পাহাড়ের নতুন রঙের, নতুন সম্ভাবনা!

Sulav Changma Dhenga
Last updated Sep 23rd, 2021

1821

featured image

চুনীলালের শিল্পযাত্রার স্বপ্ন যেন ভঙ্গ না হয়…

পাহাড়ের শিল্পের যে দ্যুতি তা নিয়ে খুব কমই কাজ হয়েছে। চুনীলাল দেওয়ান সর্বপ্রথম পাহাড়ের অনুভূতিগুলো শিল্পের ফ্রেমে উপস্থাপণের প্রয়াস চালান। কলিকাতা আর্ট কলেজে একসাথে সময় কাটিয়েছেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের সাথে।

মূলত চুনীলাল দেওয়ানের হাত ধরেই পাহাড়ের উর্বর শিল্পসম্ভাবনার সন্ধান পাওয়া যায়। কেবল চিত্রশিল্পীই নন, তিনি একাধারে কবি, গায়ক, সুরকার, গীতিকার ও ভাস্কর ছিলেন।

পাহাড়ের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতে চুনীলালের স্বপ্নময় পদচারণা প্রজন্মের অনেককেই এখনো বেশ উৎসাহ যোগায়।

পরবর্তীতে শিল্পী কনক চাঁপা চাকমা পাহাড়ের রঙকে পরিচয় করিয়ে দেন মূলধারার শিল্পযাত্রার সাথে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় পড়ার সুবাদে তাঁর সে সুযোগটুকু তৈরী হয়েছে। তাঁর তুলির গতি ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের শিল্প দরবারেও।

কনকচাঁপার শিল্প ভাবনায় পাহাড়ের কোলে আবহমানকাল সৌন্দর্যের বেষ্টনিতে নিষ্পাপ মুড়িয়ে থাকা পাহাড়ী কন্যার অন্তর্দহন, উচ্ছাস, গহীনের শব্দগুলো উঠে এসেছে। তাঁর শিল্প ভাবনায় সবসময় খেলা করে বেড়ায় পাহাড়ী কন্যার নিষ্পাপ চাহনি অথবা নির্মল অবয়ব।

পাহাড়ের “ফিগার” অধ্যয়নে তিনি এখনো পর্যন্ত বিনাতর্কে অদ্বিতীয় এবং অবিসংবাদিত। কখনো কখনো বৌদ্ধ ধর্মের গেরুয়া সারল্যের প্রতি ঝোঁক পাওয়া যায় তাঁর কাজগুলোতে। অবশ্য সবসময়ই তুলির গতিতে অবিরাম তিনি রঙের উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে দিচ্ছেন সাহসী এবং পরিণত ক্যানভাসে।

গতিময় তুলিতে নির্বাক বয়ান দিয়ে যাচ্ছেন কিছু “সময়ের”। পাহাড়ের শিল্পযাত্রায় নিজের অবস্থান অনেক উঁচুতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন শিল্পী কনকচাঁপা চাকমা। পাহাড়ের শিল্পীদের জন্য অণুপ্রেরণার একটা জায়গাও তিনি নিশ্চয়ই প্রতিষ্ঠা করেছেন।

চুনীলালের সূচনা করা গন্তব্যে খুব কম পাহাড়ি শিল্পীই যাত্রা ধারাবাহিক রাখতে সক্ষম হয়েছেন।

দীর্ঘদিন ধরে তাই পাহাড়ের শিল্প মানেই খুব স্বাভাবিকভাবে কনকচাঁপা চাকমার অবস্থানই প্রতিষ্ঠিতভাবে প্রতিনিধিত্বমূলক বলে আখ্যায়িত করা যায়। তবে পাহাড়ের শিল্পময় অনুভূতিগুলোর বিকাশে যে কাজ একেবারেই হয়নি এমন নয়।

কনকচাঁপার পরবর্তীতেও অনেকেই এগনোর চেষ্টা করেছেন পাহাড়ের শিল্প সম্ভার নিয়ে। অনেক প্রতিশ্রুতিশীল তরুণের আনাগোনাও নতুন করে পরিলক্ষিত হচ্ছে।

