Jumjournal Logo

Search

Menu

কৃষ্ণকিশোর চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষা বিস্তারের পথিকৃৎ

Jumjournal

Last updated May 12th, 2021

3132

featured image

কৃষ্ণকিশোর চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রাম শিক্ষার অগ্রদূত হিসাবে পাহাড়ের মানুষের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।

গত শতকের শুরুর দিকে পার্বত্য অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা কতটা অপ্রতুল ছিল তা সহজেই অনুমেয়।

এ অবস্থাতে সরকারের শিক্ষা দপ্তরের স্কুল পরিদর্শক কৃষ্ণকিশোর তাঁর সরকারি দায়িত্ব পালন করেই ক্ষান্ত ছিলেন না বরং পাহাড়িদের মধ্যে বিদ্যার উৎসাহ জাগানো এবং স্থানীয় মানুষের সহযোগিতায় বিদ্যালয় গড়ে তোলার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এবং আমৃত্যু সে কাজেই ব্যাপৃত ছিলেন।

কৃষ্ণকিশোরের জন্ম রাঙ্গামাটি জেলার নান্যাচর উপজেলার কেরেতকাবা মোনতলা গ্রামে ১৮৯৫ সালে ১৪ই জুলাই।

সুন্দরবি চাকমা ও চানমুনি চাকমার তিন ছেলের মধ্যে কৃষ্ণকিশোর সবার বড়। বাকি দুই ভাই হরকিশোর চাকমা ও চিত্তকিশোর চাকমা।

প্রথমদিকে তাঁদের পরিবার পাহাড়ের পাদদেশে মাওরুম ছড়ার উৎপত্তি যেখানে সেই সত্তা-ধুরুং নামের এলাকায় ছিল, পরে তাঁরা মহাপ্রুম এলাকায় সরে আসেন।

কৃষ্ণকিশোর চাকমা
কৃষ্ণকিশোর চাকমা

পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম অঞ্চলে বাস করলেও সুন্দরবি ও চানমুনি চাকমার পরিবারটি শিক্ষার ব্যাপারে সচেতন ছিল।

ফলে তাঁদের তিন ছেলেই উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। বড় ছেলে কৃষ্ণকিশোর ১৯১৯ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে স্নাতক পাশ করার পর ১৯২০ সালে পাবর্ত্য চট্টগ্রামের শিক্ষা বিভাগে সাবইন্সপেক্টর পদে যোগ দেন।

মেজ ভাই হরকিশোর চাকমাও ছিলেন শিক্ষক। সমাজসেবক হিসাবে খ্যাত ছোট ভাই চিত্তকিশোর চাকমাও শিক্ষকতাকেই পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন।

ষাটের দশকে তিনি ছোট মহাপ্রুম মাধ্যমিক স্কুলসহ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় উদ্যোক্তার ভূমিকায় ছিলেন।

চিত্তকিশোরের পুত্র মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (মঞ্জু) ষাটের দশকে সূচিত পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।

তাঁর অপর তিন সন্তান, জ্যোতিপ্রভা লারমা, শুভেন্দু প্রভাস লারমা ও জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা, সন্তু লারমা নামে যাঁর অধিক পরিচিতি, সকলেই পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জাতিগুলোর অধিকার আদায়ের আন্দোলনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন বা এখনও আছেন।

কৃষ্ণকিশোরের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। শিক্ষানুরাগ আর অধিকার সচেতনতা– এ দু’য়ের মিশেলে পরিবারের যে আদর্শিক চেতনা তা থেকে তিনি বিচ্যুত হননি কখনও।

পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজাশাসিত সমাজে উচ্চবর্গীয় গোষ্ঠীর প্রতাপে সাধারণ মানুষ শিক্ষার সুযোগ পেতেন না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষা কেবল উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।

কিন্তু সুন্দরবি চাকমা ও চানমুনি চাকমা এসব বাধা অতিক্রম করে সন্তানদের শিক্ষা নিশ্চিত করেছিলেন।

তাঁদের সন্তানরা বিশেষ করে কৃষ্ণকিশোর সমাজের গোষ্ঠীপতিদের সামন্তীয় চিন্তাচেতনার সঙ্গে কখনও আপোষ করেননি এবং সামাজিক সব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে কঠোর পরিশ্রম, দূরদর্শিতা ও দৃঢ় সংকল্পের মধ্য দিয়ে পাহাড়ে শিক্ষা আন্দোলনের সূচনা ঘটিয়েছিলেন।

বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যালয় স্থাপন, শিশুদের স্কুলে পাঠাতে অভিভাবকদের উদ্বুদ্ধ করা, স্কুলের জন্য সরকারি সাহায্য-অনুদান আদায়ের ব্যবস্থা, বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগ, ছাত্র সংগ্রহের লক্ষ্যে মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান এবং উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করার জন্য কৃষ্ণকিশোর আমৃত্যু কাজ করে গেছেন।

শিক্ষা বিভাগের সাবইন্সপেক্টর থাকা অবস্থায় তিনি কখনও সাইকেলে, কখনও পায়ে হেঁটে দুর্গম পাহাড়ি এলাকা পরিদর্শনে যেতেন এবং অভিভাবক ও গ্রামের মুরুব্বীদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন।

এ অঞ্চলে তিনিই প্রথম সকল উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ইংরেজি শিক্ষাদানের ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। মূলতঃ তাঁরই ঐকান্তিক চেষ্টার ফলে ১৯২২ সালে মগবান ইউপি স্কুল ও সুবলং খাগড়াছড়ি ইউপি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়।

এছাড়া ১৯২৩ সালে মহাপ্রুম এমই স্কুল, রামগড় এমই স্কুল, পানছড়ি এমই স্কুল, দিঘীনালা এমই স্কুল এবং তুলাবান এমই স্কুল এই বিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

কৃষ্ণকিশোর এবং তাঁর সমসাময়িকরা পাহাড়ে যে শিক্ষা আন্দোলন শুরু করেছিলেন তা এগিয়ে নিয়ে গেছেন তাঁর পরের প্রজন্ম। আর সে কারণেই আজ চাকমা জাতির মধ্যে শিক্ষার হার বেশ উঁচু।

গত কয়েক বছর ধরে সরকারি পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী চাকমাদের মধ্যে শিক্ষার হার ৭০ শতাংশের বেশি। তবে এক্ষেত্রে একটি কথা বলে রাখা প্রয়োজন, কৃষ্ণকিশোর চাকমার নেতৃত্বে শুরু হওয়া শিক্ষা আন্দোলন দ্বারা প্রাথমিকভাবে লাভবান হয়েছে চাকমারা।

এর কারণ এ আন্দোলন শুরু হয়েছিল রাঙামাটিকে ঘিরে যেখানে কৃষ্ণকিশোর শিক্ষা কর্মকর্তা হিসাবে প্রথম দায়িত্ব পালন করার সুযোগ পেয়েছিলেন।

রাঙামাটির কর্ণফুলি নদীর উপত্যকায় সেসময় পাহাড়িদের মধ্যে মূলতঃ চাকমাদের বসতিই ছিল। পরবর্তীকালে শিক্ষা আন্দোলনের এ চেতনা তিনি খাগড়াছড়িতেও পৌঁছে দিয়েছিলেন।

সেখানে চাকমা ছাড়াও, মারমা ও ত্রিপুরাদের বাস যারা এ আন্দোলনের সুফল কিছুটা হলেও পেয়েছেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামের আরো যে আটটি জাতি তঞ্চঙ্গ্যা, বম, খুমি, পাংখোয়া, খ্যাং, লুসাই, মুরুং ও চাক, আরো দুর্গম অঞ্চলে বসবাস করার কারণে শিক্ষা আন্দোলনের ঢেউ তাদের কাছে পৌঁছাতে সময় লেগেছে।

তাছাড়া এর পেছনে ভাষাগত বাধাসহ বিবিধ সামাজিক-রাজনৈতিক কারণও কাজ করেছে।

কৃষ্ণকিশোর ও তাঁর ভাইদের সামন্ত সমাজের প্রতিকূলতাকে ডিঙিয়ে শিক্ষালাভ করতে হয়েছিল।

সামন্তীয় মূল্যবোধ এবং পশ্চাদপদ চিন্তা-চেতনা জাতিকে কতটা পিছিয়ে রাখে তা তিনি ভেতর থেকে উপলব্ধি করেছিলেন।

শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি তাই সমাজ থেকে ক্ষতিকর সামন্ত মূল্যবোধ ও শ্রেণী বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যেও তিনি জনচেতনা প্রসারে কাজ করে গেছেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষা বিস্তারে বিশেষ অবদান রাখার জন্য রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ ২০০১ সালে কৃষ্ণকিশোর চাকমাকে মরণোত্তর বিশেষ সন্মাননা প্রদান করেছে।

পাহাড়ে শিক্ষার পথিকৃৎ এ মহান মানুষটি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মাত্র ঊনচল্লিশ বছর বয়সে ১৯৩৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন।


লেখক: পুলক চাকমা, সহকারী পরিচালক, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট (২০১৫ সালে প্রকাশিত)

প্রসঙ্গ:কৃষ্ণকিশোর চাকমা

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা