বম জনগোষ্ঠীর উত্তরাধিকার প্রথা, বম ভাষায় যার নাম রৌতিং
1049
বম জনগোষ্ঠীর উত্তরাধিকার প্রথার উদ্ভব
পার্বত্য এলাকার বম সমাজ ব্যবস্থায় অদ্যাবধি জুম চাষ তাদের প্রধান পেশা। ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধির ৪২ নং বিধিমতে পাহাড়ে জুম চাষের জন্য জমির মালিকানা স্বত্বের প্রয়োজন হয় না, যার কারণে বম সমাজে স্থাবর সম্পত্তি তথা ভূমির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বা স্থায়ী মালিকানা স্বত্ত্ব অর্জনের প্রচেষ্টা তেমন একটা ছিল না বললেই চলে।
এ অবস্থায় সম্পত্তির উত্তরাধিকার অর্জনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে পার্বত্য জেলাসমূহে বসবাসকারী বম সমাজে অতীতে তেমন একটা সুস্পষ্ট ধারণা গড়ে ওঠেনি।
ইদানীংকালে জুম চাষের জন্য জমির অপ্রতুলতা এবং পর্যায়ক্রমে একই জমিতে বংশানুক্রমিকভাবে চাষাবাদের কারণে বম জনগোষ্ঠীর মধ্যে উদ্যান কৃষির প্রতি মনোযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি বর্তমান শিক্ষিত সমাজে ভূ-সম্পত্তির উপর স্থায়ী মালিকানা স্বত্ব অর্জনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ধারণার উদ্ভব হয়েছে।
বম সমাজভুক্ত পরিবারে কেউ মারা গেলে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদনের দায়-দায়িত্ব পালনের দ্বারা মৃতের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবার বিষয়টি সম্পর্কযুক্ত এবং পারিবারিক কর্তব্য হিসেবে সমাজে স্বীকৃত।
বম জনগোষ্ঠীর উত্তরাধিকার প্রথার সাধারণ নীতি
উত্তরাধিকার: বম সমাজভুক্ত কোনো পরিবারের কেউ মারা গেলে তার সৎকার, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করা সামাজিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সমাজের অনুশাসন অনুসারে মৃতের আত্মার সদ্গতির জন্য বিশেষ কিছু আচার-অনুষ্ঠান পালনের মধ্য দিয়ে মৃত ব্যক্তির আইনগত উত্তরাধিকারী হতে হয়।
বম সমাজে সম্পত্তির মালিকের মৃত্যুর পর মৃতের সৎকার, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার পর, তার অনাদায়ী ঋণ (যদি থাকে), জীবদ্দশায় সম্পাদিত উইল বা দানমূলে দখল হস্তান্তরিত হয়েছে কিন্তু মালিকানা স্বত্ব হস্তান্তরিত হয়নি এমন ভূ-সম্পত্তির দায়/দাবী মেটানোর পর যা অবশিষ্ট থাকবে তার উপরই উত্তরাধিকারীগণের দাবী/অধিকার বর্তায়। একজন সম্পত্তির মালিকের সম্পূর্ণ স্থাবর সম্পত্তি উত্তরাধিকারযোগ্য সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হয় না।
উত্তরাধিকারযোগ্য সম্পত্তি কি কি: সম্পত্তির মালিক যেসব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি রেখে মারা যায় সে সবই উত্তরাধিকারযোগ্য সম্পত্তি হিসাবে গণ্য। অস্থাবর সম্পত্তি যেমনঃ- আসবাবপত্র, থালা-বাটি, কাপড়চোপড়, অলংকার, গবাদিপশু ইত্যাদি উত্তরাধিকারীগণের মধ্যে আপোষ রফায় ভাগবন্টন ও হস্তান্তর হয়। কিন্তু লিখিত কোনো আইন বা বিধি-বিধানমতে সেগুলো ভাগবন্টন করা হয় না।
কেবলমাত্র ভূমি তথা জায়গা-জমিকে স্থাবর সম্পত্তি হিসেবে সামাজিক বিধি-বিধানমতে ভাগবন্টন করা হয়। তাই উত্তরাধিকারযোগ্য সম্পত্তি বলতে সাধারণভাবে স্থাবর সম্পত্তিকেই বুঝানো হয়।
কিন্তু একজন সম্পত্তির মালিকের সম্পূর্ণ স্থাবর সম্পত্তি উত্তরাধিকারযোগ্য সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হয় না। সম্পত্তির মালিকের মৃত্যুর পর তার সৎকার/অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যয়, তার অনাদায়ী ঋণ (যদি থাকে) এবং জীবদ্দশায় দখল হস্তান্তরিত হয়েছে কিন্তু মালিকানা স্বত্ব হস্তান্তরিত হয়নি এমন ভূ-সম্পত্তির দায়/দেনা মেটানোর পর যা অবশিষ্ট থাকে তার উপরই উত্তরাধিকারীগণের অধিকার বর্তায়।
সম্পত্তির উত্তরাধিকার রীতি
তিন পার্বত্য জেলার সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক সংশ্লিষ্ট মৌজার হেডম্যান/ইউ.পি চেয়ারম্যান/কার্বারী/পৌর চেয়ারম্যান/সার্কেল চীফ-এর নিকট হতে মতামত ও সুপারিশ গ্রহণ। পূর্বক ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশনের ৭ নং ধারামতে প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে সংশ্লিষ্ট জেলার দেওয়ানী আদালতের ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে বিবিধ মামলামুলে তিনি মৃত ব্যক্তির আইনগত উত্তরাধিকারীগণকে উত্তরাধিকার সনদপত্র প্রদান করেন।
পার্বত্য জেলাসমূহে বসবাসকারী বম পরিবারে কারো মৃত্যুর পর তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য ব্যয় বাবদ খরচ, তার জীবদ্দশায় অনাদায়ী ঋণ এবং জীবদ্দশায় কোনো সম্পত্তি দান বা বিক্রি কিংবা মৃত্যুর পূর্বে সম্পাদিত উইল ইত্যাদির দাবী পরিশোধ বা নিষ্পন্ন করার পর নিম্নোক্ত উপায়ে বম সমাজে উত্তরাধিকার রীতির প্রচলন রয়েছেঃ-
চাকমা ও বোমাং সার্কেলে বসবাসকারী বম সমাজে মৃত ব্যক্তির পুত্র সন্তানই পিতার সম্পত্তির অপ্রতিরোধ্য আইনগত উত্তরাধিকারী । মৃত পিতার সম্পত্তির বৃহৎ অংশ সর্বকনিষ্ঠ পুত্র লাভ করে।
বম সমাজের রীতি অনুসারে মৃত স্বামীর অস্থাবর সম্পত্তির অংশ বিশেষ স্ত্রী, তাঁর অবর্তমানে বা না দাবীতে কন্যা সন্তান পায়। তবে স্বামী বা পিতার জীবদ্দশায় উইল কিংবা দানমূলে প্রদত্ত অস্থাবর সম্পত্তি স্ত্রী বা কন্যার অধিকারে থাকে। পুত্রের অবর্তমানে মৃতের পিতা, তার অবর্তমানে সহোদর ভাই, ভাইপো উত্তরাধিকারী হয়।
উত্তরাধিকারযোগ্য পদ ও পদবী: পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি ১৯০০ এর ৪৮ নং বিধিমতে সার্কেল চীফ নিয়োগ এবং হেডম্যান নিয়োগ ও বরখাস্ত বিষয়ে লিপিবদ্ধ আছে।
ক) পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি ১৯০০-এর ৪৮ নং বিধিতে বম সমাজের হেডম্যান/কারবারী এসব পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সার্কেল চীফের সুপারিশ বা মতামতকে অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়। হেডম্যান/কারবারী নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্র যদি যোগ্য হন তাকে সেই পদে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রদান করা হয়।
খ) বম সমাজের সমাজপতি বা পাড়া প্রধান পদটি বংশানুক্রমিক হিসেবে পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্র এতে অগ্রাধিকার পায়, যদিও উক্ত পদটি ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি অনুসারে স্বীকৃত নয়। এক্ষেত্রে বম সোশ্যাল কাউন্সিলের সিদ্ধান্তই সমাজের নিকট বিবেচিত হয়।
বম জনগোষ্ঠীর উত্তরাধিকার প্রশ্নে অগ্রাধিকার ভিত্তিক শ্রেণীবিন্যাস: বম জনগোষ্ঠীর উত্তরাধিকার প্রশ্নে অগ্রাধিকার ভিত্তিক নিম্নবর্ণিত শ্রেণীবিন্যাস বম সোশ্যাল কাউন্সিলের ইউনিট, এরিয়া ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের প্রতিবিধান ও সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়ঃ-
ক) বম পরিবারে মৃত ব্যক্তির পুত্র সন্তানেরা মৃতের অপ্রতিরোধ্য উত্তরাধিকারী। তার বা তাদের উপস্থিতি অন্য সকল নিকটাত্মীয়ের অধিকারকে খর্ব করে। অবশ্য পুত্র সন্তান বলতে- ঔরসজাত, অবৈধ ও দত্তক সন্তানকে ও বুঝায়। পুত্র সন্তানের মৃত্যুজনিত কারণে পৌত্রগণ উত্তরাধিকারী হিসেবে গণ্য হয়।
খ) বম পরিবারে মৃত ব্যক্তির পুত্র সন্তান যদি না থাকে, সেক্ষেত্রে মৃতের সহোদর ভাই, ভ্রাতুস্পুত্র উত্তরাধিকারী হয়।
গ) স্বামী-স্ত্রীঃ স্বামী-স্ত্রীর বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলে স্ত্রীর মৃত্যুতে স্বামী স্ত্রীর অর্জিত সম্পদের অধিকারী হয়।
ঘ) পিতা-মাতাঃ মৃত ব্যক্তির পুত্র, নাতি যদি না থাকে, সেক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তি যাদের ঔরসজাত অথবা দত্তক সন্তান রূপে যাদের স্নেহে লালিত পালিত হয়েছে সেই পিতা-মাতা মৃতের আইনগত উত্তরাধিকারী হয়।
ঙ) রক্ত সম্পর্কীয়ঃ বম সমাজে মৃত ব্যক্তির পুত্র, নাতি, পিতামাতা কেউ যদি জীবিত না থাকে অথবা জন্মগ্রহণ না করে, সেক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির সহোদর ভ্রাতা, ভ্রাতুস্পুত্র তাদের অবর্তমানে কাকা, জেঠা উত্তরাধিকারী হয়।
চ) মৃতের যদি পুত্র, পৌত্র, পিতা, ভাই এবং ভাইপো এ ধরণের রক্ত সম্পর্কীয় কেউ যদি জীবিত না থাকে অথবা জন্মগ্রহণ না করে, সেক্ষেত্রে কাকা/জেঠা তাদের অবর্তমানে কাকার/জেঠার পুত্র আইনগত উত্তরাধিকারী হয়।
ছ) মৃত ব্যক্তির ‘চ’ অংশের রক্ত সম্পর্কীয় উত্তরাধিকারী ও যদি না থাকে, তবে ‘রৌখেংকই’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আত্মীয়তা স্থাপনকারী বা তার উত্তরাধিকারীগণ মৃতের উত্তরাধিকারী।
ব্যাখ্যা: বম সমাজের রীতি অনুসারে কোনো ব্যক্তি অপর একজনের সাথে ‘রৌখেংকই’এর মাধ্যমে ধর্ম সম্পৰ্কীয় আত্মীয়তা স্থাপন করতে পারে। এতে সম্পর্ক স্থাপনকারী উভয়ের রক্ত, চিলের নখ, বাঘের দাঁত ও রৌপ্যমুদ্রার সাথে মোরগ-মুরগীর রক্ত মিশিয়ে সমাজের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি বা পুরোহিতের মাধ্যমে তা মন্ত্র পুতঃ করে দু’জনে পান করার মধ্য দিয়ে ধর্ম সম্পর্কীয় আত্মীয়তা স্থাপন করে। (সূত্রঃ- জুয়ামলিয়ান আমলাই)।
সম্পত্তির ভাগবন্টন:
ক) বর্তমানে বম সোশ্যাল কাউন্সিল-এর সিদ্ধান্ত মতে সম্পদশালী স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী তার স্বামীর অস্থাবর সম্পত্তি হতে ২৫% ভাগের উত্তরাধিকারী হচ্ছে। তবে বিধবা তার মৃত স্বামীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া (কুতসাহ/Kutsamh) সম্পন্ন হবার পূর্বে যদি দ্বিতীয়বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় সেক্ষেত্রে পূর্বের স্বামীর সম্পত্তিতে ২৫% অংশ লাভের অধিকার হারায়।
খ) বম সমাজের কন্যা সন্তানেরা বম সোশ্যাল কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুসারে বর্তমানে মৃত পিতার অস্থাবর সম্পত্তিতে মাতার অনুরূপ ২৫% ভাগের আইনগত উত্তরাধিকারী হচ্ছে।
গ) বম সমাজের পুত্র সন্তানেরা মৃত পিতার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির সিংহভাগ লাভ করে। তবে মৃত পিতার সর্বকনিষ্ঠ পুত্র সম্পত্তির বৃহৎ অংশের উত্তরাধিকারী হয়।
অবৈধ সন্তানের উত্তরাধিকার স্বত্ব: যে ব্যক্তির ঔরসে অবৈধ সন্তান (জারজ) জন্মগ্রহণ করেছে/করে সেই জন্মদাতার সামাজিক রীতিনীতি ও প্রথা অনুসারে সন্তানের উত্তরাধিকার নির্ধারণ করা হয়। তবে ভিন্ন কোনো ব্যক্তির পিতৃ পরিচয়ে সে যদি পরিচিত হয়, সেক্ষেত্রে জন্মদাতা পিতার উত্তরাধিকার সে দাবী করতে পারেনা, কেবলমাত্র নিজ মায়ের সম্পত্তির (যদি থাকে) উত্তরাধিকারী হয়।
তথ্যসূত্রঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আদিবাসীদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন (গ্রন্থনা ও সম্পাদনা – এডভোকেট জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, এডভোকেট প্রতিম রায়, সুগত চাকমা)।
বম জনগোষ্ঠী সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে চাইলে পড়ুন – বম জাতির আদ্যোপান্ত
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।