
ভারতীয় চার্বাক দার্শনিকেরা মনে করতেন যে, অতীত মৃত-অতীত বিস্মৃত, আর ভবিষ্যত অনিশ্চত, একমাত্র বর্তমানই জীবন্ত ও নিশ্চিত – বর্তমান জীবনই একমাত্র জীবন।
তাই জীবনকে যথার্থভাবে উপভোগের ও আনন্দময় করার জন্য তারা বর্তমানকেই নির্বাচন করতে অন্যদের পরামর্শ দিয়েছেন।
কিন্তু বাস্তব নিরীক্ষণে দেখা যায় অতীতই আনন্দঘন, অতীতই স্মৃতিময়। স্মৃতি শুধু আনন্দই বহন করেনা, অজানার থলিতে কিছু জানার অভিজ্ঞতাও সঞ্চিত হয় বৈকি।
খাগড়াছড়ি সরকারী কলেজেও কালের আবর্তে একদিন স্মৃতি হয়ে দাঁড়াবে। তারপর স্মৃতি হয়ে দাঁড়াবে কলেজের কিছু নেপথ্য ইতিহাস, এই নেপথ্য ইতিহাসকে আগ্রহী অন্যদের জানানোর ক্ষুদ্র প্রয়াসে এ লেখনী।
তৎকালীন রামগড়, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান – এই তিনটি মহকুমা নিয়ে বর্তমান বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা গঠিত। পরবর্তীতে প্রশাসনিক সুবিধার্থে মহকুমার সদর দপ্তর রামগড় হতে খাগড়াছড়িতে স্থানান্তরিত করা হয়।
১০/১২টি ফিডিং হাইস্কুল থাকা সত্ত্বেও মহকুমায় উচ্চ শিক্ষার জন্য কোন কলেজ না থাকাতে স্থানীয় প্রশাসন ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ একটি বেসরকারী কলেজ প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন।
এরই আলোকে তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক (১৯৭৪) জনাব শামসুদ্দীন আহমেদ এর আহবানে বর্তমান সরকারী হাই স্কুলের হল কক্ষে এক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
মহাকুমার দূর-দূরান্ত থেকে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও এলাকার বহু বিদ্যুোৎসাহী লোক সভায় যোগদান করেন। উক্ত সভায় খাগড়াছড়ি কলেজ নামে একটি বেসরকারী কলেজ প্রতিষ্ঠা করার সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
উল্লেখ্য যে, সভায় উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ কলেজের জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে নগদ অর্থ প্রদান ছাড়াও তৈরি আসবাবপত্র প্রদানের অঙ্গীকার করেন।
ফলে অতি স্বল্প সময়ের মধ্যে কলেজের জন্য নির্ধারিত জায়গায় (বর্তমানে পানখাইয়া পাড়া হাই স্কুল অবস্থিত) বাশের বেড়া (বাত্তি লাগানো) ও টিনের ছাউনি দিয়ে কলেজ ঘরটি তৈরি শেষ হয়।
কলেজ ঘরের তৈরি শেষ হওয়ার সাথে সাথে কলেজ সংলগ্ন অধ্যক্ষ ও অধ্যাপকদের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হয়।
এর পরপরই কলেজের জন্য অধ্যক্ষ ও অধ্যাপকদের নিয়োগ দেওয়া হয়। অধ্যক্ষ হিসেবে যাকে নিয়োগ দেওয়া হয় তিনি হলেন জনাব হাবিবুর রহমান (এমএ বাংলা), যিনি বাংলার অধ্যাপক হিসেবে ক্লাস নিতেন।
আর বিভিন্ন বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যারা নিয়োগ পেলে তাঁরা হলেনঃ- জনাব প্রজ্ঞাবীর চাকমা (ইংরেজী), জনাব মোঃ ইব্রাহীম (অর্থনীতি), জনাব ফিরোজ আহমেদ (ব্যবস্থাপনা), জনাব বোধিসত্ত্ব দেওয়ান (যুক্তিবিদ্যা), জনাব বীরেন্দ্র বিজয় চাকমা (হিসাব বিজ্ঞান), জনাব অমূল্য রঞ্জন চাকমা (পরবর্তীতে ম্যাজিষ্ট্রেট, সীতাকুন্ড), তিনি অনারেরী ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে বহুদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। পরবর্তীতে মিসেস চন্দ্রিমা চাকমা ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে নিয়োজিত হন।
অফিস স্টাফ হিসেবে যারা নিয়োগ পেয়েছে তাঁরা হলো জনাব সম্রাটসুর চাকমা, মংসাজাই চৌধুরী ও হাফেজ আহমেদ।
অধ্যাপকদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়াতে পরবর্তীতে মিস্টার সুখময় চাকমাকে পৌরবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ হিসেবে নিয়োগ করা হয়, যদিও তিনি অর্থনীতি বিষয়ে এমএ।
কিছুকাল অধ্যাপনার পর তিনি চাকুরী ইস্তফা দিলে তৎস্থলে পৌরবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে স্থলাভিষিক্ত হন ডঃ সুধীন কুমার চাকমা, যদিও তিনি সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ে এমএ।
অতঃপর স্টাফ নিয়োগের কাজ শেষ হলে ১৯৭৫ সনের ১০ই মার্চ মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগে মোট ৬০ জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে একাদশ শ্রেণীর ক্লাস শুরু হয়।
উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে বিজ্ঞান শাখা ও স্নাতক শ্রেণী খোলা হয় কলেজটি বর্তমান স্থানে স্থানান্তরিত হওয়ার পর। এখানে উল্লেখ্য যে, কলেজে সমাজবিজ্ঞান বিষয়টি চালু হওয়ার পিছনে যে ব্যক্তিটির অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি হলেন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ডঃ সুধীন কুমার চাকমা।
যেহেতু ডঃ সুধীন সমাজবিজ্ঞানে এমএ সেহেতু সভাবতই তিনি পৌরবিজ্ঞানের বিষয়টি পড়িয়ে আত্মসন্তুষ্টি পেতেন না।
তাই তাঁর সবসময় প্রচেষ্টা ছিল সমাজ বিজ্ঞান বিষয়টি চালু করে নিজের পড়ালেখার বিষয়ে পাঠদান করা এবং পরবর্তীতে তিনি কলেজ পরিচালনা কমিটিকে প্রভাবান্বিত করে সমাজ বিজ্ঞান বিষয়টি প্রথমে স্নাতক ও পরে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে চালু করেন।
সমাজ বিজ্ঞান বিষয়টি বেসরকারী আমলে চালু না হলে অদ্যাবধি চালু করা সম্ভব হতো কিনা যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে।
কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কয়েক বছর পর কলেজ পরিচালনা কমিটি উপলব্ধি করেন যে, কলেজের জন্য নির্বাচিত জায়গাটি সঠিক হয় নি।
তার কারণ ছিল মূলত দু’টি, এক, স্থানটি শহরের এক কোণায় টিলার উপর অবস্থিত, দুই, কলেজটি সরকারী হলে একাডেমিক ভবন সম্প্রসারণ, ছাত্রাবাস সহ বিভিন্ন আবাসিক ব্যবস্থার জন্য অপর্যাপ্ত।
এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, স্থানটি নির্বাচনের সময় এই সমস্ত কিছু কমিটির কি ধারণা ছিল না? আমার জানা মতে এসমস্ত বিষয়ে কমিটির বেশ নজর ছিল। কলেজটি কোথায় হবে এই বিষয়ে যথেষ্ট মতবিরোধ ছিল।
শহরের দক্ষিণাঞ্চলের অধিবাসীরা চান কলেজটি সেদিকেই হোক অর্থাৎ শহর থেকে প্রায় আড়াই মাইল দূরে পাইলট পাড়া নামক স্থানে এবং এই উদ্দেশ্যে তারা প্রয়োজনীয় জমি দিতেও প্রস্তুত ছিলেন।
আর শহর ও শহরের উত্তরাঞ্চলের অধিবাসীরা চান কলেজটি শহরের মধ্যস্থলে হোক। এখানে মজার ব্যপার হল তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক জনাব শামসুদ্দীন কোন দলকে সন্তুষ্ট না করে বরং অনেকটা আপোষমূলক নিষ্পত্তির মাধ্যমে বিকল্প আরেকটি স্থান নির্ধারণ করে দিলেন।
ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে স্থান পরিবর্তন করার প্রশ্ন উঠে। যা হোক শহরের মধ্যস্থলে আরেকটি স্থান (বর্তমান কলেজটি যেখানে আছে) নির্বাচনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় জমি ক্রয় করে টিলার উপর থেকে টিন শেডটি বর্তমান স্থানে স্থানান্তরিত করা হয় ১৯৭৮ সনে।
পরবর্তীতে অর্থাৎ জাতীয়করণের আগে সরকারী অনুদানে একতলা পাকা ভবন তৈরি করা হয় এবং জাতীয়করণের পরে দ্বিতল ভবন তৈরি হয়।
প্রথম সাধারণ সভায় কলেজ পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মিঃ খুলারাম চাকমাকে মনোনীত করা হলেও পরবর্তীতে তাঁকে পরিবর্তন করে মিঃ অনন্ত বিহারী খীসাকে (তৎকালীন রামগড় হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক) মনোনীত করা হয়।
মিঃ খীসা এলাকার একজন বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর যোগ্য তৎপরতায় কলেজটি অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়।
১৯৮০ সনের পহেলা মার্চ তারিখে কলেজটি জাতীয়করণ না হওয়া পর্যন্ত তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে তাঁর দায়িত্ব পালন করে যান। জাতীয়করণ না হওয়া পর্যন্ত একটি বেসরকারী কলেজকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে মিঃ খীসার অবদান যেকোন ত্যাগীর অবদানকে নিঃসন্দেহে ম্লান করে দেয়।
কলেজটি ঠিকিয়ে রাখার এবং বর্তমান স্থানে স্থানান্তরিত করার ক্ষেত্রে যে দু জন সহকারী কর্মকর্তা সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন তাঁরা হলেন কলেজের উদ্যোক্তা মহকুমা প্রশাসকের পরবর্তী মহকুমা প্রশাসক জনাব খোরশেদ আনসার খান (তৎকালীন সভাপতি, কলেজ পরিচালনা কমিটি) ও তৎকালীন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেট জনাব আবুল বাশার।
জনাব খান মহকুমার বিভিন্ন অফিসে চাঁদা আদায়ের ব্যবস্থা করে কলেজের তহবিলের প্রতি সজাগদৃষ্টি রাখতেন। যার দরুণ কলেজ কোনদিন আর্থিক সংকটে পতিত হয় নি।
আর জনাব বাশার কলেজটি স্থানান্তর ও একতলা পাকা ভবন তৈরির সময় সার্বক্ষণিক তদারককারীর কাজ করে জনসেবামূলক অবদান রেখে গেছেন।
কলেজটি জাতীয়করণের সময় যারা বিভিন্ন বিষয়ে অধ্যাপনায় রত ছিলেন তাঁরা হলেন – জনাব মুজিবুল আলম চৌধুরী (অর্থনীতি), জনাব তাহের আহমেদ (অর্থনীতি) জনাব সিরাজুদ্দৌলা (রাষ্ট্রবিজ্ঞান), জনাব কাদের হোসাইন চৌধুরী (বাংলা), জনাব তাপস কুমার চৌধুরী (বাংলা), জনাব এম মফিজুর রহমান (ইতিহাস),
জনাব মধুমঙ্গল চাকমা (ব্যবস্থাপনা), জনাব আব্দুল মতিন চৌধুরী (হিসাববিজ্ঞান), জনাব আলী আজম (পদার্থবিজ্ঞান), জনাব হিরোহিত চাকমা (রসায়ন), জনাব স্বপন কুমার সাহা (গণিত), জনাব দিলীপ কুমার দাশ (জীব বিজ্ঞান), জনাব ফিরোজ আহমেদ (ব্যবস্থাপনা), জনাব ডঃ সুধীন কুমার চাকমা (সমাজবিজ্ঞান), জনাব ধীরেন্দ্র বিজয় চাকমা (হিসাববিজ্ঞান) ও জনাব বোধিসত্ত্ব দেওয়ান (দর্শন)।
আজ ‘৯২ এর শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়ে মনে পড়ে সেই ‘৭৫ এর স্থানান্তরিত টিন শেড এর কথা। তার পরিবর্তে গড়ে উঠেছে দ্বিতল পাকা ভবন।
আত্মীকৃত অধ্যাপকবৃন্দ অন্যত্র বদলি হয়ে দেশের বিভিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানুষ গড়ার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন, যেমন আছি আমরা এখানে কয়েকজন।
প্রতিষ্ঠিত অগণিত ছাত্রছাত্রী দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। প্রতিষ্ঠিত এসমস্ত ছাত্রছাত্রীদের সংবাদে আনন্দে বুক স্ফীত হয়ে উঠে এই ভেবে যে, সমাজের একজন সচেতন মানুষ হিসেবে সমাজের জন্য কিছু শিক্ষিত মানুষ উপহার দিতে পেরেছি, যারা যাই হোক সমাজের জন্য অমঙ্গল কামনা করে না।
লেখাপড়া শিখে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে জাতির জন্য ভাল কিছু করার মনোবৃত্তি নিয়ে আজকের ছাত্রছাত্রীরা আগামী দিনে দেশের গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিবে- এটাইতো শিক্ষককুলের প্রত্যাশা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পেছনে ত্যাগ স্বীকার করার স্বার্থকতা এখানেই নিহিত।
লেখক : বোধিসত্ত্ব দেওয়ান, সাবেক অধ্যক্ষ, খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজ।
তথ্যসূত্র : গৈরিক, খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজ বার্ষিকী, ১লা নভেম্বর, ১৯৯২।