চাকমা রূপকথা – অমগদ চাকমা

Jumjournal
Last updated Sep 1st, 2021

2119

featured image

অনেক-অনেকদিন আগে আমাদের এই পৃথিবীটা ছিল একদম জঙ্গলে ভরা। মানুষ-জন খুব কম, চাকমা তো আরো কম। চারধারে খালি গিস্‌গিস্‌ করছে বুনো জন্তু জানোয়ার। সব সময় তাদের ভয়, আর ছিল যখন তখন ভূত-প্রতের দৌরাত্ম্য। এখনকার মত ভূতেরা তখন অত অদেখা হয়ে থাকত না, হর হামেশা তাদের দেখা যেত। সন্ধে হতে না হতে ভূতেরা বেরিয়ে পড়ত দলে দলে। আকাশ একটুখানি মেঘলা হলে তখনও নির্ঘাৎ  দু’চারটা ভূত দেখা যেত দিন দুপুরে। তখনকার দিনে সন্ধ্যার পর কোন চাকমা আর ঘর হতে বার হতো না। রাতের বেলা কেউ কাউকে ডাকলে কিংবা কারো ডাকে সাড়া দিলেই মুশকিল! তখন ঠিক ঐ মানুষ্টার রূপ ধরে নির্ঘাৎ একটা ভূত ঘরে এসে উঠবে। কাউকে যদি নেহাৎ রাতের বেলা বার হতেই হয় তখন ইয়া লম্বা একটা মশাল জ্বেলে নেয়। আগুনকে নাকি ভূতেরা ভয় পায়, আর ভয় করে মেইয়্যা শাক। মেইয়্যা শাক যারা খায় তাদেরও ভূত কিছু করতে পারে না বলে চাকমাদের বিশ্বাস। ভূত যাতে ধারে কাছে ঘেষতে না পারে তাই চাকমারা তখনকার দিনে মেলাই মেইয়্যা শাক বুনে দিত ঘরের আশে পাশে। কাউকে ভূতে তাড়া করলে একবার যদি মেইয়্যা শাকের বনে ঢোকা যায়, তখন আর ভূতের বাপের সাধ্য নেই তাকে ধরে। মেইয়্যা শাক অনেকটা মুলো শাকের মত। খাওয়া যায়, তবে মুলো হয় না।

ছবি ১ঃ অমগদ চাকমা

ভূতেরা কিন্তু তক্কে তক্কে থাকে। কে কোথায় একলা রয়েছে, কোথায় আঁধার একটু ঘন, আর একটুখানি সুযোগ পেলেই কাউকে দিল বিষম ভয় খাইয়ে, যাতে সে বেচারার দাতকপাট্টি লাগে। যে ভয় পায়না তাঁকে কিন্তু আবার উলটো ভূতেদের বিষম ভয়। জেদী একরোখা আর বদমেজাজী লোকদের ধারে কাছে আসতে সাহস পায়না ভূতেরা। চাকমা কথায় এদের বলে ‘অমগদ’।

একবার এমনি এক ‘অমগদ’ চাকমা গেছে কাট্টনে (১) তার বউকে একলা রেখে। একদিন যেতে- ছ’দিন যেতে-তেরাত্তিরে একভূত এসে হাজির খবর পেয়ে! বৌ টা যেদিকে শোয় সেদিকের বেড়া ফুঁড়ে কালো লোমশ হাতখানা ঢুকিয়ে দিয়ে বলল সে, -” এই নে, এট্টুখানি দে দিকিনি চুলকে!”

বৌটা ত প্রথমে বেড়ার ফুটো দিয়ে তাকে দেখেই বেহুঁশ একবারে!

“বদা পারাহ্‌ পারাহ্‌ চোখ!

মূলো পারাহ্‌ পারাহ্‌ দাত!!

কুলো পারাহ্‌ পারাহ্‌ কান!!!

তাক্কুআ পারাহ্‌ পারাহ্‌ কেচ!!”

অর্থাৎ, ভূতটার ডিমের মত ইয়া বড় ড্যাবড্যাবে চোখ, মুলোর মত দাঁত, কুলোর মত বড় বড় কান আর টাকুর মত একখানা লোম!

এতে কার না ভিরমি হবে? বৌটার মুর্ছা ভাঙে আর ভূতটাকে দেখে আবার মুর্ছা যায়! মুর্ছা ভাঙে, ভূতটাকে দেখে আবার মুর্ছা যায়! এভাবে কয়েকবার মূর্ছা যেতে যেতে ভূত দেখা তার কাছে গা সহা হয়ে গেল এক সময়। শেষে আর ভিরমি খায়না। ভূতটা কিন্তু ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সেই তখন থেকে, হাতাখানা বেড়ার ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে। এতক্ষণে বৌটাকে ফ্যাল্‌ ফ্যাল্‌ করে তাকাতে দেখে বল্‌ল সে, – ” নে আর ভয় পাস্‌নে, কিচ্ছু করবো না তোকে। এট্টুখানি চুলকে দে হাতখানা, ভারি চুলকোচ্ছে।”

বৌ বেচারী কী আর করে? ভুতের হাতখানা নিয়ে তখন আস্তে আস্তে চুলকোতে থাকে সে। তখন কোথায় ঘুম আর কোথায় কী? ভুতটার এ হাতের চুলকানি সারে ত ও-হাত বাড়িয়ে দেয়, সে হাতের চুলকানি সারেত ফের এ-হাত বাড়িয়ে দেয়। তখন এই করে করেই ভোর। আর গাছে গাছে পাখ্‌ পাখালীর সাড়া জাগতে দিনের আলোর ফোটার সাথে সাথে ভূতটা তখন হাওয়া হয়ে গেল একেবারে।

এরপর থেকে ভূতটা এসে হাজির হয় রোজ রাত্তিরে। দূর থেকে জিজ্ঞেস করে আগে বৌটাকে, ” এই তোর জামাই ফিরেছে?”
বৌটা ‘না’ – বল্‌তেই ভূতটা হাতখানা বাড়িয়ে দেয় বেড়ার ফুটো দিয়ে আর বলে,- “নে, তবে এট্টুখানি চুলকে দে।”

এই করে রোজ ভোর হয়ে আর ভূতটা যখন মিলিয়ে যায় হাওয়া হয়ে তখন বৌটার চুলকানো থামে। এমনি করে বৌটা দু’চোখের পাতা এক করতে পারে না রোজ রাত্তিরে। কয়েক দিন যেতে সে ঘুমে আর ভয়ে ভাবনায় কাহিল হয়ে গেল একেবার শেষে তার স্বামী যখন ফিরে এল কাট্টন থেকে তখন সে একদম হাড় জিরজিরে হয়ে গেছে। সব দেখে শুনে তার স্বামী ত গেলে বেজায় ক্ষেপে! দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা ভূত ব্যাটাকে! বৌকে বল্‌ল সে,- “দ্যাখ্‌ সে ব্যাটা যদি আজ যদি আসে বল্‌বি, আমি ঘরে নেই। তারপর ভূত বানিয়ে ছাড়ছি তাকে।”

বৌটার স্বামী তখন শান্‌ দিতে বস্‌ল তার তাগল্‌ (দা) খানায়, ‘কেজেরেখ্‌, কেজেরেখ্‌! কেজেরেখ্‌, কেজেরেখ্‌!! শান্‌ দিতে দিতে সেটা যখন সাদা ঝক্‌ঝকে হয়ে ‘ছিম্‌ছিমে’ ধার উঠ্‌ল তখন রেখে দিল শোবার ঘরে। দিনমানে সে নিজেও আর বের হলো না ঘরে থেকে পাছে ভূতটা তাকে দেখে ফেলে। রাত্তিরে খেয়ে দেয়ে তার বৌ ঘরে শুতে গেল আর সে রইল ঘাপ্‌টি মেরে বেড়ার ধারে হাতে ‘তাগল’ নিয়ে। একটু বাদে ভূতটার সাড়া মিলল বাইরে,- “এই তোর জামাই ফিরেছে?”

বৌটা ‘না’- বলতেই ভূতটা রোজকার মত নির্ভয়ে হাত-খানা বাড়িয়ে দিল বেড়ার ফুটো দিয়ে। আর যায় কোথায়! “এট্টুখানি চুলকে দে’ – বলারও ফুরসুৎ পেলনা সে; বৌটার স্বামী একটি কোপে ভূতের হাতখানা কেটে রেখে দিল দু’ভাগ করে।

“হাঁউ, মাউ”- করে ভূতের তখন সে কী চেল্লানি! যন্ত্রণায় চ্যাঁচ্যাঁয় আর ওদের শাসায়,- “পাতা আন্‌তে জঙ্গলে যেঁয়ে দেখিস, লাক্‌ড়ি আনতে যেঁয়ে দেখিস! কাঁকড়া খুঁজতে যাবিনি তোরা কোনদিন? তখন দেখবি মজা, ভূতের সঙ্গে চালাকী!

ভূতটা যত না শাসায় বৌটার স্বামী তত রাগে ফুস্‌তে থাকে। অমগদ চাকমা আর কাকে বলে? শুধু আঁধার রাত বলেই রক্ষে। হাজার হোক, রাতের আঁধারে ভূতের দাপট বেশী। আর আঁধারে ভূত দেখাই যায় না, লড়বে কার সঙ্গে?

এখন একটা কথা হল কী? ভূতেরা মেলা ‘তাগল’ ভয় করে। যখন কারো হাতে ‘তাগল’ থাকে তখন সে একাই একশো ভূতের কাছে। ভূত আর তার কাছে ঘেঁষেনা ভয়ে। কিন্তু খবরদার! হাতের ‘তাগল’ এ একটুখানি আগুন ঠেকিয়েছ কী মরেছ! তখন আর কিচ্ছু ভয় পাবে না ভূতেরা। আগুন ছোঁয়ালে ‘তাগল’ নাকি মরে যায় আর তা’ দিয়ে সারাদিন কোপালেও ভূতের কিচ্ছু হবেনা তাতে।

অনেক্ষণ দাপাদাপি হম্বি তম্বি করে ভূতটা ত একসময় গেল ফিরে, পরদিন না ভোর হতে; সকাল সকাল খেয়ে দেয়ে বৌটার স্বামী জঙ্গলে বার হল হাতে ‘তাগল’ নিয়ে, ঠিক ভূতটা যেখানে যেখানে যেতে শাসিয়েছে ঠিক সেখানে সেখানে। তখন মেলা লোকও গেছে জঙ্গলে কাজ করতে। কেউ পেত্যাপাতা, বুনো কলাপাতা তুলছে, কেউ বা কাঠ কুড়োচ্ছে এখানে সেখানে জট্‌লা বেঁধে। তাদের সবাই কী আর মানুষ? অনেক ভূতও মিশে আছে তাদের সাথে মানুষের রূপ নিয়ে। ওরা শুধু পাতা তোলার, কাঠ কুড়ানোর ভান করে আর তক্কে তক্কে থাকে। একলা একলা কাউকে পেলে অমনি তার ঘাড় মট্‌কে দেবে।

ছবি ২ঃ অমগদ চাকমা

“উঁ-হু” – ভূতটার কিন্তু দেখা নেই ধারে কাছে। না পাতা তোলাদের দলে, না কাঠ কুড়োনোদের মাঝে। মানুষ হোক আর ভূতই হোক, এদের সবার দুটো করে হাত রয়েছে। তখন সে তাদের ছাড়িয়ে আরো এগিয়ে গেল ছড়ার উজানে, যেখানে আরো অনেক লোক কাঁকড়া ধরছে। যেতে যেতে যেতে ছড়ার প্রায় সেই শেষ প্রান্তে যেখানে দু’ধারের বাঁশবন এপাশে ওপাশে হেলে পড়ে দিনের বেলাও একটুখানি আঁধার মত হয়ে আছে, দেখা গেল, একটা লোক-চুলগুলো ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া, একলা একলি সেখানে কাঁকড়া ধরছে। কাঁকড়ার গর্তে একখানা হাত ঢুকিয়ে ছোট্ট ছড়ার প্রায় সবটা জুড়ে বসে আছে সে। বৌটার স্বামী কাছে গিয়ে ধমকাল তাকে,- “এই, কী করচ্ছিস এখানে?”

লোকটা চোখ তুলে তাকাল তার দিকে। দুটো চোখই মরার মত সাদা ফ্যাকাসে। মিন্‌মিনে গলায় বল্‌ল তাকে,- “দেখছিস্‌ না কাঁকড়া ধরছি?”

“তবে ও-হাতখানা বার কর্‌ দিহি গর্তের ভেতর থেকে”

“উঁ-হু”- লোকটা মাথা ঝাঁকাল আর বিড় বিড় করে বল্‌ল-“কাঁকড়াটা কামড়ে দিয়েছে, অনেকক্ষণ হাতটা বার করতে পারছি না কিছুতেই।”

ছবি ৩ঃ অমগদ চাকমা

এতক্ষণে বৌটার স্বামী ভুতের চালাকী ধরতে পেরেছে। ঝট্‌ করে তার চুলের ঝুঁটি ধরে এক ঝটকায় তুল্‌ল তাকে। আর কোথায় হাত! কনুইয়ের উপরে কাটা হাতের বাকী অংশটা খালি সেখানে ঝুলছে লট্‌ পট্‌ করে। তখন আর দেরী কীসে? ‘তাহলের’ একটি কোপে ভূতের মুন্ডুটা আলাদা হয়ে এল ধড় থেকে। তখন সেই ‘অমগদ’ চাকমার রাগ থামে। তখন সেই ‘অমগদ’ চাকমার রাগ থামে।

লোকটা গাঁয়ে ফিরে যখন সব কথা বল্‌ল সবাইকে, তার পরের দিন সবাই মজা করে দেখতএ গেল ভুতের লাশটাকে। কিন্তু কোথায় লাশ? তার জায়গায় পড়ে আছে শুধু একটা মরা দাঁড় কাক! তবে কিনা গলাটা তার দু’ভাগ করে কাটা।

তখন ভূতেরা সেই যে লুকিয়ে গেল ভয়ে, এখন শুধু আড়ালে আবডালে ভূতের শব্দ সাড়া মিলে। ভূতের ভয়টা আছে তবে কশ্চিৎ কারো ভূতের দেখা মিলে। আসলে ভূতেরাই আর আগের মত বার হয়না ভয়ে। কী জানি কোথায় কোন ‘অমগদ’ চাকমা আছে আর একটুখানি কসুর হলেই অমনি ‘ঘ্যাচাং’ ক্রএ দেবে মুন্ডু উড়িয়ে।

*নোট ১: ব্যবসার উদ্দেশ্যে দূর বনে গিয়ে বাঁশ, গাছ ইত্যাদি কেটে নিয়ে আসা।


বঙ্কিম কৃষ্ণ দেওয়ান, চাকমা রুপকাহিনী – ২০০০ ইং, রাঙামাত্যা (রাঙ্গামাটি)

প্রসঙ্গ: চাকমা, রূপকথা

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা