লুসাই জনগোষ্ঠীর বিবাহ (ইননেইহ্‌)

Jumjournal
Last updated Jan 18th, 2020

899

featured image

বিবাহ (ইননেইহ্‌) এর সংজ্ঞাঃ আদিবাসী লুসাই সমাজে পাত্র-পাত্রীর বিবাহ অনুষ্ঠান মূলতঃ সামাজিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নির্ভর। বর্তমানে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের পর তাদের বিবাহ অনুষ্ঠানে খ্রিস্টধর্মীয় রীতিনীতির অনুসরণকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

লুসাই সমাজে পাত্র-পাত্রী নির্বাচন নিজেদের পছন্দমতো হলেও বাবা-মা কিংবা অভিভাবকের সম্মতিতে বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। লুসাই সমাজে স্বীকৃত বিবাহের পূর্বশর্ত হচ্ছে ‘ইননেইহয়না’ অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে লুসাই বিবাহিত দম্পতি সমাজসিদ্ধভাবে একত্রে বসবাস ও দৈহিক মিলনের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের অধিকার লাভ করে।

উপরোক্ত রীতি অনুসরণ ব্যতীত লুসাই সমাজে নর-নারীর দৈহিক মিলন ও সন্তান জন্মদান সমাজসিদ্ধ নয় বিধায় অবৈধ বলে গণ্য হয়। সমাজ স্বীকৃত বিবাহের ক্ষেত্রে খ্রিস্টধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে ‘ইননেহ্‌নি’ সামাজিক অনুষ্ঠানের সম্পর্ক বিদ্যমান।

বিবাহের আনুষ্ঠানিকতাঃ

বিবাহ রীতি: বিয়ের সামাজিক রীতি অনুসারে পাত্রপক্ষের তরফ হতে ‘পালাহ’ (ঘটক)-এর মাধ্যমে পাত্রীপক্ষের অভিভাবকের নিকট বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে হয়। পাত্রীর অভিভাবকের সম্মতি পাওয়া গেলে পাত্রীর পিতামহ অথবা তার অবর্তমানে পাত্রীর পিতার দাবী অনুসারে পাত্রপক্ষকে কনে পণ দিতে হয়।

কনে পণ বাবদ গবাদি পশু অথবা সমমূল্যের টাকা প্রদান (মান ইন হ্লান) করতে হয়। কনে পণ দিতে ব্যর্থ হলে পাত্রের ঔরসজাত পুত্র কিংবা নাতি পর্যন্ত এই পণ পরিশোধ করতে বাধ্য থাকে। কনে পণ (মান ইন হ্লান) প্রদানের দিনেই কনেপক্ষ ভোজের আয়োজন ও বিয়ের দিন (ইননেহ্‌য়না) ধার্য করে।

এই অনুষ্ঠানে বরপক্ষ এসে ‘ইননেহ্‌য়না’ সম্পন্ন করে। অনুষ্ঠানের এক মাস পর বর-কনের দেখা এবং বরের বাড়িতে কনে বউ নেয়া হয়। বর্তমানে খ্রিস্ট ধর্মীয় রীতি অনুসারে চার্চে ‘বান’ প্রকাশের মাধ্যমে লুসাই পাত্রপাত্রীর বিবাহ হয়।

বিবাহের যোগ্যতাঃ লুসাই সমাজে বিবাহ (ইননেইহ্‌) বন্ধনে আবদ্ধ হবার ক্ষেত্রে সাবালক হবার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সাবালকত্ব অর্জনের বিষয়টিকে সমাজে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়।

সাবালকত্বের মাপকাঠি হিসেবে পাত্রের বেলায় ‘থুরুং’ (বেতের তৈরী বড় ঝুড়ির বিশেষ) তৈরী, জুম চাষ, ঘরবাড়ি তৈরীর কাজে পারদর্শী এবং ভারবহনের ক্ষমতার অধিকারী কিনা যাচাই করা হয়।

পাত্রীর বেলায় কাপড়, লুঙ্গী, কম্বল তাতে বোনার দক্ষতা এবং রান্নাবান্নাসহ গৃহস্থালী কাজের উপযুক্ত হতে হয়। লুসাই সমাজে বাল্য বিবাহের প্রচলন নেই।

যদিও প্রচলিত সাবালকত্ব আইন ১৮৭৫, অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন ১৮৯০, বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন ১৯২৯, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ বাংলাদেশের সকল ধর্মীয় সম্প্রদায় ও জনগোষ্ঠীর উপর সমানভাবে প্রযোজ্য।

এ সকল আইনে অপরিণত বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ১৯২৯ সনের বাল্য বিবাহ নিরোধ আইনের ২(ক) ও ২(খ) ধারায় শিশু ও বালক বলতে যার বয়স পুরুষ হলে ২১ বছরের কম এবং নারী হলে ১৮ বছরের কম বুঝাবে।

লুসাই জনগোষ্ঠীর গ্রামীণ সমাজে প্রচলিত কম বয়সের বিবাহ সংক্রান্ত বিষয়ে দেশের বিদ্যমান আদালতে যদি কোনো কারণে প্রশ্ন উত্থাপিত হয় এবং যদি প্রমাণিত হয় যে, বিবাহিত পক্ষগণ নাবালক তাহলে লুসাই সামাজিক প্রথামতে নাবালকের বিবাহ কার্য সমাজসিদ্ধ হলেও তার কোনো প্রকার আইনগত বৈধতা থাকবে না, বরঞ্চ তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের মধ্যে বিবাহ হতে পারে যদি পাত্র-পাত্রী উভয়ের সম্মতি থাকে।

লুসাই সমাজে বিবাহের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ সম্পর্কঃ লুসাই জনগোষ্ঠী মোট ২৭টি দলে বিভক্ত। লুসাইদের ২৭টি দল হলো- ১. সাইলু, ২. যাদেং (জাদেং),৩. চেনাকোয়াল, ৪. খাংলুয়াহ, ৫. রিভুং, ৬. রুখুম, ৭. পাচুআও, ৮. চুয়ান নার, ৯. চুওয়াওঙও, ১০. চুওয়াওহাং , ১১. ছাংতে, ১২. হ্রাসেল, ১৩. তৌছং, ১৪. ভনছাআং, ১৫. ছাকুছুয়াক, ১৬. হুয়লিঙু, ১৭. হুয়াল হাং, ১৮. রালতে, ১৯. পয়তে, ২০. জাহাও, ২১. হাওহ্লার, ২২. হ্রাংতে, ২৩. জাহাও, ২৪. ঈনতে, ২৫.পাংখোয়া,২৬.বমজুই এবং ২৭. ভাইতে তাদের সমাজে একই গোত্রের মধ্যে বিবাহের প্রচলন আছে, তবে রক্ত সম্পৰ্কীয় নিকটাত্মীয়ের মধ্যে তিন পুরুষ পর্যন্ত বিবাহ নিষিদ্ধ।

নিষিদ্ধ সম্পৰ্কীয় বিবাহিত দম্পতিকে সামাজিক আদালতে অর্থদন্ড ও সমাজচ্যুত করা হয়। লুসাই জনগোষ্ঠী বর্তমানে খ্রিস্ট ধর্মীয় রীতি অনুসারে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে ।

বৈবাহিক সম্পর্কে স্থাপনের কতিপয় অনুসরণীয়/পালনীয় রীতিনীতি:

(ক) সাধারণভাবে একজন লুসাই পুরুষ একজন লুসাই মহিলাকে বিয়ে করে।

(খ) পাত্র-পাত্রীকে বিবাহ নিষিদ্ধ সম্পর্কের আওতা বহির্ভূত হতে হয়।

(গ) পাত্র-পাত্রীকে সাবালকত্ব অর্জন করতে হয়।

(ঘ) পাত্র-পাত্রীকে ‘ইননেইহ্‌য়না’ সম্পন্ন করতে হয়।

বিবাহের প্রকারভেদঃ লুসাই সমাজে সচরাচর দুই প্রকার বিবাহের অস্তিত্ব রয়েছে। (ক) সামাজিক নিয়মিত বিবাহ এবং (খ) পলায়ন/অনিয়মিত বিবাহ। লুসাই সমাজে বহু বিবাহ নিষিদ্ধ। তবে বিধবা বিবাহের প্রচলন রয়েছে।

আধুনিক ও শিক্ষিত সমাজে কোর্ট ম্যারেজ ও মিশ্র বিবাহের কিছু প্রবণতা ইদানীং দেখা গেলেও সামাজিক রীতি ও প্রথা অনুসারে সমাজসিদ্ধ করা ব্যতিরেকে লুসাই সমাজ তা অনুমোদন করে না। রক্ত সম্পৰ্কীয় বিবাহ নিষিদ্ধ দম্পতিকে সমাজচ্যুত করা হয়।

সামাজিক/নিয়মিত বিবাহঃ লুসাই সমাজে পাত্র-পাত্রী উভয়পক্ষের পিতা মাতা বা অভিভাবকের সম্মতিতে সামাজিক/নিয়মিত বিবাহ সম্পন্ন হয়। পাত্র-পাত্রী নির্বাচন ও বিবাহ অনুষ্ঠান মূলতঃ আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের উপস্থিতিতে সম্পন্ন হয়।

সামাজিক/নিয়মিত বিবাহের আইনগত ফলাফলঃ সমাজে প্রচলিত রীতি ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করে বিবাহিত একজন লুসাই যুবক (পুরুষ) এবং একজন যুবতী (মহিলা) স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বসবাস করার সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করে, যা লুসাই সমাজের প্রথা অনুযায়ী সমাজসিদ্ধ বলে স্বীকৃতি পায়।

বিবাহিত দম্পতির দৈহিক মিলনের ফলে যে সন্তান জন্ম লাভ করে, সে বৈধ সন্তানও পিতা-মাতার উত্তরাধিকারী হিসেবে গণ্য হয়।

স্বামী-স্ত্রী হিসেবে তাদের একজনের উপর অপরজনের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। একজনের ভাল-মন্দ দেখার দায়িত্ব অপরজনের উপর বর্তায়। স্ত্রী তার স্বামীর ভরনপোষণ ও সামাজিক মর্যাদা পায় এবং স্বামীর পারিবারিক পদবীর অধিকারী হয়।

পলায়ন/অনিয়মিত বিবাহ (ইনরু): বর্তমান লুসাই সমাজে রক্ত সম্পৰ্কীয় নিকট আত্মীয়ের মধ্যে তিন পুরুষ পর্যন্ত বিবাহ নিষিদ্ধ। তবে একই গোত্রের মধ্যে বিবাহের প্রচলন রয়েছে।

লুসাই যুবক ও যুবতী উভয়ে পরস্পরের সম্মতিতে পালিয়ে যাবার পর সমাজে ফিরে এসে বিবাহের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ সম্পর্ক না থাকলে সামাজিক সিদ্ধান্ত অনুসারে কার্বারী বা হেডম্যান আদালতের সম্মতিতে ‘ইননেহ্‌য়না’ প্রদানের মাধ্যমে পিতা-মাতার অনুমতি নিয়ে খ্রিস্টধর্মীয় চার্চ এন্ডারের দ্বারা তার ঘরে বা অন্য কোথাও ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে বিবাহকে সমাজসিদ্ধ করে।

পলায়ন/অনিয়মিত বিবাহের ক্ষেত্রে ভিন্ন জনগোষ্ঠীর মহিলার সাথে বিয়ে হলে তাকে লুসাই সমাজভুক্ত হয়ে তাদের ধর্মাবলম্বী হতে হয়। অন্যথায় সমাজচ্যুত করা হয়।

