এ অশ্রুজলে বিলাস সাজে না, চিক্কোবি!

Sulav Changma Dhenga
Last updated Aug 31st, 2021

1891

featured image

“১৯৬০ ওর গদাআনে ভাজেই নেজেয়ে সেই সুখকানি”

(১৯৬০ এর বাঁধটা ভাসিয়ে নিয়ে গেল সেই সুখগুলো)

আমার খুব প্রিয় একটি গানের এই লাইনটি শোনার পর থেকে আমার প্রচন্ড কৌতুহল গানটির মাধ্যমে কোন সে সুখের কথা স্মরণ করেছেন গীতিকার! চাকমা ভাষায় গদা মানে বাঁধ।

বোঝাই যাচ্ছে এখানে কাপ্তাই বাঁধ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। গানটিতে কাপ্তাই বাঁধ পরবর্তী একটি বিরহী অনুভূতির চিত্র পাওয়া যায়। চাকমা গানটির প্রথম কলিটি এরকম-

“তর আর মর দেগা ওয়ে ইধোত আগে মারিশ্যা লঞ্চানত”
(মনে পড়ে তোমার- আমার দেখা হয়েছিলো মারিশ্যার লঞ্চটায়)

বাঘাইছড়ি বাংলাদেশের অন্যতম বড় একটি উপজেলা। অথচ কাপ্তাই বাঁধ হওয়ার আগে এই বাঘাইছড়ি/মারিশ্যা অঞ্চলটি ছিল মূলত মায়ানি রিজার্ভ ফরেস্ট। এখন মারিশ্যায় লঞ্চ চলে।

রাঙ্গামাটি থেকে বাঘাইছড়ি উপজেলায় যাওয়ার একমাত্র ভরসা এইতো কিছুদিন আগেও এই নৌপথই ছিল।

এখন অবশ্য খাগড়াছড়ি-দীগিনালা হয়ে সড়কপথেও যাওয়া যায়। রাঙামাটি থেকে নৌপথে বাঘাইছড়ি/মারিশ্যা যাওয়ার পথে লংগদু উপজেলার সদর বাজার ঘাটে পৌঁছানোর আগে হাট্টলী বিল নামে একটা বড় বিল পার হয়ে যেতে হয়।

এই বিল এখন সারাবছর কাপ্তাই বাঁধের আটকানো পানির নীচে ডুবে থাকে। কিন্তু একটা সময় এই বিল ছিল উর্বর চাষযোগ্য ভূমি, সেখানে ছিল অনেক “ভরন্দি আদাম”/(সুজলা-সুফলা গ্রাম!)-র সমন্বয়ে সমৃদ্ধ জনপদ। তাই গীতিকার আপসোসের সুরে বলেছেন,-

“হাক্কন পরে হাট্টলী মাদত দেগা অহল দিজনর
বুজেই দিলুঙ এই পানিত তলে জাগায়ানি এল আমার!”

(কিছুক্ষণ পরে হাট্টলী মাঠে দেখা হলো দুজনার
বুজালাম তোমায় এই পানির নীচের জমিগুলো ছিলো আমাদের!)

কাপ্তাই বাঁধ হওয়ার পরে গ্রামের পর গ্রাম, পুরাতন চাকমা রাজবাড়ি, উর্বর শস্যভূমি চোখের সামনে তলিয়ে যায়। হাজার হাজার উদ্বাস্তু পাড়ি জমায় পার্শ্ববর্তী ভারতের মিজোরাম, ত্রিপুরা আর অরুণাচল প্রদেশে।

সম্পূর্ণ বদলে যায় একটি সমৃদ্ধ জনপদের জনমিতি, ভৌগলিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস। এই বাঁধ এর কারণে উদ্বাস্তু হওয়া শতশত পরিবার কে কোথায় পাড়ি জমাল তার চিত্রটা মেলে গানটির এই কলিতে-

“গেলাক হিয়ে থেগাকূলে, হিয়ে গেলাক মিজোরাম
তিবিরে আসাম আর অরুণাচল হিয়ে থেলঙ চাদিগাঙ”

(কেউ গেলো ওই থেগাকূলে, কেউ গেলো মিজোরাম
ত্রিপুরা, আসাম আর অরুণাচল, কেউ থাকলো চাদিগাঙ!!)

(চাকমারা পার্বত্য চট্টগ্রামটাকে হিল চাদিগাঙ বলেও অভিহিত করে থাকে)

কর্ণফুলী নদীটিকে চাকমারা বরগাঙ বলে সম্বোধন করে। এই বরগাঙকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল সমৃদ্ধ এক জনপদ।

বড়গাঙ তাই মিশে আছে পার্বত্য চট্টগ্রামের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, গান-কবিতা, প্রেম-বিরহ, আনন্দ-বেদনা এবং দ্রোহ-সংগ্রামের সামগ্রিকতায়।

বরগাঙের পাড়ে পুরাতন রাঙামাটি শহরটি কেমন ছিলো তার একটি খন্ডচিত্র পাওয়া যায় খুব বিখ্যাত একটি চাকমা গানে-

“হিল্লে আধিক্কে স্ববনত দেক্কোং পুরান রাঙামাত্যে
তুত্তে বোইয়ের বাহর্ , সিমেই তুলা উড়ি যার, স্ববনত দেক্কোং বরগাঙও পার।”

(গতকাল হঠাৎ স্বপ্নে দেখলাম পুরাতন রাঙামাটি
প্রবল এলোবাতাসে শিমূল তুলা উড়ে যায়, স্বপ্নে দেখলাম বরগাঙ এর পার।)

এরপরের কলিগুলো,-

“ভাজি উত্তে বুইয়ানি, ভাজি উত্তে ঘরান মর
চিগোন হালর সমাজ্জেগুন বালুচরত খারা অদন।”

(ভেসে উঠেছে ধানখেতগুলো, ভেসে উঠেছে ঘরটি আমার
বালুর চরে খেলা করে ছোট্টবেলার সাথীরা আমার)

আবার,-

“বার্গী পেখকুন উড়ি যাদন, টদেকখুনে ধান হাদন
ছাভা ছাভা মিধে রোদত হোগিলুনে গীদ গাদন।”

(বার্গী পাখিরা উড়ে যায়, টিয়াপাখিরা ধান খায়
ছায়াময় মিষ্টি রোদে কোকিলেরা গান গায়।)

বরগাঙের পারে আদাম ছিলো, সেই আদামগুলোতে এলোবাতাসে বড় বড়- উঁচুউঁচু শিমূল গাছের নরম তুলাগুলো মেঘের পানে ভাসতো, বার্গী পাখিরা নীলআকাশে উড়ে বেড়াতো, কোকিলরা মিষ্টি রোদের ছায়ায় কুহু কুহু ডাকতো।

বরগাঙের পারে বালকদের নিআলজি খেলা, ঘরের সিংগবা জুড়ে মায়েদের পানজা নাগর, উফ! পুরাতন রাঙামাটি।

এমনে এমনে তো আর প্রবাদ হয়নি, বরগাঙানও চাই পারা-খাদিয়ানও ধয় পারা (বরগাঙটাও দেখে আসি-খাদিটাও ধুয়ে আসি)।

বরগাঙ এবং পুরান রাঙামাটির স্মৃতি বারবার ঘুরেফিরে এসেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের গানে-কবিতায়। অন্য আরেকটি চাকমা গান এরকম-

“ওই দেগোচনি চেঙে দুয়ার, যিয়োত আগে রিজার্ব বাজার
তা পূগেন্দি গাঙও সঙমধ্যে এলঅ ম’ আদাম
সেক্কে ন এল্ পানি, ন অয় গদাগান
গাঙও পারত আমি থেদং মিলি-ঝুলি!!”

(দেখছো কি ওই চেঙে-র মুখ, যেখানে আছে রিজার্ব বাজার
তার পূবে গাঙ-র মাঝে ছিল আমার গ্রাম
তখন আসেনি পানি, ছিল না কোন বাঁধ
গাঙের পারে মোরা ছিলাম মিলেমিশে!!)

বর্তমান যে রিজার্ব বাজার লঞ্চঘাট, ঠিক সেখানটাই বা তার কিঞ্চিত একটু পাশেই ছিলো পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম প্রধান নদী চেঙের মুখ।

চেঙে নদীটি পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরের দিক থেকে এসে খাগড়াছড়ি-মহালছড়ি হয়ে এই রিজার্ব বাজারেই বরগাঙের সাথে মিলিত হয়েছে।

গানটিতে চেঙে নদীর মুখের পূর্ব পাশে পুরাতন রাঙামাটি শহরকে কেন্দ্র করে যে গ্রামগুলো ছিল, তার বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে।

“গাজঅ ফাগন্দি জুনান যেক্কে উধে, ইধোত তুলিচ মরে”/(গাছের ফাঁক বেয়ে যখন জোছনা ছড়ায়, মনে করো আমায়) ব্যাপক জনপ্রিয় এই চাকমা গানটিতে গীতিকার সুরে সুরে বরগাঙের উপর গদা/বাঁধ হওয়ার আগে যে চিত্র তার স্মৃতি তাঁর প্রেয়সীকে মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন এভাবে-

“এক কুড়ি বজর আগর কধানি, আহজি যিয়েগোই গদা পানিত!!
সলিল রায়ও হধা ইধোত উধে নি, দলাচানও গীদ কানত বাজে নি??
ত মনঅ সুন্দুক্কোত থোগেই চেলে, থোগেই পেবে!!
এচ্চে তুই হুধু আগচ হিজেনি, ন দেগং তরে গদাআন উয়ে ধুরি!!”

(কুড়ি বছর আগের সেই কথাগুলো তলিয়ে গেছে বাঁধের পানিতে!!
সলিল রায় এর কথা কী মনে পড়ে, কানে কী বাজে দলাচানের গান??
তোমার মনের সিন্দুকে খুঁজে দেখ, পেয়ে যাবে!!
আজ তুমি কোথায় আছো জানি না, বাঁধটি হওয়ার পরে নেই কোন দেখা!!)

কত বিরহের উপাখ্যান এই বাঁধ জন্ম দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। কত গেরস্তের ঘর ভেঙেছে, কত স্মৃতি ভুলিয়ে দিয়েছে এই অভিশপ্ত বাঁধ তা মনে না করে জুম্মবী থাকতেই পারে না। চিক্কোবি ইধোত তুল সে হধানি, ইধোত তুল।

অন্য আরেকটি গানে বাঁধটির কারণে অভিশপ্ত উদ্বাস্তু জীবনের কথা গীতিকার স্মরণ করেছেন এভাবে-

“গদান অবার পরেন্দি, নানান মানেই নানান জাগাত
যিয়োন তারা মনত দুখকানিলোই, যিয়োন তারা মনত দুখকানিলোই!”

(বাঁধটি হওয়ার পরে, নানান মানুষ নানান জায়গায়
চলে গেল তারা মন:কষ্টে, চলে গেল তারা মন:কষ্টে!)

আবার,-

“বেলান ডুপ্পেগোই জুনান উট্টে আগাজত, গোদা দিন্নো দুগ গরিনেই, বোচ্চোঙ ইঝোরত”

(সুর্য ডুবে গেছে, জোছনাটা ওই আকাশে, সারাটা দিন কষ্ট করে, বসে আছি ইঝোরে)

– জনপ্রিয় এই চাকমা গানটিতেও গদা/বাঁধ হওয়ার আগে পুরাতন চাকমা রাজবাড়ির স্মৃতি হাতরানো হয়েছে এভাবে-

“গদাআন ন’ অবার আগেন্দি রাজঘরান তুই দেক্কোচ্ নি??
পুরোন দিনোর পুরোন দিনুন ইধোত উধের নি???”

(বাঁধটি হওয়ার আগে রাজবাড়িটি দেখেছো কী??
পুরনো দিনের পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে কী???)

কাপ্তাই বাঁধটি প্রথমদিকে হওয়ার কথা ছিলো বর্তমান সুবলং বাজারের একটু নীচের দিকে। এখনো সুবলং যাওয়ার পথে এর কিছু চিহ্ন চোখে পড়ে।

এখানে কিছু কাজও হয়েছিলো। পরবর্তীতে ভারতের আপত্তির কারণে প্রকল্পটির স্থান বর্তমান কাপ্তাইয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়।

সুবলং-এ বাঁধটি নির্মিত হলে ভারতের মিজোরাম রাজ্যের কিছু অংশও প্লাবিত হতো, তাই ভারত আপত্তি তোলে। সুবলং-র পুরনো নাম ছিলো শলক দোর (শলক মুখ); দেখুন-স্নেহকুমার চাকমার “জীবনালেখ্য”।

এই শলক নদীটি জুরাছড়ি উপজেলার দক্ষিণ-পূর্ব সর্বশেষ ইউনিয়ন দুমদুম্যা-র বড়হলগ হয়ে প্রায় পুরো জুরোছড়ি উপজেলাটিকে সাপের মত পেঁচিয়ে বর্তমান সুবলঙের সন্নিকটে বড়গাঙের সাথে মিলিত হয়েছে।

মূল বরগাঙ নদীর উৎস মিজোরামের লুসাই পাহাড়! বরগাঙের একেবারে শুরুর দিকেই বরকল উপজেলার ঊরিঙে মৌন/হরিণা পাহাড় থেকে উৎপন্ন হওআ ঊড়িঙে/হরিণা ছড়াটি কিছুটা নেমে এসে থেগা ছড়াটির সাথে মিশে বড়গাঙে রুপ নিয়েছে।

কিছুদূর নীচে তার সাথে মিলেছে জুরাছড়ি উপজেলার শলক ছড়া। শলক ছড়াটির সাথে মিশেছে ছোট ছোট অনেক ছড়া-ছড়ি।

বড়হলগ, ফইরেছড়া, নলবন্নেছড়া, শিলছড়ি প্রভৃতি ছড়াগুলো পূর্ব-পশ্বিমমুখী হয়ে উত্তর-দক্ষিণ মুখী শলক ছড়াটায় মিশেছে। থেগা ছড়াটিতে যেমন মিশেছে আন্দারমানিক।

বরকল উপজেলার দক্ষিণে জুরাছড়ি আর উত্তরে বাঘাইছড়ি। বাঘাইছড়ি উপজেলা থেকে হাজলং নদীটা কিছুটা দক্ষিণে এসে মিলিত হয়েছে মেইনীর সাথে।

হাজলঙ বেয়ে একটু নীচে নামলে লংগদু উপজেলা সদর বাজার ঘাটটির একেবারেই সন্নিকটে যেখানে এখন মাইনী বাজার সেখানে মেইনী নদীটি মিলেছে হাজলঙের সাথে।

এই হাজলঙে ছোটবড় আরো অনেক ছড়া-ছড়ি মিশে আছে, এই যেমন,- সাজেক, শিজক, দূরছড়ি ইত্যাদি।

হাজলঙ এবং মেইনীর সম্মিলিত প্রবাহ একসাথেই সমর্পিত হয়েছে বড়গাঙের বুকে!! আর উত্তরের দিক থেকে খাগড়াছড়ি-মহালছড়ি হয়ে সোজাসুজি দক্ষিণমুখী হয়ে চেঙে নদীটা বর্তমান রিজার্ব বাজারের সন্নিকটে মিলিত হয়েছে বড়গাঙ-র সাথে।

এরপর আরও কিছুটা দক্ষিণে বর্তমান কাপ্তাই বাঁধটির সন্নিকটে বিলাইছড়ি উপজেলা থেকে নেমে আসা রেইংখং নদীটাও এসে মিলিত হয়েছে বরগাঙর সাথে। রেইংখং বিলাইছড়ি উপজেলার প্রধান নদী।

এটি বিলাইছড়ির একেবারে দক্ষিণদিক থেকে উৎপন্ন হয়ে ফারুয়া ইউনিয়ন হয়ে নেমে এসে বর্তমান ধনপাতা এবং বড়াদম বাজারের কাছাকাছি যে কাপ্তাই নেভিক্যাম্প তার সন্নিকটে বড়গাঙের সাথে মিলিত হয়েছে।

বলা যায়, খাগড়াছড়ির প্রধানতম নদী চেঙে এবং রাঙ্গামাটির সবকটা প্রধান নদীই বরগাঙের সাথে মিলিত হয়ে প্রথমে উত্তর-দক্ষিণ এবং পরে সোজা পশ্চিমমুখী হয়ে চলে গেছে বঙ্গোপসাগরে।

কাপ্তাই বাঁধ হওয়ার ফলে ৫৪ হাজার একর ফসলি জমি তলিয়ে যায় পানির নীচে। হাজার হাজার উদ্বাস্তু পার্শ্ববর্তী ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে শরণার্থী হয়ে যেতে বাধ্য হন। অনেকেই চলে যান খাগড়াছড়ি, দিঘীনালা, মাটিরাঙ্গায়।

কেউ কেউ চলে যান ভারত সীমান্তবর্তী থেগাকূলে। উদ্বাস্তুদের বড় একটা অংশ অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসেবে নতুন বসতি করেন বর্তমান মারিশ্যা/বাঘাইছড়ি অঞ্চলের গহীন মায়ানী রিজার্ব ফরেস্টে। অনেকেই চলে যান বান্দরবানের কিছু কিছু জায়গায়।

যেমন- বান্দরবান সদর উপজেলার কুহালং ইউনিয়ন, থানচি উপজেলার বলিপাড়া। বান্দরবানের বর্তমান নীলাচল পর্যটন কেন্দ্রটির আশেপাশে যে তঞ্চঙ্গ্যা পাড়াগুলো চোখে পড়ে খুব সম্ভব তারাও এই কাপ্তাইয়েরই উদ্বাস্তু।

আর রাঙামাটির আসামবস্তি-কাপ্তাই রোডের দুপাশে যে গ্রামগুলো চোখে পড়ে এরা সবাই কাপ্তাই বাঁধের অভিশাপ নিয়ে কীভাবে বেঁচে আছে তা যারা নিয়মিত এই রোডে আসা-যাওয়া করেন একটু চোখ বুলালেই তা বুঝা যাবে।

বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ইউনিয়নটার বড় অংশটা এখনও রিজার্ব ফরেস্টের অধীনে। ফারুয়া ইউনিয়নে যাদের বসবাস তারা সবাই এই কাপ্তাইয়ের ভিকিটিম।

কাপ্তাই বাঁধ, ছবিঃ উইকিপিডিয়া

বিদ্যুৎ উৎপাদন কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটির গুরুত্বপূর্ণ একটি উদ্দেশ্য হলেও এর পাশাপাশি মূলত পার্বত্য রাঙামাটির বনজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ লুন্ঠন করাই ছিল এর প্রধানতম কারণ।

এই যে- হরিণা, থেগা, শলক, হাজলং, মেইনী, রেইংখং-র দুপার জুড়ে বিসতৃত পাহাড়ের সারি, সেই পাহাড়ের বনজ সম্পদ আহরণকে খুব সহজ করে দেয় এই কাপ্তাই বাঁধ। অথচ বাধঁটি হওয়ার ৫০ বছরের অধিক সময় পরেও কাপ্তাইয়ের একেবারে ২/১ কিলোমিটারের কাছাকাছি করে লাগোয়া

যে পাহাড়ি গ্রামগুলো, যেমন-কামিল্লেছড়ি, বেঙছড়ি, মগবান, জীবতলী, বড়াদম প্রভৃতি জুম্ম অধ্যুষিত এলাকায় এখনো বিদ্যুৎ পোঁছাইনি। বরকল, বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি-র বিসতৃত এলাকাজুড়েও নেই বিদ্যুৎ।

আমরা আমাদের রাজবাড়ি হারালাম, জনপদ হারালাম, উর্বর জমি হারালাম, বনজ সম্পদ হারালাম বিনিময়ে বিদ্যুৎ উদপাদিত হলো, আমরা চিরঅন্ধকারে নিমজ্জিত হলাম আর কারো কারো ঘর আলোকিত হয়ে উঠলো আমাদের রক্তে-আমাদের অশ্রুতে!!!

এখন কাপ্তাই বাঁধের ফলে সৃষ্ট কৃত্রিম হ্রদটাকে কেন্দ্র করে রাঙামাটি শহরের পরিচিতি হচ্ছে পর্যটন নগরী। এখানে শহুরে লোকেরা মৌসুমী প্রমোদ ভ্রমণে বেড়াতে আসে।

হ্রদের জলের উপর স্টিমার ভাসিয়ে তারা পাহাড় দেখে, মেঘ দেখে, আকাশ দেখে, ঝরণা দেখে অথচ আমাদের দু:খটাকে দেখে না, কষ্টটাকে দেখে না, পুরাতন রাঙামাটির অশ্রুসিক্ত বেদনাকে দেখে না!!

সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড়ের বর্তমান প্রজন্ম, এই আমরাও আমাদের অন্তরের গহীনে লুকিয়ে থাকা অশ্রু আর অব্যক্ত বেদনাগুলোকে পাশ কাটিয়ে চলার বৃথা চেষ্টা করি অবচেতনভাবে অথবা সচেতনভাবেই!!!

আমরা যারা উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট প্রভৃতি শহরে পড়তে আসি সেই তথাকথিত শিক্ষিত ছাত্র-যুবসমাজ এই আমরাই,আমাদেরই অশ্রুজলের উপর নাচানাচি করি, ব্যাচ পিকনিক করি, মাইক বাজাই, সেলফি তুলি, মজা লুঠি, মাস্তি করি আরও কত্ত কী?

আমরা আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতাকে, কষ্টকে-বেদনাকে ভুলে যাই অথবা ভুলিয়ে দেওয়া হয়। চারিদিকেই তো ভুলিয়ে দেওয়ার-ভুলিয়ে রাখার কত শত আয়োজন!!!

আদিপুরুষের অশ্রুসিক্ত ইতিহাসকে ভুলে থাকার এবং অস্বীকার করার প্রতিযোগিতাই কেউই আমরা পিছিয়ে নেই। এ তো হওয়ার কথা ছিলো না!!

যাস্ট একবার ভাবুন তো, সেই ৬০ দশকেই মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এই বাঁধটিকে কেন জুম্ম জনগণের জন্য মরণফাঁদ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন?

কাপ্তাই বাঁধ, জুম পাহাড়ের মরণফাঁদ!! জুম্ম জনগণের জন্য সর্বনাশী এই মরণফাঁদ প্রিয় বড়গাঙকে করে রেখেছে চিরদুঃখী।

তোমাকে-আমাকেও নয় কী? হরিণা, থেগা, শলক, হাজলং, মেইনী, চেঙে, রেইংখং থেকে প্রতিমুহুর্তে শতশত পাহাড় আর হাজার হাজার পাহাড়ির অশ্রুজল বড়গাঙ বেয়ে নীরবে বয়ে যায়।

এ অশ্রু চিবচরণের, এ অশ্রু রাধামনের, এ অশ্রু তান্যেবীর, এ অশ্রু পুনংচানের। এ অশ্রু তোমার, এ অশ্রু আমার। এ অশ্রুজলে বিলাস সাজে না, চিক্কোবি…

লেখকঃ সুলভ চাকমা 

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা