গাছ কাটা ছিল বাঁধের প্রথম ধাপ

Jumjournal
Last updated Dec 10th, 2020

613

featured image

আমার নাম মহেন্দ্র চাকমা কিন্তু আমি দেশ ছাড়ার পর বরপরং ক্যাম্পে বলেছি মহেন্তু চাকমা । আমার বয়স এখন কম করে হলেও ৭৯ বছর হবে। আমরা দেশ ছেড়েছি ১৯৬৪ সালের দিকে।

কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ হবার আগে পুরনাে ১৭নং ঘণমন মৌজা যেটি দেওয়ানদের মৌজা নামেও বিখ্যাত ছিল সেই মৌজার বাসিন্দা ছিলাম আমরা। আমাদের মৌজা প্রধান ছিলেন শশীমােহন দেবান। আমাদের গ্রাম ছিল কাজলং পারে। পুরাতন মারিশ্যার বাসিন্দা ছিলাম আমরা। সেই গ্রামটি পরে বাঁধের পানির তলে ডুবে যায়।

১৯৫৪ সালের দিকে আমরা প্রথম জানতে পারি কাপ্তাই বাঁধের কথা। বাঁধ হবে পানি আসবে কোন জায়গা পর্যন্ত পানিতে ডুবে যাবে সেসব দাগ দেয়া হয় প্রথমে তারপরতাে গাছ কাটিং হয়। গাছ কাটিং হয়েছিল ১৯৫৯ সালের দিকে।

গাছ কাটিং করার আগে জায়গায় জায়গায় গিয়ে নির্ধারণ করে আসা হয়েছিল বড় লম্বা গাছগুলােকে। পরে সেসব বাগান বাগিচা গাছপালা আরেকদল এসে কেটে ফেলে। কেটে ফেলার কারণ ছিল পানি হয়ে যাবার পর যাতে নৌকা লঞ্চ চলাচলে বাধাগ্রস্ত না হয়।

আমি কাপ্তাই পেপার মিল (কেপিএম)-এর চাকরি করতাম সুপার ভাইজার হিসাবে। তাই গাছ কাটিং-এর সময় আমি নিজেই কাটি। আমার সাথে হাষে গােজার ধনঞ্জয় বাবুও ছিলেন তিনি আমাদের দলনেতা, কাটিং-এ অনেক চাকমা কাজ করেছিল চেঙেই (বর্তমান খাগড়াছডি) মগবান থেকেও কাজ করতে এসেছিল। চাকমা যারা গাছ কাটিং কাজ করতেন তারা সকলে রাঙামাটিতে থাকতেন। গাছ কাটিং-এর কাজে বাঙালি এবং বিদেশিরাও ছিল ।

তখনকার অবস্থা

আমাদের গ্রামে একটা প্রাইমারি স্কুল ছিল ক্লাস ৫ পর্যন্ত পড়াশুনা করা যেতাে। আমাদের স্কুলে হেড টিচার ছিলেন সুরেন্দ্র মাস্টার। তাঁর কাছেই আমার লেখাপড়া শেখা। তখনতাে পড়াশুনা নিয়ে মা-বাবাদের মধ্যে সচেতনতার অভাব ছিল।

তাই মেয়েদের লেখাপড়া শেখা ছিল খুব কঠিন। তাদেরকে সংসারের কাজে লাগানাে হতাে আর বেইন বুনাতে পারদর্শী করে তুলতাে। বেইন বুনাতে পারদর্শী হলে সেই মেয়ের বিয়ের কোনাে ঝামেলা হতাে না। গ্রামের মেয়েরা পিনন খাদি পরতাে আর ছেলেরা গামছা, তেন্যা হানি আর বয়স্করা ধুতি পরতাে (সামর্থ্যবানরা)।

তবে যতদূর মনে আছে এলাকার স্বচ্ছল পরিবারের নারীরা বাইরে গেলে শাড়ি পরতেন। তবে আমার পরিবারের কাউকে আমি শাড়ি পরতে দেখিনি। বরং এখন এই পেচারতলে আমার পরিবারের নারীরা মাঝে মাঝে শাড়ি পরে থাকে।

সত্যি বলতে কী, আমরা অনেক জমির মালিক ছিলাম না। কাপ্তাই বাঁধ হবার আগে মাত্র ৭ কানি জমি ছিল আমাদের। তাই কাপ্তাই বাঁধের পর কাজলং-এ এসে আমি সেই ৭ কানি থেকে আরাে এক কানি মােট ৮ কানি জমি পেয়েছিলাম।

আমাদের পরিবারে আমরা তিন (৩) ভাই। পুরাতন জায়গা থেকে আমরা বাঘাইছড়ি উপরে জীবংগা ছড়া এখন নাকি বাবু পাড়া নাম হয়েছে সেই জায়গায় বসতি গড়ে তুলি।

আমাদের গ্রামের পাশে শিলাব ছড়া গ্রাম এরপরে হুরু হুত্যা বংশের মানুষের আদাম মানে গ্রাম। কাপ্তাই বাঁধ করবে এই সিদ্ধান্তের পর তকালীন পাকিস্তান সরকার সার্ভেয়ার দিয়ে (যারা ছিল সকলেই বাঙালি) এলাকার কোন কোন জায়গা পানিতে ডুবে যাবে সেসব কাগজে কলমে নকশা করে নিয়ে যায়। আমাদের গ্রামের অধিবাসীরা সকলেই চাকমা। তবে কাট্টলী বাজারে কিছু সংখ্যাক দোকানদার ছিল বাঙালি।

এলাকার লােকেরা অনেকে সার্ভেয়ারদের কথা বিশ্বাস করেছে অনেকে আবার পাত্তাই দেয়নি। দূর পানি কি এতদূরে আসতে পারে! যতসব মিথ্যা কথা বলে উড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করেছি। আমাদের একটা অনেক বড় বড়ুই গাছ ছিল সেটির একেবারে মাথার উপর কাপড় উড়িয়ে দিয়ে বলেছিল এইটুকু পর্যন্ত পানি হবে। এবং সত্যি সত্যি তাই হয়েছে। বাঁধের পানিতেই সব ডুবে গেল আর আমরা জায়গা ছাড়া হলাম।

জায়গা জমির ক্ষতিপূরণ

আমি যতটুকু জানি, ডুবে যাওয়া জায়গা জমির ক্ষতিপূরণ অনেকে পেয়েছে আবার অনেকে পায়নি। তবে লাভবান হয়েছে ধূর্ত বা চালাক ব্যক্তিরাই।

সেসব ব্যক্তি নিজ বাড়ি থেকে দূরের কোন এক পাহাড়ি কলা বাগান বা গাছের বাগানকে সার্ভেয়ারদের আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে ‘ঐ বাগানটাও আমার’। আর সার্ভেয়ার সেটা তার নামে দেখিয়ে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। এবং বেশ কিছু টাকা নিজের পকেটে ঢুকিয়েছে।

অথচ অনেকে নিজের আসল বাগানের দামও পায়নি। যেমন আমাদের গ্রামের সুচিত্র চাকমা সে তার বাড়ির পাশের জঙ্গলের কলা বাগানকে নিজের বলে অনেক টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছিল।

কারণ জঙ্গলের কলাবাগানটা ছিল বিশাল। এভাবে যে যেভাবে পেরেছে সুযােগ কাজে লাগিয়েছে। ১৯৫৭ এবং ১৯৫৮ সাল এই দুই বছর আমি কাপ্তাই বাধে কাজ করেছি। পরে তাে কর্ণফুলি পেপার মিলে চাকরি নিয়ে কিছুদিন কাজ করেছি।

শুনেছি এখন নাকি পেপার মিলে কোন পাহাড়িকে ঢুকতে দেয় না। কেপিএমে কাজ করার পর আবার সার্ভেয়ারের চাকরি নিয়ে কুমিল্লার ময়নামতিতে চলে যায়।

কাপ্তাই বাঁধের শ্রমিক

কাপ্তাই বাঁধে শ্রমিক হিসাবে ছিল মূলত বাঙালিরা। তখনতাে চাকমারা শ্রমিক হিসাবে কাজ করতাে না। তারা কারাের দাস হিসাবে থাকতে অভ্যস্ত ছিল না। নিজেরা কায়িক পরিশ্রম করে যা পেতাে তাই দিয়ে সংসার চালাতাে। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস সেই আমরাই দেশ ছেড়ে এসে ভারতে স্থানীয় লােকদের বাড়িতে কাজের জন্য ধরনা দিতাম নিজের প্রয়ােজনে।

এবার বাঘাইছড়ি

কাপ্তাই বাঁধের পানি আসার আগেই আমরা আমাদের গ্রাম ছেড়ে চলে আসি। এর আগেই একবার এসে জায়গা দেখে শুনে ঠিক করে যায়।

পরে আবার ১৫/১৬ জনের এক গ্রুপ এসে আমরা ঘন জঙ্গল কেটে বসবাসের উপযােগী করি। তখন আবিন কানুনগােরাই এসে এই জমি আমাদের মধ্যে ভাগ করে দেয়।

ভগবানের আশীর্বাদে আমাদের নিজেদের চেষ্টায় আমরা ভালাে জায়গা পেয়েছিলাম। পেডি ল্যাভও পেয়েছিলাম। যা অন্য অনেকের ভাগ্যে জুটেনি।

আমাদের গ্রামে বাঙালি না থাকলেও কালী বাজারে কয়েকজন বাঙালি দোকানদার ছিল। নতুন জায়গায় বাঘাইছড়িতেও এসে দেখি এখানে না দোকানদার আছে।

আরও কিছু মুসলমান বাঙালি আমাদের সাথে বাঘাইছড়িতে বসত করেছে। আমরা সকলে তাদেরকে বলতাম রিফুজি মুসলমান। অত্র ৫ আমাদের কাছে আতঙ্কের নাম। এরাই আসার পর আমাদের অধিকার কমে যায়। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আইয়ুব খান তাদেরকে পাহাড়ে ঢুকিয়ে দিয়ে আমাদের সুযােগ সুবিধা কেড়ে নেয়।

একজন কসুম চাকমা এবং বর-পরং যাত্রা

কসুম বাবু, কসুম চাকমা আমার এক ক্লাস সিনিয়র ছিলেন। তখনো আমি বিয়ে করিনি। আমরা এক সাথে তুলাবান স্কুলে পড়তাম। সে তখন থেকেই মেধাবী ও চৌকুষ ছিল। এরপর সে রাঙামাটির হাই স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করে। আমরা স্কুলে তাকে লুকিয়ে লুকিয়ে বর্মা পাগলা ডাকতাম।

সেখানে সে এক হিন্দু মেয়ের প্রেমে পড়ে। কিন্তু হিন্দু মেয়েটির বাবা কিছুতেই এই সম্পর্ক মানবে না, তাই মেয়েটাকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু মেয়েটির পিছু পিছু কসুম বাবু কলকাতায় যাওয়ার চেষ্টা করে। সেটা জানার পর হিন্দু মেয়েটির বাবা তখন কসুম বাবুর বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে নালিশ করে।

এই নালিশের ভিত্তিতে পুলিশ তাকে খোঁজা শুরু করলে কসুম বাবু বাঘাইছড়িতে পালিয়ে আসে। সে বুঝতে পেরেছিল সে আর রাঙামাটি ফিরতে পারবে না, তাই ভারতে যাওয়ার জন্য সে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে শুরু করে।

আমার মনে হয়ে তার কারণেই আমরা দেশ ছাড়তে সাহস পেয়েছিলাম। সে আমাদের বুঝাতাে যে হারে বাঙালি ঢুকছে পাহাড়ে কিছুদিন পর আমরা এখানে সংখ্যালঘু হয়ে যাবাে।

ওরা সব আমাদের জায়গা-জমি কেড়ে নিবে। আমাদের ভারতে পালিয়ে যেতে হবে। আমাদের অস্তিত্ব এখানে থাকবে না যদি আমরা পাকিস্তান ছেড়ে চলে না যায়।

সে ছিল ভীষণ একরােখা। আমরা তার কথা শুনতাম এবং ভাবতাম। কিন্তু কিছুতেই সাহসে কুলাতােনা দেশ ছাড়ার। জীবনে কখনাে চেঙেই কূলেই যাইনি, এ যে একেবারে ভারত।

কিন্তু আমরা না গেলে কী হবে প্রতিদিন কয়েক পরিবার করে নানা জায়গা থেকে মানুষ আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে ভারতে চলে যেতে লাগলাে। আমরা দেখতাম আর দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম।

ছােট ছােট বােচকা ছােট বাচ্চা কাঁধে কোলে নিয়ে মানুষজন যাচ্ছেই তাে যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলে বলতাে ভারতে দেমাগ্রী যাচ্ছি। এর আগে কসুম বাবু ভারতে গিয়ে সেখানকার অফিসারদের সাথে আলাপ করে ভারতে চলে যাবার দরজা খুলে দিয়ে এসেছে।

এরই ভেতর আমরা ভারতে চলে যাবার জন্য কতবার নিজেদের সম্পত্তি বিক্রি করেছি আবার না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে সেই সম্পত্তি কিনে নিয়ে ফেরত নিয়েছি। যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে কসুম বাবু ও অন্যদের সাথে আলােচনা ফলপ্রসূ না হবার কারণে।

এরকম বেশ কয়েকবার হয়েছে আমাদের। সেটা এক বছরের মধ্যে। কিন্তু প্রতিদিন দেখতে হতাে মানুষের যাওয়া এটা দেখে আমাদেরও মন কেমন উদাস আর ভবিষ্যতের কথা ভেবে খারাপ হয়ে যেতাে।

প্রতিরাতে কুকুর ডাকলেই আমাদের কাজ ছিল ঘর থেকে বের হয়ে ভারতে চলে যাওয়া লােকদের দেখা। প্রথম দিকে গেছে অভাবি মানুষেরা। যারা কাজ করতে পারতাে না, অলস টাইপের লােকেরা। শুনেছে যে ভারতে গেলেই ভারত সরকার খেতে দেবে জায়গা দেবে। তাই যাওয়া।

অবস্থাপন্ন পরিবারের লােকেরা প্রথম দিকে দেশ ছাড়েনি। বঙলতলী, রুপকারী, বাঘাইহাট পরে চেঙেই মেইনি থেকেও লােক আসছিল । সবাই শুনেছে চাকমা রিফুজিদের জন্য ভারত সরকার দরজা খুলে দিয়েছে গেলেই জায়গা আর খাবার পাওয়া যাবে। এভাবে দেখতে দেখতে আমাদের মনও দুর্বল হয়ে গেল।

দেমাগ্রী যাত্রা

তাই একদিন আমাদের পরিবারের প্রতিনিধি হয়ে আমি দেমাগ্রীতে চলে আসি। আমার বড় দাদা বললেন যাও তাে একবার দেখে এসাে কী অবস্থা। দেমাগ্রীর চম্পাতলীতে এসে দেখি সে এক এলাহী কাণ্ড। যেন বুদ্ধ মেলা বসেছে। মানুষ আর মানুষ।

যে যেভাবে পারে সেভাবে বাসা বেঁধেছে। হাজারে হাজারে মানুষ। লিডার জাতীয় একজন বললাে ১৭/১৮ হাজার লােক এখন। সেটা ১৯৬৪ সালের প্রথম দিকের কথা। বিজুর আগের কথা।

আমি এসব দেখে এখান থেকে দাদার কাছে চিঠি দিলাম সব কিছু বর্ণনা দিয়ে। লিখলাম ‘এতাে হাজার হাজার মানুষ যদি এখানে এসে মরতে পারে তাে আমরা পারবাে না কেন। তােমরা আসতে চাইলে চলে আসে। সেখানেও কষ্ট করে কামাই করতে হবে এখানেও।

সেখানে বাঙালির ভয় আছে, এখানে কারাের ভয় নাই । চলে আসসা। আমার চিঠি পেয়ে আমার ভাইয়েরা পরিবারের সকলকে নিয়ে দেমাগ্রীতে চলে আসলেন। আমি তাে আগে ভাগেই দেমাগ্রীতে চলে এসেছিলাম। আমাদের আত্মীয় খুজে সেখানেই জায়গা নিলাম । কারণ ভগগান বুদ্ধ বলেছেন স্ব-জাতির ছায়া সুশীতল।

দেমাগ্রী টু নেফা : ক

দিনে দিনে দেমাগ্রীতে মানুষ বেড়ে যাচ্ছিল তখন হঠাৎ একদিন ভারত সরকারের লােক এসে জানাল আমাদের আর এখানে রাখা হবে না, নেফা নিয়ে যাবে। এখন সবাই নেফাকে অরুণাচল বলে।

কোথায় নেফা কত দূর কেমন সেসব কিছুই জানি না আমরা। সরকার নিয়ে যাবে তাই যেতে হবে। যাওয়ার সুবিধার্থে ভারত সরকার মানুষদের মােট ২২ গ্রুপে ভাগ করে। আমি ১৯ নম্বর গ্রুপের আমাদের সব গ্রুপের নেতা ছিলেন কসুম চাকমা।

এরই মধ্যে ভারত সরকার একটা পলিসি নেয় যে, যেহেতু কসুম চাকমার নেতত মানুষ মেনে নিয়েছে তাই তাকে বেশি নেতাগিরি করতে দেয়া যাবে না । না বসিয়ে রাখতে হবে একটা কিছু দিয়ে।

নাহলে মানুষদেরকে ইচ্ছেমতাে ব্যবহার করতে পারবে না। তাই দেমাগ্রীতে তাকে একটা এসআই চাকরি দেয়া হলাে। এদিকে ভারত সরকার আমাদেরকে নিয়ে নেফার পথে রওয়ানা দিলেন। দেমাগ্রীতে বসে কসুম চাকমা ভাবলাে আমি এখানে থেকে কী করবাে। পরে সেও চাকরি ফেলে নেফার পথে রওয়ানা দেয়।

খ. দেমাগ্রী থেকে মিজোরাম

ভারত সরকার আমাদের নেফা নিয়ে যাচ্ছে। দেমাগ্রী থেকে মিজোরামের রাজধানী আইজল পর্যন্ত পুরােটাই ছিল হাটা পথ। ক’দিন লেগেছে আমার মনে নেই। তবে ট্রানজিট ক্যাম্প হিসাবে নির্দিষ্ট দূরত্বে বানিয়ে রেখে দিয়েছিল।

খাবারের জন্য চাল ও অন্যান্য জিনিস দিয়েছিল আমরা নিজেরাই রান্না করে খেতাম। এভাবে একদিন আমরা আইজলে পৌছালাম। আমরা সকলেই হেঁটে আসলেও যারা অসুস্থ বৃদ্ধ আর শিশু ছিল তাদের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু আসার কষ্টটা ছিল খুব।

যদিও মেডিকেল টীম ছিল সাথে নিরাপত্তার জন্য পুলিশ ছিল। একএকটা গ্রুপে ১২/১৩ জন সৈনিক থাকতাে। কিন্তু কষ্ট তাে কষ্ট। আসার সময় এক গর্ভবতী নারীকে দেখেছি রাতে সন্তান জন্ম দিয়েছে সকালে বাচ্চাকে কোলে করে কাল্যোং* পিঠে নিয়ে আবার হাটতে হয়েছে। তাদের জন্য গাড়ীর ব্যবস্থাও ছিল না।

অনেকের গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়ে গিয়েছে। অসুখে মারা পরেছে। আমার সাথে একটা পরিবার ছিল তাদের সন্তান মারা গেল সে সন্তানের বাবা মাকে হাঁটতে বাধ্য করা হয় আমাকে বলা হয় এই বাচ্চাকে মাটি চাপা দেবার জন্য।

আমি মাটি চাপা দিয়ে আবার গ্রুপে যােগ দিলাম। সেসব বলার নয়। দেমাগ্রী থেকে আইজল আসার পথে মােট ১৯ টার মতাে বিশ্রাম ক্যাম্প তুলে দিয়েছিল সরকার। সেখান থেকে গাড়িতে করে আমাদের নেয়া হলাে বিভিন্ন ক্যাম্পে।

আসামের আনিপুর, মনাছড়া, শিলছড় ক্যাম্পে রাখা হলাে আমাদের ভাগ ভাগ করে। ত্রিপুরা শিবিরে যেসব চাকমারা ছিল তারা সম্ভবত দণ্ডকারণ্য/ বিহার গিয়েছিল। এখন স্পষ্ট আমার মনে নেই।

আমার গ্রুপে লােকসংখ্যা ছিল উনিশ শতের (১৯০০) মতাে। সেখান থেকে তিন পরিবার হিন্দু বাঙালি। তারা মনাছড়া ক্যাম্পে থেকে যাই। আমরা ডিরেক্ট আসামের আনিপুর ক্যাম্পে চলে আসি। এরপর ৪ দিন আমরা বিশ্রাম নিলাম।

আমার একদিন পর রেশন দেয়া শুরু করে ক্যাম্পের লিডাররা। রেশন বলতে ঘল শুটকি, তেল লবন আর কিছু কাপড়-চোপড় প্রথমদিন সরকার আমাদের জন্য রান্না করে দিয়েছিল। আমরা আনিপুর শিবিরে এন্ট্রি হলাম। এই আনিপুর ক্যাম্পে আমরা প্রায় তিন (৩) বছর ছিলাম।

গ. আনিপুর থেকে ত্রিপুরা

আমরা আনিপুর ক্যাম্পে তিন (৩) বছর থাকার পর ত্রিপুরাতে চলে আসি । ত্রিপুরাতে আসার পেছনে একটা কাহিনী আছে। সরকার চেয়েছিল আমাদের নর্থ ফ্রন্টিয়ার ডিভিশন (নেফা) নিয়ে যাওয়ার।

কিন্তু আমরা কেউ সেখানে যেতে চাইছিলাম না। আমরা চাইছিলাম ত্রিপুরাতে থাকতে কারণ ত্রিপুরাতে অনেক চাকমা বাস করেন তাছাড়া আমাদের ফেলে আসা জন্মভূমিরও কাছে।

এখানে থাকলে আমাদের আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে দেখা হবে আমরা বেড়াতে যেতে পারবাে দেশে। আর যারা নেফা দেখতে গেছে তাদের কাছে শুনেছি নেফাতে হিম করা ঠাণ্ডা। শুধু পাহাড় আর পাথর।

সব শুনে আমরা নেফার দিকে কেউ যেতে চাইছিলাম না। যারা নেফা গেছে তাদেরকে নাকি সেখানকার স্থানীয়রা ভয় পেতাে। তারা পাহাড়ে গেলে নাকি অস্ত্র হাতেই থাকতাে । কিন্তু চাকমারা শুধু একটা লাঠি নিয়েই পাহাড়ময় ঘুরে বেড়ায়। তাই ভাবতাে চাকমারা কত সাহসী।

তাে একদিন ক্যাম্পের লিডার আমাদের ডেকে বলে দিলযে নেফা না গেলে রেশন বন্ধ। এদিকে ক্যাম্পের গেটে গাড়ি রাখা আছে সবসময়। তাই একদিন রাতে আমরা ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে এলাম ত্রিপুরার উদ্দেশ্যে।

কুসুম চাকমার পরিণতি

কসুম চাকমা নেফায় আর সবার সাথে যােগ দেয়। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস সেখানকার নতুন চাকমা নেতারা তাকে নেফা থেকে বের করে দেয়। সে আগে ইন্ডিয়ান ইলিজিবিলিতি সার্টিফিকেট গ্রহণ করেনি তাই তাকে সেখান থেকে বের করে দেয়া সহজ ছিল।

আমি শুনেছি নতুন নেতা কৃপাধন চাকমারা ভেবেছে কসুম যেহেতু বড় লিডার সে থাকলে ছােট লিডাররা পাত্তা পাবে না তাদেরকে কেউ দাম দিবেনা। তাই কসুমকে কীভাবে অরুণাচল থেকে বের করে দেয়া যায় সে ষড়যন্ত্রে ছিল তারা এটা আমাদের চাকমাদের ছােট মনের হিংসা ছাড়া কিছুই না। সত্যি তাে সেতাে আসলে অল ইন অল ছিল । তখন অফিসিয়াল কাজ করলেও সে ছাড়া হতাে না আবার সামাজিক বিচার আচার কাজেও তাকে বাদ দিয়ে কর যেতােনা।

কারণ সে যুক্তি দিয়ে কাজ করে। তাই তাকে আমরা সবাই বিশ্বাস করতাম। এখন অরুনাচল চাকমাদের কোন ক্ষমতা নেই। সে যদি থাকতে হয়তাে ইতিহাস অন্যরকম হতাে। তারা হয়তাে নাগরিকত্ব পেতো। কসুমকে বের করে দেবার পর তাে জুনিয়ররা নেতা বনে গেছে। আমি যদ্দর জানি কসুম এখন তিন সুকিয়াতে আছে।

নতুন আবাস ত্রিপুরা

ত্রিপুরাতে আমরা চলে এলাম একেবারে খালি হাতে। কোন কিছু চিনি না জানি। শুধু এর আগে কয়েক পরিবার চাকমা ক্যাম্প থেকে এসেছিল তাদের মাধ্যমে এখানে আসা।

এখন খাবাে কী থাকবাে কোথায়? এই নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমরা ত্রিপুরাতে সত্যিকারের জীবন-সংগ্রামের লড়াইয়ে আবার ঢুকে পড়লাম।

জঙ্গলে গিয়ে গাছ কাটা লাকড়ি নিয়ে বাজারে যাওয়া কত কি করেছি বেচে থাকার জন্য। সেসব বলার নয়। এখানে আসার একটা ভালাে ফলও আছে। নেফাতে গেলে আমরা হয়তাে জায়গা জমি রেশন পেতাম। ভাল স্বাবলম্বী হতে পারতাম।

কিন্তু আমাদের ছেলে মেয়েরা নাগরিকত্বহীন হয়ে থাকতাে আজো। আমরা এখানে স্বর্বহারা বলতে স্বর্বহারা। কিছুই নেই কিন্তু নাগরিকত্ব পেয়েছি আর কঠিন পরিশ্রম করে ছেলে মেয়েদের লেখা পড়া শিখিয়েছি। আর এখান থেকে আমার জন্মভূমির সাথে সম্পর্ক রক্ষা করতে পেরেছি।

শেষ কালের ভাবনা। তেমন কোনাে ভাবনা নেই। দেশে ফিরে যাবার কোনে চেষ্টা আমি আগে করিনি সামনেও করবাে না। ওখানেতাে এখন ঝামেলা চলছে। বাদি লাম্বা গ্রুপে চাকমারা ভাগ হয়ে গেছে। এই গ্রুপ মারামারির ভেতরে আমি কেমন করে যাই বলাে। সেখানে আত্মীয় স্বজন ছাড়া আর কিছুই নেই আমার।

Mohendra Chakma
Mohendra Chakma

লেখকঃ মহেন্দ্র চাকমা, ১৯নং গ্রুপের নেতা, বর-পরং যাত্রা পেচারতল, আগরতলা, ভারত।

তথ্যসুত্র : “কাপ্তাই বাঁধ : বর-পরং – ডুবুরীদের আত্মকথন” – সমারী চাকমা।

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা