জাতিসংঘ ও আদিবাসী ইস্যু

Jumjournal
Last updated Dec 5th, 2020

3050

featured image

আদিবাসী বিষয়ঃ প্রাথমিক ধারণাটি কিভাবে আসল?

জাতিসংঘে বিগত ৪০ বছরে এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা এর থেকে ও অনেক বেশি সময় ধরে আদিবাসী বলতে কাদের বোঝানো হবে তা নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। এখনোে এই বিষয়টি জাতিসংঘ ফয়সালা করতে পারেনি। আদিবাসী ধারণাটি Martinez Cobo study-তে তুলে ধরা হয়েছে এভাবে;

Indigenous communities, peoples and nations are those, which, having a historical continuity with pre-invasion and other pre-colonial societies that developed on their territories, consider themselves distinct from other sectors of the societies now prevailing on those territories, or parts of them.

They form at present non-dominant sectors of society and are determined to preserve, develop and transmit to future generations their ancestral territories, and their ethnic identity, as the basis of their continued existence as peoples, in accordance with their own cultural patterns, social institutions and legal system.

এই সংজ্ঞার আলোকে আদিবাসী হল তারাই যাদের মধ্যে নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ বিদ্যমান রয়েছে;

  • কোন একটা অঞ্চলে বংশ পরম্পরায় ‍যুগ যুগ ধরে বসবাস করছে।
  • দেশের প্রধান জনগোষ্ঠী থেকে সাংস্কৃতিক দিক থেকে স্বতন্ত্র।
  • যাদের নিজস্ব সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আছে।

আইএলও কনভেনশন-১৬৯ ও উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহের আলোকে আদিবাসীদের সংজ্ঞায়িত করেছে।

People in independent countries who are regarded as indigenous on account of their descent from the populations which inhabited the country, or a geographical region to which the country belongs or the establishment of present state boundaries and who irrespective of their legal status, retain some or all of their own social, economic, cultural and political institutions.

জাতিসংঘ ও আদিবাসী অধিকার

আদিবাসী ইস্যুটি মূলত আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ১৯৫০ দশকে স্থান পায় যখন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) ১৯৫৭ সালে Convention Concerning the Protection and Integration of Indigenous and Other Tribal and Semi-Tribal Population in Independent Countries গ্রহণ করে।

‍১৯৭০ দশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন গড়ে উঠে যার ফলশ্রুতিতে ১৯৮৯ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আরেকটি কনভেনশন গ্রহণ করে যা বর্তমানে ILO Convention No.169 নামে পরিচিত।

এটাও বলে রাখা উচিত যে, ১৯৬০ এবং ১৯৭০ দশকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক আদিবাসী সংগঠন আত্মপ্রকাশ করেছিল।

এসব সংগঠন আদিবাসীদের আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিয়েছিল শোষণ-বঞ্ছনা-বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে।

আদিবাসীদের এই বিক্ষোভের আর্তচিৎকারে ঘুম ভাঙে সমগ্র দুনিয়ার অধিকার সচেতন গণমানুষের যারা জাতিসংঘকে আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করতে চাপ প্রয়োগ করেছিল।

১৯৭২ সালে জাতিসংঘের Sub-Commission on Prevention and Protection of Minorities (SCPPM) আদিবাসীদের বঞ্ছনার সমস্যাটি নিয়ে গবেষণা করেছিল যেটা পরবর্তীতে Martinez Cobo Study নামে পরিচিতি লাভ করেছে।

এই গবেষণাটি ঠিক তখন-ই পরিচালিত হয়েছিল যে সময়ে আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান, আর্কটিক, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং ফিলিপাইনে আদিবাসীদের আন্দোলন চাঙ্গা হয়েছিল।

একদিকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চাপ অন্যদিকে এই গবেষণার ফলাফল জাতিসংঘকে ১৯৮২ সালে Working Group on Indigenous Populations of the Sub-Commission।

১৯৮৫ সালে UN Voluntary Fund for Indigenous Populations প্রতিষ্ঠা এবং আইএলও-এর কনভেনশন-১৬৯ এবং ১৯৯৩ সালকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস ঘোষণা করার মাধ্যমে ১৯৮৪-৯৩ এই সময়ে আদিবাসী অধিকারের বিষয়টি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে।

জাতিসংঘ ১৯৯৪-২০০৪ সময়ে প্রথম আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালন করেছে। এই দশকে আন্তঃরাষ্ট্রীয় ও সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে আদিবাসী ইস্যুটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে স্থান পেয়েছে।

এই দশকের অন্যতম অর্জন হল, জাতিসংঘ ২০০০ সালে আদিবাসীদের অধিকার বাস্তবায়নের জন্য প্রতিষ্ঠা করে।

২০০৭ সালে জাতিসংঘ ‘আদিবাসীদের মানবাধিকারের ঘোষণাপত্র’ গ্রহণ করে। নিচে আদিবাসী বিষয়টি কিভাবে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে স্থান লাভ করেছে তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সংক্ষিপ্ত আকারে উপস্থাপন করা হল।

১৯৫৭ – ILO Convention No.107 গৃহীত হয়েছে।

১৯৭২ – আদিবাসীদের বঞ্ছনার বিষয়টা নিয়ে Martinez Cobo গবেষণা করেছেন।

১৯৮২ – জাতিসংঘ Working Group on Indigenous Populations প্রতিষ্ঠা করে।

১৯৮৫ – UN Voluntary Fund for Indigenous Populations প্রতিষ্ঠা করে।

১৯৮৯ – ILO Convention No. 169 গৃহীত হয়েছে।

১৯৯৩- মানবাধিকার বিষয় নিয়ে বিশ্ব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় যেটি জাতিসংঘে আদিবাসী বিষয় নিয়ে একটি স্থায়ী ফোরাম গঠন করার জন্য সুপারিশ প্রদান করে।

১৯৯৩ – জাতিসংঘ ঘোষিত প্রথম আন্তর্জাতিক বর্ষ উদযাপন।

১৯৯৪ – জাতিসংঘ ১৯৯৪-২০০৪ কে প্রথম আন্তর্জাতিক আদিবাসী দশক হিসেবে ঘোষণা করে।

২০০০ – UN Permanent Forum on Indigenous Issues প্রতিষ্ঠা করে।

২০০৫ – জাতিসংঘ ২০০৫-২০১৫ সালকে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক আদিবাসী দশক হিসেবে ঘোষণা করে।

২০০৭ – UN Declaration on the Rights of Indigenous Peoples গৃহীত হয়েছে।

বিশ্বে আদিবাসীদের বর্তমান অবস্থা

১৯৪৫ সাল থেকে জাতিসংঘ সারা বিশ্বে মানবাধিকার, গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

এই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বিগত ৬০ বছর ধরে অনেক ক্ষেত্রে যেমন সফল হয়েছে, ঠিক তেমনি তার অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থতাও আাছে।

এসব ব্যর্থতার মধ্যে আদিবাসীদের অধিকারের ইস্যুটি উল্লেখ করার মত। জাতিসংঘের মতে, বিশ্বে ৯০টি দেশে ৩৭০ মিলিয়নের বেশি আদিবাসী জনগণ বসবাস করছে যাদের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা খুবই শোচনীয়।

জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের ‍State of the World’s Indigenous Peoples প্রতিবেদনে আদিবাসীর যে রাষ্ট্রীয় নির্যাতন, নিপীড়ন, বঞ্ছনা, বৈষম্যের শিকার হচ্ছে তার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এভাবেঃ

বিশ্বের অনেক জায়গায় আদিবাসীদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। তারা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে বঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। তারা দরিদ্রের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দরিদ্র এবং শিক্ষার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত।

তারা সশস্ত্র সংঘাত-সংঘর্ষ ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে উদ্বাস্তু হচ্ছে। তাদের অস্তিত্বকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য ethnic cleansing এর কৌশল হিসেবে আদিবাসী নারীদের ধর্ষণ ও বিভিন্ন ধরনের যৌন হয়রানি করা হচ্ছে।

এছাড়া ও তাদের সংস্কৃতি ও জীবন ধারা হুমকির মুখে পড়েছে। বর্তমান বিশ্বে যে ৭০০০টি ভাষা প্রচলিত আছে তাদের মধ্যে ৪০০০টি ভাষা এই আদিবাসীদের। ভাষা বিজ্ঞানীদের মতে, আদিবাসীদের ৯০ শতাংশ ভাষা এই শতাব্দীর শেষের দিকে পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় নেবে।

এই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছেঃ

  • আদিবাসীরা পুঁজিবাদীদের দ্বারা বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া, পানামাতে আদিবাসীদের সংরক্ষিত অঞ্চল আছে যেসব জায়গায় সরকার কিংবা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান কাজ করতে গেলে আদিবাসীদের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে আদিবাসীদের প্রথাগত ভূমি অধিকার না থাকার কারণে আদিবাসীরা বিভিন্ন লোভী মাইনিং কোম্পানি কর্তৃক উদ্বাস্তু হচ্ছে। অন্যদিকে আদিবাসীরা তাদের প্রাকৃতিক সম্পদের মালিকানা হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে।
  • বর্তমান সভ্য দুনিয়ার তথাকথিত উন্নয়ন আদিবাসীদের জীবনে বয়ে এনেছে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট। বিশ্ব বাঁধ কমিশনের মতে, আদিবাসী জনগণ বিভিন্ন বাঁধ নির্মাণের কারণে কেবল হারায়নি তাদের ভূমি এবং জীবিকা ব্যবস্থা, সেই সাথে তাদের সংস্কৃতিও ধ্বংসের মুখে পড়েছে।
  • আদিবাসীরা দিন দিন তাদের বাস্তুভিটা হারিয়ে এবং রাষ্ট্রীয় বঞ্ছনা-বৈষম্যের শিকার হয়ে নিঃস্ব থেকে আরো বেশী নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। যেখানে সমগ্র বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৫ শতাংশ হল আদিবাসী জনগণ অথচ বিশ্বের মোট হত দরিদ্রের মধ্যে ১৫ শতাংশ হল এই আদিবাসীরাই। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, গুয়েতেমালাতে প্রধান জনগোষ্ঠীর ৩২.২ শতাংশের বিপরীতে ৫৩.৫ শতাংশ (যাদের বয়স ১৫-১৯ এর মধ্যে) আদিবাসী শিশু তাদের প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করতে পারেনি। আদিবাসীর চাকুরীর ক্ষেত্রেও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। লাতিন আমেরিকায় দেখা গেছে, আদিবাসীদেরকে কেবলমাত্র চাকুরী সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে না, তাদেরকে মজুরিও অ-আদিবাসীদের চেয়ে ৫০ শতাংশ কম দেয়া হচ্ছে। ইউএনডিপি-এর মানব উন্নয়ন সূচকের আলোকে আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডে দেখা গেছে যে, আদিবাসীরা অ-আদিবাসীদের থেকে অনেক পিছিয়ে আছে।

মোটকথা, আফ্রিকাতে পিগমি ও বাতোওয়া আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মত এশিয়া-আমেরিকাতে বসবাসরত আদিবাসীদের অবস্থা খুবই করুণ। আদিবাসীদের এই শোচনীয় অবস্থাও অনেকটা বিশ্বায়ন ও জাতীয় রাষ্ট্রের উগ্রজাতীয়তাবাদী ভাবধারার ফসল। তাই আদিবাসীদেরকে তাদের মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচতে হলে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্রসমূহের অগণতান্ত্রিক আচরণ ও নীতির পরিবর্তন করতে হবে। কেবলমাত্র লোক দেখানো আন্তর্জাতিক সম্মেলন করে এই সমস্যার সমাধান হবে না।


লেখক: অনুরাগ চাকমা , প্রভাষক, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা