খিয়াং জনগোষ্ঠীর বিবাহ বিচ্ছেদ (যাং মালা খাওয়াল)
1109
খিয়াং বিবাহ বিচ্ছেদ
খিয়াং পরিবারে স্বামী ও স্ত্রীর বৈবাহিক সম্পর্ক বিচ্ছেদকে ‘যাং মালা খাওয়াল’ বলা হয়।
বিবাহ বিচ্ছেদের বিভি‘ন্ন পদ্ধতি
স্বামী কিংবা স্ত্রী যে কোনো একজনের মৃত্যুতে খিয়াং সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত একটি দাম্পত্য জীবন তথা বিবাহিত জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। তবে সমাজ ও আইন স্বীকৃত উপায়ে নিম্নবর্ণিত কারণে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে তাদের জীবদ্দশায়। বৈবাহিক সম্পর্কের পরিসমাপ্তি বা ‘হ্রি খাওয়েইয়াল স্’ হতে পারবেঃ-
ক) স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে গ্রাম প্রধান বা সমাজপতির উপস্থিতিতে ‘হ্রি খাওয়েইয়াল স্’ হতে পারবে।
খ) স্বামী-স্ত্রী একে অপরের বিরুদ্ধে পাড়া প্রধান বা সমাজপতির নিকট দ্বারস্থ হয়ে পাড়া প্রধান বা সমাজপতির উপস্থিতিতে কার্বারীর আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘যাং মালা খাওয়াল’ সম্পাদন করতে পারে।
পাড়ার কার্বারী বা সমাজপতির উপস্থিতিতে স্বামী-স্ত্রী উভয়ে ঘরের সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে একে অপরকে কাঠাল গাছের পাতা ফেরত দিয়ে বিবাহ বিচ্ছেদ দেবার রীতি খিয়াং সমাজে প্রচলিত আছে।
গ) খিয়াং সমাজের মধ্যে পাড়া প্রধান বা সমাজপতির উপস্থিতিতে কার্বারীর আদালতে অথবা কার্বারী আদালতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হেডম্যান আদালতে এবং হেডম্যান আদালতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সার্কেল চীফ আদালতের মাধ্যমে ‘যাং মালা খাওয়ালা’ সম্পাদন করা যায়।
‘যাং মালা খাওয়াল’ প্রদানের বিষয়ে সার্কেল চীফের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গণ্য হয়। যদিও অদ্যাবধি খিয়াং সমাজে ‘যাং মালা খাওয়াল’ সংক্রান্ত কোন প্রকার সামাজিক মোকদ্দমা হেডম্যান আদালতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সার্কেল চীফ আদালত পর্যন্ত গড়ায়নি।
কোন কোন ক্ষেত্রে স্বামী বা ‘হ্রি খাওয়েইয়াল স্’ দাবী করার অধিকার লাভ করে
নিমোক্ত কারণে খিয়াং সমাজে স্বামী বা স্ত্রী ‘হ্রি খাওয়েইয়াল স্’ প্রদানের অধিকার লাভ করেঃ-
ক) স্বামী যদি দৈহিক মিলনে অক্ষম বা পুরুষত্বহীন হয় কিংবা স্ত্রী গর্ভধারণে অক্ষম হয়, সেক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন যথোপযুক্ত ডাক্তারী পরীক্ষার সনদপত্র দ্বারা ‘যাং মালা খাওয়াল’ দাবী করতে পারে।
খ) স্বামী বা স্ত্রী যদি পরকীয়া প্রেম কিংবা ব্যভিচারে বা নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে লিপ্ত হয় তাহলে এ ধরণের অপরাধের জন্য যে কোনো একজন সামাজিক আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয় তাহলে অপরজন ‘যাং মালা খাওয়াল’ দাবী করতে পারে।
গ) স্ত্রীর সম্মতি বা অনুমতি ব্যতিরেকে স্বামী দ্বিতীয়বার বিবাহ করলে সেক্ষেত্রে সতীনের সাথে একত্রে বসবাসে অসম্মত হয়ে প্রথমা স্ত্রী সামাজিক আদালতের দ্বারস্থ হয়ে ‘যাং মালা খাওয়া’ দাবী করতে পারে।
ঘ) স্বামী বা স্ত্রী উভয়ের যে কেউ এক বছর নিরুদ্দেশ হলে এবং বহু বছর যাবৎ উভয়ের মধ্যে কোনো প্রকার দাম্পত্য সম্পর্ক বা পারিবারিক যোগাযোগ না থাকলে, সেক্ষেত্রে যে কোনো একপক্ষ তাদের সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘যাং মালা খাওয়াল’ সম্পাদন করে দ্বিতীয় বিবাহে আবদ্ধ হতে পারে।
ঙ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন যদি মানসিক বিকারগ্রস্ত অথবা বিকৃত রুচির হলে, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ তাদের সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘যাং মালা খাওয়াল’ প্রদান করতে পারে।
চ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন কৃত জঘন্য অপরাধে দন্ডিত হয়ে যদি দীর্ঘদিন কারাভোগে থাকে, সেক্ষেত্রে অপর পক্ষ দন্ডিত স্বামী বা স্ত্রীর সম্মতিতে তাদের সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘যাং মালা খাওয়াল’ দাবী করতে পারে।
ছ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একপক্ষ যদি বৌদ্ধ পুরোহিত বা বুংখুংমা হয়, সেক্ষেত্রে অপর পক্ষ একতরফাভাবে সামাজিক আদালতের মাধ্যমে ‘যাং মালা খাওয়ালা’ করতে পারে।
জ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একপক্ষ যদি নিষ্ঠুর প্রকৃতির, অহেতুক সন্দেহপ্রবণ, মাদকাসক্ত, অকর্মণ্য এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনকারী হয়, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘যাং মালা খাওয়ালা’ সম্পাদন করতে পারে।
ঝ) স্ত্রী যদি স্বামীর সংসারে প্রাপ্য ভরনপোষণ, ন্যায্য অধিকার, চিকিৎসা-সেবা ও পারিবারিক মর্যাদাসহ স্ত্রীর অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, সেক্ষেত্রে সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘যাং মালা খাওয়ালা’ করতে পারে।
ঞ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একপক্ষ যদি অবিশ্বস্ত বা অবাধ্য হয়, পারিবারিক দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রতিপালনে অনিচ্ছুক বা উদাসীন হয়, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘যাং মালা খাওয়ালা’ প্রদান করতে পারে।
বিবাহ বিচ্ছেদের (‘যাং মালা খাওয়ালা’) আইনগত ফলাফল
ক) সমাজ স্বীকৃত পদ্ধতিতে সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘যাং মালা খাওয়াল’ সম্পাদিত হলে স্বামী-স্ত্রী যে কেউ পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। এরূপ বিবাহ বহুবিবাহ হিসেবে গণ্য হয় না ।
খ) ‘যাং মালা খাওয়াল’ হবার পর স্বামী বা স্ত্রী এমনকি উভয়ের সম্মতিতে দৈহিক মিলন অবৈধ হয়। এরূপ দৈহিক মিলনের কারণে গর্ভজাত সন্তান অবৈধ হিসেবে গণ্য হয়।
গ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো পক্ষ দ্বারা ‘যাং মালা খাওয়াল’ সম্পাদনের পর পারস্পরিক সমঝোতা ও আস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ‘লাকশোঙ’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পূনঃ বৈধ বিবাহ দ্বারা সামাজিক স্বীকৃতি অর্জন করতে হয়।
তবে ‘যাং মালা খাওয়াল’ হবার পর উভয়ের মধ্যে যে কোনো একজনের অন্যত্র যদি বিবাহ হয় সেক্ষেত্রে দ্বিতীয় পক্ষের স্বামী বা স্ত্রীর অনুমতি/বিবাহ বিচ্ছেদ ব্যতিরেকে ‘যাং মালা খাওয়ালা’ প্রাপ্ত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পুনরায় ‘লাকশোঙ’ অনুষ্ঠান সম্পাদন অবৈধ হয়।
তবে বিবাহ বিচ্ছেদের পর উভয়ের মধ্যে পুনঃ বিবাহের নজির খিয়াং সমাজে নেই। ‘লাইতু’ খিয়াং সমাজে এরূপ পূনঃ বিবাহের ক্ষেত্রে সমাজকে এক বোতল মদ ও একটি শূকর অথবা সম পরিমাণ টাকা জরিমানা দিতে হয়।
ঘ) ‘যাং মালা খাওয়াল’ সম্পাদনের পর স্বামী ও স্ত্রী উভয়ে উভয়ের প্রতি পারস্পরিক অধিকার এবং কর্তৃত্ব হারায়।
ঙ) ‘যাং মালা খাওয়ালা’ সম্পাদনের পর স্ত্রী তার পূর্ব স্বামীর উত্তরাধিকারসহ পারিবারিক পদবী ও মর্যাদা হারায়।
চ) ‘যাং মালা খাওয়াল’ সম্পাদনের সাথে সাথে স্ত্রী তার স্বামীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের উপর অধিকার হারায় তবে স্ত্রীর আর্থিক অসঙ্গতি কিংবা অসুস্থতার কারণে চিকিৎসার জন্য সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে যুক্তিসঙ্গত সময়ের জন্য স্ত্রী খোরপোষ পায়।
বিচ্ছেদকালে স্বামী স্বেচ্ছায় কোনো সম্পত্তি দান করলে স্ত্রী সেই সম্পত্তি পায় এবং স্ত্রীর অধিকারে থাকা সন্তান সেই সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়।
ছ) ‘যাং মালা খাওয়াল’ সম্পাদনের পর স্ত্রীর সম্পদের উপর স্বামীর অধিকার থাকবে না এবং স্বামী সরকারী চাকুরীজীবি হলে, তার মৃত্যুর পর ‘যাং মালা খাওয়াল’ প্রাপ্ত স্ত্রী পেনশন সুবিধা হতে বঞ্চিত হয়।
জ) স্বামী বা স্ত্রীর দোষে যদি বিবাহ বিচ্ছেদ হয়, সেক্ষেত্রে সামাজিক আদালত দোষী স্বামী বা স্ত্রীকে এককালীন অর্থদন্ড বা ভরনপোষণবাবদ স্ত্রীকে অর্থ প্রদানে বাধ্য করতে পারে।
‘যাং মালা খাওয়ালা’ সম্পাদনকালে স্ত্রী গর্ভবতী অবস্থা
‘যাং মালা খাওয়াল’ বা বিবাহ বিচ্ছেদের সময় স্ত্রী যদি গর্ভবতী অবস্থায় অনাগত সন্তানের দায়-দায়িত্ব থাকে অথবা ‘খাং মালা খাওয়াল’ সম্পাদনের পর স্ত্রীর দ্বিতীয় বিবাহ সত্ত্বেও যদি ধাত্রী বিদ্যামতে প্রমাণিত হয় যে, বিচ্ছেদ পূর্ব সময়ে স্ত্রী গর্ভবতী ছিল, সেক্ষেত্রে ভিন্ন কিছু নিশ্চিত প্রমাণিত হওয়া পর্যন্ত জন্মদাতাকে পিতৃত্বের স্বীকৃতি দিতে হয়।
উক্ত সন্তান অবৈধ সন্তান হিসেবে গণ্য হয় না। পুত্র সন্তান হলে পিতার অধিকারে এবং কন্যা সন্তান হলে মায়ের অধিকারে রাখার নিয়ম খিয়াং সমাজে বিদ্যমান।
তবে সাবালক পুত্র-কন্যাদের সম্মতি এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পায়। যদি নাবালক সন্তান মাতার সাথে অবস্থান করে সেক্ষেত্রে সন্তানের পিতা ভরনপোষণ প্রদানে বাধ্য থাকবে এবং সন্তান তার পিতার উত্তরাধিকারী হয়।
সম্পত্তির উত্তরাধিকার বা ভাগ-বণ্টন হয় সামাজিক রীতি অনুসারে সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে। তবে সন্তান সাবালক না হওয়া পর্যন্ত বিচ্ছেদপ্রাপ্ত স্ত্রী তাকে নিজ হেফাজতে রাখার অধিকার পায়।
বিচ্ছেদপ্রাপ্ত স্ত্রীর অন্যত্র বিবাহ হলে তখন সন্তান যদি মাতৃদুগ্ধ পান করে তবে সন্তানের জন্মদাতা পিতা সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে নাবালক সন্তানের অভিভাবক হয়।
খ) বিবাহ বিচ্ছেদ বা ‘যাং মালা খাওয়াল’ সম্পাদনের তারিখ হতে পরবর্তী ২৮০ দিন পর বিচ্ছেদ প্রাপ্ত স্ত্রীর গর্ভে যদি কোনো সন্তান জন্মগ্রহণ করে, সেক্ষেত্রে ভিন্ন কিছু নিশ্চিত প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত বিচ্ছেদপ্রাপ্ত স্বামী উক্ত সন্তানের পিতৃত্ব গ্রহণে বাধ্য নয়। বিচ্ছেদপ্রাপ্ত স্ত্রীর গর্ভজাত এ ধরণের সন্তানের দায়-দায়িত্ব খিয়াং সমাজের রীতিনীতি অনুসারে সামাজিক আদালত নির্ধারণ করে।
তথ্যসূত্রঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আদিবাসীদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন (গ্রন্থনা ও সম্পাদনা – এডভোকেট জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, এডভোকেট প্রতিম রায়, সুগত চাকমা)।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।