বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা

Jumjournal
Last updated Oct 7th, 2020

1649

featured image

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর আদিবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের বীরত্বপূর্ণ অবদানের কথা তুলে ধরা হয়েছে এই লেখাটিতে।

কার্তিকচন্দ্র ভুইমালী

আদিবাসী ভুইমালী সম্প্রদায়ের একজন মুক্তিযোদ্ধা কার্তিকচন্দ্র ভুইমালী। রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার হরিদেবপুর গ্রামে কার্তিকের বাড়ি।

যুদ্ধাহত এই মুক্তিযোদ্ধা বর্তমানে মোটরসাইকেল মেকানিক হিসেবে কোনোরকমে জীবিকার সংস্থান করেন। ১৯৭১ সালে সবে কৈশোর উর্ত্তীর্ণ হওয়া কার্তিকচন্দ্র মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন – ১৯৭১ সালে আমি তালাদ স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র।

এ সময় দেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। আমরা আতংকে আছি। স্থানীয় কিছু পাকিস্তানপন্থী মুসলমান আমাদের ভারতে চলে যাবার ব্যাপারে উৎসাহ দিতে থাকে।

আশপাশের গ্রামের আদিবাসী এবং হিন্দুরা আমাদের সামনে দিয়ে ভারত চলে যাচ্ছে। এসব দৃশ্য আমাদের মনোবল ভেঙে দেয়। বৈশাখ মাসের কোনো এক শুক্রবার।

আমরা দুপুরের খাবার খাচ্ছিলাম। এ সময় গ্রামের আবদুল মান্নান এসে বলল, সবাই ভারত চলে গেল, তোমরাও চলে যাও। আমরা বললাম, খাওয়া শেষ করে তারপর যাব।

সে ভাতের হাঁড়ি লাথি মেরে ফেলে দিল। তারপর ঐদিনই ভারতের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। বলতে গেলে শুধুমাত্র পরনের কাপড়ই সম্বল ছিল।

হাঁটতে হাঁটতে নিয়ামতপুরের নিমদীঘি গিয়ে আশ্রয় নিলাম। স্থানীয় লোকজন কেউ ভয় দেখায়, কেউ সহযোগিতা করে। একদিন শুনলাম, আর্মি আসছে।

ঐ দিনই বিল পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে গেলাম। ভারতে গিয়ে প্রথমে মালদার এক প্রাইমারি স্কুলে আশ্রয় নিলাম। ওখান থেকে ভারত সরকার আমাদের গোবিন্দপাড়া শরণার্থী শিবিরে নিয়ে যায়।

ঐ শিবিরে আমরা প্রায় দশ হাজার লোক ছিলাম। এখানকার আব্দুর রাজ্জাক স্যারসহ আরো কিছু লেখাপড়া জানা ব্যক্তি আলাদা বাড়ি ভাড়া করে থাকতেন।

রাজ্জাক স্যার এবং আনারুল একদিন আমার ক্যাম্পে গেলেন। তারা আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। আমার সাথে দেখা হলে তিনি আমাকে মুক্তিযুদ্ধে যাবার কথা বললেন। আমি রাজি হয়ে গেলাম।

রাজ্জাক স্যার ঐ দিনই আমাকে মালদায় নিয়ে গেলেন। ওখানে রবীন্দ্র হলে এক রাত থাকলাম। পরদিন ভোর চারটার সময় গাড়িতে উঠলাম। আমরা শরণার্থী শিবিরের মোট সাতজন গেলাম। রাজ্জাক স্যার গেলেন না।

গেলাম শিলিগুড়ির পানিঘাটা পাহাড়ি এলাকায়। গায়ে তেমন কাপড় নেই। বলা হল সকাল পর্যন্ত কষ্ট করতে হবে। সকালে কাপড় দিল। তাঁবু দিল। প্রতি তাঁবুতে ছয় জন করে থাকতে হবে।

বলা হল, আজ সন্ধ্যা থেকে ট্রেনিং শুরু হবে। এটা আনুমানিক জুন মাস ছিল।

রাত-দিন ট্রেনিং চলত। এর মধ্যে একটি উচ্চতর ট্রেনিং-এর আহ্বান জানালে তাতে অংশগ্রহণ করি। ট্রেনিং কমান্ডার ক্যাপ্টেন ধীলন আমার যোগ্যতা দেখে মুগ্ধ হন।

মোট ২৮ দিনের ট্রেনিং হল। রাইফেল, এসএলআর, এলএমজি, গ্রেনেড, এক্সপ্লোসিভ ইত্যাদি অস্ত্রের ট্রেনিং হয়।

পানিঘাটা থেকে আমরা ১৫ জনের বাহিনী এলাম বালুরঘাটে, ৫০ জন এদেশী, ১০০ জন ভারতীয় সেনা। কমান্ডার ছিলেন ভারতীয় ক্যাপ্টেন ধীলন ও ক্যাপ্টেন চক্রবর্তী এবং বাঙালি সমীর কুমার দাস।

প্রথম যুদ্ধ করি দিনাজপুরের চিরির বন্দর। চিরির বন্দরে পাক আর্মির একটি ক্যাম্প ছিল। আমরা ঐ ক্যাম্প আক্রমণ করি। ১৪ জন পাক আর্মিকে জীবিত আটক করি একজন আহতসহ।

যাবার সময় তারা একটি ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে যায়, যাতে আমরা আর অগ্রসর হতে না পারি।

এরপর আমরা পার্বতীপুরের একটি ক্যাম্প আক্রমণ করি। এটি ছিল একটি বিহারি অধ্যুষিত এলাকা। দুইবার আক্রমণ করেও আমরা ঐ ক্যাম্প দখল করতে ব্যর্থ হই। পরে পেছন থেকে ভারতীয় আর্মি এলে ঐ যুদ্ধের দায়িত্ব তাদের ওপর দিয়ে আমরা চলে যাই বগুড়ার দিকে।

বগুড়ায় আমরা এক যুদ্ধে যোগ দেই। প্রচণ্ড যুদ্ধ হয় সেখানে। উভয় পক্ষ-ই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। রাস্তাঘাটে যেখানে সেখানে মানুষের লাশ পড়ে ছিল। বগুড়া থাকা অবস্থায় পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এই ঘোষণায় আমরা উল্লসিত হই।

এরপর আমরা গিয়ে থাকি বগুড়া শাহ আজিজুর রহমান কলেজে। ওখানে ১৫ দিন ছিলাম। এ সময় টহল দিতাম এবং মাঝে মাঝে রাজাকার আটক অভিযানে বের হতাম।

ঐ এলাকা থেকে আমরা মোট ৭২ জন রাজাকার আটক করেছিলাম। বগুড়াতেই অস্ত্র জমা দেই। বঙ্গবন্ধু দেশে আসার পর ভারতীয় আর্মি গাড়িতে করে আমাদের রাজশাহী দিয়ে যায়। ওখান থেকে বাড়িতে আসি।

বাড়ি এসে দেখলাম বাড়ি বলে কিছু নাই । গ্রামে কোনো লোকও পাচ্ছি না। পরে পার্শ্ববর্তী গ্রামের সামাদ তার বাড়িতে আমাকে নিয়ে যায়। ওখানে তিন দিন থাকি।

আবার বাড়িঘর তৈরি করে পরিবার দেশে নিয়ে আসি। স্কুলে আবার ভর্তি হলাম। ১৯৭৪ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিলাম। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আনুমানিক ১৬টি ছোট-বড় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি।

স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধারা একতায় থাকতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সমাজে শতকরা ৫ ভাগ লোক সম্মান ও মর্যাদা দেয়। ২৬-শে মার্চ ও ১৬-ই ডিসেম্বরের দিন সরকারি কর্মকর্তারা অনেক প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু পরে গেলে ঝামেলা মনে করে। এছাড়া, কখনও কখনও সামাজিক অনুষ্ঠানে ডাকা হয়।

শহীদ গুরনা ভর

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ধলাই চা-বাগানের শ্রমিক গুরনা ভরের পিতার নাম পরদেশী ভর।

১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন সংবাদদাতা ও গাইড-এর ভূমিকা পালন করেছিলেন অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে।

স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস পর্যালোচনায়, ধলাই চা-বাগানের যুদ্ধ বহুল আলোচিত। এই যুদ্ধে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। পাকিস্তানি বাহিনীর পুরো একটা কোম্পানি ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অবস্থান করতো ধলাই ক্যাম্পে।

এই ঘাঁটি আক্রমণে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী যৌথভাবে ভূমিকা রেখেছিল। অন্যান্যের মধ্যে মেজর জিয়াউর রহমান এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।

ধলাই বাগানের পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্প ধ্বংসের জন্য মুক্তিযোদ্ধারা বারবার আক্রমণ করেও ব্যর্থ হন। টিলার গা-ঘেঁষে তৈরি করা বাংকারের সঠিক অবস্থান সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যেত না।

কেননা কোনো চা-শ্রমিক কাছে ঘেঁষলে তাদের পাকসেনারা গুলি করে হত্যা করতো। এই কারণে বাংকারের সঠিক অবস্থান ভাল করে জানার উপায় ছিল না।

চা-শ্রমিক গুরনা ভর জীবনবাজি রেখে ধলাই বাগানে প্রবেশ করেন। ২৯ অক্টোবর ভোরে যুদ্ধ শুরু হয়। ঐ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বেঙ্গল রেজিমেন্টের চালি কোম্পানি, ডেলটা কোম্পানি ও ব্রাভো কোম্পানি।

তিন দিন ধরে যুদ্ধ চলে। এক পর্যায়ে বাংকারের অবস্থান নির্দেশের জন্য গুরনা ভর হামাগুড়ি দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে বাংকারের ওপরে উঠে সঙ্কেত দিতে থাকেন।

কিন্তু দূর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা তার সঙ্কেত বুঝতে না পারায় তিনি চিৎকার করে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ঠিক তখনি গুলিতে তার বুক ঝাঁঝরা হয়ে যায়।

বহু মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগের ফলে ধলাই যুদ্ধে পাক বাহিনীর পরাজয় ঘটে। পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধারা বাংকার থেকে ৭০ জন বিবস্ত্র নারীকে উদ্ধার করেন, তাদের শারীরিক অবস্থা ছিল বর্ণনাতীত।

দেশপ্রেমিক গুন ভর সহ শহীদ অন্যান্য মুক্তিযোদ্বাদের আত্মাহুতির ফলে বীরাঙ্গনাদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল।

মুক্তিযোদ্ধা কেদারলাল হাজরা জানান যে, এ মেয়েদের ওখান থেকে ভারতের কালপুর থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। নিকটবর্তী বাজারের ব্যবসায়ীরা কাপড়-চোপড় দিয়ে সাহায্য করেছিলেন।

শহীদ চম্পক বাড়াইক

সিলেটের জৈন্তাপুর থানার খান চা-বাগানের শ্রমিক চম্পক বাড়াইকের পিতার নাম ছিল- চুনিলাল বাড়াইক। বয়সে তরুণ চম্পক ভারতে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণ নেন।

সহযোদ্ধাদের কাছে তিনি ‘রেকিম্যান’ এবং যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তামাবিল সীমান্ত দিয়ে তার প্রথম ইনডাকশন হয়, তবে ছদ্মবেশে তিনি প্রায়শ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পাকবাহিনীর অবস্থান পর্যবেক্ষণ করতেন।

এরকম এক মিশনে একদিন চম্পক বাড়াই পিয়াইনছড়ার তীরে শত্রুর অবস্থানের খুব কাছাকাছি এসে সশস্ত্র অবস্থায় ধরা পড়ে যান।

পাকসেনারা তাকে নিয়ে একটি গাছে ঝুলিয়ে রাখে। সেখানে তার উপর চলে অমানবিক নির্যাতন- কখনো শরীরে গরম পানি ঢালা হয়, কখনো ঢুকানো হয় সুঁই।

কখনো আবার বেয়নেটের খোঁচা দিয়ে তার শরীর রক্তাক্ত করা হয়। যন্ত্রণাকে তীব্র করার জন্য বাঙালি রাজাকাররা তার সারা শরীরে একদফা লবণ মাখিয়ে দেয়, পরবর্তী দফায় তার শরীরে মাখানো হয় লেবুর রস।

এভাবেই ধীরে ধীরে মুক্তিযোদ্ধা চম্পক বাড়াইকের সুঠাম দেহটি নিথর হয়ে আসে। দূর থেকে আদিবাসী চা-শ্রমিকরা একজন মুক্তিযোদ্ধার এই মর্মান্তিক পরিণতি প্রত্যক্ষ করেছেন কিন্তু কাছে এগোতে পারেননি।

অনিল ছত্রী

সিলেট সদরের কালাগুল চা-বাগানের শ্রমিক ছিলেন অনিল ছত্রী। এই বাগানটি শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে এবং ভেতরে।

পাকবাহিনী সিলেট শহর ও তার পাশেপাশের এলাকাগুলোতে আক্রমণ শুরু করলে লাক্কাতুরা, কেওয়াছড়া, কলাপাড়া প্রভৃতি বস্তি থেকে বহু আদিবাসী শ্রমিক ও বাঙালি পরিবার কালাগুল চা-বাগানে যেয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

তাদের অনেকেই ধারণা করেছিলেন যে, এতটা ভিতরে পাকবাহিনী অগ্রসর হবে না। কিন্তু তাদের ভাবনা ভুল প্রমাণ করে, একাত্তরের ২৬ এপ্রিল পাকসেনারা কালাগুল চা-বাগান আক্রমণ করে এবং গণহত্যা শুরু করে।

প্রায় ৫০ জন শ্রমিককে হত্যা করে তারা তাদের লাশ টিলার নিচে ফেলে দিয়েছিল। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা অনিল ছত্রীর মনে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণার উদ্রেক করে এবং দেশকে শত্রুমুক্ত করতে যুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ করে।

ভারতে প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযোদ্ধা অনিল ছত্রী ৫ নম্বর সেক্টরে ক্যাপ্টেন খুরশীদের অধীনে যুদ্ধ করেন। তিনি সহ কালাগুল বাগানের ১২ জন শ্রমিক মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন।

তিনি টেংরাটিলা, হাদারপাড়, আমবাড়ি, বেরীগাঁও, চানপুর, মাসিমপুর, বাংলাবাজার, ছাতক, গোবিন্দগঞ্জ ও বিশ্বনাথ এলাকায় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

চাঁনপুরের যুদ্ধে তিনি কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য খতম করেছিলেন। গ্রামটি সীমান্তের খুব কাছে অবস্থিত হওয়ায় পাকিস্তানি সৈন্যরা সেখানে খুব শক্ত ঘাঁটি গড়েছিল।

তাদের অত্যাচারে গ্রামটি জনশূনা হয়ে পড়েছিল। অনিল ছত্রীসহ বিশজন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল। চানপুর গ্রামে অপারেশনের জন্য যখন অবস্থান নেন, তখন সেই সংবাদ ইনফর্মারের মাধ্যমে পাকবাহিনী জেনে যায় এবং তারা এসে মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে থাকে।

মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা গুলি ছোঁড়ে। চাঁনপুর ক্যাম্পে পাকিস্তানি সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রচুর এবং তারা দলে দলে অগ্রসর হতে থাকলে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন।

পশ্চাদপসরণের সময় অনিল ছত্রী দলছুট হয়ে পড়েন এবং প্রাণ বাঁচাতে পার্শ্ববর্তী এক পুকুরে নেমে কচুরিপানার নিচে লুকিয়ে থাকেন। সংঘর্ষ থেমে যাবার কিছুক্ষণের মধ্যে পাকসেনারা স্থান ত্যাগ করলেও তিনি সতর্কতা হিসেবে দীর্ঘক্ষণ ঐভাবে ডুবে থাকেন।

এক সময় তিনি দেখলেন ৬ জন পাকসেনা পুকুর পাড় দিয়ে লাইন করে এগিয়ে যাচ্ছে। অনীল ছত্রী এটাকে সুযোগ বুঝে চেপে ধরেন তার এসএলআর-এর ট্রিগার।

পাকিস্তানি সৈন্যরা বুঝতেও পারেনি কোথা থেকে গুলি এসেছে। গভীর রাতে পুকুর থেকে ওঠে কখনো হেঁটে, কখনো দৌড়ে তিনি ভোরবেলা ক্যাম্পে পৌছান।

অন্যান্য অপারেশনের মধ্যে অনীল ছত্রী হাদারপাড় যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এতে তারা জয়ী হন। তবে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের মুখে পিছু হটার সময়ও তাদের হাতে আটক দশ-বারোজন নারীকে সাথে করে নিয়ে যায়।

তাদের উদ্ধার না করতে পারার বেদনা এখনো অনীল ছত্রীর বুকে বাজে। আমবাড়ি এলাকায় প্যাট্রোল করার সময় মরিচা থেকে তারা তিনজন বীরাঙ্গনাকে উদ্ধার করে ক্যাপ্টেন খোরশেদ আলমের কাছে নিয়ে আসেন।

আরেক দফায়, পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে টেংরাটিলার ভয়াবহ যুদ্ধের পর, সেখানকার ক্যাম্প থেকেও বহুদিন আটকে থাকা অনেক বীরাঙ্গনাকে তারা উদ্ধার করেছিলেন যাদের অনেকে ছিলেন গর্ভবতী।

চা-বাগানে বীরাঙ্গনার সংখ্যা প্রচুর। তাদের অপরিমেয় ত্যাগে দেশ স্বাধীন হয়েছে, তবে তাদের বেশিরভাগই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেননি।

স্বাধীন দেশে বীরাঙ্গনাদের অবদান মূল্যায়িত হওয়া প্রয়োজন এবং তাঁদের শ্রদ্ধা জানানো দরকার- মুক্তিযোদ্ধা অনীল ছত্রী এটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন।

উপেন্দ্র বাড়াইক

বীর মুক্তিযোদ্ধা উপেন্দ্র বাড়াইক ছিলেন সিলেটের সদর উপজেলায় অবস্থিত খাদিম চা-বাগানের শ্রমিক। সিলেট-তামাবিল সড়ক সংলগ্ন এই বাগানটিতে পাকসেনাদের বড় ক্যাম্প ছিল।

বাগানের অবাঙালি বাবস্থাপক আজিজ আহমেদ পাকসেনাদের দোসর হিসেবে ভূমিকা রাখতো। পাকসেনারা এ বাগানে দু’দফায় বহু শ্রমিককে হত্যা করে।

একাত্তরের ২৮- শে মার্চ তারা এই বাগানের ৩ নম্বর বস্তির ৩০-৪০ জন শ্রমিককে হত্যা করে। এদের লাশ বহুদিন পর্যন্ত যেখানে মৃত্যুবরণ করেছেন সেখানেই পড়েছিল।

দ্বিতীয় দফায় ১৯ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে এবং গুলি করে পঞ্চাশজনের মতো শ্রমিককে হত্যা করে।

উপেন্দ্র বাড়াইক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে জানিয়েছেন যে, পাকসেনারা দূর্গা, মতিলাল, কিরণ, ভানু, ঘরবোনা, অনীল, নূরী, সুধীর, রামধনী ও শৈলেনসহ বহুজনকে লাইনে দাঁড় করায়।

তারপর যারা কালেমা বলতে পারে, তাদের পৃথক লাইনে দাঁড়াতে বলে এবং অন্যদের গুলি করে হত্যা করে। ভাগ্যক্রমে অনীল, নূরী, শৈলেন এবং তিলা নামের একজন বৃদ্ধা বেঁচে যান।

কিন্তু পরবর্তী সময়ে তিলা এবং সূর্য নামের এক যুবককে জীবন্ত কবর দিয়েছিল পাকবাহিনী। এই হত্যাযজ্ঞের মধ্যেও উৎপাদন অব্যাহত রাখার জন্য ম্যানেজার শ্রমিকদের বাগানে থাকার নির্দেশ দেয়।

যারা কালেমা বলতে পেরেছিলেন অর্থাৎ মুসলিমদের যখন ছেড়ে দেওয়া হয়, সেই সুযোগে উপেন্দ্র বাড়াইক তাদের দলে মিশে প্রাণ বাঁচান। সেইরাতেই তিনি ভারতে পালিয়ে যান।

সেখানে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে তিনি প্রশিক্ষণ নেন এবং পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।

রাযোয়া মাহাতো

আদিবাসী মহাতো সম্প্রদায়ের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা রাযোয়া মাহাতো। বাড়ি জয়পুরহাট জেলার বীরনগর গ্রামে।

১৯৭১ সালে যুবক রাযোয়া মাহাতো বর্তমানে কৃষি শ্রমিক। দারিদ্রের সাথে লড়াই করে কোনোরকমে জীবনপাত করেন।

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে রাতারাতি পরিবারের সবাই মিলে ভারত চলে যান। সাথে কিছু নিয়ে যেতে পারেনি। সব সময় ভয় আর আতংক নিয়ে ভারতে পৌছাল।

শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় পেল। কয়েকদিন পর মাইকে মুক্তিযুদ্ধে যাবার আহ্বান জানানো হল। তিনি মুক্তিযুদ্ধে যাবেন এটা ভাবেননি। তার বাবা একদিন আদেশের মতো করে বললেন- তুমি মুক্তিযুদ্ধে যাও।

দেশের জন্য লড়াই কর। দেশকে মুক্ত কর। বাবার আদেশে মুক্তিযুদ্ধে গেল। ট্রেনিং হল গঙ্গারামপুর এবং শিলিগুড়িতে। ট্রেনিং শেষ করে বীরগঞ্জ পাঠানো হল।

যুদ্ধ তখন শেষের দিকে। ওখানে কয়েকটি অপারেশনে অংশগ্রহণ করি। ১৬ ডিসেম্বর বীরগঞ্জ ছিলাম।

দিনাজপুর শহরে অস্ত্র জমা দিয়ে বাড়ি চলে এল। বাড়ি এসে নতুন করে ঘর করল। নিজের কাজে লেগে গেল। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম দিল। এখন ভাতা পান।

মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সমাজের লোকেরা কিছু সম্মান-মর্যাদা দেয়। ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর পাঁচবিবিতে চিঠি দিয়ে ডাকে।

শহীদ শম্ভু সিং ভূমিজ

মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার ডেনস্টন চা-বাগানের ফুসকুড়ি ফাঁড়ির আদিবাসী শ্রমিক পিরায় সিং ভূমিজের সন্তান শম্ভু সিং ভূমিজ পাঠশালা পর্যন্তও লেখাপড়া করেছিলেন। তারপর ঐ বাগানের সত্যরঞ্জন টিলাবাবুর বাসায় ফুট-ফরমাস খাটার কাজ করতেন।

মৌলভীবাজারের দক্ষিণাঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পাকসেনারা বালিশিরা। ভ্যালি ক্লাবে শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলে। কুখ্যাত পাকিস্তানি সেনা-কর্মকর্তা শের খানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এই ঘাঁটি গড়ে তোলা হয়।

বালিশিরা ক্লাবটি উড়িয়ে দেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছিল কিন্তু তাদের কয়েক দফা প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবার পর এ দায়িত্ব পড়ে দুজন মুক্তিযোদ্ধা বালিশিরা ভ্যালি বাগানের এক কর্মকর্তার ছেলে মানিক দেব ও শম্ভু সিং ভূমিজের ওপর।

একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ফুলছড়া ও কালিঘাট প্রভৃতি আক্রমণ করলে চা-বাগান জনপদের অনেকেই ভারতে আশ্রয় নেন। সত্যরঞ্জন টিলাবাবু ভারতের পথে পা বাড়ান এবং যাওয়ার সময় শম্ভু সিংকে সাথে নিয়ে যান।

শম্ভুর বয়স তখন বিশ-বাইশ। ভারত যেয়েই তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম লিপিবদ্ধ করেন এবং যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে পরপর কয়েকটি অপারেশনে অংশ নেন।

শম্ভু সিং পাঁচটি গ্রেনেড নিয়ে রাতের অন্ধকারে ফুসকুড়ি বাগানে প্রবেশ করেন। কিন্তু রাজাকারের মাধ্যমে পাক বাহিনী খবর পায় বাগানে বাইরের লোক প্রবেশ করেছে।

রাতে গোটা বাগানে তল্লাশি চলে- অপরিচিত শম্ভু সিংকে পাওয়া যায় সকালে। তাকে বাঁচানোর জন্য কয়েকজন শ্রমিক মহাদেব তাঁতীকে শম্ভু সিংহের নকল পিতা সাজিয়ে পাকিস্তানি সেনা-কর্মকর্তা শের খানের কাছে হাজির করে।

অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এই উদ্যোগ সফল হয়, তবে শের খান আদেশ দেয় শম্ভু সিংহকে প্রতিদিন সিন্দুরখান বাজার ক্যাম্পে যেয়ে হাজিরা দিতে হবে।

এটা তার জন্য শাপে বর হয়েছিল। কেন না এ সুযোগে তিনি পাকিস্তানি পতাকা হাতে নিয়ে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিতে দিতে বালিশিরা ভ্যালির সর্বত্র যেতে পারতেন এবং পাকসেনাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে মুক্তিবাহিনীকে পাঠাতেন।

আবার বিকেলে তিনি সিন্দুরখান বাজারে শের খানের নিকট উপস্থিত হতেন। বালিশিরা ভ্যালী ক্লাব আক্রমণের জন্য নির্ধারিত দিনে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সীমান্তবর্তী অবস্থান থেকে কামানের গোলা ছুঁড়তে থাকে এবং আরেকদল মুক্তিসেনা ক্রলিং করে ক্লাব আক্রমণ করে।

এই গ্রুপের সাথে ছিল শম্ভু সিং ভূমিজ। তারা এতটা এগিয়ে যান যে সংঘর্ষ প্রায় হাতাহাতি পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায়। এক সময় একদল সেনা তাকে ধরে ফেলে এবং তার কাছে গ্রেনেড পেয়ে যায়।

সংঘর্ষ থামার পর শুরু হয় নির্যাতন। তার শরীরের এক একটা অংশ কেটে কেটে আলাদা করা হয়। এভাবে বীর মুক্তিযোদ্ধা শম্ভু সিং ভূমিজ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন।

সালগী খাড়িয়া

সিন্দুরখান বাগানের চা শ্রমিক বন্ধু খাড়িয়ার বিধবা মেয়ে সালগী খাড়িয়া। ১৯৭১ সালে তার উপর নজর পড়ে শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ অঞ্চলের কুখ্যাত পাকসেনা শের খানের।

সে সালগী খাড়িয়াকে তুলে নিয়ে যায় এবং জোর করে বিয়ে করে। কিন্তু এই বৈবাহিক সম্পর্কও পাকিস্তানি সৈন্যদের হত্যানিপীড়নের প্রতি সালগীর ঘূণাকে একটুও কমাতে পারেনি।

তিনি বরং বহু কৌশলে যোগাযোগ রেখেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে। ‘স্বামী’ শের খানের অবস্থা, অবস্থান ও গতিবিধি তিনি নিয়মিতভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের জানাতেন।

বাগানের মুক্তিযোদ্ধা উদয় ভূইয়া ছদ্মবেশে তার সাথে যোগাযোগ করে এসব তথ্য সংগ্রহ করে নিতেন। রাজঘাট চা বাগানের উত্তম কুমার তাঁতীর জীবন সালগী খাড়িয়া বাঁচিয়ে ছিলেন খুব কৌশলে।

সে কথা উত্তম কুমার তাঁতী এখনো মনে রেখেছেন। পাক সেনাদের হাতে কেউ ধরা পড়লে শের খান সালগীর কাছে জানতে চাইতেন তিনি চেনেন কিনা।

সালগী বহু অপরিচিত লোককে চেনেন এবং ‘আত্মীয়’ বলে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। সালগীর দেয়া তথ্যানুযায়ীই মুক্তিযোদ্ধারা শের খানকে ‘এ্যাকশন’ করে। ধলাই চা বাগানের একটি বটগাছের উপরে তৈরি মাচায় বসে শের খান মাঝেমধ্যে সীমান্ত অঞ্চল পর্যবেক্ষণ করতো। সালগীর কাছে থেকে সে তথ্য পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে অভিযান চালিয়ে তাকে হত্যা করে। অবমুক্ত সালগী এরপর নিজ পরিবারে ফিরে যান।

উপেন্দ্র ভৌমিক

হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার লালচান্দ চা বাগানের শ্রমিক উপেন্দ্র ভৌমিক ১৯৭১ সালে ছিলেন ২২ বছরের যুবক। তার পিতার নাম মহেন্দ্র ভৌমিক, মায়ের নাম রুফদী ভৌমিক। তিনি একজন প্রত্যক্ষদর্শী।

তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসের দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হবিগঞ্জে ঢুকে পড়ে। শাহজিবাজার বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে শায়েস্তাগঞ্জ পর্যন্ত তারা দখল করে নেয়।

সেখানে তারা ঘাঁটি স্থাপন করে এবং এখান থেকেই তারা বিভিন্ন জায়গায় টহলে বের হতো। ঠিক এমনি করে জ্যৈষ্ঠ মাসে চুনারুঘাট বাজারের দিকে অগ্রসর হয়।

এখানে এসেই পাকবাহিনী লালচান্দ চা বাগানের ম্যানেজারের অফিসে ঢুকে পড়ে। অফিসে যারা ছিলেন তারা সকলে ভয় পেয়ে যান। বাগানের সহকারী ম্যানেজার মান্নান সাহেব পাক-সেনাদের কিছু একটা বোঝালে তারা অন্যদিকে চলে যায়।

তারা যাওয়ার পর পর পাকিস্তানি সৈন্যদের আরেকটি দল রাজাকারদের দেয়া ১১ জন শ্রমিকের একটি নামের তালিকা নিয়ে আসে এবং ম্যানেজারের সাথে কথা বলে চলে যায়।

ম্যানেজার ঐ ১১ জন শ্রমিককে ডেকে পাঠান এবং পরদিন সকালে তাদেরকে গাড়ি নিয়ে পাকবাহিনীর মেজরের সাথে দেখা করার নির্দেশ দেন।

তিনি তাদের আশ্বস্ত করেন যে, তাদের কোনো ক্ষতি হবে না। শ্রমিকরা পরদিন সকালে গেলেন। তাদেরকে লাইন করে নিয়ে কোনো জিজ্ঞাসাবাদ না করে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হয় এবং লাশগুলো গর্তে ফেলে দেওয়া হয়।

রাজাকারদের দেওয়া নামের তালিকায় তারাই ছিলেন, যারা পাকিস্তানের বিপক্ষে ছিলেন । মননশীল এই শ্রমিকরা সব সময় শ্রমিকদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতেন, যুদ্ধে যাওয়ার কথা বলতেন।

বলতেন দেশ স্বাধীন করতে হবে, স্বাধীনতা আমাদের চাই। তাদের মধ্যে ছিলেন কুমার গোয়ালা, কৃষ মেম্বার ও তার দুই ছেলে সুশীল বাউড়ী ও ভুবন বাউড়ী, ছিলেন লাল, হরিদাস, নিপু বাউড়ী, নিউ রায়, রাজেন্দ্র রায়, গৌড় রায় ও মহাদেব বাউড়ী।

তাদের প্রধান নেতা ছিলেন কৃষ্ণ বাউড়ী। এদের মূত্যুর পর স্বাভাবিকভাবে শ্রমিকরা নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে এবং তাদের মধ্যে এই ভীতি জন্মে যে, ঐ ১১ জনের মতো অবস্থা তাদেরও হতে পারে।

এই পরিস্থিতিতে উপেন্দ্র ভৌমিক ও তার সাথে অন্যানা কয়েকজন শ্রমিক মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ত্রিপুরার লোহারবনে ট্রেনিং নিতে চলে গেলেন।

আর যারা গেলেন না তাদেরকে বাগানের কর্মকর্তা হাফিজ উদ্দিন সাহেব আশ্বাস দিলেন যে, যতটুকু সম্ভব তাদেরকে দেখে রাখা হবে এবং তিনি তাদের সান্ত্বনা দিলেন যে, তোমাদের কোনো অসুবিধা হবে না।

উপেন্দ্র ভৌমিক সহ এই বাগানের ৮ জন আদিবাসী শ্রমিক লোহারবনে ট্রেনিং নিয়েছেন। এখানে তারা এসএলআর, এলএমজি ও রাইফেল চালনা শিখেছিলেন। পরবর্তীকালে তারা প্রত্যক্ষভাবে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন।

অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা হলেন অভয় রায়, নলীদ রায়, অজয় বাউড়ী, উমেশ ভৌমিক, রমেশ ভৌমিক, হরিচন্দ্র মুন্ডা ও অনিল মুন্ডা।

মুক্তিযোদ্ধা উপেন্দ্র ভৌমিকের সহযোগীদের মধ্যে অনিল মুন্ডা ছিলেন অন্যতম। উপেন্দ্র ভৌমিক ও অনিল মুন্ডা এ দুজনই পঞ্চায়েতের সদস্য ছিলেন।

উপেন্দ্র ভৌমিক শ্রাবণ মাসে প্রথম অপারেশনে অংশ নেন ফুলতলা চা বাগানের চুঙ্গাবাড়ি নামক স্থানে। তার সাথে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা তো ছিলেনই, এমনকি ভারতের মিত্র বাহিনীর কয়েকজন সদস্যও ছিলেন।

শ্রমিক মুক্তিযোদ্ধাদের তেমন কোন অত্যাধুনিক অস্ত্র ছিল না। ছিল শুধু এলএমজি, এসএলআর এবং রাইফেল। চুঙ্গাবাড়ির আক্রমণের পর উপেন্দ্র ভৌমিক তার বাহিনীর সাথে পাহাড়ের ভিতর ক্যাম্পে চলে যান।

তারপর দ্বিতীয় হামলায় অংশগ্রহণ করেন সিলেট এলাকায়। বিশেষ করে সিলেটের জালালাবাদে বেশি হানাহানি হয়েছিল। সেখানে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা ৭০ জনের একটি পাকিস্তানি সেনাদলকে আক্রমণ করেন ও জালালাবাদকে শত্রুমুক্ত করেন।

মুক্তিবাহিনীর যেসব সদস্য শাহজীবাজার থেকে চাঁদপুরে যাওয়ার পথে, রাস্তায়, প্রান্তে প্রান্তে বোমা পুঁতে রাখতেন।

উপেন্দ্র ভৌমিক ছিলেন তাদের একজন। এই কৌশলে হানাদার বাহিনী ও তাদের ব্যবহৃত গাড়িকে মুক্তিযোদ্ধারা বিধ্বস্ত করে দিতেন।

অজয় বাউড়ী

১৯৭১ সালে যুদ্ধে অজয় বাউড়ী ছিলেন ১৯ বছরের যুবক। তার পিতার নাম বিজয় বাউড়ী এবং মায়ের নাম কমলা বাউড়ী। তার বড় ভাই মহাদেব বাউড়ী ছিলেন লালচান্দ চা বাগানের শহীদ ১১ জনের একজন, যাদের নামের তালিকা করে হত্যা করা হয়েছিল।

ঐ হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য অজয় বাউড়ী মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি ত্রিপুরার লোহারবনে ট্রেনিং নিয়েছিলেন।

তিনিও রাইফেল, এলএমজি ও মেশিনগান চালাতেন। তিনি টুঙ্গাবাড়ি, আখাউড়া, ফুলতলা, কালেট ইত্যাদি বিভিন্ন স্থানে অপারেশনে অংশগ্রহণ করেছেন।

হরিমুন্ড দাস ছিলেন অজয় বাউড়ীর দলের কমান্ডার, ত্রিপুরা রাজোর হেমনগর এলাকার কদমতলীতে ছিল তাদের হেডকোয়ার্টার। তার সাথে আরো ছিলেন সুরুজ কুমার দত্ত, ক্যাপ্টেন মতিন, আর দু’জন সেনাসদস্য হারুন এবং সাখাওয়াত।

অজয় বাউড়ীর দল বিভিন্ন এলাকায় হানাদার বাহিনীর তাণ্ডব প্রত্যক্ষ করেছেন। পাকিস্তানি বাহিনী চা বাগানে এসে জনসাধারণের ওপর অত্যাচার নির্যাতন চালাতো ও অসভ্য আচরণ করতো।

বিশেষ করে মেয়েদের ওপর নিপীড়ন ছিল অপরিসীম। তার চোখের সামনেই তিন-চারজন আদিবাসী মেয়ে ধর্ষিত হয়েছেন। নিরীহ চা শ্রমিকের সমস্ত জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যেত।

তাদের দোসর রাজাকার বাহিনী বিনা অপরাধে চা-জনগোষ্ঠীর ওপর চালাতো অত্যাচার। রাজাকার বাহিনীর সংখ্যাও দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছিল।

কুখ্যাত রাজাকারদের মধ্যে ছিল ওসমান গণি ও আবদুল মোল্লা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা ওসমান গণিকে হত্যা করেছিল। আর রাজাকার আবদুল মোল্লা পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়।

শহীদ নিবারণ উরাং

নিবারণ উরাং ছিলেন চান্দপুর চা বাগানের শ্রমিক। চার ছেলে ও দু-মেয়ের জনক। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের ছোঁয়া ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে অবস্থিত এ বাগানে এসে লেগেছিল।

শ্রমিকদের সংগঠিত করার এবং মিটিংমিছিলে সমাবেশিত করার কাজে নিবারণ ও নজর আলী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়েও তাদের এ ভূমিকা অব্যাহত থাকে।

১৯৭১ সালে চা বাগানে পাকবাহিনী গণহত্যা শুরু করলে নিবারণ উরাং ভারতে গিয়ে মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগাযোগ করেন এবং সীমান্ত অঞ্চলের রাস্তাঘাট সম্পর্কে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেন।

শ্রমিকের বেশে বাগানে বাগানে। ঘুরে পাকসেনাদের অবস্থান জানার জন্য তাকে বারবার আসতে হয়েছে। চা বাগানের আদিবাসী তরুণদের যুদ্ধে যাওয়ার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করা এবং কোথা থেকে কীভাবে কার কাছে যেতে হবে সে ব্যাপারে বড় ভূমিকা তিনি রেখেছিলেন।

পাকিস্তানি বাহিনী নলুয়া চা বাগান, সাতছড়ি চা বাগান এবং তেলিয়াপাড়া ও নয়াপাড়া চা বাগান এলাকায় ছিল খুব তৎপর। তাদের হত্যাযজ্ঞ ও তাণ্ডবলীলা চলছিল প্রায় অবাধে।

একে প্রতিরোধের জন্য মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্ত এলাকায় আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, সেই প্রয়োজনে নিবারণ উরাং প্রবেশ করেন নলুয়া চা বাগানে।

কিন্তু তথ্য নিয়ে ফেরার পথে পাকসেনাদের আক্রমণের মুখোমুখি পড়েন। নলুয়া বাগানে অন্য শ্রমিকদের সাথে তাকে লাইনে দাঁড় করানো হয়। পাকসেনারা শ্রমিকদের কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করেনি বা করার প্রয়োজনও বোধ করেনি।

নিবারণ উরাংসহ কয়েকজনকে একসঙ্গে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে এবং লাশগুলি কুয়োর মধ্য ফেলে দেয়। স্বাধীনতার পর কুয়োতে পচে যাওয়া লাশের মধ্য থেকে নিবারণ ঔরাংয়ের দেহাবশেষ নিয়ে এসে চান্দপুর চা বাগানের রাস্তার পাশে সমাধিস্থ করা হয়।

শহীদ রেবতী মাহালী

খাদিম চা বাগানের শ্রমিক তিন নম্বর বস্তির অধিবাসী যোগীন মাহালীর কন্যা রেবতী মাহালী মাত্র ১৪ বছর বয়সে পাকসেনাদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন।

বাগানগুলিতে যখন গণহত্যা চলছিল ঠিক তখন, একদিন পাকসেনারা গুলি করতে করতে খাদিম চা বাগানের শ্রমিক কলোনিতে আসে। সেখানকার পুরুষ শ্রমিকদের লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে আর কলোনির মহিলাদের একটি ঘরের ভিতর ঢুকিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়।

রেবতীর বাবা সারিবদ্ধ সেই পুরুষদের লাইনে এবং মা আগুনে পুড়ে শহীদ হন। এই দৃশ্য দেখে রেবতী দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলে পাকিস্তানি সেনা সদস্যরা তাকে ধরে প্রকাশ্য স্থানে পালাক্রমে পাশবিক নির্যাতন করে।

তার আর্তচিৎকার টিলায় টিলায় প্রতিধ্বনিত হলেও শ্রমিকরা সাহস করে নি সহায়তার জন্য সামনে আসতে। গভীররাতে দু-একজন এগিয়ে এসে তার শরীর এক টুকরা কাপড়ে ঢেকে দেন। ঐ অবস্থায় কয়েকদিন ধুকে ধুকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

শহীদ কুনকুনিয়া রুদ্রপাল

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় কুনকুনিয়া রুদ্রপাল ছিলেন এক ছেলে ও চার মেয়ের জনক। তিনি ছিলেন মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার কালিঘাট চা বাগানের ট্রাক্টরচালক। তার পিতার নাম সীমাধার রুদ্রপাল।

স্বাধীনতার লক্ষ্যে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠলে তা কুনকুনিয়া রুদ্রপালকেও স্পর্শ করে। শত্রুর হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য তিনি বাগানের শ্রমিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন।

হানাদারমুক্ত মৌলভীবাজার

দেশে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর শ্রমিক-কর্মচারীদের আপত্তি সত্ত্বেও বাগানটি চালু রাখে কর্তৃপক্ষ। তাই কুনকুনিয়া রুদ্রপাল বাগানের ট্রাক্টর চালানোর কাজে নিয়োজিত ছিলেন।

তবে পাকবাহিনী এ বাগানে আসার আগে তিনি বহু তরুণদের যুদ্ধে ট্রেনিং নেওয়ার জন্য ভারতে যেতে সহায়তা করেন। পাকিস্তানি বাহিনী এলাকায় আসার পরে তিনি তাদের অবস্থান ও গতিবিধি সম্পর্কিত তথ্য মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌছাতেন।

কালিঘাট বাগানের ব্রিটিশ ম্যানেজার পাকবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী উভয় পক্ষকেই খুশি রাখার দ্বিচারী নীতি গ্রহণ করেছিলেন। এটা কুনকুনিয়া রুদ্রপালের জন্য সহায়কই হয়েছিল।

চা কোম্পানির ট্রাক্টর ড্রাইভার হিসেবে তিনি খুব সহজেই সীমান্তবর্তী বিভিন্ন জায়গায় যেতে পারতেন কারো সন্দেহ উদ্রেক না করে এবং সে সুযোগে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তথ্য সরবরাহ করতে পারতেন।

তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর উপর বেশ কয়েকটি অপারেশন চালিয়েছেন।

যুদ্ধের শেষভাগে পাকবাহিনী শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ থেকে বিতাড়িত হবার পর কুনকুনিয়া রুদ্রপাল মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয়ে যান।

এই এলাকায় উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় অংশ সিলেটের দিকে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং তারা ৩৬টি গাড়ি নিয়ে এগিয়ে যান। মুক্তিযোদ্ধাদের অপর অংশ তামাবিলের দিকে অগ্রসর হন।

এদের পরিবহনের দায়িত্বে ছিলেন কুনকুনিয়া, তার সিলেট টি-২৩২৪ নম্বর ট্রাক নিয়ে। তারা কিছুদূর মাত্র অগ্রসর হতে পেরেছিলেন। পাকসেনাদের পুঁতে রাখা মাইনের বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় কুনকুনিয়া রুদ্রলালসহ গাড়িভর্তি মুক্তিযোদ্ধাদের দেহ।

শ্রীপ্রসাদ গোয়ালা

হরিলাল গোয়ালার পুত্র চা-শ্রমিক শ্রীপ্রসাদ গোয়ালা ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়া চা বাগানে।

এই বাগানের শ্রমিক ও স্টাফরা মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাদের সহায়তায় ১৪-১৫ মে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের কয়েকটি গাড়ি উড়িয়ে দেন এবং ১৯ মে একটি সামরিক বহর ধ্বংস করেন।

শ্রীপ্রসাদ গোয়ালা সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু হবার পরপরই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য ত্রিপুরায় চলে যান এবং ইয়ুথ ক্যাম্পে আশ্রয় নেন।

তিনি ট্রেনিং পান সিমলা কলোনি ও লোহারবন। চান্দপুর-তেলিয়াপাড়া-সুরমাসাতছড়ি প্রভৃতি বাগানে পাকসেনাদের স্থায়ী ক্যাম্প ছিল, সেখান থেকে প্রায়ই তারা টহলে বেরোত। মুক্তিযোদ্ধারা দফায় দফায় মাইন পেতে রেখে পাকবাহিনীর বেশ ক্ষয়ক্ষতি করেছিলেন। কাছেই সীমান্ত থাকার কারণে পাকসেনারা সবসময় চাপের মধ্যে থাকতো।

শ্রীপ্রসাদ ছিলেন খুব সাহসী । একবার তিনি পাকবাহিনীর খাদ্য পরিবহনের একটি গাড়ি ছিনিয়ে নিয়ে ড্রাইভারসহ সীমান্ত পেরিয়ে ভারতীয় ক্যাম্পে চলে যান।

এছাড়া লালচান্দ চা-বাগানের পাকিস্তানি ম্যানেজার মিয়ালাল পাঠানকে হত্যার ব্যাপারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তবে সেই অপারেশন শেষে ফিরে যাবার পথে দেউড়ী চা-বাগানে তিনি পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন।

তার উপর বেয়োনেট চার্জসহ অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। তবে তিন দিন পর তিনি সেখান থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন এবং কোনোক্রমে মুক্তিযোদ্ধাদের সাতছড়ি ক্যাম্পে পৌছে অজ্ঞান হয়ে যান।

দীর্ঘ অসুস্থতা কাটিয়ে তিনি পুনরায় ইয়ুথ ক্যাম্পে আশ্রয় পান। কিন্তু তিনি ফিরে যান যুদ্ধক্ষেত্রে এবং ২ রজকী-রেহানা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। গাজীপুর বাগানের ভয়াবহ যুদ্ধেও তিনি অংশ নেন।

সেই যুদ্ধে উভয়পক্ষে বহু সৈন্য হতাহত হয়। পাকিস্তানি বাহিনী শেষাবধি এখানে পরাজিত হয়েছিল।

যুদ্ধ শেষে শ্ৰীপ্রসাদ গোয়ালা, নিলু চাষা ও রাজারাম রাজপুত পলায়নপর চারজন পাকসেনাকে জীবিত অবস্থায় পাকড়াও করে চুঙ্গাবাড়ি ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যান।

কাঁকন বিবি

দেশবাসীর কাছে যিনি মুক্তিযোদ্ধা কাঁকন বিবি নামে পরিচিত তিনিই খাসিয়া মুক্তিবেটি কাকেট। তার জন্ম মেঘালয়ে। কাঁকন বিবিরা ৫ ভাইবোন। অল্প বয়সে বাবা-মাকে হারান।

এরপর চলে আসেন বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের মেঘালয় সীমান্তবর্তী হাওর জেলা সুনামগঞ্জের দোয়ারা বাজার উপজেলার জিরারগাঁও এলাকায়। শৈশবকাল থেকে এখানেই তিনি বেড়ে ওঠেন।

বাবা-মা মারা যাবার পর কাঁকন তার বড় বোনের কাছে বড় হন। তখন পাকিস্তান আমল। সীমান্তবর্তী এলাকায় কর্মরত পাঞ্জাবি সীমান্তরক্ষী আব্দুল মজিদ খানের সাথে পরিচয়, তারপর পরিণয় এবং বিয়ে।

বিয়ের পর তার নাম হয়ে যায় নুরজাহান। তার এই দাম্পত্য জীবন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। বিয়ের কয়েক বছরের মাথায়, পাঁচ সন্তানের জননী হওয়ার পর স্বামী আবদুল মজিদ অন্যত্র বদলি হয়ে যান এবং এরপর আর তার সাথে কোন যোগাযোগ রাখেনি।

এই দরিদ্র দুস্থ জীবনে বড় বোনের কাছে আশ্রিতা কাঁকনকে পরিবারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দ্বিতীয় বিয়ে করতে হয়। দ্বিতীয় স্বামীর কাঁকনকে বিয়ের আগেই আরো দুটো বউ ছিল।

যাই হোক দ্বিতীয় স্বামীর ঘরে তার মেয়ে সখিনার জন্ম হয়। এই সংসারও তার টিকে না। কারণ দ্বিতীয় স্বামীও আর একজনকে বিয়ে করে আলাদা সংসার করতে চলে যান।

তাই আবারও একা হয়ে যান কাঁকন বিবি। মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই জীবনযুদ্ধে ৫ সন্তান নিয়ে লড়ছিলেন একাই। ১৯৭১ সালে তার বয়স ছিল ৪৪ বছর।

সেই সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সংগ্রাম চলছে। দেশকে স্বাধীন করতে হবে, প্রয়োজন একজন সাহসী মানুষের। এলাকার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বললেন, যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান জানার জন্য প্রয়োজন একজনকে।

এলাকার সকলে কাঁকন বিবির নাম প্রস্তাব করলেন। এরপর থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও গোটা সময়কালজুড়ে তিনি ৫ নম্বর সেক্টরের একটি ক্যাম্পের হয়ে তার দায়িত্ব পালন করেছেন।

মুক্তিসেনাদের দেখাশোনা এবং খাবার ও অস্ত্র যোগান দেওয়ার পাশাপাশি যুদ্ধকালীন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ নানা খবরাখবর মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট পৌছানোর দায়িত্ব তিনি পালন করেন। অত্যন্ত সফলতার সাথে তিনি কাজগুলো করছিলেন।

৫ দফা সফল অভিযানের পর ৬ বারের সময় পাকবাহিনী তাকে আটক করে এবং তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। তার সারা শরীরে লোহার শিক গরম করে ছ্যাঁকা দেয়।

তার কোমরের নিচে পশ্চাদভাগের দুপাশে গরম লোহার শিক ঢুকিয়ে দিয়ে পাক হানাদার বাহিনী বর্বর নির্যাতন চালায়। এ দাগ তার শরীরে এখনো আছে। তবুও সেদিন তার কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে কোনো তথ্য বের করতে পারেনি হানাদার বাহিনীরা।

সীমান্তরক্ষী আব্দুল মজিদের কথা বলেন। বলেন- ‘আমার স্বামী একজন পাঠান সৈনিক, আমি মুক্তিবাহিনীর লোক নই।’ হানাদার বাহিনী তখন আব্দুল মজিদের সাথে যোগাযোগ করে তার এ কথার সত্যতা যাচাই করে।

পরে নিশ্চিত হয়ে পাকবাহিনী তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। কাঁকন বিবি মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান। একজন সৈনিকের স্ত্রী জেনে পাক হানাদার বাহিনীরাও তাকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করতে চান।

তাকে একটি পরিচয়পত্র দিয়ে তাদের পক্ষে কাজ করতে বলে। খুশি হওয়ার ভান করে কাঁকন বিবি পাকিস্তানিদের এ প্রস্তাবে রাজী হয়ে যান।

কারণ তিনি বুঝেছিলেন, এ কার্ড দেখালে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে তার কাজ করা সহজ হবে।

সেসময় তিনি ৫ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত আলীর তত্ত্বাবধানে মহব্বতপুর, কান্দারগাঁও, বসরাই-টেংরাটিলা, বেনিংগাঁও, নুরপুর, সিলাইর পাড়, দোয়ারাবাজার, টেবলাই, তামাবিল প্রভৃতি এলাকায় তিনি যুদ্ধে অংশ নেন।

এভাবে তিনি প্রায় ২০টিরও বেশি সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে পাক হানাদার বাহিনীর আগমন ঠেকানোর জনা মুক্তিযোদ্ধারা জাউয়া সেতু উড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

সেদিন কাঁকন বিবি গভীর রাতে কলার ভেলায় জেলে-নারীর ছদ্মবেশে মাইন ও গোলা-বারুদ নিয়ে জাউয়া সেতুর কাছে পৌছান এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সংকেত পাঠান।

তাঁর সংকেত অনুযায়ী সেদিন মুক্তিবাহিনী জাউয়া সেতু উড়িয়ে দিতে সক্ষম হন। এতগুলো সফল অপারেশনের পর স্থানীয় মানুষ ভালবাসা ও শ্রদ্ধায় তাকে ‘খাসিয়া মুক্তিবেটি’ নামেও ডাকেন।

জীবনের ওপর ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিবাহিনীকে তিনি গোপনে অনেক সহায়তা দিয়েছেন।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর দীর্ঘ সময়ে এ মহিয়সী বীর মুক্তিযোদ্ধার খোঁজ কেউ রাখেনি। যুদ্ধের পর প্রায় ভিক্ষা করেই দিন কাটাতেন তিনি।

পরে ১৯৯৭ সালে সংবাদপত্রের মাধ্যমে দেশবাসী এ বীর মুক্তিযোদ্ধার কথা জানতে পারেন। সংবাদপত্রের মাধ্যমে কাঁকন থেকে নুরজাহান পরবর্তীকালে দেশব্যাপী কাঁকন বিবি নামে পরিচিতি লাভ করেন।

১৯৯৯ সালে দৈনিক জনকণ্ঠ তাকে গুণীজন সম্মাননা প্রদান করে। পরবর্তীকালে প্রতিমাসে আর্থিক ভাতার ব্যবস্থা করলেও ২০০২ থেকে তা বন্ধ হয়ে গেছে।

এখন তার আশ্রয় ৬ সন্তানের মধ্যে বেঁচে থাকা মেয়ে সখিনার ঘরে। মেয়ের সংসারেই অভাব আর দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে প্রায় সময়েই অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় তার দিন কাটে।

তার সাথে কেউ দেখা করতে গেলে সবাইকে খাসিয়া পান-সুপারি দিয়ে আপ্যায়ন করেন। নিজেও পান খেয়ে ঠোট লাল করা মুখে মিষ্টি কথায়, বাংলা ও খাসিয়া ভাষায়, মুক্তিযুদ্ধের নানা কাহিনীর কথা শোনান।

আর বলেন, এ দেশের মানুষের সুখের লাগি আমি যুদ্ধ করছি। কত মা-বোনরে রাজাকাররা আমার সামনে পাকসেনাদের জন্য ধরে নিয়ে গেছে।

কত নারীকে যুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীরা ধর্ষণ করেছে। অনেককে মেরে ফেলেছে। একথা মনে হলে আমার চোখ জলে ভরে যায়।

এই বীর নারী-মুক্তিযোদ্ধা ২০০৬ সালে দেশের গৌরব বহন করে মুক্তিযুদ্ধ উৎসব কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়েছিলেন।

সেখানে দেশমাতৃকার জন্য তিনি কীভাবে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন সে অভিজ্ঞতার কথা গর্বের সাথে সবাইকে জানিয়ে এসেছেন।

আদিবাসী খাসিয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা নারী কাঁকন বিবি নিজের জীবন বাজি রেখে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন। এখন তার বয়স ৮০-র কোঠায় পৌছেছে। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া কাঁকন বিবি আজো অত্যন্ত আশাবাদী।

দেশকে তিনি সন্তানের মতো লালন করেন। তিনি মনে করেন জীবনের বিনিময়ে যে, স্বাধীনতাকে আমরা পেয়েছি সেটা কখনও লুণ্ঠিত হবে না। তাঁর ভাষায়, দেশের লাগি যুদ্ধ করছি, তোমরা কোনো বিবাদ না কইর‌্যা দেশটা সাজাও, আমি তোমারে সাহস দিমু দোয়া করমু।

তিনি একজন আদিবাসী বীর সৈনিক। বৃদ্ধ কাঁকন বিবি আজ ভালো নেই। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার এই পরিণতি দেশের ও দেশের মানুষের জন্য কখনই শুভ হতে পারে না।

যে কাকন শুভ ও সুন্দরের জন্য লড়েছেন সেই কাঁকন এখন অশুভ’র জালে আষ্টেপৃষ্ঠে সেই ক্ষত নিয়ে চরম দুর্ভোগের মধ্যে দিনাতিপাত করছেন।

তেরেসা মাহাতো

বাংলাদেশের এক ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নাম মাহাতো। উত্তরবঙ্গের সিরাজগঞ্জ, জয়পুরহাট ও রাজশাহীর বিভিন্ন অঞ্চলে এদের বসবাস। এই জনগোষ্ঠীরই এক বীর মহিয়সী নারীর নাম তেরেসা মাহাতো।

১৯৫১ সালে দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাটের রাজবাড়ির শীতল গ্রামে তাঁর জন্ম। কৃষক পিতা যহন গনো এবং মাতা জলেশ্বরীর প্রথম সন্তান তেরেসার পড়াশোনা শুরু হয় দিনাজপুরর সেন্ট ফিলিপস স্কুলে।

১৯৭০ সালে এই স্কুল থেকেই তিনি এসএসসি পাস করেন। ১৯৭১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল স্রোতে চরাচর বিস্তৃত, তখন তিনি দিনাজপুর পিটিআইতে ট্রেনিংরত।

বচনায় তখন পিটিআই’র ছাত্রীদের নার্সিংয়ে প্রশিক্ষণের জন্যে নিয়ে যাওয়া হয় মিশন হাসপাতালে। ২৫ মার্চ রাতে দেশব্যাপী হায়েনাদের নির্বিচারে নিধনযজ্ঞ চললে তেরেসাও তাতে আক্রান্ত হন।

তার হাত, পা ও মাথায় গুলি লাগে পাকসেনাদের। এই অবস্থায় কিছুদিন অতিবাহিত করার পর তেরেসা সুস্থ হবার আগেই রত হয়ে যান যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য সেবায়। এভাবেই তেরেসা প্রাণের আবেগে জড়িয়ে যান মুক্তির মহান যুদ্ধে।

স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে ১৯৭২ সালে মরিয়মপুর মিশন স্কুলে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে কর্মজীবন শুরু হয় তেরেসা মাহাতোর । দীর্ঘদিন এখানেই চাকরি করে ২০০২ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ২ ছেলে ও ১ মেয়ের জননী। তার স্বামীর নাম সুভাষ মাহাতো।

বাবনী রাজগৌড় বাবনী রাজগৌড়ের স্বামী গৌড়া রাজগৌড় ছিলেন কমলগঞ্জের পাত্রখোলা চা বাগানের শারীরিক শিক্ষা প্রশিক্ষক। বাবনী রাজগৌড় এই বাগানেরই শ্রমিক হিসেবে নিয়েজিত ছিলেন।

মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদানে স্বামীর ডাক পড়লে বাবনীও তাতে সংযুক্ত হন। চা বাগানের ঘরে ঘরে সংগ্রহ করতেন যুদ্ধে সহায়ক তথ্যাবলি।

কিন্তু অচিরেই যুদ্ধের সাথে মনেপ্রাণে জড়িয়ে যাওয়া এই দম্পতি শিকার হন ষড়যন্ত্রের।

স্থানীয় রাজাকারদের ইন্ধনে একদিন তাঁদের ঘরের দরজায় আঘাত হানে পাক হায়েনার দল। দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে টেনে-হিচরে নিয়ে যায় স্বামীসহ বাবনী রাজগৌড়কে।

এক অপরিসীম অসহায়ত্ব নিয়ে রয়ে যায় তার দুটি শিশুকন্যা। এই ঘটনার ১ মাস পর জানা যায়, বাবনীকে তাঁর স্বামীর সাথে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় শ্রীমঙ্গল আর্মি কোয়ার্টারে।

ক্যাম্পের সামনে বটগাছের সাথে বেধে ব্রাশ ফায়ার কাছে হয় তাদের। কিন্তু তাদের মৃতদেহ আর পাওয়া যায়নি।

এই শহীদ দম্পতির রেখে যাওয়া ২টি কন্যা সন্তানের একজন স্বাধীনতা- উত্তর সময়ে অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় মারা যান।

বর্তমানে বেঁচে হাত একমাত্র সন্তান পুতুল রাজগৌড় এখনো জানেন না, তার পিতামাতার নাম সরকারি শহীদদের তালিকায় উঠেছে কি না।

রাঙামা কুৰ্মী

মৌলভীবাজারে কমলগঞ্জ উপজেলার একটি বাগানের নাম ধলাই চা বাগান। বহু কারণে বিশিষ্ট এই চা বাগানটির অবস্থান বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের কাছে।

তাই ১৯৭১ সালে এখানে স্থাপিত হয়েছিল এক কোম্পানি পাকসেনা ও ভারী অস্ত্রসমৃদ্ধ ক্যাম্প।

এখানে অপারেশন চালাতে গিয়ে বেশ কয়েকবার ব্যর্থ হন মুক্তিযোদ্ধারা। পরবর্তীকালে এই ঘাঁটিতে আক্রমণ চালাতে ভারতীয় কমান্ডারের সাথে মেজর জিয়া যুক্ত হন।

২৮ অক্টোবর ১৯৭১ সাল। মুক্তিযুদ্ধের এই বিশেষ দিনটিতে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর সাথে যুক্ত হয়ে ধলাই ক্যাম্প আক্রমণ করে।

১ নভেম্বর পর্যন্ত চলা টানা যুদ্ধে প্রাণ হারান বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানসহ বেশ কয়েকজন জাতীয় বীর।

রাঙামা কুৰ্মী এই ধলাই চা বাগানেরই মেয়ে। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন ২৩ বছরের এক বিবাহিতা নারী।

এই বাগানের বহু অপমানিত নারীর তিনি একজন। ১৯৭১-র জুন মাসের এক রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে হঠাৎ করেই অন্ধকার হয়ে আসে রাঙামার চরাচর।

বাগানের আরো তিনজন যুবকের সাথে স্বামীকে তুলে নিয়ে মেরে ফেলে পাক হায়েনারা। স্বামীকে বাঁচাতে প্রবল কাকুতিমিনতি করেও কোনো লাভ হয়নি।

বরং এই ঘটনার কিছুক্ষণ পরেই যখন রাঙামা শাশুড়ির সাথে অন্যত্র পালিয়ে যাচ্ছিলেন, পথিমধ্যে ধরা পড়ে যান পাক-সেনাদের হাতে।

এরপর তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় কদমতলী বাংকারে। সেখানে রাতভর রাঙামার উপর চলতে থাকে বহু অমানুষের অকথ্য অত্যাচার। পরের দিন দুপুরে জ্ঞানহীন রাঙাম্মকে ফেলে দেওয়া হয় বাংকারের সামনের রাস্তায়।

এই ঘটনার পর আর স্বাভাবিক হতে পারেননি বীরাঙ্গনা রাঙামা। কয়েকদিন পর শরণার্থী হয়ে ভারতে যাওয়ার প্রাককালে হার্টফেল করে মারা যান বীরাঙ্গনা রাঙামা কুর্মী।

লক্ষ্মী সবর

ভারতীয় সীমান্ত-লাগোয়া একটি চা বাগান শ্রীমঙ্গলের খেজুড়ীছড়া চা বাগান। চতুর্দশী লক্ষ্মী সবর এই বাগানেরই চা শ্রমিক গোপলা সবরের আদরের মেয়ে। আসন্ন যুদ্ধের ঘনঘটায় থমথমে সারাদেশ।

গোপাল তৎপর হন লক্ষ্মীর বিয়ে দিতে। এরই মাঝে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় তা আর হয়ে ওঠে না। ক্রমান্বয়ে যুদ্ধের রেশ চা বাগানে ছড়িয়ে পড়লে লক্ষ্মীকে নিয়ে পিতার উদ্বিগ্নতা বেড়ে যায় আরো কয়েকগুণ।

কয়েকদিন বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থাও করেছিলেন তিনি। কিন্তু তাতে শেষ রক্ষা হয়নি। পাক হায়েনার হাতে ধরা পড়ে যান লক্ষ্মী সবর।

সময়টা জুলাইয়ের মাঝামাঝি। বর্ষাঋতুর একটি দিন। লক্ষ্মী সেদিন বাড়িতেই ছিলেন। তার উপস্থিতি টের পেয়ে রাজাকাররা খবর দেয় পাকসেনাদের।

অতঃপর শান্ত মাটি কাঁপানো গাড়ি আর বুটের শব্দ চলে আসে লক্ষ্মী মেয়েটির খুব কাছে। চতুর্দিকে অমানুষদের বিকৃত উল্লাস।

জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন লক্ষ্মী সবর। এই অবস্থাতেই গাড়িতে তুলে নেয় পাকসেনারা। নিয়ে যায় সিন্দুর খান সেনানিবাসে।

এখানেই কেটেছে তার তিন মাসের নারকীয় জীবন। সীমাহীন নিপীড়নে ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে গেলে মুমূর্ষ অবস্থায় তাকে ক্যাম্পের সামনের রাস্তায় ফেলে রাখা হয়।

কিছুক্ষণ বেঁচে থেকে এখানেই অসহায় মৃত্যু ঘটে লক্ষ্মী সবরের। এরপর তার শেষ আশ্রয় হয় ইপিআর ক্যাম্পের বধ্যভূমি।

বিন্দু নায়েক

বিন্দু নায়েক। ১৪ বছরের এক আদিবাসী কিশোরী বালিকা। তার পিতা দুর্গা নায়েক মৌলভীবাজার জেলার শিলুয়া চা বাগানের শ্রমিক।

যুদ্ধের সময় শত্রুপক্ষের সরব উপস্থিতি আশপাশে ছড়িয়ে পড়লে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন পিতা দুর্গা নায়েক।

তার উদ্বিগ্নতা কিশোরী বিন্দুকে নিয়ে। একমাত্র কন্যার যাতে কোনো সর্বনাশ না হয় তাই পরামর্শ নিতে যান চা বাগানের ইংরেজ ম্যানেজারের কাছে।

ম্যানেজার সরল মনে অভয় দিলে নিশ্চিন্ত মনে কাজ করতে থাকেন দুর্গা তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে।

অন্যদিকে স্থানীয় রাজাকারদের মাধ্যমে পাকসেনাদের কাছে পৌছে যায় ঘরে বিন্দুর একা থাকার খবর। এমনি একটি অনুকূল সময়ে শেয়ালের মতো বিন্দুর ঘরে ঢোকে পাঁচ-ছয়জন পাকসেনা।

বিন্দুর আর্তচিৎকার ছড়িয়ে পড়ে বহুদূর। কিন্তু কেউই প্রাণভয়ে এগিয়ে আসেনি সেদিন। ঘরের মধ্যেই দীর্ঘক্ষণ নারকীয়তা চলে বিন্দুর শরীরে।

এক সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেললে তাকে ফেলে রেখে চলে যায় হানাদাররা। মাটিতে পড়ে থাকেন রক্তাক্ত জ্ঞানহীন বিন্দু নায়েক।

পরবর্তী নিপীড়নের আশঙ্কায় সেদিন রাতের আঁধারেই বিন্দুকে নিয়ে পিতা-মাতা চলে যান ভারতে। কিন্তু বিন্দুকে তারা বাঁচাতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধের কয়েকদিন পরে স্বাধীন দেশে তিনি অভিমানে ত্যাগ করেন এই পৃথিবী।

শান্তি ভৌমিজ

বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে বসবাসরত ভুমিজ আদিবাসীদের একটি অংশের বাস সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন চা বাগানে। মিতিঙ্গা চা বাগান তার মধ্যে একটি।

শান্তি ভৌমিজ এই বাগানেরই চা শ্রমিক অর্জুন ভৌমিজের স্ত্রী। স্বামী অর্জুনের অস্তিত্বের আদিগন্ত জড়িয়ে ছিল মানুষের অধিকার আদায়ের মন্ত্র।

রাজপথে সংগঠিত ১৯৬৯-র গণঅভ্যুত্থানকে নিভৃত চা বাগানেও ধারণ করেছিলেন অর্জুন ভৌমিজ।

অন্যদিকে স্ত্রী শান্তি ভৌমিজ ছিলেন একেবারে অন্যরকম। অথচ সেই শান্তির ঘরে অশান্তির বিষ নিয়ে একদিন ঢুকে পড়ে ৫ পাকসেনা।

ঘরের মধ্যেই পাঁচ পশুর উপর্যুপরি বলাৎকারে যখন শান্তি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তখনি চলে যায় পাকিস্তানিরা।

জ্ঞানহীন অবস্থায় তার নাক-মুখ দিয়েও অবিরল ধারায় রক্ত ঝরছিল। জানা যায়, স্বামী অর্জুনকে শায়েস্তা করার জন্যে স্থানীয় রাজাকারদের প্ররোচনায় ধর্ষিত হয়েছিলেন শান্তি।

এই ঘটনার পর সাত দিন বেঁচে ছিলেন শান্তি ভৌমিজ। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন তিনি।

অহল্যা চাষা

সিলেটের মণিপুর চা বাগান। এই বাগানেই শ্রমিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন মকুন্দ চাষা।

অহল্যা ছিলেন তাঁরই স্বপ্নের সন্তান, আদুরে মেয়ে। গোলার চাষার প্রিয়তম পত্নী। শান্তিতেই কাটছিল দিনগুলো উভয়ের।

যুদ্ধ কিছু সৃষ্টি করলেও ধ্বংস করে দেয় সবকিছু। একথাই যেন সত্য হয়ে উঠেছিল সেদিন, যেদিন রাজাকারদের সহায়তায় অহল্যার দরজায় ধাক্কা দিয়েছিল রক্তপিপাসু পাকসেনারা।

ত্রিশ বছরের এক মমতাময়ী নারীর দেহটিকে টেনে-হিচঁড়ে নিয়ে যায় তথাকথিত সভ্য জগতের বাসিন্দারা। নিয়ে যায় মণিপুর চা বাগানের রেস্টহাউসে।

তখন থেকে প্রতিদিনই কোনো-না-কোনো পশুর আস্তানায় যেতে হয়েছে তাকে পশুদের খেদমত করার জন্যে।

রাজাকার আবদুল হক তার ট্রাক্টরে তুলে সন্ধ্যায় নিয়ে যেত অহল্যা চাষাকে। আর পরদিন সকালে ফিরে আসত একটি জ্যান্ত লাশ নিয়ে।

শত আকুতি আর আর্তচিৎকারেও মানবতা দেখায়নি পাক পশুরা। তাকে না পেলে নরপশুরা তার স্বজনদের মেরে ফেলবে, এই ভয়ে কখনো আত্মহত্যা বা পালানোর চেষ্টা করেননি অহল্যা। এভাবেই জ্বলতে জ্বলতে নিভে যায় একটি দীপ, অহল্যা চাষা। অবশেষে তার লাশটিও পায়নি তার পরিবার।

একই রকম অথবা তার চেয়েও করুণ পরিণতির শিকার হয়েছেন এদেশের অসংখ্য আদিবাসী নারী। মুক্তির জন্যে তাদের এই আত্মোৎসর্গের কথা ইতিহাস লিখে রাখে না।

সে কথা রয়ে যায় আদিবাসী নর-নারীর মুখে মুখে মহত্ত্বের মহিমা নিয়ে। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আরো কয়েকজন।

বীরাঙ্গনা নারী হলেন- সিন্ধুর খান চা বাগানের মুরতিয়া রবিদাস, শিশেরবাড়ি চা বাগানের যাহালী তাঁতী, ফাঁড়ি কাপাই চা বাগানের সাবিত্রী নায়েক, চান্দপুর চা বাগানের যশোধা নায়েক, সোনারূপা চা বাগানের লক্ষ্মী রানি লামা, মণিপুর চা বাগানের ধনী কর্মকার, খাদিম নগর চা বাগানের রেবতী মাহালী, লক্ষ্মীছড়া চা বাগানের শুভ্রদা বাইরী, ছোটলেখা চা বাগানের যমুনা ভুমিজ প্রমুখ।

লিয়ানপুম বম

খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী আদিবাসী বম সম্প্রদায়ের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা লিয়ানপুম বম। ১৯৩০ সালে বান্দরবান জেলার মধ্যম পাড়ায় তার জন্ম। পিতা-মৃত সালহার বম।

স্থানীয় খ্রিস্টান মিশন স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এরপর যোগ দেন ইপিআর-এ । সৈনিকের ধর্ম যুদ্ধ করা। এটাই তার পেশা। কিন্তু বাঙালি না হওয়ায় বিভিন্ন লোভ দেখানো হতো সে সময়ে অবাঙালি সৈনিকদের। যাতে তারা পাকিস্তানিদের হয়ে যুদ্ধ করে।

কিন্তু না, দেশের মাটি, যেখানে নাড়ি পোতা, যেখানে পূর্ব পুরুষদের পদচিহ্ন পড়েছে সেই মাটির সাথে কোনো বেইমানী করা যায় না।

তাই লিয়ানপুম বম কোনো ইন্ধনের শিকার হন নি। যুদ্ধ করেছেন নিজের দেশের হয়ে। ১৯৭১-র মার্চ মাসের শেষের দিকে তিনি তার দলের সাথে সিলেট হয়ে আসাম সীমান্তে পৌঁছেন।

সেখান থেকে ফিরে এসে মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে অংশ নেয় অনেকগুলো অপারেশনে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ময়মনসিংহ অপারেশন, রাজশাহী অপারেশন, সিলেট অপারেশন ইত্যাদি। এই শেষ দুটি অপারেশনই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।

কারণ, পাঠান ও পাঞ্জাবি সেনারা অতর্কিতে আক্রমণ করেছিল তার দলকে। আশপাশের গ্রামবাসীরা ফেন, পান্তা, সম্ভব হলে ভাত, পোশাক ও আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করেছিল সে সময়।

আজও কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন লিয়ানপম সেইসব গ্রামবাসীদের যাদের অফুরন্ত ত্যাগ তাদের যুদ্ধ জয়ে সহায়ক হয়েছিল।

বয়সের ভারে ন্যুজ, একাংশে প্যারালাইসড নিয়ে ঘরের খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে লিয়ানপুম মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বিশেষ স্মৃতি হাতড়ে বলেন, সিলেটের অপারেশনে বেশ কয়েকজন মিত্রবাহিনীর সহযোদ্ধা হারিয়েছিলাম আমরা।

রক্তাক্ত শহীদের বুকের রক্ত আঙুল দিয়ে মুখে নিয়ে খুনের রক্তে দিশেহারা হয়ে নতুন করে দল নিয়ে এগুচ্ছিলাম আমি। সেই অপারেশনে ১৪০ জন হানাদার বধ করে অপারেশনকৃত অঞ্চল শত্রুমুক্ত করি।

শহীদের রক্তই ছিল সেদিন আমার অনুপ্রেরণা। তাদেরকে পরবর্তীকালে ভারতে নিয়ে দাফন করা হয়। হারিয়ে যাওয়া সেই সহযোদ্ধাদের মতো আমার জীবনও সেদিন অনিশ্চিত ছিল সব সময়।

ভাবতাম, মরে গেলে তো ভালোই, দেশের জন্যে মরলাম। কিন্তু যদি বেঁচে থাকি তাহলে বাঁচব একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে।

অন্তত আমার পরিবারের সদস্যদের জন্যে একটু ভালো ঘর, ভালো খাবারের ব্যবস্থা হবে। আমার সেক্টর কমান্ডার মুক্তিযুদ্ধে আমার কৃতিত্ব দেখে বলেছিলেন- লিয়ানপুম তোমাকে একটি ছ’তলা ভবন অন্তত করে দিব, তোমার সন্তানদের ভালো চাকরি দিব।

তোমার এটি পাওনা। আর সেই কমান্ডার একসময় দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর হয়ে বসেন। কিন্তু আমার কথা ভুলে গেছেন অন্য অনেকের মতোই।

হ্যাঁ, আমি মেজর জিয়ার কথা বলছি। যিনি কথা দিয়ে কথা রাখেন নি। আজ আমার ভাঙা ঘর, টিনের উপর বাঁশের ভার দেওয়া। এছাড়া আমার আর কিছু নাই।

এই ঘরে জায়গাটুকু আবার কেড়ে নেওয়ার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে মারমারা। কেস করেছি। সেই কেস চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। এ পর্যন্ত দিয়েছে এই দেশ মুক্তিযুদ্ধে আমার বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্যে….।

এভাবেই নিষ্ঠুর স্বপ্ন প্রতারিত করে যায় লিয়ানপুম বমকে, যার এখন চলাফেরা করার শক্তি নেই, নেই কথা বলার শক্তিও।

পরিবারের অসহায় সদস্যদের ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার কথা ভেবে আজও কুল পান না তিনি। এটাই কি তার স্বাধীনতার পাওনা অথবা অর্জন?

ইন্দ্রজিৎ কৈরী

ইন্দ্রজিৎ কৈরী আদিবাসী চা জনগোষ্ঠীর একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে তিনি চা শ্রমিক হিসেবে আলীনগর চা বাগানে কাজ করতেন।

২৫- শে মার্চের পর এই এলাকায় পাকবাহিনী প্রবেশ করলে চা শ্রমিকদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো শুরু করে।

পাকবাহিনীর ভয়ে দলে দলে চা শ্রমিকরা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এপ্রিল মাসে অন্যান্য আত্মীয়সজনের সাথে ইন্দ্রজিৎ কৈরী আসামের চরগোলা শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন।

মাতৃভূমিকে হানাদারমুক্ত করার অভিপ্রায়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। জুন মাসে তিনি অন্যান্য যুবকের সাথে লোহারবন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ২১ দিন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষকদের কাছ থেকে তিনি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে জকিগঞ্জ এলাকায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে বাজারামের নেতৃত্বে যুদ্ধ শুরু করেন।

তাদের গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন মরহুম আলাল মিয়া। তার সহযোদ্ধা ছিলেন- রাধারাম, গৌড় প্রমুখ। সেপ্টেম্বরঅক্টোবর মাসে সিলেট শহর, করিমগঞ্জ সীমান্ত এলাকায় বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নেন।

বিজয়ের দিন তিনি সিলেট শহরে ছিলেন। বিজয়ের সংবাদ পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা তখন আবেগে আপ্লুত ও খুশিতে আত্মহারা। যুদ্ধশেষে তিনি কমান্ডার আলাল মিয়ার নেতৃত্বে সিলেট জামেয়া স্কুলে অস্ত্র জমা দেন।

ইন্দ্রজিৎ কৈরীর বর্তমান বয়স প্রায় ৬০ বছর। তার পিতা রাজপতি কৈরী, মাতা-বাচিয়া কৈরী, স্থায়ী বসবাস- মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার আলীনগর চা বাগানে।

তিনি চা শ্রমিক পরিবারের সদস্য। ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। ১৯৬৮ সালে তিনি বিয়ে করেন। স্ত্রী স্বরসতী কৈরী একজন গৃহিণী। তারা ২ কন্যা ও পুত্র সন্তানের বাবা-মা। ১ ছেলে চা শ্রমিক, অন্যজন বেকার। ২ মেয়ে বিবাহযোগ্য।

ছেলেমেয়ে কাউকে বেশি লেখাপড়া করাতে পারেননি। বর্তমানে তিনি চা শ্রমিকের পেশা থেকে অবসর নিয়েছেন। তিনি দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত।

সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। সরকারি তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার নাম নেই। এ জন্য তিনি কোন ভাতা পান না। রহস্যজনক কারণে তার নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে।

ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ। করেও তালিকায় নাম নেই। অথচ অনেক অমুক্তিযোদ্ধা এমনকি রাজাকারদের নামও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে।

আর বাদ দেয়া হয়েছে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার নাম। কিন্তু এর বিচার কে করবে? কেউ তা দেখার নেই। তাহলে ইন্দ্রজিৎ কৈরী মুক্তিযুদ্ধ করে কি ভুল করেছেন? এটাই তাঁর প্রশ্ন বাংলাদেশের ১৫ কোটি মানুষের কাছে?

কার্তিক পাত্র

চা জনগোষ্ঠীর আদিবাসী পাত্র সম্প্রদায়ের বীর মুক্তিযোদ্ধা কার্ত্তিক পাত্র। ১৯৭১ সালে তিনি চা শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন।

২৫ মার্চের পর পাকসেনারা চা বাগান এলাকায় ব্যাপক তাণ্ডবলীলা চালায়। জীবন বাঁচাতে তিনি পরিবার পরিজন নিয়ে ভারতের শ্রীনাথপুর শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় গ্রহণ করেন।

মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার প্রবল ইচ্ছায় সেখান থেকে লোহারবণ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যোগদান করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষকদের কাছে ১ মাস প্রশিক্ষণ নেন।

প্রশিক্ষণ শেষে জালালপুর ক্যাম্প থেকে কমান্ডার আশরাফ মিয়ার নেতৃত্বে বিভিন্ন স্থানে অপারেশন শুরু করেন। গোয়াইনঘাট, বিয়ানীবাজার, হরিপুর এলাকায় তিনি যুদ্ধ করেন।

রঘুরচক, জকিগঞ্জ, হরিপুর যুদ্ধে পাকবাহিনীর সঙ্গে তারা জয়ী হন। তাঁর সহযোদ্ধা ছিলেন মৃত নন্দলাল গঙু, শুকুর মিয়া, সাদির মিয়া, ইন্দ্রজিৎ কৈরী প্রমুখ। ১৬-ই ডিসেম্বর বিজয়ের দিন তিনি হরিপুরে যুদ্ধ করেন। সারাদিন যুদ্ধ চলে।

অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। যুদ্ধে তাঁরা জয়ী হন। সন্ধ্যার দিকে যুদ্ধ শেষ হলে সংবাদ পান দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। বিজয়ের সংবাদে মুক্তিযোদ্ধারা বিজয় উল্লাসে মেতে উঠেন।

হরিপুর যুদ্ধে পায়ে গুলি লেগে তিনি আহত হন। করিমগঞ্জ হাসপাতালে ১০ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর তিনি সুস্থ হন । ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে তিনি সিলেট জামিয়া স্কুলে অস্ত্র জমা দেন।

কার্তিক পাত্রের বর্তমান বয়স ৫৮ বছর। তার পিতা কাণ্ড পাত্র, মাতা স্বরসতী পাত্র। তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন মৌলবীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার আলীনগর চা বাগানে। তিনি ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন।

১৯৮০ সালে বিয়ে করেছেন। ২ ছেলে ১ মেয়ের জনক। এখনো তিনি ভাঙ্গা পা নিয়ে জীবিকার তাগিদে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকেন।

পায়ে আঘাতের কারণে ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারেন না। যুদ্ধের পর আর্মি মেডিকেলে পায়ের চেকআপ করিয়েছিলেন।

কিন্তু পরে সেটির আর কোন হদিস পাওয়া যায়নি। যুদ্ধাহত হওয়ার জন্য তিনি কোন ক্ষতিপূরণ পাননি। অনেক আবেদন নিবেদন ও তদ্বির করেও কোন কাজ হয়নি।

এখন একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মাত্র ৫০০ টাকা আর্থিক ভাতা পাচ্ছেন। ভাঙ্গা পা নিয়ে জীবনের দায়ভার নিয়ে বেড়াচ্ছেন।

আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর সেনানীদের দুরবস্থা দেখার আজ কেউ নেই। এ দেশে স্বাধীনতার সৈনিকদের কোন মূল্যায়ন হয়নি। আজও এ দেশে যুদ্ধাপরাধীদের কোন বিচার হলো না। জীবন যুদ্ধের পরাজয়ে দুঃখে-শোকে আজ মুক্তিযোদ্ধারা নির্বাক।

আপিগা রেলী

চা জনগোষ্ঠী আদিবাসী রেলী সম্প্রদায়ের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা আপিগা রেলী। ১৯৭১ সালে তিনি শমসেরনগর চা বাগানে চা শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন।

২৫ মার্চের পর পাকবাহিনীর ভয়ে পালিয়ে ভারতের মুনবেড়ি শরণার্থী শিবিরে সপরিবারে আশ্রয় নেন। অন্য পরিচিত যুবকদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য মনুবেড়ি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।

প্রশিক্ষণ শেষে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে দেশে প্রবেশ করে বিভিন্ন স্থানে অপারেশন শুরু করেন। তিনি যুদ্ধে গোলাবারুদ বহন করার কাজ করতেন।

ভানুগাছ, সুনছড়া এলাকায় তিনি বিভিন্ন যুদ্ধে গোলাবারুদ বহন করেছেন। আজ মুক্তিযুদ্ধের ৩৬ বছর পর তিনি যুদ্ধের স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছেন। এখন আর তেমন কিছু মনে করতে পারেন না।

এছাড়া তিনি বাংলা ভাষা খুব বেশি বোঝেন না। তিনি রেলী ভাষায় কথা বলেন। মুক্তিযোদ্ধা আপিগা রেলীর বর্তমান বয়স প্রায় ৭০ বছর। চা শ্রমিকের কাজ থেকে এখন অবসর নিয়েছেন। তার পিতার নাম সিব্বা রেলী, মাতা পার্বতী রেলী।

স্থায়ী নিবাস শমসেরনগর, কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার। তিনি লেখাপড়া জানেন না। ৬ সন্তানের জনক। ছেলেমেয়েরাও কেউ লেখাপড়া জানে না। ২ ছেলে চা শ্রমিক।

অন্যরা বাইরে দিনমজুরের কাজ করে। আর্থিকভাবে হতদরিদ্র এই মুক্তিযোদ্ধা কোন ভাতা পান না। কারণ, সরকারি-বেসরকারি কোন তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার নাম নেই।

অনাহারে-অর্ধাহারে কংকালসার দেহ নিয়েই চলছে তাদের জীবন। সহজ সরল বোকা প্রকৃতির এই পরিবারের এখনো বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই।

সুরেন চন্দ্র পাহান

নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর থানার সুরেন চন্দ্র পাহান ১৯৭১ সালে ছিলেন ২৫ বছরের যুবক।

উত্তরগ্রাম ইউনিয়নের শিবরামপুর গ্রামের দহপাড়ার জংলা পাহানের দ্বিতীয় সন্তান সুরেন।

১৯৭১-এর এপ্রিল মাসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মহাদেবপুরে নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করলে পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে তিনি ডাঙ্গি সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে যান এবং কালাইবাড়িতে এক বিদ্যালয়ে আশ্রয়গ্রহণ করেন।

ভারতে পৌছেঁই সুরেন নিজ উদ্যোগে তার কাকাতো ভাই গিরিশ চন্দ্র পাহান, পরমেশ্বর চন্দ্র পাহান, ধীরেন চন্দ্র পাহান ও এক ভগ্নিপতি রবিন চন্দ্র পাহানকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য বালুরঘাট ক্যাম্পে যোগ দেন।

প্রথমত, সুরেন ও তার সহযোদ্ধাদের পারিলা ক্যাম্পে এক মাস ও পরবর্তীকালে শিলিগুড়ি ক্যাম্পে দুমাস উচ্চতর গেরিলা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

প্রশিক্ষণ শেষে তারা সাত নম্বর সেক্টর কমান্ডার কর্নেল (অব:) কাজী নুরুজ্জামানের অধীনস্থ বাহিনীতে যোগ দেন। এরপর মহাদেবপুর থানার খাজুর ইউনিয়নের নুর নবীর নেতৃত্বে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন।

বাংলাদেশে প্রবেশ করেই স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় সাপাহার, পোরশা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সংলগ্ন নওগাঁ জেলার থানাগুলোতে সফল হামলা চালাতে সক্ষম হন।

স্থানীয় দালালদের বাড়িতে পরপর কয়েকটি হামলা চালানোর ফলে, ঐ এলাকায় পাকবাহিনীর তৎপরতা স্তিমিত হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পরে আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা সুরেন ফিরে যান যুদ্ধপরবর্তী ক্ষেত-মজুরের পেশায়।

অন্যের জমিতে কামলা হিসেবে কাজ করে যা আয় করতেন তা দিয়ে বাবা, মা, স্ত্রী ও এক ভাইকে নিয়ে সংসার চলতো। স্বাধীনতার দু’বছরের মাথায় কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়ে অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করেন। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ থানা কমান্ডের তালিকায় তাঁর নাম আছে।

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা