Last updated Sep 7th, 2025
4
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও রীতি-নীতির আচরণ পরিবর্তনের পদক্ষেপ: উন্নত যোগাযোগ, গণ মাধ্যম ও বাজার ব্যবস্থার ফলশ্রুতি
উন্নত রাস্তাঘাট, জলজ: যানবাহন ও যোগাযোগ, সরকারি-বেসরকারি গণ মাধ্যমসমূহের সম্প্রসারিত ভূমিকা এবং ভোগ্যপণ্য সামগ্রী, সংগীত, সাহিত্য ও কলাসহ বাজার সম্প্রসারণ-এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের তাবৎকাল বিচ্ছিন্ন থাকা এলাকাসমূহ এখন বাইরের প্রভাব ও প্রবণতায় প্লাবিত। সেসব পরিবর্তন অবশ্যই আবশ্যম্ভাবী। আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিজ্ঞ উপদেশের সাথে একমত যে, বাইরের প্রভাব ঠেকাতে কৃত্রিমভাবে প্রতিরোধ ও আবরণ তৈরি করা উভয়ই দুর্বল ও অনাকাঙ্ক্ষিত। যা হোক, এ মুহূর্তে এ প্রেক্ষিতে এবং ভবিষ্যতের দিনগুলোতে পরিবর্তনের পদচারণা সর্বব্যাপী। সরকার, বাজার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কোনটিই কণা পর্যায়ে পরিবর্তনের পদযাত্রা পরিবীক্ষণ করতে পারে না- এর বিপক্ষে প্রতিক্রিয়া করা তো দূরের কথা। যা’হোক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের নেতৃবৃন্দের প্রতি কর্তব্য বর্তায় যে, তাঁরা একদিকে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনগুলো রোধ বা ধীর গতিতে হ্রাস নিশ্চিতকরণে এবং অন্যদিকে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনগুলো ত্বরান্বিতকরণে সাহায্য করবেন (আমি কোনটা কাঙ্ক্ষিত বা অনাকাঙ্ক্ষিত সে যুক্তিতে যাবো না, মতামত অবশ্যই ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে)।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আইন এবং আদিবাসী সাংস্কৃতিক কৃষ্টি
আমরা যদি দেখি, পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন, ১৯০০, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন, ১৯৯৮, পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন, ১৯৮৯ সহ পার্বত্য চট্টগ্রামের আইনগুলোর আলোকে তিনটি ভিন্ন প্রতিষ্ঠান- এর নিকট আদিবাসী (বা ট্রাইবাল) সংস্কৃতির দায়িত্ব অর্পিত। এগুলো হল ঐতিহ্যগত প্রতিষ্ঠান সার্কেল চীফ, হেডম্যান ও কার্বারী (পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ও আইনসমূহ, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথা ও রীতি- নীতিসমূহ), পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহ, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ (পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন, ১৯৮৯ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন, ১৯৯৮)। নিঃসন্দেহে প্রাথমিক ভূমিকা ঐতিহ্যগত প্রতিষ্ঠানসমূহের নিকট বর্তায় যদিও পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহ ও আঞ্চলিক পরিষদ এর এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় ভূমিকা রয়েছে। এখানে আমি ঐতিহ্যগত প্রতিষ্ঠানসমূহের সম্ভাব্য ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করছি।
সামাজিক প্রথা ও ঐতিহ্যসমূহের অমান্যতারোধে বিচারিক এবং বিধিগত বৈধ হস্তক্ষেপ: হেডম্যান এবং কার্বারীগণের ভূমিকা
ঐতিহ্যগত প্রতিষ্ঠানসমূহ – প্রাথমিকভাবে হেডম্যান ও কার্ববারীগণ সামাজিক ন্যায়ের নিষ্পত্তিকারক (arbiters) হিসেবে (জজ এবং ম্যাজিস্ট্রেডগণের প্রকৃতির দিক থেকে তাঁদের ভূমিকা) এবং অন্যান্য বিষয়াবলীর মধ্যে, ভূমি, রাজস্ব ও উত্তরাধিকার বিষয়ে সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে তাঁদের ভূমিকার মাধ্যমে তাঁরা কোন কোন সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধরে রাখতে সাহায্য করতে পারেন। প্রথমতঃ, হেডম্যান এবং চীফগণ প্রথাগত আইনের আওতাধীন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আচরণ বিধি, প্রথাগত রীতিনীতি ভঙ্গকারী আচরণের জন্য জরিমানা করতে পারেন। চীফ এবং হেডম্যানগণ পারিবারিক আইনের আওতায় বিবাহ, বিবাহ-বিচ্ছেদ, শিশুর হেফাজত, ব্যবস্থাপনা ইত্যাদিসহ আদিবাসীদের মধ্যেকার বিবাহের সনদপত্র প্রদান যেহেতু, আদিবাসীদের মধ্যেকার বিবাহ নিবন্ধীকরণ হয় না, তবে যেমনটা মুসলিম ও গণবিবাহের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে এমন নয়)। অধিকন্তু, তাঁরা ডেপ্যুটি কমিশনারকে উত্তরাধিকার বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ, যদি পাহাড়ীদের মধ্যেকার বিবাহ আদিবাসী প্রথা ও ঐতিহ্যের সাথে মৌলিকগতভাবে সংগতিপূর্ণ না হয় (এখন কিছু কিছু পাহাড়ী ‘হলফনামা’ ও ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে বিবাহ সম্পন্ন করে থাকে প্রথাগত আইনে যার কোন ভিত্তি নেই) তাঁরা সে ধরণের বিবাহ অস্বীকার করতে পারেন এবং বিবাহ ও উত্তরাধিকার সনদপত্র প্রদান থেকে বিরত থাকতে পারেন। এটা অবশ্য কেবল আংশিক সমস্যা পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অতএব, এর সাথে ঘটনা পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা রোধকল্পে তাঁরা অবশ্য নিম্নোক্ত সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন।
আদিবাসী মূল্যবোধ, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সক্রিয় উন্নীতকরণ
কিছু ক্ষেত্রে আদিবাসী প্রতিষ্ঠানসমূহ সক্রিয় ভূমিকা নাও নিতে পারে কিংবা অন্ততঃ তাঁরা নিজেদের মধ্যে নয়। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠনসমূহের তুলনায় তাঁরা ভালো অবস্থানে আছেন। সুনির্দিষ্টভাবে, বিবাহ অনুষ্ঠানে যেখানে প্রথা, ঐতিহ্য এবং রীতি-নীতি জড়িত (তাদের সম্প্রদায়গত রীতি ও অনুষ্ঠানসহ বা ব্যতিরেকে), প্রতিপালিত অন্য সব রীতি ও অনুষ্ঠানাদির ক্ষেত্রে না হলেও হেডম্যান এবং কারবারীগণ সংশ্লিষ্ট আইন ও প্রথা প্রতিপালন নিশ্চিতকরণে ভালো অবস্থানে আছেন। কেননা, তাঁরা স্বাভাবিকভাবে তাঁদের মৌজায় বা গ্রামের বিবাহ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে থাকেন। তাঁরা বিবাহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলো অনুসরণের প্রশ্নে জোরালো অবস্থান রাখতে পারেন কিংবা সংশ্লিষ্ট বিবাহ বর্জন করার হুমকি প্রদান করতে পারেন এবং প্রাক-বিবাহ সামাজিক ও বিচারিক জরিমানার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন। উপরোক্ত ঐতিহ্যগত প্রতিষ্ঠানসমূহ সংশ্লিষ্ট প্রথা ও ঐতিহ্যসমূহ সংরক্ষণ, রেকর্ড-রক্ষণ, আলোচনা, প্রকাশনা ও প্রচারণার অন্যান্য পদ্ধতিসমূহের মাধ্যমে উন্নীত করতে পারেন। তবে তাঁদের অন্যান্য বাস্তবায়নকারীদের সহযোগে এসব কার্যাবলী নিম্নোক্তভাবে পরিচালনা করতে
হতে পারে।
অন্যান্য বাস্তবায়নকারীদের ভূমিকা
আমি প্রায়ই বলি যে, আজকাল ফুটবল খেলায় যেমনটা ইউরোপের ফুটবল টিমগুলো সামগ্রিকভাবে গ্রহণ করেছে— এতে যে কেবল স্ট্রাইকাররাই জরুরি তা’ না- প্রতিরক্ষা, পারস্পরিক বল যোগান দেওয়া, আক্রমণ, ইত্যাদির প্রশ্নে আস্ত টিম-ই প্রয়োজন। অনুরূপ, আদিবাসী সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও কৃষ্টি সংরক্ষণে, ঐতিহ্যগত প্রতিষ্ঠানসমূহ ‘স্ট্রাইকার’ হতে পারে। তবে তারা ‘টিম এর বাকি অংশ’-এর সমর্থন ছাড়া সফল হতে পারে না। ‘টিমের বাকি অংশ’ বলতে, পার্বত্য চট্টগ্রাম-নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ (পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং ইউনিয়ন স্থানীয় পরিষদসমূহ), সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সংস্থাসমূহ এবং প্রতিষ্ঠানসমূহ৷ (এনজিও-সহ), যুব ও মহিলা ইত্যাদি বোঝায় (আমি এ সময়কার জন্যে বাজার ও গণ মাধ্যমগুলোর ভূমিকা রেখে দিই)। একই লক্ষ্যে সবাইকে পাওয়া বা অধিকাংশ বাস্তবায়নকারীদের পাওয়া গুরুত্ববহ, তবে সকল প্ল্যাটফরম থেকে পাওয়া আবশ্যকীয় নয়। বিভিন্ন বাস্তবায়নকারীর কাজে বৈচিত্র্যতা থাকতে পারে এবং থাকবে। চ্যালেঞ্জটা হল- আবার সেই ফুটবলের রূপক থেকে নিয়ে বলতে হয়- ‘একই দিকে, ঐক্যবদ্ধভাবে, বলটাকে লাঠি মারা।’
বাজার, মিডিয়া, ইত্যাদি অন্যান্য চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করা
অবশ্য এ বিষয়ে কয়েকটি চ্যালেঞ্জ আছে যা মোকাবিলা করা প্রয়োজন (কেবল বিবাহের ক্ষেত্রে নয়, আদিবাসী ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে), যেখানে বাজার এবং মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বাংলাদেশে সংখ্যাগুরু বাংলা ভাষা-ভাষী লোকেরা এবং আন্তর্জাতিক বিশ্ব থেকে অন্যান্যরা মিডিয়া পরিচালনা এবং নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এখানে জুম্মদের পরিচালিত কোন টেলিভিশন বা বেতার কেন্দ্র নেই (তবে জুম্ম-সংস্কৃতি অন্য উপায়ে এখনো উন্নীতকরণ হতে পারে; আমরা রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত টেলিভিশন ও রেডিওতে অধিক পর্যাপ্ত প্রচারের জন্য সময় পাওয়ার চেষ্টা করতে পারি)৷
হ্যাঁ, কেবল ধনীরা ঐতিহ্যবাহী বাড়ীতে বোনা কাপড়-চোপড় কিনতে পারে। তবে, আমরা, আমাদের ঐতিহ্যের সাথে খাপ খায় এমন বাজারলভ্য জিনিসপত্র বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করতে পারি (চাকমা লোকজন পশ্চিমা স্যুট বা মোঘল/ভারতীয় শেরওয়ানী/আজকান এর থেকে বিকল্প গামছা/ধূতি এবং সিলুম/কোট্টা কম মূল্যে পেতে পারে)। মুসলিম ও হিন্দু সম্প্রদায় ধর্মীয়/সামাজিক অনুষ্ঠানে তাদের ঐতিহ্যগত খাবার (বিরিয়ানী/প্রসাদ) পরিবেশন করে থাকে। চাকমা, ত্রিপুরা এবং তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ও বিঝু, বিষু, বৈসু, ইত্যাদি অনুষ্ঠানকালে বিরিয়ানী, নুডলস্ এর পরিবর্তে তাদের সবজি আইটেম ‘পাজোন’ (আমি এখানে চাকমা ভাষার শব্দ ব্যবহার করেছি) পরিবেশন করতে পারে৷
আমি আশা করবো যাঁরা আমাদের পবিত্র ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি (তবে, যেসব দিক মানবাধিকার তথা নারী অধিকার ভঙ্গ করে সেসব ব্যতিরেকে) রক্ষায় আগ্রহী তাঁরা এ বিষয়ে কাজ করতে তাঁদের স্বপ্ন ও কৌশল অংশীদারীত্বের মাধ্যমে শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে পারেন। আদিবাসী সংস্কৃতির প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো ধরে রাখতে হলে তা যে একই প্ল্যাটফরম থেকে করতে হবে তার কোন প্রয়োজন নেই। তবে, একই স্বপ্ন এবং লক্ষ্য হবে এক। কেননা, সংস্কৃতি ছাড়া আমরা মানুষ হয়ে থাকতে পারি, তবে আমরা কিছুতেই একটা জাতির অংশ হতে পারি না। আর সাংস্কৃতি ব্যতিরেকে পৃথিবী বিরক্তিকর হয়ে উঠবে এবং ভাষাগত, জৈবিক ও জীববৈচিত্র্যতার মৃত্যু ঘটবে।
লেখকঃ রাজা দেবাশীষ রায়
[ইংরেজি মূল লেখা থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন- সুদত্ত প্রিয় চাকমা]
প্রসঙ্গ:আদিবাসী ঐতিহ্য, কার্বারী, রাজা দেবাশীষ রায়।, হেডম্যান
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।