একটু সচেতন দৃষ্টি আর যত্ন পেলেই পাহাড়ের শিল্পীরা মূলধারার শিল্পযাত্রায় যোগ করতে পারে বৈচিত্রময় পাহাড়ের সমৃদ্ধ শিল্পভাবনার নতুন নতুন অভিসন্ধর্ব।

Morning Light
Morning Light, Image: Nantu chakma

যাই হোক,পাহাড়ের শিল্পচর্চার ধারাটা খুব বেশী বেগবান হয়ে উঠতে পারে নি, বিভিন্ন কারণে। তবে সেখানকার অব্যক্ত অনুভূতিগুলো সুযোগ মিললেই দেওয়াল ভাঙার উচ্চারণে উঠে আসার বিদ্রোহ দেখিয়েছে।

১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় “হিল আর্টিস্ট গ্রুপ”। প্রতিষ্ঠার পর থেকে তারা পাহাড়ের শিল্পচেতনার সাথে সংযোগ ঘটানোর প্রয়াস চালিয়েছেন, দেশের শিল্পজগতের। এপর্যন্ত প্রায় ৬টি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন তারা পাহাড়ের শিল্পীদের নিয়ে।

গত ৯ ডিসেম্বর, ২০১৬ ইং থেকে ১৪ই ডিসেম্বর,২০১৬ ইং ঢাকার ধানমন্ডিস্থ দৃক গ্যালারিতে  “প্রকৃতি ও জীবন” শিরোনামে সফলভাবেই তারা সম্পন্ন করলো তাদের ৬ষ্ঠ শিল্পকর্ম প্রদর্শনী। বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মী এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল ছিলেন উদ্বোধনী দিনের প্রধান অতিথি।

আমার পরিচিত অনেক শিল্পীর কাজ দেখলাম প্রদর্শনীতে। ভালো লাগলো। ঘুরে আসা প্রদর্শনী এবং ইতোপূর্বেকার আমার ব্যক্তিগত আগ্রহের জায়গা থেকে পাহাড়ের শিল্প ও শিল্পীদের প্রতি স্বভাবসুলভ ঝোঁকের নিমিত্তে সম্ভাব্য ধারাবাহিক অনুস্মরণ চেষ্টার অভিজ্ঞতার আলোকে আমার চেনা-জানা মুখগুলোর শিল্পভাবনার সাথে কিছুটা সহভাগিতা করার খায়েশ হলো। সেই খেয়ালেই, এই লেখা….

পাহাড়ের শিল্প সম্ভাবনাকে আঁকড়ে ধরে পাহাড়ের অপরাপর শিল্পীদেরকে সাথে নিয়েই দীর্ঘদিন থেকে দেশের শিল্পজগতে পাহাড়ের শিল্পকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ব্রত নিয়ে কাজ করে যাওয়ার চেষ্টা করছেন পাহাড়ের অন্যতম সিনিয়র শিল্পী ধনমনি চাকমা।

নিজে বিকশিত হওয়ার পাশাপাশি আগলে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন অন্যান্য শিল্পীদেরকেও। পাহাড়ের শিল্পীদের সংগঠিত করার চেষ্টায় তিনি বরাবরই উদ্যোগী ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেছেন বলে জানি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্রয়িং এন্ড পেইন্টিং বিভাগ থেকে মাস্টার্স শেষ করা এই শিল্পী ১৯৯৮ সালে প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী করেন রাঙ্গামাটি শিল্পকলা একাডেমীতে। ২০০৩ সালে তিনি দুইটি একক চিত্র প্রদর্শনী করেন। এপর্যন্ত ১০টিরও অধিক দলীয় শিল্প প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন।

অভিজ্ঞ এই শিল্পীর কাজের মধ্য দিয়ে পাহাড়ের প্রতি তার দ্বায়বোধ প্রস্ফূটিত হয়। শিল্পী ধনমনি চাকমার তুলিতে পাহাড়ের আবহমানকালের বিমূর্ত ভাবনাগুলো যেন মূর্ত হয়ে উঠে। তাঁর অনেক কাজেই দেখা যায় যে, জুম্ম নারীর কর্মক্লান্ত মুহুর্ত আদি অবয়ব নিয়ে ধরা দিতে চায় তার ক্যানভাসে।

তিনি আঁকতে ভালোবাসেন ‘জুম’ আর ‘জুম্ম’ নারীর অবিচ্ছেদ্য বন্ধনকে। রঙ মাখেন বলিষ্ঠ সাহসে। হলুদের একটা ছড়াছড়ি আছে তাঁর রঙবিলাসে। সদ্যসমাপ্ত প্রদর্শনীতে তাঁর “রেস্ট” আর “জুম্মবী” শিরোনামের কাজগুলো তাঁর শিল্প অঙ্গীকার নিয়ে আমাদের বেশ উৎসাহী করে তোলে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলকাতার রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাস্কর্য নিয়ে পড়াশোনা করা শিল্পী লাভলী চাকমা পাহাড়ের অন্যতম সিনিয়র শিল্পী। ভাস্কর্য শিল্পে ঝোঁক দেখানো এই শিল্পী যেন পাহাড় থেকে নিয়ে আসা নির্যাস নিয়ে নিজেই নিজেকে ভাঙতে চান অন্য এক গড়ে নেওয়ার আকাঙ্খায়।

অভিজ্ঞ এই ভাস্কর্য শিল্পী ১৯৯২ সালের হিল আর্টিস্ট গ্রুপের প্রথম প্রদর্শনী থেকে শুরু করে আজোবধি পাহাড়ের শিল্পের প্রতি তাঁর নিবেদন অব্যাহত রেখেছেন। এযাবৎ ১৫টিরও অধিক প্রদর্শনীতে তিনি শিল্পকর্ম প্রদর্শন করেছেন।

“চাকমা অরনামেন্টস” নামে তাঁর একটি প্রকাশনাও আছে। সাহসী এই ভাস্কর তাঁর কাজের মাধ্যমে পাহাড়ের শিল্পকে প্রেরণা যুগিয়ে যাচ্ছেন আলোর যাত্রায়। তাঁর নিবেদন এবং অঙ্গিকার নিয়ে কোন সংশয় থাকার কথা নয়, উপরন্তু আমরা বাহবা দিতে বাধ্য হই বরঙ।

আলোচ্য প্রদর্শনীতে শিল্পীর কাঠনির্মিত ভাস্কর্য “আনটাইটেল” বা “শিরোনামহীন” কাজটিও আমাদেরকে কোন এক মমত্বমাখা খোদাইকার্যের ইঙ্গিত দেয়। ঠিকঠাক খোঁজ নেওয়া গেলে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন শিল্প প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া এই শিল্পীকে হয়তো গুণী শল্পীদের কাতারে মাপতে চাইবেন অনেকে।

পাহাড় থেকে উঠে এসে শিল্পচর্চায় আগ্রহী হয়ে ওঠা সেইসব গুটিকয়েক স্বপ্নবাজ পাহাড়ি তরুণদেরই একজন শিল্পী রনেল চাকমা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় অধ্যয়ন শেষ করে তিনি এযাবৎ তিনটি একক চিত্র প্রদর্শনী করেছেন।

১০টিরও অধিক প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া এই শিল্পী এখনো রঙ-তুলি নিয়ে সমসাময়িকদের সাথে ঠিকে থাকার চেষ্টা নিরলসভাবে করে যাচ্ছেন ক্যানভাস আর শিল্পের প্রতি আবেগকে সম্বল করে।

সদ্য সমাপ্ত প্রদর্শনীতে “ওয়েটিং”, “ম্রো ফেস্টিভেল” শিরোনামের কাজগুলো নিয়ে তাঁর ভাবনাজুড়ে মিশে থাকা পাহাড়ি জনপদের অকথিত কথনকেই তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।

তাঁর ছবিগুলোতে চমৎকার অঙ্গীকারকে লিপিবদ্ধ করে অযথা রঙের অপচয় না করেও তিনি তাঁর ভাবনাগুলো অনায়াসেই ফুটিয়ে তুলতে পারবেন বলে মনে করি।

পাহাড়ের সাম্প্রতিক সময়ের সম্ভাবনাময়ী শিল্পীদের একজন নান্টু চাকমা। বিভিন্নসময়ে বেশকিছু দলীয় প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের পাশাপাশি তিনি ২০০৯ সালে রাঙ্গামাটিতে একটি একক প্রদর্শনীও করেছিলেন।

তাঁর কাজগুলোতে পাহাড়ের প্রতি নিখাদ মমতার চিত্র ফুটে উঠে। সেইসময় তিনি কেবল জলরঙের কাজ নিয়ে সাজিয়েছিলেন পুরো প্রদর্শনী। এই প্রদর্শনীতে তাঁর চারটি চিত্রকর্ম তিনি হাজির করেছেন।

খেয়াল করছি, শিল্পী নান্টু চাকমার তুলিতে গতি এসেছে, রঙ ব্যবহারে তিনি পরিণত এবং স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন। তাঁর বিষয়বস্তুর গভীরে খোঁজ নিলে দেখা যায় সেখানে আস্ত একটা পাহাড় বসে আছে যেন!

পাহাড়ের প্রতি নিখাদ ভালোবাসায় উদাসীন জীবন নিয়েই বোধহয় তিনি সাজাতে চান আরেক পাহাড়ের চুড়ো। পাহাড়ি ছড়ায় চপল জুম্ম নারীর নিবিড় কথোপকথনের মতোই তাঁর ছবির ক্যানভাসের মাঝেই তিনি ধরা দেন অন্য একটি চোখ নিয়ে, অন্য একটি অনুভূতি নিয়ে।

Hill village, Painting: Nantu Chakma
Hill village, Painting: Nantu Chakma

ঘন-সবুজের কোলে ঐতিহ্যের চাঁদরে ঢাকা নিটোল পাহাড়ি গ্রাম কখনো কখনো তাঁর ছবির বিষয়বস্তু হয়, ঘুমিয়ে থাকা সারি সারি পাহাড়ের চিরন্তন মোহের টানে কখনো কখনো ছুট দেয় তাঁর দূরন্ত এবং ক্ষ্যাপাটে তুলি।

জীবনবোধেও সাহসী উচ্চারণের দৃঢ়তা দেখানো এই শিল্পী মাঝে মাঝে ছিমছাম ক্যানভাসের উপরিভাগে নির্মাণ করেন নীল-সাদা-সবুজের লুকোচুরি। সেখানে মেঘেরা যদি ভেসে না বেড়ায়, তবে অস্তগামী সূর্যের খেয়ালিপণা নয়তো ভোরের নিষ্কলুষ হিমেল হাওয়ার স্বাদমাখা একটা সকাল আপনি খুজে নিতে পারবেন কখনো কখনো।

পাহাড়ের সরল এবং নিবিড় আলোছায়ায় তিনি গভীর মনযোগে খেলতে চান শিশুতোষ কৌতুহলে! কাজগুলো প্রাণবন্ত। সেন্স মেকিং। তাঁর কাজগুলোতে একটা প্রাণ আছে। সেই প্রাণ জাগিয়ে তুলতে তিনি তাঁর চেতনারই রঙ মাখেন হয়তো।

এইতো কদিন হলো জলরঙ ছেড়েছেন। এক্রিলিক মাধ্যমে তিনি নতুন ক্যানভাস নির্মাণ করার সাহস দেখাতে পারছেন, এটাই বা কম কীসে?? সদ্যসমাপ্ত হয়ে যাওয়া প্রদর্শনীতে শিল্পী নান্টুর “রেইনিং ইন স্প্রিঙ” শিরোনামের কাজটি দেখেই আপনার মনে হবে যে,

তুলি নিয়ে নিখুঁত অভিযান চালাতে তিনি সবকিছু ভুলে থাকতে পারবেন। গভীর মমতায় তিনি পাহাড়কে স্থান দেন ক্যানভাসে। তাঁর প্রতিশ্রতি এবং সাহসী অঙ্গীকার আমাদেরকে আশাবাদী করে বৈকি!

পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চল
অবিরাম প্রকৃতি, ছবি: নান্টু চাকমা

শিল্পী জয়দেব রোয়াজা দাদার সাথে সেভাবে ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। ক্যাটালগ পড়ে জানলাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে “পেইন্টিং” -এ মাস্টার্স সম্পন্ন করা এই শিল্পী বেশকিছু দলীয় প্রদর্শনীর পাশাপাশি একক প্রদর্শনীও করেছেন।

বিভিন্ন জায়গায় তিনি “পারফরমেন্স আর্ট” ও করে যাচ্ছেন নিয়মিত। গতবছরের হিল আর্টিস্ট গ্রুপের প্রদর্শনীতে যেয়ে তাঁর কাজের সাথে পরিচয় হওয়ার সুযোগ ঘটে। সেই থেকে তাঁর শিল্পভাবনাকে খেয়ালে রাখার চেষ্টা করেছি।

বিনয়াবনত পর্যবেক্ষণের দাবি রেখেই বলতে চাই, পাহাড়ের শিল্পে যে সম্ভাবনা নতুন করে উঁকি দেয়, সে যাত্রায় জয়দেব দা অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারেন অনায়াসেই। তাঁর কাজগুলো ভীষণ ভালো লাগে।

ভালো লাগার মতোন যে! তিনি কবে যে এত পরিণত শিল্পযাত্রা শুরু করেছেন তা আমরা অনেকেই খেয়ালও করতে পারি নি হয়তো। যাই হোক আমার মতো করেই আমি খুজে পেয়েছি যে, জয়দেব দা-র শিল্প ভাবনায় নিখাদ শিল্পের আনন্দ উপভোগ করার প্রবণতা আছে।

অবশ্য পাহাড়ের গহীনে প্রবেশ করে তিনি বের করে নিয়ে আসেন আদি পাহাড়ের পাথরে মোড়ানো ছিপছিপে ছড়ার বহমানতা। কখনো তিনি আটকে থাকেন গুল্মরশ্মির শেকড়ে, সবুজ মিহি আগাছা হয়ে!

গতির সাথে মিল রেখে কাঁচা সবুজের মিশেল তিনি নির্ধিদ্বায় ক্যানভাসে তুলে দিচ্ছেন। তার ভাবনায় সাহসী অঙ্গীকার আছে গহীন থেকে গহীনে প্রবেশ করার। তার ভাবনায় যেন সবসময়ই লুকিয়ে থাকে এক একটি “Haza Toisa”, এক একটি পাহাড়ি ছড়া।

কয়েকদিন আগেই তিনি জাপান থেকে পারফরমেন্স আর্টের একটা সফর করে আসলেন। পাহাড়ের শিল্পচর্চায় এই গুণী ও সম্ভাবনাময় শিল্পীর আন্তরিক যাত্রার প্রতি শুভ কামনা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার পরিচিত মুখ ভানরাম বম আমার স্কুলবন্ধু। রাঙ্গামাটির মোনঘরে পড়ার সময় আমরা তাঁকে ডাকতাম “আতে”, তাঁর ঘরোয়া নাম। নামটাও যে শিল্পমুখর!

যতদূর জানি, বান্দরবানের রুমায় তাদের পুরো ফ্যামিলিটাই যেন একটা শিল্পের বন্ধন। যাই হোক, কাছের বন্ধু হিসেবে যতটুকু দেখেছি, আতের কাজে পরিপক্কতা আসছে। কবে কবে যেন জলরঙের খোলস ভেঙে ক্যানভাস বড় করার প্রয়াস পেয়েছেন!

বিভিন্ন মাধ্যমে তাঁর নিরীক্ষামূলক কাজগুলোয় বম জাতির উন্ন রুচি, মানবিকতা, অভিজাত সাংস্কৃতিক চৈতন্য, উঁচু সামাজিক মূল্যবোধের মানসপট ফুটে উঠছে যেন। হিল আর্টিস্ট গ্রুপের এবারের প্র্রদর্শনীতে তার “মিসআউট” শিরোনামের কাজটি তাঁকে অনেক উচ্চতর যাত্রায় সামিল হওয়ার আহবান জানাচ্ছে।

বম, খুমী, ম্রোদের ব্যবহার্য পানি রাখার প্রাকৃতিক পাত্রগুলোর মাঝে হয়তো তিনি খুঁজে ফিরে পেতে চান,স্বতন্ত্র অনুভূতির স্বাদ। আতের শিল্পযাত্রা শুভ হোক!

পাহাড়ের আরেক নবীন শিল্পী জুলিয়ান এর কথা না বললেই নয়। ট্রাডিশনাল ক্যানভাসের পাশাপাশি জুলিয়ান কাজ করছে আধুনিক মাধ্যমগুলো নিয়ে। আমার স্কুল, কলেজ এবং বর্তমান ক্যাম্পাসেরও প্রিয়ভাজন অনুজ।

প্রদর্শনীতে তাঁর “MN Larma” শিরোনামের মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার উপর করা কাজটি আমার দেখা তার কাজগুলোর মধ্যে সেরা বলা যায়। কেবল তারই নয়, আমার কাছে পুরো প্রদর্শনীটির অন্যতম সেরা কাজও এটি। নিখুঁত একটা প্রচেষ্টায় চেতনালব্ধ বুনন ফুটে উঠেছে এই কাজে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েল চারুকলায় অধ্যয়নরত এই নবীন শিল্পপথিক একাডেমিক শিক্ষার দক্ষতাকে পরীক্ষামূলক ভাবে প্রয়োগ করছেন এবং অবশ্যই আমাদেরকে আশান্বিত করছেন। “Winter” শিরোনামের গ্রাফিক্স এর কাজটি খুবই ভালো হয়েছে।

সাহসী যাত্রা নিঃসন্দেহে। অনেক পরিণত লাগছে। জীবনবোধে শিল্পের প্রতি সততা রাখতে পারলে অনাগত আগামীতে শিল্পযাত্রায় এগিয়ে থাকবেন, এ বিশ্বাস আমি অবশ্যই করি।

জুলিয়ানের চিত্রপটে বিষয়বস্তুর আয়োজনটা ভালো। রঙের ব্যবহারে বাহারি ঝলক আছে, তবে নিপুন হতে একটু সময় সে নিশ্চয়ই টানবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় ভাস্কর্য বিভাগে অধ্যয়নরত অপর এক নবীন শিল্পী দিব্যআলো চাকমা বেশ প্রতিশ্রুতি নিয়েই শিল্পচর্চা শুরু করেছেন। সাম্প্রতিকসময়ে বিভিন্ন প্রদর্শনীতে তাঁর শিল্পকর্ম প্রদর্শন করছেন।

এবারের প্রদর্শনীতে তিনি জলরঙের চারটি কাজ উপস্থাপন করেছেন। রাঙ্গামাটির বিখ্যাত বনরুপা বাজারের লঞ্চঘাট/জলঘাটতি-র গুরুত্ব রাঙ্গামাটির অর্থনীতিতে ব্যাপক। সেই সমতাঘাটের উপর করা তাঁর “সমতাঘাট” কাজটি রাঙ্গামাটির পাহাড়ি বাজারে পাহাড়ি ফসলের কথায় আমাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাইবে।

জুমে উৎপাদিত ফসল নৌকাযোগে সমতাঘাটে নিয়ে আসে পরিশ্রমী জুম্ম নারী। জুম্মনারীর জীবনযুদ্ধে ঠিকে থাকার সেই নৌকাকে তিনি উপস্থাপণ করেছেন “বোট” শিরোনামের কাজেটির মাধ্যমে।

এছাড়াও ইন্ডিজিনাস পিপল ১ ও ২ শিরোনামের কাজগুলোতেও মিশে আছে আদিবাসী জীবনের স্বাতন্ত্র। নবীন এই শিল্পীর তুলিতেও প্রতিশ্রতির মিশেল আছে বৈকি!

প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া অনেকের তুলিতেই গতি এবং প্রতিশ্রুতির মিশেল আছে, কিন্তু বিষয় নির্বাচনে কেউ কেউ খেই হারিয়ে ফেলছেন। আবার অনেকে বিষয়বস্তু ঠিকমতোন ধরতে পারলেও তার গভীরে যেতে পারছেন না।

অনেকেই আবার দ্বিধান্বিত যেন রঙ মাখার যথার্থতা নিয়ে! ক্যানভাস, ফ্রেম এবং মাধ্যম বিষয়বস্তুর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা তাও খেয়ালে আসা উচিত।

অনেক চমকপ্রদ বিষয়বস্তু ভাবনায় আসছে, কিন্তু যথার্থ তুলি চালিয়ে, উপযুক্ত রঙ মাখানোর কাজ হয়তো করা যাচ্ছে না। সবকিছুর পরেও আমরা মোটাদাগে চিহ্নিত করবো প্রত্যাশিত “সম্ভাবনা”-কেই।

অনেক প্রতিভাবান নবীন শিল্পীদের আগমনী রঙ পাহাড়ের ক্যানভাসে দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের শিল্পযাত্রায় তাঁদের অঙ্গীকার এবং প্রতিশ্রুুতি আমাদের জন্য খুবই স্বস্তিদায়ক।  এসবের দুর্বার আয়োজন চলতে থাকুক…

পাহাড়ের মেঘ, রোদ, হাওয়া, সবুজ, পাথর, ঝিড়ি, ছড়া, আলো-ছায়ার নিখুঁত ছাপ আমরা পাহাড়ের শিল্পীদের ক্যানভাসে উপভোগ করতে চাই। তাঁদের তুলিতে কোমল সৌন্দর্যের অর্ন্তমুখী আহবান থাকুক, নির্মল ব্যাপ্তি ছড়াক প্রত্যাশার রঙ।

পাহাড়ের তেজোদীপ্ত সংগ্রাম, যুগান্তরের চেতনা, বঞ্চিত ইতিহাস এবং প্রতিরোধের বার্তাও উঠে আসুক আমাদের শিল্পীদের তুলিতে। শিল্পের প্রতি নিখাদ দরদ, বিশ্বাস এবং মনযোগ হয়ে উঠুক সময়ের “ক্রাইসিস”-কে উপলব্ধিতে নেওয়ার হাতিয়ার।

তার যথাযথ প্রয়োগ ঘটুক শিল্পীদের মানসপটে, শিল্পভাবনায় এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনাচরণেও। সেই শিল্পবোধের প্রেরণা আমাদেরকে সাহস যোগাক সর্বত্র।

সিনিয়র শিল্পী কনকচাঁপা চাকমা, ধনমনি চাকমা, লাভলী চাকমা, রনেল চাকমাদের অভিজ্ঞতালব্ধ কাজগুলোর সাথে সাথে জয়দেব দা-র কাজগুলোতে আমরা উপভোগ কললাম আলোছায়ার যাদু।

নান্টুর কাজে পাওয়া যাচ্ছে নিবিড় অনুভূতি, ভানরাম-দিব্যআলোরা জানান দেয় স্বাতন্ত্র ও বৈচিত্রের, জুলিয়ান সেখানে সাহস দেখায় নতুন মাধ্যম নিয়ে, নতুন আঙ্গিকে, নতুন ক্যানভাসে কাজ করার। সবাইকে অভিনন্দন! আপনাদের তুলিতে বেঁচে থাকুক চুনীলালের শিল্পযাত্রার স্বপ্ন…

প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন প্রায় ২৭ জন নবীন-প্রবীণ শিল্পী। সীমিত জ্ঞানে সবাইকে আলোচনায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি।

জুলিয়ান বম, উদয়শংকর চাকমা, মিংকু চাকমা,  সাপু ত্রিপুরা, তিতাস চাকমা, নয়ন ত্রিপুরা, খিং সাই মং, নয়ন ত্রিপুরা, জয়তু চাকমা, লুম্বিনী দেওয়ান, এভলি চাকমা, সৌমিক দেওয়ান, নুমংসিং মারমা, তনিমা চাকমা, জেনিমং, মংখ্য সিং, নয়ন আলো চাকমা প্রমুখের কাজ প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে।


লেখক : সুলভ চাকমা 

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা