আরণ্য জনপদের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক সনদের ছায়াতলে
745
বাংলাদেশে আদিবাসী পরিচয় পুনর্নির্মাণের দুই দশক (১৯৯৩-২০১৩)*
১।পটভূমি: একটি ফেরারি শব্দ
এই নিবন্ধকে দেখা যেতে পারে বাংলাদেশে বর্তমানে ফেরারি জীবন কাটাচ্ছে, এমন একটি শব্দের আখ্যান হিসাবে।
শব্দটি সবারই পূর্বপরিচিত, যার সাথে অনেকেরই সম্পৃক্ততা রয়েছে কমপক্ষে দুই দশক ধরে।
কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলিতে সরকারিভাবে এক প্রকার নিষিদ্ধ ঘোষিত এই শব্দটিকে লুকিয়ে ফেলার বা আড়ালে রাখার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় বিভিন্ন মহলে।
আমি বলছি ‘আদিবাসী’ শব্দটির কথা। খুব যে প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে এটির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, তা নয়, তবে এ সংক্রান্ত একটা গোপনীয় সরকারি প্রতিবেদনের খবর ফাঁস হয়ে গিয়েছিল বছর তিনেক আগে।
এর পাশাপাশি সরকারি মহলে শব্দটির উচ্চারণ কমে আসতে শুরু করে, এবং লিখিত রূপে এর ব্যবহার হতে থাকে আরো বিরল।
অন্যদিকে এনজিও মহলে দ্রুত জানাজানি হয়ে যায়, প্রকল্প সংক্রান্ত কাগজপত্রে ‘আদিবাসী’ শব্দ থাকলে এনজিও এফেয়ার্স ব্যুরোর অনুমোদন বা সরকারি অনুদান মিলবে না।
বিপাকে পড়ে যায় ‘আদিবাসী’ শব্দটি নামেই রয়েছে, এমন কিছু সংস্থা, যাদের মধ্যে নাম পাল্টে ফেলার মত ঘটনাও ঘটে!
আদিবাসী শব্দটির উপর কথিত নিষেধাজ্ঞার বিষয়টা ২০১১ সালে এসে আরো প্রকাশ্য রূপ নেয়।
সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা থাকুক বা না থাকুক, শব্দটি যে ক্ষমতাসীন মহলে অপাংক্তেয় হয়ে পড়েছিল,
তার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেল ২০১১ সালের মাঝামাঝি নাগাদ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী চূড়ান্ত হওয়ার পর, যখন দেখা গেল,
সংবিধানে সংযোজিত একটি গুরুত্বপূর্ণ নূতন ধারায় (২৩ক) সামষ্টিক পরিচয়বাচক একাধিক শব্দ (উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী) থাকলেও ‘আদিবাসী’ শব্দটি ছিল না, যেটিকে ঘিরে বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক প্রত্যাশা ও প্রতিশ্রুতি উচ্চারিত হয়ে এসেছিল।
এদিকে এই অনুপস্থিতির বিষয়টি সবার জানা বা বোঝা হয়ে ওঠার আগেই, সে বছরেরই জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় একটা খবর বেরোল যে,
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকাস্থ কূটনীতিকদের একটি সভায় ডেকে এনে বলেছিলেন,
“পার্বত্য চট্টগ্রামের ‘উপজাতীয়’ (tribal)-রা ethnic minority, কিন্তু indigenous নয়!”
উপরে উদ্ধৃত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথিত উক্তির অনুরূপ বক্তব্য অবশ্য আমরা আগেও শুনেছিলাম, দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে গণতন্ত্র প্রত্যাবর্তনের পর, ১৯৯৩ সালে, যদিও এসব কথা আশির দশকের স্বৈরাচারি শাসনামলেই বেশি মানানসই হত।
উল্লেখ্য, ১৯৯৩ সাল ছিল জাতিসংঘ-ঘোষিত ‘আন্তর্জাতিক বিশ্ব আদিবাসী বর্ষ’ (International Year of the World’s Indigenous People),
যা সরকারিভাবে পালনের বিপক্ষে তৎকালীন সরকারের মুখপাত্ররা যুক্তি দেখিয়েছিলেন, Indigenous People-এর ধারণা এদেশে প্রযোজ্য নয়।
অবশ্য বেসরকারিভাবে বর্ষটি তখন উদযাপিত হয়েছিল ব্যাপক প্রত্যাশা ও উৎসাহের সাথে, তৎকালীন বিরোধী দলের সাংসদ ছিলেন এবং আদিবাসী হিসাবে নিজেদের পরিচয় দিতেন,
বা এখনো দেন, এমন দু’জন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব দীপঙ্কর তালুকদার ও প্রমোদ মানকিনের নেতৃত্বে, যাঁরা উভয়েই বর্তমান সরকারে রয়েছেন প্রতিমন্ত্রীর পদে।
উল্লেখ্য, আদিবাসী বর্ষ উদযাপন উপলক্ষে যে স্মরণিকা ছাপানো হয়েছিল, তাতে বাংলাদেশের আদিবাসী জনগণের প্রতি সংহতি জানিয়ে বাণী দিয়েছিলেন তখনকার বিরোধী দলীয় নেত্রী, যিনি বর্তমানে দেশে সরকার প্রধানের পদে রয়েছেন।
২০০৮-এ প্রণীত তাঁদের দলের নির্বাচনী ইশতেহারেও ‘আদিবাসী’দের জন্য আশ্বাসমূলক অঙ্গীকার ছিল।
অথচ এই সরকারের আমলেই কিনা দুই দশক ধরে রাষ্ট্রযন্ত্রে বহাল তবিয়তে থেকে যাওয়া ‘আদিবাসী’ ধারণা সংক্রান্ত একটি পুরানো আপত্তির ভূত নূতন করে আত্মপ্রকাশ করল!
তাও আবার এমন এক মন্ত্রীর উপর ভর করে, যাঁকে এর আগে আদিবাসীদের একজন বন্ধু হিসাবে ভাবা হত।
তিনি নিজেও তেমন ভাবমূর্তি নিয়েই আগের বছরগুলোতে বিশ্ব আদিবাসী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত একাধিক অনুষ্ঠান আলোকিত করেছিলেন, যেমন ২০০৮ সালে মন্ত্রী হওয়ার আগে, আবার ২০০৯ সালে মন্ত্রী হওয়ার পরে!
উল্লেখ্য, ২০১১ সালে এমন কথাও শোনা গিয়েছিল যে, বিভিন্ন সরকারি দলিল থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দটি মুছে ফেলা হবে।
আর একই ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালে খবর বেরুল যে, ‘বিশ্ব আদিবাসী দিবস’ পালনে নাকি সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে।
এ ধরনের খবরের ভিত্তি যাই হোক, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বিভিন্ন আলামত দেখে শুনে বোঝা যাচ্ছিল,
‘আদিবাসী’ ধারণার প্রতি যে সন্দিহান দৃষ্টি অন্ততঃ বিশ বছর আগে থেকেই রাষ্ট্রযন্ত্রের বিশেষ কিছু পরিসরে বহাল ছিল, সেগুলো বর্তমান সরকারের আমলে এসে আরো জেঁকে বসেছে।
এক্ষেত্রে বিস্ময়কর ব্যাপার হল, অতীতে ‘আদিবাসী’ ধারণার প্রতি সরকারি মহলে আপত্তি থাকলেও তা ঠিক নিষেধাজ্ঞার পর্যায়ে পৌঁছে নি কখনো।
কাজেই প্রশ্ন জাগে, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে কি এমন ঘটল যাতে ‘আদিবাসী’ শব্দটির এই ফেরারি দশা হল? এ অবস্থার গূঢ় তাৎপর্য ও কারণ কি?
আমি মনে করি এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার দায় শুধু আদিবাসীদের নয়, বরং এদেশের সকল গণতন্ত্রকামী মানুষের।
সেটির সরাসরি কোন উত্তর দেওয়ার চেষ্টা আমি করছি না, তবে এ ধরনের প্রশ্ন মাথায় রেখেই আমি লিখতে বসেছি বর্তমান নিবন্ধ।
এক্ষেত্রে আমরা প্রসঙ্গক্রমে ফিরে তাকাব বিশ বছর আগে ‘আন্তর্জাতিক বিশ্ব আদিবাসী বর্ষ’ উদযাপনের সময় আমরা মুখোমুখি হয়েছিলাম, এমন কিছু প্রশ্ন ও বিষয়ের দিকে।
উদাহরণস্বরূপ, উক্ত আদিবাসী বর্ষ উদযাপন উপলক্ষে ডিসেম্বর ১৮, ১৯৯৩ তারিখে ঢাকায় আয়োজিত একটি সেমিনারে উপস্থাপিত আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ ও বাংলাদেশের আদিবাসী জনগণ শীর্ষক মূল প্রবন্ধের শুরুতে আমি লিখেছিলাম:
[জাতিসংঘ-ঘোষিত আলোচ্য বর্ষ] মূলতঃ একটি প্রতীকী পদক্ষেপ হলেও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা Indigenous অভিধার দাবীদার জনগোষ্ঠীদের কাছে এই ঘোষণার বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে,
কারণ এর মধ্য দিয়ে তাদের বহু শতাব্দীর বঞ্চনা ও নিপীড়নের ইতিহাস এবং বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় তাদের উপেক্ষিত অবস্থানের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণের প্রয়াস রয়েছে।
কিন্তু জাতিসংঘের ঘোষণা সব সদস্য রাষ্ট্রে সমান আবেদন সৃষ্টি করে নি। কিছু […] দেশ indigenous জনগোষ্ঠীর ধারণা এবং তাদের বিশেষ অধিকারের প্রশ্নকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দিলেও অন্য অনেক দেশে অনুরূপ কোন উদ্যোগ নেই,
বরং কথার মারপ্যাঁচে জাতিসংঘের ঘোষণার মূল উদ্দেশ্যকে পাশ কাটানোর চেষ্টা রয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশও কোন ব্যতিক্রম নয়।
এখানে জাতিসংঘ ঘোষিত বর্ষটি উদযাপনের কোন সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হয় নি, এই যুক্তিতে যে এদেশে কোন indigenous জনগোষ্ঠী নেই।
কিন্তু একজন গারো, সাঁওতাল বা ম্রোর কাছে এই সরকারি ব্যাখ্যা তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করারই নামান্তর।
এতদিন তাকে আদিবাসী আখ্যায় ভূষিত করে হেয় করা হয়েছে। আর আজ যখন সে এই পরিচয়কে সগৌরবে ধারণ করে বিশ্বের দরবারে মাথা তুলতে চাইছে,
তখন তার সরকার তাকে বলছে, সে নিজেকে indigenous বলে দাবী করতে পারে না।
এখানে স্বভাবতই যে প্রশ্নগুলি সর্বাগ্রে চলে আসে সেগুলি হল, indigenous কথাটির অর্থ কি?
বাংলাদেশের আদিবাসী বা উপজাতীয় নামে পরিচিত জনগোষ্ঠীগুলোকে indigenous বলা যায় কি?
বিশ বছর আগে যখন উপরে উত্থাপিত ও এ ধরনের অন্যান্য প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের উত্তর খোঁজার দায়িত্ব আমার উপর অর্পিত হয়েছিল, আমি ছিলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগের একজন নবীন প্রভাষক।
আমার সীমিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা তখনকার প্রবন্ধে পেশ করা যেসব প্রশ্ন ও যুক্তি এখনও প্রাসঙ্গিক, সেসবের উপর বিশেষভাবে আলোকপাত করা হয়েছে এই নিবন্ধে।
সে সাথে যেসব বিষয় এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে, সেসবের প্রেক্ষিতে আগামীতে কি ধরনের চিন্তা ও কর্মকান্ড কাম্য, তারও একটা রূপরেখা আমি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি এ লেখায়।
২। আদিবাসী পরিচয়ের আদি সীমানা
বাংলা ভাষায় ‘আদিবাসী’ শব্দটি ঠিক কবে, কোন অর্থে, কার দ্বারা বা কোন প্রেক্ষিতে চালু হয়েছিল, তার বিস্তারিত ও সুনির্দিষ্ট বিবরণ গবেষণাসাপেক্ষ বিষয়।
তবে এ ব্যাপারে আমাদের কিছু সাধারণ পর্যবেক্ষণ রয়েছে যেগুলির ভিত্তিতে মোটা দাগে কিছু কথা বলা যায়।
প্রথমত, ১৯৯৩ সালে যখন জাতিসংঘের বর্ষ ঘোষণার সুবাদে ইংরেজি ‘ইনডিজেনাস’ শব্দটি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে বা অনেকের আগ্রহের বিষয় হয়ে ওঠে, তখনই আমরা জানতাম যে,
বাংলায় আগে থেকে প্রচলিত ‘আদিবাসী’ শব্দটিকে এটির প্রতিশব্দ হিসাবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা রয়েছে।
বিশেষ করে, ‘আদিবাসী’ শব্দের যে অর্থ প্রায় সব বাংলা অভিধানেই দেওয়া আছে, সে অনুযায়ী ‘আদি নিবাসী’র পরিবর্তে ‘আদিম অধিবাসী’ অর্থটাই প্রাধান্য পেয়েছে।
এ নিবন্ধ লিখতে বসার পর একাধিক অভিধান ঘেঁটে দেখে এ ব্যাপারে আবার নিশ্চিত হলাম আমি।
দেখা যাচ্ছে, আমার হাতের কাছে যেসব বাংলা অভিধান আছে, সেগুলির প্রত্যেকটিতে ‘আদিবাসী’ শব্দের অর্থ দেওয়া হয়েছে অভিন্ন রূপে:
‘আদিম জাতি বা অধিবাসী’ (বাংলা একাডেমী প্রণীত সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান, দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯৯৬;
এবং কলকাতা থেকে প্রকাশিত সংসদ বাংলা অভিধান, নূতন সংস্করণ ২০০০ ও সরল বাঙ্গালা অভিধান, নবম সংস্করণ, ২০০৯)।
হুবহু একই অর্থ রয়েছে ইন্টারনেট-ভিত্তিক একটি বাংলা অভিধানেও (http://www.ebangladictionary.com/5376)।
আর ‘চলন্তিকা’ (১৩৮০ বাংলা সনের সংস্করণ) নামের আমার প্রিয় পুরানো অভিধানে একই শব্দগুচ্ছই দেওয়া হয়েছে একটু ভিন্ন বিন্যাসে, ‘অধিবাসী আদিম জাতি’।
অভিধানের বাইরে বাংলাদেশে ‘আদিবাসী’ নামে অভিহিত বিভিন্ন জনগোষ্ঠী সম্পর্কে জানার জন্য ১৯৮০’র দশক পর্যন্ত যে লেখকের বইয়ের উপর এদেশের গড়পরতা শিক্ষিত মানুষেরা নির্ভর করতেন, তিনি ছিলেন আবদুস সাত্তার।
বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা তাঁর বিভিন্ন বইয়ের মধ্যে সম্ভবত সর্বাধিক পঠিত ও পরিচিত ছিল ‘আরণ্য জনপদে’। আমার ১৯৯৩ সালের প্রবন্ধে এটির নাম উল্লেখ করে আমি লিখেছিলাম:
আদিবাসী কথাটি বাংলায় ব্যবহৃত হয় মুলতঃ আদিম বা সভ্যতার মাপকাঠিতে নীচু অর্থে।
তাই আমরা দেখি আবদুস সাত্তারের ‘আরণ্য জনপদে’-এর মত গ্রন্থে একদিকে সাঁওতাল, গারো, চাকমা প্রভৃতি জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী বলে অভিহিত করা হচ্ছে,
অন্যদিকে একই সাথে এটাও বলা হচ্ছে, আদিবাসীরা কেউ এদেশের ভূমিজ সন্তান নয়।
আরণ্য জনপদে বইটি বর্তমানে আমার সংগ্রহে নেই, তাই আমার উপরের বক্তব্য নূতন করে মিলিয়ে দেখা হয় নি।
তবে একই লেখকের অন্য একটি বই আমার হাতের কাছে আছে, সেটা হল মুক্তধারা থেকে ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত ‘আরণ্য সংস্কৃতি’, যার মুখবন্ধের শুরুতেই বলা হয়েছে:
‘আরণ্য সংস্কৃতি’ গ্রন্থে আদিবাসী বা উপজাতীয় সমাজের সাংস্কৃতিক জীবনধারার প্রতিই আলোকপাত করা হয়েছে।
বাংলাদেশের অধিকাংশ উপজাতিই অরণ্য অঞ্চলে বাস করে। শুধু বাংলাদেশে কেন পৃথিবীর অন্যান্য স্থানেও আদিম সমাজ বা উপজাতীয় গোষ্ঠীভুক্ত লোকদেরকে পাহাড়-পর্বত ঘেরা আরণ্য জনপদে বসবাস করতে দেখা যায়।
দেখা যাচ্ছে, ‘উপজাতীয়’, ‘আদিবাসী’, আর ‘আদিম সমাজ’ এই পদগুলিকে ব্যবহার করা হত প্রায় অভিন্ন অর্থে, অভিন্ন প্রেক্ষিতে, এবং পারস্পরিকভাবে বদলযোগ্য হিসাবে।
এই শব্দগুলির প্রত্যেকটি যে ঔপনিবেশিকতার সূত্রে ইংরেজি বা অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় প্রচলিত কোন না কোন শব্দকে অনুসরণ করে চালু করা হয়েছিল, তা সহজেই অনুমেয়।
এ প্রেক্ষিতে উল্লেখ্য, আমার হাতের কাছে বাংলা একাডেমীর যে ইংরেজি-বাংলা অভিধান আছে (Bangla Academy English-Bangla Dictionary, 2nd edition, 2002) সেখানে indigenous শব্দটি দেখানো থাকলেও সেটির অর্থ মানুষের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় নি,
এবং indigenous people নামে কোন আলাদা পদ নেই, কিন্তু aboriginal শব্দের অর্থ হিসাবে দেওয়া আছে ‘আদিবাসী’।
বিপরীতভাবে দুইটি বাংলা-ইংরেজি অভিধানে দেখতে পাচ্ছি (Oxford Advanced Learners’ Dictionary, Bengali to English, 2005; Samsad Bengali English Dictionary, 3rd edition, 2000),
‘আদিবাসী’ শব্দের অর্থ দেওয়া হয়েছে, যথাক্রমে, ‘aborigines, aboriginal’ ও ‘the aborigines’ হিসাবে।
এখানে লক্ষ্যণীয় যে, ব্যুৎপত্তিগতভাবে বাংলা ‘আদিবাসী’ বা ইংরেজি aboriginal শব্দের অর্থগত সীমানা indigenous people-এর সাথে প্রায় একই রকম হলেও প্রথমোক্ত শব্দগুলির সাথে ‘সভ্যতার বিচারে নীচু বা আদিম’ অর্থটি গেঁথে গিয়েছিল,
যা প্রধান আভিধানিক অর্থ হয়ে ওঠে বাংলা ‘আদিবাসী’র বেলায়, অন্যদিকে ইংরেজি aboriginal শব্দটির ব্যবহার বর্তমানে মূলত অস্ট্রেলিয়াতেই সীমিত,
যেখানেও indigenous people পদটিকেই অনেকে অধিকতর সম্মানজনক মনে করেন।
উল্লেখ্য, বাংলা ভাষায় ‘আদিবাসী’ শব্দটি মূলত ‘আদিম’ (বা ‘সভ্যতার মাপকাঠিতে পিছিয়ে থাকা’) অর্থে ব্যবহৃত হত বিধায় ১৯৯৩ সালে আমরা দেখেছিলাম,
এ নামে অভিহিতদের অনেকের কাছে – বিশেষত পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের বেলায় – ‘ইনডিজেনাস’-এর প্রতিশব্দ হিসাবে ‘আদিবাসী’ আপত্তিকর ছিল।
৩। আন্তর্জাতিক সনদের ছায়ায় বাংলাদেশে ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের পুনর্নির্মাণ
‘আন্তর্জাতিক বিশ্ব আদিবাসী বর্ষ’ উপলক্ষে ১৯৯৩ সালের ১৮ই ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সেমিনারে উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধে আমার পুরো আলোচনা আবর্তিত হয়েছিল কয়েকটি মূল প্রশ্নকে ঘিরে: ইংরেজি ‘ইনডিজেনাস’ শব্দটির প্রায়োগিক অর্থ কি?
‘আদিবাসী’ শব্দটি ‘ইনডিজেনাস’-এর প্রতিশব্দ হিসাবে ব্যবহার করা যায় কি? সরকার যে বলছিল, এদেশের ‘উপজাতীয়রা’ ইনডিজেনাস নয়, এর জবাব কি?
এসব প্রশ্নের উত্তরে, বাংলাদেশে যাদেরকে আগে থেকেই ‘উপজাতীয়’ বা ‘আদিবাসী’ বলা হত,
আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত অর্থে তাদেরকে যে ‘ইনডিজেনাস’ বলা যায়, সে যুক্তি পেশ করতে গিয়ে আমি লিখেছিলাম:
আভিধানিক ভাবে indigenous কথাটির অর্থ হচ্ছে স্থানীয়ভাবে উদ্ভূত।
কোন নির্দিষ্ট একটি জনগোষ্ঠীকে indigenous বলার অর্থ হচ্ছে এই যে, তারাই নির্দিষ্ট একটি ভূখন্ডের প্রাচীনতম অধিবাসীদের বংশধর।
স্পষ্টতঃই এটি একটি আপেক্ষিক ব্যাপার। অর্থাৎ স্থান ও কালের সীমানা কিভাবে বেঁধে দেওয়া হচ্ছে, তার উপরই নির্ভর করছে কোন প্রেক্ষিতে কাদের আমরা indigenous বলতে পারি।
উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়া, এই তিন মহাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের মূল অধিবাসীদের নিধন,
উচ্ছেদ বা সাংস্কৃতিকভাবে ধ্বংস করে ইউরোপীয়রা কিভাবে এই ভূখন্ডগুলোর কর্তৃত্ব নিয়ে নিয়েছিল, সে ইতিহাস আমাদের সবারই কমবেশী জানা আছে।
এসব জায়গার বিজিত জনগোষ্ঠীদেরকে ইউরোপীয়রা অতীতে savage, primitive, tribal, Red Indian, Aboriginal প্রভৃতি বিভিন্ন নামে ডেকে এসেছে।
এই নামগুলির অবজ্ঞাসূচক ও বর্ণবাদী ব্যঞ্জনা এড়ানোর জন্যই indigenous কথাটির ব্যবহার শুরু হয়।
তবে indigenous জনগোষ্ঠীর ধারণা যে শুধুমাত্র আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ার মত দেশের ক্ষেত্রে অর্থবহ তা নয়।
আফ্রিকা ও এশিয়ার বহু দেশেও এটি সমানভাবে প্রযোজ্য। এসব দেশে যতদিন ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসন ছিল ততদিন ইউরোপীয়দের চোখে স্থানীয় সবাই ছিল native, এবং সভ্যতার মাপকাঠিতে নীচু বলে বিবেচিত।
কিন্তু এসব দেশের নূতন শাসকশ্রেণী ও সংখ্যাগুরু জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা নিজেরাই পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উপর ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণ ও নিপীড়ন চালাতে শুরে করেছে।
আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে আভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিকতার শিকার এ ধরনের বিভিন্ন জনগোষ্ঠী,
বিশেষ করে সংস্কৃতি ও আর্থসামাজিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে যাদের স্বতন্ত্রভাবে সনাক্ত করা যায়, এবং যাদের নিজেদের মধ্যে এই স্বাতন্ত্র্যের বোধ ধরে রাখার প্রচেষ্টা আছে, তাদেরকেও indigenous বলে আখ্যায়িত করা যায়।
[জাতিসংঘের পরিসরে ব্যবহারের ক্ষেত্রে] কথাটির এরকম সম্প্রসারিত অর্থই দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
এক্ষেত্রে কোন দেশে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে কাদের পূর্বপুরুষেরা প্রথম সেখানে বসতি গেড়েছিল, এ প্রশ্ন গৌণ।
মূলতঃ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তথাকথিত সভ্যতার বিকাশের শিকার tribal, primitive প্রভৃতি ঔপনিবেশিক আখ্যায় ভূষিত জনগোষ্ঠীদের সবাই indigenous অভিধার বৈধ দাবীদার।
উপরে উত্থাপিত যুক্তি পেশ করার পর আমি লিখেছিলাম, “আন্তর্জাতিকভাবে indigenous কথাটি যে অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে,
সে অর্থে বাংলাদেশে আদিবাসী ও উপজাতীয় নামে পরিচিত বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সবাইকে indigenous বলে চিহ্নিত করা যায়।”
এর পর ‘ইনডিজেনাস’-এর বাংলা হিসাবে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহারের পক্ষে নিজের মত দিয়ে আমি লিখেছিলাম:
[ইংরেজি] indigenous কথাটি তুলনামূলকভাবে নূতন এবং এর নেতিবাচক কোন ব্যঞ্জনা এখন পর্যন্ত নেই।
অন্যদিকে ‘আদিবাসী’ শব্দটি বাংলায় অবজ্ঞাসূচক অর্থ বহন করে। কাজেই যে বিশেষ অর্থে এবং ইতিবাচক উদ্দেশ্যে কথাটি আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলনের প্রচেষ্টা চলছে, আদিবাসী কথাটির মাধ্যমে তা সঠিকভাবে প্রকাশ করা যায় না।
এভাবে দেখলে আদিবাসীর পরিবর্তে বাংলা বানানেই ‘ইনডিজেনাস’ কথাটি ব্যবহার করা, অথবা অন্য কোন নূতন শব্দ উদ্ভাবন করা অধিকতর যুক্তিযুক্ত।
তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, আপাততঃ কাজ চালানোর জন্য ‘আদিবাসী’কে indigenous –এর প্রতিশব্দ হিসাবে ব্যবহার করায় কোন অসুবিধা নেই।
আদিবাসী নামে পরিচিত মানুষেরা নিজেরাই যদি এ আখ্যাকে সগৌরবে ধারণ করে দেশের ভিতরে এবং বাইরে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে, তাহলে এটি একদিন ইতিবাচক ব্যঞ্জনাই বহন করবে।
উপরের যুক্তির সাথে যখন ‘আদিবাসী’ শব্দের বর্তমান ফেরারি দশাকে মেলাই, তখন প্রশ্ন জাগে, গত বিশ বছরে আমরা আসলে এগিয়েছি না পিছিয়েছি?
এদেশে ‘আদিবাসী’ পরিচয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বহু মানুষের দুই দশকের অক্লান্ত পরিশ্রম ও বিভিন্ন ধরনের আত্নত্যাগের পরেও যখন দেখি,
এটিকে বাংলাদেশে সাংবিধানিকভাবে তথা আন্তর্জাতিক সনদের আওতায় প্রতিষ্ঠিত করা যায় নি, তখন প্রশ্ন জাগে, এ ব্যাপারে যে স্বপ্ন দেখা শুরু হয়েছিল ১৯৯৩ সালে, তা অধরা রয়ে গেল কেন?
৪। অর্থগত বিভ্রান্তি ও অনর্থের অন্যান্য মূল: অধিকারের প্রশ্ন, ভূমি দস্যুতা ও পরিচয় দখলের রাজনীতি
কথিত আছে, ২০১১ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন কূটনীতিকদের ডেকে বুঝিয়েছিলেন, কেন পার্বত্য চট্টগ্রামের ‘উপজাতীয়’দের ইনডিজেনাস বলা যাবে না,
এ ব্যাপারে পেশ করা যুক্তির অংশ হিসাবে তিনি নাকি শেষোক্ত শব্দের সংজ্ঞার্থ উদ্ধৃত করেছিলেন অক্সফোর্ড বা সে জাতীয় কোন ইংরেজি ডিকশনারি থেকে।
এই জনশ্রুতি সত্য বা মিথ্যা যাই হোক, তখনকার সার্বিক প্রেক্ষাপট এবং পূর্বাপর ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে যাঁরা ওয়াকেবহাল ছিলেন,
তাঁদের মতে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়রা ইনডিজেনাস নয়, এটি প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের ব্যস্ত হয়ে ওঠার মূল কারণ ছিল এমন একটি (ভ্রান্ত) ধারণা,
যে, এখানে ‘ইনডিজেনাস’ লোকজন নেই, এটি প্রতিষ্ঠিত করা গেলে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় এ নামে অভিহিত মানুষদের অধিকার রক্ষার দায় থেকে রাষ্ট্র বেঁচে যাবে!
এ প্রসঙ্গে এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯৭২ সালেই বাংলাদেশ আইএলও কনভেনশন ১০৭-এ স্বাক্ষর করার মাধ্যমে ‘উপজাতীয়’ ও ‘আদিবাসী’ (বা ইনডিজেনাস) জনগোষ্ঠীদের অধিকার সুরক্ষার ব্যপারে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছিল।
এই প্রেক্ষিতে যে বিষয়টা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য, তা হল, আইএলও’র ১০৭ নং কনভেনশনে এটা বলা হয় নি যে, ‘উপজাতীয়’দের জন্য এক ধরনের ব্যবস্থা থাকবে, আবার ‘আদিবাসী’দের জন্য থাকবে আরেক ধরনের ব্যবস্থা।
কাজেই বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে যাঁরা কূটনীতিকদের কাছে বাংলাদেশের কিছু মানুষকে ‘উপজাতীয়’ আখ্যা দিয়ে বলছিলেন যে
এরা ‘মাইনরিটি’, কিন্তু ‘আদিবাসী’ নয়, তাঁরা আসলে সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সনদ বা ঘোষণাসমূহে কি রয়েছে, সে ব্যাপারে নিজেদের অজ্ঞতাই তুলে ধরছিলেন!
আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় ‘ইনডিজেনাস’ জনগোষ্ঠীর ধারণা যে অর্থে প্রয়োগ করা হয়, তার ব্যাপারে অজ্ঞতার পাশাপাশি অন্য যেসব সমস্যা এখনো ব্যাপকভাবে ক্রিয়াশীল,
সেগুলোর মধ্যে রয়েছে, বাংলায় ‘আদিবাসী’ শব্দের সাথে মিশে থাকা প্রচলিত অর্থ, এবং আদিবাসীদের সম্পর্কে প্রচলিত কিছু অপরীক্ষিত, ভ্রান্ত বা অপ্রসাঙ্গিক ধারণা (যেমন, ‘তারা চীন, মিয়ানমার ইত্যাদি দেশ থেকে এসেছে!’)।
ইদানীং আমার মনে হয়, বাংলাদেশে বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দদের মধ্যে অনেকে যে বাংলায় ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার করতেন,
বা এখনো করেন, এবং তাদের অধিকারের পক্ষে কথা বলেন, তাঁদের অনেকের কাছেই হয়তবা শব্দটির প্রচলিত (‘আদিম’, ‘অনগ্রসর’) অর্থই প্রাধান্য পেয়ে এসেছে।
অন্যদিকে তাঁদেরই অনেকে আবার ইংরেজি ‘ইনডিজেনাস পিপল’ শব্দটা – বা এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঘোষণা, সনদ ইত্যাদিকে – দেখে থাকেন সংশয় বা সন্দেহের সাথে।
এরকম দৃষ্টিভঙ্গী যাঁরা পোষণ করেন, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ তাই সচেতন ভাবেই ‘আদিবাসী’ শব্দটিকে ইংরেজিতে ‘ইনডিজেনাস’ হিসাবে অনুবাদ না করে Adivasi হিসাবেই লিখে থাকেন।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ‘আদিবাসী’দের মানবাধিকার লংঘনের ব্যাপারে ১৯৯০ দশকের গোড়াতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে যেসব লেখালেখি হয়েছিল,
সেগুলির মধ্যে রয়েছে বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় প্রকাশিত ফাদার টিমের লেখা একটি বই (মাইনরিটি রাইটস গ্রুপ কর্তৃক ১৯৯১ সালে The Adivasis of Bangladesh শিরোনামে ইংরেজিতে, এবং ১৯৯২ সালে ‘বাংলাদেশের আদিবাসী’ নামে বাংলায় প্রকাশিত)।
আমি আগে খেয়াল করি নি, কিন্তু নূতন করে পড়তে গিয়ে সম্প্রতি আবিস্কার করলাম, ফাদার টিম বলছেন,
আইএলও কর্তৃক ব্যবহৃত ‘ইনডিজেনাস’ শব্দটি নাকি বাঙালিদেরকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ‘আদিবাসী’দের বেলায় ব্যবহার করা সমস্যাজনক,
কারণ আদিবাসীরা নাকি অনেকে ‘বাইরে থেকে এসেছে’ (‘মান্দিরা এসেছে তিব্বত থেকে’), পক্ষান্তরে বাঙালিদের উৎপত্তি এদেশেই!
এতো দেখি ‘আদিবাসীরা কেউ এদেশের ভূমিজ সন্তান নয়’, আবদুস সাত্তারের সেই গোলমেলে কথা বা আরো সম্প্রতি দেওয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথিত বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি!
সে যাই হোক, বাংলাদেশে সরকারিভাবে ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের প্রত্যাশিত স্বীকৃতি না মিললেও,
ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসা একাধিক আইন, ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও সে সূত্রে প্রণীত বা সংশোধিত বিভিন্ন আইন, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী প্রভৃতির প্রেক্ষিতে একথা বলা যায় যে,
‘উপজাতি’ বা অন্যান্য পদের ভিত্তিতে যেসব অধিকার প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ রয়েছে, সেগুলো একেবারে ফেলনা নয়।
‘উপজাতি’, ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ প্রভৃতি ধারণার সীমাবদ্ধতা রয়েছে বই কি, তবে এখানে সে আলোচনায় না গিয়ে যে বিষয়টা আমরা দেখতে পারি,
তা হচ্ছে, পৃথিবীর অন্যত্র যেমন, তেমনি বাংলাদেশেও আদিবাসীদের বিপন্নতার একটা প্রধান কারণ হচ্ছে এখনো তাদের জিম্মায় রয়েছে, এমন ভূমির উপর বিত্তবান ও ক্ষমতাশালী শ্রেণীর মানুষদের নজর পড়া।
একটা মহল যে জোরেসোরে প্রচারণা চালাচ্ছে, যে, জাতিসংঘের বিভিন্ন সনদ বা ঘোষণার আওতায় এদেশের জনগণের একটা ‘ক্ষুদ্র’ অংশকে আদিবাসী হিসাবে স্বীকৃতি দিলে রাষ্ট্রের অখন্ডতা বিপন্ন হবে, বা অনেক ক্ষেত্রে তার কর্তৃত্ব ক্ষুন্ন হবে,
একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, তারা সেটা করছে আদিবাসীদের কাছ থেকে ভূমি কেড়ে নেওয়ার ইতিহাস বা সুযোগকে আড়ালে রাখার জন্যই।
দেখা যাচ্ছে, শুধু ভূমি দখলের দিকেই এ ধরনের কায়েমি স্বার্থান্বেষী মহল নজর দেয় নি, তাদের প্ররোচণায় আদিবাসীদের পরিচয় দখলের পাঁয়তারাও চলছে।
আমার বিশ্বাস, ধারণাগত বিভ্রান্তির চাইতেও মূলত এ কারণেই সাম্প্রতিককালে এটা বেশ জোরেশোরে বলা হচ্ছে যে, ‘উপজাতীয়রা’ নয়,
বাঙালিরাই বাংলাদেশের প্রকৃত আদিবাসী। এ ধরনের দাবীর অর্থ নিশ্চয় এই নয় যে, বাঙালিরা ‘আদিম’ অর্থে নিজেদেরকে ‘আদিবাসী’ বলতে শুরু করেছে,
বা শেখ-সৈয়দ-মুগল-পাঠান-আর্য হিসাবে নিজদের পরিচয় দেওয়ার রেওয়াজ ছেড়ে সত্যিকার অর্থে শেকড়-সন্ধানী হয়েছে?
৫. আদিবাসী পরিচয়ের ভবিষ্যৎ : সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাবনা
বিশ বছর আগে যে প্রত্যাশা নিয়ে ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের পক্ষে ওকালতি করতে শুরু করেছিলাম আমরা অনেকে, তার কিছু দিক ভালভাবেই পূরণ হয়েছে এর মধ্যে।
যেমন, আদিবাসীদের মধ্যে এই পরিচয় স্বেচ্ছায় ও সগৌরবে ধারণের প্রবণতা অনেক বেড়েছে।
সেসাথে এ নামে যারা পরিচিত, বা পরিচিত হতে আগ্রহী, তারা যে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় কিছু অধিকার পাওয়ার দাবীদার,
এ নিয়ে বিভিন্ন পরিসরে সচেতনতা বেড়েছে। এক্ষেত্রে অবশ্য অনেকের মধ্যে প্রত্যাশার পরিধিও হয়তবা একটু বেশিই বেড়েছে, যেনবা ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের স্বীকৃতি পেলেই সকল ধরনের বঞ্চনা থেকে সহসা মুক্তি মিলবে।
অন্যদিকে, আদিবাসী ধারণার বিরোধীরাও বসে ছিল না, বা বসে নেই, এবং কিছু ক্ষেত্রে তারাও তাদের অবস্থান সংহত করতে পেরেছে।
এ প্রসঙ্গে মোটা দাগে আদিবাসী ধারণার প্রতি বিরোধিতার দ্বিবিধ কারণ চিহ্নিত করা যেতে পারে।
যেমন, একদল আছে যারা মনে করে আদিবাসীদের অনেক বেশী ছাড় দেওয়া হয়েছে এর মধ্যে, এবং আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় তাদেরকে আদিবাসী হিসাবে মেনে নেওয়া হলে তাতে নানাভাবে জাতীয় স্বার্থ ক্ষুন্ন হবে।
আরেকদল আছে যারা মনে করে, ‘আদিবাসী’ (বা ইনডিজেনাস) ধারণা আসলে ঔপনিবেশিকতার ইতিহাস সঞ্জাত অপরাধবোধ লাঘবের জন্য উদারনৈতিক পশ্চিমাদের একটি ফন্দি, যা শেষ পর্যন্ত বর্তমান ধনতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার স্বার্থই বেশি রক্ষা করে।
যাহোক, ‘আদিবাসী’ ধারণার প্রতি প্রদর্শিত এ ধরনের বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গীর মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়েই বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও একাধিক ক্ষেত্রে জাতীয় নীতিমালায়,
এমন কি সংবিধানেও, আদিবাসীদের চাহিদা বা অধিকারের প্রতি আগের চেয়ে কিছুটা বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে, যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ‘আদিবাসী’ শব্দটা হয়ত ব্যবহার করা হয় নি।
একটা বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, ‘আদিবাসী’ শব্দটির উপর কথিত সরকারি নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও গণমাধ্যম ও উন্নয়ন ডিসকোর্সে এটির ব্যাপক ব্যবহার (ইংরেজি ‘ইনডিজেনাস’ এবং তার সমার্থক হিসাবে বাংলা ‘আদিবাসী’) অনেকটাই অব্যাহত রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, কারা শব্দটি ব্যবহার করছে, তার চাইতেও বড় কথা কোন্ অর্থে এবং কি উদ্দেশ্য তারা তা করছে।
ব্যক্তিগতভাবে কেউ আমাকে ‘আদিবাসী’ বললেই আমি যেমন ধরে নেব না যে সে আমার অধিকার, সংস্কৃতি বা ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন,
তেমনি শব্দটি ব্যবহারে কেউ আপত্তি করলেই আমি ভাবব না যে, সে আমাকে আমার ন্যায্য অধিকার দিতে চায় না।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, বিভিন্ন জাতীয় নীতিমালা, আইন, সরকারি উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রভৃতি মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সেগুলিতে ‘আদিবাসী’ শব্দটি আছে কি নেই, এমন বাহ্যিক বিষয়ের চাইতেও সেগুলির অন্তঃসারের দিকে নজর দিতে হবে।
যেমন, ‘আদিবাসী’দের কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে বলেই জাতীয় শিক্ষানীতি শিরোধার্য হয়ে গেল,
আবার শব্দটি না থাকাতে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সন্নিবেশিত সংবিধানের ২৩ক ধারা একেবারে নিন্দনীয় হয়ে গেল,
এরকম সরল সমীকরণের উর্ধে উঠে আমাদেরকে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলিকে তলিয়ে দেখতে হবে আনুপূর্বিক প্রেক্ষাপট বিচার ও পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের সমন্বয়ে।
আগেই পরোক্ষভাবে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের স্বীকৃতি দেওয়ার দ্ব্যর্থহীন উদ্যোগ নেওয়া হলেও আদিবাসীরা সব ধরনের বঞ্চনা ও বৈষম্য থেকে মুক্তি পাবে, তা নয়।
তেমনটা রাতারাতিতো হবেই না, দীর্ঘ মেয়াদেও কতটুকু হবে, তা দেখার বিষয়। এখানে সংশয়ের দুটি প্রধান ক্ষেত্র রয়েছে।
প্রথমত, আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজ যতদিন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এগিয়ে দেওয়া আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা-নির্ভর প্রকল্প-ধর্মী উদ্যোগের মধ্যে সীমিত থাকবে, ততদিন সেগুলির তেমন কোন ব্যাপ্তি ও গভীরতা আশা করা যাবে না।
দ্বিতীয়ত, আমাদের মনে রাখতে হবে, আদিবাসীদের অস্তিত্বের সংকটের পেছনে একটা প্রধান কারণ হচ্ছে ‘জাতিরাষ্ট্র’ ধারণার বর্তমান দাপট,
এবং ‘জাতিসংঘ’ হচ্ছে মূলত জাতিরাষ্ট্রসমূহের একটি সংগঠন, যা কাজ করে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা ও আপোষের মধ্য দিয়ে।
কাজেই এমন একটি সংগঠনের ছায়ায় আদিবাসীদের অস্তিত্বের সংকটের মৌলিক সুরাহা কতটা হবে, তা তলিয়ে দেখার বিষয়।
তার মানে আবার এই না যে, ‘আদিবাসী’ ধারণাকে সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার মনে করে সম্পূর্ণ পরিহার করে চলতে হবে, যেমনটা বিভিন্ন ঘরানার মতাদর্শিক অবস্থান থেকে অনেকে বলে থাকেন।
চলমান বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী, বিতর্ক ও প্রবণতা পর্যবেক্ষণ করে আদিবাসী ধারণাকে বর্তমানে আমি নিজে যেভাবে তুলে ধরতে চাই, তা হল এই,
এটি যেমন সর্বরোগহর কোন দাওয়াই নয়, তেমনি নয় কোন চেতনানাশক বড়ি, বা কোন বিষবৃক্ষের গুপ্ত বীজ।
আদিবাসীদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, আদিবাসী হিসাবে পূর্ণাঙ্গ স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য তাদেরকে সর্বাগ্রে ঘর গোছাতে হবে, এবং অভিন্ন কিছু লক্ষ্য, পন্থা ও ক্ষেত্রকে ঘিরে শক্তিশালী ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।
পাশাপাশি তাদেরকে মিত্র বাছার ক্ষেত্রে বিচক্ষণ হতে হবে, এবং সচরাচর বৈরী বলে বিবেচিত, এমন পরিসরেও সহায়ক শক্তির খোঁজে চোখ কান খোলা রেখে চলতে হবে।
আর ‘আদিবাসী’ শব্দের ব্যবহার থাকা না থাকাকে বিভিন্ন উদ্যোগ, নীতি, কর্মসূচী প্রভৃতির মূল্যায়নের প্রধান মাপকাঠি না ধরে, শেষোক্ত বিষয়গুলির অন্তঃসারের উপর অনেক বেশী মনোযোগ দিতে হবে।
সবচেয়ে বড় কথা, যারা ‘আদিবাসী’ ধারণার প্রবক্তা হবেন, তাঁদেরকে দেশ ও বিশ্বের সামনে এ ধারণার সার্বজনীন আবেদন তুলে ধরতে হবে।
এক্ষেত্রে দেশ বা বিশ্ব আদিবাসীদেরকে কি দিতে পারে, সেটার চাইতেও বেশি জোর দিতে হবে, ‘আদিবাসী’ ধারণার ধারক-বাহক-প্রবক্তারা দেশ বা বিশ্বকে কি দিতে পারে, এ বিষয়ের উপর।
এ প্রসঙ্গে ২০০৪ সালে সংহতিতে প্রকাশিত আমার ‘আদিবাসী চেতনার সন্ধানে’ নামের লেখার সূত্র ধরে আমি আবারো বলব, আমরা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে পারি অন্তত তিনটি আদর্শ,
যেগুলোর জোরালো অস্তিত্ব ছিল বা রয়েছে বিভিন্ন আদিবাসী সমাজে। এই আদর্শগুলো হল- প্রকৃতি সংলগ্নতা, সমতা ও সহভাগিতা।
~~~
*নিবন্ধটি ‘আরণ্য জনপদের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক সনদের ছায়াতলে: বাংলাদেশে আদিবাসী পরিচয় পুনঃনির্মাণের দুই দশক (১৯৯৩-২০১৩)’ শিরোনামে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস ২০১৩ উপলক্ষে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম প্রকাশিত সংহতি ২০১৩ নামক সংকলনে প্রথম প্রকাশিত হয়েছে।
প্রকাশিত ভাষ্যে দু’একটা মুদ্রণ প্রমাদ চোখে পড়েছে আমার, আবার কিছু জায়গায় ভিন্ন বানান রীতির প্রয়োগ বা অন্য কোন সম্পাদনার ছোঁয়া থাকতে পারে।
লেখক: prashanta tripura
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।