Last updated Oct 8th, 2025
6
লেখকঃ তনয় দেওয়ান।
এত্তে এল’ এক রাজা বিজয়গীরি তার নাং
সাত চমু সৈন্য লােই ছ’ দিন ছ’ রেদে
পার হ্ল তে এক বড় গাং
তেওয়া গাঙ’ পারত্ কালাবাঘা নাঙ’ দেঝত
কুরেল তে চেরবাে পন্ডিত মানুচ জন আর
নানা জাদর্ হা্ত্যার রসদ।
ইন্দং ক্রিং টেকনাফ তিন দেঝত্
পাদেল তে বীর সেনাপদি
লারেইয়র জয় শুনি গেল তে উজোনী
ন-যেবং ভেইলক পিঝেন্দি।
চম্পকনগরর বুড়াে রাজা মরি গেল্
হ্ল রাজা ভেই সমরগীরি
কল’ রাজা বিজয়গীরি ন-যেবং আর ফিরি
বেঘে মিলি নূয়াে দেচ গরি।।
কথা: ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়।
সুর: ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় ও রাঙা
চাকমারা ইতিহাসকে ‘বিজক’ বলে। চাকমাদের প্রকৃত ইতিহাস কথ্য সাহিত্য নির্ভর। চাদিগাঙ ছাড়া পালা অনুসারে চম্পকনগর এর রাজা সাংবুদ্ধার পুত্র বিজয়গিরি মগদের সাথে দেয়াং পাহাড়ের যুদ্ধে বিজয় লাভ করে আরাকানের রােসাঙ রাজ্য অধিকার করেন। এটা ৫৯০ খৃষ্টাব্দের কথা বলে ধারণা করা হয়। সেনাপতি রাধামন বিজিত রাজ্য সম্পর্কে এভাবে বর্ণণা করেন-
সাজের গাবুরে ব ’ কাদি
সিদুগ ’ মানুসসুন অজাদি।
চুমা কাবিনে পানি খেই
তারার কারত্তুন পৈদা নেই।
দুধে খাদি সিজেদং
পৈদা বারাত গরি আমি সিদু বেরেদং ।
*এক চমু = ২৬,০০০
এর পর অনেক বছরের কথা জানা যায় না। ১৪১৮ খৃষ্টাব্দে চাকমা রাজা মারিক্যা (মানিকগিরি) তৈনমুড়িগাঙ অঞ্চলে ১২টি গ্রামে বসতি স্থাপন করা প্রত্যেক গ্রামের লােকদের এক একটি গােজা নাম দিয়ে চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেন।
গােজা শব্দের অর্থ হলাে গুচ্ছ। প্রতিটি গােজাতে একজন করে অধিনায়ক থাকতেন। গােজার অধিনায়ক বিচার ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। অধিনায়করা রাজার পক্ষ হয়ে মৃত্যুদন্ড ব্যতীত সকল প্রকার বিচার কার্য পরিচালনা করতেন।
মারিক্যার মৃত্যুর পর তৈনসুরেশ্বরী আলিকদমে রাজধানী স্থাপন করে বাংলার নবাব হতে রাজা উপাধি লাভ করেন। তিনি তৈনমুড়িগাঙ এর যুদ্ধে কুকি ও মগদদের পরাজিত করেন। বর্তমান তৈমুড়িগাঙের দক্ষিণাঞ্চলে ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় তিনি রাজ্য বিস্তার করেন। পরে ট্যাক্স উসুলের জন্য চট্টগ্রামে ঘাট স্থাপন করেন। রণপাগলা নামে তার একজন সুদক্ষ ও বিচক্ষণ সেনাপতি ছিলেন। বীরত্বের রাজা তৈনসুরেশ্বরী প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে রাজত্ব করেন। তার সময়ে চট্টগ্রাম গুরুত্ব বেড়ে যায়।
এই চট্টগ্রাম অধিকারে নেয়ার জন্য বাংলার নবাব তিল মহারাজা ও আরাকান রাজের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। ১৪৫৯ খৃষ্টাব্দের দিকে চাকমারা ক্রমশ: দক্ষিণ চট্টগ্রাম হতে উত্তর দিকে পার্বত্য অঞ্চলে চলে আসতে শুরু করে। বর্তমান কক্সবাজার জেলার রামু থানায় এখনাে চাকমারকুল নামে একটি ইউনিয়ন রয়েছে। এছাড়া টেকনাফ নদীর নামকরণ করেছিল চাকমারা। যার আদি নাম ছিল টেক নাক।
১৫০০ খৃষ্টাব্দের দিকে সুদুর ইউরােপ হতে এ অঞ্চলে এসে পর্তুগীজরা স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন শুরু করে। ১৫০২ খৃষ্টাব্দের দিকে বাংলার নবাব হুসেন শাহ চট্টগ্রাম আক্রমণ করে বিজয় পতাকা উড়ান। তবে আরাকান রাজা চাকমা রাজের সহায়তায় আবার চট্টগ্রাম জয় করেন। কিন্তু ত্রিপুরা মহারাজের সেনাপতি চরচাক আরাকান সেনাপতির দর্প চূর্ণ করে চট্টগ্রাম জয় করে নেন।
এর প্রেক্ষিতে হুসেন শাহ পুনরায় ত্রিপুরা মহারাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করেন। অন্যদিকে চাকমা রাজা জনু ত্রিপুরা মহারাজা ধন মাণিক্যের সাথে সখ্যতা ও মিত্রতা স্থাপন করেন। উল্লেখ্য যে, ত্রিপুরার রাজপরিবার ত্রিপুরা নয়। তারা জাতিতে রেয়াং। তিনটা পুরের সমন্বয়ে ত্রিপুরা হয়েছিল।
এই তিনটি পুর হলাে উদয়পুর, চাদপুর এবং নিযামপুর (চট্টল অঞ্চল)। এতে আরাকান রাজা মইজাগিরি চাকমা রাজার প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন। তার সেনাপতি সে-দইজ্যা এক যুদ্ধে চাকমা রাজাকে পরাজিত করেন। সে সময়ে চাকমারা নিজেদের চম্পকনগরে ফিরে যাবার জন্য আকুল হয়ে উঠেছিল।
ডুমে বাজেবাক চুল ঢঙর
ফিরি যেবঙ চম্পকনগর।
আরাকানে চাকমাদের শেষ রাজধানী ছিল মোজাম্রু। যা কালাদান নদীর তীরে অবস্থিত। এই নদীটি আরাকানের প্রধান ও একমাত্র নদী। এ সময়ে রাজা সূর্যজিতের মৃত্যুর পর মংসাই রাজত্ব করেন। রাজা ছিলেন নামমাত্র।
তিনি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েন। তাকে আরাকান রাজের অধীনে থাকতে হতাে। এতে তিনি অর্থবল, জনবল এবং রাজার ধন সৈন্যবল হারা হলেন। একসময়ে তিনি বৌদ্ধব্রত পালন করার জন্য শ্রমণ হলেন।
আরাকানে দীর্ঘ বছরের রাজ্যে পতন ঘনিয়ে এলে চাকমাদের মনে গভীর ভীতির সঞ্চার হয়। বিশেষ করে আরাকানী মগ রাজার সিপাহীরা চাকমা রাজ্য হতে কর উসুল করার জন্য নির্দয় হয়ে উঠায় চাকমারা ভীতসন্ত্রস্থ হয়ে পড়ে।
শ্রুতি আছে যে, গ্রামে কর উসুল। করতে এলে তারা গৃহকর্তাকে উঠানে বেঁধে রাখতাে। নারীদেরকে মুহুর্তের মধ্যে মদ রানা করে খাওয়াতে হতাে। চাকমারা এটাকে রেত্যা মদ বলে। এরূপ অত্যাচারে প্রজাকুল বিজিত রাজ্য ছেড়ে চম্পকনগরে ফিরে যেতে উদ্বেগাকুল হয়ে উঠে।
এলে মংসাই লালজ নেই ন
এলে মংসাই কেলেজ নেই।
চল বাপ ভেই চল যেই
চম্পকনগরৎ ফিরি যেই ।
ঝারত গেলে বাঘে ধরে,
ঘরত গেলে মগে মারে
যেইরে ভেই চম্পকনগরত ফিরি যেই
পধত উধি তােগেই চেই চম্পকনগর নেই।
কুন্দি এস্যে বিজয়গিরি
কুধু গেল পধর ধুর
কুধু রইয়ে চম্পকনগর
কদক আগে দুর?
১৫১৮ খৃষ্টাব্দে চাকমা রাজা জনু আরাকান রাজার বশ্যতা স্বীকার করেন এবং আরাকান রাজার সম্মানের জন্য দুটি শ্বেত হস্তী ও বহু মূল্যবান উপঢৌকন পাঠান। আরাকান রাজা এতে সন্তুষ্ট হয়ে চাকমা রাজা জনুকে কংহ্লা প্রু (সদাশয়) উপাধিতে ভূষিত করেন। রাজা জনুর আমলে মন্ত্রীদের বলা হতাে চেগে আর রাজদূতদের বলা হতাে ধ্যুবেং।
সেনাপতিদের অধীনে যে সকল সামরিক কর্মচারী ছিলেন তাদের বলা হতাে লস্কর। রাজস্ব উশুল করা ও শাসনতান্ত্রিক কাজে যারা নিয়ােজিত ছিলেন তারা রােয়াজা, আমু, খীসা, রােয়াসই, সইসুথ নামে পরিচিত ছিলেন। রােয়াজা শব্দটি বার্মিজ শব্দ এবং এর অর্থ হলাে দেশীয়। তখনকার সময়ে চাকমা রাজার স্থায়ী সেনাবাহিনী গড়ে উঠে। সেনাবাহিনীতে যারা ছিলেন তারা বব্বুয়া নামে পরিচিত ছিলেন ।
১৫৫০ খৃষ্টাব্দে পর্তুগীজ ঐতিহাসিক Joa de Barros (descripcao do Reino de Bengal) নামক মানচিত্রে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরে উত্তরে ত্রিপুরা এমন দক্ষিণে বার্মা এর মধ্যবর্তী স্থানে চাকোমাস (CHACOMAS) নামক একটি রাজ্যের কথা উল্লেখ করেন। ভৌগােলিক দিক হতে ছােট হলেও এটি রাজ্য হিসেবে আরাকান, ত্রিপুরা ও বাংলার সমমর্যাদা পেত।
জেলা গেজেটিয়ার অনুসারে ১৪৪৮ খৃষ্টাব্দে MWUN TSNI নামে একজন চাকমা রাজা বার্মা হতে বিতাড়িত হয়ে আলিকদমে (আলেখ্যডং) আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। অপরদিকে মানচিত্রটি রচিত হয়েছিল ১৫৫০ খৃষ্টাব্দে। তাই বলা যায় যে, পর্তুগীজ ঐতিহাসিকের মানচিত্রের চাকোমাস রাজ্যটি হলাে চাকমাদেরই রাজ্য।
১৬০৯ সালে ত্রিপুরার মহারাজ মাণিক্য আরাকান আক্রমণ করেন। এসময় চাকমা রাজ্যে রাজা সাত্তুয়া যিনি পাগলা রাজা নামে ঐতিহাসিকগণের কাছে সমধিক পরিচিত রাজত্ব করছিলেন। পাগলা রাজাকে হত্যা করার পর রাজ মহিয়সী রাজ্য লাভ করেন। তাকে কাটুয়া রাণী ডাকা হয়। রাণীর লােকান্তরের পর রাজকুমারী অমঙ্গলীর সন্তান ধাবানা সিংহাসন লাভ করেন।
ধাবানা উপযুক্ত রাজা ছিলেন বলে জানা যায়। তবে সেসময়ে পর্তুগীজ ও মগ জলদস্যুদের আক্রমণ বেড়ে যায়। এসকল জলদস্যুরা দাস ব্যবসা করতাে এবং চাকমা রাজ্যসহ উপকূলীয় অঞ্চল আক্রমণ করে দাস সংগ্রহ করতাে। চাকমারা মিজিলিক নামে অভিহিত করে। এসময়ে সমতল জমি চাষের পরিবর্তে চাকমারা নিরাপত্তার কথা ভেবে পাহাড়ী অঞ্চলে জুমচাষে মনােযােগী হয়ে উঠে।
ধাবানা রাজপদে উত্তরাধিকার হওয়ার পেছনে রাজপদ পাওয়ার যােগ্যদের মধ্যে এক ধরণের রাজা বাছাই প্রক্রিয়া হয়েছিল বলে জানা যায়। প্রক্রিয়ার মূল কথা হলাে কাক ডাকা ভােরে যিনি রাজ পােষাকে সজ্জিত হয়ে প্রথম রাজসিংহাসনে বসবেন তিনিই রাজা হবেন। জানা যায় যে, ধাবানার আগে একজন ব্যক্তি রাজ সিংহাসনে বসেন।
কিন্তু সভাসদগণ দেখেন যে, যে ব্যক্তিটি প্রথমে রাজ সিংহাসনে বসেছেন তিনি মাথার খবং বা পাগড়িটা তার স্ত্রীর খাদি ব্যবহার করেছেন। এতে তাকে অনুপযুক্ত ঘােষণা করা হয়। ফলে তার পরবর্তী হিসেবে ধাবানার রাজ পােষাকের সাজ-সজ্জা সঠিক মনে হওয়ায় তাকে রাজা মনােনীত করা হয়। তখন থেকে চাকমা রাজদন্ড মুলিমা গােজার হাতে চলে যায়।
রাজা ধাবানার সময়ে ত্রিপুরা রাজ, আরাকান রাজ ও মােঘলদের মধ্যে চট্টগ্রাম দখল নিয়ে অনবরত সংঘর্ষ চলতে থাকে। ১৬৬১ সালে ধরম্যা রাজা হন। ১৬৬৬ সালে বাংলার নবাব শায়েস্তা খাঁর পুত্র বুজুর্গ উমেদ খাঁ আরাকান রাজকে পরাজিত করেন। কিন্তু তখনও চাকমা রাজা স্বাধীনভাবে রাজ্য পরিচালনা করতে থাকেন। মােঘলরা এক খন্ড যুদ্ধে রামু দুর্গ দখল করে নিলেও চাকমা রাজা তা পুনরায় দখল করে নেন।
পরে চাকমা রাজা ও মােঘলদের মধ্যে সখ্যতা গড়ে উঠে। ১৬৮৪ খৃষ্টাব্দে ধরম্যার ছােট ভাই মােঘল্যা (মঙ্গল্যা) রাজা হন। এসময়ে আরাকানীদের আক্রমণ বাড়তে থাকে। তবে মােঘলদের সহায়তায় মােঙ্গল্য নিরাপদে রাজত্ব চালান। ১৭১৫ খৃষ্টাব্দে রাজা সুবল খাঁর মৃত্যুর পর তার সহােদর ফতে খাঁ রাজা হন। রাজা ফতে খাঁ রাজ্যের সমস্ত প্রজাগণকে যুদ্ধ বিদ্যা শিক্ষা ও অস্ত্রধারণে বাধ্য করেছিলেন।
চাকমা রাজার প্রতিপত্তি দেখে বাংলার নবাব জনৈক সেনাপতিকে বিস্তর সৈন্য, বন্দুক, কামানসহ চাকমা রাজার বিরুদ্ধে প্রেরণ করেছিলেন। রাজা ফতে খাঁ বনপথে অতর্কিতে আক্রমণ করে মােঘল বাহিনীকে পরাজিত করেন।
তিনি মােঘলদের কাছ হতে কামান দখল করে নেন। তার অর্জিত একটি কামানের নাম ফতে খাঁ এবং অন্য একটি কামানের নাম কালু খাঁ সেনাপতি কালু খাঁর নামানুসারে। পরে কিছু পরিমাণ কার্পাস শুল্ক দেবার বন্দোবস্ত করে সমস্যার নিষ্পত্তি হয় এবং চাকমা রাজ্যের অধিবাসীদের সাথে বাণিজ্য বা বেচাকেনা শুরু হয়।
১৭৫৭ সালে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলা পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজদের হাতে পরাজিত হলে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ক্ষমতায় অধিষ্টিত হলে বলা যায় শুকদেব রায়ই ছিলেন মােঘল আমলের চাকমাদের শেষ রাজা। ১৭৬৩ সালে মীর জাফর বাংলার নবাবী ক্ষমতা লাভ করলে বৃটিশরা চট্টগ্রাম জেলার উপর অধিকার লাভ করে। ১৭৭৬ সালে চাকমা রাজা শুকদেব রায় মৃত্যুবরণ করলে চাকমা রাজ সিংহাসনে আসীন হন শের ধৌলত খাঁ।
তিনি ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী আমলের প্রথম চাকমা রাজা। তখন এ অঞ্চলের নাম ছিল কার্পাস মহাল। ১৭৮৯ সালে কার্পাস মহালের তথা চাকমা রাজা জানবক্স খাঁ ইংরেজদের বশ্যতা স্বীকার করে নিজের রাজ্য এবং প্রজাকুলকে রক্ষা করেন। বিনিময়ে গভর্ণর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস এর নিকট বার্ষিক ৫০১ মণ কার্পাস দেবার চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এই কার্পাস বিক্রয় করে সম পরিমাণ অর্থ তখন কর হিসেবে ইংরেজদের প্রদান করার নিয়ম চালু হলাে।
১৭৯০ সালে কার্পাস মহাল ইংরেজদের কাছে করদ রাজ্যে পরিণত হলাে। করদ রাজ্যে পরিণত হওয়ার আগ পর্যন্ত চাকমা রাজা কর নিতেন মানুষের উপর থেকে কিন্তু করদ রাজ্য হওযার পরে ১৭৯০ সালের ৩ নভেম্বর চট্টগ্রামের কালেক্টর ভূমি রাজস্বের ন্যায় কর প্রবর্তনের সুপারিশ করলে পরবর্তীতে ১৭৯৯ সালে করারােপের উপর পরিবর্তন আসে। এমনকি কর হিসেবে কার্পাসের পরিবর্তে টাকার রাজস্ব বা কর দেয়ার বিধান প্রণয়ন করা হয়।
১৮৫৭ সালে ইংরেজ তথা কোম্পানী শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় সিপাহীদের সিপাহী বিদ্রোহ সংঘটিত হয় । সিপাহী বিদ্রোহ অবসানের পর মােঘল শাসনের আলাংকারিক রূপকে লুপ্ত করা হয়। কোম্পানী শাসনের পরিবর্তে সরাসরি বৃটিশ রাজার শাসন কায়েম করা হয়। এতদিন ধরে বৃটিশরা চাকমা রাজ্যকে চট্টগ্রামে বসে শাসনের ব্যবস্থা করত।
কিন্তু ১৮৬০ সালের ১লা আগস্ট তারা চাকমা রাজ্যকে নতুন নামকরণ করে এর নাম রাখেন চিটাগাং হিল ট্রাক্টস। ১৮৬০ সালের রেইড অব ফ্রন্টিঢার ট্রাইবস্ এ্যাক্ট, ১৮৬০ মূলে তারা এ এলাকাটিকে নতুন জেলা হিসেবে গঠন করেন। নতুন জেলা গঠন ও নামকরণের পর এ অঞ্চলকে পৃথক উপজাতীয় এলাকা হিসেবে শাসন করতে লাগলেন।
১৮৮১ সালে বৃটিশরা আবার চিটাগাং হিল ট্রাক্টসকে বিভক্ত করার উদ্যোগ নেন । ১ লা সেপ্টেম্বরে তারা চিটাগাং হিল ট্রাক্টসকে তিনটি সার্কেলে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন। প্রথমে চিটাগাং হিল ট্রাক্টস এর কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ অংশ নিয়ে চাকমা সার্কেলের পাশাপাশি বােমাং সার্কেল নাম দিয়ে আরেকটি সার্কেল গঠন করা হয়। পরে আবারও চাকমা সার্কেল ভেঙে এর উত্তর পশ্চিম অংশ নিয়ে মং সার্কেল গঠন করা হয়। ফলে গােটা চিটাগাং হিল ট্রাক্টস তিনটি সার্কেলে পরিণত হয়। চিটাগাং হিল ট্রাক্টসকে বাংলায় পার্বত্য চট্টগ্রাম নামে অভিহিত করা হয়।
চাকমা জাতির ইতিহাস চর্চা সম্পর্কে নন্দলাল শর্মার লেখা একটি তথ্যবহুল লেখা পড়তে পারেন –
বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্ব প্রান্তে অসংখ্য গিরিবেষ্টিত, নদী-নির্ঝরিনী বিধৌত, হ্রদ ও অরণ্যের অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলা নিকেতন এই পার্বত্য চট্টগ্রাম । তার রূপ ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের জন্য দেশী বিদেশী সকল শ্রেণীর দর্শকদের কাছে একটি আকর্ষনীয় স্থান। এর উত্তরে এবং উত্তর-পূর্বে যথাক্রমে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য ও মিজোরাম বা লুসাই পাহাড়, দক্ষিণে কক্সবাজার জেলা, দক্ষিণ-পূর্বে বার্মার আরাকান পার্বত্য অঞ্চল এবং পশ্চিমে চট্টগ্রাম জেলা।
বিশ্বের মানচিত্রে এ অঞ্চলের অবস্থান উত্তর অক্ষাংশের ২১°২৫ থেকে ২৩°৪৫ এবং পূর্ব দ্রাঘিমাংশের ৯১°৪৫ থেকে ৯২°৫২। মােট আয়তন ৫০৯৮ বর্গমাইল। ১৮৬০ সালে একটি জেলা হিসেবে এর জন্ম হয়েছিল। বর্তমানে এ অঞ্চলটি তিনটি পার্বত্য জেলায় বিভক্ত- রাঙামাটি, বান্দরবান এবং ‘খাগড়াছড়ি।’ – সুগত চাকমা ননাধন
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিটি জেলায় একটি করে পার্বত্য জেলা পরিষদ রয়েছে। যদিও ১৯৮৯ সালে গঠন হবার সময়ে এগুলাের নাম ছিল স্থানীয় সরকার পরিষদ। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মােতাবেক এগুলাের নাম পরিবর্তন করে পার্বত্য জেলা পরিষদ করা হয়। এই চুক্তির আওতায় এই তিন পার্বত্য জেলাসমূহকে সমন্বয়ের জন্য নতুন একটি পরিষদ গঠন করা হয়।
যার নাম হলাে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ। এ পরিষদের প্রথম চেয়ারম্যান হলেন জ্যোতিরিন্দ্র বােধিপ্রিয় লারমা যিনি সন্তু লারমা নামে সমধিক পরিচিত। শুধু তাই নয়, সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীপরিষদে নিশ্চিত করার জন্য গঠন করা হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে অবশ্যই একজন উপজাতীয়কে নিয়োগ করার বিধান রাখা হয়েছে। এই মন্ত্রণালয়ের প্রথম মন্ত্রী ছিলেন কল্প রঞ্জন চাকমা।
পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনাে রাজা বা সার্কেল চীফগণের মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়ে যায়নি। বরং ১৯৮৯ সালের স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন ও ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মােতাবেক গঠিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাদের মর্যাদা স্থির করা হয়েছে। বান্দরবান জেলা জুড়ে বােমাং সার্কেল বিস্তৃত। শুধু তাই নয় রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার পুরাে রাজস্থলী উপজেলা ও কাপ্তাই উপজেলার কয়েকটি মৌজা এই সার্কেলের অন্তর্ভুক্ত।
চাকমা সার্কেলে অন্তর্ভুক্ত হলাে রাঙ্গামাটি জেলার বোমাং সার্কেলের এলাকাবাদে সকল উপজেলাসমূহ এবং খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা। মং সার্কেলের অধীনে রয়েছে খাগড়াছড়ি জেলার অপরাপর উপজেলাসমূহ। তিনটি সার্কেলের অধীনে রয়েছে হেডম্যান ও কার্বারী প্রথা। হেডম্যানরা হলেন মৌজা প্রধান এবং কার্বারীরা হলেন গ্রাম প্রধান।
তারা সার্কেল চীফের পক্ষ হয়ে ভূমি ও ঐতিহ্য সংক্রান্ত দিকগুলাে দেখাশুনা করে আসছেন তারপরও এই অঞ্চলের রাজারা ভূপতি নন; তারা হলেন নৃপতি। চাকমা সার্কেলের অধীনে ১৭৭টি মৌজা রয়েছে। ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধের কারনে ক্ষতিগ্রস্থ হয় ১২৫টি মৌজা। এক একটি মৌজার আয়তন হলাে সর্বনিম্ন ২ বর্গমাইল ও সর্বোচ্চ ৩২ বর্গমাইলের মধ্যে। চাকমা সার্কেলের অধীনে চাকমা ছাড়াও তঞ্চঙ্গ্যা, মারমা ,পাংখুয়া, ত্রিপুরা ও বাঙালী হেডম্যান রয়েছেন।
চাকমারা নিজেদেরকে চাঙমা বলে পরিচয় দেন। তারা নিজেদের শাক্যবংশের বংশধর বলে মনে করেন। অতীতে মারমারা চাকমাদেরকে সাক বা ঠেক নামে অভিহিত করতাে। ত্রিপুরারা চংমা বা কুরুমু বলে ডাকে। লুসাইরা বলে তাকাম। এবং পাংখােরা বলে আইএং। এছাড়া সমতল বাংলাভাষীরা হেয় অর্থে জুম্মো নামে অভিহিত করতাে।
অবশ্য পরে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে জুম্ম জাতীয়তাবাদের উদ্ভব হলে বাঙালীরা জুম্মাে ডাকা হতে সরে আসে। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল জাতিদের উপজাতি ও অউপজাতি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। চাকমারা উপজাতি সংজ্ঞায় অন্তর্ভূক্ত।
চাকমারা মঙ্গোলীয় মানব গােষ্ঠীভূক্ত। স্যার রিজলী তার ট্রাইবস এন্ড কাস্ট অব বেঙ্গল পুস্তকে চাকমাদেরকে শতকরা ৮৪.৫ ভাগ মােঙ্গলীয় বলে মন্তব্য করেন। চাকমাদের চেহারা সুশ্রী। গায়ের রং ফর্সা, নাক কিছুটা বােচা। দেহ সুগঠিত, শক্তিশালী এবং নারী-পুরুষ সকলে খুবই পরিশ্রমী।
১৯৯১ সনের আদমশুমারী অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের জনসংখ্যা ২,৩৯,৪১৭ জন। পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়াও ভারতের মিজোরাম, অরুনাচল ও ত্রিপুরা রাজ্যে প্রচুর পরিমাণে চাকমা বাস করেন। শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা জনসংখ্যা বর্তমানে ৫ লক্ষাধিক হবে বলে ধারণা করা হয়।
চাকমাগণ মনে করেন তারা চম্পকনগর নামক একটি নগর এলাকা থেকে তাদের রাজা বিজয়গিরির সহিত এই এলাকায় আসেন। কিন্তু কোথায় এই চম্পকনগর বা তার অবস্থান সে সম্পর্কে তাদের কোন স্মৃতি নেই। তবে তারা মনে করেন চাম্পা থেকে চম্পকনগর হয়েছে। উত্তর ও উত্তর-পূর্ব ভারত, বার্মা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বেশ কয়েকটি চাম্পা নামের জায়গার সন্ধান পাওয়া গেছে।
যেমন ভারতের হিমাচল প্রদেশে চাম্বা, মধ্যপ্রদেশে চাম্পা, বিহারে ভাগলপুর ও পূর্ণিয়ার চাম্পা, ত্রিপুরা রাজ্যে চাম্পা ও চম্পকনগর, আরাকানে চাম্পা, উত্তরবঙ্গে চাম্পা, ভিয়েতনামে চাম্পা নামের সন্ধান পাওয়া যায়। কিন্তু এতগুলি চাম্পার মধ্যে কোন চাম্পা থেকে চম্পকনগর নামের উৎপত্তি হয়েছে তা কেউ সঠিকভাবে বলতে পারেননি।
চাকমাগণ ৪৬টি গােজা ও বিভিন্ন গুথিতে বিভক্ত। মারমা শব্দ গংসা থেকে গােজা শব্দের উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করা হয়। গং এর অর্থ মাথা বা সর্দার।
‘চাকমাগণ সর্বমােট ৪৬টি গােজা এবং বিভিন্ন গােষ্ঠীতে বিভক্ত। একটি গােজা বেশ কয়েকটি গােষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে থাকে। গােজার সর্দার বা নেতার দৈহিক গঠন, স্বভাব, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, অভ্যাস, তার বসতি অঞ্চল ইত্যাদির উপর নির্ভর করে একটি গােজা বা গােষ্ঠীর নামকরণ হয়ে থাকে বলে অনেকে মনে করেন। বগা গােজার আদি পুরুষের দেহ বকের মতােন সাদা এবং তার গলা লম্বা ছিল বলে বগা গােজার নামকরণ হয়েছিল।
লামা অঞ্চলে যারা বাস করে তারা লারমা গােজা, যাদের সর্দার লস্কর ছিলেন তারা লস্কর গােজা, ফাইসাখালি এলাকায় যারা ছিল তারা ফাকসা গােজা, যে গােজার সর্দার ছিল লেবা তারা লেবা গােজা ইত্যাদি। তাহলে দেখা যায় যে, গােজার আদি পুরুষের কীর্তিকলাপ, কাজকর্ম, বীরত্ব, আচার আচরণ, অভ্যাস, স্বভাব-চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, বাসস্থান, দৈহিক গঠনের উপর ভিত্তি করে এবং বসতি অঞ্চলের নামের উপর ভিত্তি করে গােজার নামকরণ করা হয়েছিল।’ -সুরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা
চাকমারা যখন আলিকদম এলাকায় রাজধানী স্থাপন করে বাস করছিল সে সময়েই চাকমাদের মধ্যে গােজা গুথির উদ্ভব হয় বলে অনেকে মনে করেন। উল্লেখ্য যে, আলিকদমের আদি নাম ছিল ‘আদি আদাম’। আদি আদাম নামটি বিকৃত হতে হতে আলিখ্যডং এবং বর্তমানে আলিকদম নামে এসে ঠেকেছে। মূলত: আরাকান রাজ্য ছাড়া হয়ে মাতামুড়ি নদীর তীরে চাকমা রাজা সর্বপ্রথম যে আদাম পত্তন করেছিলেন সে আদামের নামটি ছিল আদি আদাম। নিম্নে চাকমাদের কয়েকটি গােজা ও তাদের অন্তর্গত গুথির নাম দেখানাে হলাে।
ক্রমিক নং | গোজার নাম | গুত্থির নাম |
১ | বগা গোজা | ১। ধূর্য্যা গোজা ২। নিনাদ্ন্যা ৩। কাঠ্যেয়া ৪। রামদালিকা ৫।মুলিখাজা ৬।কাত্তুয়া ৭।ভেলে ৮।বোয়া ৯। নানুকতুয়া ১০। পোয়াকামার্য্যা ইত্যাদি |
২ | দার্য্যা গোজা | ১। কোমরেং ২। নাদুকতুয়া ৩। কাত্তুয়া ইত্যাদি |
৩ | লারমা গোজা | ১। চার্য্যা ২। পিড়াভাঙা ৩। বগা ৪। ভবা ৫। তদেগা ৬। সামঝা ৭। সাতভেইয়া ইত্যাদি |
৪ | ধামেই গোজা | ১। চাওন্যা ২। সকুয়া ৩। আগারা ৪। হাতি ৫। পিড়াভাঙা ৬। সুরেশ্বরী ৭। বাঘঅজা ৮। করেংগিরি ৯। আওনি কণা ১০। রাক্কোয়াবাপ ১১। নাদকতুল ১২। কাঙারা ইত্যাদি |
৫ | তোন্যা গোজা | ১। ধুর্য্যা ২। কুর্য্যা ৩। মুলিয়া ৪। পৈয়ব ইত্যাদি |
৬ | পোয়া গোজা | ১। কাক্কিনা ২। ফাত্তোয়া ৩। কলয় ইত্যাদি |
৭ | পোমা গোজা | ১।জান্দর ২। গুইয়া ৩। তুদা ইত্যাদি |
৮ | কুরাকুত্যা বা নারান গোজা | ১। নেন্দার ২। সুরেশ্বরী ৩। তদেগা ৪।পেনজাং ৫। কাঙারা ৬। তেতৈয়া ৭। পজা ৮। পিরাভাঙা ৯। আগুনা ১০। কাউয়া ১১। ভদং ১২। ভূত ১৩। ক্যকধরা ১৪। কবা ১৫। দেয়ান ১৬। রাজাকাবা ১৭। অমরি ১৮। কুগী ১৯।আউনাপুনা ২০। আমু ইত্যাদি |
৯ | ওয়াংঝা গোজা | ১।কাঙারা ২। শ্যাঠা ৩। পুংঝা ইত্যাদি |
১০ | লচ্চর গোজা | ১।ভিদ্দিলী ২।ওয়াংঝা ৩। গঝাল ৪।পিরাভাঙা ইত্যাদি |
১১ | কাম্ভেই গোজা | ১। মেন্দর ২। কালাপেনজাঙি ৩।জাঙি |
১২ | চেগে গোজা | ১। লুলাং ২। ভুরুমা ৩। কাঙরা ৪। ধাবানা ৫। বহুলা ৬। বান্যাব ৭। পিড়াভাঙা ৮। মগ ইত্যাদি |
১৩ | বড় চেগে গোজা | ১। খোট্যাল/গত্তাল ২। লোয়াকদ্দা ৩। চেলীপুনা ৪। উন্দুরতালা ৫।পুংজা ইত্যাদি |
১৪ | বুংসা গোজা | ১। কাঙারা ২। মৈষচরা ৩।চগদা ইত্যাদি |
১৫ | মুলিমা গোজা | ১।ধাবানা ২। মিদা ৩। নোয়ান্যা ৪। সিং হাসর্প ৬। আনন্দ্যা ৭। কলা ৮। রাঙসিলন্যা ৯। বাদালী ১০।সেবাজ্যা ১১। সকুয়া ১২। মানিয়া ১৩। সাদং ১৪। করম্যা ১৫। সল্যা ১৬। পজা ১৭। ইজা পজা ১৮। ক্ষাংথং ১৯। বামন চেগে ইত্যাদি |
১৬ | ফাক্সা গোজা | ১। বালকা ২। বরইবেচা ৩। কলা চেম ৪। কাঙ ৫। তিন ভেদা ৬। বড় কু্য্যা ৭। ছোট কুয্যা ৮। চিলা ৯। নাবালিকা ১০। গুড়াফাক্সা ইত্যাদি |
১৭ | আমু গোজা বা আঙু গোজা | ১। দয্যা ২। মগ ৩। সিঙিরা পুনা ৪। তালুকদারদাঘি ইত্যাদি |
১৮ | লেবা গোজা | গোষ্ঠীর নাম এখনো সংগৃহীত হয় নি। |
১৯ | ফিত্তিয়া গোজা | গোষ্ঠীর নাম এখনো সংগৃহীত হয় নি। |
২০ | ফেদুংসা গোজা /ফেদংসা গোজা | ১। মুলিয়া ২। কবার্যা ৩। পুংঝা ৪। কাশমানিক ৫। ইন্দুরতালা ৬। কালাপিলাবাপ ইত্যাদি |
২১ | খ্যংচেগে গোজা | ১।চৈদানী ২। চানৈ ৩। দোজা ৪। কবার্যা ৫। সম ৬। সর্দার ৭। কাগুনিকাল ৮। বেৎকাবা ইত্যাদি |
২২ | উচ্চুরী গোজা | আগুনাপুনা ইত্যাদি |
২৩ | তেইয়া গোজা | গোষ্ঠীর নাম এখনো সংগৃহীত হয় নি। |
২৪ | বড় কান্তি গোজা | গোষ্ঠীর নাম এখনো সংগৃহীত হয় নি। |
২৫ | বড়বুং গোজা | গোষ্ঠীর নাম এখনো সংগৃহীত হয় নি। |
২৬ | ছোটবুং গোজা | গোষ্ঠীর নাম এখনো সংগৃহীত হয় নি। |
২৭ | খ্যাঙজী/খ্যাংজয়/হেং্যা গোজা | গোষ্ঠীর নাম এখনো সংগৃহীত হয় নি। |
২৮ | ফেমা গোজা | গোষ্ঠীর নাম এখনো সংগৃহীত হয় নি। |
২৯ | পুরান তেইয়ে গোজা | গোষ্ঠীর নাম এখনো সংগৃহীত হয় নি। |
৩০ | হেইয়া/ঐয়া গোজা | ১। কুর্য্যা ২।ধুর্য্যা ৩।মুলিয়া ৪। পৈয়ব ৫। জাল্যা ৬। সল্যা ৭। পিড়াভাঙা ইত্যাদি |
৩১ | ফাকসা গোজা | ১। বালকা ২। বরৈবেচা ৩। কলাচেম ৪। কাঙ ৫। তিন্ ভেদা ৬। বরকুর্য্যা ৭। ছোতকুর্য্যা ইত্যাদি |
৩৩ | রাঙি গোজা | ১। লোয়াঝাত্তোয়া ২। পার্বোয়া ৩। জাদি ৪। কাল ৫। বরইয়া ৬। বাদালি ৭। চেগে/তালুকদার ইত্যাদি |
৩৪ | কুদুগা গোজা | ১। ভূলা ২। কালাবাঘা ৩। কাল ৪। পিড়াভাঙা ইত্যাদি |
৩৫ | পেদাংছাড়ি গোজা | ১। পেদাংছারি ২। কুর্য্যা ৩। মুলিয়া ৪। পৈয়ব ইত্যাদি |
৩৬ | চাদঙ গোজা | ১। সর্দার ২। শেয্যা ৩। রসিরি ইত্যাদি |
৩৭ | বাবুরা গোজা | ১। বাবুরা ২। গঝাল্যা ৩। মানাইয়া ৪। লোয়াকদ্দা ৫। ভগতপ ইত্যাদি |
৩৮ | বুর্বুয়া গোজা | ১। তবা দাগি ২। ফরা দাগি ৩। কাংদড়ি দাগি ৪। পাগালা দাগি ইত্যাদি |
৩৯ | চেক্কাবা গোজা | গোষ্ঠীর নাম এখনো সংগৃহীত হয় নি। |
৪০ | পুঙ গোজা | গোষ্ঠীর নাম এখনো সংগৃহীত হয় নি। |
৪১ | বুংযা গোজা | গোষ্ঠীর নাম এখনো সংগৃহীত হয় নি। |
চাকমা সমাজে শ্ৰেণীবৈচিত্র্য অতীতে তেমন ছিল না। তবে রাজা থাকায় সমাজজীবনে রাজকীয় শাসনরূপ হিসেবে সাধারণভাবে শাসক ও শাসিত বিভাগ বিদ্যমান ছিল। জানা যায় যে, রাজা শুকদের শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের অংশ হিসেবে ১৭৫৭ সালে দেওয়ান, তালুকদার ও কার্বারী পদ প্রবর্তন করেন। যা বর্তমানে সাধারণভাবে প্রচলিত রয়েছে। সমাজ বিজ্ঞান যেভাবে শ্রেণাতে বিবেচনা করে সে হিসেবে চাকমা সমাজে নিম্নোক্ত শ্রেণীভেদ রয়েছে বলে উল্পে করা যায়।
১. জমিদার ও মুৎসুদি্দ শ্রেণী (প্রচুর জমির মালিক, বাঙালীদের উপর নির্ভরশীল বড়াে ব্যবসায়ী, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় উচ্চপদধারী)।
২. মাঝারি বুর্জোয়া শ্রেণী (সরকারী ও বিদেশী এনজিওতে উচ্চ পদধারী)
৩. পেটি বুর্জোয়া শ্রেণী (ছােট ব্যবসাদার, বুদ্ধিজীবি, শিক্ষক, উকিল, ডাক্তার ইত্যাদি)
৪. আধা সর্বহারা শ্রেণী (মাঝারি কৃষক, গরীব ভূমিহীন কৃষক, জুমচাষী, কারিগর।)
৫. সর্বহারা শ্রেণী (দিনমজুর, কৃষি শ্রমিক ও শিল্প শ্রমিক এদের মধ্যে সামান্য কিছু উচ্ছন্ন সর্বহারা অংশ রয়েছে।)
অতীতে চাকমা সমাজ গােজাভিত্তিক ছিল। প্রতিটি গােজায় দেওয়ান, খীসা জাতীয় শাসক শ্রেণীর লােক ছিল। পদমর্যাদায় খীসারা হলেন নিম্নতম। দেওয়ানদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য তাদের নানান কাজ করতে হয়। দেওয়ানদেরকে প্রতিবছর ১ আড়ি চাউল, ১টি আলওযালা মােরগ ও ১ বােতল মদ দিতে হয়। এটাকে আকচলী বলে।
আবার খীসারা অনেক সুযােগ সুবিধা ভােগ করতাে। যেমন দেওয়ানদের বাড়ীতে সাধারণ প্রজাদের ১ দিন বিনামজুরীতে খাটার যে ব্যবস্থা ছিল তা হতে তারা মুক্ত ছিল। শুধু তাই নয়, তাদের জুমের অর্ধেক খাজনা বা ৩ টাকা দিতে হতাে। দেওয়ানদের সম্মানে খীসাদের বাৎসরিক ভােজের আয়ােজন করতে হতাে।
কোন কোন সময় ভােজের পরিবর্তে নানান দ্রব্যসামগ্রী দেওয়ানকে দিতে হতাে। আবার খীসারা গ্রামে শিকারলব্দ প্রাণীর ঘরভাগ ছাড়াও বাড়তি একভাগ লাভ করেন। খীসাদেরকে শুধু দেওয়ান নয়, প্রজাদেরকেও খানা খাওয়াতে হতাে। এটাকে খীসাখানা বলে। প্রতি বছরের বৈশাখ মাসে খীসাদের পদটি নবায়ন করতে হতাে।
জানা যায় যে, ‘মাংসী’ নামে একজন দেওয়ান ছিলেন। তিনি ছিলেন খুবই মদ্যপী। রাজবাড়ীতে এলেও তার জন্য বাড়তি মদের ব্যবস্থা করে দিতে হত। এর সূত্র ধরে একসময়ে রাজপূণ্যাহতে দেওয়ান পরবর্তীকালে হেডম্যানদের জন্য রাজার মদ বাবদ বাড়তি খরচ দিতে হতাে। এটাকে ‘মাংসী খরচ’ নামে অভিহিত করা হয়।
এটাও জানা যায় যে, দেওয়ানদের চাইতে অর্থবিত্ত থাকলেও কেহ তার চাইতে উন্নত ঘরবাড়ি তৈরী, বিয়েশাদীতে বাদকদলের ব্যবস্থা বা অলংকার পড়তে পারতাে না। তাই চাকমা সমাজে কতক ক্ষেত্রে এখনাে ‘দেওয়ান’ নাম শুনলেই এক ধরণের শােষকের কথা মনে করিয়ে দেয়।
‘অতীতে চাদিগাঙে, অর্থাৎ যেখানে বর্তমান চট্টগ্রাম শহর গড়িয়া উঠিয়াছে, রাজধানী স্থাপন করার পরবর্তী সময়ে চাকমা রাজা শাসনব্যবস্থায় দেওয়ান পদবীর সৃষ্টি হইয়া থাকিবে। চট্টগ্রামের অধিবাসী কোন মুসলমান পরিবার অথবা হিন্দু পরিবারের কৌলিক অথবা নবাব বাদশাহদের প্রদত্ত দেওয়ান উপাধি নাই এবং অতীতেও ছিল না। দেওয়ান উপাধি কেবলমাত্র চাকমা জাতির লােকদের মধ্যে প্রচলিত এবং বংশানুক্রমিকভাবে বর্তমানেও রহিয়াছে।
চাকমা রাজাদের চাদিগাঙে অবস্থানকালে, চাদিগাঙে অর্থাৎ তখনকার রাজধানীতে দেওয়ানদের স্থাপিত হাট ও পুকুর এখনও বিদ্যমান রহিয়াছে। চট্টগ্রাম শহরের বর্তমান আগ্রাবাদ রােডের পশ্চিমপার্শ্বে পাঠানতুলি এলাকায় অবস্থিত দেওয়ানহাট, রহমতগঞ্জ রোডের পূর্বপার্শ্বে দেওয়ানজি পুকুর এবং নন্দনকানন বৌদ্ধ মন্দিরে এনায়েত বাজার রােডের দক্ষিণ পার্শ্বের রাণীর দীঘি এখনো অতীত ইতিহাসের স্বাক্ষ্য বহন করিতেছে।’
-চিত্ত কিশোর লারমা, চাকমা জাতির জীবন স্মৃতি
শ্রেণীভেদে চাকমাদের জীবনযাত্রায় ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। আধুনিত সুরম্য অট্টালিকায় চাকমারা যেমন বাস করে তেমনি রাস্তায় ভিক্ষাবৃত্তি করেও অনেকে দিনাতিপাত করে। তবে চাকমাদের মধ্যে রাস্তায় ভিক্ষা করার প্রবণতা সাম্প্রতিককালে দৃশ্যমান হচ্ছে। বিভিন্ন বৃত্তিমূলক পেশায় চাকমারা নিয়ােজিত। নাপিত, রিক্সাচালক, গাড়ীচালক হতে শুরু করে সরকারী বেসরকারী চাকুরজীবি এবং সাম্প্রতিককালের তথ্য ও যােগাযােগ প্রযুক্তি খাতেও চাকমারা নিয়ােজিত।
সরকার ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের যৌথ অর্থায়নে পরিচালিত পার্বত্য চট্টগ্রাম পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের ২০০৬ সালের গ্রাম পর্যায়ের এক আর্থ-সামাজিক জরিপমূলে চাকমাদের মাথাপিছু আয় ১২,৬৪০ টাকা বা ১৮৫.৮৮ ডলার (১ ডলার=৬৮ টাকা)। তারা মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় গুরুত্ব দিয়েছেন। এগুলাে হলাে পাকা সড়ক, বাজার ও উপজেলা সদর ব্যবহারের সুযােগ সুবিধা ।
দেখা যায় যে, লােকজন যতই এসব সুবিধার কাছাকাছি থাকেন ততই তাদের আয় বৃদ্ধি পায় বিপরীতক্রমে যতই এসব সুবিধা হতে দূরে থাকে ততই আয় হ্রাস পায়। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সূচক অনুযায়ী যারা দৈনকি ১ ডলারের কম আয় করে তারা চরম দরিদ্র। সে হিসেবে চাকমারা চরম দারিদ্র অবস্থা তথা ভঙ্গুর অর্থনীতির মধ্যে বাস করছে।
অতীতে চাকমারা পাহাড়ের সাথে খাপ খাইয়ে স্থায়ী প্রকৃতির বাড়ীঘর নির্মাণ করে। কেননা শাসক জাতি হিসেবে চাকমারা অনেক আগে থেকেই স্থায়ীভাবে বসবাসের প্রতি গুরুত্বারােপ করেছিল। চাকমারা পাহাড়ী এলাকায় বাস করলেও ছােট ও সমতল পাহাড়ী এলাকাকে তারা গ্রাম গড়ার জন্য বাছাই করে। এসব গ্রামের বাড়ী স্থায়ী আকারের হয়ে থাকে। বাড়ীর খুঁটির জন্য কুম্বােই, ভাদি, জারুল প্রভৃতি গাছ ব্যবহার করে।
তাই বাড়ীঘর নির্মাণের প্রধান উপকরণ হলো বাঁশ ও গাছ। চাকমাদের মধ্যে বর্বুয়া গােজার অনেক গুত্থির লােক দক্ষিণমুখী ঘর তৈয়ার করতে পারে না। কিন্তু চাকমাদের সাধারণ ধারণা হলাে যে, দক্ষিণমুখী ঘরই হলাে সবচেয়ে স্বাস্থ্যসম্মত। চাকমারা বিভিন্ন ধরণের ঘর তৈরী করে। মাচাং ঘর হলে সেটি মাটি হতে ৬/৭ ফুট উঁচু হয়। বাড়ীগুলােতে বেড়া ঘেরা ছােট ছোট রুম থাকে। চাকমা বাড়ীগুলাে কয়েকটি অংশে বিভক্ত। যেমন-
১. সিংগবা- এখানে অতিথিদের বসার ব্যবস্থা করা হয়। অনেক সময় সম্মানিত ব্যক্তিদের জন্য সিংগবায় আহারেরও ব্যবস্থা করা হয় ।
২. ইজোর বাড়ীর সামনে বা পেছনে বড়াে খােলা অংশ। এখানে সংগ্রহ করা পানি, সামান্য পরিমাণে ধান শুকানাে এধরণের কাজে ব্যবহৃত। বাড়ীতে শিশু থাকলে ইজোরটি ঘেরা দেয়া হয় ।
৩. গুদি- বাংলায় কক্ষ বলা হয়। বাড়ীর সদস্য সংখ্যা অনুযায়ী গুদি রাখা হয়।
৪. হানিশাল- এটা হলাে চাকমাদের রান্নাঘর ।
৫. ওজেলেঙ- বাড়ীর সবচেয়ে পেছনের অংশ।
চাকমারা ঘরের ছাউনি হিসেবে সাধারণত শন ও বাঁশের পাতা ব্যবহার করে । মাচাং ঘরে মেঝে বাঁশ দিয়ে চাজা বানিয়ে বানানাে হয় । বাড়ীর বেড়াগুলাে বুননে একধারা, দুইধারা ও তিনধারা জু ব্যবহার করা হয়। বাড়ীতে আলাের ব্যবস্থা করার জন্য ফোগদি কানা রাখা হয়। সচরাচর বাড়ীর পশ্চিম দিকে এসব ফোগদিকানা রাখা হয়।
চাকমারা প্রধানত: বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তবে বৃটিশ ঔপনিবেশিক আমলে কিছু সংখ্যক চাকমা খৃষ্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত হন । জানা যায় যে, অনেক দরিদ্র চাকমা রােববার দিন পাদ্রিদের কাছ হতে বিবিধ দ্রব্যাদি পাবার জন্য চার্চে সমবেত হত। আবার বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে রাজনৈতিক সহিংসতায় কেহ কেহ বাধ্য হয়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। তবে উভয়ের সংখ্যা খুবই নগণ্য। অতীতে চাকমাদের বৌদ্ধ ধর্ম চেতনাবােধ লুরিরা রক্ষা করেছিলেন ।
অতীতে চাকমারা মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী হলেও তাদের মধ্যে হিন্দু ধর্মের প্রভাব লক্ষ্যণীয় । চাকমাদের বিভিন্ন রাজা ব্রক্ষ্মণ্য ধর্মের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। স্বয়ং রাণী কালিন্দিও প্রথম দিকে হিন্দু ধর্মের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন বলে জানা যায়। ফলে রাজার ধর্মই চাকমা জাতির ধর্ম বলে বিবেচিত হয়ে এসেছে। ব্রক্ষ্মদেশে অবস্থানকালে চাকমারা বাংলার সংস্পর্শে এসে পুরােপুরি বৌদ্ধ ধর্ম অনুসরণ করতাে না বলে জানা যায়। অর্থাৎ তারা বাহ্যিক আছার অনুষ্ঠানগুলি হিন্দু ধর্মের সংস্কার অনুযায়ী পালন করতেন।
তারা যে ধর্ম লালন করতাে সেটাকে তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্ম বলা হয়। মূলত: পাল রাজাদের উত্থানের সাথে সাথে তান্ত্রিক বৌদ্ধবাদের প্রসার ঘটে। সেন রাজাদের আমলে তান্ত্রিক বৌদ্ধবাদ পুরােপুরি হিন্দু ধর্মে পর্যবসিত হয়। তখনকার সময়ে বৌদ্ধরাজাদের নামফলকে ঔঁ ব্যবহার করা আরম্ভ হয়। সপ্তম হতে দ্বাদশ শতব্দীর মধ্যে আমরা শীল রক্ষিত, দীপংকর শ্রীজ্ঞান, শীলভদ্র, নাগার্জুন নামক বৌদ্ধ পুরুষদের নাম জানতে পারি।
চাকমাদের গাঙ পূজা হলাে হিন্দুদের গঙ্গা স্নানের মতাে। হিন্দুরা যেমন গঙ্গা স্নান করে পবিত্র হয়ে উঠে অনুরূপভাবে চাকমরাও গাঙ পূজা করে গৃহীর পরিশুদ্ধি অর্জন ও মঙ্গল কামনা করে। চাকমা রাণী কালিন্দি আরাকান হতে সংঘরাজ ভিক্ষু ও হারবাং হতে প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ ভিক্ষুগণকে আমন্ত্রন করে রাজধানী রাজানগরে ‘মহামুনি বৌদ্ধ বিহার’ স্থাপন করেন। তিনি সে সময়ে ‘থাধুথাং’ নামক বৌদ্ধ ধর্মীয় গ্রন্থ বাংলায় বৌদ্ধ রঞ্জিকা’ নামে অনুবাদ করে প্রচারের ব্যবস্থা করেন ।
অন্যদিকে বড়ুয়া বৌদ্ধগণও চাকমাদের বৌদ্ধ ধর্ম লালনে উৎসাহ যুগিয়ে চলেন । পাকিস্তান আমলে ইসলামী ধর্মের আগ্রাসন বেড়ে গেলে চাকমা সমাজ প্রতিটি গ্রামে বৌদ্ধ বিহার নির্মাণে উদ্যোগী হয়। কিন্তু প্রয়ােজনীয় নীতিবান ভিক্ষু তখন খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। মারমা ও বড়ুয়া ভিক্ষুরা এসব বিহার বা কিয়ঙে বিহারাধ্যক্ষরূপে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার ও প্রসার ঘটান। চাকমা রাজ পরিবারের এক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রয়েছে
রাজা নিজেই রাজ বিহার প্রতিষ্টা করেন। রাঙ্গামাটিতে গড়ে উঠে রাজবনবিহার । চাকমা রাজা ভূমি দান করে রাজবাড়ির উত্তর পার্শ্বের সমতল পাহাড়ে এই বিহার স্থাপন করেন। এই রাজ বন বিহারের অধ্যক্ষ হলেন বনভান্তে । মূখ্যত চাকমাদের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মের পুনর্জাগরণ ঘটে বনভন্তের মাধ্যমে। তার আসল নাম হলাে সাধনানন্দ মহাথেরাে।
বনভান্তের গৃহস্থ জীবনের নাম ছিল রথীন্দ্র। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামসহ গােটা বিশ্বের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে অতিশয় পূজনীয় একজন ভিক্ষু। অনুত্তর ভিক্ষু সংঘ ক্ষেত্র ও স্বধর্মপ্রাণ দায়ক দায়িকাগণ মনে করেন যে তিনি অর্হৎ লাভ করেছেন। তাই তিনি শ্রাবক বুদ্ধরূপে সকলের কাছে পূজনীয় ।
বর্তমানে রাজবন বিহার সকল বৌদ্ধদের কাছে একটি অন্যতম তীর্থ স্থান । দেশ বিদেশ থেকে হাজার হাজার দায়ক দায়িকা প্রতিদিন বনভান্তের অমৃতবাণী ও ধর্মদেশনা লাভের আশায় ভীড় করেন। তবে দু:খজনক হলেও সত্য যে, চাকমারা বৌদ্ধ ধর্ম পালন করতে গিয়ে পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ ও রাজবন বিহার ভিক্ষু সংঘ এ দু’টো ভাগে ভাগ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দেয় । সুখের বিষয়, বর্তমান সময়ে উহা প্রায় প্রশমিত হয়েছে। বিশেষ করে স্বধর্মপ্রাণ দায়ক দায়িকাগণ যথাসম্ভব সত্য ধর্মে আগ্রাহন্বিত হওয়ায় তা সম্ভবপর হয়েছে।
চাকমারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও তারা নিজস্ব কতকগুলি পূজা চর্চা করে থাকে। এসব পূজার মধ্যে ভাতদ্যা অন্যতম। যা পূর্ব পুরুষের উদ্দেশ্যে অনুদান করা বুঝায়। মাথা ধােয়া হলাে আরেকটি পূজা যার মাধ্যমে কোন পরিবার পবিত্র হয়ে উঠে। অনেক সময় কোন গােজার লােক বাঘের কামড়ে মারা পড়লে তখন সে গােজার লােকেরা মিলে মাথা ধােয়া পূজা করে । মা লক্ষ্মীমা পূজা করা হয় নতুন ধান খাওয়ার আগে। ভাত ঝরা পূজা দেওয়া হয় সন্তানের অসুখ হতে আরােগ্য লাভ কামনা করার উদ্দেশ্যে। জুমের দোষ নিরসনের জন্যও পূজা দেওয়া হয়। এটাকে ধুজ মারা পূজা বা জুম মারানা বলে ।
গ্রামবাসীর মঙ্গলের জন্য সবাই মিলে থানমানা করা হয়। থানমানার সময়ে মা গঙ্গা বা গাঙ পূজা করা হয়। এ পূজা দেয়ার সময় একজন ওঝা পৌরহিত্য করেন। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে থানমানা করা হয়। থানমানার সময়ে গ্রামবাসীরা সামর্থ্য অনুসারে চালসহ শুকর ও অন্যান্য দ্রব্যাদি ও নগদ টাকা দেয়।
এসকল আয়ােজন করে সবাই মিলে এক বেলা আহার করেন। তখন বিভিন্ন ধরণের আলাপ আলােচনাও চলে। বিশেষ করে কে কত আড়ি জুম কাটবে, কোথায় কোন জায়গায় কে জুম কাটবে এসব নির্ধারিত হয় থানমানার আলােচনায়। যাদের বাড়তি বীজ ধান থাকে এবং যাদের বীজধানের ঘাটতি থাকে তখন সেখানে তার ভাগাভাগি বা সমাধা করা হয়।
চাকমাদের আরেকটি পূজা হলাে আদাম বন। বন মানে ‘নিষেধ। কোন গ্রামে বা পার্শ্ববর্তী গ্রামে সংক্রামক ব্যাধি যেমন কলেরা ও বসন্ত দেখা দিলে আদাম বন করা হয়। একজন বৈদ্য গ্রামের প্রবেশ ও বাহির পথে বাঁশের চিহ্ন টাঙিয়ে দিয়ে আদাম বা গ্রাম বন করে। আদাম বন করার প্রধান কারণ হলাে সতর্কতা অবলম্বন। যেন সে গ্রামে সংক্রামক রােগ থাকলে অন্যরা গ্রামটি এড়িয়ে চলেন বা সংক্রামক রােগে আক্রান্ত ব্যক্তি যেন ঐ গ্রামটি এড়িয়ে চলেন। আদাম বন করলে গ্রামবাসীদের কিছু সতর্কতা বা নীতি পালন করতে হয়। যেমন কোন কিছু মাটিতে হেছঁড়ে নেয়া যাবে না, দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করা করা যাবে না, সন্ধ্যার সময়ে বড়াে ধরণের শব্দ করা যাবে না ইত্যাদি।
আমি ছােটকালে ভিন্ন কারনে আদাম বন করার ঘটনা দেখেছি। আমাদের গ্রামটি ছিল রাঙ্গামাটি শহরের অদুরে বন্দুকভাঙ্গা মৌজার চংড়াছড়িতে। তখন সামরিকবাহিনীর দমণ পীড়ন গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক মাত্রায় দেখা দেয়। সামরিক বাহিনীর নির্যাতন হতে রক্ষা পাবার জন্য আমার দাদু (মা এর কাকা। যিনি বৈদ্য ছিলেন।) গ্রাম বন করেন।
যতদূর মনে পড়ে গ্রামের উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে তিনি চারটি মাটির শর’ (পাত্র ঢাকার ঢাকনা জাতীয়) দিয়ে গ্রাম বন করেন। তখন বলা হতাে যে, অস্ত্রধারী লােক গ্রামে ঢুকলে দুর্বল ও অলস হয়ে পড়বে এবং গ্রামবাসীদের কোন প্রকার জিজ্ঞাসাবাদ বা মারধাের কবার মতাে তাদের গায়ে শক্তি থাকবে না। ফলে গ্রামবাসীরা নির্যাতন হতে রক্ষা পাবে।
চাকমাদের আরেকটি পূজা হলাে এদা দাগা। নিম্নে এদা দাগা সম্পর্কে তুলে ধরা হলো।
‘বাংলায় একটা কথা আছে ভয়ে ‘আত্মরাম খাঁচা ছাড়া’। চাকমাদের মধ্যে এই কথাটার একটা অদ্ভুত বাস্তব নজির আছে। এক্ষেত্রে কিন্তু আত্মরামকে আবার বিশেষ প্রক্রিয়ায় খাঁচায় আনা যায়। এটাকে ভাতদ্যার মতাে একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সংস্করণ বলা চলে। হাঁটি হাঁটি পা পা এই বয়সের বাচ্ছা ছেলেমেয়ে হঠাৎ যদি খুব ভয় পায়, অনেক ক্ষেত্রে সে ভয়ে একেবারে নেতিয়ে পড়ে। ছেলেটার বাবা, মা, যাদের খুব ন্যাওটা অনেক সময় তাদেরই কেউ রাগের বশে ছেলের উপর তর্জন গর্জন করে এরূপ বিপত্তি ঘটিয়ে থাকে।
তখন বাচ্ছাটা ঘাড় সােজা করতে পারে না, চোখ বোঁজা অবস্থায় ভাতদ্যায় আবিষ্ট হয়ে পড়া লােকের মতাে একঘেঁয়েভাবে কাঁদতে থাকে আর শিউরে উঠে। এসময় হয়ত গা সামান্য গরমও হয়ে থাকতে পারে । সহসা এর উপশম ঘটাতে না পারলে ছেলের প্রাণহানির আশংকা থাকে। এ অবস্থাকে বলে এদা জুরানা অর্থাৎ কিনা আত্মারাম খাঁছা ছাড়া হওয়া।
যে বিশেষ প্রক্রিয়ায় এরূপ ছেলেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায় তাকে বলে এদা দাগা। এই অনুষ্ঠানে কোন দেবতার পূজা হয়না এবং বিশেষ কোন মন্ত্রোচ্ছারণেরও কোন বালাই নেই। অঝা বা যে কোন অভিজ্ঞ লােক এব্যাপারে পৌরহিত্য করতে পারে। এ অনুষ্ঠানেও ভাতদার মতাে মেজাং এর উপর আগ কলা পাতা পেতে আদারাহ সাজাতে হয়।
তবে সেখানে ভাত তরকারী ইত্যাদি। কিছু দিতে হয় না ।উপকরণের মধ্যে লাগে মুরগীর বাচ্চা, কলা, আখ, আখের গুড় দুয়েকখানা বেঙ পিঠা আর একটি টাকা। আগের দিনে রুপাের টাকা দেওয়া হত। একাধিক দিলেও ক্ষতি নাই । অনুষ্ঠান শেষে এগুলােতে সূতা জড়িয়ে কিংবা গেট লাগিয়ে ছেলে কিংবা মেয়ে তাকেই পড়তে দেয়া হয়। যার প্রস্তুত প্রণালী নিম্মরূপ:
মুরগীর বাচ্ছাটাকে জবাই করে সেটার পালক ছাড়িয়ে নাড়িভূড়ি ফেলে মাথাটাকে ঘুরিয়ে এনে বুকের ছিদ্র দিয়ে পেটের ভিতর ঢুকিয়ে দিতে হবে। অনুষ্ঠানের সময় ছেলের মা বাচ্ছাটাকে কোলে বাড়ির সদর দরােজায় বসে থাকে আর নিচে মাটিতে অঝা আদারাহ বসায়। আদারাহ বসানাে মেজাং এর সঙ্গে সাতগছি সুতাে বেঁধে তার অপর প্রান্তে ছেলের মা হাতে ধরে থাকে।
আদারাহ যার জন্যে সে যদি ছেলে হয় তবে একখানা গামছা দিয়ে আর মেয়ে হলে একখানা খবং কিংবা খাদি দিয়ে আদারাহ ঢেকে দিতে হয় । সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেলে অঝা আদারার ঢাকনা ঈষৎ ফাঁক করে এদা ডাকে। পাতুরু-তরু, ত বাবে কেচকেজেয্য, তম্মা কেচকেজেয়্যে ইত্যাদি ইত্যাদি। যার ভাবার্থ হলাে তােকে বাপ শাসিয়েছে মা খেদিয়েছে এখন তারা তােকে কলা দিয়েছে, আখ দিয়েছে, আয় আয় তুই বুঝে নে।
অঝা একখানা গামছা দিয়ে ডাকার মতাে করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে থাকে এভাবে যতক্ষণ না একটা মাছি বসলে। তখন আদারাহ তুলে ছেলেকে গছানাে হয়। অর্থাৎ তার সামনে ধরা হয়ে থাকে। সে সেখান থেকে যা খুশী একটা কিছু তুলে নেয়। তারপর ভালাে হয়ে যায়।’ -বঙ্কিম কৃষ্ণ দেওয়ান।
ভাত চাকমাদের প্রধান খাদ্য। ভাতের সাথে তরকারীর মধ্যে মাছ, মাংস ও সবজি অন্যতম। সামুদ্রিক মাছ হতে তৈরী সিদোল চাকমাদের তরকারী রান্নার প্রধান উপকরণ । সিদোল এর পােড়া গন্ধ পেলে প্রত্যেক চাকমার পেটে ক্ষুধা চলে আসে। এছাড়া সমুদ্রের শুকনাে মাছ বা শুটকি চাকমারা বেশ পছন্দ করে।
চাকমাদের খাদ্য রান্নার নানান পদ্ধতি রয়েছে। এগুলাে হলাে উজ্যা, সিক্যা, গুদুয়্যে, হলা, গােরাঙ, কেবাঙ, করবাে ইত্যাদি। যেসব তরকারী সেদ্ধ করে খাওয়া হয় তাকে উজ্যা বলে। সচরাচর শাক জাতীয় সবজি এভাবে রান্না করা হয় । হাড়ির ভিতরে মরিচের পরিমাণ বেশী দিয়ে সজি রান্না করার এক পর্যায়ে। দাল গাজ দিয়ে চর্ণ করা হয়। এধরণের তরকারীকে গুদেয়ে বলে।
যে সকল তরকারী ঝােল কম দিয়ে রান্না করা হয় সেগুলােকে হলা বলে । মাছ তরকারী এই পদ্ধতিতে বেশী করে রান্না করা হয়। আস্ত বা টুকরাে করা মাছ হলুদ, নুন আর মরিচ দিয়ে একটি বাঁশের কঞ্চি দিয়ে সরাসরি আগুনে পুড়িয়ে সেদ্ধ করা হলে তা সিক্যা তরকারী।
বাঁশের চোঙার ভিতর রান্না করা তরকারীকে গােরাঙ বলে । সাধারণত: মিটিঙা বাঁশ দিয়ে মাছ, মাংস গােরাঙ করা হয়। কলা পাতা বা অন্যান্য পাতা দিয়ে সরাসরি আগুনে রান্না করা তরকারী হলাে কেবাঙ।
এছাড়া মরিচ আর তাজা সবজি কুজোতে মিশিয়ে তরকারী প্রস্তুত করলে তাকে করবো বলে। পিঠা: চাকমা ভাষায় পিঠাকে পিদা বলে । চাকমা নারীরা নানা ধরণের সুস্বাদু পিঠা তৈরীতে পটু। পিঠা তৈরীর জন্য বিন্নি চাউল চাকমাদের প্রথম পছন্দ। সাথে নারকেল এবং কলা প্রয়ােজনীয়। আত্মীয়ের বাড়ীতে বেড়াতে যাওয়া, শ্বশুর বাড়ীতে বেড়াতে যাওয়া, বৌ দেখতে যাওয়া প্রভৃতি কাজে চাকমা সমাজে পিঠা অবশ্যই প্রয়ােজন হয়।
চাকমাদের পিঠাদের মধ্যে রয়েছে- কলা পিদা, হগা পিদা, বিনি পিদা, সান্যা পিদা, বেঙ পিদা, ধুপি পিদা, লুদি পিদা, পাক্কোন পিদা, বা পিদা, ইত্যাদি। বেশীর ভাগ পিঠা ভাপে সিদ্ধ করা হয় । এভাবে পিঠা তৈরী করতে হলে মাটির তৈরী একটি পােেন লাগে। পগােন দেখতে ছারির মতাে। তবে এর নীচের দিকে ৫/৬টি ছিদ্র থাকে। তবে বরা পিঠার জন্য শুকরের চর্বি হতে তৈরীকৃত তৈল বা সরিষার তৈল পছন্দ করা হয়।
মদ চাকমাদের অতি প্রয়ােজনীয় একটি পানীয়। চাকমারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও সামাজিক প্রথায় মদের ব্যবহার উল্লেখযােগ্যভাবে দেখা যায়। সাধারণত: মদের তিনটি রূপ দেখা যায়। যেমন-
১. মদ যা এক চুয়ানি ও দুচুয়ানিতে গুণগতমান দ্বারা ভাগ করা হয়
২.জগরা আর
৩.কানজি।
জগরা বিনি চাউল দ্বারা তৈয়ার করা হয়। কানজি এবং মদ সাধারণ চাউল দ্বারা প্রস্তুত করা হয়। চাকমাদের চুঙলাঙ পূজায় মদ লাগে। অতীতে বিবাহের ভােজের আগে উপস্থিত অতিথিদের এক চুমুক মদ দিয়ে আপ্যায়ন করা হতাে। গ্রামাঞ্চলে এখনাে এর সীমিত ব্যবহার রয়েছে। মৃতদেহ পােড়ানাের সময়েও ওঝারা মদ ব্যবহার করেন।
চাকমা রমণীরা নিজস্ব তৈরী পােষাক পরিধান করে। কোমরের উপরের অংশটিকে বুকে জড়ানাের জন্য রঙিন পােষাকটির নাম খাদি। একটি খাদির বিভিন্ন অংশ রয়েছে। এসকল অংশকে ধজ্যা, মাথা, কিয়ে, পেল, ভং, দই ইত্যাদি নামে চিহ্নিত করা হয়। এর বুনন শৈলী খুবই আকর্ষণীয়। আর কোমরের নীচে হাঁটু পর্যন্ত পরিধান করার পােষাকটির নাম পিনােন।
এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলাে এতে একটি চাবুগি রয়েছে। চাবুগির বিভিন্ন অংশ রয়েছে। এসকল অংশকে কুত্তুম, সামাে লেজ, হার, দিগ নামে অভিহিত করা হয়। এই চাবুগি বুনতে হলে আলাম এর প্রয়ােজন । আলাম হলাে বিভিন্ন নক্সার একটি কাপড়। চাকমাদের মধ্যে আলাম’ কে কবে প্রথম উদ্ভাবন করেছিল তা কেহ জানে না। তবে আলামের ফুলগুলির নাম রাধামন-ধনপুদি পালাতেও উল্লেখ পাওয়া যায়।
ধনপুদি রাধামনের জন্য যে যুদ্ধ সাজ বুনেছিল সেখানে আলামের বিভিন্ন ফুলের নাম রয়েছে। সেগুলাে হলাে বিগুনবিচি ফুল, চরকা আদা ফুল, সামুলেজ ফুল, বিলেইখুজ ফুল, উলুফুল ইত্যাদি । এই পুস্তকটির প্রচ্ছদরূপে আলাম ব্যবহার করা হয়েছে।
পুরুষরা সাধারণত: লুঙ্গি, গামছা এবং পাঞ্জাবি পরিধান করে। তবে আগেকার দিনে ছােট অবস্থায় চাকমারা চার আঙুলের মাপে বুনা একটি লেংটি পরিধান করতাে। জুম থেকে প্রাপ্ত তুলা থেকে উৎপাদিত সুতা দিয়ে বােনা হত শার্ট। চাকমা ভাষায় যার নাম সিলুম। বর্তমানে এধরণের পােষাকের ব্যবহার একেবারে উঠে গেছে।
চাকমা নারীরা প্রধানত: সােনা ও রূপার তৈরী অলংকার ব্যবহার করে । চাকমা নারীদের ব্যবহৃত অলংকারগুলাের মধ্যে রয়েছে গলায় পড়ার জন্য টেঙাছড়া, হাজুলি, হালছড়া, পিজিছড়া ইত্যাদি। পায়ে পড়ার জন্য রয়েছে। ঠেঙতহারু প্রভৃতি।
এছাড়া নারী পুরুষ উভয়ে সােনার আনদিক পরিধান করে । অতীতে চাকমা পুরুষরা কানে সােনা বা রূপার তৈরী ইয়ারিং বা বালি পরিধান করতাে। চাকমা নারীদের কানে পড়ার অলংকারগুলাে হলাে ইয়ারিং কানত কজফুল, ঝুমুলি আর নাকে পড়ার জন্য রয়েছে নাকফুল বা সেনার নথ । বাহুতে তাজজোড়, হাতে বাজু, বালা ও চুড়ি পড়ে ।
চাকমাদের বিবাহ প্রথা প্রতিনিয়িত পরিবর্তিত হচ্ছে। বর্তমানকালে বিবাহ প্রথার সাথে অতীতের বিবাহ প্রথার অনেক অসামঞ্জস্য রয়েছে। পূর্বে একই গুথির ু’জন যুবক যুবতীর মধ্যে সাত পুরুষ পর্যন্ত বিবাহ বন্ধন কড়াকড়িভাবে নিষিদ্ধ ছিল। চাকমা বিবাহ প্রথানুযায়ী মেয়েকে পুরুষের বাড়ীতে আসতে হয়। চাকমারা বিবাহের জন্য চুঙলাঙ অনুষ্ঠান আয়ােজন করে।
এতে একজন বৈদ্য লাগে । চুঙলাঙ ছাড়া কোন বিয়ে বৈধ হয় না। চুঙলাঙ এর জন্য শুকর, মুরগী,ডিম, ধান ও খই লাগে। অন্য ঘরের মেয়েকে নিজেদের ঘরে আপন করার জন্য ‘যদন বানা’ বলে একটি সামাজিক অনুমতি পেলে তাদের চুঙলাঙ করা সম্ভব হয়। অতীতে চুঙলাঙের সময় বর ও কনেকে ভােজের জন্য কাটা শুকরের মাথা প্রণাম করতে হতাে। এসময়ে একজন শাবালা লাগে। শাবালা সচরাচর পাত্রের গরবা কুটুম হয় না।
কোন একজন পুরুষের জন্য কনে ঠিক করতে হলে চাকমা সুধােম বা নাতি অনুযায়ী কমপক্ষে তিনবার কনের বাপের বাড়ীতে যেতে হয়। প্রত্যেকবার কনের পিতার বাড়ীতে যাবার সময়ে পিঠা, নারিকলে, সুপারি, ও মদের বােতলসহ নানা জিনিসপত্রাদি নিয়ে যেতে হয়। এটাকে বলে তিন পুর।
তিন পুরের সময় বিবাহের তারিখ ও দেনা পাওনা ধার্য করা হয়। উল্লেখ্য যে, কনের পিতা ইচ্ছে করলে পাত্র পক্ষ হতে বিয়ের অনুষ্ঠানের বিভিন্ন সামগ্রী যেমন- নগদ টাকা, সেনারূপা, শুকর ইত্যাদি দাবী করতে পারে। নগদ টাকা দেয়াকে দাভা বলে ।
কোন কোন যুবক যুবতী প্রণয়াবদ্ধ হয়ে পলায়ণের পর আত্মপ্রকাশ করলে তখন উভয়পক্ষের সম্মতিতে বিবাহ হতে পারে। এক্ষেত্রে সচরাচর মেয়ে পক্ষ অসম্মতি প্রকাশ করে। এ ধরণের আপত্তি হেডম্যানের কাছে উত্থাপিত হয়। এতে কোন প্রকার দন্ড দেয়া হলে পুরুষটির গুরুদন্ড হয়ে থাকে। সচরাচর আপত্তি ও দন্ডের পরও যদি উক্ত যুবক যুবতী স্বেচ্ছায় তিনবার পলায়ন করে তবে তাতে কারাে আপত্তি করার সুযােগ থাকে না। তখন তাদের বিবাহ বন্ধনে কোন বাঁধা থাকে না।
বিবাহ বন্ধনের জন্য নিয়ম রয়েছে তেমনি বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রেও নিয়ম রয়েছে। কোন পুরুষ ইচ্ছে করলেই মুসলমানদের মতাে ‘তালাক’ শব্দের মতাে কোন কিছু উচ্চারণ করে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে না। তাই চাকমা সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদে পুরুষের একতরফা ক্ষমতা নেই। কোন দম্পতি দুগ্ধ শিশু থাকা অবস্থায় যদি বিবাহ বিচ্ছেদ করতে চায় এবং তাদের শিশুটির দায় দায়িত্ব কেহ নিতে না চায় তবে তাদের কোনমতে বিবাহ বিচ্ছেদ হতে পারবে না।
তবে যদি কেহ ঐ শিশুটির লালন পালনের দায়িত্ব নেয় তবে তাদের বিচ্ছেদ হতে পারে । কোন দম্পতির যদি কন্যা সন্তান থাকে এবং তাদের বিচ্ছেদের পর সে কন্যা সন্তানটি অন্য কারাে দ্বারা লালিত পালিত হয়ে বিবাহযােগ্য হয়ে উঠে তখন সে কন্যা সন্তানটির বিবাহ সম্বন্ধ নির্ধারণে তাদের কোন অধিকার থাকে না।
চাকমা সমাজে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা যখন বর্ষাবাস পালন করে সে সময়ে বিবাহ করা যায় না। তবে এসময়টাতে বিবাহের জন্য পাত্র পাত্রী ও তারিখ ঠিক করা যায় । চাকমারা খুরী, মাসী, পিসী, জেঠি মাতৃস্থানীয় স্ত্রীলােক এবং কনিষ্ট ভ্রাতাবধু, ভ্রাতৃকন্যা, ভাগিনী প্রভৃতি স্ত্রীলােকের সাথে বিবাহ সম্বন্ধ করতে পারে না।
কেহ এরূপভাবে বিবাহ করলে তার চরম সামাজিক শাস্তি ভােগ করতে হয়। তাকে পাঁঠা ছাগলের সাথে তুলনা করা হয়। তাই কাঠাল গাছের পাতা খাইয়ে মাথা মুড়িয়ে গ্রামে ঘুরিয়ে তাকে শেষ পর্যন্ত ভান্তের কাছে সূত্রপাঠে শুদ্ধ করা হয়। তবে তাকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সমাজচ্যুত হয়ে থাকতে হয় । এছাড়াও চাকমারা কনিষ্ট ভ্রাতাবধু, পুত্রবধু ও ভাগিনার বধুকে স্পর্শও করতে পারে না।
চাকমাদের গর্ভবতী মহিলা নিজ স্বামীর ঘরে সন্তান প্রসব করে। অতীতে ধাইরাই সন্তান প্রসব করাতেন। অবস্থাপন্ন পরিবারের সন্তান প্রসবের আগে হতে বাড়ীতে ধাই এনে রাখতেন। সন্তান প্রসবের পর নবজাতকের মঙ্গল কামনা করে ‘কজই পানি লনা’ নামে একটি অনুষ্ঠান করা হয়। এর মাধ্যমে প্রসূতি মা শুদ্ধসাঙ্গ হয়ে উঠেন। এদিনে ধাইকে উপহার সামগ্রী দিয়ে বিদায় করা হয়। চাকমাদের শিশুর নামকরণের জন্য কোন অনুষ্ঠান আয়ােজন করা হয় না। সচরাচর বয়ােজ্যেষ্ঠারা শিশুর নাম নির্ধারণ করেন।
অতীতে চাকমাদের ডাকনামগুলাে তাদের চরিত্র দ্বারা নির্ধারিত হতাে। যেমন কোন ব্যক্তি যদি এক জায়গায় বেশী ক্ষণ বসে থাকেন বা উঠি উঠি করেও উঠতে চান না তার নাম ডাকা হয় শিলপুনাে। যে ব্যক্তি বেশী করে গল্প করে তার নাম গপ্পো। চাকমাদের নামকরণে হিন্দু ধর্মের প্রভাব লক্ষ্যণীয়। এ কারনে চাকমাদের প্রায়ই বাংলা ভাষার নাম রাখা হয়।
অতীতে চাকমাদের নামকরণ হতাে হিন্দু দেবতাদের নামে। যেমন রাম, কৃষ্ণ ইত্যাদি। বৃটিশ আমলেও এর ধারাবাহিকতা দেখা যায়। তবে সে সময় কিছু কিছু ইংরেজী নাম চাকমাদের মধ্যে লক্ষ্যণীয়। যেমন জনি, রলি ইত্যাদি।
বড়াে বড়াে বীর বা মহাপুরুষদের নামেও চাকমারা নামকরণ করেন। যেমন সুভাষ চন্দ্র, ক্ষুদিরাম । কেহ কেহ গৌতম বুদ্ধের গৃহী নাম ব্যবহার করেন। যেমন- সিদ্ধার্থ। তার ছেলে রাহুলের নামও অনেকে রাখেন। বর্তমানে শিশুর নামকরণে চাকমা ভাষার নাম করণ করার হিড়িক পড়েছে। যেমন- জুনি, ফগদাঙ, বারিজে ইত্যাদি।
চাকমারা স্বাভাবিকভাবে মৃত ব্যক্তিদের মৃতদেহকে দাহ করে। তবে যে শিশুর দাঁত উঠেনি তাকে কবর দেয়া হয়। এছাড়া যে ব্যক্তি কলেরা, যক্ষ্মা, বসন্ত ইত্যাদি দুরারােগ্য রােগে মৃত্যুবরণ করে তাদের কবর দেয়া হয়। চাকমারা সচরাচর বুধবারে মৃতদেহ দাহ বা কবর দেয় না। চাকমাদের মৃত্যু সৎকার একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া মেনে সম্পন্ন করা হয়।
মৃতব্যক্তিকে যেদিন দাহ করা হয় সেদিন জীবিতদের সাথে মৃতব্যক্তির সম্পর্ক ছিন্ন করা হয়। মৃতব্যক্তির পায়ের কনিষ্ট আঙ্গুলে ৭ পাক সূতা বেধে ঐ সূতার প্রান্ত একটি মুরগীর বাচ্চার সাথে বাঁধা হয়। জীবিত ব্যক্তিরা ঐ মুরগী বাচ্চাটিকে ধরে থাকে। তখন উপস্থিত প্রবীণ ব্যক্তি সমাজের লােকের কাছে জীবিত ও মৃত পৃথক করার হুকুম আছে কিনা জিজ্ঞেস করে। উপস্থিত সকলে ‘হুকুম আছে’ বলে সম্মতি জ্ঞাপন করে।
হুকুম পাওয়ার পর ঐ সূতাটি কেটে ফেলে জীবিত ও মৃত পৃথক করা হয় । তারপর বাঁশের তৈরী একটি আলংএ মৃতদেহকে তুলে শ্মশান ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। মৃতদেহ বাড়ী থেকে নামানাের সাথে সাথে বাড়ীর সমস্ত পানি ফেলে দেয়া হয়। শ্মশানে মৃতব্যক্তির মুখে শেষ বারের মতাে খাদ্য স্পর্শ করানাে হয়।
অন্যদিকে শ্মশানঘাটে মৃতদেহ দাহ করার জন্য আগে ভাগে চিতা সাজানাে হয়। এটাকে বলে রুবােকুর। মৃতদেহ পুরুষ হলে ৫ স্তর এবং নারী হলে ৭ স্তর লাকড়ী সাজানাে হয়। মৃতব্যক্তির জ্যেষ্ঠপুত্র অথবা জ্যেষ্ঠপুত্র না থাকলে নিকটতম আত্মীয় মুখাগ্নি করে এবং এর পর পরই অন্যেরা চিতায় আগুন ধরিয়ে দেয়। মৃতদেহ পােড়ানাে হলে সবাই নদীতে, পুকুরে বা ঝর্ণায় গােসল করে বাড়ি ফিরে যায়।
পরদিন মৃত ব্যক্তির স্বগােত্রীয় একজন ব্যক্তি বা পুরুষ সন্তানেরা শ্মশানে গিয়ে হাড়সহ ছাই একটি মাটির নতুন তবাতে ঢুকিয়ে সাদা কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে মুখ বেঁধে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। এটাকে ‘হার ভাজানা’ বলে। এরপর চিতায় টাঙোন টাঙানাে হয়। পরিশেষে সাপ্তাহিক ক্রিয়া সম্পাদন করা হয়। তখন বৌদ্ধ ভিক্ষু সংঘ ডেকে মৃতব্যক্তির উদ্দেশ্যে নানাবিধ দানযজ্ঞ সম্পাদন করা হয়। এছাড়াও পর পর তিন বছর মৃত ব্যক্তির স্মরণে ভােজ ও পূণ্যাষ্টান করা হয়। যাকে বজরী বলা হয়।
চাকমারা নিজস্ব চিকিৎসা শাস্ত্র দ্বারা সমৃদ্ধ। চাকমা ভাষায় এটাকে তালিক শাস্ত্র বলা হয়। তালিক শাস্ত্র নিয়ে যারা চিকিৎসা কাজ করে তাদের বৈদ্য বলা হয় । সচরাচর বনজ নানান গুল্ম, লতাপাতা থেকে চিকিৎসার কাঁচামাল বা দারু তালিকা বানানাে হয়। এছাড়া বিভিন্ন প্রাণী থেকেও চিকিৎসার কাঁচামাল সংগ্রহ করা হয়। নিম্নে এ ধরণের কয়েকটি ওষুধের নাম দেয়া হলাে।
১. কাদা চিবাঙ ২. ঝারবাে বেই শাক ৩. মরমজ্যা আমিলে ৪. আদি ব’
৫. কাদা চোলা ৬.ডুব ৭. বর চল্যা ৮. মিধে ফুল ৯. ভুত্তো লুদি ঝােনঝােনি ১০. বন বড়ই ১১. পেতে্ত্য মুলাে ১২. জ্ঞান লুদি ১৩. মরমচ্যা পাদা ১৪. ডম্বাঙ ঝাদু ১৫. আঝংমা ১৬. ঘিলা লুদি
১৭. শিগিরে শিগ ১৮. বড় লেজ ১৯. মনিমজ্যা খের ২০. বিজবাদালি ২১. দেন আত পা ২২. ডাগবেঙা লেজ ২৩. ইজে খের ২৪.হাঙারা ঘিলুক শাক ২৫. দুগতরা ২৬. লাঙা আত পা ২৭. উব লেঙেরা ২৮. হাক্কোন শাক ২৯. মিধেতরা ৩০.লাঙা আত পা ৩১.উব লেঙেরা ৩২.হাক্কোন শাক।
৩৩. সােতসােদি ৩৪. ঠান্ডামানেক ৩৫. মদন মত্তো ৩৬. ধুব সুরােদি ৩৭. নাজোনী পাদা ৩৮. ফাচ্যসুগুনি ৩৯. মেলােনি ৪০. রাঙা সুরােদি ৪১. টেঙাসরা ৪২. সুদমা ৪৩. টেঙফুল ৪৪. অন্নহােলি ৪৫. ভজ ৪৬. বাঙুরি ভাঙা খের ৪৭.লাল তিদে ৪৮. সজক শাক ৪৯. য্যেস।
৫০. আমিলে তিধে ৫১. ভুল পত্তি ৫২ . রেজ্যাফুল ৫৩. মেনগুনি ৫৪. বান্দর তলা ৫৫. বিজ কুজু ৫৬. তুলসীপাতা ৫৭. দিয়ে দুলােন ৫৮. কালাসােনা পাদা ৫৯. হার্বাস ৬০. ধান সাবারাঙ ৬১. সাদি উদিস্যা ৬২. বান্দর ঘিলা ৬৩. এইদ কান্নো
৬৪. সূর্যপাদা ৬৫. কেদকী ৬৬. চঙরা মরিচ ৬৭. হাজপুরাে বকসরা ৬৮. চিদিরে বেই শাক ৬৯. কেদাভক্তা ৭০. বিলেই লেঙুর ৭১ . সুগার আমিলে ৭২. মুগুজো খের ৭৩. টুব বেই শাক ৭৪. শােগােন পাল ৭৫. করই গাছ বাকল ৭৬. চিগােন তেঙোরা মাদি
৭৭. উং গাজ আঙারা ৭৮. ভাঙুরি ভাঙা খের ৭৯. গাে পুক ৮০. হরপিগিড়ে ৮১. ভূলঙ শিঙোর ৮২. সাপ চিত ৮৩. মধু ৮৪. গন্ডার লাে ৮৫. চেদ্দবা ফোর ৮৬. রংরাঙ পিড়ে ৮৭. কুদুক ঝোনঝুনি ৮৮. গন্ডা শিঙ ৮৯. ঘােড়া লাট ৯০. কালা বিলেই ঘু ৯১. বিজ পাথর ৯২. ভাত মাস্যা ঘু ৯৩. যুবাে মেলোনি ৯৪. শুগুর’ ঘু ৯৫. ঝারবু বিলেই ঘু ৯৬. কাল্যা জিরে
চাকমাদের তালিক ব্যবহারে মাটি ও ধাতুর তৈরী জিনিসপত্রাদি লাগে। যেমন মাটির শর যেখানে আঙ তােলা হয়, তাবিজ ফুল, এক পােড়া লােহা, পেরেক, কামার দোকানের পানি ইত্যাদি।
অনেক সময় শুধু মন্তর দিয়েও চিকিৎসা করা হয়। চিকিৎসা ব্যতীত নানান কাজে চাকমা বৈদ্যরা মন্তর ব্যবহার করেন যেমন-
১. শিকার মন্তর:
কোন শিকারী শিকার কাজে বেরুলে এই মন্তরটি কোন বৈদ্য ৭ বার উচ্চারণ করলে ঐ শিকারী কোন প্রকার শিকারের নাগাল পায় না বলে জানা যায় । নিম্নে শিকার মন্তরটি উল্লেখ করা হলাে-
‘বিনি সুদো কাদি কাদি
পল্লান এযের আদি আদি
বন শিগের বনত থােক।
আদিয়ে পল্লান ফিরি এযােক ।
উল্লেখ্য যে, মন্তর শেষে প্রত্যেকবার ‘উং সুয়া ফু’ বলে বড়াে ধরণের ফু দিতে হয়।
২. ফি-বলা বা আপদ তাড়ানাের মন্ত্র:
সচরাচর মৃত গুই সাপ, কচ্ছপ ও বাঁশ ইঁদুর ঝগড়ার নাগাল ফেলে ফি বা আপদ হয় বলে চাকমারা বিশ্বাস করে। তাই যিনি এধরণের পরিস্থিতির শিকার হন তাকে এই মন্তরটি দ্বারা শুদ্ধ বা পবিত্র হতে হয়। নদীর ধারে ফি-বলা লােকটিকে বসিয়ে কানের উপরের পাশের চুল ভিজিয়ে মন্তরটি ৭ বার ঝপে ঝপে বৈদ্যরা লােকটিকে শুদ্ধ করে। নিম্নে মন্তরটি দেয়া হলাে-
‘পদিক্কো, পদিক্কো
বাচনং, শিশুনং
নম: হরি, নম: হরি,
পুনজো রং।
চোজি চোজি
উং সুয়া ফু।’
৩. দুধ পিড়া মন্তর:
সাধারণত: নতুন গর্ভ প্রদানকারী মহিলাদের স্তনে দুধ বেড়ে গেলে স্তনগুলাে ব্যাথা করে। এ সময়ে এ মন্ত্রটি ৭ বার ঝপে দিলে ঐ মহিলার দুধ ব্যথা ভাল হয়ে যায়। নিম্নে মন্তরটি উল্লেখ করা হলাে-
‘ও কুলে ভিদে এ কুলে ভিদে
মধ্য শিরা
যে শিরা উদে
সে শিরে মিলে ।
উং সুয়া ফু।’
৪. হলুদ পড়া মন্তর:
কোন ব্যক্তির মাথাঘােরা ও বমি বমি ভাব হলে এই মন্তরটি প্রয়ােজন হয়। মন্তরটি জপার সময়ে কাঁচা হলুদ লাগে। মন্তরটি ৭ বার পড়তে হয় । মন্তরটি নিম্নরূপ-
‘হলদা হলদি
জনম জাদি
হিমালয় পর্বত
উতপুদি
উং সুয়া ফু।’
৫. নুনপড়া:
কোন ব্যক্তির চিক্কো ঝরানা বা মুখে পানি বেরুলে লবণে এই মন্তর ৭ বার ঝপে দিলে সে লবণ খেলে ঐ ব্যক্তির চিক্কো ঝরানা বন্ধ হয়। মন্তরটি নিম্নরূপ-
‘রামে দিল তেউরি
লক্ষ্মণে দিল পাত
সীতা রানে ভাত ।
নুন মিলেনি মিলে যােক
ফলনা পেদ ভাত।
উং সুয়া ফু।’
৬. চিগােনগুড়ার বমি:
কোন শিশু মায়ের দুধ খাওয়ার পর বমি করলে লবনের উপর এই মন্তরটি ৭ বার ঝপে দিলে সে লবণ শিশুকে খাওয়ালে শিশুটির বমি বন্ধ হয়। মন্তরটি নিম্নে দেয়া হলাে-
‘হাজে চেকচেগায়
সুগুরে খায়
এই গুরােবুর
দুধভাত
ভজত অয়ে যায়
উং সুয়া ফু।’
চাকমা সমাজ পিতৃতান্ত্রিক। তাই সন্তানসন্ততি পিতার গােজার পরিচয় বহন করেন। স্বভাবতই ছেলেরাই চাকমা সমাজের উত্তরাধিকার হন। কিন্তু ছেলে না থাকলে মেয়ের ঘরে পুরুষ নাতি থাকলে তারা উত্তরাধিকার হতে পারেন। যেমন রাজা হরিশ্চন্দ্র। তিনি ধরম বক্স খাঁর মেয়ের ঘরে নাতি ছিলেন।
এছাড়া চাকমারা ধাবানা রাজপদে আসীন হওয়ার পদ্ধতিকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়ােগ করে।যেমন বাচ্ছা ছেলেরা খেতে না চাইলে তাদেরকে প্রতিযােতাির ভান করে বলা হয় যে, যে আগে খেয়ে শেষ করতে পারবে সে রাজা হবে। এতে চাকমা শিশুরা পটাপট খেয়ে ফেলে।
চাকমা সমাজ ব্যবস্থা পুরুষতান্ত্রিক হওয়ায় উত্তরাধিকার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি নি:সন্তান হলে তার স্ত্রী সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন। পিতার পূর্বে কোন ডুত্র যদি তার নিজের সন্তান রেখে মৃত্যুবরণ করেন তবে তারা তাদের পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন।
চাকমাদের মধ্যে আরেকটি প্রথা আছে যে, কোন পুত্র সন্তান যদি পিতার মৃত্যুর পর অন্তোষ্টিক্রিয়াতে স্বেচ্ছায় অনুপস্থিত থাকেন বা অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানান তবে সে পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারবে না । চাকমাদের মধ্যে দত্তক নেবার প্রথা স্বীকৃত।
এ অনুযায়ী দত্তরাও সন্তানের মতাে উত্তরাধিকারী হন। নি:সন্তান দম্পতির পুরুষটির আগে স্ত্রীলােকটির মৃত্যু ঘটলে ঐ পুরুষটির নিকটতম আত্মীয়রাই সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন । বৃটিশ আমলে চাকমা সমাজের প্রথাগুলাে লিপিবদ্ধ করার উদ্যোগ নেয়া হলে হেডম্যানরা তাদের প্রভাব খর্ব হবে মনে করে এর বিরােধীতা করেন।
চাকমা সমাজের উত্তরাধিকার প্রথা সম্পর্কে বিস্তারতি জানতে পড়ুন –
চাকমারা শিকারীদের পল্লান বলে। যারা পল্লানের সাথে শিকারে যায়। তাদের বলা হয় গুল্লেত। অতীতে চাকমারা ‘কাবু’ক ব্যবহার করে বাঘ, ভালুক, শুকর, হরিণ ইত্যাদি বন্যপ্রাণী শিকার করতাে। কাবুক হলাে বাঁশের ফলা দ্বারা তৈরী একধরণের তীক্ষ্ম ও ধারালাে ছুরি বিশেষ ।
এটি সূক্ষ্ম সূতা দ্বারা শিকারের চলার পথে এমনভাবে স্থাপন করা হয় যাতে পশুরা কোন মতে ঠাহর করতে না পারে। শিকারটি যখন এই পথ ধরে চলে যায় তখন কাবুকে পড়ে মারাত্মকভাবে জখম হয়। কাবুক অজ্ঞাত স্থানে স্থাপন করায় অনেক সময় মানুষও এর শিকারে পরিণত হতাে। সাধারণত: কোন মানুষের নিম্নাংশ কাবুকে জখম হয়ে যেত। ফলে শিকারের এই ভয়াবহ যন্ত্রটির ব্যবহার পরে নিষিদ্ধ করা হয়।
বৃটিশ আমলে বন্দুকের প্রসার ঘটে। প্রসার ঘটে বন্দুকের দ্বারা শিকার করার প্রবণতা। বন্দুকের দ্বারা শিকার করতে গিয়ে চাকমাদের মধ্যে শিকার সংক্রান্ত নতুন প্রথার উদ্ভব ঘটে। পল্লান শিকারের মাথা, কলিজা এবং চাইলে একটি রাণ লাভ করেন এবং মাংসের মধ্যে বন্দুকের জন্য বাড়তি ভাগ লাভ করেন।
তবে পল্লানকে শিকার করার পরে শিকারের একটা ‘রাণ’ দেওয়ান বা হেডম্যানকে দিতে হয়। বস্তুত: এই রাণ ভােগ করার অধিকারী ছিল একমাত্র রাজা। কিন্তু রাজা দেওয়ানদের এই ক্ষমতা প্রদান করেন। তবে সকল দেওয়ান বা হেডম্যান এই রাণ ভােগের অধিকারী ছিলেন না। জানা যায় যে, রাণী কালিন্দি ৩/৪টি গােজার দেওয়ানকে এ ধরণের অধিকার দিয়েছিলেন।
তামার পাতে এ ধরণের অধিকার প্রদানের নিয়ম ছিল। এক সময় রাজা ভূবন মােহন রায় রাণ না দেওয়ার কারণে জনৈক পবনরাজ দেওয়ানকে দন্ডিত করেন বলে জানা যায়। এ ঘটনায় তৎকালীন ডিসি চাকমাদের শিকারের এ প্রথা সম্পর্কে জানতে হেডম্যানদের শরণাপন্ন হন। তখন হেডম্যানরা ‘রাণ’ ভােগ করার অধিকারী বলে ডিসিকে অবহিত করেন । কিন্তু কামিনী মােহন দেওয়ান বলেন যে, সকল হেডম্যান এই রাণ ভােগ করার অধিকারী নন ।
এক সময়ে বর্বুয়া গোজার লােকেরা দল বেঁধে একটি ছংড়া (বড় হরিণ) ধাওয়া করে । ছংড়াদের স্বভাব হলাে তারা একবারে যতদূর পারে দৌড়ায় তারপর থেমে যায়। তাই বর্বুয়া গােজার লােকেরা ছংড়ার পায়ের ছাপ অনুসরণ করতে থাকে। এদিকে ছংড়াটি এক দৌড়ে রাজবাড়ী প্রাঙ্গণে এসে উপস্থিত। তখন রাজার পাইক পেয়াদারা ছংড়াটিকে ধরে মাংস বানাতে শুরু করে।
অন্যদিকে পায়ের ছাপ অনুসরণ করতে করতে বর্বুয়া গােজার লােকেরা রাজবাড়ী পর্যন্ত এসে পড়ে। তারা। দেখলাে যে, রাজার লােকেরা ছংড়াটিকে মাংস বানাচ্ছে। বর্বুয়া গােজার লােকেরা এতে দমবার পাত্র ছিল না। তাদের ভাবনা হলাে প্রথমে আমরাই ছংড়াটি শিকারের জন্য তাড়া করি। তাই এটি আমাদেরই প্রাপ্য। ফলে তারা রাজার পাইক পেয়াদাদের কাছ হতে ছংড়াটির রাণ ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
আবেগ তাড়িত হয়ে ক্ষণিকের উত্তেজনার বশে বর্বুয়া গােজার লােকেরা রাজার কাছ হতে ছংড়ার রাণ ছিনিয়ে নিলেও পরবর্তীতে রাজার চরম অপমান করা হয়েছে ভেবে ভয়ে কুঁকড়ে উঠে। গুজবের আকারে তা আরও বেশী করে ভীতি ছড়াতে লাগলাে। এক সময়ে বর্বুয়া গােজার কিছু লােক গ্রাম ছেড়ে পালাতে শুরু করলাে।
ক্রমে তারা ত্রিপুরা রাজ্যে আশ্রয় নিল। এভাবে সেখানে তাদের অনেক বছর কেটে যায়। ত্রিপুরা ও অন্যান্য জাতির সাথে তাদের বৈবাহিক সম্পর্কও গড়ে উঠে। এদিকে চাকমা রাজা তার প্রজাদের ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হন। তিনি ঘােষণা করলেন যে, যে সকল বর্বুয়া গােজা দেশে ফিরে আসবে তাদের জুম খাজনা ৪ আনা মাপ করে দেয়া হবে।
রাজার এই ঘােষণায় কাজ দেয়। বর্বুয়া গােজার লােকেরা ফিরে আসতে শুরু করে। কিন্তু ফিরে আসতে গিয়ে বর্বুয়া গােজাদের সাথে যাদের সম্পর্ক হয়েছে তারাও আসতে উৎসাহী হয়ে উঠে। ফলে দলে দলে বর্বুয়া গােজা নাম দিয়ে দেশে ফিরে আসে। এতে বর্বুয়া গােজার মধ্যে নানান গুথির জন্মলাভ করে।
আমি ছােটকালে মনুধন নামের বর্বুয়া গােজার এক বৃদ্ধ লােকের সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম। সে লােকটি ত্রিপুরা রাজ্যের মনুগাঙে জন্মলাভ করেছিল। মনুগাঙে জন্ম হয়েছিল বলে তার নাম মনুধন রাখা হয়েছিল। সে যখন ছােট তখন তার পরিবার দেশে ফিরে আসে বলে স্মরণ করতে পারতাে।
চাকমাদের বস্তুগত সংস্কৃতির প্রধান উপকরণ হলাে বাঁশ ও গাছ। লােহা ও মাটি সামান্য পরিমাণে ব্যবহৃত হয়। বস্তুগত সংস্কৃতি হলাে সেসব জিনিস যা কোন জনগােষ্ঠী নিজেদের জীবনযাপন ও অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে সৃষ্টি ও লালন পালন করে। চাকমাদের বস্তুগত সংস্কৃতি বিশাল এবং সমৃদ্ধ। নিম্নে চাকমাদের বস্তুগত সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হলাে।
জুম চাষে লােহা ব্যবহার খুব সীমিত। দা চাকমা ভাষায় তাগােল হলাে এর প্রধান উপকরণ । তাগােল দু’ধরণের। একটা হলাে ধারালাে অন্যটা হলাে সূচালাে। এছাড়া ছারি বা কাস্তের প্রয়ােজন হয়। বাদবাকী উপকরণগুলাে হলাে বাঁশ ও গাছের তৈরী। যেমন-
১. ইজোর
২. সানা
৩. ওজেলেঙ
৪. সিংগবা
৫. বাইজখানা
৬. কল ঘর
৭. বেড়
৮. বাজেই
৯.কাল্লোং
১০. কুরুম
১১. ভেরা
১২. লেই
১৩. তাগ
১৪. বেত
১৫. কাক্ক্যে
১৬.তলােই।
চাকমাদের জুম ঘর ও জুম চাষ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য পেতে চান ? তাহলে পড়ুন সুযশ চাকমার লেখা –
গৃহস্থালীর কাজে নানান ধরণের জিনিস প্রয়ােজন হয়। চাকমারা নিজেরাই এ ধরণের জিনিসগুলাে গাছ ও বাঁশ বা বিভিন্ন ধরণের ফল থেকে তৈরী করে নিম্নে এদের একটি তালিকা দেয়া হলাে-
১. দাবা
২. দুলাে
৩. লুদুঙ
৪. মেজাঙ
৫. ফুরবারেঙ
৬. পিদে কাল্লোঙ
৭. চুমাে
৮. ধ’
৯. সাম্মাে
১০.কাদি
১১. দাল গাজ
১২. ওগােই
১৩. গুদোনী
১৪. ধিঙি
১৫. ওজা
১৬, ঘাজনী
১৭. কিলে
১৮. কুলাে
১৯. জুমাের
২০. শরােনটারা
২১. আড়ি
২২. মাজা
২৩. উপ্ত মাজা
২৪. ধুলােন
২৫. জুরগাে
২৬. কালি চাবারা
২৭. কোনি
২৮. চারুক
সার্বিকভাবে পােষাক বুননের জন্য সূতা বাদে অন্যান্য যেসকল উপকরণ লাগে তাকে সজপদর বলা হয়। এগুলাে যেকোন চাকমা মহিলা নিজেই বানাতে পারে। নিম্নে এদের নাম দেয়া হলাে।
১. চরগি
২. ধনু
৩. চরগা
৪. রিবেঙ সু
৫. লাঙা
৬. রেজি
৭. নাধেই
৮. চুচ্যাক
৯. সিয়েঙ
১০. তাগলক
১১. ব’ কাদি
১২. ব’
১৩. তাম্মাে
১৪. আড়
১৫. যােদনী
১৬. গড়
১৭. বিয়ঙ
১৮. তাস্যা চাম ও দড়ি
১৯. তুঠ সুমাে
২০. নােলি
২১. কুদুক কাদাক
২২. বেন’ বেড়া
২৩. আলাম
পশুপাখি লালন পালনের জন্য চাকমারা নানা ধরণের ঘর ও জিনিসপত্রাদি তৈরী ও ব্যবহার করে থাকে। এদেরকে ভিন্ন ভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। যেমন-
১. লুর
২.উর’
৩. ঘর
৪. ফিয়ঙ
৫. ঘন্ডি
অতীতে চাকমারা গৃহসজ্জার জন্য বন ও প্রাণীদের বিভিন্ন জিনিস ব্যবহার করত। নিম্নে গৃহসজ্জায় ব্যবহৃত বিভিন্ন উপকরণের নাম দেয়া হলাে।
১. বিভিন্ন প্রাণীর শিং(হরিণ, চংড়া, মহিষ, ছাগল)
২. চিংড়ির খড়গ
৩. কাকড়া দাড়
৪. বান্দর সাঙু
৫.ঘিলে তাক
৬. চামড়া (বিভিন্ন জন্তু ও বড়াে ধরণের সাপঅজগর)।
বনে শিকার করা একটি স্বাভাবিক ব্যাপার বলে মনে করা হয়। চাকমা শিকারীরা নিজস্ব তৈরী হাতিয়ার শিকারের কাজে ব্যবহার করে । এগুলাের রয়েছে হরেক রকম নাম। যেমন-
১.বাদোল
২. চেমী খাজা
৩. কাবুক
৪. কেরাপ
৫. মঙ
৬. ঈদি
৭. বসসি সরা
৮. জাদি
৯. বেদাগী কাদা
১০. ধনু ও শেল
১১. টেরা
১২ শেই
১৩. দুপ
১৪. আদাশলা
১৫. মেইল
বিনােদনের ক্ষেত্রেও চাকমারা পিছিয়ে নেই। তারা বিনােদনের জন্য নানান সুর সৃষ্টি করে। এসকল সুর লহরীর জন্য বাঁশ ও গাছের তৈরী বাদ্যযন্ত্র ও খেলার উপকরণ তৈয়ার করে। যেমন-
১. ধুদুক
২. হেঙগরঙ
৩. শিঙা
৪. ঘিলে
৫. নাধেং
৬. বাজি
৭. শামুক
৮. মমা বিচি
৯. বাঁশের কাঠি
১০. সানেইগুলাে
১১. ঢােল।
চাকমারা দলীয়ভাবে নৃত্য পরিবেশন করে । চাকমারা নিজেদের মানবিক আনন্দবােধ হতে নৃত্য করে। রাজা বা অভিজাতদের মনােরঞ্জনের জন্য চাকমারা নৃত্য করে না। জাতীয় জীবনে আনন্দের বহি:প্রকাশে চাকমা সমাজে নৃত্য প্রচলিত। আগেকার দিনে বিজুর সময়ে চাকমা যুবক-যুবতীরা দল বেঁধে বিজু নাচ করতাে।
এছাড়াও মহামুনি বৌদ্ধ মেলার সময়েও চাকমারা দল বেঁধে ঝুমুর নাচ করতাে। আধুনিককালে চাকমারা পাহাড়ি নানান মুদ্রা ব্যবহার করে নাচ তৈরী করে চলেছে। এসকল নাচগুলাের মধ্যে জুম নৃত্য অন্যতম। চাকমাদের নৃত্যের সাথে অলংকার সম্পর্কিত। তাই চাকমা রমণীরা অলংকার পরিহিত হয়ে নৃত্য পরিবেশন করেন। এছাড়াও আধুনিক চাকমা গানের সাথে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন ধরণের চাকমা নৃত্য রয়েছে।
চাকমাদের সংস্কৃতির এক ভান্ডার হলাে অতীত লােক সাহিত্য। চাকমা ভাষায় গানের অর্থ হলাে গীত। আর গীত তখনই জমে সেটা যদি হয় উবগীত। উবগীত পরিবেশনকারীরা হলেন গেংখুলী। এক সময় উবগীতের সুরে সুরে চাকমা যুবক যুবতীরা ভাব বিনিময় করতাে। উবগীতের কয়েকটি লাইন-
কুজি মক্যা থুর ভাঙি
দিবনি ঈশ্বরবুই জুর বানি।
কুজি কুমুড়াে ঘুন পজ্যে পর্জে্্য
সমারে বেড়েবং জুন পৰ্য্যা ।
কুজি মক্ক্যা থুর ভাঙি
দিল ঈশ্বরবুই জুর ভাঙি ।
ছর মা কুড়া ছ চড়ায়
থেই দ ন পারং ত পরায় ।
উদে শুকতারা পুগেদি
মাল্যা শক্তি শেল বুগেদি।
নিম্নে কয়েকটি চাকমা প্রাচীন লােক সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত দিক তুলে ধরা হলাে।
এটা একটি প্রাচীন ধর্ম গ্রন্থ বিশেষ। এটি ২৮ অংশে বিভক্ত । এগুলাে বৌদ্ধ ধর্মের পালির সূত্র অপভ্রংশ আকারে লিখিত বলে মনে করা হয়। আসলে এটি ত্রিপিটকের চাকমা সংকলনের মতাে। নিম্নে এর বিভিন্ন টারা উল্লেখ করা হলাে।
১. আগরটারা- ধর্মীয় সূত্র ২. মালেমটারা- মঙ্গলসূত্রের অনুরূপ ৩. সাধেংগিরিটারা- ইহা শবদাহে ব্যবহৃত হয় ৪. অনিজাটারা- অনিত্য সংসারের কর্ম কথা ৫. শীল মােগলটারা- জয়মঙ্গল সূত্রের অনুরূপ ৬. দশাে পারমীটারা- পিন্ডদানে ব্যবহার্য। ৭. ক্রিতুদ্দটারা- ত্রিকুডড সূত্রের অনুরূপ ৮. বড় কুরুক ও ছােট কুরুক- মাথা ধােয়া বা পবিত্র হওয়ার কাজে ব্যবহৃত ।
৯. তালিকশাস্ত্রটারা- ইহা চিকিৎসাশাস্ত্র বিশেষ ১০. আরিন্তামাতারা – রাজ সম্মানিত ব্যক্তির পিন্ড উৎসর্গকালে ব্যবহৃত ১১. রাকেনফুলুটারা- বজরীতে ব্যবহৃত ১২. সাহসফুলটারা- শবদাহ প্রেতাত্মা হতে মুক্ত করার কাজে ব্যবহৃত ১৩. আরিন্নামাটারা- বিবাহ কাৰ্যে পাঠ করা হয় ১৪. জিয়নধারণটারা- ভাতদ্যা অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত।
১৫. আজিনাটারা- মৃত ব্যক্তির মুখে পিন্ড দানে ব্যবহৃত ১৬. পুদুমফুলুটারা- পিন্ডদানে ১৭. ফুদুমফুলুটারা- ঐ ১৮. চবাদিবাটারা- ভাতদ্যা অনুষ্ঠানে পাঠ করা হয় ১৯. চেরাকফুলুটারা- ঐ।। ২০. সানেংফুলুটারা- চান্দুয়া উৎসর্গকালে ব্যবহৃত। ২১. বুদ্ধফুলুটারা- ঐ ২২. সাক্সুত্তুনতারা- আগুনের ভয়ে ২৩. রাজাহুড়ােটারা- ঐ ২৪. চরকদানতারা-ধর্ম কাজে ব্যবহৃত ২৫. সুবাদিজাটারা ২৬. শাক্যটারা- ধর্ম কাজে ব্যবহৃত ২৭. ফকিরিটারা- নীতিজ্ঞান সম্পর্কে ২৮. আঙারাসূত্রটারা।
নিম্নে আগরটারার কিছু অংশ উদ্ধৃত করা হলাে-
সাবখিয়াং পেঞতেঞতেকা আনাপিনতে সােতিমা
তাকতেকা।। জেতাওয়ান ক্যংতে।। ভুঙাস্পন্ডাইসে
ঙ আন্যাদাতেরে, ইসং ই বেক বুম্মু।।
ইব ইমাংসে আকাতাে করা সেথ্থাং আসিং কেন।।
অক অলংত্রা । প্রুম্মা তাক্তাংওয়াসে প্লেতমা।।
তসস পন্নীয় দীপেসু সদ্দতিসস মহারাজ কালে একা রাজ
পরিমাে রাজ কম্মেন কোটঠ নাম গামে আগমসি।
প্রাচীন ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর উপর ভিত্তি করে চাকমাদের বিজিত বিভিন্ন রাজ্যের বর্ণণা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে চাদিগাঙ ছাড়া পালা রচিত হয়েছে। চাদিগাঙ ছাড়া পালা নিয়ে চাকমাদের মধ্যে নানান সংস্কার রয়েছে। কেহ কেহ মনে করেন যে, গ্রামের মধ্যে চাদিগাঙ ছাড়া পালা শােনা যায় না।
জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে চাদিগাঙ ছাড়া পালা শুনতে হয়। মূলত: চাদিগাঙ ছাড়া পালা হলাে চাকমা রাজা বিজয়গিরির বিজয় কাহিনী। বিজয়গিরির দু’জন সেনাপতি ছিলেন। একজন হলেন রাধামন এবং অপরজন হলেন কুঞ্জধন। নিম্নে চাদিগাঙ ছাড়া পালার ক’টি লাইন উদ্ধৃত হল-
নাজের উল্লাজে রাধামন
খই গাঙত পলাক্কি সৈন্যগণ।
জাদি পূজাত দিলুং ঘি
মগদেশ কুলে সৈন্যগণ পলাক্কি।
বর্শিত বাজে ধল বাজা
মগরাজা কত্তে কতুন এল কন রাজা।
রাধামনর সাজ ডাঙর
আস্তে আস্তে চাকমারাজা রাজ্য মারি লর।
লোইনেই সমারে সৈন্যগণ
রেয়াং কুলে লুঙগেগােই রাধামন ।
ছড়া ছড়িত ন গাধিব
মগরাজা কত্তে চাকমা রাজারে কাবিব।
বর্শি বেইন্যায় আধারে
রেয়াং রাজা নিজে লারেই ন গরে
লারেই গরে পাত্রে।
ডাকের তুলি জনে জনে
মার মার হুকুম দিল রাধামনে।
গত্তন মগে লিক লিকি
মগ ইন্দি সৈন্য পত্তনদে কত কি।
মগে গত্তন হাহাকার
মগের রাজ্য গত্তন চাকমায় অনাচর।
বর্শিত বাজে ধল বাজা
তুদি গরে ডাকে মগ রাজা।
কহে মগরাজা রাধামনে
রেজ্যে গজেই দ্যং তােমারে।’
চাকমাদের মধ্যে তান্যাবি পালা একটি ট্রাজেডী। বলা যায় মধ্যযুগীয় ট্রাজেডী । তান্যাবি অতিশয় সুন্দরী এক নারী ছিলেন। কমলধন নামের এক মৃতদার ব্যক্তিকে তার পিতামাতার ইচ্ছায় বিয়ে করতে হয় এবং শেষ পর্যন্ত সে পানিতে ডুবে আত্মহত্যা করেছিল। তান্যাবি পালার ক’টি লাইন নিম্নে দেয়া হলাে-
আঁরে নাদিন তান্যাবি
তুল্যা সাঙু পাজ্যা দিলে কার লাগি ।
তান্যাবি গাঙত যায় মাজি আনে সনার থাল
রজে ভরি পুরা অইয়ে বেই তান্যাবির যুবকাল ।
তান্যাবিয়ে উড়ে পিনে তেল দি মাধা আজুরে
তার যৌবনে পাগল অন্দেই সে আদামর গাভুরে।
তান্যাবি পান খায় মধুযষ্ঠী মুম গরে
কুকিছড়ার আড়িং পান আনি দেদন গাভুরে।
তান্যাবি ভাত রানে গালি ফেলেই ভাদ মু
তান্যাবির অসুখ অলে বেক গাবুরলগে চুদোমু।
তান্যাবি ভাত খায় ইত্তুক ইত্তুক উলু তােন
গাভুর লগে ন খেই খাবায় বেক্কুনর তে গুরােবােন।
তান্যাবি ধুন্ধো খায় দাবা মাদে পদোলত
মদ’রজি ভরেই থয়ে ধুব ফটিকর বদলত।
তান্যাবি পান খায় পান লগে বত্তাছাল
গাভুর লগে বাজেই ফেল্যান তান্যাবিরে মেইয়া জাল ।
তান্যাবি বেনবুনে বেনলে ব’ দলা
তান্যাবিরে ধরি নিবাক কেরেটকাবা মােনতলা।
বারমাসী মূলত: গ্রাম্য ললনার প্রণয়ঘটিত কাহিনী ভিত্তি করে রচিত। এখানে মেয়াবী বারমাসের ক’টি লাইন দেয়া হলাে।
প্রথম বৈশাখ মাস দেবায় গল্য কালা
আমারি ছাড়ি মেয়া কারে দেখ ভালা।
তুমি ছাড়িলে মেয়া আমি না ছাড়িব
রাত্রিকালে নিদ্রা গেলে স্বপনে দেখিব।
জৈষ্ঠ মাসেতে মেয়া গাছে পাকে আম
মনে কয় গলায় কলসী বাঁধি জলে দিতাম ঝাম।
ঝম্প দিয়া তেজেদুং বন্ধুহীন জীবন
তােমা বিনে মেয়া অন্ধকার এই তিন ভূবন।
আষাঢ় মাসেতে মেয়া ঝড় হইল ভারি
এমন সুন্দর দিনে তুমি মােরে কেন গেলা ছাড়ি।
কি ব্যাধিতে ধয্যা মােরে কি দিলে পুরায়
এখন শিমেই তুলার মত মন বাতাসে উড়ায়
এটি ধর্মীয় গীতিকা বিশেষ। শিবচরণ নামে একজন সাধক কবি ১১৮৪ বঙ্গাব্দে এটি রচনা করেন। তিনি কাপ্তাই উপজেলার নাড়াই পাহাড়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ধুংগিরি চাকমা এবং মাতার নাম ধর্মবি চাকমা। তারা এক সময়ে তৈনমুড়ি অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। তখন চাকমা রাজা ছিলেন সাত্তুয়া বা পাগলা রাজা ।
শিবচরণের লামাগুলি ৬টি ভাগে বিভক্ত। এই লামাগুলােতে তিনি গােজেন বা সৃষ্টিকর্তার প্রতি স্তুতি গেয়েছেন এবং নানান বর প্রর্থণা করেছেন। তিনি তার সাধনাকালের এক পর্যায়ে গৃহত্যাগ করেন এবং তার মা পুত্রের জন্য ভাত রান্না করে তা মােছা করে ছেলে যেন খেতে পায় তজ্জন্য জঙ্গলে রেখে দিতেন।
তিনি আধ্যাত্মিক সাধনাবলে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকার হয়েছিলেন। শিবচরণ এর অন্তর্ধান সম্পর্কে নানান কথা প্রচলিত রয়েছে। কেহ কেহ বলে থাকেন যে, তিনি নদীর উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন। শিবচরণের ১ম লামাটি নিম্নে উদ্ধৃত হল ।
উজানি ছড়া লামনী ধার,
নাআছিল সৃষ্টি জলৎকার ।
জল উপরে গর্য্যে স্থল,
বানেল গােজেনে জীব সকল ।
আগে সালাম বানায়ে যার জনম,
আগে সালাম দ্যং তার চরণ।
চাঁনে সূৰ্য্যে সদর ভেই,
সালাম দ্যং উদ্দেশ্যে ভূমি থেই
সম্মুখে সালাম দ্যং পুগেদি,
পশ্চিমে সালাম দ্যং পিজেদি।
উত্তরে সালাম দ্যং বাঙেদি,
দক্ষিণে সালাম দ্যং ডেনেদি।
মােরে বিধিয়ে দয়া ওক,
তিন দেব চরণত সালাম রােক।
ন বুঝে তিন দেবে সেই সকল,
সেই সকল বড় কমল, ফুলকমল।
মা স্বরস্বতী সালামত,
যােগেই দিতগােই গীতপদ।।
সালামে মানেই তাপসী,
ধর্মশীলা সন্ন্যাসী ।।
একামনে ভজঙর,
সালাম জানেলুঙ দেব সকল
পুজার গুরু মানিলুঙ,
হাজার সালাম জানেলুঙ ।
মর্ত্যপূরীত জনম মার
তার চরণে নমস্কার।
দশ মায দশ দিন দুখ পিয়্যে
জম্বু দিবত-নি জন্মেয়ে ।
পুরি চেলং চোক ভরি,
মা বাপ পারা নেই দেশভরি।
পরবােয়া বুঝে আগেরে ইঙিদে,
এযর মানেই লােক সংসারে।
মা বাপ চরণে ভূজিলে
সকল তিথ্যে ফল পেবে।
জ্ঞানী ধ্যানী সালাম দ্যং
পরবােয়া পন্ডিত ভুজিলুঙ।
সবারে সালাম মুই দিলুং
গীত সাধনাত সাধিলুঙ ।
গীত এক লামা ফুরেয়ে
বুজেলে বুঝিব মানেয়ে ।
খেলাধুলাকে চাকমা ভাষায় বলা হয় খারা। চাকমাদের নিজস্ব কিছু খেলাধুলা রয়েছে। বেশীর ভাগ খেলাধুলা বালক বালিকা, কিশাের ও যুবদের জন্য। যেমন-পল্লাপল্লি খারা, মালা খারা, ইজিবিজি, ঘিলা খারা, পত্তি খারা, ফোর খারা, গুদু খারা, বলি খারা ইত্যাদি।
চাকমারা বিজু উপলক্ষ্যে বিশেষ করে খেলাধুলায় মেতে উঠে। আগেকার দিনে এসকল খেলাধুলা আয়ােজনে গ্রাম্য মুরুব্বীরাই মুখ্য ভূমিকা পালন করতাে। চাকমাদের মধ্যে বলী খেলা বেশী জনপ্রিয়। চাকমা রূপকথায় গুঙুত্যা বলির নাম উল্লেখযােগ্য।
এছাড়া রাজা শের ধৌলত খাঁ এর আমলে ক’জাল বলি (যিনি বাঘকে বিড়ালের মতাে আছাড় দিতে পারতেন), কেশ বলি (যিনি একটা বাজ্যা বাঁশ ঝােপসহ বড়শি শীপ এর মতােন উঠানামা করাতে পারেন), গদারাম বলি( যিনি চার বেঙ্যা নৌকা দিয়ে পানি বহন করতে পারেন), রয়চান বলি (যিনি বৃদ্ধ বয়সেও ৩মণ মালামাল বহন করতে পারেন)।
গােলকচন্দ্র বলি (কান পর্যন্ত বিস্তৃত শিংওয়ালা মহিষ বিড়ালের মতাে আছড়াতে পারেন, মনীন্দ্র বলি (৪ মণ ওজনের চালের বস্তা নিয়ে সারাদিন উঠানামা করতে পারেন), চিন্তামনি বলি (১ বােনায় ২০০ বাঁশ বহন করতে পারেন), টকখলা বলি (যিনি মানুষকে ঢিলের মতাে ছুঁড়তে পারেন) উল্লেখযােগ্য। আমি নিজেও মহালছড়ি বাজারের মাঠে নবদ্বীপ বলির শিষ্যের বলি খেলা দেখেছি। তার শিষ্যটি সেই বলি খেলায় চ্যাম্পিয়ন হন।
অতীতে চাকমারা সম্পূর্ণরূপে জুমচাষের উপর নির্ভরশীল ছিল। তারা সমতল জমি চাষের চাইতে জুমচাষকে শ্রেয়তর মনে করত। সমতল জমির চাষকে তারা ঝগড়া করে ভাত খাওয়ার শামিল মনে করতাে। কেননা সমতল জমি চাষে সবসময় হাল দিতে হয় এবং এতে গরু ব্যবহার করতে হয় এবং গরুদের সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য সবসময় হেড়ে গলায় গালিগালাজ করতে হয়।
অন্যদিকে জুমচাষে এধরণের কোন প্রকার গরুর প্রয়ােজন হয় না। ফলে ঝগড়াঝাটির কোন ব্যাপার থাকে না। শুধু তাই নয়, সমতল জমি চাষে যত বর্ষা বা বৃষ্টিবাদল হয় ততই জমিতে কাজে যেতে হয় । কিন্তু জুমচাষে বৃষ্টি বাদলের দিনে জুমঘরে আরামে বসে থাকা যায়।
চাকমারা জুমচাষের বিভিন্ন ধাপসমূহকে ভিন্ন ভিন্ন নামে। চিহ্নিত করে ।
১. ফাঙ: চাকমা ভাষায় ফাঙ বাংলায় যাকে উদ্বোধন বলা যায়। জুম ফাঙ করার জন্য চাকমারা শনি ও মঙ্গলবার অগ্রাধিকার দেন। ফাঙ করার জন্য সামান্য অংশ পরিষ্কার করা হয়। সেখানে বাশ কেটে দুফালা করে ফালার মধ্যে বাশের কাটি দিয়ে চিহ্ন দেয়া হয়। অনেক সময় ফাঙ করার আগে জুম সাগা দেয়া হয়। চাকমারা ফাঙ শব্দটিকে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আমন্ত্রণের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করে।
২.জঙ্গল কাটা: ফাঙ করা জুম কাটা শুরু হয় কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাস হতে। ফাগুন মাসের শেষ পর্যন্তও জুম কাটা যায়। অতীতে বনে গাছ বেশী থাকার কারণে তাড়াতাড়ি জুম কাটতে হয়। তবে বেশীর ভাগই পৌষ-মাঘ মাসে জুম কাটা হয়।
৩.আগুন লাগানাে: শুকানাে জুমে আগুন দেয়া হয় চৈত্র মাসের মাঝামাঝি হতে। সচরাচর সন্ধ্যায় আগুন লাগানাে হয়। আগুন লাগানাের আগে জুমের চারিপার্শ্ব পরিস্কার করা হয়। যাকে ডাঙা কাজানা বলে।
৪.আরা কাজানা: পুড়ে যাওয়া গাছগুলাে পরিস্কার করাই হলাে আরা কাজানা।
৫. বাজেই মােন ঘর তৈরী: জুমে কাজ করার ফাঁকে অবসর নেবার জন্য ছােটঘর তৈরী করা হয়। সেটা হলাে বাজেই ।
৬. আনুনী কাটা: বৈশাখের প্রথম বৃষ্টিতে জুমে নানান লতা পাতা গজায় । এগুলাে পরিস্কার করাই হলাে আনুনী কাটা।
৭.বীজ খের সুলাে: আনুনী না কেটে ধান বীজ রােপণ করলে তাকে বীজ খেরত ধান বীজ (কুজো)রােপণ বলে।
৮. ধানসহ নান ধরণের বীজ রােপণ: ধান বীজ রােপণের সময় সােম ও শুক্রবার অগ্রাধিকার দেয় হয়।
৯. ধুজ মারা (যদি কোন প্রকার সমস্যা থাকে): ধুজ জুম থাকলে তা ঠিক করতে হয় । যাতে একটি পূজা দেয়া হয়। হালপালনী দিনে এটি করা হয়ে থাকে ।পূজার নাম ধুজ মারা। একজন বৈদ্য লাগে। এ সময়ে খানাপিনা হয় ।
১০. মধ্যসুলাে ও মেইডসুললা: জুমের আগাছা পরিস্কার করার এক একটি নাম।
১১. ধান কাটা ফাঙ: বুধ বা বৃহস্পতিবার ধান কাটার জন্য বেছে নেয়া হয়।এসময়ে খানাপিনা হয়। ধান কাটা ফাঙ করার সময়ে বৈদ্য লাগে। পাশাপাশি সেদিন মা লক্ষ্মীমা পূজা দেয়া হয় ।
১২. নাে ভাত খাওয়া: বয়ােজ্যেষ্ঠ আত্মীয় ও মুরুব্বীদেরকে খানাপিনার মাধ্যমে।আপ্যায়িত করে নাে ভাত খাওয়া হয়। এসময়ে কিয়ঙে বৌদ্ধ ভিক্ষুদেরও নােয়া ভাতের শিয়ঙ দেয়া হয়।
১৩. অর্থকরী ফসল সংগ্রহ: অগ্রহায়ণ মাস হতে জুমের নানান অর্থকরী ফসল সংগ্রহ করা শুরু হয়।
জুমে চাষকৃত বিভিন্ন প্রকারের ধানসমূহ নিম্নরূপ-
১. মেলে
২. গুরি
৩. কুকী মেলে
৪. বিনি
৫. কামারাও
৬. কবা বিনি
৭. তাের্গি
৮. লােবা বিনি
৯. কবরক
১০. হরিণ বিনি
১১. বাধেইয়া
১২. পাধাতটারা
১৩. লেঙদাচিগােন
১৪. আমে
১৫. গেলঙ
১৬. কালা কবরক
১৭. পাত্তেগী
১৮. লঙলঙ
জুমের অর্থকরী ফসল: জুমে নানা ধরণের অর্থকরী ফসল চাষ করা হয় । চাকমাদের জুমকে আধুনিককালের কম্পিউটারের সাথে তুলনা করা চলে। একটি কম্পিউটারের যেমন তথ্য ও যােগাযােগ প্রযুক্তি সম্পর্কিত সকল তথ্য পাওয়া যায় তেমনি জুম হতে গােটা বছরের প্রয়ােজনীয় সমস্ত প্রকারে খাদ্যদ্রব্য পাওয়া যায় । নিম্নে জুম হতে উৎপাদিত কিছু অর্থকরী ফসলের নাম দেয়া হলাে।
যেমন ১. তিল
২. পােজি
৩. দুমাের সুমি
৪. তুলা
৫. আমিলে
৬. ঢেড়শ
৭. সীম
৮. আলু- বাজতারা,এদোটেঙ, রাঙাপিলা ও ধুপপিলা
৯. রেঙ
১০. মামরা
১১. মেইয়ে শাক
১২. সিন্দিরা
১৩. ফুল- সদর ফুল
১৪. মরিচ
১৫. কচু ওল, সাম্মো, গুরি কচু, এরা কচু, মু রাঙা কচু
১৬. বেগুন
১৭. জুরাে আলু
১৮. কলা
১৯. মিষ্টি কুমড়া
২০. জেদেনা ক, মুগলি, খ. কুকী
২১. আদা
২২. মারেশ দাদি
২৩. হলুদ
২৪. সাবারাং
২৫. ভূট্টা
২৭. পেপে ইত্যাদি
রান্ন্যা: জুম হতে ধানসহ সকল প্রকার অর্থকরী ফসল সংগ্রহের পর সে জুমটি যাতে পুনরায় জুমচাষে উপযুক্ত হয়ে উঠে সেজন্য ফেলে রাখা হয়। তখন রান্যা বলে। সচরাচর ৭/৮ বছর পর এই রান্যা আবার জুমচাষেরজগযোগী উঠে।
জুমের মধ্য দিয়ে ভূমি ধস (ধংগা ভাঙা) হয়ে যদি জুমটির উপর (তুগােন) থেকে নীচে (লেজা) পর্যন্ত গড়ায় হলে জুমটি ভারবাে হয়ে যায়। তখন তা পরিত্যক্ত হয়। ভারবাে- একপ্রকার ধুজ। এতে কেউ আর সেই জুমের ফসল ঘরে তুলতে পারে না।
এক জুম ক্ষেতের পানি অন্য জুম ক্ষেতে গড়াতে পারবে না। গড়ালে ধুজ বা ভারবাে হবে।
জুম পাহাড়ের উভয় দিকে জুম থাকলে কেউ লাঙেল অতিক্রম করলে জুম ভারবাে হয় । আবার যিনি আত্মীয় সম্পর্কে বড় হবেন তার পক্ষে কোনমতে লাঙেল অতিক্রম করা যাবে না। আবার যিনি আত্মীয় সম্পর্কে ছােট তিনি সামান্য লাঙেল অতিক্রম করতে পারবেন। কিন্তু কোনমতে বড় আত্মীয়ের জুম পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারবেন না।
দুই ভাই বা বােনের জুমের মাঝখানে অন্য কেউ এমনকি বাপ মাও জুম চাষ করতে পারবে না। করলে ভারবাে হবে। ধান বীজ রােপণ করতে গেলে এক প্রজাতির ধানের মাঝখানে অন্য প্রজাতির ধানের বীজ রােপণ করা যাবে না। যেমন মেলে ধানের মাঝে বিনি ধান রােপণ করা যাবে না।
জুম কাটার সময় যদি তাগল ভেঙে দু’টুকরাে হয়ে যায় তবে সংশ্লিষ্ট জুমের মালিক তা চাষ করতে পারে না। তবে অন্যরা চাষ করতে পারে।
পরিবেশ চেতনা: চাকমারা প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রতি সর্বদা শ্রদ্ধাশীল এবং নির্বিশেষে পরিবেশ বিষয়ক প্রথা সচেতনভাবে লালন করে। নিম্নে এধরণের কয়েকটি উদাহরণ উল্লেখ করা হলাে।
১. ডাঙা কাজানা: চাকমারা জঙ্গল কেটে জুম চাষ করে। শুকানাে জুমকে আগুনে পােড়ায়। কিন্তু পার্শ্ববর্তী বন যেন পুড়ে না যায় সেজন্য জুমের চারপাশের শুকানাে বাঁশ-গাছ পরিস্কার করে পার্শ্ববর্তী বনের সাথে নিরাপদ দুরত্ব সৃষ্টি করে। এটাকে ডাঙা কাজানা বলে। এতে বন সংরক্ষণের প্রতি চাকমাদের সচেতনতা প্রকাশ পায়।
২.প্রাণী হত্যা: চাকমারা পূর্ণিমার সময়টাতে ছড়ার কাঁকড়া ও শামুক ধরে না বা খায় না। এসময়টাতে শামুকের পেটে বাচ্ছা আসে। তাই সংরক্ষণ করার মাধ্যমে ভােগ করার যে আধুনিক পরিবেশ জ্ঞান সেটা অতীত থেকে চাকমা সমাজে প্রচলিত। শুধু তাই নয়, সন্ধ্যার পর গৃহস্থের বাড়ীতে কোন অতিথি আসলে তাদের আপ্যায়নের জন্য চাকমারা গৃহপালিত পশুপাখি জবাই করে না।
৩. পানি দূষণ রােধ: চাকমারা পানিকে পবিত্র বলে মনে করে। তারা কখনাে ছড়া বা পানির উৎসে মিশে যেতে পারে এমন জায়গায় পায়খানা ও প্রসার করে না। পানিকে দূষণমুক্ত রাখতে তাদের অতীত হতে জ্ঞান ছিল ।
৪. ধুমপান: আধুনিক সময়ে ধুমপানে একধরণের ফিল্টার সিগারেটে ব্যবহার করে নিকোটিনের মাত্রা কমানাে হয়। চাকমারা অতীত কাল হতে ধুমপানের জন্য যে যন্ত্রটি ব্যবহার করে সেটি হলাে দাবা। এটি বাঁশের তৈরী। দাবার নীচের অংশে পানি থাকে। পানিতে ফিল্টার করে চাকমারা ধুমপান করে।
৫. জুমঘর তৈরী: চাকমারা জুমঘর তৈরী করার সময়ে কখনাে মাটি কাটে না ।বরং গাছ ও বাঁশের সমন্বয়ে এমন একটি ঘর তৈরী করে যা বন্যপ্রাণী থেকে নিরাপদ রাখে এবং ভূমি ধস ঘটায় না।
৬. ভাতমােজা: সদ্য প্রসূতি মায়ের স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য ভাত মােজা প্রদান চাকমা সমাজে বহুল প্রচলিত। ভাতমােজোয় সাধারণত মাছ, মাংস, শুটকি, ডিম জাতীয় শরীর বর্ধক খাদ্য এবং করলা, লাউ তথা দুগ্ধ বৃদ্ধিমূলক খাদ্য দেয়া হয়।
৭. মশা মাছি তাড়ানাে: চাকমারা মশা মাছি তাড়ানাের জন্য কৃত্রিম কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করে না। তারা সচরাচর ধানের খড়ের তৈরী বেনা ও কাপড়ের বেনা তৈরী করে ধােয়া দেয়। এতে তাদের কাজের সময়ে মশা ও মাছি কাছে ভীড়তে পারে না।
চাকমারা প্রকৃতিগতভাবে স্বাধীনচেতা। তারা কখনাে অধীনতাকে মেনে নিতে পারেনি। তাদের ভাষায় পরাধীনতার কোন শব্দ নেই। মােঘল আমল হতে চাকমাদের উপর উপনিবেশিক পরাধীনতার শৃঙ্খল এসে পড়ে। বাণিজ্য অবরােধ সৃষ্টির মাধ্যমে মােঘলরা চাকমা রাজ্যের উপর এক ধরণের উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। তাই মােঘলদের সাথে চাকমাদের যুদ্ধ সংঘাত বেধেছিল বেশ ক’ বার।
বৃটিশ আমলেও চাকমাদের বিদ্রোহ লক্ষ্যণীয় । তারা কখনাে বৃটিশদের বশ্যতা অন্তর দিয়ে মেনে নিতে পারেনি। বৃটিশরাও চাকমা রাজাকে ব্যবসাগতভাবে অবরােধ করে চাকমা রাজ্যের অর্থনীতিকে বিপর্যস্থ করে ফেলে।
অর্থনৈতিকভাবে পরাজয়ের সূত্র ধরে চাকমা রাজ্য বৃটিশ উপনিবেশে পরিণত হতে বাধ্য হয়। তবে বৃটিশ আমলে চাকমারা আভ্যন্তরীণভাবে স্বাধীন ছিলেন বলে পরবর্তীতে বিদ্রোহ হতে সরে আসে। কিন্তু কাগজে কলমে বৃটিশদের প্রতিনিধি ডিসিরাই ছিলেন সর্বেসর্বা। তারপরও বৃটিশদের সাথে তারা সম্প্রীতি নিয়ে বাস করেছিল ।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে চাকমারা যখন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠা শুরু করেন তখন থেকে তারা বুঝতে পারেন যে, সামন্ত রাজাগণের নেতৃত্বে তাদের স্বাধীনসত্বা রক্ষা করা সম্ভবপর নয়। রাজারা যে সকল অভিজাতদের দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিলেন তারাও ব্যক্তি স্বার্থ সিদ্ধিতে পরস্পরের প্রতি অনাস্থাশীল।
এমতাবস্থায় ১৯১৫ সালে রাজমােহন দেওয়ান গঠন করেন ‘চাকমা যুবক সমিতি’। এই চাকমা যুবক সমিতি গঠনের ফলে সাধারণ প্রজারা নিজ অধিকার ও চেতনা সম্পর্কে সংগঠিত ও রাজাদের দুর্বলতা সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে উঠে। ফলে সাধারণ প্রজাকুল ও রাজাদের মধ্যে জাতীয় নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্ধ হতে শুরু করে।
১৯১৬ সালে কামিনী মােহন দেওয়ান ও স্নেহ কুমার চাকমার নেতৃত্বে গঠিত হলাে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সমিতি’। এর বেশ কয়েক বছর পরে ১৯২৮ সালে ঘনশ্যাম দেওয়ান গড়ে তুললেন ‘চাকমা যুবক সংঘ’। ঘনশ্যাম দেওয়ান ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে চলে যান। তিনি সেখানে চাকমাদের মধ্যে প্রথম এমএলএ নির্বাচিত হন।
চাকমাদের রাজনৈতিক সংগ্রাম সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পেতে চাইলে পড়ুন –
পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসী হিসেবে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, বম, চাক, খিয়াং, খুমী, পাংখাে, লুসাই, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো সবারই রয়েছে নিজস্ব ভাষা। তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে বলা হয় ভিন্ন ভাষাভাষীর অঞ্চল।
অবশ্য চাকমা এবং তঞ্চঙ্গ্যা ভাষার আদি মূল এক ও অভিন্ন। সময়ের কালপ্রবাহে তঞ্চঙ্গ্যা আলাদা জাতি হিসেবে গঠিত হওয়ায় তার ভাষার দিকটিও আলাদা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
‘চাকমাদের নিজস্ব ভাষা ও সাহিত্য আছে। দু’শ বছর আগেও চাকমা লিপিতে চাকমা ভাষায় সাহিত্য রচিত হত বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। বাংলা এবং ইংরেজীতে লেখাপড়া করেন বলেন চাকমা ভাষা ও সাহিত্য তাদের জীবনে অপরিহার্য নয়।
আর এজন্যই এর প্রতি একশ্রেণীর শিক্ষিত লােকদের রয়েছে অনীহা। চাকমা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নে এখন যে উদ্যম তরুণদের মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে তা শুরু হয়েছে মাত্র দু’দশক ধরে। চাকমাদের প্রাচীন লােকসাহিত্য, গাঁথা, উপাখ্যান, পালা, উবগীত, ধাঁধাঁ, প্রবাদ ইত্যাদির সাহিত্যিক ও সামাজিক মূল্য অপরিসীম। – নন্দলাল শর্মা
‘নৃতাত্ত্বিক বিচারে চাকমারা মঙ্গোলীয়। চাকমা লিপি পূর্ব ভারতীয় খমের (KHMER) লিপি হতে উদ্ভূত। কিন্তু চাকমা ভাষা ভারতীয় আর্য ভাষার শ্রেণীভূক্ত। গবেষকদের কাছে এটা একটা রহস্যময় ব্যাপার বটে। চাকমাদের নিজস্ব লিপি কোন সময়ই বেশী প্রচলিত ছিল না।
ভাষা তত্ত্ববিদ ড. গ্ৰীয়ারসনের মতে দক্ষিণ পূর্ব এশীয় খমের লিপি থেকে চাকমা লিপির উৎপত্তি। খমের লিপি তামিল লিপি থেকে আগত বলে মনে করা হয়।
প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক তাদের লিপি কি চম্পকনগর থেকে এনেছে না বিজিত দেশ আরাকানের সাপ্রেই কুলে বসতি স্থাপন করতে গিয়ে সেখানে গ্রহণ করেছে? বর্মী লিপিও খমের লিপি থেকে আগত এবং আরাকানে বর্মী লিপি প্রচলিত।
সেই হিসাবে চাকমা লিপি খমের লিপির আরাে নিকট আত্মীয়, তার অর্থ হল চাকমা। লিপি বর্মী লিপি থেকে উদ্ভূত হয়নি। কাজেই চাকমারা এই লিপি আরাকানে এসে গ্রহণ করেননি। সরাসরি চম্পকনগর থেকেই এনেছিল। চাকমা লিপিতে লিখিত আঘরটারা (চাকমাদের ধর্মগ্রন্থ) চম্পকনগর থেকে সঙ্গে আনা হয়েছিল।
চাকমা লিপিকে রক্ষা করেছিল লুরী বা রাউলী সম্প্রদায় ‘আগরটারা’ পাঠের মাধ্যমে। এ লিপি দৈনন্দিন ব্যবহার করতেন তান্ত্রিক ও বৈদ্যরা। চাকমাদের চিকিৎসা শাস্ত্র বা তালিকশাস্ত্র চাকমা লিপিতে লিখিত। তান্ত্রিকেরা চাকমা লিপিতে তাদের মন্ত্রতন্ত্র ও দেহতত্ব সম্বন্ধে লিখে রাখতেন। সােজা কথায় চাকমা লিপি খমের লিপি থেকে উদ্ভূত কিন্তু ভাষা হলাে ভারতীয় আর্য ভাষার গােষ্টীভূক্ত।’
-ভগদত্ত খীসা- চাকমা লিপি ও ভাষা,
গিরি নিঝর, ফেব্রুয়ারী ১৯৮৭, উসাই, রাঙ্গামাটি।
বর্ণ: ‘ভাষাকে লেখার মাধ্যমে প্রকাশ ও ধরিয়া রাখার জন্য লিপির উদ্ভব। প্রাচীন ভারতের যতগুলি লিপি এ পর্যন্ত আবিস্কৃত হয়েছে তার মধ্যে ব্রাহ্মী লিপি ও খরােষ্টী লিপির নাম উল্লেখযােগ্য। খরােষ্ঠী লিপি ফার্সির ন্যায় ডানদিক হতে বাম দিকে লিখতে হয়।
খৃষ্টপূর্ব ৩০০ সাল পর্যন্ত গান্ধার নামক অঞ্চলে ব্রাক্ষ্মী বর্ণমালা প্রচলিত ছিল। গুপ্ত রাজাদের সময় হতে এ লিপির কোন কোন বর্ণের আকৃতিতে রূপান্তর দেখা দেয় এবং খৃষ্টীয় ৬ষ্ট শতকের শেষভাগে এসে আঞ্চলিক ভিত্তিতে বিভিন্ন রূপে রূপান্তরিত হতে থাকে। চাকমারা তাদের ভাষা লিপিবদ্ধ করার জন্য ব্রাক্ষ্মী লিপির অনুকরণে বর্ণমালা গ্রহণ করেছিল।
-বঙ্কিম চন্দ্র চাকমা
চাকমা সমাজ ও সংস্কৃতি, পৃ: ৬১-৬৩
বর্ণের সাথে সম্পর্ক হলাে উচ্চারণের। চাকমা ভাষার বিকাশে ধ্বনিতত্বের মাধ্যমে গবেষণার প্রয়ােজন থাকলেও তা আজো পরিলক্ষিত হচ্ছে না। চাকমারা যা উচ্চারণ করে তা বাংলার মতাে নয়।
ইদানীংকালে দেখা যাচ্ছে যে, বেশীরভাগই বাংলা ধাচে উচ্চারণ করছে এবং নিজস্বতা হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের দোষে। চাকমাতে অল্পপ্রাণ ও মহাপ্রাণ বর্ণগুলাের মধ্যে উচ্চারণের ক্ষেত্রে পার্থক্য খুব কম। যেমন জগদাৎ তা ও ঘঙদাত থা এর মধ্যে পার্থক্য খুব কম। আরাে উদাহারণ –
দাবা-ধাবা, তাল-থাল, জাল-ঝাল, আজা-আঝা, কাদি-খাদি, জার-ঝার ইত্যাদি। তাই দেখা যাচ্ছে যে, চাকমা কা বর্ণটি বাংলার মতাে কা নয়। বরং এটি কা ও হা এর মধ্যবর্তী একটা উচ্চারণের রূপ।
চাকমা ভাষায় বর্ণমালার সংখ্যা হলাে ৩৩টি। তার মধ্যে স্বরবর্ণ ১টি এবং ব্যঞ্জনবর্ণ ৩২টি। চাকমা বর্ণমালাগুলাে আ-কার যুক্ত। এটি একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচিত। এ সূত্রে আ (পিছপুজা আ) বর্ণটিকে মৌলিক বা স্বরবর্ণ বলা যায় । চাকমা বর্ণগুলাের প্রত্যেকটির নাম রয়েছে। এই নামকরণের সাথে তাদের। আকৃতির একটা যােগসূত্র রয়েছে। তবে কালের গতিতে এসকল বর্ণমালা নানান বিকৃতির শিকার হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
এটা অত্যন্ত গর্বের বিষয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা জাতির নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে। যে বর্ণগুলাে সাজিয়ে ভাষার রূপটাতে বা মনের ভাবকে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করা যায়। কৃষ্টচন্দ্র দেওয়ান কর্তৃক মি. গ্ৰীয়ারসনকে প্রেরিত প্রথম চাকমা বর্ণমালা ১৯০৩ সালে লিংগুস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া গ্রন্থে প্রকাশিত হয়।
এছাড়া সতীশ ঘােষের চাকমা জাতি বইয়েও চাকমা বর্ণ দেখা যায়। এ ব্যাপারে দীর্ঘ সময় পরে বাবু নােয়ারাম চাকমা প্রথম ১৯৫৯ সালে এ বর্ণগুলাের সংকলন লিখিতাকারে প্রকাশ করেন। তার বইয়ে ৩৯ টি বর্ণ রয়েছে। ১৯৬৯ সালে বাবু বিরাজ মােহন দেওয়ান ‘চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত’ বইয়ে চাকমা বর্ণমালা প্রকাশ করেন।
ভারতের মিজোরাম রাজ্যের চাকমা অটোমাস ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলে চাকমা বর্ণমালার মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ে পাঠদানের ব্যবস্থা রয়েছে। জাপানে বিভিন্ন বর্ণমালার উপর যে গবেষণা হয়েছে তাতে চাকমা বর্ণমালাও স্থান পেয়েছে।
তবে এসকল বইয়ে বর্ণের নাম ও আকারে বা গঠনে হেরফের লক্ষ্যণীয়। অনেকে মনে করেন বর্ণ হলাে ৩৩ টি। কেহ কেহ ৩৬ টি বর্ণ রয়েছে বলে মনে করেন । বিভিন্ন জন তথা সচেতন মহল এ ব্যাপারে এগিয়ে এসে সমন্বিত উদ্যোগ বা পাঠোপযােগী উদ্যোগ না নেওয়ায় এসকল বর্ণমালার সর্বজন গ্রহণযােগ্য রূপ অর্জন করা সম্ভবপর হয়নি। ফলে চাকমা বর্ণমালা শেখার জন্য তেমন জোরালাে উদ্যোগ চোখে পড়ার মতাে ছিল না।
পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের চাকমাদের নিজস্ব ভাষার বর্ণমালা থাকলেও এগুলাে ব্যবহারের বাস্তব উদ্যোগ না থাকায় এসকল বর্ণ নানান বিকৃতির শিকার হয়েছে বলে ধরে নেয়া যায়। বিশেষ করে সরকারী পৃষ্টপােষকতা ও সুশীল সমাজের উদ্যোগ না থাকায় এতদিন ধরে এসকল বিকৃতি ও ক্রটি লালিত পালিত হয়ে আসছিল। অথচ এগুলাে শুধরে নেয়াটা ছিল জরুরী।
আশার কথা যে, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পর হতে বেসরকারী সংস্থা বা এনজিও পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপকভাবে গড়ে উঠে। এদের মধ্যে অনেকে ভাষা ও সংস্কৃতির উন্নয়নে ভূমিকা রেখে চলেছে। তারই ধারাবাহিকতায় বিগত ২০০০ সালের ৫ অক্টোবর তারিখে নুঅ পহর, টংগ্যা ও তৃণমূল নামক তিনটি এনজিও যৌথ উদ্যোগে একটি কর্মশালা আয়ােজন করে।
যার মূল লক্ষ্য ছিল চাকমা বর্ণমালাগুলাের অসঙ্গতি চিহ্নিত করা এবং ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে বর্ণগুলাের নাম ও আকার বা কাঠামাে ঠিক করা। সৌভাগ্যের বিষয় যে, সেখানে চাকমা রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায় উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের প্রতিনিধি হিসেবে বাবু স্নেহ কুমার চাকমা।
চাকমা ভাষার বর্ণমালা, বানান রীতি, শব্দ ও বাক্য গঠন, ব্যকরণ, বাগধারা ইত্যাদি সম্পর্কে আরও বিস্তারতি জানতে চাইলে পড়ুন –
বানাকে বাংলায় ধাঁধাঁ বলে। বানা একধরণের বুদ্ধি চর্চা ও কিশাের কিশােরীদের খেলার মতােন। চাকমারা ছােটবেলায় বানা দিয়ে এক অপরকে বােকা বানানাের চেষ্টা করে। তবে মনে করা হয় যে, যারা বানা ধরাধরি করে তাদের মধ্যে দুরত্ব বা পরস্পর বিচ্ছিন্নতা সৃষ্ট হয়। তাই বুড়ােবুড়িরা অনেক সময় বানা ধরাধনি খেয়াল করলে তা না করার জন্য নিষেধ করে থাকে। নিম্নে এধরণের কয়েকটি বানা দেয়া হলাে।
১. ভগ গরি পড়ে চুপ গরি থায়, যে ভাঙি ন’ পারে তে বেক্কান খায়।
২. খাইদে গুলোত্তুন বুদু নেই।
৩. সাত গাঙ সাজুরি বাঘকো এযের হা গরি।
৪. গাজ’ উগুরে বাঙাল দেই।
৫. হারেলে থােগায়, পেলে ন’ আনে।
৬. তারা দ্বিবাপ পুত, তারা দ্বিবাপ পুত, তিননাে নারিকুল জনে জনে ভাগ গরি দো।
৭. বুজ্যে ন মণ, বুড়ি ন মণ, তারা দ্বিবে পাে মিলে ন মণ, তারা নগানত্ সরে দে ন মণ। তারারে এ পাড়তুন ঐ পাড়ত কেনে নেযেবে?
৮. বাঘকো, পান বিড়া আ ছাগললুরে এ কুলত ও কুলত পাড় গর। তবে নগানত একসমারে বানা দ্বিজন সরন। শর্ত অল দে, বাঘ্যে ন থেলে ছাগল্যে পান বিড়াবু খাই। আবার পান বিড়াবু ন থেলে বাঘ্যে ছাগললু খায়।
৯. চাল আগে তলা নেই, পজা থােবার জাগা নেই । জিনিসসান কি চেই?
১০. এক হাত গাচ্ছ, গুলাে ধচ্ছেন পাচছাে ।
১১. খেলে এক কুরুম, ন খেলে এক কুরুম।
১২. চাল উগুরে বড় বেনা, যে ভাঙি ন পারে তে বর হেনা।
১৩. চিগােন বুজ্যা, দাড়ি হরহুজ্যো।
১৪. গাজ উগুরে দই থবা
১৫. ঝার চিরি চিরি সাপ যায়।
চাকমারা বিশেষ করে যারা কাজ কর্ম কম করে হেলায় সময় কাটায় তারা না ধরণের গব দিয়ে সময় কাটায়। বর্বুয়া গােজার দীর্বচান নামে গব মারায় দল একজন লােক ছিলেন বলে জানা যায়। গল্পের আকারে তিনি এ সকল গব মারতেন। চাকমারা সচরাচর মিষ্টি কুমড়ার তরকারী কতটুকু ভাল তা পরিমাপ করে তরকারীর আঁঠালাে হবার দিকটা নিয়ে। নিম্নে তার এ ধরণের একটি গব তুলে ধরা হলাে-
শীতের সময়ে আমি পাহাড়ে জুম কাটছিলাম। প্রতিদিন দেখতাম যে, সেখানে দুটো বুনাে মােরগ ঝগড়া করছে। জুম কাটা শেষ করে চৈত্রের একদিন আমি জুমে আগুন দেবার জন্য গেলাম। কিন্তু দেখলাম যে, ঐ মােরগ দুটির হাড়গােড় তখনাে লড়াই করছে। তাদের লড়াইয়ের এক পর্যায়ে আমার জুমটা পুড়ে গেল।
ঐ জুমে একটা মিষ্টি কুমড়ার শাক গজালাে। অনেকগুলাে পাকা মিষ্টি কুমড়া পাওয়া গেল। তরকারী না থাকায় একদিন মিষ্টি কুমড়া তরকারী রান্না করার চিন্তা করলাম। দেখলাম যে কোন প্রকার মিশেল নাই। তাই গ্রামের ৭/৮ জন সুঠাম দেহের যুবককে নিয়ে ঝর্ণায় শামুক সংগ্রহে বের হলাম। একটি শামুক পেলাম।
শামুকটি ৭/৮ জন যুবকে মিলে কোনমতে বাড়ীতে আনতেই কাহিল হয়ে পড়লাম। এরপর শামুক মিশিয়ে মিষ্টি কুমড়া রান্না শুরু হলাে। রান্না যতই শেষ হয়ে আসছিল ততই সুগন্ধি চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগলাে। পাড়ার লােকেরা সবাই শামুক মিশানাে মিষ্টি কুমড়া তরকারী খেতে ছুটে আসলাে।
তরকারীটা ঘাটতে গিয়ে কাদিটা হঠাৎ তরকারীতে আটকে গেল । গ্রামের সব যুবকরা ঘরের টুলিতে কল টেনে মিষ্টি কুমড়ার তরকারী হতে কাদিটা তুলে আনা হলাে। এবার তরকারী কেমন হয়েছে তা ছেকে দেখার পালা। এক এক করে সবাই ছেকে দেখা আরম্ভ করলাে।
কিন্তু দেখলাম যে, মিষ্টি কুমড়া তরকারী কেমন আঁঠালাে হয়েছে জিজ্ঞেস করলে সবাই বােবা হয়ে ইশারা করছে। তারপর আমি খাঁটি সর্ষে তৈল মুখের ভিতর লাগিয়ে মিষ্টি কুমড়া তরকারিটা ছেকে দেখলাম।। তারপর উপস্থিত সবাইয়ের দিকে মুখটা কোন মতে হা করে বলতে থাকে আঁঠা, আঁঠা। মগদা অয় সঙ আঁঠা।
গব’ তুরুক অর্থ হলাে একটা গবের উপরে আরেকটি গব দিয়ে পূর্বের গবটাকে হেয় প্রতিপন্ন করা। নিম্নে এ ধরণের একটি গব তুরুক উল্লেখ করা হলাে।
নান্যাচর’ বােদত কেবিনত গরি ইক্কু দাঁড়িওয়ালা বাঙালে বেক্কুনে শুনুন পারা গরি আরব গব্ মারের। গব্ মাত্তে মাত্তে এক পর্যায়ে কয়দে আরব যেনেই দেক্কুংগে ইক্কু বিরেট বিগুন। মানুষসুনে পুজোর গরিলাক কম্বা?
নান্যাচর বিললাে দেগেনেই কয়দে- ইত্তুন কম ন’ অব। সিয়দ এলদে ইক্কু টেঙ্যো পিন্ন্যে চাঙমা। তে কয়দে- মুই ইক্কু মাধত দেক্কোঙগে শত শত মানুষ এলুমিনিয়ামমােই টুঙটাঙ গত্তন্দে। কেবিন মানুসসুনে কনদে- শত শত মানুষ টুঙটাঙ কেত্তেই গত্তন্দে? পিলে বানাদন্ধে। পিলে? এম্বা পিলে কি গরিবাক?- বাঙাল্যা পুঝার গরিল? তরতাঙুরি টেঙ্যো পিন্ন্যো চাঙমায়ে কয়দে ত বিগুননাে রানিবাক্কে।
তারা গবআনি শুনি আর এলাক্কে মানুসসুনে তুদি থেই ন পারিলাক। ইকু বুড়াে চাঙমায় কয়দে- মুই দেলুঙগে ইক্কু সিগুন গুড়াে। তিন কুড়ি বজর অয়ে। এজ’ তা মা দুধ ন খায় । টেঙ্যো কানি পিন্ন্যো চাঙমায়ে কয়দে
কিয়া? ত বিগুন তােনান খেবাত্তে।
কোণা চেরেত্তুন আরেকু চাঙমা মাধি উধিল। তে কয়দে-
মুই দেলুঙগে চিবিট গাজত টাঙেয়ে এক্কান বিরেট কেরঙযু ধুলােন। ধুলােনানত এয’ কোনগুরােই ন’ দুলােন।
কিয়ে?- বেক্কুনে মাধি উদিলাক। তােমা তিন কুড়ি বজর’ গুরাের বিগুন তােন খেই খেই দুলিবাত্তে।
(১)
রাঙামাত্যা গাড়ী চলে আর চলে টেক্টার
রামানন্দ গম ভাত খাইদে আর দেদে লেক্চার ।।
কয়দে শাগত কয়দে নেই
রামানন্দর বাজার যেবার পয়জে নেই।-সংগ্রহ
(২)
ইজি বিজি দুধ কাজি
এইদ চড়ে মােজ চড়ে
গাভুর ভেইয়ে শিঙৎ ধরে
তা লগে ক্য ন পারে।
উদো উদো ভায়ারে
রাজকন্যা নেয়ায় রে
ধরে কন্না বিজুরাম
ফালল্যে উত্তে মনুরাম
একলতা তেলকাত
রাজাবুয়াই কয়েদে
চুর’ হাত্তান কাবি নেযাঙ। -সংগ্রহ
(৩)
দারু নেই ধর্ম নেই
গৌরাঙ্গ ডাক্তর।
টেঙা নেই পয়জে নেই
মহররম সওদাগর।
মান নেই সম্মান নেই।
ওয়ালী মাতবর। -সংগৃহীত(পাকিস্তান আমলে এটি বেশ প্রচলিত ছিল।)
(৪)
হাদত্ লােয়ে বাদোল বা,
কুজ্জোত লয়ে গুলী
লক্ষী চিজি ঘুমান যায়
সােনার ধুলােনত পড়ি।
(৫)
নাক্সা গাজর রিবাং যু
ধুলােন বুনি কেরেঙ যু
কেরেঙ যু ধুলােনত কেরেদচাগ
ওয়াঙ ডগত্তন চিজি
চুব গরি থাক।
(৬)
বেঙ ডগত্তন করক করক
বাজ্যে ডুবােত তলে
সােনার চিজিরে
বাে আনি দিবােঙ
চুলে ঢঙরে।
(৭)
ওলি ওলি ওলি
বাজকপাদা জলি
সােনার চিজি
ঘুমান যায়
ধুলােনানত পড়ি।। -সংগৃহীত
রচনা- নধন চাকমা
সুর- রঞ্জিত দেওয়ান
রচনাকাল- ১৯৭০, রাঙ্গামাটি
হিল্লমিলেবু জুমত্ যায়দে,
কাল্লোঙ পিদত্ তাগল হাদত্
জুমত্ যায় দে (২)।।
যাদে যাদে পধত্তুন পিচ্ছে ফিরি সায়্
সােয্যা ফুলুন দেগি খেদত বুক্কুয়া তার জুড়ায়।
মনত্ সুখ লােইনে তে উরি উরি হাদেদে
জুমত যায় দে।।
নুয়াে জুম ধান কদাত, পিবির পিবির বুইয়্যার বায়্
চিগােন পেক্কুন ঘুত্যাত বােইনে ধান পাগানা হান্
হিল্লমিলেবু বাদো মারি চিগােন পেকুন ধাবায়্ ।
বেলান গেলে সাজন্য হ্লে ঘরত্ ফিরেদে।
জুম যায় দে।।
রচনা ও সুর- অমর শান্তি চাকমা
উত্তন পেগে মেঘে মেঘে মেঘুলাে দেবাত্ তলে
মর্ পরানান যেদ মাঘে তারা লগে লগে।।
উত্তন পেগে মেঘে মেঘে
চেরােকিত্যা নানান পেগে উরি উরি গীত গাদন্
সে গীদেন্দি মন ভুলেইনেই ফুল ফুদি যাদন্ ॥
গেদুং চাঙ্গে গেই ন’ পারং তারা ডগে ডগে
মর্ পরানান যেদ’ মাঘে তারা লগে লগে।।
এই দেযর মুরােয় মুরােয় গাজ’ বাজ’ তারুমবন্
সাল সিলেইয়্যা ধক্ক্যা গােরি সাদে লাগে গম।
যারত্ সােমেই এগা মনে গায় গায় গােরি বেরেলে
মর্ পরানান যেদ’ মাঘে তারা লগে লগে।।।
–উৎস: শিঙগা, ১৯৭৪
বার্গী
-সুহৃদ চাকমা
কাদিমায ফুত্যে সুদোহলার জুমতুগুনােত জুনােপহর ফুদিলে
একঝাক সনারঙ মেদোনী-বার্গী যান
মেঘ সেরে কুওর খবং মুগুচ্যে মােন’ সান স্ববনত।
সােজরঙ সাজুরি সনারঙ বার্গীজাঙাল জুনােপহরে ভিজে মােন
জিংকানির ঘর-গিরিত্তি-পােচপানা-লুভ-ধাব-আওঝ
কৃষ্ণাগাভুরীর ভরনভিরােন বুগ সান।
মথুরার মেদোনী-বার্গীপাল সােজমেঘ সাজুরি উরি যায়
জুনােপহরে ভিজে মােন হারেযেয়্যে সুরনত কৃষ্ণার বুগ ভাজি থায়।
উৎস: বার্গী, ১৯৮৭
ধনপুদি
তনয় দেওয়ান
মিধে মিধে তিদে তিদে
কধা ঝরের গীদে গীদে
ঝুরি লামনি পানি লামের
হাঝের হাঝের নাজের নাজের
কুজি কুজি বােয়েরত আহধি আহধি যর ঘরত,
মােন লেজা ছড়া পাড়ত
য়েল ছিদেইয়্যে জুম চাবত।
চিগােন চিগােন বেত দিনেই লেই জু কাল্লোঙ বুগি
আঝার খাঙ খাঙ চাধারাত
আহ্দর তুই নুদি নুদি।
ব’ নিজেচর সমারে উজুকচুক বুক উদে পড়ে
সােজ পিনােন রাঙা খাদি
নাঙান কি তর ধনপুদি?
এধাহ্ পোয়
মৃত্তিকা চাকমা
সে দিন্ন এক্কান মাজাঙ ঘরত উদিবের চেয়ঙ
মাত্তর সাঙু এল’ চের কম কুরি কোইদ্যা।
তারপর মন পাদা সার গােচছ্যঙ উধিবের
খালিক উধনা আর ন’ অল’
বাগী চেরােত হুসদি
বিজিদি যেই মুই ইক্কু দুলুগ মুওত
লােহই কোরবাে, মুই লেঙ, মুই আদুর।
অয়ধ’ তােমা সিদু কদ’ খেব বাইনী গােস্যঙ,
গর্ব গােস্যঙ, উধি পারিম, উধি পারিম ভিলিনে
খালিক মুই ইক্কু সেদাম উক্ক জীব।
মরা তুমি এধা পােই ঝাবেই দুও বানা এধা পোই ।
তারপর সিউন্নই পেদ জুরেই মন জুরেই
দিন, মাঝ, বঝর আর যুগ যুগ কাদেই যেম
সেনত্যা মরে তুমি এধা পপাই ঝাবেই দুও।
উৎস: মন পরানী, ২০০২
ঘিন
তনয় দেওয়ান
চাদরে বেঙে ঘিনেই
বেঙে ঘিনেই চাদরে।
কবারে কবাই ঘিনেই।
কন্না ন’ ঘিনেই দালালরে?
(শুনিয়েলক, শুনদে শুনদে ই পুরে পেবা ।)
ভালক বজরর আগ’ কধা। এক্কান জাগাত এল ইক্কু হচ্ছে বেঙ আর ইক্কু সুদুতটুবি। (ছােট পাখী)। তারা দ্বি জনে পরানে পরান সমাজ্যা। কাররে কেহই ফেলেনেই ন’ খান। তারা দ্বি-জনে সাজন্যা অলে গব মারি মারি থান। কিন্তু ঝার কাল এলে দ্বিজনর আর দেগা ন অয়।
ঝার কাল যেই যায় ভালক দিন পর তারার দেঘা অল। সুদুতটুবিবু হচ্ছাে বেঙয়ােরে কয়দে- বন, এদক দিন কুদু যেয়ােচ?
কলকাতাদ যেয়ােঙগে। – হচ্ছো বেঙয়ােই উত্তর দিল।
তে কি খবর পেলে?’
হচ্ছে বেঙয়াে কয়দে- খবর পেলুংগে-
বিরেট বরব’ অব। একগাজ বাগল আরেক গাজত যেব । বুড়াে মিলের দুধ সিনি যেব । বুড়াে মদ্দর য়ুল সিনি যেব । হচ্ছো বেঙয়ুত্তুন এ খবরান শুনি সুদুতটুবিবুর বুগত ডর সমিল । হচ্ছো বেঙয়াে কয়দে- মুই গাদত সমি থেইম। তুই কুদু থেবে? একথা শুনি বেজ সুদুতটুবিবোর পরানার ডুগুত ডুগুত গরা ধরিল।
একদিন্যা আকাজ কালা য়ােই এল। সুদুতটুবিবাে মনে মনে ভাবেদে- অয়, বিরেট বরব অব। তে কি গরিবু উদিজ গরি ন পারের। চায়দে ইক্কু রঙঢ়াঙ বিরেট হা গরি উই পুগ খার। ইন্দি সুদুতটুবিবােই ডরে রঙঢ়াঙ’র হাবুদি সমি পেদ ভিদিরে গেল।
কিন্তু সুয়ােদ’ও তার বুগ ন টোরিল । সিত্তুন আর পুনেদি নিগিলি গেল। ইঙিরি তে কুদু থিদ অব চিদে গরা ধল্ল । এনে গত্তে গত্তে তে রঙঢ়াঙয়ুর মুওদি সমি পুনেদি নিগিলে ধরিল । এনে রঙঢ়াঙয়ু পীড়ে পেনেই রঙঢ়াঙ গরি ডগরি উদিল ।।
সেক্কেনে গাজ ঢেলাত বজিনেই ইক্কু বান্দরে শুগুরিগুলােবু খার। আদিক্যে গরি রঙঢ়াঙর এম্বা র শুনি তে উগুরি উদিল । আ বুরুৎ গরি শুগুরিগুলােবু তা মুঅতুন তলেদি ঝরি পল্ল। সে লক্কে তলেদি এলদে ইক্কু হ্রিঙ। শুগুরিগুলােবু পলগি তা কাঙেললােত। তে হ্রিঙ অলাক্কে যদেপদে পাধারা। নিজে পাদিলেও তারা উগিরে উদন।
এম্বা শুগরিগুলাে কাঙেলত পােরিনেই তে ডরে অং অং গরি ডগিরি ডগিরি উদিজ বুদিজ নেই গরি ধাবা দিয়ে ধরিল। এন গরি তে ধাবা দি ধরিল হক্কে ইক্কু আজব সাপ’ কাঙেলত উরি যেয়ে তেও খবর ন পাই। ইন্দি ডাবা দিয়ে হরিওর হুজ পরিনেই আজব সাপপাের হাঙেলত ঘা অল। তাত্তুন উদি গেল পুজতেরি। তে এবার কি গরিবাে খবর ন’ পার । হরিঙয়ু কুদু যেয়ে তারেদ লাগত ন’ পেব । কিন্তু রাগকান কা কিয়েত ঝারিব তে কোই ন’ পারের।
এক্কানা রাগ পাদল অদেগি আজব সাপপাে চায়দে ইক্কু পুর অধক দেগে। তে ভাবেদে এ জু পারা জু নেই। এনে রাগে মরঙর, মগদা, পুর’ ছগুন খেই দিম্বে । যে কদা সে কাম । বেক পুরাে ছগুন তে গিলি খেল ।
কদকক্ষণ পরে ছরমা পুরােবু ছরি চারাই তা অদকুত করক কারাক গরি তা ছগুন ডাগি ডাগি এল । চাইদে জুর । র’ স’ নেই । তেপ তেপ লাে পড়ি আঘে। ইক্কু সও নেই। তে বুজিলদে আজব সাপ্পোই তা ছ’গুন তে নেইদে পিজে খেই দেঘােই। নিজ স’ অন্য জনে খেই দিলে কার রাগ না উদে? এবার তাত্তুন উদিল রাগ । তেও কি গরিবাে রাগে কোই ন পারের । এনে মুওত ইক্কু পিগিরে বা’ পল । রাগে তাগে তে পিগিরেয়ুনর বেগ বদায়ুন খেই দিল ।
পিগিরেয়ুনে বা’বুত ফিরিনেই চানদে ইক্কু বদাও নেই। এক্কান দিয়েন পুরাে ফোর পড়ি আঘে । এবার তারাত্নন উদিল রাগ। রাগ উদিলেও পুরােপুরে দ’ কিছু গরিবার নেই। তারা রাগে তাগে কি গরিবাক দুনিয়া আন্ধার দেঘা ধরিলাক।
ইন্ধি সাজ্যা শুগুরবু অলর গরি নাক ডগেরে ডগেরে ঘুম যার। এবার পিগিরেয়ুনে ভাবিলাককে- জু পেয়েই। সাজ্যা শুগুরও বিজেগুলােবু কামেড়ে দিনেই রাগ জুড়ে বঙগে। বেক পিগিরেয়ুনে যে যিন্দি পারে সিন্দি সাজ্যা শুগুর’ও বিজেগুলােবু কামেড়ে দিলাক। সাজ্যা শুগুর’ও বিজে গুলিবু দাম দাম য়েই গেল ফুলি।
অল যদে পদে পীড়ে। এবার তাত্তুনও উদিল রাগ। পিগিরেয়ুনরে কুদু সুগ পেব? রাগে তে রাণী মিলেবাে পাগান জুম ধানুন খেই দি ধরিলােগােই। ইন্দি রাণী মিলেবু চাহদে সাজ্যা সুগুরজ্জ্যে তা জুম ধানুন খেই দের। তারে ধাবেবাত্যে বিলে মুগের লনেই ঘুত্যাবুত মুগুরাে ধরিল। সাজ্য শুগুরবুরে ধাবেদ যেনেই তে যদে পদে ঘুত্যাবুরে মুগুরেল।
ইন্দি ঘুত্যাবুর গােদা কিয়েয়ান পীড়ে অল। এবার তার কিছু গরিবার নেই। গেল তে রাজা ইদু। গরিল নালিজ। রাজা হুকুম দিল- য, রাণী মিলিবুরে ধরি আনগােই।। রাজা সৈন্যয়ুনে রাণী মিলিবুরে ধরি আনি লাক্কোই। রাজা এবার তারে কয়দে-
তুই কিত্তেই ঘুত্যাবুরে মুগুরেয়ােজ?
রাণী মিলেবু কয়দে- মুই অলুঙগে রাণী মিলে। কারল্লোই হােল ন’ গরঙ। কিন্তু সাজ্যা শুগুরবু ম’ পাগানা জুম ধানুন খেই দের কিনেই তারে ধাবেবাত্তেই ঘুত্যাবুরে মুগুরেয়ােঙ। রাজা কলদে- অ, সালেদ রাণী মিলেবুর ধুজ নেই। ধুজ অলদে সাজ্যা শুগুরবুর। তে কিত্তেই রাণী মিলেবু পাগানা ধানুন খেই দেঘােই? এবার তারে ধরি আন। সাজ্যা শুগুরবুরে হাদে ঠেঙে বানি রাজবাড়ীত ধরি আনিলাক। এবার সাজ্যা শুগুরবাে কয়দে- মুই মন দুগে, রাগে রাণী মিলেবু ধানুন খেই দোংগে ।
রাজা ম বিজিগুলােবু পিগিরেয়ুনে গােদা কামেড়ে দোন। রাজা বুঝিলদে ধুজসান সাজ্যা শুগুরবুর নয়। এবার তে হুকুম দিল- পিগিরেয়ুনরে ধরি আন।। সুর গরি পিগিরিয়ুনে রাজদরবারত হাজির অলাক। এবার তারা সাজ্যা শুগুরবুর বিজেগুলাে কামেড়ে দিবার কারণ ফগদাঙ গরিলাক। রাজাও ভাবিলদে ছরমা কুরােপুরে বিজের ন গজ্জে বাদে বিচার গরিলে ঠিক অদ নয়। হুকম অল- ছরমা কুরােপুরে ধরি আনা য়োক।
সুদোমু গরি ছরমা কুরােবু রাজদরবারত এল। ডরে ডরে কল- তা ছ’গুন আজব সাপ্পো খেই দিঘোই। আ কল কিত্তেই পিগিরে বদাগুন খেই দেঘােই।
রাজা বুজিলদে ধুজসান ছরমা কুরােবুর নয়। এবার তে কলদে আজব সাপপােরে ধরি আনা য়োক। হাঙেল পীড়ে গরিনেই সাপপাে রাজ দরবারত হাজির অলগি । সেক্কেও তা ঘা আন ন শুগোই। এবার তে কল- কিত্তেই তে কুরাে ছ’গুন খেই দেঘােই সে কধানি।
রাজা ভাবিলদে- হরিঙয়ু যদি সাপপাে হাঙেললু ন’ উরিদ সালে তে কুরাে ছ’গুন খেই ন দিলুন। ধুজসান অলদে হরিঙয়র। তারে ধরি আন। হ্রিঙুয়ু ইন্দি ডরে মরিবার আজের নেই। তে রাজবাড়ীত এনেই কয়েকবার মুজ্জো গেল। রাজবৈদ্যয়ুনে পানি ঢালি দিনেই তার উজ ফিরি আনিলাক।
উজ এনেই হরিঙয়ু কলদে- ইক্কু বান্দরে ম’ কাঙেললুত সুগুরিগুলাে ফেলে দিনেই ডরে মুই ধাবা দোঙ। হক্কে আজব সাপপাে কাঙেললাে উরি দোঙ মুই কোই ন পারঙ। রাজা এবার কল বান্দরবুরে ধরি আন। বান্দজ্যা অন্য সময় ধেঙ গরিলেও রাজা ডাকক্যে শুনিনেই সুদোমু গরি রাজবাড়ীত এল।
এবার তে কল তে কিত্তেই সুগুরিগুলােবু ফেলে দিয়ে । তে কয়দে- এম্বা মিধে সুগুরিগুলাে ন খেনেই কন্না ফেলে দে? রঙঢ়াঙ র’ শুনি ডরে সুগুরিগুলােবু ফেলে দোঙগে । এবার হুকুম অল- রঙঢ়াঙ পেক্কোরে ধরি আন। বড় দো মেলি রঙঢ়াঙ পেক্কো রাজদরবারত হাজির অল।
এবার তে কল তা কধা ঢেবা কালা মায় মুই অলর গরি গাজত বােইনে উই পুক খাঙর। ইন্দি ইক্কু সুদুতটুবি ম মােওদি সমে পুনেদি নিগিলে আ পুনেদি সমি মােওদি নিগিলি যায় । তা কধা আন শুনি বেঙ্কুনে হাজি উদিলাক । তে কয়দে- তুমি হাজত্তনে! সেক্কেনে মুই পীড়ে পেনেদে রঙঢ়াঙ’ গরি ডগরি উঠ্যোঙগে । তা র’বু শুনি রাজাও উগুরি উদিল ।।
রাজা বুজিলদে- অই, সেনত্ত্যেই বান্দজ্যা উগুরি উত্যাদে। তে হুকুম দিল। সুদুতটুবিবােরে ধরি আন।
এবার সুদুতটুবিবু রাজদরবারত এল । রাজদরবারত এনেই ইদুক্কু পশুপক্ষী দেগিনেই তে আমক অল। রাজা প্রশ্ন গরিনেই তে কল মুই সুদুতটুবি । ম’ সমাজ্যে হচ্ছো বেঙয়াে কয়েদে বিরেট বরব অব। তে দ’ গাদ সেরে থেই পারিবাে । মুই কুদু থেম? ডরে মুই লুগে থেবাত্তে রঙঢ়াঙ পেধত সমমােঙগােই ।
রাজা এবার হুকম দিল হচ্ছােবেঙয়ুরে ধরি আন। সৈন্যয়নে হচ্ছােবেঙয়রে ধরি আনি লাক। বেক্কুনো ইধু পরিস্কার অলদে হচ্ছো বেঙয়াের মিঝে কধার কারনে তারার এই দুর্গতি। রাজা এবার শাস্তির বিধান গরিলাে । রাজা কলদে- রাজবাড়ীর কাত্তোল গাচছােত বানি হচ্ছো বেঙয়ুরে পীদোগােই। যে হুকুম সে দক্যা শাস্তি দিয়ে অল ।।
সিঙুন ধরি হচ্ছো বেঙয়ু চামান কাত্তোল গাছ দক চিদিরে অল আর তা লাে আন কাত্তোল গাছ খীর দক ধুব অল।। ম’ পজ্জনান অল থুম, শুনিয়েলক য’ ঘুম।
এক্কান ডাঙর ঘরত ভাল্লুকু উন্দুর থেদাক। তারা সিয়দ বানা দজে দজে থেদা্ক। ঘর গিরোসসোর সেনত্যায় যদপদে পূজতােরী উদিদ আ সেনত্যায় তে তস্যাত্তুন বাজিবার বুদ্ধি গরিল। তে উন্দুর মারিবাজত্যে ইক্কু বিলেই কিনি আনিল । বিলেইবু এনেই ইন্দি উন্দুরয়ুনে বিরেত পেজালত পােলাক। তারা আর আগ দক গরি গমে দালে বেরে সেরে ন পাত্তন । এ পইদ্যানে তারা ইক্কু তেম্মাঙত বজি সুলুগ গরা ধরিলাক।
যে যিয়েন বুঝে ভালক্কানি সুলুক দিলাক। কিন্তু এক্কানও মনত পরাপরি ন’ অহর। শেজেন্দি ইকু গাবুজ্যা উন্দুরে কবাত্ত্যেই উদিল । তে কল তােমা বিবেচনাত্ত্যেই মর এক্কান দোল বুদ্ধি আঘে। যেই- বিলেইবু গত্তানবুত ইক্কু ঘন্টা টাঙে দিয়োই। সালে আমি তে এত্তে খবর পেবং আর নিজে লুগেবাল্ল্যেই সময় পেবং। বেক উন্দুরয়ুনে গাবুজ্যা উন্দুরবুরে তা দোল বুদ্ধি আনত্ত্যেই হাততালি দিলাক।
কিন্তু ইক্কু বুড়াে উন্দুরে থিয়েনেই কল- এনেদ এ বুদ্ধিমান বজমান দোল অব। তে ভাবি চ কন্না বিলেইবু গত্তনাবুত ঘন্টাবু টাঙে দিবােগােই? তা কধায়ান শুনি বেক্কুনে জুরাে য়ােই রলাক। কারণ সােত ইক্কু উন্দরও ন’ এলাক যে বিলেইবু গত্তনাবুত ঘন্টাবু টাঙে দি পারিবােগােই।
বৃটিশের রাজত্বে চিড় ধরেছে। ঢাকা, কোলকাতা সবসময় বৃটিশ বিরােধী তৎপরতায় সয়লাব। পার্বত্য চট্টগ্রামের সামন্ত প্রভূদের মনে একদিকে আনন্দ আর অন্যদিকে আশংকা । দেশীয় রাজ্য হিসেবে নিজ মর্যাদা বাড়বে এতে তারা আনন্দবােধ করতে লাগলেন।
আবার বৃটিশরা চলে গেলে নতুন দেশে গণতন্ত্র এলে যদি রাজত্ব হারাতে হয়? এতে আশংকাও বাড়ে। যাক, নতুন কিছু হলে তখনই বােঝা যাবে কি করতে হবে- এখন শাসন কাজে মন দেওয়ায় শ্রেয়।
কাচারীতে বসে রাজা মহাশয় হেডম্যান, কার্বারীদের কাছ থেকে একে একে খবর নিচ্ছেন। কোথায় কেমন আছে। অমুক জায়গাতে হরিণ-শুকর বেশ মারা হচ্ছে কেন রাজবাড়ীতে রাণ দেয়া হচেছ না- এ খবরগুলাে রাজা আগেই জেনে নিচ্ছেন। বলতে বলতে চেঙ্গী পাড়ের এক মৌজার কার্বারী ২টা হরিণের রাণ নিয়ে উপস্থিত হলো রাজবাড়ীতে হৈ-হুল্লোড়ের মাত্রা বেড়ে গেল। কার্বারীকে রাজা কোথায় বসাবেন, কি খাওয়াবেন- স্বয়ং নিজে তৎপর হলেন।
কার্বারীও মনে মনে নিজের ইচ্ছে পুরণ হবার পূর্বাভাস অনুভব করলাে। পানি খাবার পর কার্বারী দাবা টানতে টানতে আপত্তির সুরে বলা শুরু করলেন-
আমাদের এলাকায় একটা পুল দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে বিহিত ব্যবস্থা
নিতে হবে। পুল। রাজা মনে মনে ভাবেন- বেশ তাে ভাল হয়েছে। কিন্তু কার্বারী মনে অন্য উদ্দেশ্য। সে ভাবতে থাকে-
আমার এলাকায় বাস করে আমার অনুমতি না নিয়ে ঐ বুড়াে পুল বানালাে। বুড়ােকে এবার একহাতে দেখে নেবাে। আমার সাথে বাড়াবাড়ি! কর্তা বাবু পুলের খবরে তেমন কর্ণপাত করলেন না। আবার কার্বারী বাবুও দমবার পাত্র নন। কার্বারী বারবার বলতে লাগলাে-
রাজার মৌজায় বাস করে নতুন কিছু করতে হলে রাজার অনুমতি না নিলে রাজার মান-মর্যাদা থাকে কোথায়?
মান-মর্যাদার প্রশ্ন এসে রাজাও স্থির থাকতে পারলেন না। কর্তাবাবুর নির্দেশ বেরুলাে ঐ বুড়ােকে কাচারীতে ডেকে আনা হােক । কার্বারী মহা আনন্দে বাড়ী ফিরে আসে সাথে ২টি গরম পানির বােতল নিয়ে । বাড়ীতে রেখে যাওয়া হরিণের মাংসটা ইতিমধ্যে রান্না করা হয়েছে। বুড়ােকে নাগারার মাধ্যমে রাজ কাচারীতে উপস্থিত হবার নির্দেশ দেবার পর কার্বারী ইজোরে বসে বােতল টানতে লাগল।
দুইটা গ্রামের মাঝখানে একটা খাল। বাজারে যাবার জন্য বাঁ দু’গ্রামের লােকজন। একে অন্যের কাছে যাওয়া-আসার জন্য খালের উপর বাঁশের তৈরী রেগাটির উপরই নির্ভরশীল। অনেক সময় গর্ভবতী মহিলা, ধান-চালের ভাড়ওয়ালা এবং ছােট ছােট ছেলেমেয়েরা রেগা থেকে পড়ে গিয়ে দূর্ঘটনার শিকার হন।
পূর্ব গ্রামটির বুড়াে মহাশয় কিভাবে যাতায়াত সুবিধা হয় সে বিষয়ে ভাবতে লাগলেন। তিনি মনে মনে ভাবলেন সারা জীবন একটা বাঁশের রেগার উপর দিয়ে হাঁটলাম। কয়েকটা বাঁশ দিয়ে তার উপর বেড়া দিলে তাে আরাে ভাল হবে। ভালাে করে চলাচল করা যাবে।
কয়েকজনকে বুড়াে ব্যাপারটি বুঝালেন। উৎসাহ বলতে যা পাওয়া গেল তা হলাে বিরাট বিরাট উপদেশ। কিন্তু কাজের বেলায় কেউ এগিয়ে এলাে না। বুড়াে তার কিশাের নাতিকে নিয়ে রেগাটি বড় করার কাজ শুরু করে দিলেন।
এখানে কি হচ্ছে? কেন এটা করছেন? এরকম প্রশ্ন খালের উভয় পাড়ের লােকজনের কাছ থেকে শুনতে শুনতে বুড়াের কান ঝালাপালা হবার অবস্থা। এক সময় রেগাটি বড় হয়ে গেল। এখন এটা একটা বাঁশের পুল। বুড়াে নিজে শিষ দিয়ে দিয়ে ভাল করে নেচে নেচে পুলটির উপর হেঁটে বেড়ালাে। বাহ! বেশ ভালো হয়েছে। কমপকে্ষ ৬ মাস ভাল থাকবে।
ততদিনে গ্রামবাসীরা অভ্যস্ত পড়লে এটি মেরামতের জন্য সবাই এগিয়ে আসবে। বুড়াে বটগাছের নীচে বসে তাকিয়ে থাকেন- লােকজন পুলের উপর দিয়ে দিব্যি আরামে আর নিরাপদে যাতায়াত করছে। আনন্দে তার প্রাণ আত্মহারা হয়ে গেল। রাজ কাচারী। ৮ মাইল রাস্তা হেঁটে ক্লান্ত বুড়াে রাজার কাছে কি অপরাধ করেছে, রাজা কেন খবর দিলাে- ভেবে ভেবে কুল পায় না।
চেঙ্গী নদীর স্রোত বাড়ার সাথে সাথে তার উৎকণ্ঠাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। দ্বিতল রাজবাড়ীটি দেখে তার অবস্থাও মনে মনে দু’ভাগ হয়ে গেল। অর্ধেক জীবন আর অর্ধেক মৃত্যু। ইতিমধ্যে রাজমহলে খবর রটে গেছে। রাজার মৌজার এক রাজদ্রোহী পুল বানিয়েছে রাজার অনুমতি না নিয়ে।
রাজার সাথে দেখা হবার আগে আরাে কয়েকজন দেওয়ান জাতীয় লােকের সাক্ষাৎ পেলেন বুড়াে। সূর্যের চেয়ে বালুর তাপ যেমনি বেশী ঠিক দেওয়ানদের কথাও গ্রীষ্মের তপ্ত হাওয়ার মতাে। তার গলার পানি শুকাতে শুরু করলাে।
বুড়ােও দমবার পাত্র নন। তার জীবনের বিনিময়ে রাজা, হেডম্যান আর প্রজাদেরকে তিনি শিক্ষা দিয়ে যাবেন বলে মনস্থ করলেন। তাই রাজার কাছে সব খুলে বলবেন বলে দৃঢ়চিত্ত হলেন। রাজা বুড়াের কথা মন দিয়ে শুনলেন। রাজা মনে মনে স্থির করেছিলেন- যেহেতু রাজার অনুমতি নেয়া হয়নি তাই পুলটি ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিবেন। প্রয়ােজনে অনুমতি নিয়ে নতুন করে বানানাে যাবে।
বুড়াে মনে কোন প্রকার ভয় না রেখে পুলের স্বপক্ষে মত দিতে লাগলেন। বুড়াের কথা শুনতে শুনতে রাজার সিদ্ধান্ত পাল্টাবার পক্ষে মনটা সায় দিল। তারপরও ভাবলেন উপস্থিত হেডম্যান, কার্বারী আর দেওয়ানদের মত নিলে কেমন হয়? যেহেতু এটা সম্পূর্ণ নতুন ধরণের আপত্তি এবং অপরাধও বটে।
সভাসদবৃন্দ নানাভাবে বােঝাতে লাগল যে, পুল নতুন জিনিস আর সেটার প্রয়ােজনটা দেখবে রাজা। তাই রাজার অনুমতি আগে নেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অবশেষে উপস্থিত সভাসদবৃন্দ রাজার মনের ইচ্ছেটিই প্রকাশ করলাে। তাই সিদ্ধান্ত দেয়া হলাে- রাজার অনুমতি না নিয়ে নতুন কাজ করায় বুড়াের অপরাধ হয়েছে তবে তার বয়স আর রাজার মৌজার লােক হওয়ায় তাকে একবারের জন্য ক্ষমা করে দেয়া হলাে। তবে পুলটি কার্বারীর নেতৃতে্ব সেখানকার লােকেরা ভেঙে ফেলবেন।
বুড়ো অত্যন্ত ভগ্নমনােরথে ফিরে এলেন। রাজদ্রোহীর অপরাধ আর উপহাসে্র পার হয়ে শেষ জীবনে বেঁচে থাকতে হবে ভেবে সে মনে তীব্র দহণ অনুভব করতে লাগলাে। এদিকে কার্বারীর নিকট বুড়াে বাড়ী পৌছার পরপরই রাজার নির্দেশ পৌছে গেল।
সুর্য তখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। কার্বারীর সাঙ্গ-পাঙ্গরা মহাসমারােহে পুল ভাঙার জন্য জমায়েত হতে লাগলাে। এদিকে বুড়ােও নিজের পরিশ্রম আর অবদানকে শেষ বার দেখার মনস্থ করলাে। কার্বারীর লােকেরা দা, কুড়াল দিয়ে পুলের বাঁশ আর বেড়া কাটা শুরু করলাে। সাথে সাথে তারা আতশ বাজি ফুটিয়ে জয়ােৎসব করতে লাগলাে। বুড়াের কয়েকদিনের শ্রম আর মেধা উত্ত লােকগুলাের অপরিণাম দা’য়ের কোপে দেখতে দেখতে নিশ্চিহ্ন হওয়ার ক্ষণ গুনতে লাগলাে।
পুলটি ভেঙে ফেলার বেদনাময় দৃশ্য দেখতে দেখতে হঠাৎ বুড়াে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল । রটে গেল- রাজার অনুমতি না নিয়ে পুল বানানােতে বুড়াে ভূতের গুলী খেয়েছে। বৈদ্যরা অনেক চেষ্টা তদবির করার পরও বুড়াের জ্ঞান ফিরাতে পারলাে না । সূর্যটা অস্ত যাবার সাথে সাথে পুলটি ক্রমশ: তলিয়ে যায় বুড়াের জীবন প্রদীপ। নিভে যাবার মতাে করে।
সময়টা ১৯৫০ থেকে ১৯৫৫ সালের মাঝামাঝি । তখনাে কাপ্তাই বাঁধের নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। লােকে বিশ্বাস করতে পারে না বরগাঙ এর উপর বাঁধ দেয়া কি সম্ভব? বিশ্বাস যারা করত তাদের মনে শত বছরের জমি-জমা, বাস্তুভিটা জলের গভীরে তলিয়ে যাবার আশংকায় দিন কাটত। চেঙ্গীর পূর্বপাড়ে এধরণের একটি গ্রাম।
বিশ্বাস-অবিশ্বাসের গুঞ্জন সবাইকে তাড়া করে বেড়ায়। গ্রামের লােকেরা সবাই একই গােজাভূক্ত। ফলে তাদের মধ্যে অন্যান্য পাড়ার চেয়ে গােজাগত ঐক্য সুদৃঢ়। আথির্ক অবস্থাও স্বচ্ছল । গ্রামের উত্তর পাশের কিয়ংটি সে স্বচ্ছল তাষে একধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে।
কিন্তু খারাপ অভ্যাসও ছিল। লােকগুলাে একমুখে মদ আর ধর্ম গোগ্রাসে গিলত। আর জুয়ার নেশাও সমানে রাজত্ব চালাত। গ্রামের কিছু মুরুব্বী ঠিক করলাে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে হবে, অন্যান্য গোজাদের চেয়ে বড়াে হতে হবে। যে ভাবা সেই কাজ। শুরু হলো খােজাখুঁজি।
অবশেষে মাষ্টার পাওয়া গেল। খুব ভাল লােক। কলকাতা থেকে গ্রাজুয়েট ডিগ্রিধারী। একে তাে নিজের গােজাভূক্ত অন্যদিকে তার স্ত্রীও শিক্ষিতা। একদিন মাষ্টার ও তার স্ত্রী গ্রামের মুরুব্বী (বিশিষ্ট কার্বারী) এর বাড়ীতে উঠল । তাদের জন্য চৌচালা পূর্বমুখী বাড়ী করে দেয়া হল। বেতন নির্ধারিত হল মাষ্টার পাবে ৬০ টাকা আর তার স্ত্রী পাবে ৪০ টাকা।
মাষ্টারেরও ভাবনা- শিক্ষা দান মানে জ্ঞান দান। এ যে বড়াে দান। নিজের গােজার লােকদেরও এগিয়ে নেয়া যাবে। কথায় বলে দাঁত থাকতে কেন মাড়িতে চিবাবাে? এভাবে একদিন যায় দু’দিন যায়। মাস গড়িয়ে যায় । কিন্তু মাষ্টার আর তার স্ত্রীর বেতন মিলে না। অগত্যা পাশের গ্রামের অন্য গােজার এক স্বচ্ছল বুড়াের কাছে চাল-চিদোলের জন্য দ্বারস্থ হতে হলাে।
মাষ্টারকে সাহায্য করতে পেরে বুড়াে বেজায় খুশী। জ্ঞানী লােকের উপকার করা বড়ই পূণ্যের কাজ। মাষ্টারও ভাবলাে বুড়াে বেশ ভাল লােক। অন্য গােজার লােক হিসেবে এত খারাপ নয়। এভাবে দু’ পরিবারের মধ্যে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠলাে। মাষ্টার বাকছড়ি বাজারে আসা যাওয়ার সময়ে প্রায়ই বুড়াের বাড়ীতে পদধূলি দিত।
বাড়ীতে বাড়ীতে নিমন্ত্রণ মিলে কিন্তু বেতন মিলে না। মাষ্টার এবার ছাত্রদের উপর রাগ ঝাড়তে শুরু করলাে। অনেকটা ঝিকে মেরে বৌকে শেখানাের মতাে । মাষ্টারের কাছে আদুরে সন্তানের কানমলা দেখে অভিভাবক আর কার্বারীর টনক নড়ল । কার্বারী সভা ডাকল । হাজির হলাে পরিবারের কর্তারা। আলাপ আলােচনার খই ফুটতে লাগলাে। মাংস পুড়লে শিককাটিও পুড়ে।
আমাদের মাষ্টার কেন অন্য গােজার লােকের কাছে চাল-সিদোল ধার নেবে? একে একে প্রতিশ্রুতি বেরুলাে- আগামী বাজারে আমি এত দেব, ও এত দেবে, অমুক সমুক সবাই দেবে । মাষ্টারের মুখে হাসি ফুটলাে। কৌশলটা কাজে লেগেছে। আহা! দু’দিন পর তাে বাজার দিন।
বাজার দিন। বৃহস্পতিবার। মাষ্টার একখানি বড় হল্যা (থলে) নিয়ে বাজারে গেল। বুড়াের বাড়ীতে উঠার তেমন ইচ্ছে হলাে না সেদিন। বাকছড়ি বাজার । বেশ ভীড়। মাষ্টার বটগাছের নীচে গামছা বিছিয়ে এককোণে বসে রইল। কখন বাঁশ-গাছ বিক্রি শেষ হবে? তিন মাসের বেশ কতগুলাে টাকা।
অপেক্ষার হাতুড়ি সজোরে আঘাত করলেও মাষ্টার একধরণের স্বচ্ছলতা অনুভব করতে লাগল । বটগাছের পাতা ঝড়ে পড়ার শব্দে সে কড়কড়ে নােটের শব্দ শুনতে থাকে। এদিকে বেচাবিক্রি প্রায় শেষ । মাষ্টার সমূহ উভয় সংকটে পড়ল। মাষ্টার মানুষ । সম্মানী লােক। টাকা চেয়ে নেয়াও মুশকিল। অন্যদিকে স্বেচ্ছায় দেবারও লক্ষণ নেই। আবার বাজার না নিয়ে বাড়ী ফিরলে বৌ এর কাছে মুখ দেখানােও অসম্ভব হবে। মনে মনে নিজের গােজার লােকদের অমানুষ ভাবতে ভাবতে বুড়াের মুখখানি ভেসে উঠে। কতাে দ্বারস্থ হওয়া যায় তার কাছে?
লজ্জা শরমের কুয়াশা উড়িয়ে দিয়ে একজনকে বললাে- বেচা বিক্রি তাে শেষ আর আমারগুলাে পেলে আমিও…………….। বলতে না বলতে প্রত্যুত্তর এলাে। আগামী বাজারে আমারগুলাে দেব। প্রথম চাওয়াতে হোঁচট। টাকার অভাবটা সে আরাে তীব্রভাবে অনুভব করলাে। মদের ঝাঁঝালাে গন্ধটি শুধু বিনিময়ে পাওয়া গেল।
না দমবার পাত্র নয় সে। হয়তাে অন্যরা এমন হবে না ভেবে আরেক জনকে– সেদিন সভায় আপনি– দেবার কথা বলেছিলেন। লােকটি বেশ রাগতস্বরে বললাে.. আমি তাে মাষ্টার তােমার কাছ থেকে ধার নিইনি। দেখা যাক। একজন দু’জন। বেশ কয়েকজনকে বলার পরও কোন গত্যন্তর না দেখে মাষ্টার হল্যাটি লুকানাে শুরু করলাে। অসুস্থ আর ভগ্ন মনােরথে গামছার ভেতর হল্যাটি ঢুকিয়ে বাড়ী ফেরার পালা।
ওদিকে বুড়ােও ভাবছিল, আসলে মাষ্টার বেতন পাবে তাে? সে মাষ্টারের আসার পথ চেয়ে থাকলাে। সূর্যটা বেশ হেলে পড়েছে। মাষ্টার ফিরছে। বুড়াে অবাক। চোখ কষলে দেখে। মাষ্টারের হল্যাটি কোথায়? বেচারা মাষ্টার। কি মাষ্টার… আজো কি চুধাে হল্যা? চুদোহল্যা হাতে মাষ্টার গােধুলীর সাথে পা ফেলতে ফেলতে চলে গেল।
চাকমাদের মনকাড়া রূপকথার আরও অনেক গল্প পড়তে ভিজিট করুন –
চাকমারা বাংলা বৎসরের শেষ দুইদিন ফুল বিজু ও মূল বিজু এবং নতুন বৎসরের প্রথম দিন গজ্যাপজ্যা দিন নামে এই তিন দিন খুব ঘটা করে পালন করেন। এই দিনত্রয়কে সর্বশ্রেষ্ট সামাজিক উৎসবের দিন বলা চলে। ফুল বিজুর দিনে প্রতি গৃহস্থ বাড়ীর ছেলে অনেক সময় বয়ােবৃদ্ধ পুরুষ মহিলারাও সকালে ঘুম হতে উঠে বিভিন্ন ফুল সংগ্রহ করে গৃহে আনে এবং সেইগুলি দিয়ে বুদ্ধ পূজা, গৃহ দেবতার পূজা করে।
ছেলেমেয়েরা ফুলে বাড়ি সজ্জিত করার পর বাড়ির পােষা গরু, মহিষ ইত্যাদির গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দেয়। খাওয়া দাওয়ার পর দুপুর বেলায় মূল বিজুর দিনে খাওয়ার জন্য বিভিন্ন দ্রব্য সংগ্রহে বের হয়। গ্রাম্য জনসাধারণ ফুল বিজুর দিনে একত্রিত হয়াে শিকারিসমেত বন্যজন্তুর মাংস সংগ্রহের জন্য বনে শিকার করতে যায়।
কেহ কেহ নদীতে বা জলাশয়ের মাছ ধরতে যায়। মেয়েরা জঙ্গলের তরিতরকারী যেমন- তারা (সবজি বিশেষ), গন্ধকী, কাটুরের আগা বা মূল, কদাজা কচুর দিগ, কেতকী, গােলাক বেতের আগা (বেদাগী) ও মরিচা বেতের আগা (তিতাবিজি) ইত্যাদি সংগ্রহ করতে যায়। ইহা ছাড়া বাড়ির ক্ষেত খামার গিয়ে মেয়েরা বিভিন্ন তরিতরকারী সংগ্রহ করে আনে। বিকেলে বাড়িতে, গােয়াল ঘরে, স্নানঘাটে সুতালি বাতি বা মােমবাতিতে আলােকসজ্জা করে।
সন্ধ্যার পরে পরদিন খাওয়ার জন্য নানা রকম পিঠা (সান্যা পিদা, বরা পিদা, হগা পিদা) ইত্যাদি তৈয়ার করে রাখে। মূল বিজুর দিনে প্রতিটি গৃহস্থের লােকেরা সকালে ঘুম হতে উঠে নদীতে বা জলাশয়ের ঘাটে স্নান করে আসে। গৃহস্থের মেয়েরাও স্নান করে এসে ফুল বিজু দিনে সংগৃহীত বিভিন্ন সবজির সংমিশ্রণে পাজন রান্না করে এবং বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য তৈয়ার করে গৃহে আগত গ্রামবাসীকে খাইতে দেয়।
যুবতী মেয়েরা বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাদিগকে নদী বা জলাশয় হতে পানি এনে স্নান করায়। গ্রাম্য বালক বালিকারা নতুন কাপড় চোপড়ে সজ্জিত হয়ে কুরুম বা টুরুং-এ ধান লইয়া দলে দলে প্রতি গৃহস্থের বাড়িতে গিয়ে মােরগ-মুরগি ও হাঁসের খাওয়ার জন্য উঠানে ধান ছিটিয়ে দেয়। গৃহস্থ তাদেরকে পিঠা পাজন ইত্যাদি তৈয়ার করা খাদ্যদ্রব্য খেতে দেয়।
এভাবে তারা এবাড়ি হতে অপর বাড়িতে গিয়ে সমস্ত গ্রাম ঘুরে বেড়ায়। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, প্রােট- প্রৌঢ়া, যুবক-যুবতী সমবয়সী পুরুষ-স্ত্রী মিলিত হয়ে দলে দলে প্রতি গৃহসে্হর বাড়িতে বেড়ায়। গৃহস্থ সাধ্যমত সংগৃহিত ও তৈয়ার করা খাদ্যদ্রব্য, মদ, সারা খেতে দিয়ে তুষ্ট করে। এভাবে খাওয়া দাওয়ার মধ্য দিয়ে সমস্ত দিন আতিবাহিত হয়। বিকেলে ঘরে, স্নানঘাটে, গরু-মহিষ বাঁধার স্থানে আলােক সজ্জা করে। এ দিন খাওয়া দাওয়ার জন্য রান্না করার কাজ ছাড়া অন্য কোন বাইরে কাজ করা হয় না।
গজ্যাপজ্যা দিনে অর্থাৎ নববর্ষের প্রথম দিনে ধর্মপ্রাণ নরনারীগণ নিকটস্থ কিয়ঙ বা বিহারে গিয়ে বুদ্ধ পূজা এবং ভিক্ষুদের উদ্দেশ্যে পিন্ডদান করেন। তাদের অনেকেই সারাদিন ধর্মচর্চায় নিমগ্ন থাকেন। আবার অনেক অবস্থাপন্ন গৃহস্থ। সাধ্যানুসারে পাড়া পড়শিদের আপ্যায়িত করেন। গ্রাম্য ছেলে মেয়ে ও যুবক যুবতীরা বিভিন্ন খেলাধুলার আমােদ উৎসবে দিনটি অতিবাহিত করে।
সন্ধ্যায় প্রতিঘর, কিয়ঙ ঘর, স্নান ঘাট, গরু-মহিষ ও ছাগল বাঁধানাের ঘর আলােক সজ্জায় সজ্জিত করে। নববর্ষের প্রথম দিনে গৃহস্থের কেহই দূরবর্তী প্রবাসে বাহির হয় না। এদিনে কেবল বিশ্রাম নেয়া হয় তাই এটাকে গজ্যাপজ্যা দিন বলা হয়। বর্তমানে শহরাঞ্চলে ও শিক্ষিত চাকমারা বিজু উৎসবের দিনে ঐতিহ্যবাহী পিঠার পরিবর্তে বাজার থেকে কিনে নানান মিষ্টি জাতীয় দ্রব্য পাজনসহ পরিবেশন করে। হাসমুরগিদের জন্য খাদ্য ছিটানাে, বুড়ােদের স্নান করানাে ইত্যাদি প্রথা প্রায় বিলুপ্তির পথে।
মালেইয়্যে ঠিক কোন পূজা পার্বন নয়। এটি চাকমাদের একটি প্রাচীন সামাজিক রীতি, এখন প্রায় লােপ পেতে বসেছে। এতে কোন দেবতার পূজা হয় না। কোন গৃহস্থ যদি কোন কাজে পিছিয়ে থাকে, ইচ্ছে করলে সে পাড়ার লােকের সাহায্য নিতে পারে । হয়ত কোন কারণে কারও জুম কাটা দেরী পড়ে গেছে, ঠিক সময়ে জঙ্গল কাটা না হলে কাটা জঙ্গল শুকাবে না, ফলে তার ফসলও ভাল হবে না।
তখন পাড়া পড়শীর সাহায্য নিয়ে সে কাজে সমতা আনতে পারে। সে ক্ষেত্রে সে পাড়ায় গিয়ে সাহায্যের আবেদন জানিয়ে আসে। তারপর দিন প্রতি বাড়ী থেকে দা’ কুড়াল নিয়ে এক একজন লােকজন এসে তার কাজটা একদিনেই সম্পন্ন করে দিয়ে যায়। এদের কোন মজুরী দিতে হয় না, শুধু খানাটা দিলে চলে । তা অবশ্য একটু ভালােই দেওয়ার রেওয়াজ আছে।
তখন এ উপলক্ষ্যে সে বাড়ীতে ছােটখাট একটা ভােজের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। গৃহস্থের স্বচ্ছলতা থাকলে কিন্তু অনেক সময় এমনিই সবাই কাজ করে দিয়ে আসে। জুমে নিড়ানি দেওয়ার বেলায় কিংবা ফসল। কাটার সময়ও মালেইয়্যে ডাকা হয়। নি:সন্দেহে এটি একটি ভাল প্রথা।
এতে পারস্পরিক সহানুভূতি আর সহযােগিতার মনােভাব বৃদ্ধি পায়, সামাজিক বাঁধন সুদৃঢ় থাকে। এক কথায় এই প্রথা প্রাচীন চাকমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্যেরই পরিচয় বহন করে। এমন সহজ ভ্রাতৃত্ববােধ একমাত্র পাহাড়িদের মধ্যে ছাড়া বােধ হয় সভ্য জগতে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
এ প্রসঙ্গে পুরনাে দিনের মিজোদের একটা ব্যাপার এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। বৃটিশ শাসনের প্রথম দিকে মধ্যে কাউকে কোন অপরাধে জেলের হুকুম হলে তখন তার যতদিনের জেলের মেয়াদ তার ততজন আত্মীয় এসে জেলে কাজ করে দিয়ে দিনে দিনে তাকে খালাস করে নিয়ে যেত। বৃটিশ গভর্ণমেন্টও তাদের সরলতা দেখে তাই মেনে নিতেন। এটাও তাদের একধরণের মালেইয়্যে বলা চলে।
চাকমা রাজ পূন্যাহ্ তৎকালে পার্বত্য চট্টগ্রামে সমগ্র পাহাড়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে ছিল একটা মহা আনন্দ ও মিলনের পূণ্যক্ষেত্র। এই দিনটা সাধারণত: অগ্রহায়ণ মাসে রাজা কর্তৃক নির্ধারিত হইত। এই পূন্যাহ্ দিনে দেওয়ান তালুকদারেরা প্রজাদের নিকট হইতে খাজনা উসুল করিয়া রাজ ভান্ডারে জমা দেওয়ার জন্য সকলে সমবেত হইত।
এই উৎসবে হাজার হাজার লােকের সমাগম হইত এমনকি পার্বত্য চট্টগ্রামের বাহির হইতেও বহু লােক আসিয়া এই সমাগত লােকদের আনন্দ দান করিত। কলিকাতা ও ঢাকা হইতে যাত্রা দল আসিয়া এই সমাগত লােকদের আনন্দ দান করিত। রাজ ভান্ডার হতে নংগরখানা খুলিয়া দিয়া এই সমাগত লােকদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করা হইত। রাজা সুসজ্জিত বিরাট চন্দ্রাতপতলে পাত্রমিত্র ও দেওয়ান তালুকদারগণের দ্বারা পরিবেষ্টিত হইয়া একটা বিশিষ্ট কারুকার্য শােভিত মন্ডপে রাজকীয় পােষাক পরিহিত হইয়া উপবেশন করিতেন।
রাজপ্রাসাদ হইতে বিরাট শােভাযাত্রা সহকারে সুসজ্জিত হস্তীপৃষ্টে উপবেশন করিয়া প্রকান্ড রাজপ্রাসাদের প্রাঙ্গণে ঐ চন্দ্রাতপতলে আয়ােজিত রাজ দরবারে মন্থর গতিতে গমণ করিতেন। রাজ ছত্রধর তুকচান রাজাকে সূর্যকিরণ হইতে রক্ষা করিবার জন্য রাজা বাহাদুরের মাথার উপর সুবর্ণরঞ্জিত ছত্র ধারণ করিতেন। রাজ দরবার জনসমাবেশে পূর্ণ হইলে তােপধ্বনিসহকারে খাজনা উসুল করার কাজ শুরু হইত। রাজা কেবল দর্শক হিসাবে উপবিষ্ট থাকিতেন। রাজ আমলাবৃন্দই সকল কাজ করিত।
চাকমাদের আর অনেক পূজা পার্বণ সম্পর্কে জানতে পড়ুন –
লেখকঃ তনয় দেওয়ান।
প্রসঙ্গ:চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।