চাকমা সমাজের যত পূজা পার্বণ
2826
ভূমিকা
চাকমা সমাজে কোন শিশু ভূমিষ্ট হলে তার জন্মে কোন শাঁখ বাজেনা, উলুধ্বনি উঠেনা, কোন প্রকার মাঙ্গলিক অনুষ্টানই তার জন্মে অপেক্ষা করা থাকেনা।
শুধু যখন নবজাতকের নাভি ঝরে যায় তখন একটা অনুষ্টান পালন করা হয়ে থাকে, যার মাধ্যমে নবজাতকসহ প্রসূতি পরিশুদ্ধি হয়ে হেঁসেলে ঢোকার অনুমতি পায়। এ অনুষ্টানের নাম ‘কজই পানি লনাহ্’।
চাকমা বিশ্বাসমতে সন্তান প্রসবের পর প্রসূতির এক ধরণের অশুচিতা জন্মে, সে জন্যেই এই অনুষ্টান। এ উপলক্ষ্যে দু-একজন লোককে খাওয়ানো হয়ে থাকে। শিশুর নামকরণেও কোন আনুষ্ঠানিকতার বালাই নেই।
বর্তমান শিক্ষিত সমাজের কথা বাদ দিলে, গ্রামের সাধরণ গৃহস্থ মা, বাপ, বুড়ো, জ্যেঠা যার যা খুশি একটা ডাকতে ডাকতেই শিশুর চলনসই একটা নাম হয়ে যায়। কারো কারো পোশাকী নামও অবশ্য একটা থাকে।
বিশেষতঃ পাঠশালায় যারা যায়, শিক্ষক মহাশয়ের হাতেই তার নামকরণ ঘটে। এভাবে একজন চাকমা শিশু জন্মের পর থেকে সরল অনাড়ম্বর পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে বেরে উঠতে থাকে। ছেলে হোক মেয়ে হোক সমাজে কিন্তু সব শিশুদের সমান কদর।
ভিন্ন সমাজে শিশুর জন্মলগ্ন থেকে অন্নপ্রাসন, নামকরণ ইত্যাদি একটা পর একটা উৎসব লেগেই থাকে; সেক্ষেত্রে চাকমা সমাজে অনুরুপ অনুষ্টানাদির অনুপস্থিতি স্বভাবতই চাকমা সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে একটা বিসদৃশ ধারনা জন্মে।
আরো মজার কথা, চাকমাদের মধ্যে নৃত্যগীত সমন্বিত কোন জাতীয় উৎসবেরই প্রচলন নেই। জাতীয় নৃত্যতো নেই বললেই চলে। গানের মধ্যও কয়েকটা সুরের সন্ধান পাওয়া যায়; যেমন, ‘অলি’ অর্থাৎ ঘুমপাড়ানী গান, উভোগীত, *গেংখুলীদের পালাগানের সুর ইত্যাদি। এসব কিছুর পেছনে কারণ কিন্তু একটাই।
ব্রিটিশ শাসনাধীনে আসার আগ পর্যন্ত কয়েক শতাব্দীকাল চাকমারা বিরুপ পারিপার্শ্বিকতার টানা পোড়নে ইতস্ততঃ ভ্রাম্যমান জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। এই সময় দক্ষিণে মগ এবং পূর্ব দিক থেকে লুসাই উপজাতির ক্রমাগত হামলার মুখে তাদের একরূপ পালিয়ে বেড়াতে হয়।
তাই নন্দন সংস্কৃতি বলতে যা’ বোঝায় চাকমাদের মধ্যে তা গড়ে উঠার সময় এবং সুযোগ কোনটাই ছিলনা। এ সময়ে রচিত একটা ছড়ার মধ্য তৎকালীন চাকমাদের সুরবস্থার একটা সম্যক ধারণা পাওয়া যায় –
‘ঘরত গেলে মঘে পায়,
ঝারত গেলে বাঘে খায়।
মঘে ন পেলে বাঘে পায়,
বাঘে ন পেলে মঘে পায়।
ঘরে গেলে মঘে পায়, ঝারে অর্থাৎ জঙ্গলে গেলে বাঘে খায়। মঘে না পায় তো বাঘে পায়, বাঘে না পায় তো মঘে পায়।
আর লুসাইয়ের উপদ্রব তো বঙ্গে বর্গীয় হাঙ্গামার মতো ‘কুগী ডর’ অর্থাৎ কুকীর ভয় নামে আজো কিংবদন্তী হয়ে আছে। এমনকি ব্রিটিশ আসার পরও এদের হামলার কোন কমতি ছিলনা।
কথিত আছে, লুসাইরা একরাত্রে বাইশ মৌজার উপড় হামলা চালায়, যার ফলে বর্তমান নানিয়াচর উপজেলাধীন বড়াদম সাকিনের নীলাচন্দ্র দেওয়ান নামক জৈনক পুলিশ অফিসারের পিতাসহ অসংখ্য চাকমা নিহত হয়। বৃটিশ গভর্নমেন্ট তখন ব্যপক অভিযান চালিয়ে এদের দমন করেন।
চাকমারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, সে কারণে চাকমাদের অধিকাংশ আচার অনুষ্ঠান পুরোপুরি বৌদ্ধধর্মভিত্তিক। এমনকি মৃত সৎকার এবং শ্রাদ্ধাদি অনুষ্ঠানেও ধর্মীয় প্রভাব সুস্পষ্ট। তবে এমন কিছু আচার অনুষ্টানও বেশ কয়েকটা দেখা যায়, যেগুলি বৌদ্ধ আদর্শের পরিপন্থী।
এর কারণ সম্ভবতঃ এই যে এককালে ধর্মের অবনতির যুগে বৌদ্ধধর্ম হিন্দুদের তান্ত্রিক মতবাদের সাথে মিশে তন্ত্রযান, মন্ত্রযান, বজ্রযান ইত্যাদি নানা বিকৃত ধর্মের রুপ নেয়, আর সেই সঙ্গে হিন্দুদের বহুু দেবদেবী ও হিন্দু আচার অনুষ্ঠান এই ধর্মে অনুপ্রবেশ করে।
চাকমা ভাষায় গাঙ্, গঙা, গঙ্গি ইত্যাদি শব্দ নদী অর্থে বুঝায়। আর চাকমাদের জল দেবীর নামও গঙা। এইসব শব্দ নিঃসন্দেহে গঙ্গানদী এবং হিন্দুদের গঙ্গাদেবীকে নির্দেশ করে। হিন্দু ভাবধারার সাথে সম্পৃক্ত যে সব পূজা-পার্বণ চাকমা সমাজে অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়, তার প্রায় সবগুলোতেই গঙা বা গঙ্গাদেবীর স্থান সর্বোচ্চ।
এসব পূজায় পশুপাখি বলি দেওয়ার বিধান আছে। এতে মনে হয়, চাকমারা এক কালে বোধ হয় গঙ্গার তীরবর্তী বা গঙ্গার কাছাকাছি কোন স্থানে বসবাস করতো। বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামে অন্য কোন উপজাতির মধ্য কিন্তু নদীকে গাঙ, গঙা অথবা গঙ্গি বলা হয় না।
এ বিষয়ে চাকমাদের মধ্যে একটা কিংবদন্তী প্রচলিত আছে যে, চাকমারা ক্ষত্রিয় এবং নেপালের শাক্যদেরই একটা দলছুট গোষ্ঠী। রাজা বিড়ুঢূকের শাক্য নিধনের সময় কিংবা পরবর্তীতে বৌদ্ধ বিতাড়ন কালে নেপাল ছেড়ে হিমালয়ের পাদদেশ ধরে ক্রমে ক্রমে আসাম হয়ে এখানে এসে পড়েছে। কথাটায় বোধহয় অনেকাংশে সত্য নিহিত রয়েছে।
এখানে অপ্রাসঙ্গিক হলেও একটা ব্যাপার বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম সার্ক সম্মেলন চলাকালে বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে একটা নেপালী ডকুমেন্টারী ফিল্ম সম্প্রচার করা হয়েছিল।
কাহিনীর মুখ্য বিষয় বস্তু ছিল নেপালী জাতীয় বিচার পদ্ধতি। ছবিতে অপরাধীকে যেই যেই দণ্ড দেওয়া হয়েছিল বলে দেখানো হয়েছে যেমন, দোষী ব্যক্তির মাথার চুল তিন ফালি করে কেটে দেওয়া, শুয়োরের খাঁচা কাঁধে নিয়ে ঢেঁড়া পিটিয়ে গ্রামের ঘরে ঘরে গিয়ে নিজের নিজের অপরাধের কাহিনী বলতে বাধ্য করা, ইত্যাদি সবই চাকমা জাতীয় বিচারে প্রযোজ্য দণ্ডের মতোই হুুবহু এক। তফাতের মধ্যে শুধু চাকমা অপরাধীকে এখন এখানে মুরগী খাঁচা গলায় ঝুলানো বিধি। তবে সামাজিক খানার জন্য শুয়োর দণ্ড দেওয়া তার পক্ষে অপরিহার্য।
চাকমা সমাজে যে সব পূজা অনুষ্ঠান প্রচিলত আছে, তার মধ্য অনেকগুলিই মানসিক পূজা। যেমন অহ্হিয়া, আহ্জার বাত্তি, চামনী, চুমুলাং, ধর্মকাম, সিন্দি ইত্যাদি।
বিপদে পড়লে প্রায় সবধর্মের লোকই বিপদ উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য হরহামেশা কিছু না কিছু মানত করে থাকে। বিপদ কেটে গেলে তারপর একসময় মানত শোধ করে। অনেকে পান তামাকও মানত করে এবং বিপদ কেটে না যাওয়া পর্যন্ত এসব জিনিস স্পর্শ করেনা।
এটা এরকমের ব্রতপালন। বৌদ্ধধর্মে এটাকে ‘শীলব্রত পরামর্শ’ বলে। এখানে চাকমাদের পাশাপাশি বহুদিন ধরে যদিও আরো বহু বিভিন্ন উপজাতি বসবাস চলছে, তাদের পূজা পার্বণের সাথে কিন্তু চাকমাদের আচার অনুষ্ঠানাদির খুব কমই মিল দেখা যায়।
মালক্ষী মা পূজা এবং থানমানা পূজা এই দুটি মাত্র অনুষ্ঠানে ত্রিপুরা সস্প্রদায়ের সাথে কিছুটা মিল থাকলেও পূজা পদ্ধতিতে অনেক পার্থক্য রয়েছে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্য সার্বজনীন বিঝু উৎসব রূপেই পালিত হয়ে থাকে।
জাতির দুর্দিনে ধর্মেরও অবনতি ঘটে, এটা স্বাভাবিক। এমনি অন্ধকার যুগেরই সাক্ষ্য বহন করে চাকমা সমাজের পুরানো দিনের বৌদ্ধ পুরোহিতেরা, যাদের বলা হয় ‘রুরি’ বা ‘লুরি’।
এই শব্দটা বোধহয় মধ্যযুগের রাউল বা রাউলী শব্দ থেকে এসেছে বয়োবৃদ্ধরা এদের আহ্বান করে থাকেন ‘থর্’ বলে, যেটা খুব সম্ভব পালি ‘থের’ অর্থাৎ স্থবির শব্দের অপভ্রংশ। এরা মাথা মুড়োয়, পীত বসন পরে কাছা দিয়ে।
কথিত আছে, সেই বৌদ্ধ বিতারণের যুগে প্রাণভয়ে পলায়নের সময় বৌদ্ধভিক্ষুরা দ্রুত গমনের সুবিধার্থে কাছা দিতে বাধ্য হয়; আর তখন থেকেই এদের মধ্যে কাছা দিয়ে চীবর পরিধান করা চালু হয়ে যায়। ব্রহ্মচর্য এদের জন্য অপরিহার্য নয়।
এরা বিয়ে করে সংসারী হতে পারে। অনেকে শুধু প্রয়োজনের সময় কাছায় ধারণ করে গৃহস্থ বাড়ী গিয়ে পূজাপাঠ সমাধা করে দিয়ে আসে। এদের ব্যবহার্য একমাত্র প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ ‘আঘরতারা’ চাকমাদের নিজস্ব বর্ণমালায় লিখিত।
এখানে বিশেষ উল্লেখযোগ্য যে, সেই দূর অতীতে চম্পক নগরের যুবরাজ বিজয়গিরি যখন রাজ্য জয়ে বের হয়েছিলেন তখনও চাকমাদের মধ্যে লেখাপড়ার চর্চা ছিল এবং শিক্ষাদীক্ষার প্রতি তাদের যথেষ্ট আগ্রহ ছিল এরূপ প্রমাণ পাওয়া যায়।
অভিযান যখন শেষ অর্থাৎ আরাকানের সমুদ্র উপকূল পর্যন্ত যখন চাকমাদের জয় করা হয়ে গেছে সেই সময়কার গৃহ প্রত্যাগমনোন্মূখ সৈন্যদের গানে আছে –
“পোর্ব্বুরা পন্দিত নেই যে দেজত,
থেদং নয় ভেইলক সে দেজত।
যেই যেই ভেইলক ফিরি যেই,
সাপ্রেই কুলত্ ফিরি যেই।”
পড়ুয়া পন্ডিত নেই যে দেশে, থাকবোনা ভাইসব সে দেশে। চল চল ভাইসব ফিরে যাই, সাপ্রেই কুলে ফিরে যাই।
বিশেষ লক্ষ্যণীয় যে, শিক্ষার প্রতি এতো অনুরাগ এতো আকুলতা খুব কম জাতিতেই দেখা যায়।
আঘরতারা বৌদ্ধ সূত্র পিটকের অন্তর্গত কয়েকটা সূত্রের সমষ্টি মাত্র। ভাষা বিকৃত পালি এবং দুর্বোধ্য। চাকমাদের প্রচলিত কিংবদন্তী মতে এটা হওয়াই স্বাভাবিক। দেশত্যাগ কালেই আঘরতারা সঙ্গে আনা হয়েছিলো এবং সুদীর্ঘ কাল ধরে এর পুনঃ পুনঃ অনুলিখন এর বিকৃতি ঘটার কারণ।
অনেকে মনে করেন, চাকমাদের ব্রহ্মদেশ, আরাকান ইত্যাদি জায়গায় এসেই বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে; কিন্তু সেক্ষেত্রে চাকমা ভাষার সঙ্গে সেসব দেশীয় ভাষার কিছু না কিছু ঘটা ছিল অনিবার্য। আশ্চর্যের বিষয় যে চাকমা ভাষায় ক্যং, স্বং, চাঙি, সাবেক এবং ওয়া এই কয়েকটি মগী শব্দ ছাড়া একটিও বার্মিজ শব্দ খুঁজে পাওয়া যায় না।
সুতরাং ভাষার আদান প্রদান যেখানে অনুপস্থিত সেখানে ধর্মের আদান প্রদান কিভাবে সম্ভব? ধর্মের পুনরুজ্জীবনের সাথে সাথে আঘরতারা এখন অপ্রচলিত এবং অবহেলিত হয়ে আছে। রুরি কিন্তু সমাজে এখনো আনাচে কানাছে দু’একজন দেখা যায়।
তখনকার দিনে মৃত্যু সৎকার ও শ্রদ্ধাদি কাজ এবং বৌদ্ধধর্ম ভিত্তিক পূজা পার্বণ এদের পৌরহিত্যেই সম্পন্ন হত। এখন বৌদ্ধ ভিক্ষুরা তাদের স্থান দখল করে নিয়েছেন।
বিয়েশাদী থেকে আর যাবতীয় সামাজিক ক্রিয়াকান্ডে পৌরহিত্য করার জন্যে সমাজে আরেক শ্রেণীর লোক আছে যাদেরকে বলা হয় ‘অঝা’। অঝা আসলে বাংলা ওঝাই। তবে চাকমা সমাজে অঝা বলতে বাংলা ধাইকেও বুঝায়, যে প্রসূতির গর্ভ খালাস করে থাকে।
অঝারা তুকতাক মন্ত্র জানে তাছাড়া পাহাড়ী চিকিৎসা বিদ্যায়ও কম বেশি দক্ষতা থাকে। অনেক রোগে এদের বনজ ঔষধ অব্যর্থ। অনেক অঝা আবার ভালো সর্পবিদ্যা বিশারদ। এসব কারণে চাকমা সমাজে অঝা আর বৈদ্য শব্দ দু’টি প্রায় সমার্থবোধক।
চাকমা ধাই অর্থাৎ স্ত্রী অঝারাও বড় কম যায় না। তাদেরও শিশুরোগ, স্ত্রীরোগ প্রভৃতি বিষয়ে যথেষ্ট অবিজ্ঞতা থাকে। গর্ভস্থ সন্তানের অবস্থান বুঝতে পারে।
প্রসবের পক্ষে তেমন বিপজ্জনক মনে হলে হাতের কৌশলে গর্ভস্থ ভ্রূণের সঠিকভাবে সংস্থাপন করে সুপ্রসব করাতে জানে। এসব কারণে চাকমাদের মধ্য প্রসবকালীন শিশু মৃত্যুর হার তুলনামূলকভাবে কম। প্রতি পাড়াতে অভিজ্ঞ অঝা দু’একজন থাকে। বহুু অভিজ্ঞতা যাদের থাকে তাদের ‘রাজ অঝা’ বলে রটে যায়।
পুরুষ অঝাদের কিন্তু এখন খুব আকাল। সমাজে শিক্ষা সম্প্রচারণের সাথে সাথে পুরনো দিনের পূজাপাঠ অনেক কমে গেছে। তাছাড়া অর্থনৈতিক কারণেও এসমস্ত পূজা অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা এখন আর সম্ভব হয়ে উঠেনা।
তাই সমাজে অঝাদের সংখ্যাও খুব কমে গেছে। চাকমাদের বিবাহ অনুষ্ঠানে অঝাদের পৌরোহিত্য অপরিহার্য, সে কারণে এখনও এরা টিম্ টিম্ করে টিকে রয়েছে।
পূজা পার্বণে ও পশুপাখি বলি দেওয়ারও একটা নির্দিষ্ট বিধান আছে। যে সমস্ত পূজায় বলি দেওয়ার বিধান থাকে সেক্ষেত্রে বলি দেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট দেবতা ভোগ নিতে রাজী আছেন কিনা ‘আগ্ পাতা’ ফেলে আগে ভাগে তা’ যাচাই করা হয়।
দুটো কাঁঠাল পাতার প্রস্থে মাঝামাঝি কেটে ল্যাজার অংশ দুটো তর্জনী, মধ্যমা ও অনামিকার ফাঁকে রেখে দেবতার উদ্দেশ্য তার মতামত প্রার্থনা করে পূজাবেদীর উপড় ছুঁড়ে দেওয়া হয়।
পাতা দুটোর একটা যদি সামনের দিক আর অপরটার পিঠের দিক উপড়মুখী করে পরে তাহলে বুঝা যাবে দেবতা ভোগ নিতে রাজী আছেন। দুটো পাতাই যদি পিঠের দিক উপড়মুখো হয়ে পড়ে, তাহলে বুঝতে হবে দেবতা নারাজ।
আর যদি দুটোরই সামনের দিক উপড়মুখী হয়ে পড়ে তাহলে বুঝতে হবে দেবতা চালাকী খেলছেন কিংবা ঠাট্টা করছেন। এই উভয় অবস্থাকে দেবতা যতক্ষণ না রাজী হচ্ছেন বার বার আগ্ পাতা ফেলা চলতে থাকে।
বলি দেওয়ার সময় শুকর কিংবা হা্স মুরগীর ইত্যাদির শির ছিন্ন না করে শুধু কন্ঠনালী ছিন্ন করে বধ করলে চলে। কিন্তু পাঁঠা, মোষ ইত্যাদি পশুর বেলায় এক কোপে মুণ্ডুটা বিচ্ছিন্ন করাটাই বিধি। ব্যতিক্রম ঘটলে ঘোরতর আশঙ্কা করা হয়ে থাকে। তখন একটির স্থলে ফের জোড়াবলি দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করার বিধান আছে।
পশু বলি দান, ছবিঃ সংগৃহীত
পরিশেষে একটি কথা এই যে, পূজা পার্বণ একটা সমাজের জন্য শুধু কিছুটা আমোদ প্রমোদ বা কিছু পূজা অর্চনা এরূপ অর্থ বহন করেনা।
যে সমাজে যেই যেই আচার অনুষ্ঠান প্রচলিত থাকে, সেগুলি সেই সমাজের তথা সেই জাতির কুল প্রথা বা কুলাচার। এসবের ভিত্তিমূলে ধর্মীয় প্রভাব বা অন্যবিধ ভাবাদর্শ যাই থাকনা কেন, এগুলির যথাযথভাবে আচরণের মধ্যে দিয়ে জাতীয় বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়।
জাতীয় ঐতিহ্য রক্ষিত হয় এবং সর্বোপরি সমাজ জীবনে অখণ্ডতা ও সংঘবদ্ধতা বজায় থাকে। সংঘবদ্ধ ভাবে কুলধর্ম আচরণ করা স্বয়ংবুদ্ধ কর্তৃক প্রশংসিত। লিচ্ছবীদের সপ্ত অপরিহানীয় ধর্মের এটি একটি অন্যতম ধর্ম।
এখানে সর্বমোট পঁচিশ প্রকার চাকমা পূজা পার্বণের কথা তুলে ধরা হয়েছে; তবে এর কিছু কিছু তথ্য ইতিপূর্বে স্থানীয় সাপ্তাহিক বনভূমি পত্রিকায় ১৭ই সেপ্টেম্বর ১৯৭৮ ইংরেজী তারিখ থেকে ২৬শে মার্চ ১৯৭১ ইংরেজী পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।
গঙাত ভাতজরা দেনা
ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের জ্বরজারি হলে চাকমা জননী সন্তানের রোগমুক্তির জন্য গঙা অর্থাৎ নদী বা ছড়ার জলে একমুঠি ভাত ছিটিয়ে দিয়ে আসেন। এই উদ্দেশ্যে একমুঠি ভাত এক টুকরো কলাপাতায় দিয়ে তাতে বাড়ির চারকোণা আর মাঝের খুঁটি থেকে দা’ও দিয়ে কিছু চিলতে তুলে মেশানো হয়ে থাকে।
তারপর রুগ্নছেলের মাথায় উপর তা’ ধরে ছেলের মা এই বলে প্রার্থনা করেন যে, আজ অমুখের অসুখ ভালো হওয়ার জন্য ভাতজরা (মুঠিভাত) দিচ্ছি, হে মা গঙা!* ছেলেকে ভালো করে দাও। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘নিঝিলনাহ্’। এরপর সেই মিশ্রিত ভাতগুলো ঘাটে নিয়ে পানিতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
কারো যদি চোখ টাটায়, চোখ থেকে পিচুট গলে, কারো গায়ে দাদ, খোসপাঁচড়া ইত্যাদি চর্মরোগ দেখা দেয়, তবে তারও প্রাথমিক চিকিৎসা হিসাবে অনেকে গঙায় ভাতজরা দিয়ে থাকে। এসময় ভাতে সঙ্গে আর কিছু মেশাতে হয় না।
শুধু রোগ ব্যাধি নয় যেকোন ধরনের মানসিক মানসের ক্ষেত্রে এবং পারস্পরিক প্রতিজ্ঞাবোধের কাজেও এই ভাতজরা চাকমা সমাজে প্রচলিত।
তাই গ্রামাঞ্চলে প্রায়ই যুবক যুবতীরা প্রেমের মোহে আবদ্ধ হয়ে পরস্পর মিলন ইচ্ছায় একসাথে গঙ্গায় ভাতজরা দিয়ে আসে। এই প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রেমিক যুগলের মুখে উভাগীত জুড়ে দেওয়া হয়েছে –
”দিলং ভাতজরা গঙ্গা-রে,
মলেহ্ মরিবং সমারে,”
গঙ্গাকে ভাতজরা দিলাম। প্রার্থনা করি,আমরা মরি তো যেন একসাথে মরি। অর্থাৎ মৃ্ত্যু পর্যন্ত কেউ যেন আমাদের পৃথক করতে না পারে।
মালক্ষ্মী মা পূজা
আগেকার দিনে নিষ্ঠাবতী চাকমা গৃহিনীরা সপ্তাহে প্রতি বৃহস্পতিবার বাড়িতে একটি সিদ্ধ ডিম আর সাধারণ ভাত তরকারী দিয়ে মালক্ষ্মী মার পূজা দিত। বিশেষতঃ কেউ যদি স্বপ্ন দেখে যে কোন বুড়ি তার বাড়ীতে বেড়াতে এসেছে, তাহলে তো কথাই নেই।
পরদিন মালক্ষ্মী মার পূজা অবশ্য কর্তব্য। বলাবাহুল্য, মালক্ষ্মী মা হলেন হিন্দুদের লক্ষ্মীদেবী। ধান ‘ফাঙ’ করার সময় এবং নবান্ন উৎসব কালেও মালক্ষ্মী মার পূজা অবশ্য করণীয়। মালক্ষ্মী মার প্রিয় ভোগ হল ভাডুই পাখী।
অভাবে শূকর, মোরগ এমনকি কাঁকড়াও হলেও চলে। তাছাড়া মদতো আছেই। মজার কথা, হিন্দুদের নিবামিযাশী লক্ষ্মীদেবী চাকমাদের হাতে পড়ে মদ মাংস সবই ধরেছেন। সকালবেলা সকলের আহারের আগে মালক্ষ্মী মার ভোগ দিতে হয়।
এর জন্য কোন অঝার দরকার পড়ে না। বাড়ীর গৃহিনীই স্নানান্তে শুদ্ধ শুচি হয়ে মাথায় ‘খবং’** জড়িয়ে পূজার চারধারে কিছু চাল আর জল ছিটিয়ে দেবীকে আবাহন করে ভোগ নিবেদন।
চামনী
মরণাপন্ন ছেলের আরোগ্য কামনায় অনেক সময় চাকমা জনক-জননী ছেলের জন্য চামনী মানত করে থাকেন। চামনীর পালি সামঞঞ্য বা শ্রামণ্যব্রত। ছেলে ভালো হয়ে গেলে একদিন ঘটা করে তাকে বিহারে নিয়ে শ্রামণ্য ধর্মে দীক্ষিত করা হয়ে থাকে।
এভাবে সে রংবসস্ত্র নিয়ে অন্ততঃ সপ্তাহকাল বিহারে অবস্থান করে এবং বিহারবাসী ভিক্ষুর নিকট শ্রামণ্যধর্মে ধর্মের পাঠ নিয়ে ব্রত পালন করেন। এসময় ভিক্ষান্নে জীবিকা নির্বাহ করাই নিয়ম।
ব্রত পালনের জন্য অন্ততপক্ষে একদিন ধারে ধারে গিয়ে ভিক্ষা করতে হয়।বৌদ্ধধর্মে এরূপ ব্রতধারী শিক্ষার্থীকে বলা হয় শ্রামেণর। সপ্তাহান্তে সে আবার চীবর পরিত্যাগ করে মা বাবার সঙ্গে গৃহে ফিরে যায়।তখন এ উপলক্ষ্য ভিক্ষু ভোজনসহ লোকজন খাওয়ানো হয়ে থাকে।
অনেক সময় অনেক বয়স্ক ব্যক্তি ও বিপদের সময় চামনী মানত করে। তারপর বিপদ কেটে গেলে এক সময় বিহারে গিয়ে মানত শোধ করে আসে।
পুরোপুরি ভিক্ষুজীবন গ্রহণের জন্য যারা দীক্ষা নেই তারা বিহারেই থেকে যায় এবং শিক্ষা সমাপনান্তে উপসম্পদা লাভ করে। চাকমা সমাজে জীবনে অন্তত একবার বিশেষত:বিবাহের পূর্বে বিহারে গিয়ে কিছুদিনের জন্য শ্রামণ্য ব্রত পালন করা প্রত্যেক পুরুষের জন্য অবশ্য কর্তব্য।
এর প্রায় বিশেষ কোন হেরফের হয় না। শীল পালন এবং ব্রক্ষ্মাচর্য্য আচরণের মধ্য দিয়ে বৌদ্ধ ধর্মের নীতিশিক্ষা গ্রহণেরই এটা মূল উদ্দেশ্য। এই সাময়িক ব্রত পালনের জন্য ও অন্ততপক্ষে সপ্তাহখানেক বিহারে অবস্থান করতে হয়।
চুমুলাং
যখনই কোন চাকমা বিপদে পরে তখন বিপদে রক্ষা পাওয়ার জন্য ‘চুমুলাং’ মানত করে। দূর্যোগ কেটে গেলে তখন সে ঘটা করে চুমুলাং পূজা করে। চুমুলাং আসলে বিয়ের পূজা।
এই পূজায় একজন দেবী আর দুজন দেবতার পূজা করতে হয়। দেবীর নাম পরমেশ্বরী আর দেবতাদের মধ্য একজনের নাম কালাইয়া। আর অন্য দেবতার নাম শাস্ত্রে বলা হয় নি তাই একে শুধু “নাইনাঙ্গ্যা” অর্থাৎ অনামী বলা হয়ে থাকে।
এই দেবদেবীগণ আবার সর্বসিদ্ধি দাতারুপে ও পরিচিত হন। আগেকার দিনে তাই প্রায় গৃহস্থই বছরে একবার গৃহ দেবতার পূজার মতো চুমুলাং পূজা করতো। এজন্য এ পূজাকে অনেকে “ঘর-তাত্তা”বলে থাকে।
এটা অনেকটা বার্ষিকি উদযাপনের মতো যদিও ঠিক। বিয়ের দিন এটি করা হয় না। চুমুলাং পূজার উৎপত্তি সম্বন্ধে এক চমকপ্রদ কাহিনী আছে। স্মরনাতীত কালে চাকমাদের মধ্য বোধহয় চুমুলাং পূজা করা কিংবা লেককে খাওয়ানোর রেওয়াজ ছিলনা।
উপোরক্ত দেবতা কালাইয়া এই প্রথার প্রবর্তক যিনি পরমেশ্বরী দেবীর প্রথম স্বামী। কথিত আছে, পরমপশ্বরী দেবীকে বিয়ের পর কালাইয়া বাণিজ্যেদ্দেশ্য বিদেশ গমন করেন।
এজন্য কালাইকে সওদাগর ও বলা হয়ে থাকে। কথা থাকে যে, বারো বছরের মধ্য কালাইয়া ফিরে না আসলে পরমেশ্বরী দেবি সেচ্ছায় দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করতে পারবেন।
এখানে বিশেষ লক্ষ্য করার বিষয় এই যে, সেই দূর অতীতে চাকমারা বিদেশে গিয়ে বাণিজ্যে করতো। কালাইয়া অবশ্য দৈবগতিকে ঠিক সময়ে ফিরিয়ে আনতে পারেন নি আর পরমেশ্বরী দেবী ও বার বছর পর আরেক জনকে বিয়ে করেন।
এরপর কালাইয়া ফিরে এসে দেখতে পান যে, তার স্ত্রী বেহাত হয়ে গেছেন। তখন তিনি চুমুলাং পূজা করে লোককে খাইয়ে সম্ভবত: তাদের মতামত নিয়েই স্ত্রীকে ঘরে ফিরে আনেন।
সেই থেকে বিয়ের সময় চুমুলাং পূজা করা হয় আর লোকজনকে খাওয়ানো চাকমা সমাজে প্রচলিত হয়ে গেলো। কালে কালে উপোরক্ত তিনজন ও এই পূজায় দেবদেবীর আসনে কায়েম হয়ে গেলেন।
এখন আর চুমুলাং না করে বিয়ের কাজ সিদ্ধ হয়না। আর যেনতেন প্রকারের একটা বিয়ের খানা দিতে হবে। অন্যথায় সেই লোকের মৃত্যু হলে তাকে কাঁধে করে শ্মশানে না নিয়ে হা্টুর নীচে ঝুলিয়ে অসম্মানজনক ভাবে শ্মশানে নেওয়াই বিধি।
চুমুলাং পূজায় মদ, তিনটি মুরগির বাচ্চা হলে ও ক্ষতি নেই, অধিকন্ত একটি শূকর লাগে। অভাব পক্ষে শুধু তিনটি মুরগির বাচ্চা হলে ও চলে। অঝা বা পুরোহিত ঘরের মধ্য চাটাইয়ের উপর ধান, চাল, কার্পাস ইত্যাদি পাশে নিয়ে দুটো পূজা সাজায়।
সামনে এক একটি সরষে তেলের পিদিম জ্বলে। তারপর পূজার শূকর আর মুরগিগুলো বলি দিয়ে অঝা সেগুলোর মাথায় এবং রক্ত মদ্য পানীয় সহযোহে পূজায় নিবেদন করেন।
অঝার পূজাপাঠ শেষ হলে স্বামী স্ত্রী জোডায় এসে পূজা প্রণাম করে। এই পূজায় সিদ্ধ অবস্থায় দ্বিতীয়বার ভোগ নিবেদন করতে হয়। এই শেষবার ভেগ দেওয়ার পর অঝা এবং পাড়ার বুড়োরা মিলে পূজার ফলাফল নিয়ে আলোচনায় বসে।
এই সময় ভোগের জন্য নিবেদিত সিদ্ধ ডিম মুরগির ঠ্যাং, মাথা ইত্যাদি নিয়ে অঝা দম্পত্তির শুভ অশুভ বিচারে প্রবৃত্ত হয়। এই পূজা মানসিক করার পূজা হলে তা’ দেবতার সন্তুষ্টি বিধান করে ভালোভাবে উত্তরে গেলো কিনা তাও নিরুপণ করা যায়। এই অনুষ্ঠানকে বলা হয় “চাম্বা চানাহ্।
অহ্ইয়া
অপুত্রক ব্যাক্তি কামনা বা অনেকগুলো পুত্র সন্তানের পর একটি মেয়ে পাওয়ার বাসনায়, আর্থিক সমৃদ্ধি কিংবা কোন বিপদ থেকে মুক্তির জন্য লোকে এই পূজা মানত করে। যদি মানস পূর্ণ হয় সে ঘটা করে এই পূজার অনুষ্টান করে।
এই পূজার বিশেষত্ব এই যে, অতপর: যতদিন সামর্থ্য কুলায় সে ততদিন এই পূজা করতে বাধ্য থাকে। যখন সামর্থ্য চলে যায় তখন সে দেবতাদের কাছে মাফ চেয়ে পূজার ইতি টানে। এই পূজাটা একটা মিশ্রিত বিশেষ অনুষ্ঠান।
এতে একাধারে চাকমা, ত্রিপুরা এবং মুসলমানী ধর্ম বিশ্বাসের অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটেছে। এই পূজায় অহ্ইয়া,গরেইয়া এবং গাজী এই তিনজন দেবতার পূজা করা হয়ে থাকে।
এদের মধ্য অহ্ইয়া চাকমাদের,গরেইয়া ত্রিপুরাদের এবং মুসলমানরা গাজী পীরের পূজা করে থাকেন। এই পূজার জন্য প্রথমে উঠানে একপাশে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন জায়গায় একটা বড় বাঁশের চোঙা, ভিতরে একটা ডিম ঢুকিয়ে ,মাটিতে পোঁতা হয়ে থাকে।
তারপর পতাকা দণ্ডের মতো দীর্ঘ একটি বাঁশের দণ্ড আস্তে করে চোঙের ভিতর অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে খাড়া করানো হয়। ঐ দণ্ডে নতুন নতুন খাদি, যেগুলো চাকমা মেয়েরা বুকে জড়িয়ে বাধে, সারি সারি ঝুলানো হয়ে থাকে।
গৃহস্থ যত বছর এই পূজা করে, অনুক্রমে এই কাপড়গুলোর সংখ্যা ও বেড়ে যায়।এইভাবে কাপড়গুলোর সংখ্যা গুনে যে কেউ বলে দিতে পারবে গৃহস্থ কত বছর ধরে এই পূজা করে আসছে। পূজা শেষে কাপড়গুলো সযত্নে তুলে রাখা হয় পরের বছর ব্যবহারের জন্য।
পূজা শেষে বাঁশের দণ্ডটি নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। এই পূজায় নয়টি মুরগি লাগে তন্মধ্য কমপক্ষে একটি মোরগ চাই। অধিক সঙ্গতি থাকলে এই পূজায় পাঠাও বলি দেওয়া হয়। অঝা বা পুরোহিত আগ পাতা ফেলে পূর্বোক্ত দণ্ডটির গোড়ায় এগুলো বলি দেয়। পূজা শেষে বলির মাংস রান্নাবান্না করে করে নিয়ন্ত্রিত অতিথিবর্গসহ মদ্যপানের মধ্য দিয়ে ভুরিভোজ চলে।
সিন্দি
অনেকদিন আগে সিন্দি পুধি বা সত্যনারায়ণের পাঁচালী নামে একটা পুঁথি বাজারে কিনতে পাওয়া যেতো। পঞ্চাশের দশকে স্বর্গীয় হর কিশোর চাকমা এই বইয়ের অনুকরণে ভগবান বুদ্ধের সত্য পারমীকে ভিত্তি করে সত্য পাঁচালী নামে আরেকটি পুৃঁথি রচনা করেন।
এটাও আর এখন পাওয়া যায়না। চাকমা ভাষায় সিন্দি আর বাংলায় শির্ নী। তখনকার দিনে চাকমাদের প্রায় ঘরে ঘরে হিন্দুদের দেখাদেখি সত্য নারায়ণের নামে শির্ নী দেওয়া হতো।
মুসলমান সমাজে ও তখন এই ধরণের শির্ নী দেওয়ার রেওয়াজ ছিলো আর তা উৎস্বর্গ করা হতো সত্য পীরের নামে। সত্য নারায়ণ আর সত্য পীর যেই হউন, উভয়ে তখন খুব জাগ্রত দেবতা বলে বিবেচিত হতেন।
সন্ধ্যাকালে কিংবা এঁটোমুখে ভূলে ও কেউ কখন ও শির্ নীর নাম মুখে আনতে সাহস করত না। অকারণে এই পূজার কথা নিয়ে তোলপাড়া করলে কিংবা শির্ নী নিয়ে কেউ কখন ও সামান্যতম অশ্রদ্ধা দেখালে তখন নাকি সত্যি সত্যি কিছু একটা বিপদ দেখা দিতো।
হয়তো: জঙ্গলে বাঘের উপদ্রব দেখা দেবে। পাড়া গ্রামে ওলাউঠা, বসন্ত ইত্যাদির মড়ক লেগে যাবে; নির্দেশপক্ষে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বিশেষ কিংবা তার পরিবারের কারো না কারোর প্রাণহানি ঘটতে পারে।
নানা কারনে লোকে এই পূজা মানত করে। বিবিধ রকমের বিপদমুক্তি, জীবনাশঙ্কা, বৈষয়িক সমৃদ্ধি এমন কি ক্ষেতে পোকা মাকড়ের উপদ্রব নিবারণের জন্যও লোকে সত্যেপীর বা সত্য নারায়ণের নামে শির্ নী দিত।
তবে বাঘের উপদ্রব নিবারণই নাকি এই পূজার বিশেষত্ব। বিপদের গুরুত্ব অনুসারে লোকে একসঙ্গে একাধিক শির্ নী মানত করত। পুঁথির ভাষায় এই পূজার জন্ম – ‘সোয়াসের দুগ্ধ লাগে সোয়াসের আটা, সুপক্ষ কদলী লাগে সোয়াসের মিঠা।’
তাছাড়া আখ, নারিকেল, পান সুপারি এবং বিবিধ প্রকার ফুল ও লাগে। তুলসী এই পাতায় অপরিহার্য। একাধিক পূজা হলে সমপরিমাণ উপকরণ দিয়ে আলাদা আলাদা পূজা পাশাপাশি সাজাতে হয়।
পূজার সময় প্রত্যেকটা পূজার শিয়রে এক একটা পিদিম জ্বলে আর লেখাপড়া জানা একজন লোক ব্রাক্ষ্মণের ভূমিকা নিয়ে সুর করে পুঁথি পড়তে থাকে। এই সময় গৃহস্থ এবং উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ পূজার কিছু না কিছু দক্ষিণা দিয়ে থাকে।
পূজার প্রদত্ত পান সুপারি এবং এইসব দক্ষিণার পয়সা পুঁথি পাঠকারী ব্রাক্ষ্মনেরই প্রাপ্য। পূজা শেষে দুধ, আঠা, গুড়, কলা, নারিকেল, ইত্যাদি একটা বড় পাত্রে নিয়ে শির্ নী মাখানো হয়ে থাকে।
তারপর গৃহস্থের জন্য পরিমাণ মতো কিছু শির্ নী রেখে বাকিটা পড়শী দের মধ্য বিলিয়ে দেওয়া হয়। খাওয়ার আগে শির্ নী প্রথমে মাথায় নিতে হয়। এই সময় শির্ নী খাওয়ার জন্য পাড়ার ছেলে পিলেদের মধ্য এমন কাড়াকাড়ি লেগে যায় যে, তাই নিয়ে চাকমাদের মধ্যে একটা বাঁগধারাই চালু হয়ে গেছে-“সিন্দি খিয়া গুরাগুন” অর্থাৎ কিনা শির্ নী খেকো বাচ্চারা।
এই শির্ নী যেখানে সেখানে ফেলা বারণ। উচ্ছিষ্ট সবকিছুই নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। মুসলমান সমাজে শির্ নী করে খাওয়া হয়ে থাকে। চাকমাদের মধ্যে কিন্তু কাঁচা খাওয়াই বিধি।
ব্যাপারটা যদি ও স্বাস্থ্য রক্ষা সম্মত নয় তবু এটা একটা আশ্চর্যের ব্যাপার যে শির্ নী খেয়ে কারোরো কোনদিন সামান্যতম পেটের অসুখ করেছে, এমনটি কখন ও শুনা যায়নি। চাকমা ভাষায় সিন্দি নিয়ে মোট তিনটি বাঁগধারা পাওয়া গেছে। যেমন –
১। সিন্দি খিয়া গুরাগুন, যেটি পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।
২। “মানিক্যা বাবর সিন্দিখানা”- অর্থ, মানিকের বাবার শির্ নী খাওয়া। অর্থাৎ যখন সে শির্ নী খেতে গেলো কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। এরুপ দেরী করা যাদের স্বভাব ইংরেজীতে তাদের বলা হয়, ‘Late latif’.
৩। ‘সিন্দিকলা’-অর্থাৎ শির্ নী পূজায় দেওয়া খোসা ছাড়ানো কলার মতো একেবারে উদোম গা।
ফানাচ্ বাত্তি
চাকমারা বিশেষ বিশেষ বৌদ্ধ পর্বদিনে ফানাচ্ বাত্তি উড়িয়ে দেয়। ফানাচ্ বাংলায় ফানুচ। একে আকাশ প্রদীপ ও বলা হয়ে থাকে। ফানুস উড়িয়ে দেওয়া বৌদ্ধদের এক ধরণের প্রদীপ পূজা।
কথিত আছে- রাজ কুমার সিদ্ধার্থ যখন গৃহত্যাগ করে অনোমা নদীর তীরে উপস্থিত হন তখন প্রব্রজ্যা গ্রহণের জন্য স্বহস্তে অসি দিয়ে নিজের ভ্রমর কৃষ্ণ কেশরাজি ছেদন করেন।
মহাব্রক্ষ্মা সঙ্গে সঙ্গে ঐগুলি মাটিতে পড়ার আগে স্বহস্তে গ্রহণ করে ব্রক্ষ্মলোকে নিয়ে যান এবং সেখানে সেই চুল নিয়ে ‘চুলামনি চৈত্য’ নামে একটি চৈত্য স্থাপন করেন। চাকমারা তথা সমগ্র বৌদ্ধ জগত ফানাচ্ বাত্তি অর্থাৎ আকাশ প্রদীপ জ্বেলে সেই চুলামণি চৈত্যর উদ্দেশ্য পূজা নিবেদন করে থাকে।
আহ্জার বাত্তি
বিপদমুক্তি কিংবা রোগমুক্তি কামনায় লোকে আহ্জার বাত্তি মানত করে। এটি আসলে ভগবান বুদ্ধের উদ্দেশ্য প্রদীপ পূজা। এই অনুষ্ঠান বৌদ্ধ বিহারে কিংবা স্বগৃহে সম্পন্ন করা যায়।
আগেকার দিনে পুরোনো বৌদ্ধ পুরোহিত রুরিরাই এই পূজায় পৌরোহিত্য করতেন এই অনুষ্ঠানে। আহ্জার বাত্তি বা এক হাজার বাতি জ্বালিয়ে বুদ্ধের পূজা করা হয়ে থাকে।
এতে এক হাজার মোমবাতি অথবা ছোট ছোট মাটির চার্টির উপড় সলিতা দিয়ে এক হাজার সরষে তেলের পিদিম জ্বালানো হয়ে থাকে। চাকমারা এই পিদিমকে বলে ‘এইচাদি’।
স্বগৃহে এই পূজা অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে হলে প্রথমে বাড়ির প্রাঙ্গণে খোলা জায়গায় চতুষ্কোণ আকারে একটা পূজা মণ্ডপ তৈরী করে নিতে হয়।
তার চারধারে জোড়ায় জোড়ায় খুঁটি পুঁতে বেশ কিছু বাঁশ লম্বালম্বি দুই ফালি করে চিরে সেগুলো খুঁটিগুলোর ফাকে প্রস্থাকারে এমন ভাবে সারি সারি বাঁধা দেওয়া হয়, যাতে প্রত্যেকটা বাঁশের ফালির খাঁজযুক্ত অংশটুকু উপরমুখো হয়ে থাকে।
তারপর সেই খাজের মধ্যে সারি সারি মোমবাতি অথবা ‘এইচাদি’ অর্থাৎ সরষে তেলের পিদিম বসিয়ে দেওয়া হয়। সাধারণত সন্ধ্যারাতে এই হাজার বাতি জ্বালানো হয়ে থাকে।
তখন গৃহস্থ পরিজন ছাড়া বহু পাড়া প্রতিবেশি এ কাজে অংশ নিতে আসে এবং বাতি জ্বালানো কাজে সরিক হয়ে পূণ্যাংশ গ্রহণ করে থাকে। অনেকে এই অনুষ্ঠানের সময় দুয়েকটা ফানুস ও উড়িয়ে দেয় এবং অনেক গৃহস্থ পরদিন ভিক্ষুসংগ সহ লোকজনকে খাওয়ায়।
ধর্মকাম
এই পূজার একাধিক নাম, যেমন – ধর্মকাম, জাদিপূজা, শিবপূজা, সীবলী পূজা ইত্যাদি। আসলে এটা বুদ্ধের শিষ্য লাভী শ্রেষ্ঠ সীবলী মহাস্থবিরের পূজা। এই পূজা এখন বৌদ্ধশাস্ত্র সম্মতভাবে বিহারে অথবা স্বগৃহে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
বৌদ্ধ ধর্মের চরম অবনতির যুগে মহাযানী বৌদ্ধ মতবাদের সাথে যখন হিন্দুদের তান্ত্রিক মতবাদের সাথে সংমিশ্রণ ঘটে তখন এই পূজা অনুষ্ঠানে ও বিকৃতি দেখা দেয়।সীবলী পূজা হয়ে যায় শিবপূজা।
ক্রমে ক্রমে বলিদান প্রথাও এই পূজায় চলতি হয়ে পড়ে। তবে এই পূজা অনুষ্ঠানে যথাস্থানে বুদ্ধমূর্তী সংস্থাপন করা অবশ্য কর্তব্য। বছর সতেরো আগে ১৯৭০ ইংরেজীর শেষ ভাগে ১০৩ নং বাকছড়ি মৌজার বড় কাটাছড়ি গ্রামে স্বর্গীয় দুলাল দেওয়ানের গৃহে আমার একবার এরুপ এক পূজা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিলো।
পূর্বোক্ত বৌদ্ধ পুরোহিত রুরিদের পৌরোহিত্যেই কেবল এই পূজা সম্পন্ন হতে পারে প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ “আঘরতারা” আবৃতি ও এখানে অপরিহার্য। তাছাড়া এই পূজার এমন কতকগুলো বিধিবিধান রয়েছে যার মূলে নিঃসন্দেহে বৌদ্ধ মতাদর্শ নিহিত রয়েছে।
যেমন পূজার সময় গৃহস্থের ঘরে কিংবা পূজা মণ্ডপে শুচি শুদ্ধ না হয়ে কেউ প্রবেশ করতে পারে না। আর যতক্ষণ না পূজা শেষ হয় ততক্ষণ পর্যন্ত মদ, জগড়া প্রভৃতি নেশাপান প্রত্যেকের জন্য নিষিদ্ধ থাকে।
এসব বিধিবিধান কোনটার বর খেলাপ ঘটলে পূজায় বিপর্যয় ডেকে আনে। অতি বিপদে পড়ে লোকে ধর্মকাম মানত করে। সিন্দির মতই এই ধর্মকাম ও বাসি মুখে মুখে জানতে নেই।
সাধারণত: যখন জুমের ধান তোলা হয়, কাজকর্ম কর আসে, এরুপ প্রসস্ত সময়ে একটা শুভদিন দেখে এই অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়। এতে পাড়ার সবাই যেমন নিমন্ত্রিত থাকে তেমনি একাজে সবার সক্রিয় সাহায্য ও পাওয়া যায়।
পূজায় ৭টি মোরগ মুরগি, ১টি শূকর, প্রচুর শুঁটকি মাছ আর বিবিধ রকমের তরি তরকারী লাগে। অনেকে মানত করার দিনই নিজের পালের একটা শূকরের বাচ্চাকে পূজার জন্য নির্ধারিত করে খাসী করে দেয়।
সেটা বড় হতে থাকে আর গৃহস্থ ধীরে ধীরে তৈরি হতে থাকে পূজার জন্য, যেহেতু এটা খুবই ব্যয়বহুল ব্যাপার। এই পূজার জন্য নিয়ত করে আগে ভাগে আলাদা ভাবে মদ বানানো হয়ে থাকে।
চাকমাদের বিশ্বাসমতে এভাবে পূজার জন্য বানানো মিষ্টি জগরা দীর্ঘদিন রেখে দিলেও কিছুতে টকে যেতে পারে না। এই অনুষ্ঠানের দুটি পর্যায় রয়েছে। দু’টি দু’দিনে সম্পন্ন করতে হয়। প্রথম দিন পিঠা খাওয়া আর দ্বিতীয় দিনে আসল পূজা।
পিঠা খাওয়া পর্বে জন্য তেলে ভাজা ও ভাবে সিদ্ধ উভয় প্রকারের হরেক রকম চাকমা পিঠা প্রচুর পরিমাণে তৈরি করা হয়ে থাকে। পিঠা খাওয়ার দিন সন্ধ্যাবেলা অনেকে আবার আহ্জার বাত্তি ও জ্বালিয়ে থাকে, ফানুস ওড়ায়। তবে সেটা মানত করা নিয়ে কথা।
পিঠা খাওয়ার পর সে রাত্রের মধ্যেই মুরগী, শূকর ইত্যাদি বধ করে আর শুটঁকি এবং অন্যান্য সব তরি তরকারী কুটনো কুটে নিয়ে পরদিন ভোরে পূজার জন্য রান্না চাপানো হয়ে থাকে।
রুরিরা বলে থাকেন, মোরগ মুরগি এবং শূকর শিবের উদ্দেশ্যেই উৎসর্গ করা হয়। তবে আর্শ্চযের বিষয় যে, অন্যান্য পূজার মত এগুলো বলি দেওয়ার পূর্বে আগ্ পাতা ফেলে কোন দেবতার মতামত চাওয়া হয় না।
মোরগ মুরগিতে ও কোন বাছবিচার নেই। ইত্যাদি কারণে স্বভাবতঃই এই পূজায় বলির বিধান নিয়ে প্রশ্ন জাগে। রান্না করতে হয় বাড়ীর বাইরে কোন সুবিধা জনক স্থানে।
পূজার জন্য প্রথমে বাড়ীর উঠানে ৫/৭ জন লোক বসতে পারে মত একটা বাঁশের মাচান ঘর করতে হয়, যাকে বলে দানঘর। আসল পূজার জন্য জায়গা করতে হয় এর থেকে কিছু দুরে অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত চত্বরে, যেখানে আলাদা একটা পূজা মণ্ডপ তৈরি করা হয়ে থাকে।
নির্বাচিত জায়গাটি পরিষ্কার করে আগে থেকেই মাটি আর গোবর দিয়ে উত্তমরুপে নিকিয়ে ঝকঝকে তকতকে করে রাখা হয়। তারপর সেখানে জার্ফার বেড়া দিয়ে ঘিরে পূজা মণ্ডপ তৈরি করা হয়ে থাকে, যার উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম চারদিকে চারখানা দরজা থাকে।
এর কেন্দ্রস্থলে একই ধাচেঁর আরেকটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রবৃত্ত তৈরি করে উভয় বেড়ার মাঝের ফাঁকা অংশটাকে চারভাগে ভাগ করা হয়। কেন্দ্রস্থলে বৃত্তটি ফাঁকাই থাকে। সমস্ত ব্যাপারটা চতুষ্কোণ কিংবা গোলাকার বৃত্তও করা যেতে পারে।
পশ্চিম দরজার মুখে বুদ্ধিমুর্ত্তি স্থাপিত হয়ে থাকে। এই পূজায় একাধিক রুরির উপস্থিতি প্রয়োজন এবং তাদের মধ্যে যিনি প্রধান তিনিই এই পূজায় পৌরোহিত্য করেন। তাকে বলা হয় ‘গাথ্যা রুরি’।
পূজার সময় তাকে ‘আঘরতারা’থেকে গাথা পাঠ করতে হয়, এজন্যই সম্ভবত:তাঁকে এই নাম দেওয়া হয়েছে। দান ঘরে পাঠ রতে হয় ‘মালেম তারা’ আর পূজা মণ্ডপে পাঠ করতে হয় সাহসফুলু তারা’ এবং ‘ধা-পারামী তারা’ (দান পারমী?)।
রান্নাবান্না হয়ে গেলে সমস্ত অন্নব্যঞ্জন প্রথমে দানঘরেই তোলা হয়। সেখান থেকে পরিমাণ মত নিয়ে পূর্বাহ্নের মধ্যেই পূজা মণ্ডপে উৎসর্গ করা হয়ে থাকে।
প্রথমে কেন্দ্রস্থলে একটি বৃহদাকারের অন্নকূট স্থাপন করে পূজা সাজানো হয়। বহির্ভাগের চার অংশে অন্নকূট স্থাপন করতে হয় প্রতি অংশে ষোলটা করে। তবে এগুলো অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র আকারের হয়ে থাকে।
এগুলো দেখতে অনেকটা বৌদ্ধ চৈত্যের মত, মগ ভাষায় যাকে’জাদি’ বলে। এ জন্যই বোধ হয় এই পূজাকে জাদি পূজা ও বলা হয়ে থাকে।এ পূজার একটি অদ্ভুত সত্য আছে।
পূজাতে একটি মাকড়সা আসবেই, না এলে পূজা সিদ্ধ হবে না। সেটি যদি আবার পূর্বদ্বারে ঢুকে পূজার যে কোন স্থানে জাল বুনে পশ্চিমদ্বারে বেরিয়ে যায় কিংবা রয়েই গেল ‘ভিতরে’ তবে গৃহস্থের পক্ষে অতি শুভ ফল দায়ক হয় বলে মনে করা হয়ে থাকে।
মাকড়সা আসার আগে পূজায় মাছি বসলে সেটি অশুভ লক্ষণ বলে বিবেচিত হয়। পরে শত মাছি বসতে পারে, তাতে কোন ক্ষতি বৃদ্ধি ঘটেনা।
কোন কারণে পূজায় যদি মাকড়সার আবির্ভাব না ঘটে তবে গৃহস্থ পরিজন সহ রুরি লুখাক* সকলে মন্ত্র আবৃতি করতে করতে পূজা মণ্ডুপ প্রদক্ষিণা করতে হয়, যতক্ষণ না মাকড়সার আগমন ঘটে।
তবে সাধারণত: এতদূর কষ্ট স্বীকার করতে হয় না। স্বাভাবিক ভাবেই পূজারম্ভ-কালে মাকড়সার আবির্ভাব ঘটে। এই রকম কোন পূজায় কখনও কোন মাকড়সা আসেনি এরুপ ব্যাপার কখন ও ঘটেনি।
পূজা শেষে রুরি লুখাক সকলে এসে দানঘরে আসন গ্রহণ করেন। তখন অবশিষ্ট অন্নব্যঞ্জন ভাগ করে কিছুটা নিজেদের জন্য রেখে বাকিটা দশের খাওয়ার জন্যে মাটিতে নামিয়ে দেওয়া হয়। আর তখন থেকে মদ, জগরা এবং খানাপিনা চলতে থাকে।
থান্ মানা
সম্বৎসরে একবার প্রতি চাকমা পাড়ায় থান্ মানা পূজা করা হয়ে থাকে। এ’টি একটি সমষ্টিগত পূজা। পাড়ার প্রত্যেক গৃহস্থই এতে অংশ গ্রহণ করে থাকে।
তবে বিশেষ কারণে কাউকে সমাজে একঘরে করা হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির এই পূজায় অংশগ্রহণ করার অধিকার থাকেনা। অনেকে একে গঙাপূজা বা গাঙ্ পূজাও বলে।
এই পূজার উদ্দেশ্য বহুবিধ যেমন – পাড়ার ধনৈশ্বর্য্য বৃদ্ধি রোগ মহামারী ইত্যাদি থেকে পরিত্রাণ, অজন্মার সময় সুবৃষ্টি কামনা ইত্যাদি ইত্যাদি। এই পূজা ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের মধ্যেও প্রচলিত আছে যদিও পূজা পদ্ধতিতে কিছুটা বিভিন্নতা রয়েছে।
চাষের ধান গোলায় উঠলে সুদিনে সুক্ষণে পাড়ায় পাড়ায় এই সম্মিলিত পূজা অনুষ্ঠান করা হয়ে থাকে। এ পূজায় একসঙ্গে চৌদ্দজন দেবদেবীর পূজা করা হয়।
তাদের মধ্যে প্রধানা হলেন পূর্বে বর্ণিতা গঙ্গাদেবী। তারপরে আসেন বিয়াত্রা, যিনি গঙ্গার স্বামী, ভূত, যিনি একাধারে গঙার ছেলে এবং সেনাপতি আহ্ত্যা, মোত্যা, বড়শিল্, মগনী আর সাত বোন কঙরী বা কুঙারী। যথা: বত্ কুঙারী (শীতল দেবী), জুরো কুঙারি (ওলা দেবী), শিব কুঙারী, বিনি কুঙারী, ওলু কুঙারী, ফুল কুঙারী এবং ক কুঙারী। এরা বিবিধ রোগ ব্যাধির জন্য দায়ী।
একই ভূমিকা নিয়ে এই সাতবোন কুমারী পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলেও পূজিত হয়ে থাকেন।
পাড়ার লোকের সামর্থ্য বিবেচনা করে প্রথমে পূজার জন্য একটা বাজেট তৈয়ার করে নিতে হয়। ঐ হিসেবে প্রত্যেকের বাড়ী থেকে চাঁদা উঠিয়ে পূজার জন্য শূকর পাঁঠা ইত্যাদি যাবতীয় পূজার উপকরণ কেনা হয়ে থাকে।
অবস্থা বিবেচনা করে অনেক সময় এই পূজায় গঙার নামে মোষও বলি দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট দিন সকালবেলা পূজার উপকরণগুলো নিয়ে পাড়ার লোক ঘাটে এসে জড় হয়।
ঐখানে জলের কিনারায় পূজার জন্য প্রায় কোমর সমান উচু একখানা বাঁশের মাচান তৈরী করে তার উপর মাটি দিয়ে পূজার বেদী তৈয়ার হয়। বেতের ধ্বজা আর নানা রকমের বেতের কারু-কাজ দিয়ে এটাকে তখন সাজানো হয়ে থাকে।
এরপর অঝা মন্ত্রপাঠ করে ‘আগ্ পাতা’ ফেলে এক এক দেবতা এবং দেবীর উদ্দেশ্যে বলি দিতে শুরু করে। গঙা আর আহ্ত্যা ও মোত্যার জন্য পাঁঠা, ভূতের জন্য শুকর, বড় শীলের জন্য কবুতর, মগনীর জন্য হাঁস (অভাবে মুরগী) এবং বাকীদের সবার জন্য একটা মোরগ বলি দিতে হয়।
গঙার জন্য মোষ বলি দেওয়া হলে মোত্যাও তাতে অংশ পায়। গঙা শুকর বলি গ্রহন করে না। ভূতের আবার পাঁঠা চলে না। এমনি বাছবিচার রয়েছে এদের মাঝে। কথিত আছে, বিয়াত্রারও নিষেধ আছে বলেই গঙা শুকর বলি গ্রহণ করে না, কিন্তু খাওয়ার বিষম লোভ আছে।
তাই অনেক সময় মরণাপন্ন রোগীর রোগ মুক্তির জন্য শুকরের গায়ে পিটুলি মাখিয়ে গভীর রাতে সকলের অগোচরে এবং সম্ভত: বিয়াত্রারও অগোচরে সাদা শুকর গঙার নামে বলি দেওয়া হয়। এভাবে স্বামী ভাঁড়িয়ে শুকর খেয়ে গঙা নাকি খুবই প্রীত হয়ে থাকেন। তাই অনেক সময় রোগী নাকি ধীরে ধীরে নিরাময় হয়ে উঠে।
পূজা শেষে সাধারণত গ্রামের প্রান্তে কোন ছায়া বহুুল বড় গাছের নীচে বলি দেওয়া পশুপাখীর মাংস রান্না করা হয়। এখানে কিন্তু ভাত রান্না করা হয় না।
এটাও এই পূজার বিশেষত্ব। মাংস রান্না হয়ে গেলে পাড়ার ছেলে বুড়ো সবাই যে যার বাড়ী থেকে ভাত এনে এখানে সরকারী ভোজে শরিক হয়। ভোজের সময় মদ অপরিহার্য আর সেটা প্রায় প্রত্যেকক বাড়ী থেকেই প্রচুর পরিমাণে সরবরাহ করা হয়ে থাকে।
এই সমষ্টিগত পূজা আর সম্মিলিত ভোজের মাধ্যমে গ্রামবাসীদের মধ্য একতা, সহযোগিতা আর ভ্রাতৃত্ব সুলভ মনোভাব বৃদ্ধি পায়। এটা যেন পূজার ভিতর দিয়ে গ্রামের সকলের আনন্দের জন্য একটা পিকনিকের বিধান দেওয়া হয়েছে।
এতে আর কিছু না হোক সম্বৎসারে অন্তত একবার সমস্ত গ্রামবাসী একত্রে মিলে সব কাজ, সব চিন্তা ভাবনা একপাশে ফেলে রেখে সারাদিন প্রচুর আনন্দ উল্লাস আর হৈ হল্লার মধ্যে দিয়ে অবকাশ যাপনের সুযোগ পায়।
মালেইয়া
মালেইয়া ঠিক কোন পূজা পার্বণ নয়। এটি চাকমাদের একটি প্রাচীন সামাজিক রীতি, এখন প্রায় লোপ পেতে চলছে। এতে কোন দেবতার পূজা হয় না। কোন গৃহস্থ যদি কোন কাজে পিছিয়ে থাকে, ইচ্ছে করলে সে পাড়ার লোকের সাহায্য নিতে পারে।
হয়ত কোন কারণে কারও জুম কাটা দেরি পড়ে গেছে; ঠিক সময়ে জঙ্গল কাটা না হলে কাটা জঙ্গল শুকাবেনা, ভালো পোড়া যাবেনা, ফলে ভাল ফসলও হবে না।
তখন পাড়া পড়শীর সাহায্য নিয়ে সে কাজে সমতা আনতে পারে। সেক্ষেত্রে সে পাড়ার ঘরে ঘরে গিয়ে সাহায্য আবেদন জানিয়ে আসে। তার পরদিন প্রতি বাড়ি থেকে দা, কুড়াল নিয়ে এক একজন লোক এসে তার কাজটা একদিনে সম্পন্ন করে দিয়ে যায়।
এদের কোন মজুরী দিতে হয় না। শুধু খানাটা দিলে চলে। তা’ অবশ্যই একটু ভালোই দেওয়ার রেওয়াজ আছে। তখন এ উপলক্ষে সে বাড়িতে ছোটখাট একটা ভোজের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
গৃহস্থের অসচ্ছলতা থাকলে কিন্তু অনেক সময় এমনিই সবাই কাজ করে দিয়ে আসে। জুমে নিড়ানি দেওয়ার বেলায় কিংবা ফসল কাটার সময়ও মালেইয়া ডাকা হয়।
নিসন্দেহে এটি একটি খুব ভালো প্রথা এতে পারস্পরিক সহানূভূতি আর সহযোগিতার মনোভাব বৃদ্ধি পায়, সামাজিক বাঁধন সুদৃঢ় থাকে। এক কথায় এই প্রথা প্রাচীন চাকমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্যেরই পরিচয় বহন করে। এমন সহজ ভাতৃত্ববোধ সভ্য জগতের আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
এই প্রসঙ্গে পুরনো দিনের মিজোদের একটা ব্যাপার এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ব্রিটিশ শাসনের প্রথম দিকে মিজোদের মধ্যে কারো কোন অপরাধে জেলের হুকুম হলে তখন তার যতদিনের জেলের মেয়াদ তার ততজন আত্মীয় এসে জেলে কাজ করে দিয়ে দিনে দিনে তাকে খালাস করে নিয়ে যেত। ব্রিটিশ গভর্নমেন্টও তাদের সরলটা দেখে তাই মেনে নিতেন। এটাও তাদের একধরণের মালেইয়াই বলা চলে।
আহল্ পালানী
প্রত্যেক বছর ৭ আষাঢ় অম্বুবাচী প্রবৃত্তি থেকে তিন দিন চাকমারা হালচাষ বন্ধ রাখে। হিন্দুমতে এই সময় বসুমতি ঋতুমতী হয় আর তার উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি পেয়ে শস্যধারণ ক্ষমতা জন্মে। এই কয়দিন হালকর্ষণ কিংবা কোন প্রকার মাটি খোঁড়াখোঁড়ি নিষিদ্ধ।
এই সময়ে চাকমারা অন্য কোন কাজকর্ম কিংবা মুজুরীও করে না। সবাই বাড়ী বাড়ী ঘুরে মদ খায় আর আমোদ ফূর্তি করে অবসর যাপন করে। এই উৎসবকে বলে আহল্ পালানী। অর্থনৈতিক কারণে তিনদিন কাজকর্ম বন্ধ রাখা এখন অবশ্য সকলের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই কেউ কেউ হয়ত একদিন মাত্র এই উৎসব পালন করে থাকে।
লেখকঃ শ্রী বঙ্কিম কৃষ্ণ দেওয়ান
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।