সাওতাল লোককথাঃ নাপিতের বুদ্ধি
1051
একই গাঁয়ে থাকত সেই নাপিত আর চাষী। দুজনের বাড়ির মাঝখানে ছিল শুধু রাস্তাটা। আর শুধু ওইটুকু তফাতেই তাদের ভাগ্যের ফারাকটা যেন বড় বড় হয়ে ওঠে।
চাষী ছিল বিরাট ধনী আর নাপিত ছিল তেমনি গরিব। তবু তাদের মধ্যে চেনাশোনা ছিল, কথাবার্তাও হত। আর তা তো হবেই, তারা যে এক গায়েতেই থাকত।
নাপিত ভাবে, চাষী জমি চাষ করে, আমিও করি। কিন্তু ওর জমিতে ফসল হয় উজার করে আর আমার জমিতে ছিটেফেঁটা।
ওর বাড়িতে মড়াইয়ের পর মড়াই বাঁধা হয়, আর আমার বাড়িতে মড়াইগুলো দিনের পর দিন থাকে ফঁকাই। নাপিত শুধু ভাবে, কেন এমন হয় ?
ভাবতে ভাবতে নাপিত ঠিক করে, নিশ্চয় তার চাষবাসের কাজে কোনো ভুল হচ্ছে। চাষীর লোকরা যেভাবে চাষ করে, যে কারণেই হোক, তার লোকেরা সেইভাবে চাষ করে না।
আর তাই তার জমিতে ফসল হয় না। দিনের পর দিন গরিব হয়ে যাচ্ছে সে। নাপিত ভাবে, না, এ বছরে চাষী যেভাবে যা চাষ করবে সেও সেইভাবেই করবে চাষ। দেখবে তাতে ফল কোনো হয় কিনা। তাদের মতই চাষ করতে হবে এবার তাকেও।
তাই এক সন্ধ্যেবেলায় নাপিত তার লোকজনকে বলে, এ বছর আমাদের আর কুঁড়েমি করলে চলবে না। এবার আমাদের দারুণ খাটা খাটতে হবে।
দেখ, আমরা নিশ্চয়ই আমাদের কাজে ফাকি দিই। আর তার জন্যই আমরা গরিব হয়ে যাচ্ছি। তাই তোমাদের বলছি, এ বছর আমরা প্রত্যেকে যত পারব খাটব, একবার চেষ্টা করে আমাদের দেখতেই হবে আমরা পারি কিনা !
নাপিতের কথা শেষ হতেই সবাই একসুরে বলে ওঠে, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই আমরা খাটব।
সত্যি কথা বলতে কি, সেইদিন থেকে নাপিত রোজই চাষীর বাড়ি যেতে শুরু করল।
কখনও খৈনি খেতে, কখনও বা তামাক খেতে। নিজের বাড়িতে খৈনি পাতা, চুন থাকা সত্ত্বেও কখনও সে আসত সেই খৈনি পাতা কিংবা চুনের খোঁজে।
নিজের ঘরে আগুন থাকা সত্ত্বেও শুধু হুকো নিয়ে চলে আসত টিকে ধরাবার জন্য। আবার কখনও বা চলে আসত শুধুই গল্প করার জন্য।
মোটকথা, চাষীর বাড়িতে নাপিতের আনাগোনাটা বেড়ে গেল হঠাৎ-ই। এই যাওয়া আসার মধ্য দিয়েই নাপিত জেনে নিত, শুনে নিত চাষী কি বলে তার লোকদের।
প্রতিদিন চাষী তার লোকজনকে যেমন যেমন নির্দেশ দিত, নাপিতও ফিরে এসে তেমন তেমন বলত। শুধু দিনের বেলা নয়, সন্ধ্যেবেলাতেও নাপিত গিয়ে বসে থাকত চাষীর বাড়ি।
শুনে রাখত পরের দিনের কাজের ফিরিস্তি। নাপিত শুনেছিল, চাষী অনেক রাত করে ঘুমোতে যায়, তাই সেও রাত করে ঘুমোতে আরম্ভ করল।
চাষীর বাড়ীর আলো নিভলে তবে নাপিত নেভাত আলো। ভোরে, যে-সময় চাষী তার গরু বলদ বের করত মাঠে। যে-সময় চাষী জমি চষা শুরু করে ঠিক সেই সময়ে নাপিতের জমিতেও লাঙল পড়ে।
চাষী যে-সময় বলদের কাধ থেকে ভয়াল নামায় সেই সময়ই নাপিতও তার হালের বলদকে দেয় রেহাই।
চাষী যখন যে ধরনের জমিতে লাঙল দিতে বলত, যে জমিতে যে বীজ দিতে বলত নাপিতও করত ঠিক তাই তাই। নাপিত যে চাষীর কাছ থেকে জেনে নিয়েই সবকিছু করছে তা কিন্তু চাষী ধরতে পারেনি কিছুতেই। তাই নাপিতের কাজ চলছিল বেশ ভালই।
তারপর একদিন চাষী বুঝতে পারল, তার কাছ থেকে শুনে শুনেই নাপিত চাষ করছে, তবু সে কিছু বলে না নাপিতকে। কিন্তু সে বছর নাপিতের ক্ষেতের ফসল দেখে চাষীর চক্ষু চড়কগাছ। ফসলে ফসলে ভরে গেছে ক্ষেত। এত ফসল, তার জমিতেও হয়নি।
নাপিতেরও মনে আনন্দ আর ধরে না। বাড়ির উঠোনে তার তৈরি হতে থাকে মড়াইয়ের পর মড়াই। তাতে ভর্তি হয় ফসল। আনন্দে নাপিত তার লোকজনদের বলে, দেখলে তো, চাষীর কাছ থেকে শিখে এসে এসে তোমাদের যেমন ভাবে বলতাম তেমনভাবেই চাষ করে কেমন লাভ হয়েছে আমাদের। তবে আমি শেখা বন্ধ করব কিছুতেই।
আর তাই খুব ভাল ফসল হওয়া সত্ত্বেও নাপিত কিন্তু রোজই যায় চাষীর বাড়ি—আগে যেমন যেত। সেটা মাঘ মাস। চাষী তার লোকজনকে বলল, জমি তৈরি কর, এবার আখ লাগাব।
বাড়ি ফিরে গাপিতও তার লোকজনকে বলল, এবার আমরা আখ চাষ করব। তোমরা জমি তৈরি শুরু কর।
সত্যি কথা বলতে কি নাপিত তার জমি চাষে আখ লাগিয়ে দিল। আখ চাষ ঠিক কি ভাবে করে তার কিছুই জানে না নাপিত। তবু চাষীর লোকজন যেমন যেমন কাজ করে তেমন ভাবে কাজ করতে থাকে নাপিত।
এক সময় নাপিত আর চাষী—দুজনের ক্ষেতই আখে আখে ভরে যায়। নাপিতের ক্ষেত দেখে চাষীর এবার একটু হিংসে আর রাগ হয়। সে বলে ব্যাটা নাপিত আমার এখান থেকে শুনে শুনে চাষ করে বেশ ভাল ফসল তুলছে। ওকে আজ জব্দ করতে হবে।
সন্ধ্যেবেলা, নাপিত এসেছে চাষীর বাড়ি। চাষী তখন গম্ভীরভাবে তার লোকদের বলে, শোন, কাল সকালে তোমরা আখের জমিতে মই দেবে।
ক্ষেত ভর্তি ফসলে কেউ কোনোদিন মই দেয় না। কিন্তু নাপিত তো চাষের কিছু জানে না, তাই চাষীর চালাকি সে বুঝতে পারল না। পরদিন সকালে সে তার লোকজনদের দিয়ে তার আখের জমিতে বেশ ভাল করে মই দিল।
সমস্ত আখ একেবারে মাটির সঙ্গে শুয়ে পড়ল। দূর থেকে তাই দেখে মনের সুখে হেসে নিল চাষী। কেননা, সে তত আর সত্যি সত্যি জমিতে মই দেয়নি।
চাষীর হাসি কিন্তু বেশি দিন রইল না। নাপিত তার ক্ষেতের আখ মাটিতে শুইয়ে দেওয়ায় আখের প্রতিটি গাট থেকে শেকড় গজাতে শুরু করল—প্রতিটি গাঁট থেকে বেরতে থাকল একটি করে গাছ।
ফলে তার জমিতে সেবার হল প্রচুর আখ। সত্যি কথা বলতে কি, চাষীর চেয়েও বেশি আখ হল নাপিতের।
কিছুদিন পরে চাষী তার লোকদের বলে, মড়াই খুলে ছোলা বের কর। কাল আমরা ছোলা চাষ করব। আর হ্যা, আজই ছোলাগুলোকে বেশ করে ভেজে নাও, তাহলে প্রতিটি দানা থেকেই একসঙ্গে বেশ ভাল গাছ হবে।
কাল ভোরে, তোমরা ছোলা ভাজার সময় পাবে কোথায় ? ছোলা ভাজার কাজ কালকের জন্য রেখে দিলে কাজে দেরি হয়ে যাবে। যাও, যাও আজই ওটা সেরে রাখ তোমরা।
চাষীর কথা শুনে নাপিত চলে এল বাড়ি। মড়াই খুলে ছোলা বের করে সে তার লোকজনকে বলে ছোলা ভেজে রাখতে। পরদিন সই ভাজা ছোলাই মাঠে ছড়িয়ে দেয় নাপিত।
এখন চাষী তো আর সত্যি সত্যি ছোলা ভাজে নি, তাই তার ক্ষেতে একই সঙ্গে সমানভাবে সব ছোলা থেকে গাছ বের হতে থাকে। নাপিতের ক্ষেতে এখান খান ছড়িয়ে ছিটিয়ে গাছ হয় হাতে গোনা কয়েকটি।
কারণটা বুঝতে না পেরে নাপিত একদিন জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা, তোমার ক্ষেতে এমন সুন্দর ছোল গাছ বেরিয়েছে আর আমার ক্ষেতে এমন হল কেন বলত ?
চাষী বলে, ছোলা বুনবার আগে আর ওগরবশ করে ভেজে নিয়েছিলাম। আমিও তো তাই করেছিলাম। হয়তো ঠিক মত ভাজা হয়নি।
যেগুলো সব ভাজা হয়েছে সেগুলো থেকেই এই গাছগুলো বেরিয়েছে। চাষী বেশ গম্ভীর ভাবেই কথাগুলো বলে নাপিতকে।
সেকথা শুনে নাপিতও বলে, বোধহয় তাই হয়েছে। হয়তো ওগুলো ঠিক মতো ভাজা হয়নি।
ঘরে ফিরে নাপিত তার লোকজনকে খুব করে গালাগালি করে।
বলে, একটা কাজও তোমরা ভাল করে করতে পার না। সামান্য ছোলা ভাজার কাজটাও তোমরা জান না। এইসব বলে নাপিত বেশ রাগ করে। তবে ক্ষেতে আর কত দেয় না সে। যেমন ছোলা ভাজা বুনেছিল সে তেমনই রেখে দেয়।
কিন্তু সে বছর সেই ছোলা থেকেই নাপিতের ক্ষেতে যে পরিমাণ ছোলা হল তা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। কল্পনা করবে কি করে, ভাজা ছোলায় গাছ কি আগে কখনও হয়েছে ?
চাষীর চেয়েও অনেক অনেক বেশি ছোলা উঠল নাপিতের ঘরে সেবার। এইভাবে, চাষীর কথা শুনে শুনে চাষ করেই বছর তিন-চারের মধ্যেই নাপিতের অবস্থা গেল ফিরে।
সে তখন চাষীর চেয়েও বড়লোক হয়ে যায়। তবে তখনও শেখাটা কিন্তু বন্ধ করে না নাপিত।
রাজা হল রামছাগল সেটা একটা রামছাগল। যেমনি লম্বা তার দাড়ি, তেমনি বড় তার শিং। গরু ছাগলের পালের মধ্যে তার ওপর নজর সবার পড়বেই।
তা একদিন সেই রামছাগল আর অন্য গরু ছাগলের পাল নিয়ে রাখাল যায় অনেক পুরনো এক জঙ্গলে। জঙ্গলের ঠিক মাঝখানটায় একটা পাহাড়।
পাহাড় মানে ঢিবি — হাত পনের উচু তাে হবেই। সেই পাহাড়ের গুহাতেই থাকত একটা বাঘ। রাখাল যখন তার গরু ছাগলের পাল নিয়ে এসেছে বনে, তখন বাঘ গেছে অন্য জায়গায় খাবারের সন্ধানে।
রামছাগলের স্বভাবটাই এই—কোনোকিছু উচু দেখলেই সে চড়ে বসবে তাতে। তা পাহাড়টা দেখেই তার মনে জাগল তাতে ওঠার শখ। এক পা দু-পা করে রামছাগল চড়ে বসে একবারে সেই পাহাড়ের মাথায়।
পাহাড়ে ওঠার পরই রামছাগলের শুরু হয়ে যায় নাচাকোদা। নাচের চোটে দিন গড়িয়ে যে কখন সন্ধ্যে হয়, তার খেয়াল নেই।
খেয়াল যখন হল তখন রামছাগল দেখে, সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিমে। তাড়াতাড়ি নামতে যায় সে পাহাড় থেকে। কিন্তু ওঠাটা যত সহজ হয়েছিল, নামাটা তত হয় না।
সত্যি কথা বলতে কি সে নামতেই পারে না সেই পাহাড়ের মাথা থেকে। এদিকে রাখাল ছেলেও ভুলে যায় তার কথা। তাই ওই জঙ্গলে—ওই পাহাড়ের মাথায় তাকে রেখেই বাড়ি ফিরে যায় সে গরু ছাগলের পাল নিয়ে।
গ্রামে ঢুকতে গিয়ে রাখল ছেলে দেখে, রামছাগলটাই আসেনি। ভয়ে তাড়াতাড়ি সবকটা গরু ছাগলকে বাড়িতে নিয়ে আসে সে। তাপর বলে, বড় রামছাগলটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।
সে কথা শুনে তার বাবা বলে, তুমি কোথায় ওদের চড়াতে নিয়ে গিয়েছিলে? বোধ হয় চিতা কিংবা অন্য কোন জন্তুতে খেয়েছে এটাকে।
না বাব, কোন জন্তুতে ওটাকে খেলে আমি জানতে পারতাম। সেদিকে আমি কড়া নজর রেখেছিলাম। আমি ওদের ওই পুরনো দলে নিয়ে গিয়েছিলাম।
সে কথায় তার বাবা বলে, ওই যেখানে বিরাট পাহাড়টা রয়েছে? ওর গুহাতে তো বাঘ আছে। নির্ঘাৎ বাঘে খেয়েছে রামছাগলটাকে। পরই লোকজনকে বলে, যাও তোমরা সবাই মিলে খুঁজে দেখ এটাকে।
ওরা সবাই রওনা হয় সেই জঙ্গলে। এদিকে রাতের আঁধার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাঘ ফিরেছে গুহায়। গুহায় ঢুকতে যাবার আগেই পাহাড়ের চুড়ার দিকে তাকিয়ে তার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া। ও নাগো! ওটা কি গো! অমন লম্বা লম্বা দাড়ি!
বাঘ দেখে ভয়ে কাঁপছে রামছাগলও। কপার সঙ্গে সঙ্গে দুলছে দাড়ি, নড়ছে শিং। পাহাড়ের মাথায় কাপছে রামছাগল আর গুহার মধ্যে ভয়ে প্রায় ভিরমি খায় বাঘ।
কাপতে কাপতেই বাঘ বলে, শুনুন মহারাজ! এখানে কি চান? এটা আমার বাড়ি, চলে যান এখান থেকে।
রামছাগলও বলে, যাব, তার আগে এ জঙ্গলের প্রত্যেকটি বাঘ আর ভাল্লুককে খাব। যতক্ষণ না সবকটাকে খাচ্ছি, ততক্ষণ নড়ছি না একপাও।
রামছাগলের সেই কথা শুনে বাঘ আর তাকায় না কোনোদিকে। লেজ তুলে সোজা দেয় ছুট। সে কি ছুট, না দেখলে তা কল্পনাই করা যায় না।
বাঘকে অমন ছুটতে দেখে একটা ভল্লুক তাকে বলে, ওকি খুড়ো, অমন করে ছুটছো কোথায়? বলি হয়েছেটা কি?
হয়েছেটা যে কি, তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না ভাইপো। আমার ডেরার হানা দিয়েছে একটা জন্তু। আজব জন্তু সেটা। ইয়া লম্বা তাঁর দাড়ি, লম্বা বর্শার মত পাকানো শিং।
তার সঙ্গে তোমার কি খুড়ো? তুমি তাকে থাকতে দিলেই পারো। আরে আগে শোনই না কথাটা। আমি তো তাকে বললাম, শুনুন মহারজি, আপনি কোথা থেকে এসেছেন। এখানে কি চান ? এখন তো রাত, একা একা ভয় লাগছে না আপনার ?
বুঝলে ভাইপো, এই কথাগুলো বলেই ভুল করেছিলাম আমি। আমার কথা শেষ হওয়া মাত্র সেই অজব জন্তু বলে—আমি যদি এই দির প্রত্যেকটা বাঘ আর ভল্লুককে খেতে না পারি তাহলে বরং উপোস করে থাকব, তবু ছাড়ব না এ জঙ্গল।
যেমন করে হোক তাদের সব কটাকে শেষ করব আমি—তার আগে সরব না কিছুতেই। কি বলব ভাইপো, রাগে আজব জন্তুটা কঁপছিল থরথর করে।
তাই না দেখে, মা দিকে না তাকিয়ে দিয়েছি ছুট, যদি বাঁচতে চাও তাহলে তুমিও দৌড়োও আমার সঙ্গে।
ভল্লুক বলে, আমার সঙ্গে চল খুড়ো। এখন আমরা দুজন। আমাদের দুজনকে সে নিশ্চরই একসঙ্গে খেতে পারবে না ! বাঘ বলে, হ্যাঁ কথাটা তুমি মন্দ বলনি ভাইপো। তাই চলে।
এবার বাঘ ভাল্লুক ফিরে চলে সেই পাহাড়ের দিকে। তাদের দুজনকে একসঙ্গে ওইভাবে চলতে দেখে পথে এক শেয়াল তাদের বলে, কি ব্যাপার মামা, তোমরা দুজনে জোড় বেঁধে চলেছ কোথায়?
তারা বলে, সে তুমি কল্পনাও করতে পারবে না ভাগ্নে। একটা রাক্ষস এসেছে আমাদের বাড়ি। রাক্ষস!
কি রকম দেখতে সেটা মামা! বাঘ বলে, বিচ্ছিরি রকম বড় ভাগ্নে, বিচ্ছিরি রকম বড়।
তা শুনে শেয়াল বলে, তাহলে তো আমাকে যেতে হচ্ছে সেটাকে দেখতে।
আর বলি কি মামা, আমরা তিনজনে গেলে নিশ্চয়ই সেটাকে হটিয়ে দিতে পারব সেখান থেকে। তবে একটা কথা। কি কথা?
আমরা তিনজনে তিনজনের সঙ্গে বাঁধা থাকব। যদি আমাদের মধ্যে কেউ হাঁফিয়ে যায়, তাহলে যার শক্তি বেশি সে পালাতে পারে।
এখন আমি হাঁফাতে পারি, তুমি হাঁফিয়ে যেতে পার। তাই তিনজনে যদি তিনজনের সঙ্গে বাঁধা থাকি, তাহলে পালাতে পারবে না কেউ।
সে যদি আমাদের কাউকে খায়, তাহলে তিনজনকেই খাবে, আর যদি বেঁচে যাই তাহলে তিনজনেই বাঁচব। এসো আমরা নিজেদের বেঁধেনি।
শেয়ালের কথামত তিনজনে বেঁধে নিল তিনজনকে বেশ শক্ত করে। তারপর তিনজনে মিলে ঢুকল সেই পাহাড়ের গুহায়। রামছাগল। যেই বুঝল, তারা এসেছে অমনি ভীষণভাবে গরগর করতে থাকল।
সেই নাক ডাকার আওয়াজ পাহাড়ের ওপর আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। সেই আওয়াজ না শুনে বাঘ, ভাল্লুক আর শেয়াল পড়ি কি মরি শুরু করল দৌড়।
বাঁধাবাঁধি অবস্থায় দৌড়তে গিয়ে প্রথমেই পড়ে গেল ভল্লুক। কিন্তু ওই অবস্থাতেই তাকে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে অন্য ভজনে ছুটতে থাকে।
যন্ত্রণায় চিৎকার করে ভাল্লুক বলে, থাম, থাম, আমার চামড়া উঠে গেল যে! কিন্তু কে কার কথা শোনে। বাঘ আর শেয়াল দৌড়াতেই থাকে।
একটু পরেই পড়ে যায় শিয়াল। এবার ভাল্লুক আর শেয়াল চিৎকার করতে থাকে—ও ভাল মানুষ খুড়ো, অমন করে টেনন না। আমাদের চামড়াটা উঠে গেল যে।
সে কথায় বাঘ এবার তাদের ওপর ঝাঁপিরে পড়ে। কামড়ে দুজনকেই মেরে ফেলে সে।
আর সেই রামছাগলটা! না, তার কথা আর জানে না কেউ কেন না, গল্পটার শেষই যে এখানে।
অর্জুনের কেরামতি অর্জুন তার নাম। থাকত সে এক গায়ে তার বউকে নিয়ে। অর্জুন ছিল খুব খাটিয়ে আর বউ ছিল ঠিক তার উল্টো। কুঁড়ে বলে কুঁড়ে যাকে বলে রাম কুঁড়ে।
ভাজা মাছটিও উল্টে খেতে ইচ্ছে করে না তার। ঘরদোর কিছুই ঝাঁট দিত না সে। এই নিয়ে অর্জুনের সঙ্গে চলত তার নিত্য ঝগড়া।
ঝগড়া বললে অবশ্য ভুল বলা হবে। অর্জুনই তাকে যাচ্ছেতাই করে বকাঝকা করত। কিন্তু বউ তার এমনই যে পাল্টা কথা বলুতেও যেন কষ্ট হত তার।
খেতে বসে অর্জুন দেখত খাওয়ার জায়গাটি পর্যন্ত নিকোয়নি তার বউ। তাই ফু দিয়ে পরিষ্কার করত সে। তার বউ কিন্তু এটা নিয়ে লোককে বলত অন্য কথা।
সে বলত আমাদের ছেলের বাপ মন্ত্রতন্ত্র জানে গো। খেতে বসে পর্যন্ত ফু দিয়ে মন্ত্র পড়বে তারপর খাবে। মুরগি পর্যন্ত খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে ও।
তা এইভাবেই চলছিল দিন। এরই মধ্যে এক রাজ্যে ঘটল এক ঘটনা। সেই দেশেতে এল এক রাক্ষস। ধরে ধরে সে খেয়ে ফেলত মানুষজন, জন্তুজানোয়ার সব। তাই সে দেশে বাস করাটাই হয়ে উঠল মস্ত ভয়ের ব্যাপার।
সব দেখে ঘোষণা করে রাজা, খুঁজে নিয়ে এস কোনো ভাল ওঝা-যে মন্ত্র পড়ে মারতে পারবে ওই রাক্ষসকে ।
রাজার আদেশে দিকে দিকে রওনা হল পেয়াদা। কিন্তু রাক্ষস মারার জন্য সাহসভরে এগিয়ে এল না কোনো ওঝা। কোনো ওঝার খোঁজ না পেয়ে তারা একসময় এল অজু নদের গায়ে ! জিজ্ঞেস করে সে গায়ে কোনো ভাল ওঝা আছে কিনা।
কেউ কিছু জবাব দেবার আগেই অর্জুনের বউ বলে, আমাদের মরদ ভাল ঝাড়ফুক জানে গো।
অর্জুন বলে, ধুৎ, কি যা তা সব বকছ । অর্জুনের বউ কিন্তু বলে, ওসব বল না, যাও না—অনেক টাকা দেবে। অর্জুনের কিন্তু একই কথা, ধুৎ, আমি ওসব কিসসু জানি না আমি যাব না।
তাদের এই কথাবার্তার মধ্যেই দুই পেয়াদা অর্জুনকে ধরে, বলে, চল আমাদের রাজ্যেমন্ত্র পড়ে মেরে দাও রাক্ষসকে—বাঁচাও আমাদের। অর্জুন কিন্তু একই কথা বলে, আমি যাব না, কিছুতেই যাব না।
বউ তার বলে, যাও না লক্ষ্মীটি, আর শোনো গরু বাঁধার দড়ি আর কুড়লটা নিয়ে যাও সঙ্গে।
পেয়াদা দুজন ততক্ষণে জোর করে ধরেছে অর্জুনকে। বেচারা অর্জুন ! দড়ি আর কুড়ল নিয়ে যায় তাদের সঙ্গে।
তাকে তারা হাজির করে রাজার কাছে। অনকে জিজ্ঞেস করে রাজা, রাক্ষসকে মারতে পারবে তো? অর্জুন বলে, কে জানে। আগে কিছু ক্রিয়াকর্ম করতে হবে, তারপর বোঝা যাবে পারব কিনা ?
রাজা বলে, খুব ভাল শুরু করে দাও তোমার ক্রিয়াকর্ম । অর্জুন জানায়, এখানে তো তা করা যাবে না। গাঁয়ের শেষ। মাথায় রয়েছে যে রাস্তাটি ওইখানে বসে করব আমি ক্রিয়া।
সবাই মিলে গেল সেই গাঁয়ের সেই শেষ রাস্তায়। অর্জুনের পেছন পেছন গেল রাজ্যের যত মানুষ। প্রায় মাঝরাতে তারা পৌছল গাঁয়ের সেই রাস্তার শেষে। অজুন বলে, শোন এখন বরং একটু গড়িয়ে নেওয়া যাক। একটু পরে শুরু করব ক্রিয়া।
অর্জুনের কথায় সবাই শুয়ে পড়ে সেখানে। আসলে অর্জুনের মতলব ছিল সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়বে, সেই সময়েই পালাবে সে সেখান থেকে।
একটু বাদেই ঘুমিয়ে পড়ে সবাই। নাক ডাকতে শুরু করে অনেকের। আর সেই তালে দড়ি আর কুড়ল নিয়ে চুপিচুপি উঠে পড়ে অর্জুন—পাড়ি দেয় সে রাজ্যের বাইরের দিকে।
এদিকে হয়েছে কি, অর্জুন চলেছে যে পথে, ঠিক তার উল্টো পথ ধরে আসে সেই রাক্ষস। রাস্তার মাঝখানেই মুখোমুখি হয় তারা। রাক্ষসটাকে দেখেই অর্জুন জিজ্ঞেস করে, এই তুমি কে ? কোথায় চলেছ ?
আমি যাচ্ছি মানুষ খেতে। কিন্তু তুমি কে বটে ? ও! তুমিই সেই। আমি চলেছি তোমারই খোঁজে। আমার খোঁজ ? মানে ?
ও, তুমি জানো না বুঝি! তোমার মত বহুজনকে যাদু শিখিয়েছি আমি। তোমাকেও আমার যাদু শেখার আছে। সত্যি! শেখাবে আমাকে!
অর্জুন বলে, শেখাব বলেই তো এসেছি। কিন্তু সত্যিই কি তুমি শিখবে? শিখব, নিশ্চয় শিখব।
শোন, সত্যিই যদি শিখতে চাও, তাহলে একটি কথা বলবে না, শুধ আমি যা বলব তাই করে যাবে। না হলে, কিন্তু কিছুই শিখতে পারবে না।
রাক্ষস বলে, ঠিক আছে, আমি একটা কথাও বলব না। ভাল, খুব ভাল। চুপচাপ তাহলে শুয়ে পড় এখানে।
অর্জুনের কথামত শুয়ে পড়ল রাক্ষস। অর্জুন তার চাদর দিয়ে বেশ করে রাক্ষসের মাথাটা মুড়ে ফেলল। সেই গরুর দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধল তার হাত পা।
তারপর তার সেই কুড়াল দিয়ে সে কোপাতে থাকে সেই রাক্ষসকে। কোপাতে কোপাতে একসময় সে মেরেই ফেলে তাকে।
অর্জুন এবার বীরবিক্রমে ফিরে যায় সেখানে—যেখানে ঘুমিয়ে রয়েছে রাজ্যের যত লোক চিৎকার করে বলতে থাকে—যত সব অকর্মার ধাড়ি! পড়ে পড়ে সব ঘুম।
এমন আহাম্মকদের রাক্ষসে যাবে না তো খাবে কাদের। নাও, এবার দয়া করে সব ওঠ। রাক্ষসটাকে টেনে নিয়ে এসে এখানে।
লোকগুলো উঠে চোখ কচলাতে থাকে। বলে কি লোকটা। রাক্ষসটাকে টেনে আনব। আমাদের সঙ্গে রসিকতা করছে নাকি?
অর্জুন আবার একবার গালাগাল দেয় তাদের। বলা যায় “গালি দিয়ে আগাপাশুল যেন ধুইয়ে দেয়। তারপর বলে, যাও, গিয়ে দেখই না, আমি রসিকতা করছি কিনা ?
এবার লোকগুলো এগিয়ে যায়। দেখে সত্যিই পড়ে রয়েছে সেই রাক্ষস। এবার পড়ে যায় মহা হৈ চৈ। সবাই মিলে রাক্ষসকে কাঁধে করে নিয়ে হাজির হয় রাজার কাছে।
রাজা এবার মহাখুশি। অর্জুনকে রাজা দেয় পেতলের একটি ভর্তি টাকা। টাকা নিয়ে অর্জুন ফিরে আসে ঘরে।
অর্জুনের হাতে ঘটি ভর্তি টাকা দেখে তার বউ বলে, দেখলে তো, না গেলে এই টাকা পেতে? ভাগ্যিস আমি তোমাকে পাঠিয়েছিলাম তাইতো টাকাটা পেলে। অত কুঁড়ে হয়ে ঘরে বসে থাকলে কি টাকা রোজগার হয়—বেরোতে হয়–বুঝলে, বেরোতে হয়।
চোরা অৰ্জুন। রাক্ষস মারতে গিয়ে যে সেই জানে মারা পড়ছিল তা বলারও সুযোগ পেল না। উল্টে তার কুঁড়ে বউ-ই উপদেশ দেয় তাকে কুঁড়ে হলে জোটে না টাকা। হায়রে অদৃষ্ট!
মুরগির ‘ফুল’ শিয়াল পুরনো সেই দিনে ছিল এক শিয়াল আর এক মুরগি। শিয়ালে মুরগিতে দারুণ ভাব। দুজনে দুজনের সঙ্গে পাতিয়েছিল ফুল। সব সময় দেখা যেত দুজনকে একই সঙ্গে।
একদিন শিয়াল বলে, ফুল, আমরা তো একসঙ্গেতেই থাকি। কিন্তু কেউ এখনও কাউকে খাওয়াইনি। তাই বলছি একদিন তুমি এসো আমার বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে।
মুরগি বলে, ঠিকই বলেছ ফুল। তবে একা আমি নয়, তুমিও এসো আমার বাড়ি নেমন্তন্ন খেতে। | হুক্কা হুয়া করে শিয়াল বলে, সে তত খুব ভাল কথা—খুব ভাল কথা।
কোঁকর কেঁ৷ ডাক ছেড়ে মুরগিও বলে, ভারি মজা, ভারি মজা। ফুলের বাড়ি ফুলের নেমন্তন্ন-ভারি খাসা খাওয়া দাওয়া।
শিয়াল বলে, একটা কথা ফুল, খাবার দাবার যাই হোক হাড়িয়াটা কিন্তু ভাল হওয়া চাই। এক কাজ কর, আজ থেকেই তুমি তোমার মতো আর আমি আমার মতো হাড়িয়া তৈরি শুরু করি।
মুরগি বলে, হ্যাঁ, হাড়িয়া পচাতে তো সময় নেবে কয়েক দিন হাড়িয়াটা গেঁজে উঠলেই দিন ঠিক করা যাবে খাওয়া দাওয়ার। শিয়ালও সায় দেয় মুরগির কথায়। তারপর দুজনে চলে যায় যে যার ডেরায়।
হাড়িয়া তৈরির জন্য মুরগি জোগাড় করে ধান, ভুট্টা, বজরা, যব— এইসব। আসলে মুরগি যেসব খায় তাই দিয়েই সে হাড়িয়া তৈরি করে।
অন্যদিকে শিয়াল, তার খাবার গিরগিটি, ব্যাঙ, কাকড়া, মাছ, গঙ্গাফড়িং এইসব ধরে ধরে হাড়িয়া করতে বসে।
দিন তিন চার পরেই মুরগির হাড়িয়া তৈরি হয়ে যায়। ঢাকনা খুলতেই গন্ধে ম-ম করতে থাকে চারদিক। মুরগি ছোটে শিয়ালের বাড়ি।
বলে, ফুল, ফুল, আমার হাড়িয়া তৈরি, তোমারটা হয়েছে কি ? আমি করেছি চাল গমের হাড়িয়াভারি সুবাস ছেড়েছে তাতে।
শিয়াল বলে, আমারটাও তৈরি হয়ে গেছে ফুল। তখন মুরগি আর শিয়াল দুজনেই বলে, তাহলে এবার শুরু করা যাক খাওয়া দাওয়া। জল টল ঢেলে সাজিয়ে নি সব।
শিয়াল বলে, ফুল, আমি, বলি কি, আমারটা আগে খাওয়া যাক। মুরগি বলে, বেশ তো, তাই হবে ফুল। তারপর তারা দুজনে মিলে আসে শিয়ালের বাড়ি।
শিয়াল নিয়ে আসে হাড়িয়ার হাঁড়ি। পচা মাছ মাংসের গন্ধে গা গুলিয়ে ওঠে মুরগির। সে কিছুতেই খেতে পারে না শিয়ালের সেই হাড়িয়া। মুরগির হাল দেখে শিয়াল বলে, একি ফুল, তুমি দৈখি কিছুই খেলে না।
মুরগি বলে, কিছু মনে করো না ফুল, তোমার হাড়িয়ার গন্ধটা বড় পচা পচা। সত্যি কথা বলতে কি, খেতে গেলেই আমার গাটা গুলিয়ে উঠছে।
শিয়াল তো এসব খেতেই অভ্যস্ত। তাই সে একাই বেশ আয়েস করে সবটা খেয়ে নেয়।মুরগি এবার বলে, ফুল, আমার হাড়িয়াটা কেমন হয়েছে তা একবার চেখে দেখবে চল।
মুরগির বাড়িতে তার তৈরি হাড়িয়ায় মুখ দিয়ে দুজনেই ভারি খুশি। ভারি ভাল হয়েছে হাড়িয়াটা। ফলে দুজনেই প্রাণভরে খেতে থাকে হাড়িয়া।
হাড়িয়া খেতে খেতে মুরগির নেশা হয়ে যায়। তার মাথাটা ঝুলে পড়তে থাকে। নেশা হয় শিয়ালেরও। কিন্তু তারই মধ্যে তার দুষ্ট বুদ্ধিটা চাড়া দিয়ে ওঠে বেশ।
সে ভাবে, যে এমন সুন্দর হাড়িয়া করতে পারে, তার মাংসটাও নিশ্চয়ই দারুণ খেতে। আমি আর হাড়িয়া খাব না। মাতাল হয়ে মুরগিটা যখন লুটিয়ে পড়বে সেইসময়ই কপ করে আমি ওটাকেই খেয়ে ফেলব।
ওদিকে মুরগি তখন নেশার ঝোঁকে টালমাটাল। নাচতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। তাই দেখে গান জুড়ে দেয় শিয়াল খেয়ো না খেয়ো না মুরগি বাড়ির কানায় হাসে দেখ শেয়াল তোমারই গানায় যেয়ো না কেঁক পাখি ওই পুকুরে ব্যাঙের ঠ্যাং পাবে নাকো এই দুপুরে খেয়ো না, খেয়ো না মুরগি আর হাড়িয়া শেয়াল উঠিছে দেখ খালি হাসিয়া— হুকক।
হুয়া ওরে হুককা হুয়া শেয়ালের গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাচতে গিয়ে মুরগি যখন একেবারেই কাৎ—তখন তার ছানারা দেখে, শেয়াল বলছে, কি হল ফুল, ওঠ—এসো আমরা একটু নাচ গান করি।
তার কথা কিন্তু মুরগির কানে যায় না। সে তখন একবারেই বেহুশ। শেয়াল এদিক ওদিক তাকিয়েই মুরগির ঘাড়ে দেয় এক কামড়। তারপর কড়মড় করে চিবিয়ে খায় সেটাকে।
তার মনের আনন্দে বাড়ি গিয়ে দু-ঠ্যাং তুলে শুয়ে পড়ে শিয়াল। খানাগানা আর হাড়িয়া সবই আজ বড় জববর হয়েছে তার।
মাঝেমাঝেই ঠোটে জিব বোলায় শিয়াল আর ভাবে, মুরগির মাংসটা বড় খাসা । কাল ওর বাচ্চা ক’টাকেও সাবাড় করব আমি।
ওদিকে মুরগির বাচ্চাগুলো মাকে হারিয়ে একবারেই অনাথ। বাড়ির উঠোনে চক্কর মারতে মারতে তারা বলে, হায়রে, এখন আমাদের কি হবে? ওই শয়তান শেয়ালটা আমাদের মাকে খেয়েছে, কিন্তু ওটাকে আমরা মারব কেমন করে ?
আর ঠিক সেই সময়ই শিয়াল হাজির হয় মুরগির বাড়ি। ছানাগুলোকে দেখে সে বলে, কি হল ভাগ্লাভাগ্নির দল, তোমরা এমন কান্নাকাটি করছ কেন?
কি বলব মামা, কাল আমাদের মা মারা গেছে। এখন আমরা একদম একা, তাই কঁদছি।
চুকচুক করে ওঠে শিয়াল। বলে, ভারি দুঃখের কথা। তা ভাগ্নাভাগ্নির দল, তোমরা তাহলে রাতে শোও কোথায়? , ওই উনুনের ধারে।
খুব ভাল, খুব ভাল। তা সাবধানে থেক বাছারা। চারিদিকে বড় বিপদ। এইসব বলে শিয়াল চলে যেতেই মুরগির ছানারা বলে, শয়তান শেয়ালটা এবার আমাদের খাওয়ার মতলব এটেছে।
তাই জেনে গেল আমরা কোথায় শুই। ঠিক আছে, কালকে ওটা আমাদের মা-কে খেয়েছে, আজ আমরা যেমন করেই হোক ওটাকে মারব।
কালকেই মা একটা ডিম পেড়েছিল, কিন্তু কে ওটাকে তা দেবে। কেই বা ডিম ফোটাবে ? ওই ডিমটার সাহায্যেই আমরা হতচ্ছাড়া শিয়ালটাকে মারব।
এইসব যুক্তি করে তারা ডিমটাকে বলে। ও ভাই ডিম, তোমাকে আমরা ওই উনুনের মধ্যে রেখে দেব। যখনই শিয়াল আসবে তখনই তুমি ফেটে ওর চোখে লেগে ওকে কানা করে দেবে।
আমরা ওটাকে যেমন করেই হোক মারব। আর ভাই মুষুল, তুমি চুপটি করে দাড়িয়ে থেকো ওই দরজার কাছে। যেই শেয়ালব্যাটা পালাতে যাবে অমনি ঠাই করে পড়ো ওর মাথায়।
আর ভাই যত তলিখিড়কির কাছে শেয়াল এই পথে এলেই সোজা থেৎলে দিও ওর মাথা আর আমরাও এসে সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলব ওটাকে।
ওরা সবাই বলে, কখন, কখন আসবে বাঙ্গ শেয়াগ্রন্থাগার ) আজই—আজই রাতে।
ওরা সবাই বলে, খুব ভাল, খুব ভাল, কামরা যাকুর্কি ফের জায়গায়।
আজকেই দফারফা হবে ওই ছোঁচা শেয়ালে তারপর সবকিছু ঠিক করে মুরগির ছানাগুলো ছোট্ট একটা কুড়ল নিয়ে বসে থাকে বাইরে বাড়ির ছাঁচায়।
সন্ধ্যের পর গুটি গুটি শিয়াল যখন এল তখন তারা কেউ কিছু বলে না। শেয়াল সোজা উনুনের কাছে গিয়ে সামনের পা দিয়ে ছাই সরাতে থাকে, আর তখনই ফট করে ডিমটা ফেটে লাগে শিয়ালের চোখে।
শিয়াল চারদিকে অন্ধকার দেখে। হুক্কা হুয়া, মরে গেলামরে বলে সে ছুট লাগায়। যেতে গিয়ে দরজার কাছে মুযুলে ধাক্কা খেতেই সেটা ঠাস করে তার মাথায় মারে এক ‘কানা শেয়াল তখন পড়িমড়ি করে দৌড় লাগায় খিড়কির দিকে।
দরজার কাছে আসতেই যাঁতাটা পড়ে ধই করে তার মাথায়। লুটিয়ে পড়ে শিয়াল আর তখনই মুরগি ছানাগুলো কুড়ুল দিয়ে কুপিয়ে শেষ করে দেয় সেই পাজি শেয়ালকে।
গুতিয়ে গুতিয়ে তারা শিয়ালের মাথার ঘিলু বের করে দেয়। তারপর সেই ঘিলুটা নিয়ে বলে, তুমি যেমন আমাদের মাকে খেয়েছ আমরাও তেমনি খেয়ে নিচ্ছি তোমাকে। পাজি শিয়াল কোথাকার!
কাজের নামে অসুখ সে এক গাঁয়ের বধূর গল্প। কোন গাঁ তা জিজ্ঞেস করলে অবশ্য বলা যাবে না তার নাম। বউটিরই বা নাম কি তাও বলতে মানা। সত্যি কথা বলতে কি, যা নেই জানা—তার কথা বলা বড় শক্ত। তবে ঘটনাটা বড় মজার।
সেই নাম না জানা গাঁয়ের সেই বউটি আর তার স্বামী ছিল বড় সুখেই। অশান্তি নেই এতটুকু। তবে একেবারে অশান্তি নেই বললে ভুল বলা হবে ; আসলে বউটি ছিল বড় কুঁড়ে—আর সেটা নিয়েই অশান্তি।
অশান্তি না বলে অবশ্য অ-সুখ বলাই ভাল। যখনই কোনো শক্ত কাজ আসত তখনই বউটির হত অসুখ আর তাতেই বাড়ির সবার অ-সুখ। তারা বুঝে পায় না ব্যামোটা কি?
অথচ তখন তারা বউটিকে দেখবে, না সেই কাজ করবে ? বিশেষ করে আষাঢ়-শ্রাবণে ধান রোয়ার সময় বউটির ব্যামো হবেই হবে। বিছানায় শুয়ে গোঙাতে থাকবে সে।
বাধ্য হয়েই তাকে ঘরে রেখে সবাই চলে যায় মাঠে। আর সবাই যেই চলে যায়, অমনি উঠে বসে বউটি। ইতি-উতি খুঁজে ভাত আর অন্য খাবার খেয়ে নেয় সে।
যেদিন হাঁড়িতে ভাত থাকে না, সেদিন নিজের জন্য চারটি ভাত রেধে খেয়ে নেয় সে।
একদিন বউটির শ্বশুর মনে মনে বলে, না, ব্যাপারটা ভাল হচ্ছে না। বউকে এবার ওঝা দেখানো উচিত।
না হলে লোকে নিলে-মন্দ করবে। ওষুধপত্র খাইয়েও যদি কোনো ফল না হয়, তাহলে না হয় ওকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে ওর বাপের ঘরে।
এইসব নানা কথা ভেবে বউটির শ্বশুর সত্যি সত্যিই জনা দুই ওঝাকে নিয়ে এল। ওঝারাই যে ঝাড়ফুক করে, জরিবুটি দিয়ে রোগ সারায় তাদের।
তাই ওঝাদেরই ডেকে নিয়ে এল সেই বউটির শ্বশুর। বলল, ভাল করে দেখুন আপনারা, বউমাটি আমাদের ভুগছে এক অদ্ভুত রোগে।
ওর নাড়ী দেখে ব্যবস্থা করুন ওষুধপত্রের। না হলে ওর বাপ-মা শেষে বলবে, কোনো চিকিৎসাই আমরা করিনি ওর।
তার কথায় আসনে বেশ আয়েশ করে বসল দুই ওঝা। তারপর এক ওঝা বউটির হাতটি নিয়ে গম্ভীরভাবে দেখতে থাকল তার নাড়ী। খানিকক্ষণ বাদেই কিন্তু ওঝা একটু মুচকি হেসে দ্বিতীয় ওঝাকে ডেকে বলল, একবার তুমি দেখ।
দ্বিতীয় ওঝাও গম্ভীরভাবে নাড়ী দেখতে দেখতে একটু মুচকি হেসে রেখে দেয় বউটির হাত। তারপর দুজনেই বসে থাকে চুপচাপ।
বউটির শ্বশুর এবার বলে, কী দেখলেন আপনারা? কী হয়েছে। বউমার ? ওষুধপত্রই বা কী দিতে হবে?
দুই ওঝা গম্ভীরভাবেই বলে, ব্যামোটা বড় শক্ত। বড় জটিল বোগটা। ওকে জড়িবুটি গুড়িয়ে খাইয়ে দিন।
তাহলে আপনার ওষুধ দিন। দয়া করে ভাল করে দিন আমাদের বউমাকে। আমি তো শেকড়-বাকড় কিছুই চিনি না। সেই জন্যই তো আপনাদের ডেকে নিয়ে এলাম। এখন যা করার করুন আপনারা।
দুই ওঝাতে এবার সেই বউটির সামনেই বলতে থাকে। হ্যা ঠিকই বলেছেন আপনি। ওষুধ দিতে হবে আমাদেরই। আমরা দেবও। তার আগে অবশ্য একটু ঝাড়-ফুক করতে হবে—পড়তে হবে কিছু মন্ত্র।
পর ওষুধ দিলে তবেই কাজ হবে নিশ্চিত। না হলে ফল হবে না। বেশ তো যাতে কাজ হয় তাই করুন। আধখেচর কিছু প্ররি দরকার নেই আপনাদের।
বাড়ির কর্তার কথায়, দুই ওঝাতে এবার বলে, বেশ তাই হবে। আমারই ওষুধ তৈরি করব। তারপর ঝাড়ফুক করে দেব সেই ওষুধ।
কর্তা বলে, দয়া করে যা করার তাই করুন। এখন বড় কাজের চাপ।রোগা লোককে একাও বাড়িতে রাখা যায় না আবার একজনকে যে রেখে যাব তারও উপায় নেই। মাঠে যেতে হয় সবাইকেই দয়া করে তাড়াতাড়ি ওষুধটা দিন।
ঠিক আছে, ঠিক আছে। আজ আমরা ওষুধটা খুঁজে পেতে তৈরি করি—তারপর কাল দেব সেই ওষুধ। বলেই দুই ওঝা গাঁয়ের পথ ধরে। তাদের এগিয়ে দিতে সঙ্গে চলে বাড়ির কর্তা।
কিছুদূর এসে দুই ওঝা বলে, আপনার বউমার কিচ্ছু হয়নি, হয়েছে। কুঁড়েমির জ্বর।
তাহলে সে রোগ ভাল করব কি করে। সে ভাবনা ভাবতে হবে না আপনাকে। ও রোগেও সারিয়ে দেব আমরাই।
এই রোগেরও জবর দাওয়াই জানা আছে আমাদের। আপনি শুধু চুপচাপ থাকবেন। কাউকে জানাবেন না এসব কথা।
সেই মতো কর্তা চুপচাপ আর দুই ওঝা বনে গিয়ে মাটি খুঁড়ে বের করে বিরাট দুই ‘পটলকোণ্ডা’, মানে মেটে আলু। এক একটা আলু কুমড়োর মতো বড়। সেই পটলকোণ্ডা নিয়ে ওঝারা চলে আসে ঘরে।
তারপর যখন সন্ধ্যে হল, তখন তারা দুজনে আবার গেল সেই বউটির বাড়ি। বাড়ির কর্তাকে ডেকে তারা বলে, ওষুধ আমরা পেয়েছি। কালকেই দেব সেই ওষুধ। খুব ভোরে দেব সেই ওষুধ। কিন্তু মনে রাখবেন, এখানে নয়। ওষুধ দেব গাঁয়ের সেই শেষ তেমাথায়।
ওইখানেতেই আপনাদের সবাইকে ঝাড়ফুক করে ওষুধ দেব আমরা বউমাকে। আজকেই জানিয়ে গেলাম, কাল ভোরে বাড়ির কেউ যেন যাবেন না অন্য কোনোখানে।
বাড়ির সবাই বলে, না, না, কোথাও যাব না আমরা। ভোরবেলাতেই হাজির হব ওই তেমাথায়।
ঠিক আছে, আমরাও সেই কোরেই যাব সেখানে। কথা ঠিকঠাক । ওঝারা এবার সেখানেই রাতের খাওয়া সেরে ফেরে নিজেদের ঘরে।
পরদিন সেই মোরগডাকা ভোরে দুই ওঝা প্রথমেই সেই ‘পটলকোণ্ডা’ দু’টো রেখে আসে গাঁয়ের সেই তেমাথায়। তারপর সেই বউটির বাড়ি গিয়ে ডেকে তোলে সবাইকে।
দুই ওঝা এবার পেতলের এক গ্লাসে করে জল, কিছুটা সিদুর আর একটা ভাঙা কুলো নিয়ে সবাইকে আসতে বলল তাদের সঙ্গে।
গাঁয়ের সেই তেমাথায় তারা সেই ভাঙা কুলোর ওপর বসায় বউটিকে। সিদুর নিয়ে তার মুখকে করে চিত্রবিচিত্র। তারপর উৎকট সব মন্ত্র পড়ে শুরু করে ঝাড়ফুক।
কিছুক্ষণ পরে তারা সেই ‘পটলকোণ্ডা দুটোকে নিয়ে এসে ঝুলিয়ে দেয় বউটির গলার দুদিকে। তারপর বলে, বউমা, এবার ঠিক এইভাবে গাঁয়ের এই রাস্তা ধরে তিনবার এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত যাও।
যতক্ষণ না তোমার তিনবার যাওয়া আসা হচ্ছে ততক্ষণ আমরা এইভাবে বসে থাকব এখানে। মনে রেখ তিনবার তুমি এই রাস্তা ধরে সারা গাঁ ঘোরার পরই আমরা উঠতে পারব।
সেই সাত সকালে অমন অদ্ভুতভাবে বউটি হাঁটতে থাকল গায়ের ভগ ধরে। তার গলায় ঝুলতে থাকল দুটি ঢাউস মেটে আলু। তার বা মখে সিদুর। ওই বিচিত্র রূপ দেখে সবাই হাসতে থাকল।
গাঁয়ের ছেলেমেয়েগুলো পর্যন্ত তার পেছন পেছন হাততালি দিয়ে লতে থাকল। সব মিলিয়ে বউটি লজ্জায় একেবারে জেরবার।
দুই ওঝা কিন্তু তখনও তাকে বলে, যতক্ষণ না তুমি পুরোপুরি সেরে যাচ্ছ, যতক্ষণ না রোগের ভূত নামছে তোমার ঘাড় থেকে ততক্ষণ কিন্তু এই ওষুধ ঝুলবে তোমার গলায়।
যখন তোমার মনে হবে পুরোপুরি সেরে গেছ তুমি, তখনই গলা থেকে খুলে ফেল এই পটলকোণ্ডা।
এখন বউটি চলে আর পেছনে ওঠে হাসির হররা। এইভাবে দুবার গাঁয়ের পথে ঘোরার পর বউটি আর পারে না।
গলা থেকে সেই পটলকোণ্ডা খুলে ছুড়ে ফেলে দেয় দূরে তারপর ছুটে চলে যায় ঘরে।
দুই ওঝাও যায় তার পিছু পিছু।
ঘরে গিয়ে তারা বউটিকে বলে, কী বউমা, অত তাড়াতাড়ি তুমি ভাল হয়ে গেলে, নাকি এমনি ও দুটোকে ছুড়ে ফেলে দিলে।
বউটি এবার হেসে ফেলে। দুই ওঝা বলে, মনে রেখ, আবার যদি তোমার এমন অসুখ হয়—তাহলে কিন্তু আবার দেব এই ওষুধ। জানো তো আমরা সব রোগ ধরতে পারি।
সেদিন থেকে সেই গাঁয়ের বধূ পুরোপুরি ভাল হয়ে গেল। আর ই তার কুঁড়েমি। আর পাঁচজনের সঙ্গে সেও খাটে সমানভাবে। তাই দেখে খুশি তার শ্বশুরঘরের লোকেরাও।
আর ছাগল চুরি নয়
সেই সেকালেরই গল্প। অনেক অনেক দিন আগে এক গায়েতে একজনের একটা ছাগল হঠাৎ-ই ঢুকে পড়ে অন্য একজনের বাড়ি।
যেই ছাগলটা ঢুকেছে সেই বাড়িতে অমনি সে বাড়ির মালিক মেরে ফেলে সেই ছাগলটাকে।
সন্ধ্যে হয়। তারারা মিটমিট করে জ্বলে ওঠে আকাশে। যার ছাগল—সে ততক্ষণে বেরিয়ে পড়েছে ছাগলের খোঁজে। খুঁজতে খুঁজতেই সে আসে সেই লোকটির বাড়ি। বলে, আমার ছাগলটাকে দেখেছ?
সেটা তোমাদের ছাগলের পালের সঙ্গে এখানে চলে আসেনি তো? ছাগলটাকে মেরেছিল যে লোকটি সে বেশ ভাল মানুষের মতোই বলে, কে জানে, সত্যিই তোমার ছাগলটা আমার ছাগলের পালের সঙ্গে এসেছে কিনা?
তা এক কাজ কর তুমি। এই আলোটা নিয়ে একবার বরং দেখে এসে আমার ছাগল রাখার জায়গাটা।
সে কথায় লণ্ঠন নিয়ে লোকটি যায় ছাগল রাখার জায়গায়। ভাল করে দেখে সে সবকটা ছাগলকে। না, তারটি নেই কোথাও।
আসলে থাকবে কী করে? লোকটি তো আগেই সেটিকে মেরে রেখে দিয়েছে অন্য জায়গায়। বেচারা ছাগলের মালিক, ছাগলের খোঁজ না পেয়ে চলে যায় শুকনো মুখে।
লোকটা চলে যেতেই সেই লোকটি টেনে বের করে সেই ছাগলটাকে। তারপর বেশ ভাল করে কেটেকুটে কিছুটা মাংস রেখে দেয় আর বাকিটা রান্না করে সেই রাতেই।
সে রাতে তাদের বাড়িতে হল দারুণ ভোজ। মাংস দিয়ে বেশ জবর খাওয়া হল তাদের। তারপর লোকটি তার ছেলেকে বলে, শোন ছেলে, ছাগলের মাংসটা তোফা।
কিন্তু খবরদার, কাল ছাগল চরাতে গিয়ে ভুলেও যেন ওই লোকটার ছেলেদের আশেপাশে যেও না। তারা কিন্তু তোমার গা থেকে ছাগলের মাংসের গন্ধ পাবে। তাহলেই ধরা পড়ে যাব আমরা।
সে রাতে বাপের ওই কথার উত্তরে ছেলে রা কাড়ে না একটাও। পরদিন সকালে লোকটির ছেলে গরু-বাছুর, ছাগল নিয়ে যায় গাঁয়ের সেই মাঠটাতে—যেখানে গাঁয়ের সবাই চরায় তাদের গরু ছাগল।
ওই মাঠেতে গরু ছাগল ছেড়ে দিয়ে ছেলেরা রোজই খেলা করে। কিন্তু সেদিন সেই ছেলেটির কাছে যখনই কেউ আসে অমনি সে দূরে সরে যায়।
ছেলেটি সরে যাচ্ছে দেখে, অন্যরা খালি আসতে থাকে তার কাছে। তাই দেখে বিরক্ত হয়ে সে বলে—খুব সাবধান, তোমরা কেউ আমার কাছে এসো না। তাহলেই কিন্তু গন্ধ পেয়ে যাবে।
গন্ধ, কিসের গন্ধ পাব আমরা? ছেলেগুলিই এবার প্রশ্ন করে। কেন ছাগলের মাংসের। কাল রাতে আমি ছাগলের মাংস খেয়েছি। বাড়িতে এখনও কিছুটা মাংস রয়েছে। আজ ফিরে গিয়ে আবার আমি মাংস খাব।
সেই ছাগলের মালিকের ছেলেরা একথা শুনে তাদের বাড়িতে বলে দেয় সব। সবাই মিলে তখন চড়াও হয় সেই লোকটির বাড়ি। তল্লাস করে সত্যিই পাওয়া যায় কিছুটা মাংস।
তখন পাঁচজন মিলে পাঁচসিকে জরিমানা করে তার। শুধু তাই নয়, তার একটা ছাগলও দিতে হয় সেই লোকটিকে।
এবার সেই লোকটি ভাবে অন্যের ছাগল খাওয়ার ফল পাওয়া গেল দেখি হাতে হাতেই। আর কখনও অন্যের ছাগল চুরি করে খাওয়া নয়। বিশেষ করে তার ঘরে যখন রয়েছে অমন হাঁদা গঙ্গারাম একটি ছেলে।
চিতা আর ব্যাপারীরা সে অনেক অনেক দিন আগের কথা। হ্যাঁ, বুড়ো বুড়ির ঠিক এইভাবেই শুরু করে গল্পটা।
পুরনো সেই অনেক অনেক দিন আগে-জঙ্গলে ছিল এক চিতা বাঘ। ভারি পেটুক সেই চিত। বনের পশু মেরে তো সে নেই, সুযোগ পেলেই হানা দিত গায়েও।
টেনে নিত গরু ছাগল, ভেড়া কিংবা মোষ। শুধু তাই নয়, বাদ দিত না মানুষজনকেও। যত বীর্য ততই যেন চাগার দিয়ে ওঠে তার খিদে।
চিতার অত্যাচারে তিতিবিরক্ত গাঁয়ের মানুষজন। ভাবে একটা বিহিত করতেই হবে এর। কথাটা শুনে গাঁওবুড়ো, মানে মোড়ল বলে, বিহিত মানে তো মেরে ফেলা।
সবাই মিলে বলে, হ্যাঁ মেরেই ফেলতে হবে ওই হতচ্ছাড়া চিতাকে। ওর জন্য জঙ্গলে ঢোকা হয়েছে দায়। তাল পেলেই টেনে নেবে একে ওকে। গায়ে যে ঠিকভাবে থাকব তারও উপায় নেই—হামলা চালাবে যখন তখন। তাই ওকে মেরেই ফেলতে হবে।
গায়ের লোকেরা চিতাকে মারবার জন্য নানা ফন্দি আঁটতে থাকে। কিন্তু এমনই চালাক সেই চিতা, কোন ফাঁকে ঠিক সেই জাল কেটে বেরিয়ে যায়।
এবার ঠিক হয়, এইভাবে নয়। আশপাশের সব গাঁয়ের লোক মিলে ঘিরে ফেলবে ওই জঙ্গল। সবাই মিলে কেটে সাফ করবে বন,দেখবে কোথায় লুকিয়ে প্রাণ বাঁচায় ওই চোর চিতা।
কথামত গায়ে গায়ে পড়ে গেল টেড়া। অমুক দিনে মারা হবে চিতাটাকে—সবাই হাজির হও হাতিয়ার নিয়ে।
তারপর—ঠিক সেই দিনটাতে নানা গাঁ থেকে এসে হাজির হয় অনেক অনেক লোক। কারো হাতে কুড়ল, কারো হাতে দা। কেউ এনেছে কাস্তে আবার কেউবা তীর ধনুক। সব মিলিয়ে সে এক ধুন্ধুমার কাণ্ড।
অত মানুষজন মিলে বন ঘিরে ধরেছে দেখে ভয় পেয়ে যায় চিতা। ভাবে এবার বুঝি সত্যিই জানটা যাবে তার। কোনোমতেই রেহাই পাওয়া যাবে না এই রাগী মানুষগুলোর কাছ থেকে।
চিতা ভয় পায়, কিন্তু আশা ছাড়ে না। কেন না সে জানে, যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণই আশ। আগেই হাল ছেড়ে দিলে মরা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো রাস্তা থাকবে না। কিন্তু চেষ্টা করলে হয়তো বাঁচার একটা সড়ক মিলে গেলেও যেতে পারে। তাই ফঁক ফোকর খোঁজে চিতা।
চিতা ভাবে, লোকগুলো একদিনই এসেছে তাকে মারতে। আজ যদি কোনোরকমে বেঁচে যায় তাহলে বেঁচেই গেল সে। রোজ রোজ তো আর আসবে না ওরা।
বনের মাঝখান দিয়েই গেছে এক রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে এগোচ্ছিল তখন একদল লোক তাদের গরু-বাছুর, ছাগল-ভেড়ার পাল নিয়ে। রাস্তা জুড়ে চলেছে ওইসব গরু ভেড়া।
পেছনে পেছনে লোকগুলো। ওদের দেখে চিতার প্রাণে বুঝি জ্বলে ওঠে আশার প্রদীপটা। মনের ভয়টাকে চেপে রেখে সে সোজা এসে হাজির হয় লোকগুলোর সামনে।
চিতাকে দেখে তো ভয়ে সিটিয়ে যায় লোকগুলো। আড়চোখে তাদের সেই ভয় ভয় ভাবটা দেখে চিতা বলে, এই লোকগুলো, তোমরা যদি আমার একটা উপকার কর তাহলে আমি তোমাদের ছেড়ে দেব।
কিন্তু আমার কথায় রাজি যদি না হও তাহলে তোমাদের গরু ভেড়াকে খাব, তোমাদেরও খাব। বল, রাজি কিনা? লোকগুলো বলে, কথাটা কি তাই তো জানলাম না এখনও?
ও বলিনি বুঝি? তা শোন, বেশ গম্ভীরভাবেই বলে চিতা। আমাকে মেরে ফেলার জন্য এই জঙ্গলটাকেই ঘিরে ধরেছে গায়ের লোক।
এখন তোমরা যদি আমাকে বাঁচাতে পারি, তাহলে ভাল। নাহলে, বুঝতেই পারছবলেই চিতা হাই তোলার ছলে তার ছু’চলো দাঁতগুলো আর হাত পায়ের নখগুলো দেখায়।
লোকগুলো বলে, বলল তোমার কথা। শোনাই যাক! চিতা বলে, দেখ, আমি হচ্ছি এই বনের রাজা। তোমরা যদি আমার কথা শোন, তাহলে তোমাদের সুখের সীমা পরিসীমা থাকবে না।
আর যদি কথা না শোন তাহলে তোমাদের সামনে হাজির হবে ভয়ঙ্কর—মানে বুঝতেই পারছ—মৃত্যু। শুধু তোমরা নয়, তোমাদের এই যে গরুবাছুর, ছাগল ভেড়াকেউ রেহাই পাবে না আমার হাত থেকে।
চিতার কথা শুনে লোকগুলো বলে, এত ভয় দেখাবার কি আছে, তোমার কথাটাই আগে বল, আমরা শুনি, তারপর তো কথা দেওয়ার পালা।
চিতা বলে, দেখ, আমি বুঝতে পেরেছি তোমরা সব ভাল মানুষের ছা। কিন্তু ওই সব গাঁয়ের লোকগুলো, ওরা দারুণ বদ। ওরা সবাই সিলে আজ আমাকে মারবার ফন্দি এঁটেছে।
আর তাই আমি তোমাদের অনুনয় করছি, না, অনুনয় নয়, হুকুম করছি, তোমরা যদি আজ আমাকে ওই মারকুটে লোকদের হাত থেকে বাচাও তাহলে তোমাদের খুব ভাল হবে।
আমি জানি, করুণায় গলে যাচ্ছে তোমাদের মন। তাই বলছি, আমাকে লুকিয়ে রাখো, বাঁচাও। লোকগুলো বলে, কেমন করে ?
তোমাদের ওই যে জিনিসপত্রে ভরা বস্তাটা রয়েছে ওর থেকে জিনিসগুলো ফেলে পুরে ফেল আমাকে—তারপর ওই মারকুটে লোকগুলো চলে গেলেই ছেড়ে দেবে আমাকে। ব্যস, এইটুকু শুধু কাজ।
ওই লোকগুলো নিজেদের মধ্যে খানিকটা শলাপরামর্শ করে। তারপর চিতাকে বলে, দেখ, তোমার কথায় আমরা রাজি। কিন্তু তোমাকেও কথা দিতে হবে, আর কোনো দিনই, কি দিনে, কি রাতে।
আমরা ব্যাপারীরা যখন এই বন দিয়ে যাব তুমি আমাদের কাউকে খাবে না, ভয় দেখাবে না, একটা আঁচড়ও কাটবে না আমাদের কিংবা আমাদের এইসব গরু ভেড়ার ওপর।
ওদের কথা শেষ হবার আগেই চিতা বলে, আর এই কথাটাই তো আমি আগে বললাম, তোমরা যদি আজ আমাকে বাঁচাও, তাহলে জীবনভর আমাদের মধ্যে থাকবে এই কথা।
কো্নো দিন, সে গভীর কালো অন্ধকার রাতই হোক, আর আলো ঝলমল দিনই হোক, তোমাদের আমি কিচ্ছুটি বলব না। কোনরকম ভয়াস না করে বুক ফুলিয়ে সোজা তোমরা চলে যাবে আমার এই বনের মধ্য দিয়ে।
চিতার কাছ থেকে কথা পেয়ে ব্যাপারীরা এবার বস্তা থেকে সব জিনিসপত্র কে, করে চিতাটাকে তার মধ্যে পুরে ফেলে। তারপর একটা বলদের পিঠে বেশ আচ্ছা করে বেঁধে তারা চলতে থাকে।
সময় শেষ হয় বন। ওদিকে সেই সাত গাঁয়ের মানুষজন সারা বন চুরেও চিতাকে না পেয়ে ফিরে যায় যে যার ঘরে।
লোকগুলো এবার চিতাকে বলে, দেখ, আমরা তোমাকে সেই বন পার করে অন্য বনে নিয়ে এসেছি। আর সেই স্মৃতির চুলে গেছে যে যার ঘরে। তাহলে এবার আমাকে বস্তা থেকে বের করে দাও?… |
লোকগুলো চিতাকে বস্তা থেকে বার করতেই সে আড়মোড়া ভি বলে, তোমরা আমাকে বাঁচিয়েছ সত্যিই। আমিও সত্যিই আমার দারুণ খিদে পেয়েছে, এবার আমি তোমার খামাদের গরু বাছুর খাব, তারপর তোমাদেরও খাব।
চিতার এই ভোল বদলানো দেখে আকাশ থেকে পড়ল লোকগুলি। তারা বলে, তুমি বলেছিলে,তোমাকে বাঁচালে আমরা সুখে থাকব। কিন্তু এই কি সুখ?
মরলে পরে তো সব দুঃখই ঘুচে যায়। তার চেয়ে বড় আর কোনো সুখ হতে পারে বল ?
চিতার কথায় লোকগুলি বুঝতে পারে, মহা ধূর্ত এই চিতা।
এর হাত থেকে বাঁচার আর কোনো রাস্তাই খোলা নেই সামনে। তাই ভয় জড়ানো গলায় তারা বলে, দেখ, তুমি আমাদের নিশ্চয় খাবে, কিন্তু তার আগে আরো কয়েকজনের মত নেওয়া যাক।
তারা যদি তোমার কথাতেই সায় দেয়—তাহলে দয়া করে তুমি আমাদের নিশ্চয়ই খাবে—দেখ তখন আর কোনো ওজর আপত্তি তুলব না আমরা।
লোকগুলির কথা মেনে নেয় চিতা। বলে, বেশ, কার কাছে যাবে বল। যাওয়া যাক সেখানেই।
লোকগুলি চারদিকে তাকায়। কিন্তু বিচার করতে পারে এমন কাউকে দেখতে পায় না আশেপাশে। শেষে একটা মহুয়া গাছ দেখতে পেয়ে তারা বলে, বেশ, জিজ্ঞেস করা যাক একেই।
চিতা বলে, বেশ তো, সাক্ষি মানো তোমরা এই মহুয়াকেই। তাদের কথা শুনতে পেয়ে মহুয়াই বলে, বলি হয়েছে কি এত গোল কিসের ?
ব্যাপারীরা বলে, মহুয়া, ও মহুয়া গাছ, তোমাকে বিচার করতে হবে একটা। বেশ তো, বল কাণ্ডটা কি? আমি বিচার করে দিচ্ছি এক নিমিষে।
ব্যাপারীরা বলতে থাকে, দেখ এই চিতাকে, একে মারতে জঙ্গল ঘিরেছিল একদল লোক। তাদের হাত থেকে আমরা একে বাঁচিয়েছি। বাঁচিয়েছি যে, তা তো তুমি দেখতেই পাচ্ছ।
তখন চিতাটি বলেছিল, তোমরা আমাকে এবারের মতো বাঁচাও আমি তোমাদের কোনো ক্ষতি করব না, কখখনো খাব না তোমাদের। কিন্তু এখন বলছে, আমি তোমাদের নিশ্চয়ই—নিশ্চয়ই খাব।
মহুয়া গাছ, তুমিই বল, এটা কি ঠিক হচ্ছে ? এর একটা বিচার কর তুমি। মহুয়া গাছ ডালপালা দুলিয়ে বলে, হ্যা এই চিত তোমাদের নিশ্চয়ই খাবে। তোমরা মানুষরা বড় অকৃতজ্ঞ।
তোমরা গাছের ছায়ায় বসে—কিন্তু সেই গাছের ওপর তোমরা কুড়ল চালাও। গাছের শেকড় বাকড়ের ওপরও নেমে আসে তোমাদের কুড়ল। তাই বলছি, ওই চিতা নিশ্চয়ই খাবে তোমাদের।
মহুয়ার কথা শুনে মুখ শুকিয়ে যায় ব্যাপারীদের। চিতা একটা ডিগবাজি খেয়ে বলে, বিচারের রায় শুনলে তো। আনি নিশ্চয়ই বাৰ তোমাদের। ব্যাপারীরা বলে, দাড়াও, আরো দুজনের রায় শোনা যাক।
তারাও যদি একই কথা বলে তখন তুমি আমাদের খেয়ো, একটা কথা বলে না তখন।
চিতা বলে, বেশ, চল তবে এগোনো যাক। চলতে থাকে তারা! কিছুটা গিয়েই চোখে পড়ে একটা পুকুর।
ওরা বলে, চল এবার তাহলে জিজ্ঞেস করা যাক এই পুকুরটাকেই। ওরা এগিয়ে যায় পুকুরের কাছে। বলে, ওগো পুকুর, আমাদের কথাটা শুনে তুমি একটা বিচার করে দাও তো ?
কি কথা তোমাদের?
ওরা এই চিতাটাকে মারতে চাইছিল। সেইসময় ও আমাদের বলে, আমাকে বাঁচাও, জীবনে আমি তোমাদের খাব না। আমরা ওকে বাঁচাই। তুমি তো দেখতে পাচ্ছ ওকে। কিন্তু এখন বলছে, ও আমাদের খাবে। এখন তুমিই বিচার কর, এটা কী ঠিক হচ্ছে।
পুকুর জলে কোনো ঢেউ না তুলেই বলে, ও নিশ্চয়ই তোমাদের খাবে। তোমরা মানুষরা বডড পাজি। তোমরা আমার জল খাও, আবার আমার জলেই তোমরা ময়লাটয়লাও ফেল। তাই ও তোমাদের নিশ্চয়ই খাবে।
পুকুরের মত শুনে তো লোকগুলোর অজ্ঞান হবার অবস্থা। চিতা আরেক পাক ঘুরে বলে, তাহলে বুঝেছ, আমি তোমাদের খাবই খাব, ওরা দুজনেই বলেছে। তোমাদের খেয়ে ফেলাই উচিত আমার।
লোকগুলো মাথা নেড়ে বলে, হ্যাঁ তা বলেছে সত্যি। এর আরো একজন—আরো একজায়গায় জিজ্ঞেস করা যাক। চিতা তার লালঝরা মুখটা আর একবার চেটে বেশ উদারভাষ্ট্রে বলে, বেশ তো, জিজ্ঞেস করো আরো একজনকে।
আবার হাঁটতে থাকে তারা। হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা গেছে তারা। এমন সময় দেখতে পায় একটা শিয়ালকে। ওরা বলে, বেশ জিজ্ঞেস করা যাক এই শেয়ালটাকেই। এও যদি বলে একই কথা তাহলে আমরা অরি রা-টি কাড়বো না।
শেয়ালও তাদের বিরুদ্ধে যাবে, এমনটি করে বলে, শেয়াল ভাই, একটু দাড়াও না।
কেন, হয়েছেটা কি ? একটা বিচার করে দেবে।
কিসের বিচার ? এই যে চিতাটা—চিতাটাকে দেখছ না একে মেরে ফেলতে চাইছিল কিছু লোক। তাদের হাত থেকে আমরা একে বাঁচাই। তখন বলেছিল, আমরা যদি ওকে বাঁচাই তাহলে কখনও খাবে না আমাদের।
কিন্তু এখন বিপদ থেকে রেহাই পেয়ে বলছে, আমাদের খাবে। তুমিই বল এটা কি ঠিক হচ্ছে ? আমরা ওকে বাঁচালামআর ও আমাদের মারতে চাইছে।
শেয়াল এবার চিতার দিকে তাকিয়ে গম্ভীরভাবে বলে, চিতামশাই, ঘটনাটা কি এইরকম, না অন্যরকম? আসলে আমি যদি আপনাকে জিজ্ঞেস না করি তাহলে আপনি বলতে পারেন, এমনই বিচারক আমাকে একবার জিজ্ঞেস পর্যন্ত করল না। তাই না? দয়া করে বলুন, ঘটনাটা কি ঠিক ওইরকম না অন্যরকম ?
না, ঘটনাটা ঠিক এই রকমই—এতটুকু জল মেশানো হয়নি এতে। শেয়াল এবার ব্যাপারীদের বলে, আপনারা বললেন, চিতাকে আপনারা লুকিয়ে বন পার করে এনেছেন।
এখন দয়া করে দেখান তে কেমনভাবে ওকে আপনারা লুকিয়ে এনেছিলেন? ওটা জানতে পারলেই আমরা জানতে পারব ঠিক ঠিক ব্যাপারটা।
আমরা ওকে একটা বস্তায় পুরে নিয়ে আসি। শেয়াল আবার জিজ্ঞেস করে চিতাকে, আপনিই বলুন, সত্যিই কি বস্তায় করে লুকিয়ে এনেছিল এরা।
চিতা বলে, হ্যাঁ, ঘটনাটা ঠিকই, এতটুকু মিথ্যে নেই ওতে। শিয়াল আবার গম্ভীরভাবে বলে ব্যাপারীদের, আচ্ছা ব্যাপারটা আমাকে একটু গুছিয়ে বলুন। বস্তায় পুরে এনেছিলেন তো একে ? ঠিক কেমন ভাবে ?
ব্যাপারীদের মধ্যে একজন যেন শেয়ালের কথার আসল মানেটা বুঝতে পারল। তাই তাড়াতাড়ি বস্তাটা নিয়ে চিতার কাছে গিয়ে বলল, তুমি একবার বস্তার মধ্যে ঢোকো তো, আমরা দেখিয়ে দি কেমনভাবে এনেছিলাম তোমাকে।
চিতা গুটি গুটি আবার ঢুকে যায় বস্তার মধ্যে। লোকটিও বস্তার মুখটা বেঁধে ফেলে বেশ জোরে। তারপর বলে, দেখুন, এইভাবে বস্তায় বেঁধে বলদের পিঠে চাপিয়ে ওকে আমরা নিয়ে এসেছি এখানে।
শিয়াল গম্ভীরভাবে বলে, হু খুব ভাল। আগে আমাকে ভাল করে পুরো ব্যাপারটা বুঝে নিতে দিন। বলতে বলতেই শিয়াল আবার চোখ মটকায় সেই লোকটির দিকে—যে বুঝতে পেরেছিল তার কথাটা ঠিক ঠিক ভাবে।
আর সেই লোকটাও বিরাট একটা পাথর মাথার ওপর তুলে সোজ। সেই চিতার মাথার ওপর ফেলে। এইবার বাকি যারা ছিল তারাও পাথর ছুড়ে মারতে থাকে চিতাকে। যতক্ষণ না চিতাটা মরল ততক্ষণ তারা পাথর ছুড়ে মারতেই থাকে।
শেয়াল এবার বলে, আমি যদি না থাকতাম তাহলে ও তোমাদের খেয়েই ফেলত। তাই না ? হুঁ, সত্যিই খেয়ে ফেলত এই বদমাস চিতাটা। তুমি সত্যিই বাঁচিয়েছ আমাদের।
শেয়াল হাসতে হাসতে বলে, ঠিক আছে। মনে রেখ, কোনো সময়েই দুর্জনের কথায় ভুলবে না। ভুললেই কিন্তু মরতে হবে।
ব্যাপারীরা বলে, আবার ভুলি। তারপর তারা ধরে রাস্তা আর শিয়ালও চলে যায় নিজের কাজে।
পেন্নাম তোমায় মরণআরক লতা বউকে নিয়ে দূর গাঁয়েতে থাকত একটা লোক। একদিন ঝগড়া করে বউ তার চলে গেল বাপের বাড়ি। এমনটা হয়েই থাকে।
আর বউ চলে গেলেই সবাই প্রায় তার পিছু পিছুই যায় শ্বশুরবাড়ি। তা এই লোকটিও করল তাই।
লোকটির শ্বশুরবাড়ি ছিল দূর গাঁয়ে। সেই গায়ে যেতে পথে পড়ে একটা বন। সেই বনের মধ্য দিয়েই এগিয়ে যায় লোকটি। যেতে যেতে জঙ্গলের মধ্যে সে দেখে অনেক মরণআরকের লতা। এ লতার পাতা খেতে ভারি মিষ্টি আর এর ডালপালা থেকে হয় ওষুধ।
লোকটি বনের মধ্যে সেই মরণআরকের পাতা তুলতে গিয়েও ভাবে, যাচ্ছি তো শ্বশুরবাড়ি। সেখানে জুটবে ভালমন্দ অনেক খাবার।
তবে এখন কেন এসব হাবিজাবি খেয়ে পেট ভরাই। তার চেয়ে বরং খিদেটা আরো চাগুক। শ্বশুরঘরেই খাবো বেশ কজি ডুবিয়ে।
এইরকম সাতপাঁচ ভেবে লোকটি সেই মরণআরকের পাতা না, খেয়েই চলতে থাকে। একসময় সে পৌঁছৌয় তার শ্বশুরঘর। জামাইকে সবাই খাতির করে বসতে দেয় চাটাই।
কিছুক্ষণের মধ্যেই শেষ হয়ে যায় রান্না। ডাক পড়ে খাবার। সে আর তার বউয়ের বড় ভাই হাত পা ধুয়ে খেতে বসে।
একথালা গরম ভাত আর সুন্দর মাংসর ঝোল দেখে জামাইয়ের মনে পড়ে যায় সেই মরণআরকের কথা।
সে ভাবে তখন যদি বোকার মতো ওই গাছের পাতা খেয়ে পেট ভরাতাম তাহলে এখন এসব খেতাম কি করে ? নিজেকে খুব চালাক মনে করে সে হঠাৎই হেসে, ওঠে হো-হো করে।
খেতে বসে অমন হো-হো করে হাসতে দেখে তার বউয়ের দাদা কিন্তু যায় ক্ষেপে। সে ভাবে, আমরা কোথায় তোমার আদর যত্ন করে খেতে দিলাম, আর ও কিনা সেই খাবার দেখে হাসছে? আমাদের হেয় করছে।
কথাটা ভাবতেই মাথায় রক্ত চড়ে যায় তার। লোকটি তখন সবে একগ্লাস ভাত মুখের কাছে তুলেছে কিন্তু তার বউয়ের দাদা ততক্ষণে তাকে কষিয়ে দেয় এক চড়।
তারপর একরকম ঘাড় ধরে তাকে তুলে দিয়ে বলতে থাকে সে, খিদের সময় আমরা তোমাকে খেতে দিলাম, আর তুমি কিনা হাসছ ? আমাদের ব্যঙ্গ করছ?
দেখাচ্ছি তোমাকে মজা। মারতে মারতে সে লোকটিকে বের করে দেয় বাড়ি থেকে।
লোকটি আর কি করে। পেটে একটা দানাও পড়েনি।
মাথার ওপরে আগুনের গোলা। ক্লান্ত পায়ে সে আবার হাঁটতে থাকে তার নিজের বাড়ির দিকে। চলতে চলতে আবার সে পৌঁছোয় সেই বনে।
আবার দেখতে পায় বনের সেই মরণআরক লতাকে। এবার সে আর ভুল করে না। সটান মাটিতে শুয়ে পড়ে প্রণাম করে সে লতাকে, বলে, মরণআরক লতাগো, তখন যদি তোমাকে অবজ্ঞা না করতাম, যদি তোমার পাতা চিবুতে চিবুতে শ্বশুরবাড়ি যেতাম তাহলে আজ হয়তো আমার এই দুর্দশা হত না।
জানো তো মরণআরক লতা, ঠেকে মানুষ শেখে। আর আমি তোমাকে কোনোদিন অবজ্ঞা করব না। বলেই সে চিবুতে থাকে সেই লতার পাতা।
ঠিক এরই জন্য লোকে বলে, পথে চলতে চলতে যদি মরণআরক লতা দেখ—তার পাতা ছিড়ে দিও মুখে। তা যদি না কর তাহলে রেগে যাবেন চান্দো দেবতা। বলবেন, ভারি বড় মানুষ হয়েছে দেখছি ?
মরণআরকের পাতা খায় না—দেখাচ্ছি মজা! সেদিনের সেই ঘটনার পর থেকেই মানুষ মরণআরকের পাতা দেখলেই খায়। আর খেলে না—কোনো ঝামেলাতেই পড়তে হয় না তাকে।
লেখকঃ নন্দলাল শর্মা
তথ্যসূত্রঃ সাওতাল লোককথা
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।