ত্রিপুরা বর্ষপঞ্জি ‘ত্রিপুরাব্দ’ বা ‘ত্রিং’ : হোক সকল সন্দেহ আর প্রশ্নের অবসান
1450
ত্রিং’ কি?
ত্রিপুরাদের বর্ষপঞ্জিকে ত্রিপুরাব্দ বলা হয়। এই ত্রিপুরাব্দের সংক্ষিপ্ত রূপই ‘ত্রিং’। এটি খ্রীষ্টাব্দ হতে ৫৯০ বছরের কনিষ্ঠ, শকাব্দ হতে ৫১২ বছরের কনিষ্ঠ এবং বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন হতে ৩ বছরের জ্যেষ্ঠ।
অর্থাৎ খ্রীষ্টাব্দ প্রচলন হওয়ার ৫৯০ বছর পর, শকাব্দ প্রচলন হওয়ার ৫১২ বছর পর এবং বঙ্গাব্দ প্রচলন হওয়ার ৩ বছর আগে ত্রিপুরা বর্ষপঞ্জি বা ত্রিপুরাব্দ বা ত্রিং প্রবর্তন করা হয়।
ত্রিং-এর ইতিহাস কী?
৫৯০ খ্রীষ্টাব্দ এবং ৫১২ শকাব্দে ত্রিং বা ত্রিপুরাব্দ বা ত্রিপুরা বর্ষপঞ্জির প্রচলন করা হয়। ত্রিপুরার মহারাজাদের ইতিহাস শ্রী শ্রী রাজমালা অনুসারে ১১৮তম ত্রিপুরা মহারাজা হিমতি অথবা হামতরফা বা যুঝারুফা ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তবর্তী রাজ্য বঙ্গের শাসককে পরাজিত করে কিছু অংশ নিজের নিয়ন্ত্রণে আনেন।
এই বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্যে মহারাজ হামতরফা ত্রিপুরাব্দ প্রবর্তন করেন। ৫১২ বছরের জ্যেষ্ঠ এবং তৎকালীন ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত শকাব্দের অনুসরনে ত্রিপুরাব্দের মাস ও দিন গণনার রীতি গ্রহণ করা হয়।
রাজমালায় এই রাজ্যের নাম বাংলা বলা হলেও ‘বাংলা’ নামটি সেই সময়ে প্রচলন শুরু হয়নি। এমনকি ‘বঙ্গ’ শব্দটিও তেমন প্রচলিত ছিল না।
বরং গৌড় নামের একটি সক্রিয় রাজ্যের অস্তিত্ব আমরা এই সময়ে দেখতে পাই, যেটি বঙ্গ-বিহার এলাকার বিস্তর অঞ্চলকে নিয়ে গঠিত ছিল।
রাজমালায় উল্লেখিত বাংলার শাসকের নাম কোন ইতিহাসগ্রন্থে উল্লেখ না থাকলেও এটি ধারণা করা যায় যে, সেই দেশ বা রাজ্যটি ‘গৌড়’ হতে পারে এবং রাজ্যটি যদি গৌড় হয়, তবে সেই পরাজিত রাজা শশাংক ছাড়া আর কেউই নন।
ইতিহাসে রাজা শশাংকের সম্ভাব্য রাজত্বকাল ৫৯০ থেকে ৬২৫ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত বলে ধারণা করা হয়।
ত্রিপুরা মহারাজাদের আমলে সমসাময়িক বহু অঞ্চলের ভূপতিগণ ত্রিপুরাব্দকেই স্ট্যান্ডার্ড সন হিসেবে ব্যবহার করতেন।
কুমিল্ল, সিলেট, নোয়াখালি, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন অঞ্চলের প্রাচীন দলিল-দস্তাবেজগুলো যাচাই করলে এখনো ত্রিপুরাব্দের তারিখ ও সন পাওয়া যাবে।
কিন্তু ১৯৪৯ সালে স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্য ভারত সরকারের অভ্যন্তরে অন্তর্ভূক্তির পর ত্রিপুরাব্দ ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়।
তবে এখনো ত্রিপুরা রাজ্যের পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহের বিভিন্ন প্রাচীন দলিল-দস্তাবেজে বিশেষ করে সিলেট, বাহ্মনবাড়িয়া, কুমিল্লা, চাঁদপুর, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম ইত্যাদি অঞ্চলে ত্রিপুরা সনের উল্লেখ পাওয়া যায়।
১৯৯০ সালে ত্রিপুরা সরকার ত্রিপুরা রাজ্যের রাজস্ব নথিগুলোতে ত্রিপুরাব্দ ব্যবহারের এক আদেশ জারি করে।
ত্রিপুরার তৎকালীন গভর্নরের পক্ষে ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৯০ তারিখে এই বিজ্ঞপ্তি জারি করেন ত্রিপুরা সরকারের সচিব পি, কে, মাথুর। বিজ্ঞপ্তিটি নিম্নে উপস্থাপন করা হলো-
No. F. 4(10)-RCC/90GOVERNMENT OF TRIPURA
REVENUE DEPARTMENT Dated, Agartala, the 13th/15th Sept, 1990 NOTIFICATION Subject: Introduction of “TRIPURA YEAR” (T.E.) in Revenue Records In Exercise of the powers conferred by Clause (X) of Section 2 of the Tripura Land Revenue and Land Reform Act, 1960, the State Government hereby declare that “Tripura Year” (T.E.) shall be used in all revenue records in the state along with Bengali Year. The order shall come into force with effect the date of issue of this order. By order of the Governor, Sd/- R.K. Mathur, dt 15-9-90 Secretary to the Government of Tripura |
১৯৯১ সালে ১ ডিসেম্বর তারিখে ত্রিপুরা রাজ্যের বিভিন্ন স্তরের ত্রিপুরা বুদ্ধিজীবি, লেখক, কবি ও শিল্পীদের অংশগ্রহণে ত্রিপুরা বর্ষপঞ্জি সম্পর্কে আলোচনা করার জন্যে একটি সেমিনারে মিলিত হন।
এই সেমিনারের আগে ইতোপূর্বে বিভিন্ন পত্রিকা ও সংকলনে প্রকাশিত লেখক-বুদ্ধিজীবিদের লেখা সমাজ গবেষণামূলক প্রবন্ধ সংগ্রহ করা হয় এবং বিভিন্ন সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠনের কাছে বিশেষ করে মাস, সপ্তাহ ও দিনের নাম আহবান করা হয়।
এই সেমিনারে ত্রিপুরা রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের বয়স্ক বহু সমাজপতি, লেখক, বুদ্ধিজীবি, লোক গায়েন, শিক্ষক উপস্থিত হয়ে এসব বিষয়ে তাঁদের মতামত তুলে ধরেন। অনেক বিচার-বিশ্লেষনের পর সেমিনারে সর্বসম্মতিক্রমে নিম্নে উপস্থাপিত সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়-
ককবরক বা ত্রিপুরা ভাষায়-
‘ঋতু’কে ‘মল’ বলে
‘বছর’কে ‘বিসি’ বলে
‘মাস’কে ‘তাল’ বলে
‘সপ্তাহ’কে ‘হাথি’ বলে, যদিও বাংলাদেশে এই উচ্চারণ হয় ‘হাতি’
‘দিন’কে ‘সাল’ বলে
এই সিদ্ধান্ত অনুসারে ককবরকে বারোটি মাসের নাম হলো- ১) তালহিং, ২) তালরুং, ৩) তালসøাং, ৪) তালাং, ৫) তালতুং, ৬) তালক্রান, ৭) তালয়ুং, ৮) তালতুক, ৯) তালবাং, ১০) তালুমায়, ১১) তালওয়াং ও ১২) তালবুং।
দার্শনিক অলিন্দ্র লাল ত্রিপুরা কর্তৃক সংগৃহিত নামগুলোকে কিছুটা পরিমার্জন করে এই মাসগুলোর নাম নির্ধারণ করা হয়।
ককবরকে বারো মাসে চারটি ঋতু বা মলই প্রচলিত, সেগুলো হলো- ১) মাইসিং, ২) তুংব্লাং, ৩) ওয়াতৈ ও ৪) সাচলাং।
ককবরকে সাতটি দিনের নাম হলো দেওয়া হলো- ১) চাসাল, ২) ককতিসাল, ৩) তাংসাল, ৪) ক্রাকসাল, ৫) স্রাংসাল, ৬) সাংগ্রংসাল ও ৭) ফাসাল।
ব্রু সোসিও কালচারাল অর্গানাইজেশন কর্তৃক প্রেরিত নামগুলোর বানানগত পরিমার্জনসহ তিনটি নাম সংযোজন করে এই সাতটি দিনের নাম নির্ধারণ করা হয়।
২০০১ খ্রীষ্টাব্দে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ত্রিপুরা ট্রাইবেল এরিয়া অটোনমাস ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল (টিটিএএডিসি) এটিকে সরকারি দিনপঞ্জিতে অন্তর্ভূক্ত করেন।
মাস ও দিনের নাম গণনার ক্ষেত্রে বাংলা সন থেকে সরে আসা হলো কেন?
বর্তমান বাংলা সনে ব্যবহৃত মাস ও দিনের নামগুলোর উৎস হলো শকাব্দ। এই শকাব্দতেও বৈশাখ, জ্যেষ্ঠ ইত্যাদি মাস হিসেবে এবং শনি, রবি ইত্যাদি দিন হিসেবে গণনা করা হয়।
অন্যদিকে ত্রিপুরা রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে এমনকি বাংলাদেশেরও ত্রিপুরা অধ্যুষিত বিভিন্ন অঞ্চলে আদিকালে নিজস্ব রীতিতে মাস, দিন ও ঋতু চিহ্নিত করার রীতি প্রচলিত ছিল।
সংস্কৃত ও বাংলা সভ্যতার প্রভাবে ত্রিপুরা মহারাজাগণ নিজেদের মাতৃভাষা ককবরককে বাদ দিয়ে ত্রিপুরা রাজ্যের রাজকর্ম পরিচালনার জন্য বাংলাকেই সর্বত্র প্রচলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
যার ফলে প্রাচীনকালে প্রচলিত অনেক সামাজিক-সাংস্কৃতিক উপাদান বিলুপ্ত হয়ে যায়।
ত্রিপুরার রাজা-মহারাজাদের ইতিহাস শ্রী শ্রী রাজমালাকে মহারাজ ধর্মমাণিক্যের আমলে সংস্কৃত ও বাংলায় অনুবাদ করার মধ্য দিয়েই মূলত এই কর্মযজ্ঞের সূচনা হয়। রাজমালায় উল্লেখ করা হয়েছে-
পূর্বে রাজমালা ছিল ত্রিপুর ভাষাতে।
পয়ার গাঁথিল সব সকলে বুঝিতে।।
সুভাষাতে ধর্মরাজে রাজমালা কৈল।
রাজমালা বলিয়া লোকেতে হৈল।।
(শ্রী শ্রী রাজমালা, ২য় খ-, ধর্মমাণিক্য অধ্যায়, পৃষ্ঠা-৬)
মহারাজ ধর্মমাণিক্যের আমলে সূচিত সেই কর্মযজ্ঞের ষোলকলা পূর্ণ হয় মহারাজ বীরচন্দ্রের আমলে। তিনি বাংলাকে সর্বত্র প্রচলন করার জন্যে রাজাদেশ জারি করে বলেন, ‘আমি বঙ্গভাষাকে প্রাণের তুল্য ভালবাসি এবং রাজকার্যে ব্যবহৃত ভাষা যাহাতে দিন দিন উন্নত হয় তৎপক্ষে চেষ্টিত হওয়া একান্ত কর্তব্য মনে করি।’
রাজ্যের সকল প্রশাসনিক কাজে তিনি বাংলা ভাষা ব্যবহার করার জন্য আদেশনামা জারি করেন।
এমনকি বহির্দেশের সাথে যোগাযোগের প্রয়োজনে কেউ যদি অন্য যেকোন ভাষা ব্যবহার করেও থাকে, তহলে উক্ত দলিলের এক কপি বাংলায় অনুবাদ করে রাখার জন্যে নির্দেশ প্রদান করেন (বাংলাভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতায় ত্রিপুরার রাজ পরিবার, মথুরা ত্রিপুরা, দৈনক সুপ্রভাত বাংলাদেশ)।
এইসব বিলুপ্ত মল, তাল ও সালের নামগুলো নানা গবেষণার মধ্য দিয়ে পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করে ব্যবহারোপযোহি করে তোলা হয়।
এই কাজে মূলত ত্রিপুরাদের ভাষা-সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষক ও প্রাচীন প্রথা ও রীতি-নীতি সম্পর্কে অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের জ্ঞানকে ব্যবহার করা হয়েছে। তাই, এখানে বাংলা গণনা পদ্ধতি থেকে সরে আসার প্রশ্নই আসে না।
বরং নিজেদের একটি সাংস্কৃতিক উপাদানকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে তৎকালীন ত্রিপুরা বুদ্ধিজীবি, গবেষক, লেখক, শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মীরা নিজেদের মাতৃভাষা ককবরকে ঋতু, মাস, সপ্তাহ ও দিনের নাম নির্ধারণ করেন এবং বর্ষপঞ্জির সংস্কার সাধন করেন।
কোন বর্ষপঞ্জি কি সংস্কার করা যায়?
পৃথিবীর বিভিন্ন বর্ষপঞ্জি সেই বর্ষপঞ্জির ব্যবহারকারী সমাজ, জাতি বা রাষ্ট্রের প্রয়োজন বা চাহিদা অনুসারে সংস্কার সাধিত হয়েছে। প্রথমে আসি বঙ্গাব্দ বা বাংলা সনের সংস্কারকার্য সম্পর্কে।
এই সনটি ৫৯৩ কিংবা ৫৯৪ সালের দিকে প্রবর্তিত হয়েছে বলে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন। এই সময়ে বাংলা নামের কোন নিদ্দিষ্ট ভূখন্ড এই দুনিয়াতে ছিল না।
বঙ্গ-বিহার ইত্যাদি অঞ্চল নিয়ে গৌড় নামের একটি রাজ্যের অস্তিত্ব এই সময়কালে ছিল, যার অধিপতি ছিলেন শশাংক (৫৯০-৬২৫ খ্রীস্টাব্দ)।
অনেকের মতে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির (যেটি বর্তমানে খ্রীস্টাব্দ নামে পরিচিত, ভুলবশত যে বর্ষপঞ্জিকে অনেকে ইংরেজী সন বা সংক্ষেপে ‘ইং’ বলে উল্লেখ করেন) ২০ মার্চ তারিখে বঙ্গাব্দের সূচনা হয়েছিল।
সম্রাট আবকর বর্তমানের ১৪ এপ্রিল তথা ১ বৈশাখ তারিখে শুরু হওয়া বাংলা বর্ষপঞ্জিটি প্রচলন করেন। তিনি মূলত হিজরী সনকেই অনুসরন করতেন।
মূল হিজরী সন আবার চান্দ্র মাসের উপর নির্ভরশীল। চান্দ্র বছর সৌর বছরের চেয়ে ১১/১২ দিন কম হয়। কারণ, সৌর বছর ৩৬৫ দিন আর চান্দ্র বছর ৩৫৪ দিন ধরে গণনা করা হয়।
এ কারণে চান্দ্র বছরের ঋতুগুলো ঠিক থাকে না (http://bn.wikipedia.org/s/3db)। অথচ বঙ্গদেশের চাষাবাদসহ জীবন-জীবিকা ছিল ঋতুনির্ভর।
তাই সম্রাট আকবর ইরান থেকে আগত বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমীর ফতুল্লা শিরাজীকে দায়িত্ব দিয়ে চান্দ্র বর্ষপঞ্জিকে সৌর বর্ষপঞ্জিতে রূপান্তরের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
মজার ব্যাপার হলো যে ১ বৈশাখ বর্তমানে বাংলা নববর্ষ হিসেবে উদযাপিত হচ্ছে, সম্রাট আকবর তাঁর নিজস্ব প্রেক্ষিত থেকেই তা নির্ধারণ করেছিলেন।
রাজা শশাংকের আমলে বর্ষ গণনা শুরু হতো ২০ মার্চ থেকে, যা শকাব্দের ৩০ ফাল্গুন অথবা ১ চৈত্র হতো।
কিন্তু সম্রাট আকবর হিজরী সনকে সৌর বর্ষে রূপান্তরের বছর ছিল ৯৯২ হিজরী সাল যা খ্রীস্টাব্দের ১৫৮৪ সাল।
কিন্তু এটি প্রচলনের সময় হিসেবে তিনি তাঁর সিংহাসনে আরোহনের বছর ৯৬৩ হিজরী থেকে তা প্রচলিত হিসেবে ধরার আদেশ দেন।
ঐ বছরে আবার তিনি যে মাসে সিংহাসনে আরোহন করেন, তা ছিল মহররম মাস, যেটি বৈশাখ মাসে পড়ে। তাই বৈশাখ মাসের ১ তারিখ থেকেই বর্ষ গণনা শুরু করার সিদ্ধান্ত জারি করেন।
১৯৬৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে বাংলা সনকে সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করে।
বাংলা সন অন্যান্য সৌরবর্ষগুলোর মতো বছরে ৩৬৫ দিন হিসেবে গণনা করা হয়। কিন্তু এই বর্ষপঞ্জিতে পৃথিবীর সূর্যকে প্রদক্ষিণের মোট সময় ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট এবং ৪৭ স্যাকেন্ড-এর ব্যবধানকে যথাযথভাবে বিবেচনা করা হয়নি।
গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জিতে এই ব্যবধান ঘোচানোর জন্যে প্রতি চার বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি অতিরিক্ত দিন যোগ করা হয়।
সূর্যের একেকটি রাশি অতিক্রম করতে মাসভেদে ২৯, ৩০, ৩১ বা ৩২ দিন লেগে যায়। তাই বাংলা সন মাসভেদে বিভিন্ন পরিসরের হয়ে থাকে।
এ সমস্যাগুলো দূরীকরণের জন্যে ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মাস গণনার ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত সুনির্দ্দিষ্ট প্রস্তাবগুলো পেশ করেন-
বছরের প্রথম পাঁচ মাস অর্থাৎ বৈশাখ থেকে ভাদ্র পর্যন্ত হবে প্রতিটি ৩১ দিনের
বাকি মাসগুলো অর্থাৎ আশ্বিন থেকে চৈত্র পর্যন্ত হবে প্রতিটি ৩০ দিনের
প্রতি চতুর্থ বছরের ফাল্গুন মাসে অতিরিক্ত একটি দিন যোগ করে ৩১ দিন গণনা করতে হবে।
এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলার ফাল্গুন মাস গ্রেগরীয় সনের ফেব্রুয়ারি মাসে পড়ে।
এবার আসুন, শকাব্দের বিষয়ে যেটি ত্রিপুরাব্দ ও বঙ্গাব্দ উভয় বর্ষপঞ্জির জ্যেষ্ঠ এবং পথ প্রদর্শক। এটি ভারত ভূখন্ডের সবচেয়ে প্রাচীন বর্ষপঞ্জি।
খ্রীস্টাব্দের ৭৮ বছর পর এই বর্ষপঞ্জির প্রচলন শুরু হয়। অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে রাজা শালীবাহনের রাজত্বকালে একবার বাহিরাগত শক জাতি তাঁর রাজ্য আক্রমণ করে।
শালীবাহন শকদের পরাজিত করে ‘শকারি’ উপাধি গ্রহণ করেন এবং এই বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্যে তিনি তাঁর বর্ষপঞ্জির নাম রাখেন শকাব্দ (http://bn.wikipedia.org/s/2lwf)।
১৯৫০ খ্রীস্টাব্দে স্বাধীন ভারত প্রতিষ্ঠা লাভ করার পর একটি জাতীয় বর্ষপঞ্জির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ১৯৫২ সালের নভেম্বর মাসে Council of Scientific and Industrial Research-এর অধীনে Calendar Reform Committee গঠন করা হয় (Committee & Commissions in India 1947-54, Vol I, Virendra Kumar)।
এই কমিটির প্রধান ছিলেন অধ্যাপক মেঘনাথ সাহা (এম, এন, সাহা), সদস্য ছিলেন যথাক্রমে- অধ্যাপক এ, সি, ব্যানার্জি, ড. কে, এল, ডাফিয়ারি, শ্রী জে, এস, করনাধিকার, ড. গোরখ প্রসাদ, অধ্যাপক আর, ভি, বৈদ্য এবং সচিব ছিলেন শ্রী এন, সি, লাহিড়ী।
এই কমিটি শকাব্দকে ঋতুনিষ্ঠ ও সর্বস্তরে ব্যবহারোপযোগী করে তোলার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির সাথে সমন্বয় রেখে সংস্কার সাধন করে।
১৯৫৭ সালে এই কমিটির প্রস্তাবিত দিন গণনা রীতির প্রচলন করা হয়। আগে ভারতের কোন কোন অঞ্চলে অগ্রহায়ণ মাসকে মার্গশীর্ষও বলা হতো।
এই সংস্কারের ফলে মাসগুলোর নাম চৈত্র, বৈশাখ, জৈষ্ঠ্য, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ ও ফাল্গুন হিসেবে গণনার জন্য চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ করা হয়।
এই সংস্কার প্রস্তাব অনুসারে শকাব্দের বর্ষ গণনা শুরু হয় ১ চৈত্র থেকে, যা খ্রীস্টাব্দের ২২ মার্চ এবং অধিবর্ষকালে ২১ মার্চ, বৈশাখ মাস শুরু হয় ২১ এপ্রিল, জৈষ্ঠ্য মাস শুরু হয় ২২ মে, আষাঢ় মাস শুরু হয় ২২ জুন, শ্রাবণ মাস শুরু হয় ২৩ জুলাই, ভাদ্র মাস শুরু হয় ২৩ আগস্ট, আশ্বিন মাস শুরু হয় ২৩ সেপ্টেম্বর, কার্তিক মাস শুরু হয় ২৩ অক্টোবর, অগ্রহায়ণ মাস শুরু হয় ২২ নভেম্বর, পৌষ মাস শুরু হয় ২২ ডিসেম্বর, মাঘ মাস শুরু হয় ২১ জানুয়ারি এবং ফাল্গুন মাস শুরু হয় ২০ ফেব্রুয়ারি তারিখে।
অনুরূপভাবে গ্রেগরিয় সনও সংস্কারকার্য সম্পাদনের পরেই ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়েছে। এই গ্রেগরিয় সনটি খ্রীস্টাব্দ হিসেবেই অধিক পরিচিত, যা বাংলাদেশে ভুলবশত ইংরজী সন বা সংক্ষেপে ইং হিসেবে অধিক ব্যবহৃত।
আসলে ইংরেজী অব্দ বলে কোন অব্দ নেই। এই গ্রেগরিয় বর্ষপঞ্জির আদি উৎস রোমান ক্যালেন্ডার। এটি ছিল প্রথমে চান্দ্র বর্ষীয়, যার ভিত্তিতে ১০ মাসে বছর গণনা করা হতো এবং ১ মার্চ বর্ষ শুরুর দিন বা নববর্ষ হিসেবে উদযাপন করা হতো।
৭০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দে রোমান রাজা নুমা পম্পিলিয়াস এই বর্ষপঞ্জিতে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাস সংযোজন করেন এবং এর পর থেকে মার্চের পরিবর্তে জানুয়ারিকে বছরের প্রথম মাস আর ১ জানুয়ারি তারিখকে নববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হয় (http://bigganjatra.org/history-of-new-year/)।
১৫৩ খ্রীস্টপূর্বাব্দে রোমে ১ জানুয়ারি নববর্ষ উদযাপন শুরু হয়। তবে এ সময়ে এটি অনিয়মিতভাবেই পালন করা হতো। কারণ বিভিন্ন অঞ্চলে মার্চের ১ তারিখই নববর্ষ হিসেবে পালন করা হতো।
৪৬ খ্রীস্টপূর্বাব্দে রোম সম্রাট জুলিয়াস সিজার বর্ষপঞ্জিটি সংস্কার করে সৌর বর্ষে রূপান্তরের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এবং জুলিয়ান ক্যালেন্ডার প্রচলন করেন, যার পর থেকে ১ জানুয়ারি তারিখকে নববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
ইউরোপের চার্চগুলো জানুয়ারি ১ তারিখে নববর্ষ উদযাপানের বিরুদ্ধে সমালোচনার রব তোলে। তাদের মতে এটি অখ্রিস্টান কৃষ্টি।
তাই জানুয়ারি মাসে না করে যীশুখ্রীস্টের জন্মদিন ২৫ ডিসেম্বরে অথবা পহেলা মার্চ কিংবা কোন কোন ক্ষেত্রে ইস্টার সানডে দিনকেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নববর্ষ হিসেবে উদযাপন করা হতো।
এরপর ১ জানুয়ারি দিনটি আর বেশি দূর অগ্রসর হয়নি।
জুলিয়ান বর্ষপঞ্জির গণনা অনুসারে একটি মহাবিষুব থেকে আরেকটি মহাবিষুব পর্যন্ত সময়কাল ধরা হয়েছিল ৩৬৫.২৫ দিন, যা প্রকৃত সময়কাল থেকে প্রায় ১১ মিনিট কম।
এই ১১ মিনিটের পার্থক্যের ফলে প্রতি ৪০০ বছর অন্তর মূল ঋতু থেকে জুলিয়ান বর্ষপঞ্জির প্রায় তিন দিনের ব্যবধান ঘটতো।
পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরির সময়ে এই ব্যবধান ১০ দিনে উত্তীর্ন হয়েছিল এবং ২১ মার্চের স্থানে ১১ মার্চ এসে পড়েছিল।
এই পরিবর্তনের ফলে ইস্টারের দিন নির্ণয় বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল, যেহেতু ইস্টার নির্ণয়ের জন্যে মহাবিষুব অনুসরন করা হতো।
১৫৮২ সালে পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি জুলিয়ান বর্ষপঞ্জি এবং গীর্জায় ব্যবহৃত চান্দ্র পঞ্জিকা সংস্কারের ব্যবস্থা করেন।
এই সংস্কার গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার নামে পরিচিতি লাভ করে এবং ১ জানুয়ারি খ্রীস্টাব্দের প্রথম মাসের প্রথম দিন বা নববর্ষ হিসেবে নির্ধারিত হয়ে যায়। গ্রেগরির এই সংস্কারের ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খ্রীস্টাব্দ বিস্তৃতি লাভ করে।
বৈসু শব্দটি আসলো কিভাবে?
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সৌরমাস নির্ধারণ করতেন সূর্যের গতিপথের উপর নির্ভর করে। সূর্যের বিভিন্ন অবস্থান নির্ণয় করা হয় আকাশের অন্যান্য নক্ষত্রের বিচারে।
সে সময় সূর্যের বার্ষিক অবস্থান অনুসারে আকাশকে ১২টি ভাগে বিভক্ত করা হয়, যা রাশি নামে পরিচিত। সূর্য যখন এক রাশি থেকে আরেক রাশিতে যায়, তখন তাকে সংক্রান্তি বলে।
এই সংক্রান্তি প্রক্রিয়া মহাবিষুব রেখা অতিক্রম করে সম্পন্ন হয় বলে বিষুব সংক্রান্তি বলা হয়। মূলত প্রাচীন মুণি ঋষিদের জ্যোতির্বিজ্ঞান অনুসারে সূর্য এক রাশি হতে অন্য রাশিতে প্রবেশের সময় বিষুব রেখা অতিক্রম করে।
তাই ১২ মাসে ১২টি সংক্রান্তি ঘটে। সেই ক্ষেত্রে শকাব্দের বর্ষ গণনা অনুসারে পৌষ মাসে পৌষ সংক্রান্তি হয়ে ১ চৈত্র তারিখে তাদের নববর্ষ উদযাপিত হয় আর আধুনিক বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে চৈত্র মাসে চৈত্র সংক্রান্তি হয়ে ১ বৈশাখ নববর্ষ উদযাপিত হয়।
এখনো বাংলাদেশের সনাতন ধর্মের অনুসারিরা পৌষ সংক্রান্তিতে বিশেষ তিথি উদযাপন করেন। এই বিষুব সংক্রান্তির বিষুব থেকেই কালক্রমে নানা দেশে নানা জাতি তাদের নিজ নিজ ভাষার সাথে সামঞ্জস্য রেখে উৎসবের নামকরণ করে।
আসামের অসমিয়ারা এটিকে বিহু বলে, বোডো জাতির লোকজন বলে বিসাগু, ত্রিপুরা এবং চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যারা কেউ বিষু, কেউ বিজু আর কেউ কেউ বৈসু বা বৈসুক বলে।
ত্রিপুরাদের মধ্যেও অনেক দফা এই দিনটিকে বৈসু, বৈসুক, বিসু বা বৈস বলে। অন্যদিকে চাক, মারমা, বার্মীজ, থাইদের নিকট দিনটি সাংগ্রাই, সাক্রান, চাক্রান, সাংক্রান ইত্যাদি নামে পরিচিত, যেটা হয়তো ‘সংক্রান্তি’ শব্দ থেকে উদ্ভূত হয়ে থাকতে পারে।
আমরা কি তাহলে কেবল ত্রিং উদযাপন করবো, বৈসু উদযাপন করবো না?
বৈসু ত্রিপুরাদের একটি ঐতিহ্যবাহী সামাজিক উৎসব। স্মরনাতীত কাল থেকেই উৎসবটি উদযাপিত হয়ে আসছে।
কিন্তু উৎসবটি অন্যান্য জাতি ও সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত কি না তা এখনো কেউ গবেষণা করে বের করেননি। একটি বিষয় এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ত্রিপুরারা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য ছাড়াও বিভিন্ন রাজ্যে বসবাস করছে।
পাশাপাশি বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় এবং মায়ানমারের কিছু অঞ্চলে তাদের বসবাস রয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের মধ্যে মধ্য এবং দক্ষিণ অঞ্চলের ত্রিপুরারা বৈসু বা বৈসুক বা বৈস আড়ম্বরতার সাথে উদযাপন করলেও একই ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষ বান্দরবান জেলার ত্রিপুরারা এটি কোনকালেই সামাজিকভাবে উদযাপন করতো না।
সাম্প্রতিক কালেই কিছুটা আনুষ্ঠানিকভাবে এই উৎসবটি তারা উদযাপন করতে শুরু করেছে। অথচ গরিয়া নৃত্যের সংস্কৃতি এখনো তাদের মাঝে প্রচলন রয়েছে।
গরিয়া নৃত্যের সাথে বৈসুকে একাকার করে আলোচনা করা হলেও গরিয়া পূজা যে তার স্বতন্ত্র রীতিতেই প্রচলিত ছিল, তা আমরা সহজে অনুমান করতে পারি।
তাই বৈসু উদযাপন করার সাথে ত্রিপুরাব্দ উদযাপন করার মধ্যে আমি কোন দ্বন্দ্ব রয়েছে বলে মনে করি না। ত্রিং বা ত্রিপুরাব্দ একটি প্রাচীন বর্ষপঞ্জি।
এই বর্ষপঞ্জি সময়ের প্রয়োজনে সংস্কার করা হয়েছে এবং ত্রিপুরাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে তার দিন, মাস ও ঋতুগুলোর নাম পরিবর্তন করা হয়েছে।
ত্রিপুরাব্দের ঋতু, মাস ও দিনগুলোর নাম কিভাবে ককবরকে করা হয়েছে একটু ভেবে দেখলে সহজেই বোঝা যায়। যেমন- বছরের যে মাসে দিনগুলো সবচেয়ে বেশি বড়ো থাকে, সেই মাসকে বলা হয়েছে ‘তালয়ুং’।
এ ক্ষেত্রে ককবরকের কিছু নমুনা দেখুন- দক্ষ ও বৃদ্ধ অচাইদেরকে আমরা ‘অচাইয়ুং’ বলি। বনের পাখিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়ো পাখিকে আমরা বলি ‘তকয়ুং’ বা ‘তায়ুং’।
ঠিক সেভাবে যে মাসে ওয়াং পাখি ডাকে, সে মাসের নাম রাখা হয়েছে ‘তালওয়াং’, যে মাসে ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করে, সে মাসকে বলা হয়েছে ‘তালহিং’ ইত্যাদি।
ত্রিপুরাব্দের মাসগুলোর নাম হলো- তালহিং (৩০ দিন), তালরুং (৩০ দিন), তালস্রাং (৩০ দিন), তাললাং (৩০ দিন কিন্তু প্রতি চার বছর অন্তর ৩১ দিন), তালতুং (৩১ দিন), তালক্রান (৩১ দিন), তালয়ুং (৩১ দিন), তালতুক (৩১ দিন), তালবাং (৩১ দিন), তালুমায় (৩০ দিন), তালওয়াং (৩০ দিন) এবং তালবুং (৩০ দিন)।
অনুরূপভাবে দিনগুলোর নামও রাখা হয়েছে প্রকৃতি, পরিবেশ ও আমাদের সামাজিক বিশ্বাসের সাথে সামঞ্জস্য রেখে। যেমন- সাংগ্রংমা নামের ত্রিপুরাদের একজন গৃহদেবীর নামে রাখা হয়েছে সাংগ্রংসাল, যা বাংলা বা শকাব্দ গণনায় পড়ে বৃহস্পতিবার। সৃষ্টির অমোঘ রীতি অনুসারে সৃষ্টির পূর্ণতা লাভের জন্য মাতার সাথে পিতার অস্তিত্ব অনস্বীকার্য।
তাই শুক্রবারের নাম দেওয়া হয়েছে ফাসাল। এভাবে সবগুলোই কোন না কোন যুক্তি বিচার করে তা নির্ধারণ করা হয়েছে। যেমন- চাসাল (শনিবার), ককতিসাল (রবিবার), তাংসাল (সোমবার), ক্রাকসাল (মঙ্গলবার), স্রাংসাল (বুধবার) ইত্যাদি।
ত্রিং কেন ২২ ডিসেম্বরে শুরু হলো এবং ২১ ডিসেম্বর গভীর রাতে কেন তা উদযাপন করা হয়?
ত্রিং বা ত্রিপুরাব্দ আসলে ২২ ডিসেম্বর নয়। এটি ১ তালহিং তারিখে পালিত হয়। বিশ্বের অন্যান্য সৌরবর্ষ গণনা অনুসারে যেদিন রাত ১২টার মধ্যে সংক্রান্তি হয় বা অন্য একটি দিনে প্রবেশ করে তারপর থেকেই অন্যদিন বা নতুন দিনের সূচনা হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।
তাই তালবুং-এর শেষ দিন তথা ৩০ তারিখের রাত বারোটার পর ০ ঘন্টা থেকে নতুন দিনের সূচনা শুরু হয়। তাই ৩০ তালবুং-এর গভীর রাতে দিবসটি উদযাপনের মাধ্যমে ১২ টা ১ মিনিট হওয়ার সাথে সাথে ১ তালহিং-কে স্বাগত জানানোর জন্যে এই দিবসটি উদযাপন করা হয়।
নির্দ্দিষ্ট এই দিনেই না হলেও এই সময়কালে মোটামুটি জুমের সব ফসল তোলা সম্পন্ন হয় এবং ত্রিপুরা জুমিয়ারা নতুন জুমের সন্ধান করতে শুরু করে।
তাই, এই দিনটিকে ত্রিপুরাব্দের নতুন বছরের দিন হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। ত্রিপুরাদের নানা লোকগীতিতেও শকাব্দের পৌষ মাসের প্রথমদিকে তারিখে দুকমালি নামের একটি ফুল ফোটার কাহিনি রয়েছে, যেটি নববর্ষের ফুল হিসেবে ত্রিপুরা লোক সমাজে অধিক পরিচিত।
আমার মতে আমরা ত্রিপুরাব্দও উদযাপন করবো এবং উপমহাদেশের সার্বজনীন উৎসব হিসেবে বৈসুও উদযাপন করবো।
কোন সংকীর্ন রাজনৈতিক বা ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে বিচার না করে আমাদের জাতীয় পরিচয় ও আত্মমর্যাদার স্বার্থে দিবসটি সার্বজনীনভাবে উদযাপিত হোক এই কামনা করি।
শেষ কথা
সংস্কৃতি সর্বদা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। সমকালিন পারিপার্শ্বিকতা, পরিবেশ ও প্রতিবেশের সাথে অভিযোজনের মধ্য দিয়ে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য অক্ষুন্ন রেখে যদি কোন সংস্কৃতি অগ্রসর হতে না পারে, তাহলে সেই সংস্কৃতি অন্য সংস্কৃতি দ্বারা কলুষিত হওয়া স্বাভাবিক।
তাই, ত্রিপুরা জাতির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য অক্ষুন্ন রেখে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও প্রতিবেশের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্যে নিজেদের যোগ্য করে তোলার স্বার্থে প্রগতির পথেই অগ্রসর হতে হবে আমাদেরকে।
পুরনো বা প্রাচীন বলে সবকিছুকেই আঁকড়ে ধরে রাখার মধ্যে কোন গৌরব নেই, বরং পুরনো অচল সংস্কারগুলো ঝেড়ে ফেলে চলমান বিশ্বের জন্য উপযোগি করে তোলার মাধ্যমেই সংস্কৃতির পূর্ণতা দান করতে হবে।
যে কোন সংস্কারকাজ প্রথম দিকে সাধারণ্যে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। নিয়ত চর্চার মধ্য দিয়ে, সেসব সংস্কারের সপ্রমান উপকারিতা প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে সংশ্লিষ্ট সংস্কৃতির ধারক-বাহক জনগোষ্ঠির আস্থা অর্জন করতে পারলেই সমাজ সংস্কারের পথ প্রশস্ত হয়।
তথ্যঋণ:
১। http://bigganjatra.org/history-of-new-year/
২। Virendra Kumar, Committee & Commissions in India 1947-54, Vol
৩। http://bn.wikipedia.org/s/3db
৪। http://bn.wikipedia.org/s/2lwf
৫। মথুরা ত্রিপুরা, বাংলাভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতায় ত্রিপুরার রাজ পরিবার, দৈনক সুপ্রভাত বাংলাদেশ
৬। কৈলাস চন্দ্র সিংহ, শ্রী শ্রী রাজমালা
৭। ঐতিহাসিক তথ্যের আলোকে Twipra Bisi এবং Borok জাতি, ককবরক তাই হুকুমু মিশন, ত্রিপুরা, ভারত, ১৯৯৯।
লেখকঃ মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা
ত্রিপুরাব্দ নিয়ে আরও লেখা – ত্রিপুরাব্দ নিয়ে কিছু কথা
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।