কোর্ট ম্যারেজ: কোর্ট ম্যারেজ মূলতঃ আদালতের কোনো প্রকার আদেশ নয়। আধুনিক লুসাই সমাজে ইদানীং পরিবারের অসম্মতিতে বিবাহে ইচ্ছুক যুবক-যুবতী উভয়ে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট অথবা নোটারী পাবলিক-এর সম্মুখে নিজেদেরকে আইনতঃ স্বামী-স্ত্রী হিসেবে শপথ পূর্ব ঘোষণা প্রদানের মাধ্যমে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে দেখা যায়।

এক্ষেত্রে বলা চলে প্রাচীনকালের মনোমিলনে অনিয়মিত/পলায়ন বিবাহের আধুনিক সংস্করণ হচ্ছে কোর্ট ম্যারেজ, যদিও এটি নিছক একটি শপথনামা মাত্র।

তাই এ বিবাহ অলঙ্ঘনীয়ও নয়। তবে বিবাহিত পাত্র-পাত্রী এক্ষেত্রে সাবালক হলেও বিবাহের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ সম্পৰ্কীয় নিকটাত্মীয় হলে সম্পাদিত কোর্ট ম্যারেজ সমাজের কাছে বৈধ হয় না। সর্বোপরি এ ধরণের কোর্ট ম্যারেজ প্রথাসিদ্ধ নয়, তা অসামাজিক বিবাহ।

ব্যাখ্যা: মূলতঃ কোর্টে কোনো বিবাহ হয় না। পরস্পরের প্রতি প্রণয়াসক্ত পাত্র-পাত্রীকে স্বেচ্ছায় কোর্টে আসার পূর্বে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হয়। পরে কোর্টে এসে উভয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে এই প্রকার Love Marriage-এর সমর্থনে একটি শপথ সম্বলিত বিবৃতি Affidavit দেয় এবং এভাবে বিবাহের সমর্থনে একটি দলিল সৃষ্টি করে। কার্যতঃ এই প্রকার শপথ সম্বলিত বিবৃতি অর্থাৎ এফিডেবিটের যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে।

“অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রণয়ঘটিত বিবাহগুলো উভয়পক্ষের অভিভাবকদের অসম্মতিতে হয়ে থাকে। এরূপ বিবাহিত দম্পতিকে বিবাহের অব্যবহিত পরেই কোর্টে গিয়ে তাদের বিবাহের সমর্থনে একটি দলিল সৃষ্টি করতে হয়, যাতে যে কোনো পক্ষের অভিভাবকের উদ্যোগে থানায় অথবা কোর্টে তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা দায়ের হলে এই দলিল তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনে সহায়ক হয়”। (সূত্রঃ- হিন্দু আইনের ভাষ্যঃ গাজী শামছুর রহমান)

পরস্পরের প্রতি প্রণয়াসক্ত হয়ে লুসাই যুবক-যুবতী কোর্টে আসার আগে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় না। কোর্টে এসে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে আমরা পরস্পরকে বিবাহ করলাম’ মর্মে বিবৃতি (হলফনামা) সম্পাদন করে দেয়।

অর্থাৎ তারা কোর্টেই একে অপরকে বিয়ের ঘোষণা দেয় মাত্র। কোর্টে আসার আগে বিয়ে করে না। আগেই বলা হয়েছে যে, কোর্টে কোনো বিয়ে হয় না। পূর্বে সম্পন্ন হওয়া বিয়ের ঘোষণা কোর্টে এসে দেয়া হয় যায় মাত্র।

সুতরাং যুবক-যুবতী হলফনামার মাধ্যমে বিয়ে হয়েছে বলে যা বুঝাতে চায়, তা মোটেই সমাজসিদ্ধ বিয়ে নয়। লুসাই সমাজসিদ্ধ বিবাহের পূর্ব শর্ত হচ্ছে ‘ইন্‌নেহ্‌য়না’ অনুষ্ঠান সম্পাদন করা।

মিশ্র বিবাহ: পার্বত্য জেলাসমূহে বসবাসকারী আদিবাসী জনগোষ্ঠী ছাড়াও দেশের অন্যান্য অঞ্চলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীসমূহের পাত্রীর সাথে উভয়পক্ষের সম্মতিতে ‘ইন্‌নেহয়না’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সম্পন্ন হওয়া বিবাহকে লুসাই সমাজে স্বীকৃত বিবাহ রূপে গণ্য করা হয়।

এরূপ বিবাহের ক্ষেত্রে স্ত্রী যে ভিন্ন জনগোষ্ঠী হতে লুসাই সমাজে এসেছে সেই জনগোষ্ঠীর ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, মর্যাদা, পদৰী তার লোপ পায় এবং স্ত্রী তার লুসাই স্বামীর ধর্মীয় বিশ্বাস, বর্ণ, গোত্র, মর্যাদা, পদবী ধারণ করে।

অনুরূপভাবে লুসাই সমাজের কোনো মহিলার সাথে অন্য জনগোষ্ঠীর পুরুষের বিবাহ হলে এবং ধর্মান্তরিত হয়ে অন্য জনগোষ্ঠীভুক্ত হলে সেই বিবাহিত মহিলা লুসাই সমাজের উত্তরাধিকারসহ পদ ও পদবী হারায়।

পলায়ন/অনিয়মিত বিবাহের (পালিয়ে গিয়ে গোপনে বিয়ে করা)আইনগত ফলাফল:

পলায়নের পর প্রেমিক-প্রেমিকাকে সামাজিক আদালতে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়। যদি মেয়ের অভিভাবক তার মেয়েকে সেই পাত্রের সাথে বিয়ে দিতে রাজী না হয় কিংবা প্রেমিকের অভিভাবক যদি প্রেমিকার পিতা-মাতার কনেপণসহ আর্থিক ও অন্যান্য দাবী পূরণ করতে রাজী বা সমর্থ না হয়, তাহলে তাদের বিয়ে হয় না। এবং প্রেমিকাকে তার পিতার বাড়ী ফিরে যেতে হয়।

প্রেমিক-প্রেমিকা এভাবে পলায়নের কারণে সামাজিক বিচারে জোর করে অপহরণ করার অভিযোগে পাত্রকে অপরাধী সাব্যস্ত করা না হলে এবং প্রেমিকার পিতা-মাতা সেই পাত্রের সাথে বিয়ে দিতে রাজি হলেও পলাতক অবস্থায় বিবাহ বহির্ভূতভাবে দৈহিক মিলনের সামাজিক অপরাধের জন্য সাজাভোগ করতে হয়, যেমনঃ- সেক্ষেত্রে পাত্রকে ‘ইননেহয়না’ সম্পাদন বাবদ পাত্রীর বাবাকে বর্তমানে ৩০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা প্রদান করতে হয়। পাত্রের জরিমানার টাকা কনের পিতাকে দিতে হয়।

সমাজে অনুমোদিত হলে পাত্র-পাত্রীর বিবাহ বহির্ভূত দৈহিক মিলনের দ্বারা জন্মগ্রহণকারী সেই সন্তানও বৈধ সন্তান হিসেবে গণ্য হয় এবং পিতা-মাতার উত্তরাধিকারী হয়ে পূর্ণ সামাজিক মর্যাদা ভোগ করে।

প্রেমিক বা প্রেমিকার পিতা-মাতার অসম্মতির কারণে প্রেমিক যুগলের পলাতক অবস্থায় দৈহিক মিলনের কারণে প্রেমিকা গর্ভবতী হলে সমাজ স্বীকৃত নিয়মে ভূমিষ্ট সন্তান বৈধ সন্তান হিসেবে গণ্য হয়। সন্তান যার ঔরসে জন্মলাভ করে সেই পিতার উত্তরাধিকারী হয় এবং পিতার পারিবারিক মর্যাদার অধিকারী হয়।

দেশের প্রচলিত আইনে আদালতে মামলা ও সাজা হওয়ার আশঙ্কাঃ প্রেমিক-প্রেমিকার বিয়েতে তাদের অভিভাবকের সম্মতি না থাকলে পলায়নের খবর জানাজানি হবার পর প্রেমিকার পিতা প্রেমিকের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর আওতায় মামলা দায়ের করতে পারে।

আদালতে এ ধরণের মামলার ফলে প্রেমিক গ্রেপ্তার ও বিচারে তার সাজা হয়। আর প্রেমিকা যদি নাবালিকা হয় অথবা তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে অপহরণ ও দৈহিক মিলনে বাধ্য করা হয়েছে বলে আদালতে জবানবন্দি দেয়, তাহলে প্রেমিকের ১৪ বছর থেকে যাবজ্জীবন পর্যন্ত কারাদন্ড হতে পারে।

নিষিদ্ধ বা অননুমোদিত বিবাহঃ লুসাই সমাজে রক্ত সম্পৰ্কীয় নিকট আত্মীয়ের মধ্যে তিন পুরুষ পর্যন্ত বিবাহ নিষিদ্ধ। কাকা-জ্যেঠা ও মামাতো ভাইবোনের সাথে বিবাহ হলে তা অবৈধ বলে গণ্য হয় এবং তাদের সন্তানগণ অবৈধ সন্তান ‘শন-ফা’ হিসেবে সমাজে পরিচিত হয়।

লুসাই সমাজভুক্ত কার্বারী বা হেডম্যানের দ্বারা সামাজিক বিচারে অবৈধ বিবাহিত দম্পতিকে জরিমানাসহ বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানো হয়। তবে পাত্রী যদি এ সময়ে গর্ভবতী হয় তাহলে বিচারের পূর্বে পাত্রপক্ষকে গরু বধ করে পাড়ার লোকজনকে খাওয়াতে হয় এবং পাত্রের পিতাকে পাত্রীর পিতা-মাতার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতে হয়।

অবৈধ সন্তান বা ‘শন-ফা’ ভূমিষ্ট হলে তার ভরনপোষণের দায়ভার পিতৃকুলে বা জন্মদাতার উপর বর্তায়।

নিষিদ্ধ বা অননুমোদিত বিবাহের আইনগত ফলাফল: লুসাই সমাজে নিষিদ্ধ সম্পর্কের আত্মীয়ের সাথে বিয়ের অপরাধের জন্য বিবাহ বিচ্ছেদ অপরিহার্য এবং সামাজিক প্রথা অনুসারে শাস্তিস্বরূপ শূকর জরিমানা দিতে হয়।

দন্ড দেওয়া শূকরের মাংসও সমাজের অনেকে খায় না। গোপনে বিয়ে করে সামাজিক স্বীকৃতি ছাড়া স্বামী-স্ত্রীরূপে বসবাস করার অপরাধের শাস্তি হচ্ছে অর্থদন্ড। এরপরেও উক্ত দম্পতি যদি দাম্পত্য জীবন অক্ষুন্ন রাখে তবে তাকে সমাজচ্যুত করে এক ঘরে করা হয়।

কিন্তু লুসাইদের জনসংখ্যা কম হওয়ার কারণে সমাজপতির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জরিমানা আদায় করে সমাজভুক্ত করা হয়। সেক্ষেত্রে সামাজিক আদালত বা সমাজপতির সিদ্ধান্ত অনুসারে খ্রিস্টধর্মের রীতিনীতি অনুযায়ী চার্চ এন্ডারের বাড়ীতে ‘ইননেইহয়না’ অনুষ্ঠান সম্পাদন করতে হয়।

বিধবা বিবাহঃ লুসাই সামাজিক প্রথামতে বিধবা বিবাহ অনুমোদিত। একজন বিপত্নীক যেমন বিয়ে করতে পারে, তেমনি একজন বিধবা মহিলাও বিয়ে করতে পারে। একজন বিধবা যদি তার স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তান-সন্ততিসহ স্বামীর পরিবারে বা শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে বসবাস করে তাহলে স্বামীর সম্পত্তি থেকে উক্ত বিধবা আমৃত্যু ভরনপোষণ পাবার অধিকারী।

কিন্তু দ্বিতীয়বার বিয়ে করে সে যদি স্বামী-শ্বশুরের পরিবার থেকে বিছিন্ন হয়ে যায়, তাহলে স্বামীর সম্পত্তি থেকে ভরনপোষণ পায়। লুসাই সমাজে একজন বিধবা মহিলার দ্বিতীয় বিবাহ সামাজিকভাবে প্রথাসিদ্ধ। তবে মহিলাকে পিতার বা ভাইয়ের বাড়িতে থেকে দ্বিতীয় বিবাহ সম্পন্ন করতে হয়।

বহু বিবাহঃ লুসাই সমাজে বহু বিবাহ নিষিদ্ধ। 

বিবাহের প্রমাণঃ লুসাই সমাজে বিবাহ একটি সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান। খ্রিস্টধর্মীয় রীতি অনুসারে বিবাহের প্রমাণস্বরূপ চার্চ/চার্চএল্ডার কর্তৃক সনদ প্রদান করা হয়। এছাড়াও বিবাহের আইনগত বৈধতার প্রশ্নে কোনো প্রকার সমস্যার উদ্ভব হলে, সেক্ষেত্রে বিবাহের সত্যতা বা অস্তিত্ব প্রমাণ হয় নিম্নমতেঃ

ক) ‘ইননেইহয়না’ অনুষ্ঠানে উপস্থিত গণ্যমান্য ব্যক্তি ও পালাই এর সাক্ষ্য।

খ) ‘ইননেইহয়না’ অনুষ্ঠানে উপস্থিত সমাজপতি/কার্বারীর সাক্ষ্য।

গ) স্বামী-স্ত্রী উভয়ের বাবা-মায়ের স্বীকৃতি।

ঘ) সমাজ স্বীকৃত পন্থায় স্বামী ও স্ত্রী হিসেবে একত্রে বসবাস।

ঙ) স্ত্রীর গর্ভে স্বামীর ঔরসজাত সন্তানের পিতৃত্ব স্বীকার।

চ) স্বামী-স্ত্রী হিসেবে পরস্পর-পরস্পরকে স্বীকৃতি প্রদান।

ছ) চার্চ/চার্চ-এল্ডার কর্তৃক বিবাহ সংক্রান্ত বিষয়ে প্রদত্ত সিদ্ধান্ত বা সনদপত্র।

জ) ‘ইননেইহ্‌য়না’ অনুষ্ঠানের প্রামাণ্য ছবি।

উপরোক্ত উপাদানগুলো বিয়ের অস্তিত্ব সরাসরি প্রমাণ করে।

বৈবাহিক কর্তব্যঃ

ক) স্ত্রী তার স্বামীর সাথে বসবাস করে এবং স্বামীর ন্যায়সঙ্গত নির্দেশ ও পরামর্শ মেনে চলে।

খ) স্বামী তার স্ত্রীর সাথে বসবাস করতে ও তার ভরনপোষণ দিতে বাধ্য।

গ) উভয়ে পারিবারিক ও সাংসারিক দায়-দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠাবান থাকে।

আইনসঙ্গত বিবাহে স্বামী-স্ত্রীর অধিকার এবং দায়িত্ব:

ক) বিয়ের পর স্ত্রীকে অবশ্যই স্বামীর ইচ্ছানুযায়ী পছন্দনীয় স্থানে স্বামীর সাথে বসবাস করতে হয় এবং স্বামীর সকল প্রকার ন্যায়সঙ্গত নির্দেশ অনুযায়ী চলতে হয়। অনুরূপভাবে স্বামীকেও স্ত্রীর মর্যাদায় স্ত্রীকে তার সাথে রাখতে হয় এবং পারিবারিক মর্যাদা ও সামর্থ্য অনুযায়ী ভরনপোষণ দিতে বাধ্য।

তথ্যসূত্র

১। Majority Act, 1875.

২। Guardians and Wards Act, 1890.

৩। Child Marriage Restraint Act, 1929.

৪। নারী ও শিশু নির্যাতন আইন, ২০০০


তথ্যসূত্রঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আদিবাসীদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন (গ্রন্থনা ও সম্পাদনা – এডভোকেট জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা,  এডভোকেট প্রতিম রায়, সুগত চাকমা)।

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা