Last updated Oct 8th, 2025
3
আদিবাসী সমাজে নারীর অবস্থান
সরকারি পরিসংখ্যানে নারীর আর্থ-সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তবে এটা সর্বজনবিদিত যে, আদিবাসী সমাজের মধ্যে আদিবাসী নারীরাই সবচেয়ে দুর্বল অংশ। আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁরা সবসময় পুরুয়ের চেয়ে কম মর্যাদা পেয়ে থাকেন। তাঁরা সবচেয়ে বেশি মানবাধিকারের লঙ্ঘনের শিকার হন।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১০, ১৯, ২৮ ও ২৯ নম্বর অনুচ্ছেদে নারীর সমঅধিকারের কথা উল্লেখ থাকলে ও বাস্তবে তার কোন মিল নেই। আইন ব্যবস্থায়, বিশেষ করে পারিবারিক বিষয় যেমন বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, সন্তানের অভিবাবকত্ব, উত্তরাধিকার ইত্যাদিতে নারী পুরুষের বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। হেডম্যান/কার্বারি কর্তৃক পরিচালিত গ্রাম্য শালিসগুলোতে নারীর সিদ্ধান্ত-নির্ধারণী ভূমিকা নেই বললেই চলে। ইদানিং তৃণমূল পর্যায়ে উউনিয়ন পরিষদগুলিতে নির্বাচিত আদিবাসী নারী প্রতিনিধিরা অনুষ্ঠিত সালিশিগুলিতে নারীদের সম্পৃক্ত করে এ ব্যবস্ঞায় পরিবর্তন আনায় ভূমিকা রাখছেন।
১৯৯৭ সালে প্রবর্তিত পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে সাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান ও বিচার ব্যবন্থাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ অাইন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ অাইন কার্যকর না হওয়ার কারণে পাহাড়ি নারীরা এখনো বঞ্চনা ও বৈষম্যর শিকার হচ্ছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভন্ন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী সুদূর অতীতকাল থেকে অলিখিতভাবে সমাজের শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সামাজিক রীতিনীতির ওপর ভিত্তি করে আদিবাসী সামাজিক প্রথা অনুসরণ করে আসছেন, যা আজো মুখে মুখে প্রচলিত হয়ে আসছে। বিভিন্ন আদিবাসী সমাজে একই গোত্রের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ। রক্তের সম্পর্ক আছে এমন আত্মীয়ের সঙ্গে বিবাহ নিষিদ্ধ।
তুলনামূলকভাবে আদিবাসী পাহাড়ি নারীরা তাদের জীবনসঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে থাকেন। বিয়ে হয় প্রথাগত নিয়মকানুন অনুসারে এবং তা রেকর্ড করা হয় না। বিয়ের পর কনে সাধারণত আরেক গ্রামে চলে যান। নতুন পরিবারে কনের প্রচুর কাজের ভার পড়ে এবং তাঁর পরিচিত দাঁড়ায় কারোর স্ত্রী বা কারোর পুত্রবধূ হিসেবে। সংক্ষেপে একজন পুরুষ সারাজীবন পরিচিত হন তাঁর নিজের নামে, কিন্তু একজন নারী পরিচিত হন তাঁর পুরুষ আত্মীয়ের পরিচয়ের ভিত্তিতে। এভাবে পুরুষ নিয়ন্ত্রিত আত্মীয়তার পদ্ধতি আদিবাসী নারীদের স্বতন্ত্র সামাজিক পরিচিতি স্বীকার করে না।৩০
পার্বত্য চটগ্রামের আদিবাসী পাহাড়ি সমাজে বিবাহবিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহ খুবই সীমিত বলা যায়। বহুবিবাহের ঘটনা ঘটলেও এর সংখ্যা অত্যন্ত কম। তবে বিবাহবিচ্ছেদ ও বহুবিবাহ শিক্ষিত আদিবাসীদের মধ্যে আরো কম প্রচলিত। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পর নারী অধিকার বাস্তবায়ন ও জেন্ডার ইস্যুতে বেসরকারি যোচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর উদ্যোগে নানা প্রয়াস চলছে এতে নারী ও জেন্ডার বিষয়ে আদিবাসী পাহাড়ি সমাজে আরো বেশি সচেতনতা গড়ে উঠছে বলে আদিবাসী নারী অধিকার কর্মীরা মত প্রকাশ করেছেন।
সম্পত্তির উত্তরাধিকারে আদিবাসী পাহাড়ি নারী
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে সম্পত্তির ওপর আদিবাসী পাহাড়ি নারীর উত্তরাধিকার বিষয়ে সরাসরি কোনো কিছু বলা নেই। তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে “উপজাতীয় আইন ও সামাজিক বিচার” বিষয়টি যথাক্রমে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ [চুক্তির গ’ খণ্ডের ৯(ঙ) ধারা] এবং তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের আওতাধীন বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে [চুক্তির ‘খ’ খন্ডের ৩৪() ধারা] । এই ধারা বলে আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্পত্তির ওপর আদিবাসী পাহাড়ি নারীর উত্তরাধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে আদিবাসী পাহাড়িদের প্রথাগত সামাজিক আইনে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে এবং সম্পত্তির ওপর আদিবাসী পাহাড়িদের উত্তরাধিকার স্বত্ব নিশ্চিত করতে পারে । তবে এ ধরনের কোনো উদ্যোগ-আয়োজন এখনো দেখা যায়নি।
বাংলাদেশ সংবিধানে (১০, ১৯, ২৭, ২৮ এবং ২৯ নম্বর অনুচ্ছেদ) নারীপুরুষের সমঅধিকারের কথা বলা হয়েছে । কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী পরিবার ও সমাজে সমঅধিকার কাজ করে না বিশেষ করে সম্পদ ভোগের বেলায়। আদিবাসী পাহাড়ি সমাজে সাধারণভাবে একমাত্র পুত্রসন্তানরাই সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারে, নারীরা নয়। তবে বিশেষ ব্যবস্থাপনার সুযোগ আছে। পিতা যদি কন্যাসন্তানকে জীবদ্দশায় সম্পত্তি দিয়ে যান অথবা উইল করে যান তাহলে কন্যাসন্তানেরা সম্পত্তি পেতে পারে । অবশ্য বর্তমান সময়ে চাকুরিজীবী তথা উপার্জনকারী নারীরা নিজ প্রচেষ্টায় কোনো অর্থ বা সম্পত্তি অর্জন করলে সেই অর্থে বা সম্পত্তিতে তার অধিকার রয়েছে বলে মেনে নেয়া হয়।
ভূমির সাথে আদিবাসী নারীদের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। বিভন্নি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, কৃষিতে নারীদের অংশগ্রহণ প্রায় ৯০ শতাংশ; কিন্তু দুঃখজনক হলে ও সত্য, এই ভূমির ওপর আদিবাসী নারীদের অধিকাংশের মালিকানা নেই। আদিবাসী নারীদের অর্থনৈতিক দুরবস্থার পেছনে এই অসম উত্তরাধিকার ব্যবস্থা অন্যতম একিটি কারণ। এর ফলে পারিবারিক পরিধিতে পুরুষের ওপর নারীর নির্ভরশীলতা দৃঢ়ভাবে কায়েম হয়েছে। বৈষম্যমূলক উত্তরাধিকার আইন নারীর সার্বিক মুক্তিকে আরো বিঘ্নিত করেছে। কোনো কোনো জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে নারীরা সম্পত্তির অংশ পেলেও তা তাঁরা দখল কিংবা ভোগ করতে পারেন না।
স্বল্প জনসংখ্যাসম্পন্ন জনগোষ্ঠীসহ অধিকাংশ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উত্তরাধিকার অাইন নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক। আদিবাসী সমাজে কেবল পুত্রসন্তানরাই ভূ-সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। সাধারণত নারীরা পিতৃসম্পত্তির কোনো উত্তরাধিকার দাবি করতে পারেন না। এটার ব্যতিক্রম দেখা যায় কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলের মারমা জাতিগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে। মারমা সমাজে মায়ের সম্পত্তি মেয়ের পাওয়ার বিধান রয়েছে । কিন্তু স্বেচ্ছায় মারমা নারীরা তা পায় না । অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তা অর্জন করতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। তাই অনেকে পারিবারিক বিবাদ এড়ানোর জন্য সম্পত্তি দাবি করেন না।
আদিবাসী পাহাড়ি সমাজের প্রথাগত সামাজিক আইন অনুসারে সমাজসিদ্ধ নিয়মে বিবাহিত একজন স্ত্রী তাঁর স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণের খরচ পাবার অধিকারী হন। একজন পাহাড়ি নারী বিবাহের পূর্বে বা পরে স্বামীর সংসারে কিংবা পৈত্রিক অথবা মাতৃক সূত্রে কিংবা তাঁর আত্মীয় কর্তৃক দান বা উপহার হিসেবে কিংবা স্বোপার্জিত অর্থে সম্পত্তি ক্রয় অথবা লাভ করতে পারে। বিবাহের পূর্বে অজিত কোনে সম্পত্তির ওপর আইনত নিরঙ্কুশ মালিকানাস্বত্ব ও অধিকার স্ত্রীর থাকে। বিবাহের পর একজন নারী স্বামীর পরিবারের পদবি ও মর্যাদার অধিকারী হন।
স্বামী নিষ্ঠুর প্রকৃতির হলে, স্ত্রীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করলে, স্বামী দ্বতীয় স্ত্রী গ্রহণের কারণে সতীনের সাথে একসঙ্গে সংসারে অবস্থান বা বসবাসে অসম্মত হলে, সেক্ষেত্রে প্রথম স্ত্রী স্বামীর ভিটায় নিরাপদ অবস্থানে অথবা স্বামীর বক্তসম্পৰ্কীয় আত্মীয়ের পৃথকান্নে থেকে স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ লাভের অধিকারী হন অথবা সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পিত্রালয়ে অবস্থান করে স্বামীর কাছ থেকে খোরপোষ লাভের অধীকারী হন । বিবাহের পর স্বামী বৈবাহিক সম্পর্ককে অগ্রাহ্য করলে বা অব্যাহত না রাখলে অথবা ভরণপোষণ প্রদানে বিরত থাকলে স্ত্রী তার দাম্পত্য সম্পর্ক ও দাবি পুনরুদ্ধারের জন্য সমাজপতি বা কার্বরিী-হেডম্যান আদালতে মামলা করার অধিকার রাখেন। স্বামীর দ্বিতীয় বা একাধিক বিবাহের ক্ষেত্রে আপত্তি করার অধিকার রাখেন। পক্ষান্তরে স্বামী যদি পুরুষত্বহীন বা নপুংশক হন অথবা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন কিংবা মানসিক ভারসাম্যহীন হন, সেক্ষেত্রে স্ত্রী সমাজপতি বা কার্বারী-হেডম্যান আদালতের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ সম্পাদনের অধিকারী হন।৩১
রাঙ্গামাটি জেলা আদালতের অ্যাডভোকেট প্রতীম রায় পাম্পর মতে, সার্কেলভেদে আদিবাসী সমাজে বৈষম্যমূলক প্রথার প্রচলন রয়েছে। যেমন চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, খুমী জাতিগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে কেবল পুরুষসন্তানরা আইনগত উত্তরাধিকার লাভ করে এবং পুত্রসন্তানের অবর্তমানে কন্যাসন্তানরা পৈত্রিক সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারিত্ব লাভ করেন। লুসাই ও পাংখো জাতিগোষ্ঠীতে পুত্রসন্তানের অবর্তমানে স্ত্রী ও কন্যাসন্তানরা সম্পত্তির উত্তরাধিকারিত্ব লাভ করেন না। সেক্ষেত্রে পিতৃকুলের পুরুষ সদস্যরা মালিকানা লাভ করে থাকেন। আবার বোমাং সার্কেলের মারমা জাতিগোষ্ঠীর কন্যাসন্তানরা পৈত্রিক সম্পত্তির এক-চতুর্থাংশ লাভ করলেও চাকমা ও মং সার্কেলের মারমা জাতিগোষ্ঠীর কন্যাসন্তানেরা কোনো উত্তরাধিকত্ব লাভ করেন না। অন্যদিকে বান্দরবান জেলার ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর রিয়াং ও উসুই গোত্রের সদস্যদের মধ্যে মৃতের সম্পত্তিতে স্ত্রী এবং পুত্র ও কন্যাসন্তানদের সমান অংশ লাভের বিধান রয়েছে। পক্ষান্তরে রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলার ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর বেলায় কোনো কোনো গোত্রের নারীরা সম্পত্তির উত্তরাধিকার লাভ করেন না।
প্রতীম রায় পাম্পু আরো বলেন, চাক জাতিগোষ্ঠীতে পুত্রসন্তানের সাথে স্ত্রীও সম্পত্তির উত্তরাধিকার লাভ করলেও কম্পত্তির উত্তরাধিকার ।ন্যাসন্তানরা কোনো সম্পত্তি লাভ করেন না। আবার খিয়াং জাতিগোষ্ঠীর বেলায় সম্পত্তিতে স্ত্রী, পুত্র ও কন্যাসন্তানরা সমানহারে মালিকানা লাভ করে থাকেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী সমাজের উপরোল্লিখিত বৈষম্যমূলক উত্তরাধিকার প্রথা পর্যালোচনা করলে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, বৈষম্যমূলক উত্তরাধিকার প্রথা আদিবাসী পাহাড়ি নারীর সার্বিক মুক্তিকে বিক্রিত বিঘ্নিত করছে; জানান অ্যাডভোকেট প্রতীম রায় পাম্পু।
উল্লেখ্য যে, উত্তরাধিকার বা পিতৃত্ব দাবি মামলাগুলো পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন অনুযায়ী জজ কোর্টে নিষ্পত্তি হওয়া সত্ত্বেও ভূমি আপিল বোর্ড ও উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। মামলার দীর্ঘসূত্রিতা ও নারী-প্রতিকূল আইনি ব্যবস্থার কারণে সহায় সম্বলহীন নারীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হন বেশি।
প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থায় আদিবাসী পাহাড়ি নারী
নারীও পরিবেশের সম্পর্ক চিরকালের। সামাজিক বনায়ন, বাণিজ্যিক বনায়ন, ইকোপার্ক ইত্যাদি কারণে পরিবেশের যে বিপর্যয় ঘটছে তার সবচয়ে বড়ো শিকার বাংলাদেশের আদিবাসী নারী। পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে বাঙালি নারীর তুলনায় আদিবাসী নারীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত কারণ তারা জ্বালানি খাবার (পাহাড়ি আলু, বাঁশের কচি) সংগ্রহ করতে অনেকটাই বনের ওপর নির্ভরশীল। আদিবাসী নারীরা বনের ওপর বেশিমাত্রায় নির্ভরশীল হওয়ার কারণে বন পরিবেশ ধবংসের প্রধান শিকার হছেন তাঁরাই। যে বন ছিল আদিবাসী মানুষের তথা আদিবাসী নারীর স্বাধীন বিচরণভূমি,সেখানে আজ তারা অধিকারহীন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। বাণিজ্যিক কারণে পাহাড়ে ফলনের পরিবর্তন হচ্ছে। আগে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে আনারসের চাষ হতো দেখা যেত, আনারসের পাশাপাশি ওই পাহাড়গুলোতে অন্যান্য ফলজ বনজ ও ঔষধি গাছ জন্মাত। কিন্তু বর্তমানে অধিক মুনাফা পাওয়ার আশায় এসব পাহাড়ে ইউকিলিপটাস, অ্যাকেশিয়া, কলা, তামাকসহ ব্যাপক হারে বিদেশী গাছলাগানো হয়েছে। অন্যদিকে পারিবারিক আয়ে নারীর যে ভূমিকা (জালানি, ঔষধ, খাবার) তাতে এই পরিস্থিতি মারাত্মক কুপ্রভাব ফেলছ।৩২
অনেকেই তাদের ঐতিহ্যগত আয়ের পথ ছেড়ে স্বল্প মজুরির নির্মাণ শ্রমিক বা অন্য কোনো কাজ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে। যার সাথে তার পূর্ব পরিচিতি ছিল না। এখানে নারী-পুরুষের ভূমিকা দুইরকম। পুরুষেরা অর্থ উপার্জনের জন্য প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করছেন, অন্যদিকে নারী বন ধ্বংসের কারণে জীবনধারণের জন্য আরো কঠোর পরিশ্রম করছেন। যার ফলে নারী শারীরিক ও মানসিকভাবে হচ্ছেন নিপীড়িত ও নির্যাতিত। বন-ভূমি-জলের সাথে নারীদের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। তাই বন-ভূমি-জলমহাল হারানোর প্রভাব আদিবাসী নারীদের ওপর পড়ে সবচেয়ে বেশি।
সামরিক কাজে পাহাড়ভূমি
সামরিক কাজে ব্যবহারের জন্য সরকার কেবল বান্দরবান পার্বত্য জেলায়ই ৭৫,৬৮৬ একর পাহাড়ভূমি অধিগ্রহণ করেছে।৩৩ এই অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সাথে কোনো আলোচনা হয়নি। আইন অনুসারে পার্বত্য জেলা পরিষদের পূর্বানুমোদন ব্যতিত কোনো ভূমি অধিগ্রহণ করা যায় না। ক্ষতিগ্রস্তরা অভিযোগ করেছে যে, অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। তাদের সাথে কোনো আলোচনা করা হয়নি। এই অধিগ্রহণের ফলে হাজার হাজার আদিবাসী অধিবাসী নিজ বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ হয়ে পড়ছেন এবং প্রথাগত জুমভূমি হারিয়ে তাদের জীবন-জীবিকা বিপন্ন হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে বিশেষ করে রুমা সেনানিবাস ও সুয়ালক গোলভাজ ও পদাতিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের জন্য অধিগ্রহণকৃত ভূমি থেকে শত শত আদিবাসী পাহাড়ি ও স্থায়ী বাঙালি অধিবাসী উচ্ছেদ হওয়া ও তাদের মানবেতর জীবন সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় অনেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
ভূমি ইজারা ও জুমভূমি
আদিবাসী জীবনযাত্রার ওপর মারাত্ৰাক বিরুপ প্রভাব সৃষ্টিকারী একটি পদক্ষেপ হলো পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে বাঙালি অধিবাসীদের কাছে বাণিজ্যিক উদেশ্যে বা শিল্প স্থাপনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে পাহাড়ভূমি ইজারা প্রদান। কেবল বান্দরবান জেলায়ই ৪০,০৭৭ একর ভূমির ১৬০৫টি প্লট ইজারা প্রদান করা হয়েছে বহিরাগতদের কাছে।৩৪ এই পাহাড়ভূমিগুলো ছিল মূলত আদিবাসীদের জুমজমি ও যৌথ মৌজা বন। ইজারা প্রদানের ফলে শত শত আদিবাসী পরিবার প্রথাগত জুমচাষ ও গৃহস্থালীর জন্য বনজ সম্পদ আহরণা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সার্বিকভাবে তাদের জীবনযাত্রা বিপন্ন হয়ে পড়ছে। ভূমি ইজারাদাররা আদিবাসী জুমচাষীদের জুমচাষে বাধা দিচেছ এবং তাদের ওপর সন্ত্রাসা দিয়ে হামলা করছে। ইজারা নেয়া এসব পাহাড়ভূমির বরাতে ইজারাদাররা ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ নিয়েছে। তারা ইজারা নিলেও অধিকাংশ পাহাড়মি অনাবাদি অবস্থায় রেখেছে অথবা চুক্তি ভঙ্গ করে অন্য কাজে ব্যবহার বা অন্যের নিকট অবৈধভাবে বিক্রি করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুযায়ী এসব ইজারা বাতিলের বিধান রয়েছে। কিন্তু সরকার আজ অবধি এই বিধান কার্যকর করেনি। পক্ষান্তরে এই বিধান লঙ্ঘন করে তিন পার্বত্য জেলার জেলা প্রশাসকরা এখনো ইজারা প্রদান অব্যাহত রেখেছেন।৩৫
সংরক্ষিত বন ঘোষণা ও জুমভূমি
বনবিভাগ পার্বত্য চট্টগ্রামের রক্ষিত ও অশ্রেণিভুক্ত বনাঞ্চলের ২,১৮,০০০ একর ভূমি রিজার্ভ ফরেস্ট হিসেবে ঘোষণা করে। এসব ভূমির মধ্যে প্রান্তিক আদিবাসী কৃষকের রেকর্ডীয় বসতভিটা ও পাহাড়ভূমি, বন্দোবস্তী প্রক্রিয়াধীন কৃষিজমি এবং যৌথভাবে ব্যবহৃত ঐতিহ্যগত বন ও চারণভূমি রয়েছে। এই সংরক্ষিত বন ঘোষণার ফলে এ অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর জীবনধারার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। অশ্রেণিভুক্ত বনাঞ্চলাকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণার বিরুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীরা তীব্র বিরোধিতা করে আসছে। উক্ত ঘোষণা বাতিলের দাবি নিয়ে ১৯৯৮ সালের আগস্টে আদিবাসী নেতৃবৃন্দ তৎকালীন বন ও পরিবেশ মন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। মন্ত্রী মহোদয় সেসব ঘোষণা স্থগিতকরণের প্রতিশ্রুতি দিলেও তা এখনো কার্যকর করা হয়নি।
বন ব্যবস্থাপনা
পার্বত্য চটগ্রাম চুক্তির খ খণ্ডের ৩৩ নম্বর ধারায় পার্বত্য জেলা পরিষদের কার্যাবলি হিসেবে “সরকার কর্তৃক রক্ষিত নয়। এই প্রকার বন সম্পদ উন্নয়ন ও সংরক্ষণ” বিষয়টি হস্তান্তরের বিধান করা হয়। পার্বত্য জেলা পরিষদের এই হস্তান্তরিত বিষয়টিও এখনো কার্যকর করা হয়নি। এই ধারা অনুযায়ী রক্ষিত বন ব্যতীত অন্য সকল বন যথা সংরক্ষিত ও অশ্রেণিভুক্ত বন জেলা পরিষদের আওতাধীন বিষয়। কিন্তু বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে লজন করে কেবল অশ্রেণিভুক্ত বনকে পার্বত্য জেলা পরিষদের এবং রক্ষিত ও সংরক্ষিত বনকে বনবিভাগের আওতাধীন বলে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে সাধুলার জারি করা হয়েছে। এটা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনেরই বরখেলাপ। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুসারে জনপ্রতিনিধিত্ব তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে বন ও পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়টি হস্তান্তরিত না হওয়ার কারণে এই ধ্বংসযজ তরান্বিত হয়েছে বলে অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেন। যার প্রত্যক্ষ ভুক্তভোগী হচ্ছেন আদিবাসী নারী সমাজ।
সামাজিক বনায়ন ও পাহাড়ি নারী
বন ধ্বংস রোধকল্পে সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। তন্মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সামাজিক বনায়ন প্রকল্প। সরকার ব্রিটিশ আমলে প্রবর্তিত ১৯২৭ সালের বন আইন সংশোধন করে ২০০০ সালে, যা বন (সংশোধন) আইন নামে পরিচিত। বনের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য করা হলেও এই আইনকে পরিবেশবিরোধী এবং গণবিরোধী বলে ব্যাপকভাবে সমালোচনা করা হয়। এই আইনে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি এবং আদিবাসীদের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ও ভূমি অধিকারের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নেয়া হয়নি। সংশোধিত বন আইনের ২৮(৪) ও ২৮(৫) ধারা অনুসারে সামাজিক বনায়ন বিধিমালা ২০০৪ প্রবর্তন করা হয়। এই বিধিমালায় সামাজিক বনায়ন প্রকল্পে সুবিধাভোগী হিসেবে ভূমিহীন ব্যক্তি ও দুস্থ নারীদের পাশাপাশি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে বলে বিধান করা হয়। কিন্তু আইনে তাদেরকে ভূমির অধিকার প্রদানের কোনো বিধান নেই এবং বনবিভাগের কর্মকর্তাদের এতই ক্ষমতা দেয়া হয়েছে যে, তাদের মর্জির ওপর নির্ভর করবে সুবিধাভোগীদের ভবিষ্যৎ। যে কোন মুহূর্তে যেকোনো অজুহাতে বনবিভাগের কর্মকর্তারা সুবিধাভোগীদের বাদ দিয়ে দিতে পারবেন।৩৬
বনবিভাগের হয়রানি ও পাহাড়ি নারী
আদিবাসীরা বনবিভাগের নানা হয়রানির শিকার হন। তার অন্যতম হচেছ হয়রানিমূলক মামলার শিকার হওয়া। প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর আদিবাসীদের অধিকার কিংবা বনজ সম্পদ আহরণে আদিবাসীদের প্রথাগত অধিকার বন আইনে স্পষ্টভাবে স্বীকৃত না থাকার কারণে বা বনবিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এ ধারণা না থাকার কারণে আদিবাসীরা এরকম হয়রানির শিকার হন। বনজ সম্পদ উজাড় করার জন্য কখনই আদিবাসীরা দায়ী নন, কিন্তু বনকর্মকর্তারা বনের সম্পদ লুণ্ঠন করার জন্য আদিবাসীদের নির্যাতন করেন; মিথ্যা মামলায় জড়িত করে হয়রানি করেন। একজন আদিবাসীর বিরুদ্ধে শত শত মামলা দায়ের করার ঘটনাও ঘটেছে। শুধু তাই নয়, পার্বত্য চটগ্রাম চুক্তির পর অসংখ্য আদিবাসীর জীবন অকালে ঝরে গেছে বনরক্ষীদের গুলিতে। আদিবাসীদের ওপর বনবিভাগের এ ধরনের নির্যাতন সমতল ও পাহাড়ি উভয় অঞ্চলেই দেখা যায়।
ভূমি ব্যবস্থাপনা ও ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে পার্বত্য জেলার এলাকাধীন বন্দোবস্তযোগ্য খাসজমিসহ কোনো জায়গা-জমি পরিষদের পূর্বানুমোদন ব্যতিরেকে ইজারা প্রদানসহ বন্দোবস্ত, ক্রয়, বিক্রয় ও হস্তান্তর না করা এবং সরকার কর্তৃক অধিগ্রহণ ও হস্তান্তর না করার বিধান করা হয়েছে। ‘ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা’ পার্বত্য জেলা পরিষদের আওতাধীন বিযয় করা হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে একটি ভূমি কমিশন গঠন করে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি তথা বসতি স্থাপনকারী বাঙালি কর্তৃক জবরদখলকৃত আদিবাসী পাহাড়িদের ভূমি প্রত্যর্পণের বিধান করা হয়েছে। অধিকন্তু চুক্তিতে রাবার চাষ ও অন্যান্য উদ্দেশ্য অস্থানীয়দের কাছে বরাদ্দ প্রদানকৃত জমি ইজারা বাতিল করার বিধান করা হয়েছে।
কিন্তু এসব কোনো বিষয়ই এখনো কার্যকর করা হয়নি। আজ অবধি পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা হস্তান্তর করা হয়নি। পার্বত্য জেলা পরিষদের আইনকে অগ্রাহ্য করে প্রশাসকরা নামজারি, অধিগ্রহণ, ইজারা ও বন্দোবস্ত প্রদান প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছেন। অপরদিকে ভূমি কমিশন ভূমি নিষ্পত্তির জন্য বিগত ১২ বছরেও কোনো কাজ শুরু করেনি। আওয়ামী লীগ সরকারে।আমলে “পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১” প্রণীত হয়। কিন্তু উক্ত আইনে চুক্তির সাথে বিরোধাত্মক ১৯টি ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা আজও সংশোধিত হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে ভূমি, বন ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংক্রান্ত সমস্যাগুলো দিন দিন জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। ভূমি ও বন নিয়ে বিরোধের কারণে এ অঞ্চলের হরহামেশাই সাম্প্রদায়িক হামলা ও উত্তেজনা দেখা দেয়। আদিবাসী পাহাড়ি গ্রামে হামলা, অমিসংযোগ, হত্যা,ধর্ষণ, অপহরণের মতো অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে চলেছে। আর এতে আদিবাসী পাহাড়ি নারীরাই প্রত্যক্ষভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছেন।
২০০৬ সালের মহালছড়ির মাইসছড়ি এলাকায় ভূমি দখলের উদ্দেশ্যে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলায় ৪ জন আদিবাসী নারী ধর্ষণের ঘটনার খবর এসেছে পত্রপত্রিকায়। অতিসম্প্রতি ৩ সেপ্টেম্বর ২০০৯ খাগড়াছড়ি জেলার সিন্দুকছড়ি এলাকায় বাগান-ভূমি দখলের উদ্দেশ্যে ভূমির মালিক বিভিষণ ত্রিপুরার স্ত্রী পণেমালা ত্রিপুরাকে (৫০) অপহরণের পর হত্যা করা হয়। বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশের মতো পার্বত্যঞ্চলের আদিবাসী নারীদের ওপর সংঘটিত নির্যাতনের অন্যতম কারণ হলো জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা। এ ধরনের সহিংসতা আদিবাসী নারীদের নিরাপত্তাহীনতাকে চরমভাবে প্রভাবিত করে আসছে।
আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রান্তিকীকরণ সত্ত্বেও আদিবাসী নারীরা বিশেষ করে কৃষি উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিক পালন করে। আদিবাসী নারীদের ওপর বিশ্বায়নের প্রতিক্রিয়া সুদূরপ্রসারী। বংশানুক্রমিক আবাস-এলাকা থেকে সশরীরে স্থানান্তর অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করে। অন্যান্যদের মধ্যে বাণিজ্যিক বনায়ন, কাঠ আহরণ, বাঁধ নির্মাণ ও জ্বালানি প্রকল্প ইত্যাদির মাধ্যমে ও বিশ্বায়নের আগ্রাসন ব্যাপকতর হচ্ছে। ভূমি হারানোর ফলে আদিবাসী নারীরা হারিয়ে ফেলেছেন প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণও, জন্মলগ্ন থেকেই যা তাদের বেঁচে থাকার মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে।৩৭
এখনো অনেক পরিবারে নারীদেরকে কেবল বুনন, রান্নাবান্না, সন্তান লালনপালন, গৃহস্থালির কাজের উপযোগী বলে বিবেচনা করা হয় । পারিবারিক ও সামাজিক বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পুরুষের প্রধান্য আদিবাসী নারীর তুলনায় অনেক বেশি। তবে বিভিন্ন বৈষম্য সত্ত্বেও পাহাড়ি সমাজে নারীদের গুরুত্ব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৈষম্যমূলক অনেক প্রাচীন প্রথা ধীরে ধীরে অপসৃত হচ্ছে। বিভিন্ন পেশায় ও সংস্থায়ও নারীর অংশগ্রহণ গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হচ্ছে।
আদিবাসী সমাজে আয়বৃদ্ধিমূলক কর্মকান্ডে পুরুষের তুলনায় নারীদের সম্পৃক্ততা অনেক বেশি। কিন্তু পরিবারে, সমাজে ও জাতীয় অর্তনৈতিক কর্মকান্ডে নারীদের অবদান আজো অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মতে, বিশ্বের ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সি ৪৫ শতাংশ নারী এখন অর্থনৈতিকভাবে সক্রিয় এবং মুসলিম দেশগুলোতে নারীর শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ সামাজিক ও ধর্মীয় কারণে নিরুৎসাহিত করা হলেও এ ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ও শ্রমবাজারে নারীর ক্রমর্ধমান উপস্থিতি সত্বেও আদিবাসী নারীর অর্থনৈতিক অধিকার এখন ও নিশ্চিত হয়নি। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নারীল অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে আদিবাসী পাহাড়ি নারী আজো বহুমুখী বঞ্চনা শিকার হচ্ছেন। যেমন ১. অসম মজুরি, ২.প্রশিক্ষণের অসম সুযোগ, ৩. ঋণ ও উৎপাদনমূলক কাজে সম্পদ লাভের অসম সুযোগ, ৪. পেশা নির্দিষ্টকরণ/বিভাজন ইত্যাদি। এছাড়াও বিশ্বের সর্বত্র এখনো নারীর কাজ বা পুরুষের কাজ চিহিত করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও শ্রমকে লিঙ্গীয় ভিত্তিতে বিভাজন করা হয়ে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়, যা আদিবাসী পাহাডি নারীদের প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছে।৩৮
উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে আদিবাসী পাহাড়ি নারী
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সাক্ষরের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারি উন্নয়নের পাশাপাশি বেসরকারি উন্নয়নের ক্ষেত্র হিসেবে পার্বত্য চটগ্রাম ডিজিক স্থানীয় বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা (এনজিও) গড়ে উঠে। তারই অংশ হিসেবে অনেক বেসরকারি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও পার্বত্য চট্টগ্রামে জন্মলাভ করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নারী সংগঠনের মধ্যে খাগড়াছড়ি জেলার খাগড়াপুর মহিলা কল্যাণ সমিতি, মিলনপুর মহিলা কল্যাণ সমিতি ও আনন্দনগর মহিলা কল্যাণ সমিতি, রাঙ্গামাটি জেলার গর্জনতলী মহিলা সমিতি, জুমবী মহিলা কল্যাণ সমিতি, সংবী মহিলা কল্যাণ সমিতি, পেরাছড়ি মহিলা কল্যাণ সমিতিও রান্যা নারী সংঘ এবং বান্দরবান জেলায় বলিপাড়া নারী কল্যাণ সমিতি ও অন্যান্য নারী কল্যাণ সংগঠন সক্রিয়ভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া আরো অনেক আদিবাসী পাহাড়ি নারী সংগঠন রয়েছে, যারা নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। আরার এমনও কিছু সংগঠন আছে, যাদের কোন সক্রিয় প্রকল্প নেই।
এসব নারী সংগঠন নারীসমাজের সক্ষমতা গড়ে তোলা, তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলা, নারীর শিক্ষা প্রসার, নারীর স্বাস্থ্যসেবা ও পরিচর্যা, নারীর কর্মসংস্থান, গ্রামীণ দুস্থ নারীর আয়বর্ধকমূলক ও আত্মকর্মসংস্থানমূলক কাজে উৎসাহিত করা, পাহাড়ি নারীর ওপর চলমান পারিবারিক, সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলা ইত্যাদি কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ডানিডা, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের পার্বত্য চট্টগ্রাম পল্লি উন্নয়ন প্রকল্প, জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন নারী উন্নয়ন সংগঠন ও সহযোগী সংগঠনসহ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠীর অর্থায়নে এসব আদিবাসী পাহাড়ি নারী সংগঠনগুলো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চলেছে। বিশেষ করে ডানিডা, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের অনুকূলে এসব কর্মসূচি-সহায়তা দিয়ে চলেছে বলে দাবি করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সাক্ষরের বদৌলতে বেসরকারি উন্নয়নের অনুকূল পরিবেশ গড়ে ওঠার ফলেই এসব নারী সংগঠনের জন্ম এবং কাজের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। কাজেই উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে স্বেচ্ছাসেবী নারী সংগঠনসহ বেসরকারি উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিরই প্রত্যক্ষ ফসল বলে অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি-উত্তরকালে সীমিত পরিসরে হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক উন্নয়নে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের নারী সদস্য, ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী সদস্য, উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান, পৌরসভার সংরক্ষিত নারী কমিশনারদের অংশগ্রহণ রয়েছে এবং নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তারা যথাসাধ্য ভূমিকা পালন করে চলেছেন।
তিন পার্বত্য জেলায় সরকারের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরও কাজ করে যাচ্ছে। এই অধিদপ্তর মূলত নারীর অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জনের জন্য সেলাই ও কম্পিউটার প্রশিক্ষণ,ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম, দল (সমিতি) গঠন, বিধবা ভাতা ইত্যাদি কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। তিনি পার্বত্য জেলা পরিষদ ও ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন, সমাজসেবা বিভাগ ও সমবায় বিভাগের মাধ্যমে নারীর অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতা অর্জনের জন্য নানা প্রশিক্ষণ ও প্রকার বাস্তবায়ন করে চলেছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে আদিবাসী পাহাড়ি নারীদের জন্য পৃথক প্রকল্প না থাকলেও এতে আদিবাসী পাহাড়ি নারীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে রয়েছে।
১৯৯১ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে, নারীর অংশগ্রহণ দেশের ৬.৭০ শতাংশের বিপরীতে পার্বত্য চট্টগ্রামে ১২.৬৭ শতাংশ।৩৯ এক্ষেত্রে আদিবাসী পাহাড়ি নারী ও বাঙালি নারীদের মধ্যে পৃথক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, জাতীয় স্তর থেকে প্রায় দ্বিগুণ হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ উৎপাদন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে আদিবাসী পাহাড়িদের ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনপিডি)-এর প্রোমোশন অব ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কনফিডেন্স বিল্ডিং প্রকল্পে নারীর ক্ষমতায়ন ও সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংগঠন নেটওয়ার্ক গঠনে সহায়তা দিছে। এ প্রকল্পের অধীনে এ যাবৎ মূলত প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক কাজ বাস্তবায়ন চলছে। নারীর সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বিশ্ব খাদ্য সংস্থার গ্রামীণ সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ, ভিজিডি, নগদ অনুদান ইত্যাদি প্রকল্পগুলোর উপকারভোগী হছেন নারীরা।
বান্দরবান জেলার অনন্যা নারী সংগঠন আদিবাসী নারী উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। খাগড়াছড়ি জেলার খাগড়াপুর মহিলা কল্যাণ সমিতি আদিবাসী পাহাড়ি নারীর ক্ষমতায়ন, সক্ষমতা বৃদ্ধি ওসহিংসতা প্রতিরোধ ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে এবং এসব প্রকল্পের মোট ১৪০৫ জন নারী উপকার লাভ করেছে। রাঙ্গামাটি জেলার গর্জনতলী মহিলা কল্যাণ সমিতি স্বাস্থ্য ও ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রোগ্রেসিভ কোমর তাত প্রকল্প পরিচালনা করছে। স্থানীয় সাধারণ এনজিও, যেমন জাবারাং তৈমু, গ্রাউস ও হিলে হিলি নারীদের জন্য আকর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা ও ক্ষমতায়ন ইত্যাদি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
কর্মসংস্থানে আদিবাসী পাহাড়ি নারী
সংবিধানের ২৯(২) অনুচ্ছেদের ’ক’ উপধারায় বলা হয়েছে যে, নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশ যাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারে, সে উদ্দেশ্যে তাদের অনুকলে বিশেষ বিধান প্রণয়ন করা হতে রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করবে না।
সংবিধানে উক্ত অনুচ্ছেদ বলে সরকারি চাকুরিতে আদিবাসীদের জন্য ৫% কোটা সংরক্ষিত আছে। কিন্তু তা যথাযথভাবে কার্যকর করা হয় না। ১৯৭২ থেকে এ যাবৎ বিসিএস-এর ২২টি ব্যাচে মোট ২৯,৬৬৭ জন ক্যাডার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ৫ শতাংশ হারে হিসাব করলে মোট ১,৪৮৩ জন আদিবাসী ব্যক্তি নিয়োগ পাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে এই সংখ্যা অনেক অনেক নিচে। বলাই বাহুল্য যে, এক্ষেত্রে আদিবাসী নারীদের নিয়োগের চিত্র আরো হতাশাব্যঞ্জক।৪০
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে আদিবাসী পাহাড়ি নারীদের চাকুরি ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সরাসরি কোনো বিশেষ বিধান নেই। তবে পার্বত্য চুক্তির ‘ঘ’ খণ্ডের ১০ নম্বর ধারায় আদিবাসী পাহাড়িদের জন্য সরকারি চাকুরিতে কোটা ব্যবস্থা বহাল রাখার বিধান করা হয়েছে। এছাড়া চুক্তির ’ঘ’ খণ্ডের ১৮ নম্বর ধারায় পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল সরকারি, আধা-সরকারি, পরিষদীয় ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের সকল স্তরের কর্মকর্তা ও বিভিন্ন শ্রেণির কর্মচারী পদে পাহাড়িদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পার্বত্য চটগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়োগের বিধান রয়েছে।
তবে এই বিধান থাকলেও তা যথাযথভাবে কার্যকর হচ্ছে না। সংস্থাপন মন্ত্রণালয় কর্তৃক উক্ত বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিধিমালা ও প্রবিধানমালায় আন্তর্জাতির লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ থেকে প্রস্তাব করা হয় এবং পার্বত্য চটগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ প্রদান করা হয়। কিন্তু উক্ত বিষয় সংশ্লিষ্ট সকল বিধিমালা ও প্রবিধানমালায় এখনো অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি এবং বাস্তবক্ষেত্রেও অদ্যাবধি অনুসরণ করা হয়নি। ফলে এখনো পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভন্ন চাকুরিতে বহিরাগতরা নিয়োগ লাভ করে চলেছে, যার সরাসরি ক্ষতির শিকার হচ্ছে আদিবাসী পাহাড়ি নারীরা।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মতে, বিশ্বের শতকরা ৪৫ জন নারী এখন অৰ্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়। এর মধ্যে আদিবাসী নারীরা অংশগ্রহণ করে শতকরা ৯০ শতাংশ কৃষিতে। বলাবাহুল্য, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও শ্রমবাজারে নারীর ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি সত্ত্বেও নারীর অর্থনৈতিক অধিকার এখনো নিশ্চিত হয়নি। ফলে দেখা যায়, অসম মজুরি, ঋণ ও উৎপাদনমূলক সম্পদ লাভের অসম সুযোগ, পেশার বিভাজন। অর্থনৈতিক অসাম্য ও বৈষম্যমূলক সামাজিক আচরণ সমাজে নারীদের অধীনস্থ অবস্থাকেই পাকাপোক্ত করে।
আদিবাসী নারীরা অর্থনৈতিকভাবে মোটেও স্বাবলম্বী নন। পরিবারে নারীকে একাধারে স্ত্রী, মাতা, অর্থ উপার্জনকারী হিসেবে ভূমিকা পালন করতে হয়। সন্তান জন্মদান, সন্তানের পরিচর্যা থেকে শুরু করে গৃহস্থালি কাজকর্ম, কৃষি/জুমচাষ, সর্বোপরি কাপড় বোনাসহ সব কাজই নারীকে করতে হয়। কিন্তু দেখা যায়, সকল কাজ করার পরও, বাজারে অভিগম্যতা থাকার পরেও পুরুষতান্ত্রিকতার বেড়াজাল থেকে নারীরা বের হয়ে আসতে পারেননি। পরিবারের সকল সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় পুরুষের মতামতকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। দেশে নারী-পুরুষের মধ্যে মজুরি বৈষম্য প্রকট। আদিবাসীদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা আরো মারাত্মাক। একই ধরনের পরিশ্রম করার পর নারী পান পুরুষের অর্ধেক মজুরি।
যেহেতু শিক্ষাক্ষেত্রে আদিবাসী জনগোষ্ঠী পিছিয়ে আছে, তাই চাকুরিতে এখনো সংখ্যায় তারা খুবই নগণ্য। তারপরও বর্তমানে অফিস আদালাতে আদিবাসীদের উপস্থিতি যতটাই দেখা যায়, সেখানে আদিবাসী নারী একেবারেই হাতে গোনা। বিশ্বায়নের ফলে ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় আদিবাসী জনগোষ্ঠী বিশেষ করে নারীরা কাজের সন্ধানে শহরমুখী হয়েছে।৪১ জানা যায় যে, চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াজাত অঞ্চলসহ চটগ্রামের বিভিন্ন শিল্পকারখানায় প্রায় ২০,০০০ পাহাড়ি শ্রমিক কর্মরত আছে। অপরদিকে কেবল ঢাকার সাভারে অবস্থিত রপ্তানি প্রক্রিয়াজাত অঞ্চলসহ ঢাকা অঞ্চলের বিভিন্ন শিল্পকারখানায় প্রায় ৭ থেকে ১০ হাজার পাহাড়ি শ্রমিক কর্মরত আছে। এসব পাহাড়ি শ্রমিকদের প্রায় অর্ধেকের বেশি নারী। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ঢাকা ও চট্টগাম ইপিজেডসহ দেশের বিভিন্ন গার্মেন্ট কারখানায় পার্বত্য চটগ্রামের নারীদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিজ সমাজ, সংস্কৃতি, পরিবেশ ও আত্মীয়স্বজন দূরে থাকার ফলে এদের ওপরে সামাজিকভাবে নানা বিরূপ প্রভাব পড়ছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। এছাড়া ব্যাপকভাবে না হলেও কিছু ক্ষেত্রে বাঙালি সহকর্মী দ্বারা এরা যৌন হয়রানিসহ নানা বিরূপ আচরণের সম্মুখীন হয়ে থাকে।
এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, দেশে অদিবাসী নারীদের জন্য নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে চাকরির চাহিদা তৈরি হয়েছে। যেমন বিউটিগার্ল হিসেবে বিউটি পার্লার, সেবিকা হিসেবে হাসপাতাল ও ক্লিনিক এবং রিসেপসনিষ্ট হিসেবে বেসরকারি অফিস-আদালত প্রভৃতিতে। কিন্তু এসব কাজে তাদের কম পারিশ্রমিক দেয়া হয়। এর ফলে পাহাড়ি নারীরা একদিকে যেমন মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, অন্যদিকে তারা হারাচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা। তারা পরিবারে সাচ্ছলতা আনার জন্য দিনরাত পরিশ্রম করছে, কিন্তু তাদের প্রতি সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি মোটেও সুখকর নয়।৪২
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে নারী শিক্ষকদের প্রাধান্য দেয়া হয়। কিন্তু এতে পার্বত্য চট্টগ্রামের নারীরা জাতীয় পর্যায় থেকে পিছিয়ে আছে। ২০০১-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী জাতীয় পর্যায়ে নারী শিক্ষকের হার ৩৭.৬৪ শতাংশ, আর এর বিপরীতে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের আওতাধী পার্বত্য চটগ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে নারী শিক্ষকের হার ২৮.৯৬ শতাংশ। ২০০১ এর পরিসংখ্যান অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মোট ৩,৩৪৪ জন শিক্ষকের বিপরীতে নারী শিক্ষক মাত্র ৯৫৭ জন।৪৩ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পর রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদ কর্তৃক ১৯৯৯-২০০৮ সালের মধ্যে মোট ১০৮ জন প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তন্মধ্যে ৩৫ জন নারী শিক্ষক। সহকারী শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে ৮৮৮ জন, তন্মধ্যে নারী শিক্ষক ৪৫৮ জন। উক্ত পরিসংখ্যানে আদিবাসী পাহাড়ি নারী শিক্ষক ও বাঙালি নারী শিক্ষকের পৃথক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে বাস্তব অভিজ্ঞতায় বাঙালি নারী শিক্ষকের চেয়ে আদিবাসী পাহাড়ি নারী শিক্ষকের হার অনেক বেশি হবে বলে অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেন।
বান্দরবান জেলার অন্যান্য নারী সংগঠন, খাগড়াছড়ি জেলার খাগড়াপুর মহিলা কল্যাণ সমিতি, রাঙ্গামাটি জেলার গর্জনতলী মহিলা কল্যাণ সমিতি ও প্রোগ্রেসিভ এই চারটি নারী সংগঠনে পরিচালক পদে মোট ২৩ জন নারী কর্মরত রয়েছেন এবং কর্মী পদে মোট ৯৬ জনের মধ্যে ৪৯ জন নারী কাজ করছেন। এছাড়া স্থানীয় সাধারণ এনজিওর মধ্যে তৃণমূল, জাবারাং, তৈমু, গ্রাউস ও হিলেহিলি’র স্টাফ সংখ্যা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, পরিচালক পদে মোট ৪৪ জনের মধ্যে ১৪ জন নারী এবং কর্মী পদে মোট ৪৫৭ জনের মধ্যে ২৩০ জন নারী কর্মরত আছেন। রাঙ্গামাটিতে অবস্থিত বিশ্ব খাদ্য সংস্থার অফিসে ম্যানেজারিয়াল পদে মোট ১১ জনের মধ্যে ম্যানেজারিয়াল পদে মোট ১১ জনের মধ্যে ৫ জন নারী। তবে নন-ম্যানেজারিয়াল পদে ৬ জনের মধ্যে কোনো নারীকর্মী নেই।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের বদৌলতে পার্বত্য চট্টগ্রামে এনজিও কার্যক্রমের অনুকূল পরিবেশ গড়ে উঠেছে বলেই এসব নারীকর্মীরা কর্মসংস্থানের সুযোগ লাভ করেছেন। এটা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির প্রত্যক্ষ ফসল বলা যায়।
শিক্ষায় আদিবাসী পাহাড়ি নারী
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ‘ঘ’ খণ্ডের ১০ নম্বর ধারা মোতাবেক চাকুরি ও উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সমপর্যায়ে না পৌঁছা পর্যন্ত সরকার কর্তৃক পাহাড়িদের জন্য সরকারি চাকুরি ও উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোটা ব্যবস্থা বহাল রাখা, এ লক্ষ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপজাতীয় শিক্ষার্থীদের জন্য অধিক সংখ্যক বৃত্তি প্রদান করা, বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ ও গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় বৃত্তি প্রদান করার বিধান রয়েছে।
বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের জন্য কোটা সংরক্ষিত আছে। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে (বিসিএস) পাহাড়িদের কোটা সংরক্ষিত থাকলেও তা যথাযথভাবে কার্যকর হচ্ছে না। বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ ও গবেষণার জন্য সরকারি কোনো বৃত্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। অধিকন্তু ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপজাতীয় কোটা’কে ‘পার্বত্য কোটা’ হিসেবে রুপান্তরিত করে বসতি স্থাপনকারী বাঙালিদেরও উক্ত কোটায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।
ইউনিসেফের জরিপ অনুযায়ী জাতীয় শিক্ষার হার বেড়েছে। কিন্তু এখানে উল্লেখযোগ্য যে, পুরুষের শিক্ষার হার জাতীয় পর্যায়ের সমান হলেও নারীশিক্ষার হার অনেক পিছিয়ে। তার মধ্যে অধিকতরভাবে পিছিয়ে রয়েছে আদিবাসী নারীরা। শিক্ষায় পার্বত্য চট্টগ্রামের নারীদের সুযোগ লাভ সম্পর্কে তথ্য নিয়ে জানা গেছে, দারিদ্র্য ও আর্থ-সামাজিক পটভূমির কারণে ছেলেমেয়েদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে মেয়েরাই ক্ষতিগ্রস্থ হয় বেশি। দারিদ্র্য ছাড়াও লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য তার অন্যতম কারণ। অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থার ফলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে মেয়েদের ভর্তির হার ছেলেদের তুলনায় বেশি, কিন্তু মাধ্যমিক পর্যায়ে মেয়েরা আর এগোতে পারে না। প্রত্যন্ত ও গ্রামাঞ্চলে নারীশিক্ষাকে মানবাধিকারের দিক থেকে বিবেচনা না করে কম গুরুত্বপূর্ণ ও বিলাসিতার বিষয় মনে করা হয়। পারিবারিক আয়ের ওপর নারীর শিক্ষালাভের সুযোগ নির্ভর করছে।
২০০১ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে আদিবাসী নারীদের সাক্ষরতার হার তাদের পুরুষদের তুলনায় অনেক কম। ২০০১-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের জাতীয় পর্যায়ের শিক্ষার হার ৪৫.৩ শতাংশের বিপরীতে পার্বত্য চটগ্রামে শিক্ষার হার ৩৭.৩৫ শতাংশ। অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুরুষের শিক্ষার হার ৪৯.৬ শতাংশের বিপরীতে নারীশিক্ষার হার ৪০.৮ শতাংশ।৪৪ এই পরিসংখ্যানে আদিবাসী পাহাড়ি নারী ও বাঙালি নারীদের মধ্যকার শিক্ষার হার পৃথকভাবে দেখানো হয়নি। তবে পাহাড়ি নারীকর্মীর মতে, এই হার বাঙালি নারীর চেয়ে পাহাড়ি নারীর শিক্ষার হার অনেক নিচে হবে। ইউনিসেফ বিশ্ব শিশু পরিস্থিতি ২০০৪-এ মেয়েদের শিক্ষার গুরুত্ব এবং শিক্ষায় বিনিয়োগের বহুবিধ সুফল সম্পর্কে তথ্য তুলে ধরা হয়েছে, যা স্বাস্থ্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন, নারীর সহিংসতার ঝুঁকি কমানোর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে ১০ জন নারীর মধ্যে ৭ জন নিরক্ষর অর্থাৎ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত।৪৫ কতক ক্ষেত্রে কন্যাসন্তানের লেখাপড়ায় উৎসাহ দেয়া হয় না। আদিবাসী পাহাড়িদের মধ্যে ছেলেশিশুর তুলনায় মেয়েশিশুদের স্কুলে গমনের হার কম, পক্ষান্তরে ছেলেশিশুর তুলনায় মেয়েশিশুদের অল্পবয়সে স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার বেশি।৪৬ পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর মধ্যেও শিক্ষার হারে ভারতম্য রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী ভেদে ১১-১২ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের শিক্ষার হারে তারতম্য রয়েছে। পার্বত্য চটগ্রামের কিছু গ্রামে পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায় যে, চাকমা জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার হার বেশি (৩৬.২ শতাংশ), আর সবচেয়ে কম শিক্ষার হার হচ্ছে স্বল্প জনসংখ্যাসম্পন্ন আদিবাসী ম্রো জাতিগোষ্ঠীর বেলায় (২.৯ শতাংশ)। এই গবেষণা পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার হার সম্পর্কে সামগ্রিক চিত্রের প্রতিফলন ঘটায় না। কারণ এই গবেষণা কেবল কতিপয় গ্রামে পরিচালিত হয়। তবু আংশিক ধারণা লাভের সুবিধার্থে এই গবেষণার ফলাফল উল্লেখ করা গেল। উল্লেখ্য যে, উক্ত গবেষণায় মারমা জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার হার ২৬.৬ শতাংশ আর ত্রিপুরাদের ১৮.৫ শতাংশ।৪৭
উক্ত তথ্য পুত্রসন্তান ও কন্যাসন্তানের শিক্ষার বৈষম্য নির্দেশ করে না। কিন্তু আদিবাসী সমাজেও শিক্ষা ক্ষেত্রে কন্যাসন্তানরা বৈষম্যের শিকার হয়। সাধারণভাবে সমাজে একটি ছেলেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য তৈরি করা হয়। কারণ সে রোজগার করবে। তার রোজগারে বুড়ো বয়সে পিতামাতারা জীবন নির্বাহ করবে, আর মেয়েসন্তানকে হেঁসেলে ঢুকতে হবে, সবার জন্য আহাৰ্য তৈরি করতে হবে। এ সমস্ত কারণে বিদ্যালয়ে মেয়েদের ঝরে পড়ার হার, অশিক্ষিত থেকে যাওয়ার হার অনেক বেশি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে নারীশিক্ষার সরাসরি কোনো উল্লেখ নেই। তবে চুক্তিতে মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা এবং মাধ্যমিক শিক্ষা বিষয় দু’টি তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তরের বিধান করা হয়। বলাবাহুল্য, ইতোমধ্যে ১৯৮৯ সালের পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন অনুসারে প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়টি তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক এখনো তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের হস্তান্তরিত বিষয় হিসেবে মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিকশিক্ষা এবং মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যকর করা হয়নি। তাই স্বভাবতই বিশেষ করে মাতৃভাষার মাধ্যমে।প্রাথমিক শিক্ষার অভাবে আদিবাসী শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষায় চরম প্রতিকূলতার সন্মুখীন হচ্ছে।
আদিবাসী ছেলেমেয়েদের স্কুল জীবন থেকে করে পড়ার অন্যতম একটি কারণ ভাষাগত সমস্যা। স্কুলের প্রথম দিনে যখন অপরিচিত বাংলা ভাষায় তাকে পাঠদান করা হয় সে স্বাভাবিকভাবে কিছু না বুঝে স্কুলের প্রথম দিন থেকে কঠিন এক অবস্থায় মুখোমুখী হয়। ফলে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ধীরে ধীরে স্কুল থেকে ঝরে পড়ে। অন্ততঃ প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান করা হলে শিক্ষার্থীর মনে শিক্ষার বিষয়বস্তু আরো সহজ ও বোধগম্য হত। কিন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে তেক্ষাকেতে মেয়েদের ভর্তির হার ছেলেদের তুলনায় বেশি, কিন্তু মাধ্যমিক পর্যায়ে মেয়েরা আর এগোতে পারে নামাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার বিধান করা হলেও তা এখনো কার্যকর হয়নি। এমনকি এ বিষয়টি জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি বা জাতীয় শিক্ষানীতিতেও অন্তর্ভুক্ত হয়নি।৪৮
মেয়ে সন্তানদের শিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকার আরেকটি অন্যতম কারণ নিরাপত্তাহীনতা। পার্বত্য চটগ্রামে আদিবাসী নারীদের বিভিন্ন ধরনের মানবাধিকার লঙ্গনের ঘটনার মোকাবিলা করতে হয়। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সত্বেও সেখানে আদিবাসী নারীদের বাঙালি বসতি স্থাপনকারী ও বাঙালি নিরাপত্তা কর্মীদের দ্বারা অব্যাহত গঞ্জনা ও যৌন হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। পার্বত্য শান্তি চুক্তি অনুসারে সামরিক ক্যাম্পগুলি গুটিয়ে না নেয়ার কারণে এখনো পাহাড়ি ছাত্রীরা চরম নিরাপীনতায় রয়েছে। বিশেষ করে দুর্গম প্রত্যন্ত পর্বতসঙ্কুল অঞ্চলে কিশোরী ও যুবতি মেয়েদের নিরাপত্তার অভাব সবচেয়ে বেশি। তাই অভিভাবকরা অনেকে তাদের মেয়ে সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে নিরুৎসাহিত হন।
আদিবাসীদের শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা থেকে বানোর ক্ষেত্রে জাতিগোষ্ঠীভিত্তিক তারতম্য রয়েছে। স্বল্প জনসংখ্যাসম্পন্ন ম্রো, লুসাই, পাংখো, খিয়াং ইত্যাদি জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা অধিকতর দুর্গম প্ৰত্যন্ত অঞ্চলে বাস করে। সুতরাং তাদের কাছে সরকারি শিক্ষার সুবিধা সহজে পৌছে না। এক্ষেত্রে সরকারি নিয়মনীতিও বাধা হিসেবে কাজ করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, প্রাথমিক স্কুল প্রতিস্তার ক্ষেত্রে সরকারি নীতি অনুসারে ভুলের নামে নির্দিষ্ট জায়গা রেজিস্টিকৃত হতে হবে এবং ন্যূনতম ১০০ জন ছাত্রছাত্রী প্রয়োজন হবে (জাতীয় পর্যায়ে ১৫০ জন ছাত্রছাতী দরকার)। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে স্কুলের নামে জমি রেজিস্ট্রি করায় নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে যেখানে ভূমি, বন ও পাহাড় অনেকাংশে সমষ্টিগত সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত সেখানে স্কুলের নামে রেজিস্ট্রি করা না করা অনেকটা গৌণ বিষয়। অপরদিকে পাহাড়ি প্রত্যন্ত দুর্গম অঞ্চলের গ্রামগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ১৫/২০টি মাত্র পরিবার নিয়ে গঠিত, সেখানে একগ্রামে ন্যূনতম ১০০ ছাত্রছাত্রী পাওয়া কখনোই সম্ভব হতে পারে না। ফলে সরকারি নীতি অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম অঞ্চল, যেখানে সবচেয়ে বেশি শিক্ষাবঞ্চিত স্বল্প জনসংখ্যাসম্পন্ন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী বসবাস করে, সেখানে সরকারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত কঠিন। স্বাভাবিকভাবে স্বল্প জনসংখ্যাসম্পন্ন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে নারীরাই শিক্ষা থেকে সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হয়ে আসছে।৫০
স্বাস্থ্য-চিকিৎসায় আদিবাসী পাহাড়ি নারী
স্বাস্থ্য বিভাগ তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তরিত বিষয়। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামেও সাস্থ্যসেবা পর্যাপ্ত নয়। জেলা ও উপজেলাগুলো ছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা নেই বললেই চলে। তাই এ এলাকায় মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি এবং মাতৃত্বজনিত কারণে নারীর স্বাস্থ্যও হুমকির মুখে। বাচ্চারা টিকা পাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত দুটো কারণে– ১. স্বাস্থ্যকর্মীরা সময়মতো উপস্থিত থাকেন না এবং ২. মায়েদের অসচেতনতা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে দেশের ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকা। এ অঞ্চলের অধিবাসীরা ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয় সবচেয়ে বেশি। ডায়রিয়া, হেপাটাইটিস, এনিমিয়া, যয়া প্রভৃতি রোগের প্রাদুর্ভাবও রয়েছে ব্যাপকভাবে। কিন্তু সে তুলনায় চিকিৎসা-সুবিধা অত্যন্ত কম। উপজেলা হসপাতালে চিকিৎসকরা অনেক ক্ষেত্রে থাকতে চান না। আর প্রত্যন্ত দুর্গম পাহাড়ি ও গহিন অরণ্যে সরকারি স্বাস্থ্যসেবার কোনো ব্যবস্থা নেই।
শ্রম বৈষম্যের কারণে নারীরা ঘরে-বাইরে এতই ব্যস্ত থাকে যে তাদের ফুসরত মেলে না টিকাজনিত কারণে অসুস্থ শিশুর জন্য বাড়তি সময় ব্যয় করা। এক্ষেত্রে আদিবাসী পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীভেদে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা লাভের ক্ষেত্রে তারতম্য রয়েছে। স্বল্প জনসংখ্যাসম্পন্ন ম্রো, লুসাই, পাংখো, খিয়াং ইত্যাদি জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা অধিকতর দুর্গম প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাস করে। স্বাভাবিকভাবে এই জাতিগোষ্ঠীর নারীদের পক্ষে মাতৃস্বাস্থ্যসেবাসহ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা লাভ করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। এসব প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিশুদ্ধ পানীয় জল ও স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশনের ব্যবস্থাও নেই, যার প্রত্যক্ষ শিকার এসব পিছিয়ে পড়া স্বল্প জনসংখ্যাসম্পন্ন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর নারীরা।
পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা কিংবা স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতার কারণে আদিবাসী নারীর স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি সঙ্কুচিত হয়েছে বলা যায়। স্বাস্থ্য অধিকার থেকে বঞ্চনার ফলে পার্বত্য চটগ্রামের আদিবাসী পাহাড়ি নারীদের মধ্যে রক্তশূন্যতার ব্যাপকতা, প্রজননম্বাস্থ্য সমস্যা ও শিশুমৃত্যুর হার রীতিমতো অস্বাভাবিক। বিশেষ করে দুর্গম প্রত্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চলে প্রসবকালীন মৃত্যুহার এখনো ব্যাপক।
গ্রামীণ ও হস্তশিল্পে আদিবাসী পাহাড়ি নারী
আদিবাসী পাহাড়ি সমাজে নারীরা স্বকীয় বর্ণবৈচিত্র্যমণ্ডিত অলংকারে, পোশাকে-আচ্ছাদনে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের মূর্ত প্রতীক। আবহমান ঐতিহ্যের ধারায় আদিবাসী পাহাড়ি নারীরা নিজস্ব ঐতিসংস্কৃতির ধারক। আদিবাসী পাহাড়ি নারীদের পোশাক-পরিমদ ও পরিধেয় কাপড়চোপড় বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ও ডিজাইনে আকর্ষণীয়। একপ্রকার কোমর তাঁতে পাহাড়ি নারীরা কাপড় তৈরি করে থাকে।
আদিবাসী সমাজে পোশাক-পরিচ্ছদ সংক্রান্ত বস্তুগত সংস্কৃতি সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে নারীদের অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। তারা কাপড় বোনা ও ডিজাইন সংগ্রহ করার কাজ বংশপরম্পরায় ধারাবাহিকভাবে সংরক্ষণ করে আসছে। নিজৰ কাপড় পরিধান করে নিজস্ব ঐতিহ্যকে ধরে রাখছে। আদিবাসী পোশাক-পরিচছদ বিশ্বের ফ্যাশন জগতে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। নারীরাই নিজস্ব পদ্ধতিতে মদ বানানো, বিভিন্ন সুস্বাদু আদিবাসী রান্নাসহ বিভিন্ন রকমের পিঠার সংস্কৃতি ধরে রেখেছে। আদিবাসী এই সুস্বাদু রান্নার পদ্ধতিগুলোও সংরক্ষণ করার প্রয়োজন রয়েছে। কৃষিক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম বীজ সংগ্রহ নারীরাই করে থাকে।
আদিবাসী পাহাড়িরা বনের বাঁশ ও বেত দিয়ে সুন্দর সুন্দর বাঁশের ঝুড়ি তৈরিতে দক্ষ। তারা বাঁশসহ তাদের অন্যান্য প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র তৈরি করে থাকে। তবে তৈজসপত্র হিসেবে মৃৎশিল্পের হাঁড়ি, বাসন-কোসন ইত্যাদির প্রচলন আছে বলে জানা যায় । এক্ষেত্রে আদিবাসী নারীরা অনেকে দক্ষ ।
আদিবাসী পাহাড়িদের ঐতিহ্যবাহী পেশার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী কোমর তাঁতে পোশাক-পরিচ্ছদ বুনন। আর আদিবাসী পাহাড়ি নারীরাই এই পেশার শ্রমজীবী। আগেকার দিনে মূলত নিজের ব্যবহারের জন্য এবং গুণবতী পাত্রী হিসেবে উপস্থাপনের জন্য এই ঐতিহ্যবাহী বুননশৈলী শিখতে হতো পাহাড়ি নারীদের। বাজার অর্থনীতির সাথে পরিচিত হবার ফলে এখন ব্যবসায়ের মাধ্যমে মুনাফা অর্জনের উদেশ্যেও পাহাড়ি নারীরা আদিবাসী ঐতিহ্যবাহী পোশাক-পরিচ্ছদ তৈরি করে থাকে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাহাড়ি নারীরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। মধ্যস্বত্বভোগীরাই অধিকাংশ লভ্যাংশ আত্মসাৎ করে থাকে।৫১
ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশন তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের হস্তান্তরিত প্রতিষ্ঠান। তিন পার্বতা জেলা পরিষদ এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আদিবাসী পাহাড়ি নারীদের বয়নশিল্প ও বাঁশ-বেতের শিল্প বিকাশে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তবে পর্যাপ্ত অর্থ সংস্থানের অভাবে এবং বাজারজাতকরণের পদ্ধতিসুযোগ-সুবিধার অভাবে এ পেশায় নিয়োজিত পাহাড়ি নারীরা আশানুরূপ সফলতা অর্জন করতে পারছে না বলে অনেকে অভিমত দিয়েছেন।
প্রত্যাগত শরণার্থী পাহাড়ি নারীদের অবস্থা
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ‘ঘ’ খণ্ডের ১ নম্বর ধারা অনুযায়ী এবং সরকার ও শরণার্থী নেতৃবৃন্দের মধ্যে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় ১ মার্চ ১৯৯৭ তারিখে স্বাক্ষরিত ২০ দফা প্যাকেজ চুক্তি মোতাবেক ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে ১২.২২২ পরিবারের ৬৪,৫০১ জন পাহাড়ি শরনার্থী প্রত্যাবর্তন করে। টাস্কফোর্সের মাধ্যমে প্রত্যাগত শরণার্থীদের অধিকাংশকে অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধাদি দেয়া হয়েছে। প্রত্যাগত পাহাড়ি শরণার্থীরা এখনো সরকার থেকে রেশন (প্রতি সপ্তাহে ৫ কেজি ও অপ্রাপ্তবয়স্করা ২.৫ কেজি চাল) পেয়ে থাকে।
অপরদিকে প্রত্যাগত শরণার্থীদের ভিটেমাটি ফেরত দেয়া হয়নি। সরকার ও শরণার্থী নেতৃবৃন্দের মধ্যে সাক্ষরিত ২০ দফা প্যাকেজ চুক্তির ১১ নম্বর ধারা অনুসারে প্রত্যাবর্তনকারী শরণার্থীদের মালিকানাধীন জমি তাদের নিকট প্রত্যার্পণ করার বিধান রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী কল্যাণ সমিতির তথ্যানুসারে প্রত্যগত পাহাড়ি শরণার্থীদের মধ্যে ৯,৭৮০ পরিবার তাদের ধান্যজমি, বাগান-বাগিচা ও বাস্তুভিটা ফেরত পায়নি। তাদের জায়গা জমি ও ৪০ গ্রাম এখনো বসতি স্থাপনকারীদের দখলে থাকায় তাদের পুনর্বাসন এখনো যথাযথভাবে হয়নি। প্রত্যাগত ৮৯০ পরিবার হালের গরুর টাকা পায়নি।
নিজ জায়গা জমি ফেরত না পাওয়ায় প্রত্যাগত পাহাড়ি শরণার্থীদের অনেকে মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে। বিশেষ করে অনেকক্ষেত্রে প্রত্যাগত নারী শরণার্থীরা নানা হয়রানির শিকার হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে দীঘিনালা মডেল প্রাইমারি স্কুলে স্থাপিত ট্রান্সজিট ক্যাম্পে অবস্থানকারী ২৬টি প্রত্যাগত শরণার্থী পরিবারের সমস্যার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তাদের জায়গা-জমির ওপর বোয়ালখালী নতুন বাজার স্থাপনের ফলে এখনো তারা তাদের জায়গা-জমি ফেরত পায়নি। কিন্তু তাদের জায়গা-জমি ফেরত দানের কোনো উদ্যোগ না নিয়ে সরকার ১৯৯৯ সালের ২০ আগস্ট তাদেরকে ট্রান্সজিট ক্যাম্প থেকে জোরপূর্বক উচেছদের জন্য স্বপন চন্দ্র পাল নামে এক ম্যাজিস্টেটের নেতৃত্বে পুলিশ ও বসতি স্থাপনকারী বাঙালিদের গড়া ভিডিপি সদস্যদের লেলিয়ে দেয়। এসময় কেৱল নারী ও শিরা ক্যাম্পে ছিল। কিন্তু পুলিশ ও ভিডিপি সদস্যরা কোনো বাছবিচার না করে নারী ও শিশুদের ওপর এলোপাথাড়ি লাঠিপেটা করে। এতে ৬ মাসের একজন শিশু ও ১০ জন নারীসহ ১২ জন প্ৰত্যাগত শরণার্থী আহত হয়। সর্বশেষ ড. ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালে তাদেরকে ট্রান্সজিট ক্যাম্প থেকে জোরপূর্বক উচেছদ করে অন্যত্র পুনর্বাসিত করা হয়। তারা এখনো তাদের জমি ও বসতভিটা ফেরত পায়নি।
সরকার পক্ষ প্রতিশ্রতি দিয়েছিল যে, প্রত্যাগত পাহাড়ি শরণার্থীদের এলাকা থেকে বসতি স্থাপনকারী বাঙালিদের অন্যত্র সরিয়ে নেবে। কিন্তু সরকার তা পালন করেনি। ফলে বসতি স্থাপনকারী বাঙালিদের সাথে প্রত্যাগত পাহাড়ি শরণার্থীদের মধ্যে প্রায়ই নানা বিরোধ ও সমস্যার উদ্ভব হয়। বিশেষ করে শরণার্থী ও তাদের মেয়েশিশুরা বসতি স্থাপনকারী বাঙালিদের সহিংসতার শিকার হয়। উদাহরণ হিসেবে ১৯৯৯ সালের ২১ জানুয়ারি খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলার মেরুণং ইউনিয়নের বেতছড়ি বিভূতি ভূষণ কার্বারী পাড়ায় প্রত্যাগত শরণাধী নারী পূর্ণশোভা চাকমার ওপর বসতি স্থাপনকারী বাঙালিদের হামলার ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। ওইদিন পূর্ণশোভা চাকমা তাদের জমিতে কাজ করতে গেলে ইউনুস নামে একজন বসতি স্থাপনকারী বাঙালি ধারালো দা দিয়ে হামলা করে। পাশ্ববর্তী জমিতে কর্মরত পাহাড়িরা পূর্ণশোভা চাকমার চিৎকার শুনে তাকে উদ্ধার করে। উক্ত ইউনুস দীর্ঘদিন ধরে পূর্ণ শোভাদের জমি জবরদখল করার চেষ্টা করে আসছিল। ২০০৬ সালের ২সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলার ছোট মেরুং এলাকার প্রত্যাগত শরণার্থী জ্ঞানজ্যোতি চাকমার মেয়ে স্কুলছাত্রী রুনা চাকমা (১৫) স্কুলে গেলে বসতি স্থাপনকারী বাঙালিরা ধর্ষণ করে হত্যা করে।
অভ্যন্তরীণ পাহাড়ি উদ্বাস্তু নারীদের অবস্থা
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ‘ঘ’ খণ্ডের ১ ও ২ নম্বর ধারায় তিন পার্বত্য জেলার অভ্যন্তরীণ পাহাড়ি (উপজাতীয়) উদ্বাস্তুদের পরিচিহ্নিত করে টাস্কফোর্সের মাধ্যমে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিধান রয়েছে। প্রত্যাগত শরণার্থীসহ অভ্যন্তরীণ পাহাড়ি উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য টাস্কফোর্স গঠিত হয় এবং টাস্কফোর্স সভায় ‘পার্বত্য চটগ্রামে (খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবন) দীর্ঘ সময় ধরে অস্বাভাবিক পরিস্থিতিজনিত কারণে যে সকল উপজাতি নিজ গ্রাম, মৌজা, অঞ্চল ত্যাগ করে দেশের ভিতরেই অন্যত্র চলে গেছে বা চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন, তারা অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসেবে বিবেচিত হবেন’ মর্মে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুর সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়।৫২
কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের ১২ বছর অতিক্রান্ত হলেও অভ্যন্তরীণ পাহাড়ি (উপজাতীয়) উদ্বাস্তুদের এখনো পুনর্বাসন করা হয়নি। অধিকন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে কেবল অভ্যন্তরীণ পাহাড়ি উদাস্তুদের পুনর্বাসনের উল্লেখ থাকলেও সরকার রাজনৈতিক উদেশ্যে বসতি স্থাপন করতে দেয়া বাঙালিদেরও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসেবে গণ্য করে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি লম্বন করে বসতি স্থাপনকারী বাঙালিদেরও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসেবে গণ্য করে পার্বত্য চটগ্রাম পুনর্বাসনের জন্য কার্যালয়ের বিভাগ কর্তৃক ১৯-০৭-১৯৯৮ তারিখে টাস্কফোর্সের কাছে পত্র প্রেরণ করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পরিপন্থী এই উদ্যোগের প্রতিবাদে জনসংহতি সমিতি ও জুম্ম শরণার্থী কল্যাণ সমিতির প্রতিনিধিদ্বয় ২০০০ সালে অনুষ্ঠিত নবম সভা চলাকালে ওয়াকআউট করেন। পরবর্তীকালে জনসংহতি সমিতি ও জুম্ম শরণার্থী কল্যাণ সমিতির প্রতিনিধিদের অনুপস্থিতিতে ২০০০ সালের ১৫ মে অনুষ্ঠিত টাস্কফোর্সের একাদশ সভায় একতরফাভাবে ৯০,২০৮ পাহাড়ি পরিবার এবং স্থাপনকারী ৩৮,১৫৬ বসতি পরিবারকে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অবশেষে বসতি স্থাপনকারী বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসনের সরকারি উদ্যোগের বিরুদ্ধে পার্বত্যবাসীর প্রতিবাদের মুখে টাস্কফোর্সের কার্যক্রম প্রায় অচল হয়ে পড়ে।
বর্তমানে অভ্যন্তরীণ পাহাড়ি উদ্বাস্তুরা অধিকাংশই সংরক্ষিত বনাঞ্চল, পাহাড়িদের প্রথাগতভাবে পরিচালিত জুমভূমি ও মৌজা ভূমি, আত্মীয়স্বজনের ভিটেমাটি ইত্যাদি জায়গা-জমিতে বসবাস করছে।
অনেকে ভাসমান অবস্থায় দিনমজুরি, কৃষিশ্রম বিক্রি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়, এমনকি চট্টগ্রাম ও ঢাকায় ইপিজেডসহ বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে স্বল্প বেতনে নিম্নশ্রেণির চাকুরি করে জীবন নির্বাহ করছে। সংরক্ষিত বনাঞ্চল, পাহাড়িদের প্রথাগতভাবে পরিচালিত জুমভূমি ও মৌজা ভূমিতে বসবাসকারী পাহাড়ি অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুরা বনবিভাগের ফরেস্ট ভিলেজার হিসেবে দিনমজুরি এবং পাশাপাশি জুমচাষ করে মানবেতর জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। সংরক্ষিত বনাঞ্চলের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় নেই কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও সরকারি সেবা সুবিধাদি। ফলে তারা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে পুরোপুরিই বঞ্চিত।৫৩ তারা ম্যালেরিয়া, ডায়রিয়া, হেপাটাইটিস ও এনিমিয়া রোগে আক্রান্ত হয়। কিন্তু চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই। এসব গহিন অরণ্যে ম্যালেরিয়া প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে বঞ্চনার শিকার হয় পাহাড়ি নারী ও মেয়েশিশুরা। মুষ্পিমেয় কিছু উদ্বাস্তু পরিবার উপজেলা বা জেলা সদরে পাঠিয়ে তাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার ব্যবসস্থা করতে সক্ষম হলেও নিরাপত্তাহীনতা ও সামাজিক কারণে মেয়েশিশুরা সেই সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হয়। অধিকন্তু প্রত্যাগত পাহাড়ি শরণার্থীরা সরকার থেকে রেশন পেলেও অভ্যন্তরীণ পাহাড়ি উদ্বাস্তুরা কোনো রেশন পায় না।৫৪ কতিপয় স্থানীয় এনজিও এসব পাহাড়ি উদ্বস্তুদের শিক্ষা ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে প্রকল্প নেয়ার উদ্যোগ নিলেও তা অত্যন্ত অপ্রতুল ও সাময়িক।
এসব অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু প্রতিনিয়ত বনবিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হয়রানির শিকার হয়। ফরেস্ট ভিলেজার হিসেবে বসবাসকারী উদ্বাস্তুদের কাজের সুযোগ ও মজুরি নির্ভর করে বনবিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর। ফলে তাদের অনাহারে অর্ধাহাারে জীবন কাটাতে হয়। উপরন্তু প্রায় সময় বনবিভাগ, বিডিআর ও সেনাবাহিনী অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের জুমের ওপর হামলা চালিয়ে থঅকে। জুমচাষকে অবৈধ ঘোষণা করে তাদের জুমঘর ভেঙে দেয় এবং জুমক্ষেত তছনছ করে দেয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, ২০০০ সালের ৩০ জানুয়ারি বনবিভাগ রাঙ্গামাটি জেলা বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া এলাকায় জুমচাষীদের এক ডজনের অধিক জুমঘর ভেঙে দেয়। ২০০৫ সালের ২৩ জুন রাঙ্গামাটি জেলার বাঘােইছড়ি উপজেলার সাজেকের নিউ লঙ্কর ও ওল্ড লঙ্কর এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিডিআর সদস্যরা ২০টি জুমঘর সম্পূর্ণভাবে গুঁড়িয়ে দেয়। সম্প্রতি ২০ এপ্রিল ২০০৮ সাজেকের বাঘাইছড়ি এলাকায় হামলায় বসতি স্থাপনকারী বাঙালিদের লেলিয়ে দিয়ে ৭টি পাহাড়ি গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়।
প্রসঙ্গ:আদিবাসী, পার্বত্য চট্টগ্রাম, পাহাড়ি নারী
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।