নির্বাচনী ইশতেহার, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও আদিবাসী অধিকার

Jumjournal
Last updated Dec 14th, 2020

664

featured image

ভূমিকা :

জাতীয় নির্বাচন আসন্ন। ব্যতিক্রম কোন কিছু না হলে চলতি বছরে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনের আগে নিজ নিজ নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে।

বর্তমান মহাজোট সরকারের প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনে এক চমঙ্কার নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে। এই নির্বাচনী ইশতেহারে দেশের আদিবাসীসহ সাধারণ জনগণের জন্য সুন্দর সুন্দর অঙ্গীকার ছিল।

আওয়ামী দলের এই নির্বাচনী অঙ্গীকার দেশের জনগণকে আকর্ষিত করে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে আদিবাসীদের জন্যও সুন্দর সুন্দর অঙ্গীকার ছিল। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতি আকর্ষিত হয়ে আদিবাসীরাও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে ভােট দেয়। আদিবাসী-বাঙালী সকলের বিপুল ভােটে মহাজোট ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে এবং সরকার গঠন করে।

ইতােমধ্যে এ সরকারের মেয়াদ ৪ বছর শেষ হয়েছে। গত ৪ বছরে আদিবাসীদের কাছে আওয়ামী লীগের অঙ্গীকারাবদ্ধ বিষয়গুলাে কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে সে বিষয়ে নিয়ে আলােকপাত করার চেষ্টা করা হলাে।

১. নির্বাচনী ইশতেহার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়নের অবস্থা

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়নের অঙ্গীকার ছিলাে। আওয়ামী নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বর্তমান অবধি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়নের কথা বলে আসছে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ে মহাজোট সরকারের বক্তব্য ও বাস্তব অবস্থা নিয়ে পর্যালােচনার প্রয়ােজনীয়তা রয়েছে। নিম্নে সে বিষয়ে আলােকপাত করা হচ্ছে :

(ক) পার্বত্য চট্টগ্রামের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ :

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ‘ক’ খন্ডে পার্বত্য চট্টগ্রামের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের অঙ্গীকার করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনমিতিগত (ডেমােগ্রাফি) বৈশিষ্ট্যসহ এ অঞ্চলের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের অঙ্গীকার করা হয়েছে।

কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের এ সংক্রান্ত স্বকীয় বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের লক্ষণ পরিলক্ষিত হয় না; উপরন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ না করে সরকার চুক্তি লংঘন করে চলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে আদিবাসী (সরকারী ভাষায় উপজাতীয়) অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করলেও বার্মার রােহিঙ্গাসহ সমতলের বিভিন্ন জেলার সেটেলার পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসিত হচ্ছে।

ইতােমধ্যে বান্দরবান পার্বত্য জেলা আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে। এই জেলায় আদিবাসীরা বর্তমানে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে।

(খ) পার্বত্য জেলা পরিষদে বিভাগ হস্তান্তর :

চুক্তি অনুসারে পার্বত্য জেলা পরিষদে ৩৩টি বিভাগ হস্তান্তরের কথা রয়েছে। সরকার এ পর্যন্ত ১২টি বিভাগ মাত্র হস্তান্তর করেছে। এসব বিভাগের অধিকাংশই এরশাদ আমলে হস্তান্তরিত হয়। স্মর্তব্য যে, ১৯৮৯ সালে এরশাদ সরকার কতৃক স্থানীয় সরকার পরিষদ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরশাদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন সংশােধন করে পার্বত্য জেলা পরিষদ করা হয়।

বর্তমান মহাজোট সরকার বিভাগ হস্তান্তরের বিষয়ে কোন কোন ক্ষেত্রে শঠতার আশ্রয় গ্রহণ করছে। এরশাদ সরকারের আমলে যেসব বিভাগ হস্তান্তরিত হয়েছে, সেসব বিভাগের অধীন প্রতিষ্ঠান বা কর্মসমূহ হস্তান্তর দেখিয়ে সরকার বিভাগ হস্তান্তর করা হয়েছে বলে অপপ্রচার করছে।

এ ধরনের শঠতার আশ্রয় গ্রহণ করে সরকার দাবী করছে যে, সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক।

(গ) অপারেশন উত্তরণসহ অস্থায়ী সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার :

সরকার ২০০১ সালে ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামে এক ধরনের সেনাশাসন জারী করে। আগে এর নাম ছিল ‘অপারেশন দাবানল’। এক ধরনের এই সেনাশাসন কার্যকর থাকার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে বেসামরিক প্রশাসন ও সুশাসন কার্যকর হতে পারছে না।

চুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রামে পাঁচ শতাধিক ক্যাম্প ছিল। এর মধ্যে মাত্র ৬৬টি ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে সরকার দাবী করছে দুই শতাধিক ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। বর্তমানে অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

চুক্তির শর্ত অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করার কথা ছিল। তবে চুক্তি অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামে ৩টি স্থায়ী ক্যান্টনমেন্ট ও ৩টি জেলা সদর ব্রিগেড অফিস থাকবে।

(ঘ) পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন ও ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গ :

১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং ১৯৯৮ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠিত হয়। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০১৩ সাল- এই ১৫ বছরেও পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি যার কারণে পরিষদে সুশাসন, উন্নয়ন ও জনপ্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠা করা যাচ্ছে না।

তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের অধিকার প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রতিষ্ঠান হলেও এ তিনটি প্রতিষ্ঠান বর্তমানে সরকারী দলের পুনর্বাসন কেন্দ্র ও দুর্নীতির আখড়া হয়ে আছে।

এ তিনটি প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে গেলে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভােটার তালিকা প্রণয়ন করতে হবে। অদ্যাবধি এ ভােটার তালিকা প্রণীত হয়নি। যার কারণে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারছে না।

তিন পার্বত্য জেলা পরিষদেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হবার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারছে না। কারণ তিন অত জেলা পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করবেন।

সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট সকল ক্ষমতা ও সকার করেনি। আঞ্চলিক পরিষদ প্রতিষ্ঠার ১৫ বছর পার হলাে আজ অবধি পরিষদের বিধিমালা প্রণীত হয়নি।

বিধিমালা প্রণীত না হবার কারণে পরিষদ যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। পরিষদের মূল কাজ ‘তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় সাধন’- এ কাজটি পরিষদ যথাযতভাবে পালন করতে পারছে না। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুসারে পার্বত্য জেলা পরিষদের নকট ৩৩টি বিভাগ হস্তান্তর করার কথা।

এ পর্যন্ত বিভিন্ন সরকারের আমলে মাত্র ১২টি বিভাগ হস্তান্তরিত হয়েছে। মহাজোট সরকারের আমলে গুরুত্বপূর্ণ কোন বিভাগ হস্তান্তরিত হয়নি। ভূমি, লিশ আইন-শৃংখলা, জুমচাষ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ সরকার পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তর করেনি। যার কারণে পার্বত্য জেলা পরিষদ চুক্তি বাস্তবায়নে ভূমিকা পালন করতে পারছে না।

(ঙ) চক্তির অন্যান্য বিষয় :

চুক্তির শর্ত অনুসারে আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু ও জুম্ম শরণার্থীদের তাদের জমিজমা ফেরত প্রদানসহ নিজ নিজ ভূমিতে পুনর্বাসন করার কথা ছিল। মহাজোট সরকার এ পর্যন্ত আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের মধ্য থেকে ১টি পরিবারকেও পুনর্বাসন করতে পারেনি। সরকার সকল জুম্ম শরণার্থীকে জমিজমা ফেরত দিয়ে নিজ নিজ বাস্তভিটায় পুনর্বাসন করতে পারেনি।

চুক্তি স্বাক্ষরের ১৫ বছর পরও পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভােটার তালিকা প্রণয়ন করা হয়নি। চুক্তির শর্ত অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকরি নিয়ােগের ক্ষেত্রে আদিবাসীদেরও অগ্রাধিকার প্রদান করে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ােগ দানের কথা ছিল।

কিন্তু চুক্তি লংঘন করে পার্বত্য চট্টগ্রামের অ-বাসিন্দাদের চাকরীতে নিয়ােগ প্রদান করা হচ্ছে। মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালুসহ আদিবাসীদের ভাষা, সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও বিকাশ সাধনে পৃষ্ঠপােষকতা প্রদানের কথা রয়েছে। মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালু হয়নি।

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি রক্ষায় সরকারী পৃষ্ঠপােষকতা অনুপস্থিত। সেকারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের ভাষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্য বিলুপ্তির পথে ধাবিত হচ্ছে। বিশেষতঃ খ্যাং ভাষাসহ অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর জনগােষ্ঠীর ভাষা ও সাহিত্য আজ অবলুপ্তির পথে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের মূল স্পিরিট (Spirit) ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী ও স্থায়ী বাসিন্দা বাঙালীদের অস্তিত্ব ও তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও অধিকার রক্ষা করা ও সমুন্নত রাখা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামকে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে অক্ষুন্ন রাখা। চুক্তির উদ্দেশ্য ও মূলপারকে লংঘন ও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এ সরকার। এসব কাজের মধ্য দিয়ে মহাজোট সরকার তার নির্বাচনী ইশতেহারের অঙ্গীকার লংঘন করেছে।

(চ) চুক্তি লংঘন :

আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করলেও বাস্তবে দেখা যায় যে, এ সরকার কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বহুভাবে লংঘিত হয়েছে, যা নিম্নরূপ-

(১) প্রতিমন্ত্রী নিয়ােগ :

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে একজন মন্ত্রী (পূর্ণমন্ত্রী) নিয়ােগ দানের কথা রয়েছে। কিন্তু মহাজোট সরকার পার্বত্য মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রী মর্যাদার একজন মন্ত্রী নিয়ােগ করে। বর্তমানে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে এ দায়িত্ব পালন করছেন বাবু দীপংকর তালুকদার এম পি।

(২) জেলা প্রশাসক কর্তৃক ভুমি লীজ প্রদান, ভূমি হস্তান্তর ইত্যাদি :

পার্বত্য চুক্তি ও চুক্তি অনুসারে প্রণীত পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনে ভূমি সংক্রান্ত বিষয়ে বলা হয়েছে-অন্য কোন আইনে যা কিছু থাকুক না কেন, পার্বত্য জেলা পরিষদের পূর্বানুমােদন ব্যতীত কোন ভূমি বন্দোবস্তী, লীজ, ক্রয়-বিক্রয় বা অন্যবিধভাবে হস্তান্তর করা যাবে না। কিন্তু ডেপুটি কমিশনারগণ চুক্তি ও আইন লংঘন করে ভূমি ক্রয়-বিক্রয় অনুমােদন ও লীজ প্রদান করে চলেছে।

(৩) ভূমি কমিশন চেয়ারম্যান কর্তৃক ভূমি জরীপের সিদ্ধান্ত :

নিয়ােগ পাবার সাথে সাথে ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান জনাব খাদেমুল ইসলাম একতরফাভাবে ভূমি জরীপের ঘােষণা দেন। চুক্তি ও ভূমি কমিশন আইনে কমিশনকে ভূমি জরীপের কোন এক্তিয়ার দেয়া হয়নি। তথাপি ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান খাদেমুল ইসলাম ভূমি জরীপের ঘােষণা দেন।

(৪) পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের পরামর্শ গ্রহণ ব্যতিরেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রভাব পড়ে এমন আইন প্রণয়ন :

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযােজ্য এমন আইন কোন প্রণয়ন করতে গেলে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সাথে পরামর্শ গ্রহণের বিধান রয়েছে।

সরকার এ পর্যন্ত একমাত্র ‘সামাজিক বনায়ন বিধিমালা’ প্রণয়নকালে আঞ্চলিক পরিষদের পরামর্শ করেছে। এটি ব্যতীত সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রভাব পড়ে এমন বহু আইন প্রণয়ন করেছে, সেক্ষেত্রে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সাথে কোন ধরনের পরামর্শ গ্রহণ করেনি।

(৫) স্থায়ী বাসিন্দার সার্টিফিকেট প্রদান সংক্রান্ত :

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের স্থায়ী বাসিন্দার চূড়ান্ত সার্টিফিকেট প্রদান করবেন স্ব স্ব সার্কেলের সার্কেল চীফ। চুক্তি লংঘন করে ডেপুটি কমিশনারগণ স্থায়ী বাসিন্দার চূড়ান্ত সার্টিফিকেট প্রদান করে চলেছে।

এভাবে প্রশাসনে ও সরকারে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ চুক্তি ও আইন লংঘন করে বেআইনী ও নীতি বিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত রয়েছেন। তথাপি সরকার এসব আইন ও চুক্তি লংঘনকারীদের বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।

১. নির্বাচনী ইশতেহার, বন-ভূমি ও আদিবাসী :

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে আদিবাসীদের বন ও ভূমির সনাতনী অধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করা হয়েছে। এলক্ষ্য পরিপূরণে ও চুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে মহাজোট সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য ভূমি কমিশন গঠন করে।

তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান খাদেমুল ইসলামের চুক্তি বিরােধী কার্যকলাপের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি কমিশন কার্যকর হতে পারেনি।

খাদেমুল ইসলাম ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান হবার পর ভূমি জরীপের ঘােষণা দেন যা ভূমি কমিশনের কাজ নয় এবং যা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সুস্পষ্ট লংঘন। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে ভূমি জরীপ বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরােধ নিষ্পত্তির পর সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সাথে আলােচনা করে ভূমি জরীপ করবেন।

খাদেমুল ইসলাম চুক্তি বিরােধী কাজে লিপ্ত থাকার পরও সরকার তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। তাঁকে অপসারণ তাে দূরের কথা মেয়াদ উত্তীর্ণ হবার পরও তাঁকে চেয়ারম্যান পদ থেকে সরানাে হয়নি। উল্লেখ্য যে, গত ১৮ জুলাই ২০১২ তারিখে তার মেয়াদ শেষ হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের ভূমি বেদখল অব্যাহত রয়েছে। বিভিন্ন বিত্তশালী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন কর্তৃক আদিবাসীদের এসব রেকর্ডীয় কিংবা ভােগ দখলীয় হাজার হাজার একর ভূমি বেদখল করছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামের যেসব অবৈধ লীজ বাতিল করা হয়েছে ভূমির সেসব বাতিলকৃত লীজ আইন লংঘন করে বিশেষতঃ বান্দরবান জেলার ডেপুটি কমিশনার নূতন করে লীজ প্রদান করেছে।

বান্দরবান জেলাসহ তিন পার্বত্য জেলায় ডেসটিনি, এক্সিম গ্রুপ ইত্যাদি সংগঠন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি আদিবাসীদের হাজার হাজার একর ভূমি বেদখল করছে। বান্দরবান জেলায় বার্মা থেকে আগত রােহিঙ্গা মুসলিমের অনুপ্রবেশ ঘটছে এবং তারা আদিবাসীদের ভূমি বেদখল করে নিচ্ছে।

সরকার বন্যপ্রাণী আইন সংসদে পাশ করেছে। এই আইনে বন, ভূমি ও বনজ সম্পদের উপর আদিবাসীদের অধিকারকে খর্ব করা হয়েছে। সামাজিক বনায়ন আইন প্রণয়নকালে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদেও পক্ষ থেকে যে সুপারিশ প্রদান করা হয়েছে, সেসব সুপারিশসমূহ আমলে নেয়া হয়নি।

বর্তমানে ১৯২৭ সালের বন আইন সংশােধনের প্রক্রিয়া চলছে। ইতােমধ্যে এই আইনের খসড়া জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়েছে। এই আইনে এমন কিছু ধারা সংশােধন ও সংযােজনের প্রস্তাব করা হয়েছে যা আইনে পরিণত হলে আদিবাসীদের বন, ভূমি ও বনজ সম্পদেরও উপর অধিকার রয়েছে তা খর্ব হবে এবং তা পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদ আইন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সাথে সাংঘর্ষিক হবে।

নির্বাচনী ইশতেহারের অঙ্গীকার অনুসারে জমি, জলাধার ও বনের উপর আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা দরকার। এলক্ষ্যে সরকারকে এ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করতে হবে। বন বিভাগসহ সরকারী কোন প্রতিষ্ঠান বা প্রভাবশালী মহল যাতে আদিবাসীদের সনাতনি অধিকার লংঘন করে তাদের জমি, জলাধার ও বন বেদখল করতে না পারে তৎজন্য সরকারী কড়া নির্দেশনা থাকা দরকার। কেউ বা প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা এ অধিকার ক্ষুন্ন করলে তার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

নির্বাচনী ইশতেহার ও আদিবাসীদের মানবাধিকার পরিস্থিতি :

আওয়ামী লীগ এর সর্বশেষ নির্বাচনী ইশতেহারে আদিবাসীদের প্রতি মানবাধিকার লংঘনের চিত্র অবসান করার অঙ্গীকার ছিলাে। প্রশ্ন হলাে- আওয়ামী লীগ কি তার সেই অঙ্গীকার রক্ষা করতে পেরেছে?

বাংলাদেশে আদিবাসী নারী, পুরুষ ও শিশুর উপর প্রতিনিয়ত চলছে ৯ নির্যাতন। সরকার কর্তৃক মৌলিক মানবাধিকার প্রতিনিয়ত লংঘিত হচ্ছে, সে বিষয়ে নিয়ে আলােচনা করা হলাে –

(ক) আদিবাসী দিবস উদযাপনে বাধা :

২০১২ সালে আদিবাসী দিবস উদযাপন সংক্রান্ত বিষয়ে সরকার কর্তৃক এক সরকারী সার্কুলার জারী হয়। স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয় ২০১২ সালের ১১ মার্চ এই সার্কুলার জারী করে।

এই সার্কুলারে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে কাউকে সহযােগিতা না করার জন্য অফিস আদেশ প্রদান করা হয়। সার্কুলারে আদিবাসী দিবস উপলক্ষে আয়ােজিত অনুষ্ঠানে সরকারী কোন ব্যক্তি অংশগ্রহণ না করা ও বক্তব্য প্রদান না করার নির্দেশনা প্রদান করা হয়। উল্লেখ্য যে, উক্ত সার্কুলারে বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই বলে উল্লেখ করা হয়।

২০১২ সালে প্রথমবারের মতাে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস’ উদযাপনে সরকারীভাবে বাধা প্রদান করা হয়। বরাবরের মতাে আদিবাসীরা সারাদেশে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস’ উদযাপন করলেও কোন কোন জায়গায় পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের বাধার সম্মুখীন হয়।

বিশেষতঃ খাগড়াছড়ি ও জয়পুরহাটে আদিবাসীরা আদিবাসী দিবস উদযাপনে বাধার সম্মুখীন হয়। আদিবাসী উদযাপনকে কেন্দ্র করে পুলিশ জয়পুরহাটে ৯ জন আদিবাসী নেতা-কর্মীকে বেধড়ক পিটিয়েছে। পুলিশের আক্রমণের শিকার হয়ে কয়েকজন আদিবাসী নেতা-কর্মী গুরুতর আহত হয় এবং তাদেরকে জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়।

পুলিশ খাগড়াছড়িতে আদিবাসী দিবস উদযাপন উপলক্ষে আয়ােজিত র্যালীতে বাধা প্রদান করায় র্যালী সম্পন্ন করতে ও নির্ধারিত স্থানে সমাবেশ করতে পারে নাই। এছাড়াও দেশের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে আদিবাসী উদযাপন কমিটির নেতা-কর্মীদের নানাভাবে হয়রানী ও হুমকি প্রদান করা হয়।

(খ) আদিবাসী নারীর মানবাধিকার অবস্থা :

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পার্বত্য চট্টগ্রামের নারীদের রাজনীতি, অর্থনীতি ও উন্নয়নে অংশগ্রহণের এক গুরুত্বপূর্ণ সুযােগ সৃষ্টি করে। কিন্তু চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলি বাস্তবায়িত না হবার কারণে নারীরা সে সুযােগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। উপরন্তু নারীরা নানাভাবে নিপীড়ন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

চুক্তির শর্ত অনুসারে পার্বত্য জেলা পরিষদ নির্বাচন না হবার কারণে বর্তমান পার্বত্য জেলা পরিষদে নারী প্রতিনিধিত্ব থাকছে না। উল্লেখ্য যে, চুক্তির শর্ত অনুসারে প্রতিটি পার্বত্য জেলা পরিষদে ৩ জন করে ৩টি পার্বত্য জেলা পরিষদে নারীদের জন্য ৯টি আসন সংরক্ষণ করা হয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়িত না হবার কারণে নারীরা তাদের এই অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমার অপহরণ ঘটনা বাংলাদেশের এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা। গত ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৩ হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী কল্পনা চাকমার মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন সিআইডি (অপরাধ তদন্ত বিভাগ) কর্তৃক দাখিল করা হয়।

এই প্রতিবেদনে অপহরণ ঘটনার প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠেনি। প্রতিবেদনে অপহরণ ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত লে. ফেরদৌস-সহ তিন জনের নাম উল্লেখ করা হয়নি। রাঙ্গামাটি মুখ্য বিচারিক হাকিম গত ১৩ জানুয়ারি ২০১৩ কল্পনা চাকমার বড় ভাই কালিন্দী চাকমাকে শুনানীর জন্য আদালতে উপস্থিত থাকার জন্য বলা হয়।

কল্পনা চাকমার বড় ভাই শুনানীর দিন আদালতে উপস্থিত থেকে কল্পনা চাকমার অপহরণ ঘটনার চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখান করেন। আইনজীবীরা আদালতে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবী জানান।

শুনানীর সময় রাঙ্গামাটি, ঢাকা ও চট্টগ্রামের আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী উপস্থিত ছিলেন। উল্লেখ্য যে, ১৯৯৬ সালের ১২ জুন তারিখে কল্পনা চাকমা রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার নিউ লাল্যাঘােনা গ্রামের নিজ বাড়ী থেকে অপহৃত হন।

ঘটনা তদন্তের জন্য একই বছরের ৭ সেপ্টেম্বর তারিখে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আবদুল জলিলের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে। পুলিশ ২০১২ সালের ২১ মে তারিখে অপহরণ মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। কিন্তু মামলার বাদী নারাজী আবেদন দাখিল করেন।

পরে রাঙ্গামাটি চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এ ঘটনা তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে সিআইডিকে নির্দেশ দেয়। ২০১২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখে সিআইডি চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিদর্শক মাে. শহীদুল্লাহ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।

এ চূড়ান্ত প্রতিবেদনকে প্রত্যাখান করে জাতীয় রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী, পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সংগঠন, নারী ও মানবাধিকার সংগঠন বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবী জানিয়েছে।

আদিবাসী নারীদের উপর নিপীড়ন, নির্যাতন প্রতিনিয়ত চলছে। তবে ২০১২ সালে আদিবাসী নারীদের উপর নির্যাতন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। কাপেং ফাউন্ডেশনের রিপাের্ট অনুসারে ২০১২ সালে সমতল ও পাহাড় মিলে ৭৫ জন আদিবাসী নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছে যার মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৭ জন এবং ধর্ষণের পর মারা গেছে ৪ জন। ২০১২ সালে শুধুমাত্র

পার্বত্য চট্টগ্রামে নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৫৫। তম্মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৫ জন। উল্লেখ্য যে, ২০১১ সালে পাহাড় ও সমতল মিলে আদিবাসী নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছিল ৩১ জন, যার মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল ১৬ জন।

পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা প্রতিনিয়ত চলছে। ২০১১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে রাঙ্গামাটি জেলার লংগদু, রাঙ্গামাটি শহরের বিভিন্ন এলাকা, খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা ও পানছড়ি উপজেলায় সেটেলার বাঙালী প্রশাসনের সহায়তায় আদিবাসীদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত করে।

এসব ঘটনায় বহু আদিবাসী আহত হয়। শুধুমাত্র রাঙ্গামাটি শহরের সাম্প্রদায়িক হামলায় ১০০ জন আদিবাসী আহত হয়। তম্মধ্যে একজন সরকারী ডাক্তার, ১৪ জন ইউপি চেয়ারম্যান ও ১ জন কলেজ শিক্ষক রয়েছেন। হামলাকারীরা সরকারী ডাঃ সুশােভন চাকমাকে সারা শরীরে আঘাত হানে এবং মৃত মনে করে তাঁকে ঘটনাস্থলে রেখে যায়।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে আদিবাসীদের অধিকার স্বীকৃতিসহ তাদের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের অঙ্গীকার করেছিলাে। কিন্তু বাস্তবে পরিলক্ষিত হয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমতলের বহু আদিবাসী জাতির ভাষা ও সাহিত্য হারিয়ে যাচ্ছে।

এক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিক উদ্যোগ নেই বললেই চলে। আদিবাসীদের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি রক্ষার বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য যাতে কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে ব্যাপারে প্রশাসন তথা সরকার কঠোর হতে হবে।

প্রসঙ্গ চুক্তি বাস্তবায়ন ও মহাজোট সরকারের আন্তরিকতা :

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রশ্নে মহাজোট সরকারের আন্তরিকতা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। ২০০৮ সালের আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নসহ আদিবাসীদের সংস্কৃতি রক্ষা, উন্নয়ন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ছিল।

তবে বাস্তবে দেখা গেল যে, গত ৪ বছরে মহাজোট সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে উল্লেখযােগ্য কোন ভূমিকা পালন করেনি; বরং কোন কোন ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে চুক্তিতে স্বীকৃত আদিবাসীদের অধিকার খর্ব হয় এমন ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে।

গত ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০১৩ ইং তারিখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাঙ্গামাটি সফরে আসেন। পার্বত্য জনগণের প্রত্যাশা ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাঙ্গামাটি সফর চুক্তি বাস্তবায়নে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা রাখবে এবং তিনি পার্বত্য জেলা পরিষদে ভূমি, আইন-শৃংখলা ও পুলিশ বিভাগের মত গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হস্তান্তরসহ চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ে ঘােষণা দিয়ে যাবেন।

কিন্তু তিনি চুক্তির ধারে কাছেও যাননি। বরং পার্বত্য চুক্তির মৌল স্পিরিটকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এমন বিষয় বা প্রকল্প বাস্তবায়নের ঘােষণা দিয়ে যান। পার্বত্য চুক্তিতে ছিল মাতৃভাষায় শিক্ষা চালু করা এবং আদিবাসীদের শিক্ষা উন্নয়নসহ সার্বিক উনয়নে উদ্যোগ গ্রহণ করা। কিন্তু মহাজোট সরকারের বয়স ৪ বছর পার হলাে আজ অবদি এ সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষা চালু করতে পারেনি।

সরকার সবার জন্য শিক্ষা ঘােষণা করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বহু আদিবাসী গ্রাম রয়েছে যেখানে সরকারী স্কুল নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামের হাজার হাজার আদিবাসী শিশু এখনাে শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত। পার্বত্য চট্টগ্রামে যেসব সরকারী-বেসরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ রয়েছে, সেসবও শিক্ষক ও অবকাঠামাে সংকটসহ নানাবিধ সমস্যার কারণে মানসম্মত শিক্ষা অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না।

এক্ষেত্রে সরকারের দৃষ্টি নেই বললেই চলে। এমতাবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় রাঙ্গামাটিতে প্রতিষ্ঠার ঘােষণা দিয়ে গেলেন। চুক্তি স্বাক্ষরকারী শ্রী জ্যোতিরিন্দ্র বােধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা), চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়সহ বিদগ্ধ নাগরিক সমাজ আগে থেকে এ মুহূর্তে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ভক্ষে মত দিয়ে আসছেন।

সাধারণ জনগণও এ মুহূর্তে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় চায় না। অনেকেই অভিমত প্রকাশ করেছেন- রাঙ্গামাটিতে এ মুহূর্তে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ হলে তা পার্বত্যবাসীর জন্য কাপ্তাই বাধের মত আরেকটি ‘মরণ ফাঁদ’ হবে।

মানে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, এনজিও ও বিভিন্ন ব্যক্তি কতৃক আদিবাসীদের ভূমি বেদখল অব্যাহত রয়েছে। এব্যাপারে সরকারের কোন মাথা ব্যথা নেই। আদিবাসীদের ভূমি রক্ষা করে দেয়ার ব্যাপারে সরকার ও তার প্রশাসনের কোন সহযােগিতা নেই বললেই চলে।

বরঞ্চ বেশীরভাগ ক্ষেত্রে প্রশাসন ও সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বেদখলকারীদের পক্ষে পক্ষাবলম্বন করে থাকেন এবং প্রশাসন ও সরকারের প্রভাবশালী এসব ব্যক্তিরাও কোন কোন ক্ষেত্রে সরাসরি যুক্ত থাকেন। তথ্য সংগ্রহ করলে দেখা যাবে যে, বহু সামরিক-বেসামরিক আমলা ও প্রভাবশালী রাজনীতিক ও অ-রাজনীতিক ব্যক্তিরা পার্বত্য চট্টগ্রামের জমির মালিক হয়ে আছেন।

নির্বাচনী ইশতেহার ও আদিবাসী :

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও পার্বত্য চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নসহ আদিবাসীদের বন ও ভূমির অধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ছিল। মানবাধিকার ও উন্নয়ন বিষয়েও বেশ শক্তভাবে অঙ্গীকার ছিলাে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা গেল না।

অপরদিকে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নির্বাচনী ইশতেহারে চুক্তি বাস্তবায়ন ও আদিবাসীদের অধিকার ও উন্নয়ন বিষয়ে আওয়ামী লীগের মত শক্তিশালী অঙ্গীকার ছিল না।

আমরা আশা করবাে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির আগামী নির্বাচনী ইশতেহারে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নসহ আদিবাসীদের বন, ভূমি ও মানবাধিকার বিষয়ে শক্তিশালী অঙ্গীকার থাকবে। আওয়ামী লীগের আগামীর নির্বাচনী ইশতেহারে আরাে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সন্নিবেশ করা প্রয়ােজন, যা আদিবাসীদের জন্য অতীব জরুরী।

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাতীয় সংসদে আদিবাসীদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। নির্বাচনী ইশতেহারে এ বিষয়টি সংযােজন করা দরকার এবং সরকারে গেলে যাতে তা বাস্তবায়নে সহজতর হয়।

২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘আদিবাসী’র হিসেবে স্বীকৃতি থাকলেও ‘আদিবাসী’ হিসেবে সংবিধানে স্বীকতি প্রদানের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে ছিল না। তাই আগামী নির্বাচনী ইশতেহারে সংবিধানে ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতির বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করার প্রয়ােজনীয়তা রয়েছে।

‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতিসহ তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার- এর স্বীকৃতির প্রয়ােজনীয়তা রয়েছে। বিএনপি জাতীয় পার্টিসহ অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলিরও এবিষয়গুলি তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে সংযােজন করা দরকার।

দেশের বামপন্থী ও প্রগতিশীল দলগুলির নির্বাচনী ইশতেহারে আদিবাসীদের অধিকারের বিষয়গুলি সংযােজিত রয়েছে। তবে এসব অঙ্গীকার বাস্তবায়নে তাকে আরাে সােচ্চার হবার প্রয়ােজনীয়তা রয়েছে।

উপসংহার :

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখিত অঙ্গীকার ও সরকারের ৪ বছরের কার্যকলাপ মূল্যায়ন করে দেখা গেল যে, নির্বাচনী ইশতেহারের অঙ্গীকারের সাথে বাস্তব কার্যকলাপের কোন মিল নেই।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করলেও চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের আন্তরিকতা পরিলক্ষিত হয়নি। মহাজোট সরকার চুক্তির মূল বিষয়গুলি বাস্তবায়নের জন্য আন্তরিক সহকারে এগিয়ে আসেনি।

আদিবাসীদেরও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার উল্লেখযােগ্য উন্নতি হয়নি; বরং আদিবাসীদের উপর নিপীড়ন, নির্যাতন বেড়েই চলেছে। আদিবাসীদের বন ও ভূমির সনাতনি অধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ছিল না। এক্ষেত্রেও আমরা দেখি যে, আদিবাসীরা প্রতিনিয়তই ভূমি হারাচ্ছে। আদিবাসী ভূমিহীনের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে আদিবাসী জনগণের অধিকারের স্বীকৃতি ও সংযােজন জরুরী। তবে ইশতেহারের অঙ্গীকার যদি বাস্তবায়িত না হয় সে অঙ্গীকারের মূল্য নেই।

আগামীতে যে দল সরকার গঠন করবে সে দল যাতে তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকার পরিপূরণে আন্তরিক হয় সে আহবান জানাই। রাজনৈতিক দলগুলির আগামীর নির্বাচনী ইশতেহারে আদিবাসীদের অধিকারের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি যাতে সন্নিবেশ করে সে আহবানও জানাতে চাই। আদিবাসী জনগণেরও আরাে সচেতন হওয়ার প্রয়ােজন রয়েছে।

কোন রাজনৈতিক দল আদিবাসী বান্ধব, আদিবাসীদের অধিকার স্বীকৃতি দিতে চায় এবং আদিবাসীদের সে অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক সেসব দেখেশুনে ভােটাধিকার প্রয়ােগ করা দরকার ও রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করা দরকার।

লেখকঃ শক্তিপদ ত্রিপুরা।

তথ্যসুত্র : তাক্রুপ্ : বৈসুক -সাংগ্রাই-বিঝু-বিষু-বিহু-সংকলন ২০১৩

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা