ তাহু ছীঃ তাইংরাং ছিংহাইক মালাংহাইক উজু হাইক বেড়ুক উহা ছামুক কাপিল পাজু পাজু কামু কিং লাং কংগ্লাক চামিক ছান্দা ছাকাইংছি |
গাছ বাঁশ পাহাড় নদী পাড়া পাথর মাছ ভাত তরকারি পুরুষ শিশু বৃদ্ধ বৃদ্ধা ধান চাউল মুখমণ্ডল চুল নাক কপাল বাহু বুক আম কলা এক দুই তিন চার পাঁচ ছয় সাত আট নয় দশ ঝরনা শীতকাল গ্রীষ্মকাল বর্ষাকাল টিয়াপাখি কাক গরু ছাগল শামুক ছাই লুঙি ঘর রাস্তা আকাশ সূর্য চাঁদ তারা |
চাকরা নিজস্ব ভাষায় বিভিন্ন উৎসব ও শোকানুষ্ঠানে ‘ছিকহ্রাং’ বা গান করে থাকে। গানের মধ্যে পেকোরুক্ তেহহ্রাং (ছড়া গান), ভাইক্ লুং তেহহ্রাং (ঘুম পাড়ানো গান), নাংলা ছিকহ্রং (পালা গান), অপ্য ছিকহ্রাং (উৎসব গান), ওয়েংনেহ্ ছিকহ্রাং (বিয়োগান্ত/বিরহ গান), জাইক তেহহ্রাং (নাচ গান) ইত্যাদি এখনো চাকরা তাদের সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে নাচের তালে তালে গেয়ে থাকে।
পূর্ব পুরুষরা ধর্মীয় কাহিনী ও ইতিকাহিনী ভিত্তিক জাইক্ (নাটক) মঞ্চস্থ করত। অজানা কাল হতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এভাবে উৎসব পালন করত। এ ধারা সত্তর দশক পর্যন্ত প্রচলন ছিল। পেশাদার নাট্যকার, নাচ-গান উৎসব কমে যায়। এখন পুনরায় নিজ ভাষায় নাচ-গান চর্চা করতে দেখা যাচ্ছে। লেখাপড়ার সাথে তাল মিলিয়ে চাকদের ব্যক্তি জীবনও অন্যদের সাথে মিশে যেতে শুরু করছে। ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র রয়েছে বাইক (ঢোল), হ্নে ( এক ধরণের বাঁশি) লাং হোয়াক (ঝজি মং), চিংছা ( ওাই ঝাজি) ইত্যাদি।
চাকদের জনপ্রিয় স্বাদের খানা হলাে ‘কাইংরাবুং’ ও ‘তােহজাহ’। একাধিক পদের সবজি, মাছ অথবা মাংসসহ টক-ঝাল একত্রে মিশিয়ে রান্না করাকে চাক ডাক কাইংরাবুং বলে। আর শুকনা মাছ ও মরিচ একত্রে বেটে তার সাথে সিদ্ধ শাক-সবজি মিশ্রিত খানাকে চাক ভাষায় তােহ্জাহ্ বলে। এই দু প্রকারের খানা চাকদের প্রিয় খাদ্য। চাকরা তৈল, মসলা কম খায়।
চাক জনগােষ্ঠীর বাসগৃহ সাধারণত উঁচু হয়। ভূ-প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত কারণে মাটি হতে ৪ ফুট উঁচু মাচাং ঘরের মতাে তাদের বাসগৃহগুলাে নির্মাণ করা হয়ে থাকে। যেমন : কিংসাইন বা কিং তং (মূলসুর), ক্যুকহুং (শয়ন কক্ষ), সাইনদেক ক্যুকহুং (গৃহ লক্ষ্মী কামরা যেখানে কুংনক নামে একটি বেতের তৈরি পাত্রে চাল রাখা হয়)।
প্রোয়া (ছেলে মেয়েদের সাজগােজের কক্ষ), কাবাক (গৃহের পিছনে খােলা অংশ যেখানে ধান-মরিচ ইত্যাদি শুকানােসহ মেলার বা আড্ডার আসর বসে), সুতরাং (গৃহের সামনের অংশে ছাউনি যুক্ত খােলা থাকে, যেখানে কিকছুং গাছের তৈরি), ধানের মেশিন ও থুং (হারা ধান মারাসহ ইত্যাদি কাজে ব্যবহার্য) এবং টাক (চুলাযুক্ত রান্নাঘর), উকুং আংদে (ধানের গােলা), থাংরাং (লাকা; রাখার ঘর)।
উকুং (মুরগিঘর), বাক কুং (শূকর পালন ঘর), শামুক কুং (গােয়াল ঘর), ছামুক সিদুং (গােবর রাখার ঘর), গাছি (পায়খানা ঘর) নির্মাণ করে চাকরা বসবাস করতে অভ্যস্ত। আধুনিকতার ছোঁয়ায় বাসগৃহের ধরন অনেক পরিবর্তন হয়েছে। অনেকে এখন আগেকার মতাে ঐতিহ্যমণ্ডিত মাচাং ঘর নির্মাণ না করে আধুনিক নকশার ঘরবাড়ি তুলে থাকে।
চাকদের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত পােশাক-পরিচ্ছদ রয়েছে। চাকদের পােশাক পরিচ্ছদ ও অলংকার ইত্যাদি ব্যবহারে নিজেদের ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। আগেকার দিনে পুরুষরা পাংহ্রে কামুহ বা নয় হাতি ধুতির পরিবর্তে বর্তমানে লুঙ্গি ব্যবহার করছে। মহিলারা কান বড় ‘নাতং ফ্র’ নামে একপ্রকার
চাকদের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত পােশাক-পরিচ্ছদ রয়েছে। চাকদের পােশাক পরিচ্ছদ ও অলংকার ইত্যাদি ব্যবহারে নিজেদের ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। আগেকার দিনে পুরুষরা পাংহ্রে কামুহ বা নয় হাতি ধুতির পরিবর্তে বর্তমানে লুঙ্গি ব্যবহার করছে। মহিলারা কান বড় ‘নাতং ফ্র’ নামে একপ্রকার কান দুল পরিধান করত ।
মাথায় কালো পাগড়ি বা রাংকাইন পহ, বক্ষে বক্ষ বন্ধনী বা রাইকাইন পে , ‘গলায় ক্রীক,’(গলার চেইন), আংগুলে ‘নাচক’(আংটি) ব্যবহার করত । বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসনে চাকদের এসব ঐতিহ্যবাহী বস্তু-সংস্কৃতি বিলুপ্ত হতে বসেছে।
‘তেংদু’ (রূপকাহিনী) বাচ্চাদের শােনানাে ও শােনা চাকদের মধ্যে প্রচলন আছে। রাত্রে ঘুমাবার আগে দাদু, দাদিমা, মা-বাবার কাছে বিছানায় নানান রকমের ‘তেংদু’ বাচ্চাদের শােনায়, আর বাচ্চারাও তেংদু শুনতে আগ্রহী। তেংদু বা রূপকাহিনীর মধ্যে ভূতের তেংদু, নাপ্যাছা তেংদু (অলস রূপকথা), শােয়ে-ঙয়ে রাতানা তেংদু (অলৌকিক কাহিনী), ভেলু তেংদু (রাক্ষস কাহিনী) ইত্যাদি উল্লেখযােগ্য।
কিছু কিছু চাক রূপকাহিনী ও লােককাহিনী যেমন : আউক পাধুংমাঙ, রেতুক, চিংব্লিকছা ইত্যাদি তেংদু উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রকাশিত ‘উপজাতীয় রূপকথা ও লােককাহিনী এবং কিংবদন্তি’ নামক বইয়ে এবং ‘সাংগু’ নামক সংকলনের বিভিন্ন সংখ্যায় ছাপা হয়েছে।
এসব রূপকাহিনী মূলত বংশ পরম্পরায় লােক মুখে মুখে সংরক্ষিত হয়ে আসছে। কিন্তু বর্তমান আধুনিকতার ছোঁয়ায় যান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রভাবে এখন আগের মতাে শিশুকিশােরদের শােনানাে হয় না। ফলে এসব মূল্যবান রূপকাহিনী ও লােককাহিনী হারিয়ে যেতে বসেছে। নিম্নে রেতুক তাইনদু (টিয়ে পাখি) নামে জনপ্রিয় একটি রূপকাহিনী দেয়া গেল-
এককালে এক গ্রামে বাস করত এক বুড়াে আর এক বুড়ি। তাদের সংসারে ছিল এক নাতনি। নাম তার য়োদি। একদিন বুড়াে আর বুড়ি ঘরের উঠানে ধান শুকিয়ে গ্রামের পার্শ্বের জঙ্গলে শাক ও লতাপাতা সংগ্রহে বের হয়ে পড়ল। যাবার সময় নাতনিকে বলে গেল ‘য়োদি, আজ রেতুকরাক (টিয়া পাখিরা) আসতে পারে, আসলে ধান খেতে দিও না।
নাতনিকে এই বলে ওরা ঘর থেকে বের হয়ে পড়ল। বুড়ােবুড়ি আড়াল হতে না হতেই টিয়া পাখিরা ঠিকই এসে পড়ল। তারপর য়োদির কাছে ধান খাওয়ার জন্য কাকুতি-মিনতি করতে থাকল। ছােট মেয়ে য়োদির দাদু-দাদির কথা মনে পড়ে গেল। রেতুকদের বলল, ‘আমার দাদু-দাদি তােমাদের ধান না দিতে বারণ করে গেছে। তাই আমি তােদেরকে ধান দিতে পারবাে না।
কিন্তু এ দিকে টিয়ে পাখিরা এমন নাছােড়বান্দা যে, ধন না খেয়ে ছাড়বে না। তাই অবশেষে য়োদি টিয়ে পাখিদের ধান দিতে বাধ্য হলাে। পাখিরা পেট ভরে ধান খাওয়ার পর দেখল যে, চাটাই একটুও ধান রইল না। টিয়ে পাখিরা বলাবলি করল, ‘হায়রে, অনেক তাে মস্ত বড় অন্যায় করে ফেলেছি। বেচারীকে কিছু বুদ্ধি দেওয়া দরকার।
এরপর যাবার সময় পাখিরা বলে গেল, তুই এক কাজ করবি, তাের দাদু মারলে দাদির কোলে যাবি আর দাদি মারলে দাদুর কোলে যাবি। যদি দাদু ও দাদি দুজনে মিলে মারতে চায়, তাহলে আমাদের কাছে চলে আসবি। আমাদের দেশ উত্তর দিকে বহুদূরে অবস্থিত চারেক কাউন্ বন (কাঁটা ভিঙি) ।
আমাদের স্মরণ করে এসে ঐ বন অতিক্রম করার সময় তােকে এই গান করতে হবে, ‘চেরাই্ক কাইন্ ঞো ঞো তাগাছো ফু-আ তালে লাং, মারংছা হ্রাংন’ তালো লাং রেতুক প্রাইঙ্গা ঠুক লাংগহ।” বাংলায় যার অর্থঃ কাঁটা ডিঙি বন, কাটা ডিঙি বন কোথায়? এক টিলা পার হবি, এক ছড়া পার হবি, তারপর টিয়াদের দেশ।
ওদিকে য়োদির দাদু-দাদি যথাসময়ে বাড়িতে ফিরল এবং নাতনির কাছে ধানগুলাের খোঁজখবর নিতে লাগল। নাতনি কাঁদতে কাঁদতে বলল, ধানগুলাে টিয়ে পাখিরা এসে জোর করে খেয়ে চলে গেছে। বুড়ােবুড়ি এ কথা শুনে ক্ষেপে গেল এবং নাতনিকে মারার জন্য উদ্যত হলাে।
তখন টিয়ে পাখিদের পরামর্শ মতাে য়োদি করল কি, দাদু মারতে চাইলে দাদির কোলে, দাদি মারতে চাইলে দাদুর কোলে। আর দুজন মিলে যখন মারতে চাইলো তখন সাথে সাথে দেরি না করে টিয়েদের দেশের অভিমুখে দৌড়ে চলে গেল। য়ােদি উত্তর দিকে বহুদূর যাওয়ার পর তার চোখে পড়লাে ঐ চারেক কাইন বন ।
টিয়েদের শিখিয়ে যাওয়া গান গাইতে লাগল। মেয়েটা টিলা পার হলাে, ছড়া পার হলাে। তারপরই দেখতে পেল টিয়েদের দেশ। টিয়ে পাখিরা মেয়েটাকে দেখে আনন্দে ফেটে পড়ল। মেয়েটার জ্ঞান আছে কিনা পরীক্ষা করবে ঠিক করল। ওরা তাকে ঘেরাও করে স্বাগত জানিয়ে তাদের রাজপাখির রাজ দরবারে নিয়ে গেল।
পাখিদের রাজদরবারে পৌছার পর য়োদিকে প্রশ্ন করা হলাে, ‘শে উকাফাঙা শেগালে, উসি ফ্রক ফ্রক কা উকাফাঙা মে শেগালে? (বাংলায় : সােনার সিঁড়িতে উঠবি, না ময়লাযুক্ত সিঁড়িতে উঠাব)।মেয়েটির উত্তরে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে টিয়ে পাখিরা রাজ দরবারে ৬০ জন্য সােনার সিঁড়ি পেতে দিল। মেয়েটি থর থর কাঁপতে কাঁপতে সোনার সিড়ি বেয়ে রাজ দরবারে উঠে পড়লাে।
রাজ দরবারে ঢুকে দেখতে পেল এক অদ্ভুত কাণ্ড। কোথাও কোনাে সাড়া শব্দ নেই, নীরব নিস্তব্ধ। যেদিকে চোখ পড়ে সেদিকে দেখতে পেল, অপূর্ব সুন্দর সুন্দর চকচকে রাজকীয় দ্রব্য সামগ্রী। কিছুক্ষণ পরে এক টিয়ে এসে আরাে প্রশ্ন করলাে, ‘হে মানব আগন্তুক তুমি দাঁড়িয়ে কেন?’ টিয়ে বলল, “শৈ হ্রাংপিঙা তুংগেলে, উসি ফ্রক ফ্রক কা হ্রাং পিঙ্গা মে তুংগালেহ’ (বাংলায় যার অর্থ- সােনার পাটিতে বসবে না ময়লাযুক্ত পাটিতেই বসবে)। মেয়েটি উত্তর দিল আমি ময়লাযুক্ত পাটিতেই বসবাে। সাথে সাথে টিয়েটি মেয়েটিকে সােনার পাটি বিছিয়ে দিল ।
ঐ টিয়ে পাখিটি ওখান থেকে চলে গেল। মেয়েটি মনে মনে ভাবল, টিয়ে পাখিরাতাে অত্যন্ত ভালাে! তারা বোধ হয় আমাকে পরীক্ষা করছে আমি লােভী, না লােভী নই। সে একা একা সােনার পাটিতে বসে মনে মনে বলতে লাগল, আমি এখানেই থেকে যাবাে। আরাে কিছুক্ষণ পর আরাে এক টিয়ে এসে তাকে প্রশ্ন করল, হে মানব আগন্তুক,তোমার নিশ্চয় খিদে পেয়েছে।
এখনি তোমাকে খানা দিচ্ছি।’ টিয়ে পাখিটি মেয়েটিকে অনুরূপভাবে প্রশ্ন করলাে, ‘বড় মুরগি খাবি না-কি ছােট মুরগি খাবি।’ এরপর তাকে প্রশ্ন করা হলাে, ‘সােনার থালায় খাবি না-কি ময়লাযুক্ত থালায় খাবি। মেয়েটি প্রতিটি প্রশ্নের জবাব পূর্বের মত দিল। তার সব উত্তরে সন্তুষ্ট হয়ে টিয়ে পাখিরা মেয়েটিকে বড় মুরগির মাংস, ডিম ইত্যাদি সােনার থালায় খাওয়ালাে। টেবিলে অন্যান্য জিনিস যেমন—গ্লাস, প্লেট, চামচ ইত্যাদি সােনার দ্বারা তৈরি।
য়োদির আচার ব্যবহারে সন্তুষ্ট হয়ে টিয়ে পাখিরা দল বেঁধে তাদের রাজপাখির কাছে গিয়ে তার সম্বন্ধে বিস্তারিত জানালাে। টিয়েরাজের মেয়েটির প্রতি ভালােবাসা ও সহানুভূতি জাগলাে। নির্দেশ দিলাে, মানব আগন্তুককে সােনার পাটি, সােনার থালা, সােনার গ্লাস ইত্যাদি প্রদান করে তার দেশে পৌছিয়ে দিতে। তাকে দেশে ফিরে পাঠানাে হবে শুনে মেয়েটি বললাে যে সে এসব জিনিসপত্র নেবে না, তাদের সাথে জীবন কাটাবে।
টিয়ে পাখিরা বলল, “এই হুকুম তাদের রাজার। রাজার হুকুম মানতেই হবে”। এই বলে ঐ মূল্যবান জিনিসপত্র মালামালসহ মেয়েটিকে সসম্মানে বিদায় দেওয়া হোলও।অপরদিকে বুড়োবুড়ি দুজন রাগে য়োদির কোনো খোঁজখবর নিল না। ওরা মনে মনে ভাবলাে, হয়তাে আর ফিরে আসবে না, ভালােই হলাে, সে থাকলে আরাে ক্ষতি হতাে।
বুড়াবুড়ি এভাবে আলাপ করতে করতে গন্ধ ও ময়লাযুক্ত অপরিষ্কার কাপড় দ্বারা মােড়ানাে এক বােঝা জিনিসপত্র কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছিল। নাতনিটা হঠাৎ এসে পড়ল। নাতনি তার দাদু-দাদির উদ্দেশ্য বলল, “দাদু-দাদি আমি এসেছি, আমি এসেছি, আমাকে নিয়ে চল।’ নাতনির আওয়াজ শুনে বুড়াবুড়ি ফিরে তাকালোও না।
বরঞ্চ বিরক্ত হয়ে বুড়ি বললাে, কী নিয়ে এসেছাে, যাও। তােমার আর আমাদের কাছে ঠাঁই নেই। নাতনি হাসিমুখে দাদু-দাদির সামনে টিয়ে পাখিদের দেয়া ঐ মূল্যবান জিনিসপত্রগুলি এক একটা বের করে দেখালাে। নাতনির জিনিষপত্রগুলাে দেখে বুড়াে-বুড়ি একদিকে খুশি হলাে, অন্যদিকে মনে মনে তার প্রতি হিংসা জন্মালাে।
মেয়েটির দাদু তার পিঠে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করলাে, নাতনি গাে, তুমি এসব জিনিস কোত্থেকে কিভাবে পেলে?’ মেয়েটি সব খুলে বিস্তারিত বলে দিল। ঐ দিন রাত্রে বিছানায় বুড়ােবুড়ি চুপি চুপি আলাপ করে ঠিক করলাে যে, মেয়েটি হয়তাে টিয়েদের সম্পত্তি কম পেয়েছে ওরা স্বয়ং গেলে আরাে বেশি ধনসম্পদ পাবে।
তারপর দিন ভােরে সূর্য উঠার আগে নাতনিকে না জানিয়ে বুড়ােবুড়ি দুজনে টিয়ে পাখিদের দেশের দিকে রওনা হলাে। টিয়ে পাখিরা এদের দুজনকেও স্বাগত জানালাে এবং টিয়ে রাজদরবারে নিয়ে যাওয়া হলাে। তাদেরকে প্রশ্ন করা হলাে, ‘সােনার সিঁড়ি দিয়ে উঠবে নাকি ময়লাযুক্ত সিঁড়িতে উঠবে?’ বুড়ােবুড়ি দুজনে এক বাক্যে উত্তর দিল, ময়লা সিঁড়িতে উঠবাে কেন? সােনার সিঁড়িতে উঠবাে।’ এভাবে তাদের নাতনিকে যে সব প্রশ্ন করা হয় একই প্রশ্ন বুড়ােবুড়িকেও করা হলাে।
কিন্তু বুড়ােবুড়ি সব প্রশ্নের উত্তর নাতনির বিপরীত উত্তর দিতে লাগলাে । বুড়ােবুড়ির হাতে এসব সম্পত্তি তুলে দিল। তাদের বলল, “সাবধান? তােমাদের অনেক সম্পত্তি দেওয়া হলাে । যাওয়ার পথে কোথাও খাঁচাটি খুলে দেখবে না, তােমাদের ঘরে পৌছার পরেই খাঁচাটি খুলে দেখবে, কেউ যেন দেখতে না পায়।
অতঃপর বুড়ােবুড়ি টিয়েদের দেশ থেকে চলে আসলাে। আসতে আসতে পথের মধ্যে বুড়ির হঠাৎ পায়খানা করতে ইচ্ছা হলাে। বুড়ি পাশে ঝােপের আড়ালে পায়খানা করতে গেলে তাৎক্ষণিক সেই ফাঁকে বুড়াে চুরি করে খাঁচাটা খুলে দেখতে চাইলে সাথে সাথে চারদিকে কালাে মেঘ হয়ে গর্জে উঠলাে।
এতে বুড়াে টিয়েদের কথা বিশ্বাস করে ভয়ে আর খুলে দেখলাে না। তারপর বুড়ােবুড়ি তাদের নিজ বাড়িতে যথাসময়ে পৌছলাে । টিয়েদের কথা মতাে নাতনিকে ঘরের বাইরে রেখে দরজা-জানালা বন্ধ করে টিয়ে দের কাছ থেকে প্রাপ্ত খাঁচাটা খুলে দেখতেই সাথে সাথে খাঁচা থেকে বিভিন্ন রকমের বিষাক্ত সাপ বের হয়ে আসল এবং বুড়ােবুড়িকে খপ খপ কামড় দিয়ে মেরে ফেলে। এভাবে শেষ পর্যন্ত বুড়ােবুড়ি মারা গেল।
চাক ভাষায় অনেক প্রবাদ প্রবচন রয়েছে। বংশ পরম্পরায় নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এসব প্রবাদ প্রবচন প্রচলন হয়ে আসছে। তাদের কিছু প্রবাদ প্রবচন নিম্নে দেওয়া হলাে
চাক ভাষা | বঙ্গানুবাদ |
দুঃখা আহান্নে ছুকখা লুহে | কষ্ট করলে কেষ্ট মিলে |
ইছিক শাহ হ্রং তুং | নির্বুদ্ধিতা |
চিন কেদেক হ্রাং আভেপো | যত গর্জে তত বর্ষে না |
মুইকানিহ পাইক হে | সরলতা |
টুকএকা টুকএকা লাপো হে | অলস |
চাকদের অনেক ধাঁধা রয়েছে। আগেকার দিনে আড্ডার সময় বা রাত্রে ঘুমানাের আগে যুবক-যুবতীরা একে অপরের মধ্যে ধাঁধা প্রতিযােগিতায় লিপ্ত হতাে। এতে একপ্রকার বুদ্ধির প্রখরতা যাচাই করা হয়। নিম্নে কয়েকটি চাক জনগােষ্ঠীর ধাঁধা দেয়া গেল-
১. আফাং ফো হে-আতাক কান্দা। ছামুক রঙ
গাছ আছে, ডাল পালা নাই। গরু শিং
২. তং বুকচ্ছা পুকতা ক্যাইং মাইকাছে। আহুগিয়া
জঙ্গলকীর্ণ টিলায় মই টানে। চুল আচরানো
৩.আকোনেক ছিকতা-উই নাকনেক বুলিং। তাইংনিং
ধরলে একমুঠো ছেড়ে দিলে বড় হয়। জাল
৪.আসিংতাইং আসিতাইং আতুংবাহ। পুকগাছা
সময় মতাে সমবেত হয়। ভাত খাওয়া।
৫.আমরাছা কারা কাইংথা বুলিং আংছাবুং
এক খুঁটিতে বড় দেহ । খড়কুটা
৬. আনু হআকলাং আছা প্রং লাং রাহাইক ইংগা
মা কাঁদে ছেলে বড় হয়। চরকা।
৭. লাংদেং লাংদেং ঙেক ঙে্ক কাফেহে। উকাফাং
প্রত্যেকেই একই জায়গায় পায়ে লাঠি মারে সিঁড়ি
৮. য়ু লাং চাইংলাং য়ুলাং চাইংলাং আকানা
যত তাকাই ততাে দূরে যায় কান
চাকদের শিক্ষার হার সম্পর্কে সঠিকভাবে জানা যায় না। চাকদের অধিকাংশ গ্রামে সরকারি বিদ্যালয় নেই বললেই চলে। ১৬টি চাক বসতির মধ্যে অধিকাংশ গ্রামে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। দুর্গম এলাকা হওয়ায় দূরবর্তী বা পার্শ্ববর্তী এলাকার বিদ্যালয়ে গমন করাও চাক ছেলেমেয়েদের জন্য কঠিন। তাই চাক জনগােষ্ঠী শিক্ষা-দীক্ষার ক্ষেত্রে এখনাে অনেক পিছিয়ে পড়ে আছে।
সাধারণভাবে নারীদের তুলনায় পুরুষরা লেখাপড়ায় অগ্রগামী। আগেকার দিনে বৌদ্ধ বিহারে ভিক্ষুরা বর্মী বর্ণমালায় চাক জনগােষ্ঠীকে লেখাপড়া শেখাতেন। মংমং চাক-এর পিতামহ ও তার সমসাময়িক ব্যক্তিরা শতকরা ৩৫ জন পুরুষ বর্মী অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন।
এর পরবর্তী প্রজন্মরা বর্মী ও বাংলা দুটি ভাষায় লেখাপড়া শুরু করে। ঐ সময় চাক জনপদে কোনাে বিদ্যালয় ছিল না। ব্রিটিশ আমল হতে চাকদের বৌদ্ধ বিহারে লালিত বৌদ্ধ ভিক্ষুরা শিক্ষার আলােদানে ব্যাপক অবদান রেখেছিলেন। যারা বাংলায় পড়ালেখা করতে আগ্রহী তাদেরকে নাইক্ষ্যংখছড়ি, বাইশারী হতে ১০ মাইল থেকে ২০ মাইল দূরে অবস্থিত রামু প্রাইমারি স্কুলে গিয়ে পড়তে হতাে।
প্রয়াত শৈ থােয়াইং প্রু হেডম্যান ও তার সমসাময়িক কজন চাক শিক্ষার্থী সুদূর রামু নিম্নতর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। বৌদ্ধ বিহারের ভিক্ষুগণ ছাড়াও অন্যত্র থেকে শিক্ষিত লােক এনে গৃহশিক্ষক হিসেবে শিক্ষানুরাগী অভিভাবকগণ পাড়ার বাচ্চাদের পড়াশােনার ব্যবস্থা করতেন।
এরূপ উল্লেখযোেগ্য অভিভাবকগণ হলেন বাইশারী চাক পাড়ার ধুংরী মহাজনের , ম্নগসুইহ্রা কার্বারী,সুইহ্লাউ মাস্টার , অংখ্যাই হেডম্যান এবং নাইক্ষ্যংছড়ি চাক পাড়ার ম্রাছাঅং কার্বারী, হ্রাফছু কার্বারী, মংছাথােয়াই হেডম্যান প্রমুখ।
বাইশারী জয় মঙ্গল বৌদ্ধ বিহারের ধর্মগুরু স্বর্গীয় উ গেঙা ওয়েসা চাকদের শিক্ষা-দীক্ষায় এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনে তার ভূমিকা ও অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি চাকদের গৃহ নির্মাণে তাদের ঐতিহ্যবাহী প্রথা ও নিয়মনীতিসহ নারীদের পড়ালেখায় পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন। তিনি উক্ত বৌদ্ধ বিহারে ১৯৫৯ সাল হতে ৩১ বছর (ওয়া) ধর্মগুরু হিসেবে অবস্থান করেন এবং ১৯৯০ সালে পরলোক গমন করেন।
চাক জনগােষ্ঠীর মধ্যে আধুনিক শিক্ষা প্রসারে কিছুটা ভূমিকা রেখে চলেছে বাইশারী চাক পাড়ায় প্রতিষ্ঠিত ফারীখাল নিম্নতন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (এলপি স্কুল ২য় শ্রেণী পর্যন্ত)। ১৯৫০ সালে এ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা লাভ করেন প্রয়াত শৈহ্রাউ চাক। চাক সম্প্রদায়ের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম সরকারি চাকরিজীবি।
তাঁর উত্তরসূরি উক্ত বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা লাভ করেন প্রয়াত ধুংছাথোয়াই চাক। তিনি উক্ত বিদ্যালয়টি উচ্চতর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের (১ম শ্রেণী হতে ৫ম শ্রেণী) মর্যাদা লাভের এক বছর পর ১৯৫৯ সালে চাকরি হতে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর প্রয়াত ধুং অং চাক উক্ত বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়ােগ পান।
১৯৬৬ সালে প্রথম ৩ জন এসএসসি উত্তীর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। তিনি উক্ত বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে ২০০৫ সালে অবসর গ্রহণ করেন এবং ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পরলােকগমন করেন। শিক্ষা বিস্তারে তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তারা আশপাশের চাক পাড়ার চাকদেরকে তাদের ছেলেমেয়েদের বিদ্যালয়ে পাঠানাের জন্য উৎসাহ যােগাতেন।
শিক্ষার ক্ষেত্রে সত্তর দশক হতে কিছু সংখ্যক চাক বহিঃসংস্পর্শে আসতে শুরু করে এবং ছেলেমেয়েদের পড়াশােনায় মনােযােগী হয়ে উঠে। এর ফলে বিদেশি দাতাগােষ্ঠীর অর্থায়নে পরিচালিত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে ছেলেমেয়েদের অন্তত মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক এবং কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুযােগ হয়ে ওঠে।
এক্ষেত্রে মং মং চাক ও মং ছা হ্লাহ চাক-এর ভূমিকা শেষভাবে প্রণিধানযােগ্য। তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনেক চাক ছেলেমেয়ে ভর্তির সুযােগ লাভ করে এবং তাদের মধ্যে অনেকে উচ্চশিক্ষাও সমাপ্ত করেছে।
আর্থিক দৈন্যতা ও দূরবর্তী অঞ্চল হওয়ায় চাক জনগােষ্ঠীর ছেলেমেয়েদের মধ্যে স্কুল ঝরে পড়ার হার অত্যন্ত বেশি। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার সুযােগ না থাকার ফলে প্রাথমিক স্তরে চাক শিশুদের স্কুল থেকে ঝরে পড়ার একটি অন্যতম কারন হিসেবে দেখা গেছে ।
চাক জনগােষ্ঠীর ছেলেমেয়েরা কোনাে রকমে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত যেতে পারলেও কলেজ জীবনে খুব কম পদার্পণ করতে পারে। উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দু-একজন চাক ছেলে মেয়ে ভর্তি হওয়ার সুযােগ লাভ করলেও তা অত্যন্ত সীমিত ও মুষ্ঠিমেয় বলা যায়। শিক্ষা দীক্ষায় চাকদের বর্তমান অবস্থা সংক্ষেপে নিম্নে দেওয়া হলাে-
ক্রম | শ্রেণী | সংখ্যা |
১ | মাস্টার্স ডিগ্রি(পাশ) | ৭ জন |
২ | মাস্টার্স (অধ্যয়নরত) | ৪ জন |
৩ | এমবিবিএস পাশ | ৫ জন |
৪ | স্নাতক ডিগ্রি পাশ | ১৫ জন |
৫ | বিভিন্ন কলেজেস্নাতক/ এমবিবিএস (অধ্যয়নরত) | ১২ জন |
৬ | ডিপ্লোমা পাশ | ৪ জন |
তাছাড়া বর্তমানে বিদেশে ইউএনডিপির স্কলারশিপ নিয়ে উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত আছেন ২ জন।
চাক জনগােষ্ঠীর পারিবারিক ব্যবস্থায় পুরুষদের ভূমিকা প্রাধান্য বেশি। তবে ক্ষেত্রবিশেষে নারীদের মতামত গ্রহণও অপরিহার্য। সামাজিক বিচার-আচার সম্পর্কিত কার্যাদিতে পুরুষেরাই অধিকতর ভূমিকা পালন করে থাকে। পারিবারিক কোনাে সমস্যা দেখা দিলে সেক্ষেত্রে সমাধানের জন্য নারীদের মতামত গ্রহণ অনিবার্য।
লেখাপড়ায় পুরুষেরা অগ্রগামী। সাধারণভাবে অন্যান্য জনগােষ্ঠীর মতো লেখাপড়ার ক্ষেত্রে কন্যা সন্তানের চেয়ে পুত্র সন্তানদের বেশি অগ্রাধিকার দেয়া হয়। অতীতে চাক সমাজের নারীরা গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি তাঁতের বস্ত্র তৈরি পশুপালন ও জুম চাষাবাদের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে ছিল। বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি চাকরিসহ বিভিন্ন উৎপাদনমুখী কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন তথা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত রয়েছে।
আগেকার দিনে বৌদ্ধ বিহারের বর্মী বর্ণমালায় লেখাপড়ার ক্ষেত্রে কয়েকজন চাক নারীও শিক্ষার সুযােগ লাভ করেন। বিহারের অধ্যক্ষ/ভিক্ষুদের অনুপ্রেরণায় বাইশারী বৌদ্ধ বিহারে ১৯৫২ সালে পড়ালেখা করেন ৫-৬ জন চাক মেয়ে তারা বমা ভাষায় অক্ষর জ্ঞান লাভ করেন । তাদের মধ্যে ম্যজিংউ চাক, মাহ্লাউ চাক,ক্রাখাই চাক, চিং রােয়ংখাইন চাক প্ৰমুখ মহিলারা অন্যতম। চাক নারীদের মধ্যে সর্বপ্রথম তারা বর্মী ভাষায় পড়তে ও লিখতে শেখেন। এরপর ১৯৮৫ সালে আরো
৩ জন মেয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুর কাছে বর্মী ভাষায় পড়ালেখা করেন এবং পড়তে ও শেখেন। এরা হলেন মাঅং চাক, চাইছামে চাক ও মাহলা চিং চাক।আধুনিক শিক্ষা ক্ষেত্রে ১৯৮৬ সালে মাত্র চিং চাক নামে একজন চাক মেয়ে সর্বপ্রথম এসএসসি পাশ করেন। চাক মেয়েদের মধ্যে ১৯৯৭ সালে সর্বপ্রথম ডাক্তারী পাশ করেন ড. নাংউ চাক। এরপর ১৯৯৫ সালে একজন চাক মহিলা উম্রা চিং চাক ডাক্তারি পাশ করেন।
চাক সমাজে পুরুষ-মহিলা সবাই মাঠে কাজ করে। তবে কঠোর পরিশ্রমের কাজ যেমনঃ জুম চাষের জঙ্গল কাটা, মাঠে লাঙ্গল দিয়ে চাষ করা, বাড়ি ঘর নির্মাণ, ভারি জিনিস পরিবহন ইত্যাদি কাজ মহিলারা করে না। সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে পুরুষের সমান তালে নারীরা অংশগ্রহণ করে। এক্ষেত্রে তাদের মধ্যে নারী-পুরুষের কোনাে ভেদাভেদ নেই। সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে পুরুষদের সমান তালে মহিলারাও অংশগ্রহণ করে থাকে।
সাধারণভাবে চাক সমাজে নারী-পুরুষের কোনাে বৈষম্য নেই বলে বিবেচিত। বরঞ্চ ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে নারীরাই এগিয়ে আছে। তবে অন্যান্য আদিবাসী জনগােষ্ঠীর মতাে চাক জনগােষ্ঠীর নারীরাও স্থাবর সম্পত্তির অংশ পায় না।তবে মায়ের নামে কোনাে জায়গা-জমি থাকলে এটা অবশ্যই সামাজিকভাবে কন্যাসন্তানরা পায়।
তবে এটা অনস্বীকার্য যে, তুলনামূলকভাবে অশিক্ষিত ও প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাসকারী চাক পরিবারসমূহের নারীরা অপেক্ষাকৃত পশ্চাৎপদ অবস্থায় রয়েছে। বিষয়-সম্পত্তি ও ফসল ক্রয়-বিক্রয়, ছেলেমেয়েদের বিবাহসহ নানা বিষয়ে নারীরা সীমিত পরিসরে মতামত রাখতে পারলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষের সিদ্ধান্ত চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়ে থাকে।
চাক সমাজে ‘মংনাঙ পাে’ অনুষ্ঠানের সমাজসিদ্ধ নিয়মে একজন বিবাহিত স্ত্রী তার বাম কর্তৃক ভরণপােষণের অধিকারী হয়। একজন চাক নারী বিবাহের পূর্বে বা পরে স্বামীর সংসারে কিংবা পৈতৃক অথবা মাতৃকসূত্রে কিংবা তার আত্মীয় কর্তৃক দান বা উপহার হিসেবে কিংবা স্বউপার্জিত অর্থে সম্পত্তি ক্রয় অথবা লাভ করতে পারে।
বিবাহের পূর্বে অর্জিত কোনাে সম্পত্তির উপর আইনত নিরঙ্কুশ মালিকানা সত্ব ও অধিকার স্ত্রীর থাকে। স্বামী নিষ্ঠুর প্রকৃতির হলে, স্ত্রীকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করলে, স্বামী দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণের কারণে সতিনের সাথে একসংগে সংসারে অবস্থান বা বসবাসে অসম্মত হলে, সেক্ষেত্রে প্রথমা স্ত্রী স্বামীর
ভিটায় নিরাপদ অবস্থানে থেকে স্বামীর নিকট থেকে ভরণপােষণ লাভের অধিকারী হয় অথবা সামাজিক আদালতের মাধ্যমে গৃহীত সিদ্ধান্তে পিত্রালয়ে অবস্থান করে স্বামীর নিকট হতে খােরপােষ লাভের অধিকারী হয়। বিবাহের পর স্বামী বৈবাহিক সম্পর্ককে অগ্রাহ্য বা অব্যাহত না রাখলে অথবা ভরণপােষণ প্রদানে বিরত থাকলে স্ত্রী তার দাম্পত্য সম্পর্ক ও দাবি পুনরুদ্ধারের জন্য সমাজপতি বা কার্বারী-হেডম্যান আদালতে মামলা করার অধিকার রাখে।
পক্ষান্তরে স্বামী পুরুষত্বহীন বা নপুংসক হলে অথবা দুরারােগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে কিংবা মানসিক ভারসাম্যহীন হলে সেক্ষেত্রে স্ত্রী সমাজপতি বা কার্বারী-হেডম্যান আদালতের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ (পেনেহে-কা) লাভের অধিকারী হয়।
চাক জনগোষ্ঠী সংখ্যায় অত্যন্ত অল্প এবং শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে পড়া। তাই স্বাভাবিকভাবে রাজনৈতিক অঙ্গনেও চাকদের প্রতিনিধিত্ব চোখে পড়ার মতাে নয়। স্থানীয়ভাবে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল এবং জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলােতে চাক জনগােষ্ঠী থেকে কয়েকজন নেতা-কর্মী কর্মরত রয়েছে। এসব রাজনৈতিক দলগুলােতে জেলা ও আঞ্চলিক স্তরে চাক জনগােষ্ঠীর কিছু ব্যক্তি নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করছে।
১৯৮৯ সালে জেনারেল এরশাদ কর্তৃক প্রবর্তিত বান্দরবান পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদে চাক জনগােষ্ঠীর জন্য একটি সদস্যপদ সংরক্ষিত রয়েছে। ১৯৮৯ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে চাক জনগােষ্ঠী থেকে একজন নির্বাচিত হলেও পরবর্তিতে আর কোনাে নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়ায় এখন অন্তর্বর্তী বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদে চাক জনগােষ্ঠীর কোনাে প্রতিনিধি নেই।
১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মােতাবেক প্রবর্তিত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদে চাক, লুসাই, বম, পাংখাে, খুমী ও খিয়াং এই স্বল্প জনসংখ্যাসম্পন্ন ৫টি জনগােষ্ঠীর জন্য ১টি সদস্যপদ সংরক্ষিত রয়েছে। বর্তমানে উক্ত সংরক্ষিত সদস্যপদে বম জনগােষ্ঠী থেকে একজন ব্যক্তি আঞ্চলিক পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করছেন।
প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্বল্প জনসংখ্যাসম্পন্ন প্রত্যেক জনগােষ্ঠীর একটি করে সদস্যপদ আঞ্চলিক পরিষদে বরাদ্দ করা উচিত ছিল বলে এসব জনগোষ্ঠীর অনেকে মনে করেন ।অপরদিকে বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য হিসেবে চাক জনগােষ্ঠী থেকে তিনজন ব্যক্তি নির্বাচিত হয়েছেন।
এদের মধ্যে একজন নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়নে ও ২ জন বাইশারী ইউনিয়নে নির্বাচিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন ভারপ্রাপ্ত ইউপি চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া সর্বপ্রথম হেডম্যানশিপ লাভ করেন প্রয়াত শৈথােয়াইপ্রু চাক ১৯৪২ সালে ।বর্তমানে চাক জনগােষ্ঠী থেকে তিনজন হেডম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
লেখকঃ মংমং চাক, চিংহ্লামং
তথ্যসূত্র
১. ইতিহাস গবেষক মি. ফেইরি-এর History of Burma (পৃষ্ঠা নং : ৫)
২. G. A Grierson, Linguestic Survey of India, Culcata (Vol.1, Part : 1, P/77)
৩. উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, রাঙ্গামাটি কর্তৃক ১৯৮২ সালে প্রকাশিত ‘গিরিনির্ঝর’ ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা।
৪. উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, বান্দরবান কর্তৃক ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত ‘সাংগু’-
এর ২য় বর্ষ ১ম সংখ্যা ও দশম বর্ষ, সংখ্যা এক (৭ম খণ্ড)।
৫. উ অংসাউ-এর রাখাইন রাজাগুয়ান (রাখাইন ইতিহাস) পুস্তকের ১ম অধ্যায় ও ধাওয়াতী আরেতাে পুং (আনুমানিক ১৯৬০ সালে)।
৬. থােয়াইং শৈখাইন, ইতিহাস গবেষক ও অধ্যাপক, ‘রাখাইন ম্রোকফ্যা দেসা মাহ তেইংরাংসাম্যা’ (বাংলায় অর্থ : ‘আরাকান প্রদেশের উত্তরাঞ্চলে বসবাসকারী চাক অধিবাসীগণ’, ১৯৭৯ কেবল চাকদের উপর গবেষণামূলক পুস্তক)।
৭.উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট বান্দরবান কর্তৃক ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত স্মরণিকা রাকাহ।
৮. এডভােকেট জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, এডভােকেট প্রতিম রায়, সাংবাদিক শৈলেন দে, তঞ্চগ্য ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন, কপাে সেবা সংঘ, আদালত সড়ক, বনরূপা,রাঙ্গামাটি, সেপ্টেম্বর ২০০৭।
৯. Muhammad Ishaq (editor), Bangladesh Disrict Gazetteers, Chittagong Hill Tracts,, Ministry of Cabinet Affairs, Establishment Division,Governnment of Bangladesh, Dacca, 1971
প্রসঙ্গ:আদিবাসী, চাক, চাক জাতি, চাক জাতিগোষ্ঠী, পার্বত্য চট্টগ্রাম
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।