ঊনিশ শতকে বাংলার গ্রামীণ সমাজঃ প্রেক্ষিত পার্বত্য চট্টগ্রাম
3226
Abstract: Most of the people of Bengal in the nineteenth century lived in rural areas. They mainly consist of peasants and lower income-earning people. The dominant characteristics of rural Bengal were the rule of Zamindars and their associates, pre-eminence of subsistent economy, the prevalence of customary and ascribed social leadership and the simple daily life of village dwellers. The Chittagong Hill Tracts became one of the direct administrative parts of Bengal in 1860. The indigenous people therein were also mainly jumia peasants and lived in hilly rural areas. This paper makes an attempt to investigate the similarities between the social-economic condition of plain-Bengal and that of ‘Hill-Bengal’ in the second half of the nineteenth century. It is found that except physical and basic ethnic differences there were many more similarities between these two parts of Bengal.
ভূমিকা
ঊনিশ শতকে বাংলার গ্রামীণ ইতিহাস নিয়ে গবেষণা খুবই অপ্রতুল। বাংলার রেনেসাঁস যা ছিল শহর কেন্দ্রিক এলিট শ্রেণীর বিষয়-আশয় তা নিয়ে গবেষণা হয়েছে বিস্তর।
কিন্তু গ্রামীণ জনপদসমূহে বসবাস করে মূলত সাধারণ কৃষক এবং নিম্ন আয়ের কর্মজীবীরা। তারা লেখক গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষন করতে পারে নি।
বিশ শতকের আশির দশকে সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ নামে নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চার যে ধারা শুরু হয় তাতেও গ্রামবাংলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস উপেক্ষিতই থেকে যায়।
গ্রামবাংলা সম্পর্কে তথ্যের সমাগম খুবই স্বল্প এবং গবেষণাও হাতে গোনা কয়েকটি। এর কারণ সম্ভবত, এখলাসুল কবির যেমন বলেছেন, ‘As they had never been the direct object of the State policy, neither colonial administrator nor their successors ever felt the need of bringing them to lime light.’
ঊনিশ শতকে বাংলায় জনমত হিসেবে যা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতো তা ছিল প্রকৃতপক্ষে সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণিরই মতামত ও জিজ্ঞাসা। আর ইতিহাস হিসেবে যা পাঠ্য ছিল তাও ঐ বিভিন্ন রাজবংশের উত্থান পতন এবং শাসকগোষ্ঠীর বাছাইকৃত কিছু ব্যক্তির কার্যকলাপ।
এজন্য ঊনিশ শতকের একজন বাঙালি চিন্তাবিদ আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘উদয়াস্ত খেটে খাওয়া মানুষ, যারা গ্রামে-গঞ্জে ও নগরে বসবাস করে বছরের পর বছর ধান ও গম উৎপাদন করে, যার উপর ভিত্তি করে বিশাল সাম্রাজ্যের বুনিয়াদ তৈরি হয়, যারা বছরের পর বছর প্রয়োজনীয় সামগ্রী বা বিলাস দ্রব্য তৈরি করে, যার ওপর দেশের সমগ্র বাণিজ্য ও খ্যাতি নির্ভর করে যাকে আমরা আখ্যা দিই ইতিহাস……সেই রঙিন কাহিনীর ধারে কাছেও নেই…….সেই মেহনতি মানুষের কোন স্থান।
সেই কারণে কোন কোন পন্ডিত তাদেরকে ‘ইতিহাস বিহীন লোক’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন এবং বলেছেন- ‘Wretched victims of circumstances than active participants in the history of Bengal’.
ইতিহাসের মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন বাংলার গ্রামীণ জীবনের ইতিহাস নির্মাণ দুরূহ কাজ। আর সেটা যদি হয় দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের গ্রামীণ ইতিহাস তাহলে তো কথাই নেই।
এসব সীমাবদ্ধতাকে সামনে রেখেই আলোচ্য প্রবন্ধে বিক্ষিপ্তভাবে প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে ঊনিশ শতকের দ্বিতীয় পদে আবহমান গ্রামবাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার সাথে পার্বত্য অঞ্চলের গ্রামীণ সমাজের বৈশিষ্ট্যগুলোর সাদৃশ্যসমূহ অন্বেষণ করা হবে। আমাদের জিজ্ঞাস্য হিসেবে থাকছে:
ক) পার্বত্য চট্টগ্রামের গ্রামীণ সমাজ ও অর্থনীতি কি সত্যিই সমতল-বাংলা থেকে স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত?
খ) নাকি তা আবহমান বাংলার গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক অবস্থারই প্রতিচ্ছবি?
ঊনিশ শতকে গ্রামবাংলার বৈশিষ্ট্য
ক) সামাজিক বৈশিষ্ট্য: বাংলার গ্রামীণ জীবনের বৈশিষ্ট্য অনেক। ঔপনিবেশিক দলিলপত্রে সন্নিবেশিত ঊনিশ শতকের বাংলার গ্রামীণ জীবন সম্পর্কে একটি মন্তব্য দিয়েই শুরু করা যাক। ‘এদেশের গ্রামের লোকেরা পরিবর্তন বিমুখ। কী কৃষিক্ষেত্রে, কি শিল্প ক্ষেত্রে তাদের মন প্রাচীন কলা কৌশল ও প্রথাকে চ্যালেঞ্জ করতে নারাজ।
যে কোন প্রথার পরিবর্তনের ব্যাপারে তারা ভীতি-বিহবল। আশ্চর্য, আজ পর্যন্ত এরা গরু দিয়েই ধান মাড়ায়। তাদের বোঝানো কঠিন যে উৎপাদনোপায়ে ঘন ঘন পরিবর্তন সাধনই হচ্ছে উন্নতির সোপান।
বাংলার গ্রামীণ জীবন সম্পর্কে ‘পরিবর্তন বিমুখীতার’ ঔপনিবেশিক ডিসকোর্সকে তখনকার প্রেক্ষাপটে খন্ডন করা সহজ নয়। কিন্তু মৌলিক প্রশ্ন হল গ্রামের লোকেরা পরিবর্তন চায়নি নাকি তাদের পরিবর্তন হতে দেয়া হয়নি? উত্তর হল তাদেরকে পরিবর্তন হতে দেয়া হয়নি।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে প্রজম্ম পরম্পরায় গড়ে ওঠা সামাজিক মূল্যবোধ, লোকাচার ছিল তাদের গ্রামীণ জীবনে ঘেরা বেড়ার মত যা ছিন্ন করে নতুন কিছু চিন্তা করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় নি।
এছাড়া ঔপনিবেশিক সরকার, জমিদার ও মহাজন এ ত্রি-শক্তি গ্রামের মানুষদের পরিবর্তনের বিপক্ষে ছিল এবং অবশ্যই তাদের স্ব-স্ব কায়েমী স্বার্থেই তারা তা করছে। এগুলোর সহায়ক অবলম্বন ছিল সমাজে বিদ্যমান অশিক্ষা, কুসংস্কার ও রক্ষনশীলতা।
কিন্তু এতদ্বসত্ত্বেও গ্রামের মানুষের সামনে যখনই পরিবর্তনের দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে গ্রামের লোক তা ধীরে ধীরে গ্রহণ করেছে। যেমন, পরিবর্তনের বাহন (চেঞ্জ এজেণ্ট) তথা আধুনিকতার বাহন-শিক্ষা, বাজার অর্থনীতি, যোগাযোগ প্রযুক্তি, আধুনিক উৎপাদনে কৌশল কোনটা পরিলক্ষিত হয় না বর্তমান গ্রামগুলোতে?
মানুষ মাত্রেই পরিবর্তনশীল সেটা গ্রামীণ হোক বা শহুরে হোক। পরিবেশ পারিপার্শ্বিকতা ও যুগভেদে মানুষের মানস প্রকৃতি পরিবর্তন হবেই। একথা সত্যি ঊনিশ শতকের প্রেক্ষাপটে গ্রামীণ মানুষের পক্ষে খোলা নলচে পাল্টানো সম্ভবপর ছিল না।
কারণ, তখন অপরিবর্তনের সব বাধা সমাজে ক্রিয়াশীল ছিল। যেমন- প্রগতিবিমুখ জমিদারি শাসন-শোষণ, বাজার অর্থনীতির অনুপস্থিতি, প্রথা-প্রতিষ্ঠান নেতৃত্ব ও অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রের অবহেলা বা উদাসীনতা।
ঊনিশ শতকের গ্রাম বাংলার সমাজ কাঠামো ছিল সামন্ততান্ত্রিকতার বেড়াজালে আচ্ছন্ন সমাজ। সামন্তন্ত্রে সমাজের স্তরভেদ নির্ধারিত হয় ভূমির নিয়ন্ত্রণকে ভিত্তি করে।
ভূমি নিয়েই আবর্তিত হয়েছে সমাজের বিন্যাস, জীবনবোধ ও অর্থনীতি। ভূমির নিয়ন্ত্রণ যার হাতে সেই সমাজের মোড়ল। এর পাশাপাশি চিরাচরিত সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধে যারা অভিজ্ঞ, উদ্দীপ্ত ও উৎসাহী তারাই নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হয়।
প্রাচীনকাল থেকে গ্রামের ভূমি নিয়ন্ত্রণের ভার যাদের হাতে থাকতো যুগভেদে সেই রাজা-জমিদারদেরই হাতেই শাসিত হতো গ্রামীণ জনপদ। গ্রামের ছিল নিজস্ব অর্থনীতি, সমাজনীতি ও রাজনীতি। এর সঙ্গে কেন্দ্রের কোন যোগাযোগ ছিল না।
স্থানীয় চাহিদা স্থানীয় উৎপাদন দিয়েই মেটানো হতো, স্থানীয় সমস্যা, স্থানীয় প্রথা দিয়েই সমাধা করা হতো। এতে কেন্দ্রীয় সরকারের কোন হাত ছিল না বললেই চলে। এক কথায় গ্রামবাংলার জীবন ছিল কেন্দ্রিয় প্রভাবমুক্ত। ঊনিশ শতকেও তার হেরফের হয় নি। গ্রামে জমিদারদের শাসনই ছিল সরকারী শাসনের সমতুল্য।
জমিদারেরা ছিলেন গ্রাম শাসনের সর্বোচ্চ হর্তাকর্তা। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তারা রায়তদের সব ধরনের বিরোধ নিষ্পত্তি করতেন এবং ফৌজদারি অপরাধিদের প্রাণদন্ড পর্যন্ত দিতেন।
প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করাই তাদের একমাত্র কাজ ছিল না, দেশের শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখা, চোর ডাকাত দমন করা এবং বিদ্রোহী ও বিশ্বাসঘাতকদের নির্মূল করাও ছিল তাদের কাজ।
এছাড়া সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে জমিদাররা কিছু কিছু জনহিতৈষী কাজও করতেন। বলা বাহুল্য, ঊনিশ শতকের আগে জমিদারি একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠানের চরিত্র ধারণ করতো।
কিন্তু ১৯৭৩ এরপর কোম্পানী শাসকরা জমিদারকে প্রজারঞ্জক সামাজিক নেতা হিসেবে সরকারের আজ্ঞাবাহী অর্থনৈতিক এজেণ্ট ও অসীম ক্ষমতাধর স্থানীয় শাসক বানিয়ে ছেড়েছিল। পরিণামে জমিদার রুপান্তরিত হন গ্রামে ক্ষমতা চর্চা ও শক্তির অবতাররুপে।
রেভারেন্ড লাল বিহারী দে’র মতে ঊনিশ শতকের জমিদাররা ছিলেন ‘অত্যাচার ও অনাচারের মূর্তিমান বিগ্রহ’।
জবরদস্তিমূলক খাজনা আদায়, বিভিন্ন প্রকার আবওয়াব আদায়, অবাধ্য চাষিকে মারধর, কাছারি ধরে এনে বেঁধে রাখা, হত্যা, গুম, বাড়িতে আগুন দেওয়া হেন অত্যাচার ছিল না যা জমিদার প্রজাদের উপর করতো না।
পার্বত্য চট্টগ্রামের গ্রামীণ সমাজ; ছবিঃ ইন্টারনেটগাঁয়ের মধ্যে জমিদার বাড়ি সবচেয়ে ভালো ও সবচেয়ে বড়। কিন্তু রায়ত জমিদারের বিনা অনুমতিতে পাকা ঘরবাড়ি তৈরি করতে, পুকুর খনন করতে এমনকি গাছ কাটতে পর্যন্ত পারতো না এবং সে অনুমতি পেতে হলে প্রচুর নজরানা দিতে হতো। জমিদারের আয় বৃদ্ধির জন্য যে ব্যবস্থা তা নয়।
জমিদারের বিবেচনায় প্রজার পক্ষে পাকা ঘরবাড়ি তৈরি করা, পুকুর খনন করা তার আঞ্চলিক সার্বভৌমত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ স্বরূপ। পাকা ঘরবাড়ি শুধু জমিদারেরই থাকবে, প্রজাও যদি পাকা বাড়ির অধিকারী হয় তবে জমিদার প্রজাতে তফাৎ রইল কোথায়?
এই ‘তফাৎটা’ শুধু বাড়িঘর বেশভূষার বেলায় নয়, শিক্ষা-দীক্ষা, চাকরি-বাকরীর বেলায়ও যেন থাকে, সে ব্যবস্থা শাসক শ্রেণী করেছে। স্কুল কলেজে ভর্তি হতে হলে বা চাকরি পেতে হলে একজনকে শরাফত নামা বা ভদ্রলোকের সন্তান…..এই মর্মে ঘোষনা পত্র দিতে হতো।
জমিদারের একছত্র শাসনে গ্রামীণ জীবন ছিল নিশ্চল। তাদের হাসি কান্না সবই জমিদারের মর্জির উপর নির্ভর ছিল। ঊনিশ শতকের বাংলার সেটাই ছিল সামাজিক বাস্তবতা বা স্বাভাবিক অবস্থা। এটার বিরুদ্ধে যে কোনো পদক্ষেপকেই প্রভুরা নৈরাজ্যের প্রয়াস বিবেচনা করতো।
ফলে গ্রামের মানুষদের পক্ষে পরিবর্তনের চিন্তা করা ছিল অসাধ্য ও কল্পনাতীত বিষয়। দাসত্ব ও মুখবুজে সহ্য করা হয়ে ওঠে সে যুগের ধর্ম এবং আশ্চর্যজনকভাবে সে যুগ ধর্ম সবাই মেনেও চলতো বা মানতে বাধ্য হতো।
কিন্তু জমিদার একা রাজত্ব করে এমন নয়। গ্রামের ফাঁরিদার, সালিশ, পঞ্চায়েত, ধর্মানুষ্ঠান সবকিছুর নিয়ন্ত্রক ছিলেন এই জমিদার ও তার সহযোগী দেওয়ান, গোমস্তা, পাইক পেয়াদা, মাতবর, মোড়ল প্রভৃতি উপাধিধারী সমাজনেতাগণ যারা দোর্দন্ড প্রতাপে অনিয়মকে নিয়ম, নিয়মকে অনিয়ম করতে পারতো। ক্ষমতা, মর্যাদা ও গুরুত্বে এরাও গ্রাম্য রীতিনীতির নিয়ন্ত্রক শক্তি।
খ) গ্রামীণ অর্থনীতি: বাজার অর্থনীতির অনুপস্থিতি ছিল গ্রামীণ জীবনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য। প্রাচীনকাল থেকে ঊনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে চালু ছিল বেঁচে থাকার অর্থনীতি। ১৮০২ সালে এক জেলা কালেক্টর রির্পোট থেকে জানা যায় ‘এদেশের লোকেরা নিজ প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু উৎপন্ন করে না।
তারা মাঠে কাজ করে তাদের ভাগ্যোন্নয়ের জন্য নয়, শুধু কোনমতে বেঁচে থাকার জন্য। বেঁচে থাকার অর্থনীতিতে পুঁজি বিকশিত হয় না। পুঁজি ছাড়া উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিরর্তন বা আধুনিকতার ছোঁয়া লাগা অসম্ভব। উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিবর্তন না ঘটলে বিদ্যমান সমাজের পরিবর্তন ঘটে না।
তাছাড়া ঊনিশ শতকে যে বাজারের যে চিত্র পাওয়া যায় তা পুঁজি বিকাশের পক্ষে মোটেই সহায়ক ছিল না। বৃটিশ রাজস্ব নথিতে চট্টগ্রাম অঞ্চলের একটি বাজারের চিত্র এক নজর দেখলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়। এখানকার বাজারসমূহে শুধু খন্ড কাপড় আর চাল পাওয়া যায়।
বাকী জিনিস পেতে হলে হয় নিজেরা উৎপন্ন করতে হবে, নয় চাকর বাকর নিয়োগ করে গ্রাম থেকে সংগ্রহ করার ব্যবস্থা করতে হবে।
জ্বালানী তেল, শাকসবজি, চাটাই, দুধ ইত্যাদি লোকেরা নিজেরা উৎপন্ন করে শুধু নিজেদের জন্য, এগুলো বাজারে বিক্রি করে না, কেননা এগুলো বাজারে চাহিদা নেই। তাছাড়া এসব জিনিস কেনা ও বিক্রি করা দুটোই সামাজিকভাবে নিন্দনীয়।
অথচ উৎপাদিত দ্রব্যের বাজার মূল্য সমাজ পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। বাজার মূল্যের উঠা নামার সঙ্গে অর্থনৈতিক ক্রিয়াকান্ড ওতপ্রোতভাবে জড়িত, যা পরিণামে প্রভাবিত করে সমাজ বিন্যাসকে, বস্তুগত সংস্কৃতিকে। আবার দ্রব্য বাজারজাতকরনের জন্য দরকার উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। ঊনিশ শতকের গ্রাম বাংলায় ছিল নদী কেন্দ্রিক যাতায়াত ব্যবস্থা যা ঝুঁকিপূর্ণ, সময় স্বাপেক্ষ।
গ) গ্রামীণ সমাজে দৈনন্দিন ব্যবহৃত বস্তুগত সম্পত্তি: এক খন্ড জমিই কৃষকের সারা জীবনের ধ্যান জ্ঞান। অতি সামান্য তাদের সহায় সম্পত্তি যেখানে বিলাশের লেশ মাত্র নেই, শিক্ষার কোন ছাঁয়া নেই। পুঁজিহীন, সঞ্চয়বিহীন অনিরাপদ পারিপার্শ্বিকতায় গ্রামের মানুষের চিন্তা ছিল ক্ষণিক ও স্থানিক।
ফলে জীবন-জীবিকাও ছিল সাদামাটা। বাংলার গ্রামীণ জনপদের প্রধান বাসিন্দা সেই কৃষকের বস্তুগত সম্পদ-সম্পত্তিও ছিল নিতান্ত অল্প। রমেশচন্দ্র দত্তের ভাষায় (১৮৭৪), ‘শত বছরের কোন আদিম প্রাণী যেন আজও কৃষকরা।
যে কোন ধরনের একটা লম্বা শাড়ি দিয়ে শরীর ঢাকা এই হল কৃষকের বউয়ের বস্ত্র। আর একটা খাটো ধুতিতে কোমড় থেকে হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা এবং প্রায়শ দ্বিতীয় একখন্ড কাপড় কাঁধে ঝুলে থাকে এই হল কৃষকের বস্ত্র।
কৃষকের বাড়ির সাধারন চিত্র হল: এক বা দুটো কুঁড়েঘর উঁচু মাটির ভিটেই নির্মিত এবং মেয়েরা সর্বদা এইসব ঘর ঝকঝকে করে পরিস্কার রাখে। একটু অবস্থাপন্ন কৃষকের বাড়তি এক বা দুটো ঘর থাকে।
ক্ষুদ্র গোয়াল ঘরে গরু থাকে আর ঘরের পাশে থাকে ধান ভানার কোন কল ঘর। …….সাধারনত কৃষকের বাড়ির বিছানা হল মাদুর। …….কাঁসার কিছু বাসনপত্র, ধান রাখার কিছু মৃৎপাত্র, একটি লাঙ্গল, মেয়েদের পিতল বা রূপার গহনা, মাঝে মধ্যে সূতা কাটার চরখা।
১৮৭৮ সালে লাল বিহারী দে মহাশয়ও বাংলার চাষির ঘরে কোন খাট নেই, ঘরে আলোকের নিতান্ত অভাব, ছোট্ট একটি জানালা।…..ঘরে কোন আসবাবপত্র নেই, ঘরের একদিকে দুটো আস্ত বাঁশ দেয়ালে লাগানো রয়েছে যার উপর কাপড় চোপড় ঝুলানো থাকে।
এ চিত্রটি পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘরে ঘরে দেখা যায়। কারণ সেখানে ছিল নানা প্রকারের বিশাল বিশাল বাঁশবন। ১৮৮৮ সালের একটি সরকারি প্রতিবেদনে বাংলার গ্রামীণ জনপদের বস্তুগত সংস্কৃতির কিছু নিদর্শন পাওয়া যায় যা নিন্মরূপঃ
“Apart from food which is the basic requirement of life, furniture, utensils, dress and ornaments also play very important roles in the life of human beings. From an English point of view, furniture was very meager in a Bengali house. In most houses there were neither chairs nor tables. A Bengali always ate off the ground from a mat or sheet and always squatted on his haunches. Generally the following furniture and utensils were used by the working people: brass or earthen vessels, earthen cups, mats, kantha or rag, Jharu or brush, hukkah or hubble-bubble, dao or bill-hook, bati or knife, piri or wooden stool, kalsi or earthen pitcher, pankka or hand fan, rekabi or dish, sorahi or earthen glass, sika or hanging rope shelf, kula or winnowing fan and denki or mortar. They also used jhajair or earthen vessel for straining water, hata or spoon, malai or cup of coconut shell, khuti or small earthen pots, sil and pata or flat stone and muller, sarta or nut cracker, kural or axe, chimta or pair of tongs, dula or small basket, lota or earthen water-pot, pillows of sack cloth staffed with grass.”
গোবর দিয়ে ঘরের মেঝে নিকানো, সমতলের বাংলার চাষীর চিরন্তনী ধুতি, হুক্কা, কলকে, ঢেঁকি, দা, পিঁড়ি, কুলা, কাস্তে, নারকেলের খোল বা মালা, ঝাড়ু, সিকা প্রভৃতি জিনিস পার্বত্য-বাংলায় ঘরে ঘরে দেখা যায়।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাধারণ জিনিস হল হুক্কা যা পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘দাবা’ নামে পরিচিত। অতিথির প্রাথমিক আপ্যায়নের অবলম্বন এ দাবা বা হুক্কা যা পাহাড়ের সামাজিক আচরণের একটা অংশ।
উপরের আলোচনায় ঊনিশ শতকের গ্রাম বাংলায় একটি স্থবির সমাজের চিত্র প্রতিভাত হয় যে সমাজকে জমিদারতন্ত্র, সেকেলে অর্থনীতি, যুগধর্ম এক জায়গায় নির্জীব করে রেখেছে।
যেখানে অপরিবর্তনের সকল নিয়ামকগুলো তাদেরকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে। জমিদারি শাসন শোষণে বাংলার জনগণ হয়েছে ভীষণভাবে রক্ষনশীল এবং প্রচলিত মতবাদ ও প্রথার অন্ধ অনুসারী সে মতবাদ ভুল হোক আর শুদ্ধ হোক।
আমরা এখন এ আলোকে ঊনিশ শতকে পার্বত্য চট্টগ্রামের গ্রামীণ জীবনকে মিলিয়ে দেখাবো যা এ প্রবন্ধের মূল উপজীব্য।
ঊনিশ শতকে পার্বত্য চট্টগ্রামের গ্রামীণ জীবন:
পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি গহীন অরন্য আচ্ছাদিত পার্বত্য জনপদ। বাংলার ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য হল এর ৯৫ ভাগ ভূ-ভাগই সমতল। আর যে দক্ষিন-পূর্বের সীমান্ত জেলা পার্বত্য চট্টগ্রামই কেবল পার্বত্য এলাকা। তাই আলোচ্য প্রবন্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘হিল-বেঙ্গল’ বা ‘পার্বত্য-বাংলা’ অভিধায় আখ্যায়িত করা হল। এ অভিধার যৌক্তিকতা ভৌগোলিক প্রেক্ষাপটে যেমন লাগসই তেমনি সামাজিক-সাংস্কৃতিক অর্থেও যথাযথ বলে প্রতীয়মান হবে এ আলোচনার শেষে।
ক) সমাজ কাঠামো: ১৮৬০ সালে এটি বৃটিশ-ভারতীয় প্রশাসনের বৃহত্তম প্রদেশ বাংলার একটি সীমান্ত জেলা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। জেলাটি আদিবাসী অধ্যুষিত জনপদ। ১৮৭২ সালের আদম শুমারি রর্পোট অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট গ্রামের সংখ্যা ২৯৬টি যেখানে বাস করতো ৬৩,০৫৪ জন আদিবাসী।
গ্রামের বাসিন্দারা তিনটি (চাকমা রাজা ও মং রাজা ও বোমাং রাজা) সামন্ততান্ত্রিক জমিদার-রাজা এর প্রজা। ঐ রাজাদের প্রতি প্রজাদের জাতিগত আনুগত্য অপরিসীম।
পেশায় পাহাড়িরা সকলে ছিল জুমচাষী। এই জুম নামে বিশেষ কৃষি পদ্ধতিতে চাষাবাদ করেই তারা জীবন ধারণ করতো। লোকজন জুমচাষ ছাড়া অন্য কোন পেশায় জীবিকা নির্বাহ করে এমন নজির ঊনিশ শতকের ষাটের দশক পর্যন্ত ছিল না।
জুম চাষের জন্য রাজাকে ট্যাক্স দিতে হতো যা জুম ট্যাক্স নামে পরিচিত। মূলত এ জুম ট্যাক্সকে কেন্দ্র করেই তাদের সামন্ততান্ত্রিক সোপানগুলো গড়ে ওঠে।
বলা নিষ্প্রয়োজন, এ ট্যাক্স ছিল রাজাদের কর্তৃত্বের বাহ্যিক চিহ্ন এবং অভ্যন্তরীণ প্রভাবের ভিত্তি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সমাজ ব্যবস্থায় ‘জমিদার-রাজারাই হচ্ছেন শীর্ষব্যক্তি। এরা বৃটিশদের পক্ষে স্ব-স্ব সার্কেল থেকে জুম খাজনা আদায় করেন। ক্যাপ্টেন লুইনের মতে, পার্বত্য জমিদার-রাজারা খাজনা আদায়ের কাজটা ইজারা দেন।
তাঁরা প্রত্যেকে সরকারের খাজনার একটা অংশ এককালীন দেন। তাঁরা খাজনা আদায়ের কাজটা ইজারা দিয়ে সাব-এজেণ্টের মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রাম থেকে খাজনা আদায় করে থাকেন।
চাকমা রাজার উপ-ইজারাদার হিসেবে গ্রাম শাসনে নিযুক্ত হতেন দেওয়ানরা। গ্রামের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে তারা তাদের অধস্তন হিসেবে পাড়া প্রধান নিয়োগ দিতেন যাদের পদবী হয় খীসা।
তাই সমাজে রাজা দেওয়ানদের অপরিসীম ক্ষমতা। কোনো সাধারণ লোক সে যেখানেই বসতি স্থাপন করুক না কেন তাকে তার গোত্রপতি বা দেওয়ানের প্রভাবাধীন প্রজা হিসেবে থাকতে হবে এবং খাজনা দিতে হবে।
এভাবে রাজা-দেওয়ান-খীসা-সাধারণ চাকমা এ চারিস্তরে বিভক্ত সমাজ কাঠামোর ভিত্তি স্থাপতি হয়। অনুরূপভাবে গঠিত হয় মারমা সমাজের গড়ন। তাদের সমাজে প্রধানের উপাধি ‘মাং’ (শাসক, গভর্নর-বর্মি ভাষায় অনুরুপ অর্থদ্যোতক) অথবা পোমাং (মহান নেতা; বমং)।
তিনি গ্রামের শাসন, খাজনা আদায় ও শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য নিয়োগ দেন রুয়াসা বা রোয়াজাদের। রোয়াজা অধস্তন হিসেবে থাকেন পাইংসি উপাধিধারীরা, আর সবার নিচে সাধারণ মার্মা।
রাজা, দেওয়ান, খীসা, পোমাং, রুয়াসা. পাইংসি, ধাবেং উপাধিধারী গ্রামপ্রভুরা কর অব্যাহতি, ভূ-সম্পত্তি মালিকানা, বিচারিক ক্ষমতা, আটক রাখার ক্ষমতা, জুমপ্লট বিতরণ ক্ষমতাসহ বিবিধ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার সুবাধে সমাজে নিজেদের স্থান দৃঢ়ভাবে পোক্ত করতে সক্ষম হয়।
কিন্তু সাধারণ পাহাড়ি জুমচাষীরা থেকে যায় এদের কাছে দায়বদ্ধ। ‘পার্বত্য-বাংলা’র জমিদার-রাজারা গ্রামের জুমচাষীদের নিকট থেকে পরিবার প্রতি ৪ টাকা যা তৎকালীন সময়ে ১৬ আড়ি ধানের সমমূল্যের।
সমতল বাংলার জমিদারদের মত তারা জুম খাজনা ব্যতীত আরও পাঁচ প্রকারের আবওয়াব আদায় করতো। তাদেরকে কর দিতে হয়, বেগার শ্রম দিতে হয়। কঠোর পরিশ্রমে উৎপাদিত ফসলের একাংশ দিতে হয়। শিকারলব্ধ মাংসের রান (উরু) টা দিতে হয় দেওয়ান/রোয়াজাকে।
রাজা/দেওয়ানদের অনুমতি ব্যতীত সাধারণ জুমিয়ারা স্বর্নাভরণ পরতে পারত না। ক্ষেত্র বিশেষে জুতা, মোজা খরম ব্যবহার করতে পারত না। রাজা/দেওয়ানের সন্তানের বিয়েতে দিতে হতো চাঁদা। পশ্চিম বঙ্গে কোন কোন জমিদারি এলাকায় যা মাথট নামে আদায় করা হয়।
১৮৬২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথম স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। সাধারণ পাহাড়িদেরকে স্কুলে পড়ার জন্য অনুমতি নিতে হতো। এভাবে এক প্রকার দাসত্বের বেড়াজালে আবদ্ধ ছিল জুমিয়া-জীবন। শিক্ষা ও আধুনিক সভ্যতার আলো থেকে তারা থাকে দূরে বহু দূরে।
কিন্তু তারা বিদ্রোহ করে নি। কারণ ঐ সময়ে সেটাই ছিল যুগের ধর্ম, সমাজের আচার-প্রথা: সতীশ ঘোষের মতে, ‘জাতীয় বিধান’। সমাজও মেনে নিয়েছে নীরবে।
পাহাড়ের ঐতিহ্যবাহী নেতৃত্ব যেন বাংলার চিরচেনা জমিদারের প্রতিভু। এজন্য যে পূর্ববর্তী আলোচনায় দেখা গেছে ‘সমতল-বাংলায়’ জমিদার শ্রেণী নানারুপ বিধিনিষেধ আরোপ করত।
সরকারি গেজেটিয়ারে উল্লেখ আছে রাংগামাটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে ছাত্র ভর্তি ও হোস্টেলে আবাসন সুবিধার জন্য ডিসির পাশাপাশি অধীনস্তদের উপর বিচারিক ক্ষমতার অপব্যবহার করতেন বা জুমকর থেকে অব্যাহতির সনদ প্রদান নিয়ে প্রতারণা আশ্রয় নিতেন বলে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশেষজ্ঞ ওল্ফগাং মে ফিরিস্তি দিয়েছেন।
চীফদের এহেন কার্যকলাপ সম্পর্কে তার মূল্যায়ন হল ‘বলাই বাহুল্য সনাতনী কৌম সমাজে চীফের প্রথম এবং প্রধান উদ্দেশ্য ছিল নিজের অর্থনৈতিক-সামরিক-রাজনৈতিক ক্ষমতাকে শক্ত রাখা।
জুম ঘর; ছবিঃ ফেসবুক থেকে সংগৃহীতখ) জীবন ধারণ উপযোগী অর্থনীতির প্রাধান্য: পার্বত্য বাংলায় প্রাক-পুঁজিবাদী সাম্যবাদী সমাজের চিত্র প্রতিভাত হয়। সেখানে ভুমিতে কোন ব্যক্তি মালিকানা নেই, বা ভুমির বাণিজ্যিক ব্যবহার তাদের কল্পনাতীত, শ্রমের বিনিময়ে মজুরী গ্রহণের চল নেই। লুইন ১৮৬৫ সালে লিখে গেছেন, ‘পাহাড়িরা শ্রম বিক্রি করে না, তারা শুধু নিজেদের জন্য পরিশ্রম করে। সমাজের মধ্যে দ্রব্য বিনিময় প্রথাই চালু ছিল।
উদ্বৃত্তের বাজার মূল্য তাদের কাছে অজানা বিধায় উৎপাদিত দ্রব্য ভাগাভাগি করে ভোগ করতো। ঊনিশ শতকের ষাটের দশকে লুইন স্পষ্ট করে বলেছেন, পাহাড়ি এলাকায় চারটি বাজার বা হাট আছে যেখানে পাহাড়ি লোকজন তাদের উৎপন্ন দ্রব্যাদিকে লবন, মসলা, শুটকি ইত্যাদি প্রাত্যহিক প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সাথে বিনিময়ের জন্য আসে (বিক্রির জন্য নয়)।
এইসব দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো সমতল থেকেই সংগ্রহ করতে হয়। এসব বাজার হচ্ছে কর্ণফুলির তীরে কাচালং, রাংগামাটি এবং চন্দ্রঘোনা ও সাঙগু নদীর তীরে বান্দরবান।
এই অর্থনীতিই বেঁচে থাকার অর্থনীতি যা পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান ছিল ঊনিশ শতক জুড়ে। তাদের প্রয়োজনীয় প্রায় সবকিছু অনায়াসে এবং বিপুলভাবে পেয়ে থাকে প্রকৃতি থেকেই। জনসংখ্যা কম ভূমি ছিল প্রচুর এবং নোয়াবাদ হওয়াতে জমির উৎপাদিকা শক্তি ছিল অভাবনীয়।
ফলে অল্প পরিশ্রমে অধিক উৎপাদন তাদেরকে করেছে ভবিষৎ সম্পর্কে উদাসীন। ফলে পার্বত্য সমাজে মানুষ পুঁজি বা অর্থের সঞ্চয় ও গ্রহণে নিরুৎসাহী। দুনিয়ার পরিবর্তনশীল জগৎ সম্পর্কে জানার নিস্পৃহা।
জুম ও হালকৃষি ব্যতীত চাকুরি, ব্যবসা বাণিজ্য ও কামার, কুমার সহ অন্য শিল্পবিদ্যার মাধ্যমে জীবনধারণের চিন্তা তারা দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি। সঞ্চয়ের মানসিকতা তাদের অন্তরে জন্মায় নি।
জনৈক পাহাড়িকে তার বিপদ-আপদ মোকাবেলার জন্য অর্থ সঞ্চয় প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে সে নিন্মরূপ ভায়ায় ও সুরে উত্তর দিত: ‘But here’s my bank all around me. And he indicated the hills.’ There are enough hills for my jum, bamboo enough for all my needs. There are plenty of herbs for the village doctor to fix me up if he can, when I’m ill. There are wild roots and bamboo shoots, and wild arum if there’s a famine. And there’s no death of wild boar and deer either.’
একদিকে প্রকৃতি নির্ভরতা আর আদিবাসীদের অপরিণামদর্শিতা অন্যদিকে যোগাযোগ দুর্গমতার কারণে পার্বত্য-বাংলায় বাজার অর্থনীতি বিকশিত হতে পারেনি যা ঊনিশ শতকের সমতল-বাংলার গ্রামীণ জীবনে দেখা গেছে।
গ) দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা: বাজার অর্থনীতি বিকাশের প্রধান বাহন হল উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। ঊনিশ শতকে পার্বত্য চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়া দূরে থাক যানবাহন চলাচল উপযোগী রাস্তাই ছিল না।
১৮৬৯ সালে ক্যাপ্টেন টমাস হার্বাট লুইন প্রথম ডেপুটি কমিশনার হিসেবে চাকুরীকালীন লিখেছেন ‘এখন এই জেলায় কোনো রাস্তা নেই’।…… তবে পায়ে চলার সবদিকেই আছে, লোকজন এই পায়ে চলার পথই ব্যবহার করে। শুধু দুর্গমতা নয় পার্বত্য-বাংলার আবহাওয়া ছিল বহিরাগতদের জন্য অস্বাস্থ্যকর। ফলে সমতলের লোকজন সেখানে বসতি স্থাপনে অনীহা প্রকাশ করতো।
ঘ) দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত বস্তুগত সম্পত্তি: আমরা এ নিবন্ধের প্রথম অংশে গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে ব্যবহৃত সামগ্রীর একটি তালিকা দিয়েছি। বন ও প্রকৃতি পাহাড়িদের দৈনন্দিন জীবনের সবকিছু যোগান দেয়। লবণ, গুড়, শুটকি, এলুমিনিয়াম, কেরোসিন, মাটির পাত্র, কালো কাপড় ব্যতীত বনই পাহাড়িদের বেঁচে থাকার প্রায় সমস্ত উপাদান যোগান দেয়।
বিশেষ করে বাঁশ দিয়েই পাহাড়িদের মাচাং (মাটি থেকে উপরে) বাসগৃহ তৈরি হয়। তাদের গৃহ নির্মাণের কৌশলও বনজ সামগ্রী নির্ভর। গৃহের দেয়াল ও মেঝেগুলো বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি। ছাদ এবং কাঠামো বাঁশের দন্ড দিয়ে তৈরি। ছাউনিতে প্রায় সময় বাঁশের পাতা এবং শন ব্যবহার করা হয়।
মজার ব্যপার হল কোন পেড়েক বা ধাতুর টুকরো ব্যবহার না করে পুরো গৃহ-কাঠামোটা ফালি করা বাঁশের বেতের দড়ি-দড়া দিয়ে একত্রে বাঁধা হয়। পাইপের পাত্র, মাছের ফাঁদ, টর্চ, ঝুড়ি, পানীয়ের কাপ, বড় থালা এবং বালিশ, সিড়িঁ, তাঁত, ছাতা, বসার এবং ঘুমানোর মাদুর এবং বিরুদ্ধ পক্ষকে লাঠি পেটা করার লাঠির জন্য এটাকে ব্যবহার করা হয়। বাঁশ পাহাড়ের জনজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
অনান্য ব্যবহার্য সামগ্রীর মধ্যে তাদের প্রধান কারিগরি যন্ত্র ছিল দা, কুড়োল, কাস্তে ও কোমর তাঁত, তবে ব্রিটিশ আমলের শেষের দিকে হাল চাষের লাঙ্গল ও মই এর সাথে যুক্ত হয়। দা দিয়েই তারা তাদের বনজঙ্গল সাফ করে জুমক্ষেত তৈরি করে।
জুমের ফসলই তাদের ভাত কাপড়ের যোগান দেয়। জুম ফসলের মধ্যে তিল, তিসি, ভুট্টা, মরিচ, মিষ্টি কুমড়া, বেগুন, আলু, ফুটি খরমুজ (মারপা) ধান, তুলা, হলুদ উল্লেখযোগ্য। এসব শস্য তারা পর্যায়ক্রমে পেতে থাকে। জুম থেকে সংগৃহীত তুলা থেকে সুতা এবং সুতা থেকে পাহাড়ি নারীরা কোমর তাঁতে বুনে নিজেদের এবং পরিবারের সকলের কাপড় তৈরি করে।
বস্তুত অল্পতে তৃপ্ত ছিল জীবনের চাহিদা। পাহাড়ের একজন প্রখ্যাত লেখকের বর্ণিত একজন জুমিয়ার জীবনচিত্র দেখলে বোধগম্য হয় কত সাদামাটা ছিল তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা:
‘একটি স্বনির্মিত বাঁশের তৈরি উঁচু মাচান ঘরেই কোন জুমিয়া পরিবারের বাস এবং এই ঘরের সমুদয় সামগ্রীই বিনামূল্যে বন থেকে আহরিত। অর্থাৎ স্থানীয় বিচারে যে ঘরের কোন বৈষয়িক মূল্যই নেই বলা চলে। মেয়েদের জন্য না-ছেঁড়া পর্যন্ত জনপ্রতি দুখানার চেয়ে পরনের কাপড় নেই, পুরুষদের জন্য গামছা বা নেংটি জাতীয় কাপড়ই প্রধান। শীত বস্ত্র বলতে শয়নকালের জন্য নিজ তাঁতে বোনা মোটা অতি ময়লা দু’একটি গিলাপ বা মোটা চাদর অথবা বাজার থেকে কোন আর্থিক সুযোগে কেনা ছিন্ন ভিন্ন একখানা লেপ। অন্যথায় আগুনই একমাত্র সহায়। রান্নার জন্য কয়েকটি এলুমিনিয়ামের পাত্র, মাটির কলসি ও জল পানাধার, মরিচ বাটার জন্য একটি গোলাকার মাটির তৈরি কুর্য্যা, দু’একখানা দাও বা তাগল এবং স্বনির্মিত মাল বহনের দু’একটি বাঁশের ঝুরি, এই হল একটি জুমিয়া পরিবারের মোটামুটি স্বম্বল।’
উপরের যে জীবনের চিত্র আমরা দেখি তার সারা বাংলার গ্রামীণ জীবনের প্রতিচ্ছবির সাথে অদ্ভুতভাবে মিলে যায়। এম আজিজুল হক ও তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ The Man behind the plough (1980) বাংলার গ্রামীণ কৃষকের চাহিদা অত্যন্ত নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন- The needs of the Bengal peasants are very modest and limited. A little food, some scanty clothing, a few crude utensils, a humble shelter, a few lean animals to plough with and the simplest instruments for tillage-these are all that he needs.
অন্যদিকে ঊনিশ শতকে পাহাড়ি ঘরের আসবাবপত্র সম্বন্ধে হান্টারও প্রায় একই কথা বলে গেছেন। তাঁর মতে, ‘The furniture of an ordinary hill house consists of a few tools, mats, baskets, and drinking-cups made of bamboo.’ তাদের খাদ্য তালিকাও খুবই সাদামাটা।
হান্টার জানাচ্ছেন, ‘The ordinary food of the people of the Chittagong Hill Tracts consists of rice, fish, oil, salt, and chilies.’ হান্টার এখানে মাংসের কথা উল্লেখ করেন নি যা তার পরবর্তী গেজেটিয়ার প্রণেতা ও ডেপুটি কমিশনার হাটকিনসন লিখেছেন, ‘They get three rice meals a day and very seldom have a meal without some sort of relish; while fish, flesh of goats, pig and fowlm and also game are frequent additions to the daily meal.’
ভাতের পাশাপাশি বন ও খেতের শাকসবজি ও ফলমূল এবং বুনো আলু ও বাঁশকড়োল তাদের খাদ্য তালিকায় শীর্ষে থাকে। পুরুষরা দলবেদে শিকার করে মাংস সংগ্রহ করে আর প্রকৃতির ছড়া-নালায় অস্থায়ী বাঁধ দিয়ে চিংড়ি, মাছ, কাঁকড়া সংগ্রহ করে আমিষের চাহিদা পূরণ করে।
উপসংহার: ঊনিশ শতকের প্রেক্ষাপটে উপরে বাংলার এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের গ্রামীণ জীবনের দুটি ছবি পাশাপাশি তুলে ধরা হয়েছে। বাংলার সমতলের গ্রামীণ জীবনে যেমন জমিদারতন্ত্র, বেঁচে থাকার অর্থনীতি, প্রথা-প্রতিষ্ঠানের আধিপত্য এবং গ্রামের বাসিন্দাদের অতীব সাদামাটা দৈনন্দিন জীবনের ছবি ফুটে উঠে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জীবনেও তার একই দৃশ্যপট বিদ্যমান।
সুতরাং অর্থনীতি, সমাজকাঠামো এবং সাধারণ মানুষের জীবন ধারার মধ্যে উভয় অঞ্চলের (সমতল ও পার্বত্য) অঞ্চলের মধ্যে ব্যাপক সাদৃশ্য স্পষ্ট প্রতীয়মান। জাতিগত এবং ভৌগোলিক পার্থক্য থাকলেও গ্রামীণ জীবনবোধের মধ্যে স্বাতন্ত্র্যের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। বলা যায় পার্বত্য চট্টগ্রাম আবহমান বাংলার গ্রামীণ জীবনের চিত্রই ধারণ করে। ফলে এটাকে পার্বত্য-বাংলা বলাই সমীচীন।
লেখক: আনন্দ বিকাশ চাকমা, সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল- abcjmiu@gmail.com
তথ্যসূত্র:
১. Ekhlasul Kabir, ‘The Conditions of the Working Classes of Bengal,’ 1858-1905., Unibersity of Chittagong, 1987 p.5
2. রমেশচন্দ্র দত্ত, বাংলার কৃষক, (অনু.) কাজী ফারহানা আকতার লিসা ও সাদাত উল্লাহ খান, (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ২০০৮০ পৃ.৫৯)
৩. Willem van Schendel and Aminul Huque Faraizi, Rural Laborers in Bengal, 1880-1980,Rotterdam, 1984,p.5
৪. British Parliamentary papers, Report from the Select Committee of the House of Commonsm Session 1831-2 (public) A.pp 306 অনুবাদ এবং উদ্বৃত- সিরাজুল ইসলাম, বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থা ও সামাজিক সমস্যা, দ্বিতীয় সংস্করণ (ঢাকা: গীতি রানী সাহা কর্তৃক প্রকাশিত, ১৯৮১) পৃ.১
৫. রমেশচন্দ্র দত্ত, বাংলার কৃষক, ৫৯
৬. লাল বিহারী দে, বাংলার চাষী, (অনু.) মন্মথ নাথ সরকার, (কলকাতা: চর্যাপদ প্রথম সংস্করণ, ২০১৩) পৃ. ১৫৪
৭. সিরাজুল ইসলাম, বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থা ও সামাজিক সমস্যা, দ্বিতীয় সংস্করণ (ঢাকা: গীতি রানী সাহা কর্তৃক প্রকাশিত, ১৯৮১) পৃ. ৩০-৩১
৮. Dacca Collector To Board of Revenue, 11 Feb, 1801 Dacca District Records, vol. 20 p. 37 (Dacca Collectorate Record Room) উদ্বৃত-প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫
৯. Chittagong Council to Henry Vansitart, 16 Feb 1761, Chittagong District Records, vol 479(old), (Dacca Secretariat Record), p.16 উদ্বৃত-প্রাগুক্ত, পৃ.২৩
১০. রমেশচন্দ্র দত্ত, বাংলার কৃষক, পৃ.৭৯
১১. লাল বিহারী দে, বাংলার চাষী, ২৪
১২. Report on the Condition of the Lower classes of population in Bengal, 1888, Calcutta, cited by Ekhlasul Kabir, op.cit.,p.161
১৩. হাটকিনসন, ১৪, হাণ্টার, ৩৫
১৪. চাকমা রাজা শের মুস্ত খাঁ থেকে জান বখশ খাঁ জমিদার হিসেবে মুদ্রা জারি করেছিলেন। জান বখস খাঁ নিজেকে বৃটিশদের কাছ থেকে স্বাধীন জমিদার হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। চট্টগ্রামে চাকমা রাজ এস্টেট বা জমিদার ছিল। কিন্তু প্রথাগতভাবে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজা হিসেবে সমাদৃত। এজন্য- এখানে তাদেরকে ‘জমিদার-রাজা’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
১৫. ১৯০০ সালের হিল ট্র্যাক্ট রেগুলেশন এর ৩৮ নং বিধিতে সার্কেল চীফ ব্যতীত বাকী অধিবাসীদের প্রজা বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
১৬. Capt. T.H.Lewin, Wild Races of South-Eastern India, (Calcutta: Firma KLM pvt.Ltd, Rpt. 1978) p.21
১৭. ১৮৭৩ সালের পূর্ব পর্যন্ত এটির নামকরন ছিল ‘ক্যাপিটেশন বা মাথাপিছু কর’ ১৮৭৪ সাল থেকে জুম ট্যাক্স হিসেবে পরিবার পিছু ৪. টাকা করে ধার্য করা হয়। যা দেওয়ানদের মাধ্যমে রাজারা আদায় করতেন। এবং ২ টাকা রেখে ১ টাকা সরকারকে জমা দিতেন।
১৮. Lt. Col. T.H Lewin, A Fly on the Wheel: or How I Helped to Govern India, (London: Constable & Company ltd., 1912) p. 207
১৯. Collections for social or religious or public purposes, such as a wedding or a funeral in the family of the Chief, or the building of temple, a court or a residence.ii) Sumtuary taxes such as are levied on the wearing of jewellery by women or shoes by men, or on the erection of a masonry plinth of a house or permanent fence round a compound, or on the huntinf of a boar or a deer. Iii) Personal payments to the Chiefs on the occasion of interviews or visits to house of village. iv) The claim to the first fruit (of Season). v) All other illegal, oppressive and surreptitious collections. See, Selections from the Correspondence on the Revenue Administation of the Chittagong Hill Tracts, 1862-1927, (Calcuta: Bengal Government press, 1929)p. 455-56
২০. Muhsmmad Ishaq, Bangladesh District Gazetteers: Chittagong Hill Tracts, (Dacca: Bangladesh Govt. Press, 1975) p. 188
২১. ভল্ফগাং মে, পার্বত্য চট্টগ্রামের কৌম সমাজ: একটি আর্থ-সামাজিক ইতিহাস, (অনু:) স্বপ্না ভট্টচার্য (চক্রবর্তী), (কলকাতা: ফার্মা কেএলএম প্রা: লি:, ১৯৯৬) পৃ. ৯৭
২২. হিরহিত চাকমা, পৃ. ২৭
২৩. Capt. T. H. Lewin, Wild Races of South-Eastern India, 13
২৪. Tridiv Roy, The Departed Melody, p. 25
২৫. হিরহিত চাকমা, চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চল ও তার অধিবাসীবৃন্দ, পৃ.১২
২৬. Capt. T. H. Lewin, Wild Races of South-Eastern India, 16
২৭. চাকমা সলিল রায়, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক সমস্যা ও তার সমাধান’ নিবারণ চন্দ্র দেওয়ান (সম্পা) তারকা (রাংগামাটি, ১৯৮০ পৃ. নম্বর নেই)
২৮. M. Azizul Huque, The Man Behind the plough (Dacca: Bangladesh Books International Ltd. 1980) p.v
২৯. Hunter W.W., A statistical Account of Bengal. Vol 6, 1876, Reprinted by D.K publishing House, Delhi, 1973. P. 70
৩০. Hunter, W. W., A statistical Account of Bengal. Vol 6, 1876, Reprinted by D.K publishing House, Delhi, 1973.p. 70
৩১. Hutchinson, R. H. Sneyd, Chittagong Hill Tracts, District Gazetteer, (Calcutta, 1909, Delhi: Vivek Publishing Company, Rpt. 1978)p. 78
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।