ত্রিপুরা লোককাহিনী: আংটি কথা বলে

Jumjournal
Last updated Jan 17th, 2020

811

featured image

এক গ্রামে বাস করত এক বৃদ্ধ আর এক বৃদ্ধা। তাদের ছিল দুই নাতি। তারা নাতিদের খুব ভালোবাসত। নাতিরা খুব ছোট বেলায় মা-বাবাকে হারিয়েছে।

তখন থেকে ওরা দুই ভাই দাদা-দাদির কাছেই মানুষ হচ্ছে। একদিন দুই ভাই গেল জুমখেতে কাজ করতে। সারা দিন ওরা কাজ করল।

বিকাল বেলায় ওদের খুব ক্ষুধা পেল। বনের ভিতর ওরা খাবার খুঁজে দেখল। কিন্তু ফল-মূল কিছুই পেল না। এগাছ-ওগাছ খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে একটা ঘুঘুপাখির বাসা দেখতে পেল।

ঘুঘুর বাসায় ওরা চারটি ডিম পেল। বাসায় কোনো ঘুঘু ছিল না। এই সুযোগে দুই ভাই বাসা থেকে ডিমগুলো পেড়ে খেয়ে ফেলল।

সন্ধ্যায় ওরা বাড়ি ফিরে এলো। বাড়ি ফিরেই দাদিকে বলল, আজ আমরা ঘুঘুর বাসায় চারটি ডিম পেয়েছি। ডিমগুলো পেড়ে খেয়ে ফেলেছি। ডিমগুলো ছিল খুব স্বাদের।

দাদি বলল, সবগুলো ডিম খেয়ে ফেললে! আমার জন্য একটিও আননি কেন? আমি কত দিন ডিম খাই না। নাতিদের এ ধরনের আচরণে দাদির খুব রাগ হল। সে ওদের দাদাকে পুরো ঘটনাটা খুলে বলল।

পরদিন দুই ভাই আবার জুমখেতে কাজে গেল। তখন দাদা-দাদি তাদের পোষা শূকরটা কেটে-কুটে রান্না করল।

রান্না শেষ হলে দুই ভাই কাজ থেকে ফিরে এলো। পোষা শূকরটা রান্না করা হয়েছে দেখে ওরা খুব অবাক হল। ওরা পোষা শূকরটা রান্না করার কারণ জিজ্ঞেস করল। দাদি বলল, এটা তোমাদের জানার দরকার নেই। যাও, নদীতে গিয়ে গোসল করে এসো।

দাদির কথামতো দুই ভাই নদীতে গেল গোসল করতে। ফিরে এসে দেখল, দাদা-দাদি সব মাংস খেয়ে ফেলেছে। ওদের জন্য একটি টুকরাও রাখেনি।

ওরা দাদির কাছে জানতে চাইল, ওদের জন্য কোনো মাংস রাখা হয়নি কেনো। এতে দাদি ওদের উপর খুবই রাগ করল। ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলল।

দুই ভাই সিদ্ধান্ত নিল ওরা আর এ গ্রামে থাকবে না। তাই অন্য কোথাও বসবাসের জন্য জায়গা খুঁজতে বেরিয়ে গেল। বনের মধ্য দিয়ে ওরা সারা দিন হাঁটল।

কিন্তু সূর্যাস্ত পর্যন্ত হেঁটেও কোনো গ্রামে পৌছতে পারল না। তাই রাতটা ওরা বনেই কাটিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। সেই সকাল থেকে ওরা কিছুই খায়নি। ওদের খুবই ক্ষুধা পেয়েছে।

বনে ওরা একটি বড় গাছ দেখতে পেল। পাখির বাসার খোঁজে সেই গাছে উঠে গেল দুই ভাই।

বড় ভাই গাছে একটি শকুনের বাসা পেল। বাসায় কয়েকটি ডিমও পেল সে সবগুলো ডিম খেয়ে ছোট ভাইয়ের জন্য একটি মাত্র ডিম নিয়ে এলো। কিন্তু ডিমটি মাটিতে পড়ে ভেঙে গেল। তাই ছোট ভাই ডিমটি খেতে পারল না।

বড় ভাই শকুনের ডিম খেয়ে ধীরে ধীরে শকুনে পরিণত হতে লাগল। বড় ভাইয়ের এ অবস্থা দেখে ছোট ভাই খুব অবাক হল। কিন্তু কিছুই করতে পারল না।

ছোট ভাই কেঁদে কেঁদে বলল, ভাই, তোমাকে ছাড়া এ বনে আমি একা থাকতে পারব না। আমি খুব ভয় পাচ্ছি।

বড় ভাই বলল, শকুনের ডিম খেয়ে আমি শকুন হয়ে গেছি। এ অবস্থায় আমি তোমার সঙ্গে মানব সমাজে বসবাস করতে পারব না। আমাকে অন্যান্য প্রাণীদের মতো জঙ্গলেই বাস করতে হবে।

বড় ভাই আরো বলল, সে ছোট ভাইকে বসবাসের জন্য একটি গ্রাম খুঁজে বের করতে সাহায্য করবে। একটি গ্রাম খুঁজে বের করার জন্য শকুনরূপী বড় ভাই আকাশে উড়তে শুরু করল। ছোট ভাই শকুনরূপী বড় ভাইকে অনুসরণ করল।

এভাবে কিছুক্ষণ চলার পর ওরা এক বৃদ্ধার জুমখেতে পৌছল। শকুনরূপী বড় ভাই বলল, তুমি এখানে থাক। কিছুক্ষণের মধ্যেই জুমখেতের মালিক আসবে। তুমি তার সঙ্গে লোকালয়ে যেতে পারবে। এই বলে শকুনরূপী বড় ভাই জঙ্গলে হারিয়ে গেল। ছোট ভাই সেখানেই রয়ে গেল।

ছোট ভাই খুব ক্ষুধার্ত ছিল। সে জুমখেতে খাবার খুঁজতে লাগল। সে কয়েকটি লাউ পেল। ক্ষুধার জ্বালায় সে একটি লাউ খেয়ে ফেলল। তারপর গাছের নিচে ঘাসের উপর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। মধ্যরাতে সে একটা স্বপ্ন দেখল।

সে দেখল, একজন বৃদ্ধলোক তাকে বাঁশঝাড়ের নিচের মাটি খুঁড়তে বলছে। বৃদ্ধ লোকটি বলল, তুমি সেখানে মূল্যবান একটি জিনিস পাবে। জিনিসটি তুমি নিজের কাছে রেখো। এটি সারা জীবন তোমাকে সাহায্য করবে।

সকালে উঠেই ছেলেটি বাশঝাড়ের কাছে গেল। সে মাটি খুঁড়ে একটা সোনার আংটি পেল। এটি কোনো সাধারণ আংটি নয়।

আংটিটি মানুষের মতোই কথা বলতে পারে। আংটিটি বলল, পৃথিবীতে এমন কোনো কাজ নেই যা আমি তোমার জন্য করতে পারি না। যা কিছু চাও, তাই তোমাকে এনে দেব। দয়া করে হুকুম করো।

এ কথা শুনে ছেলেটি বেশ খুশি হল। আংটিটি আঙুলে পরে নিল। এরপর জুমখেতের মালিকের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

কিছুক্ষণ পর এক বৃদ্ধা জুমখেতে এলো। সে গুনে দেখল একটি লাউ কম। সে ভাবল কেউ এটা খেয়ে ফেলেছে। সেই সময় বালকটি বৃদ্ধার কাছে এলো। সে বৃদ্ধাকে বলল, মা গত দুইদিন ধরে আমি না খেয়ে আছি। তাই আমি খেতের একটি লাউ খেয়ে ফেলেছি। দয়া করে আমাকে ক্ষমা করুন মা, আমাকে শাস্তি দিবেন না।

বৃদ্ধা বলল, তুমি আমাকে মা ডেকেছ। চিন্তা করো না। আমি তোমায় শাস্তি দিব না। আজ থেকে তুমিই আমার ছেলে। আমার সঙ্গে তুমি আমার বাড়ি চলো। বালকটি বলল, আমি আপনার জুমখেত দেখে রাখব। প্রয়োজন মতো অন্যান্য কাজও করব।

সেদিন থেকে বালকটি বৃদ্ধার বাড়িতে থাকতে শুরু করল। পরদিন বালকটি জুমখেত দেখতে এলেঅ। সেদিন ছিল খুব গরম। বৃদ্ধার জুমখেতে টংঘর না থাকায় তার খুব অসুবিধা হল। বালকটি তখন আংটিকে বলল, দয়া করে জুমখেতে আমার জন্য একটি টংঘর তৈরি কর। টংঘরে গৃহস্থালি জিনিসপত্রও এনে দাও।

বালকটির প্রত্যাশা মতো একটি টংঘর তৈরি হল। বালকটি টংঘরে গিয়ে বসল।

পরদিন বৃদ্ধা জুমখেতে এলো। সেখানে একটি টংঘর দেখে সে খুব অবাক হল। আবার সে খুব খুশিও হল। এদিকে জুমখেতের ফসল তোলার সময় এগিয়ে এলো।

বৃদ্ধা বালকটিকে বলল, তুমি দেবতার উদ্দেশ্যে পূজা দাও। আরও বলল, গায়ের পুরোহিতকে ভোগ দিতে পারিনি বলে সে পূজা করতে রাজি হয়নি।

বালকটি বলল, তুমি চিন্তা করো না। আমি পুরোহিতকে পূজা করতে বলব। আংটির সহায়তায় সে সহসা মাঠে পূজা অর্চনার ব্যবস্থা করে ফেলল। পূজার আয়োজন দেখে পুরোহিত খুব অবাক হল।

সে গ্রামে ফিরে গিয়ে সবাইকে বলল এই বৃদ্ধাই এ গায়ের সবচেয়ে ধনী। সে হয়তো কোথাও থেকে প্রচুর অর্থ-সম্পদ পেয়েছে। যখন ফসল কাটার সময় এলো বৃদ্ধা বালককে বলল, এবার সময়মতো ফসল তোলার ব্যবস্থা করো।

বালকটি আংটির সহায়তায় অনায়াসে সব ফসল তুলে ফেলল। ফসলগুলো এক জায়গায় রাখা হল। বালকটি বৃদ্ধার জন্য একটি ঝুড়ি তৈরি করে ফেলল।

বৃদ্ধা ঝুড়ি নিয়ে গ্রামের পথ দিয়ে যাচ্ছিল, তখন গ্রাম-প্রধানের মেয়েও ঐ পথ দিয়ে যাচ্ছিল। বৃদ্ধার হাতের ঝুড়িটি তার খুব পছন্দ হল। সে নিজের জন্য এমন একটি ঝুড়ি পেতে চাইল।

সে বৃদ্ধাকে বলল, এটা কে তৈরি করেছে? সে বৃদ্ধাকে তার জন্যও এমন একটি ঝুড়ি তৈরি করে দেওয়ার অনুরোধ করল। সে বৃদ্ধা ও তার ছেলেকে তাদের বাড়িতে আসার নিমন্ত্রণ জানাল।

বৃদ্ধা বাড়ি ফিরে এলো। সে ছেলেকে গ্রাম-প্রধানের মেয়ের চাহিদার কথা জানাল। তারপর অনেক দিন গড়িয়ে গেল। একদিন গ্রাম প্রধানের মেয়ে বৃদ্ধার সঙ্গে জুমখেতে গেল।

সে বালকটিকে দেখে মুগ্ধ হল। ফিরে এসে সে তার বাবাকে বলল, ঐ বৃদ্ধার সঙ্গে যে ছেলেটি থাকে তাকে সে বিয়ে করতে চায়।

গ্রাম-প্রধান বৃদ্ধাকে খবর পাঠালেন সেই বালককে নিয়ে বাড়িতে আসতে। সে দিন গ্রামের সকল যুবক গ্রাম-প্রধানের বাড়িতে হাজির হল। গ্রামপ্রধান ঘোষণা করলেন, যে এক ঘায়ে একটি শূকর মারতে পারবে এবং এক হাতে কেটে রান্না করে সকলকে খাওয়াতে পারবে, তাকে আমার মেয়ের যোগ্য পাত্র হিসাবে ঘোষণা দেওয়া হবে।

গ্রাম-প্রধান সবচেয়ে শক্তিশালী একটি শূকর এনে উঠানে বাঁধলেন । তারপর একে একে সকল যুবককে এক হাতে এক আঘাতে শুকরটিকে হত্যা করতে বললেন। তাদের কেউ এ কাজে সফল হল না। এমন কি তারা কেউ শূরকটির কাছে আসতেও সাহস করল না।

গ্রাম-প্রধান বললেন, এই গ্রামে যদি কোনো শক্তিশালী সাহসী যুবক না থাকে, তবে ভিনগাঁয়ের ছেলেদের আমার মেয়েকে বিয়ে করার জন্য ডাকতে হবে।

সব শেষে বৃদ্ধার ছেলে এগিয়ে এলো। সে শূকরটির কাছে গেল এবং সুবিধাজনক জায়গায় দাঁড়াল। হঠাৎ সে শূকরটির উপর ঝাপিয়ে পড়ল। এক হাতে সে শূকরটাকে ধরে ফেলল। এরপর আরেক হাতে এক আঘাতে শূকরটাকে হত্যা করল। সে এক হাতে শূকরের চামড়া ছাড়াল, শূকরটাকে কাটল, তারপর রান্না করে সকলকে খাওয়ালো।

গ্রাম-প্রধানসহ সকল গ্রামবাসী এতে খুব খুশি হল। তাৎক্ষণিকভাবে পুরোহিতকে ডেকে গ্রাম প্রধানের মেয়ের সঙ্গে বৃদ্ধার ছেলেটির বিয়ের আয়োজন করা হল। বর ও কনের কল্যাণ কামনা করে তাদের গায়ে পবিত্র জল ছিটিয়ে দেওয়া হল। আর মহা ধুমধামের সঙ্গে বিয়ে সম্পন্ন হল।

এরপর ঐ বৃদ্ধা ছেলে ও বউকে নিয়ে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে লাগল।

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা