পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমাদের রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ

Jumjournal
Last updated Sep 23rd, 2021

918

featured image

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত বরাবর উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে দক্ষিণে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্য পর্যন্ত বিস্তৃত যে পার্বত্য ভূমি রয়েছে তা পার্বত্য চইগ্রাম নামে পরিচিত। এখানে বসবাস করে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তনচংগ্যা, খিয়াং, বম, লুসাই, পাংখােয়া, চাক, মো, খুমি নামে মােট ১১টি জাতিগােষ্ঠীর লােকজন।

এই জনগােষ্ঠির পাশাপাশি রয়েছে বেশকিছু বাঙালি জাতিৰা লােকজন যারা স্বউদ্যোগে। অথবা অপর উদ্যোগে পাহাড়ে বসবাস করতে যায় বা বসতি স্থাপন করে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বিভিন্ন জাতিগােষ্ঠীর মধ্যে চাকমা জাতিই সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং শিক্ষা দীক্ষায় অগ্রসর।

উনিশ শতকে বিশেষত ১৮৬৯ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে বৃটিশ শাসনের স্থপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর প্রথম আঞ্চলিক ইতিহাস রচয়িতা ক্যাপ্টেন টমাস হাটি লুইন তাঁর ওয়াইল্ড রেসেস অব সাউট ইস্টার্ন ইন্ডিয়া গ্রন্থে চাকমাদের সংখ্যা ২৫,০০০ বলে উলেস্নখ করেছেন।

বৃটিশ আমলে গৃহীত কৃষি নীতির বদৌলতে চাকমাদের সংখ্যা যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। সরকারি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় চাকমাদের সংখ্যা ১৯০১ সালে ৪৪,৩৯২ জন, ১৯৩১ সালে ১,৩৫,৫০৮, ১৯৫১ সালে ১,২৪,৭৬২, ১৯৮১ সালে ২,১২,৫৭৭, ১৯৯১ সালে ২,৩৯,৪১৭ ও ১৯৯৭ সালে ৩,০৬,৬১৬ জন। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ইতিহাসে মােগল আমল থেকে সব সময় চাকমারাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।

চাকমা জাতির উত্থান :

পার্বত্য চট্টগ্রাম চাকমাদের মূল আবাসস্থল। চাকমা জাতির উৎপত্তি সম্পর্কে টি এইচ লুইনের উল্লেখ থেকে জানা যায়, ঘােড়শ শতকে পার্বত্য চট্টগ্রামে আগমনের পূর্বে তাদের পূর্ব পুরুষদের আদি বাসভূমি ছিল চম্পক নগরে। চম্পক নগরের অবস্থান নিয়ে স্থির সিদ্ধান্তে আসা না গেলেও চাকমা রাজা ভুবন মােহন রায়সহ অধিকাংশ চাকমা ঐতিহাসিক এ মতের সমথর্ক।

রাজা ভুবন মােহন রায় তার চাকমা রাজবংশের ইতিহাস গ্রন্থে অনুরূপ দাবী করেন। বিরাজ মােহন দেওয়ান, তার চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত গ্রন্থে, মাধব চন্দ্র চাকমা কর্মী তার শ্রীশ্রী রাজনামা বা চাকমা জাতির ইতিহাস গ্রন্থে এমন দাবি করেছেন। কিন্তু কোন জাতির আদি ইতিহাস পুর্নগঠনের জন্য নির্ভরযােগ্য উপাদান যেমন প্রতুলিপি, মুদ্রা, স্মৃতিফলক, দেশি-বিদেশি ভ্রমণ বৃত্তান্ত, প্রাচীন সাহিত্য, প্রশসিড় দ্বারা সমর্থিত হওয়ায় চাকমাদের আদি ইতিহাস প্রমাণসিদ্ধ নয়।

চাকমা জাতির ইতিহাসের এক একটি বড় দূর্বল দিক। শুধু তাই নয় এটি তাদের জন্য বড় দুর্ভাগ্যের এবং হতাশার যে তাদের পুর্ব পুরুষগণ কোন লিখিত বিবরণ রেখে যাননি। যদিও চাকমাদের উৎপত্তি বা আদি ইতিহাস নির্ণয় এ প্রবন্ধের মূল বিষয় নয়, তবুও তাদের রাজনৈতিক চেতনা সম্পর্কে সম্যক ধারণার জন্য তাদের আদি ইতিহাস ও সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু বলা প্রাসঙ্গিক।

অষ্টাদশ শতকের পূর্বে চাকমাদের ইতিহাসে বিজয়গিরি, সমরগিরি, সিরিত্তমা, মংদুই ৰা মইসাং মারেক্যজ, সায়া বা পাগলা রাজা, ধাবানা, ধরম্যা, মোগল্যা, সুভল খাঁ কয়েকজন রাজার ইতিহাস চাকমা উপাখ্যান রাধামন ধনপুদি ও চাদিগাং ছাড়া পালা এবং বার্মিজ রাজাবলী দেজাওয়াদি আরেংফুদ কাহিনীতে পাওয়া যায়।

এদের মধ্যে সর্বশেষ রাজার অর্থাৎ সুভল খাঁর পরবর্তী রাজা জালাল খাঁ মতান্তরে ফতেখাঁ যিনি ১৭১৫ সালে মােগল সম্রাট ফররুখশিয়ারের সাথে বাণিজ্য চুক্তিতে আবদ্ধ হন এবং মুলত তখন থেকে চাকমা রাজাদের উত্থান সর্ম্পকে প্রামাণ্য ইতিহাস পাওয়া যায়। কিন্তু উপরে বর্ণিত রাজা বিজয় গিরি, সমরগিরি, সিরিত্তমা নামধারী রাজাদের সর্ম্পকে চাকমা সাহিত্যিক উপাদান ছাড়া প্রত্নতাত্ত্বিক বা বৈদেশিক কোনাে উৎসে উল্লেখ নেই। তাদের নিজ নামে কোন মুদ্রা, শিলালিপিও পাওয়া যায় না।

চাকমা উপাখ্যান সমুহে উল্লিখিত রাজাদের কাহিনী কাহিনীকাব্য হতে পারে। পাশাপাশি সতীশ চন্দ্র ঘােষের চাকমা জাতি গ্রন্থে বর্ণিত অষ্টাদশ শতকের পূর্বে ব্রহ্ম ইতিহাসের সাথে মিশ্রিত চাকমা রাজবংশের কাহিনীর কোনাে সত্যতা প্রমাণ সাপেক্ষ বলে কেউ কেউ মনে করেন।

চাকমা জাতির আদি ইতিহাসের এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় যে তাদের শেকড়ের ইতিহাস এখনও নির্মিত হয়নি। চাকমা ঐতিহাসিক অশােক কুমার ভাষা ও সংস্কৃতির বিচারে চাকমা জাতিকে একমাত্র উপমহাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের প্রাচীনতর কোন আর্যভাষী মঙ্গোলীয় জনগােষ্ঠী থেকে উদ্ভুত মনে করাই যুক্তিসংগত বলে মনে করেন।

তার মতে ১২/১৩শ শতকেই আর্যভাষাভাষী অথবা গভীরভাবে আর্যভাষা এবং সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত কোন একটি বৃহত্তর মঙ্গোলীয় নৃগােষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চাকমা জাতির প্রথম বীজটি অঙ্কুরিত হয়। তার মতে বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের আগমন ভারতের উত্তর পূর্বঞ্চিল থেকে শ্রীহট্ট হয়ে পার্বত্য ত্রিপুরা এবং সেখান থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম।

সেখানে অবস্থানকালীন পঞ্চদশ শতকের মধ্যেই চাকমারা একটি সুসংহত জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই চাকমারা দক্ষিণ এবং দক্ষিণ পূর্বদিকে বিস্তৃত হতে থাকে। এবং এক সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে।

আবার ভাষাতাত্ত্বিক গ্রিয়ারসন চাকমা হরফ গুলাের সাথে খেমার বর্ণমালার মিল খুঁজে পেয়েছেন যেগুলাে পূর্বে কম্বােদিয়া, লাওস, আনাম, সিয়াম এবং বামরি দক্ষিণাংশে প্রচলন ছিল। এসব তথ্যের আলােকে আলমগীর সিরাজুদ্দীন চাকমাদের আদিবাসভূমি খ্যাত চম্পকনগরের অবস্থান সম্ভাব্য পাঁচটি প্রাচীন শহরের মধ্যে একটি ইন্দো-চীনে বলে মনে করেন।

চাকমা জাতির উৎপত্তির প্রশ্নটি অমীমাংসিত। এটির জন্য নিবিড় ও সময়সাপেক্ষ গবেষণা দরকার। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে তারা ষােড়শ শতক বা তারও পূর্ব থেকে বসবাস করে আসছে তা ১৫৫০ সালে পতুর্গজি লেখক জোকা ডি বেরােস। অংকিত মানচিত্রে “চাকোমাস ” নামে একটি স্থানের উল্লেখ থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়।

এরপর অষ্টাদশ শতকের গোড়া থেকে চট্টগ্রামে চাকমা রাজাদের উথান সম্পর্কে প্রামাণ্য ইতিহাস পাওয়া যায়। ১৭৬০ সালে মীর কাসিম বাংলার মসনসের বিনিময়ে বৃটিশদের বর্ধমান ও মেদিনীপুর ও চট্টগ্রাম জেলা হস্তান্তর করেন।

চট্টগ্রামের শাসনভার নিতে এসে ১৭৬৩ সালে তৎকালীন বৃটিশ প্রধান হেনরি ভেরেলস্ট নিজেই তৎকালীন চাকমা রাজার রাজ্যসীমা স্বীকার করেছেন অন্য অর্থে তিনি চাট্টগ্রাম উত্তর পূর্বাংশে চাকমা রাজার রাজনৈতিক অস্তিত্বকেই নীতিগতভাবে মেনে নিয়েছিলেন।

১৭৯৮ সালে ড.বুকানন হেমিল্টন তার পার্বত্য চট্টগ্রাম, নােয়াখালী ও এিপুরা ভ্রমণের রােজনামচায় পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান নদী কর্ণফুলী ও তার উপনদী কাচালং, মাইনী, রেইংখ্যং, এবং চেঙ্গী নদীর অববাহিকায় সমৃদ্ধ জনবহুল চাকমা গ্রামের কথা উলেস্নখ করেছেন।

চাকমাদের প্রাথমিক সমাজ গঠনঃ

বৃটিশদের দলিল পত্র থেকে জানা যায় সাধারণ চাকমারা তাদের পরিবেশ পরিস্থিতির প্রয়ােজনে তারা নিজেরাই নিজেদের রাজা নির্বাচন করেছিল। যেমনটি করেছিল অষ্টম শতকে পাল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা গােপালের প্রকৃতিগণ মাৎস্যনায়ম থেকে দেশকে সুরক্ষার জন্য।

পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের আগমনের পূর্বে নরমুক্ত শিকারী হিংস্র কুকীদের বসবাস ছিল বলে জানা যায়। তারা চাকমাদের গ্রামে দল বেধে এসে অতর্কিতে হামলা শুনাত, গ্রামের পর গ্রামে লুঠতরাজ চালাত। সম্ভবত কুকিদের এ আক্রমণ সম্মিলিতভাবে মােকাবেলা করার প্রয়ােজনে বা নিজেদের নিরাপত্তার তাগিদে চাকমাগণ তাদের প্রথম রাজা চন্দন খাকে নিবাচিত করেছিলেন। চাকমাদের উপর লিখিত একটি প্রবন্ধে এ ধরনের উল্লেখ পাওয়া যায়:

“The Chakmas were the most numerous and powerful of all the hill tribes. By degrees they extended their influence over the others and in 1711 their chief Chandan khan was elected as the first Raja by the suffrages of the hill people.”

এভাবেই চাকমা রাজবংশের আধুনিক ও প্রামাণ্য ইতিহাসের যাত্রা শুরু চাকমারা খুবই রাজাভক্ত এবং রাজানুগত। শত প্রলােভনেও তারা রাজার বিরুদ্ধাচারণ করতো না। সমাজে রাজার প্রভাব ছিল অপরিসীম।

সমাজের আইন কানুন, আচার, প্রথা, রীতিনীতি, বিচার ব্যবস্থা এসব কিছুরই চুড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন রাজন্যবর্গ। ক্রমে রাজ্যের সীমানা এবং প্রজার সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলে রাজাগণ রাজকার্য যেমন-সেনাবাহিনী, রাজস্ব সংগ্রহ, শান্তি-শৃঙ্খলা, জমিজমা বন্টন প্রভৃতি কাজ সুচারুভাবে পরিচালনার জন্য তাদের অধীনে কর্মকতা নিয়ােগ করেন।

এক্ষেত্রে তারা মােগলদের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হন। ১৭৩৭ সালে রাজা শেরমু খাঁর সময় থেকে সময় চাকমা রাজ্যকে কয়েকটি অংশে ভাগ করে সেখানে দেওয়ান নামে নতুন প্রশাসনিক পদ সৃষ্টি করে শাসনের দায়িত্ব দেওয়া হয় যা ১৯০০সাল পর্যন্ত বহাল থাকে।

দেওয়ান পদ সৃষ্টি নিয়ে চাকমা ঐতিহাসিক বিরাজ মােহন দেওয়ান ভিন্নমত পােষণ করেন। তাঁর মতে রাজা শুকদেবই, রাজ্যশাসন সংক্রান্ত ব্যাপারে নিয়ােজিত চাকমা সদর ও সম্রান্ত লােকদের প্রথম দেওয়ান উপাধি প্রদান করেন। তাহার সময়ে ধুঙ্গি, লস্কর ও বাঙালি লস্কর নামে দুইজন সেনাপতি বা সদরি ছিলেন।

উল্লেখ্য চাকমারা স্থানান্তর কৃষি বা স্থানীয় ভাষায় জুম চাষী হলেও তারা স্মরণাতীত কাল থেকে নির্দিষ্ট পাড়াতে (গ্রামে) স্থায়ী ভাবে বসবাসে অভ্যস্থ । স্থায়ীভাবে বসতিস্থাপন ও সংঘবদ্ধ সমাজব্যবস্থা রাজনৈতিক সমাজ গড়ার ক্ষেত্র তৈরী করে। তাই চাকমা সমাজে সহজে রাজার নেতৃত্বে সুসংগঠিত কেন্দ্রীভূত রাজনৈতিক কাঠামাে বিকশিত হয়।

ক্রমান্বয়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলে দেওয়ানদেরকে সহযােগিতা করার জন্য খীসা পদবীধারী প্রতিনিধি নিয়ােগ করা হয়। ১৯৫০সালে বৃটিশরা রাজাদেরকে সরকারি রেগুলেশনে স্বীকৃতি দেয় এবং মৌজা ও পাড়ায় যথাক্রমে হেডম্যান ও কার্বারি নিয়ােগ দিলে চাকমা সমাজ কাঠামাের স্তর নতুন ভাবে বিন্যাস্ত হয়। চরিত্রগত দিক দিয়ে সমস্ত ধরনের এ নেতৃত পাকিস্তান আমলের শেষদিক পর্যন্ত দাপটের সাথে বিরাজমান থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামের একজন অনুসন্ধিৎসু গবেষকের পর্যবেক্ষণ এমনটিই বলে।

এখন চাকমা রাজারা অবহেলিত। তবে এটা ভেবে দেখার অবকাশ আছে যে, এই রাজাদের গুণেই চাকমা সমাজের স্বতন্ত্র পরিচিতি ও মান মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত। অতীত থেকে দলপতি নিয়মিত আর ঐক্যবদ্ধ থাকার কারণেই তারা বিশেষ সমাজ ও সমপ্রদায় হিসেবে মান্য। তাদের বিশেষ উপজাতীয় পরিচিতি ও প্রভাবের ভিত্তি হলাে দীর্ঘ রাজকীয় ঐতিহ্য। সরিই নিয়ন্ত্রণই তাদের ঐক্য ও স্বাতন্ত্রের ভিত্তি। (আতিকুর রহমান, পর্বত প্রকাশ (অনুসন্ধান) (ঢাকা: পর্বত প্রকাশনী, ২০১৩), পৃ. ১৪)

রাজাদের তিলে তিলে গড়ে তােলা শতবছর ধরে প্রচলিত এই দেওয়ান ও খীসা, কার্বারী পদবী বংশগত উপাধিতে রূপান্তরিত হয় এবং তারা তাদের ব্যক্তিগত যােগ্যতা, ব্যক্তিত্ব, অর্থ সম্পদ ও শিক্ষাদীক্ষার গুণে অদ্যাবধি চাকমা সমাজে ও পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনীতিতে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে স্থানীয়, আঞ্চলিক এবং জাতীয় পর্যায়ে যারা প্রতিনিধিত্ব করেছেন তাঁদের অধিকাংশই এই শ্রেণির লােকজন। এর পরে রয়েছেন সাধারণ চাকমা জনগণ যারা নামের শেষে চাকমা শব্দটি যােগ করেন। জগতের সকল সমাজের সাধারণ জনগণের ন্যায় চাকমা সমাজেও এই সাধারণ চাকমারা সংখ্যাগরিষ্ঠ।

চাকমা সমাজ পিতৃতান্ত্রিক এবং একই সাথে জাতিভিত্তিকও। তারা কতকগুলি গােত্রে বিভক্ত। এগোত্র গুলােকে চাকমার গল্প বলে। উনিশ শতকে পাবর্ত্য চগ্রামের আঞ্চলিক ইতিহাস রচয়িতা ক্যাপ্টেন লুইন চাকমাদের মধ্যে ২১টি গজা বা গোত্রের নাম সংগ্রহ করেছেন। যেমন মুলিমা গঝা, লারমা গঝা, বােরবাে গঝা, কুরাকুট্যা ইত্যাদি ।

চাকমাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার নামের শেষে টাইটাল হিসেবে গঝা বা গােত্রের নাম ব্যবহার করেন। যেমন- এম এন লারমা, জে বি লারমা বা সল্প লারমা উল্লেখযোগ্য । কয়েকটি গােষ্ঠী বা গুখি নিয়ে গঝা গােত্র গঠিত।

আবদুস সাত্তার এরকম ১৫০টি গােষ্ঠীর কথা উল্লেখ করেছেন। সাধারণত স্বীয় পরিচয় প্রদানের ক্ষেত্রে এই গঝ গুথি কেন্দ্রিক পরিচয় কিছুটা ম্লান হলেও বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপনের ক্ষেত্রে এখন গজা গুথি বা গােত্র পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলনে চাকমা রাজন্যবর্গ:

অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলায় ইংরেজ বণিক কোম্পানির দুঃশাসনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে যেসব এলাকায় বিদ্রোহ নানা বেধে উঠে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা বিদ্রোহ অন্যতম।

১৭৭৬ থেকে ১৭৮৫ সাল পর্যন্ত চলা এ ব্রিটিশ বিরােধী স্বাধীনতা সংগ্রাম জাতীয় গৌরবের অংশ। বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের উপর সম্পাদিত বাংলাদেশের ইতিহাস ১৭০৪১৯৭১ শীর্ষক মূল্যবান গ্রন্থেও চাকমা বিদ্রোহের ইতিহাস সগৌরবে স্থান করে নিয়েছে। অষ্টাদশ শতকে তৎকালীন চাকমা রাজা সের দৌলত খাঁর নায়েব বনু খাও পতাকা উড়িয়ে বৃটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন।

বাংলা তথা ভারতে বৃটিশ কোম্পানি শাসনের সুচনা পর্বে সংঘটিত চাকমাদের এ বিদ্রোহের ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য অনস্বীকার্য। কিন্তু তৎকালীন সাহসী বীর চাকমারাজা সের দৌলত খাঁ, জানবক্স খাঁ ও তাদের সেনাপতি দেওয়ান রনু খাঁ, কনু খাঁ, জ্বলুপ, চোরি, বুটঠ্যাং বা সর্বস্তরের চাকমাদের নিয়ে গভীর দেশপ্রেম ও বীরত্বের সাথে বৃটিশদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ লড়াই করলেও এক পর্যায়ে বৃটিশ চাকমাদের উপর অর্থনৈতিক অবরােধ আরোপ করলে সাধারণ চাকমাদেরকে তীব্র দুর্ভোগ পােহাতে হয়।

এ পরিস্থিতিতে রাজা জান বক্স খাঁ কোম্পানির কলকাতাস্থ ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গে গিয়ে কোম্পানির গভর্নর জেনারেলের সাথে রাজনৈতিক সমঝােতা তথা শান্তি চুক্তি সম্পাদন করে জন দুর্ভোগ লাগব করেন।

পাকিস্তান আমলে চাকমা সমাজে রাজনৈতিক নেতৃত্বের আবির্ভাব:

পাকিস্থান আমলে জাতীয় রাজনীতির প্রভাবে চাকমা সমাজ কাঠামােতে নতুন উপাদান যুক্ত হয়। তবে এক্ষেত্রে বলে রাখা ভাল ত্রিপুরা , মারমাদের ক্ষেত্রে একথাটি প্রযােজ্য। এসময়কালে চাকমা রাজা ও অভিজাত দেওয়ান পরিবারের সদস্যবর্গ গোত্রপতি থেকে অবতীর্ণ হন আধুনিক রাজনৈতিক প্রতিনিধি ও প্রশাসকের ভূমিকায়।

১৯৫৪ সালে কামিনী মােহন দেওয়ান চাকমা (বৌদ্ধ) সমাজ থেকে পূর্ব বাংলার আইন সভায় প্রথম এম এল এ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া ১৯৬২ ও ‘৬৫ সালে চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য এবং ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ সময় তাঁদের জীবনযাত্রায় পাশ্চাত্য প্রভাব বেশ লক্ষণীয়। এ সম্পর্কে একটি পর্যবেক্ষণ হল :

The changing political climate induced the chiefs to search for a more modern political role, changing their appearance once again and donning business suits, they sought elected offices in Pakistan and prefered to present themselves as modern admistrators even in their role as local host.

পাকিস্তানের ইতিহাসে ১৯৫৪ সালেই প্রথম পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা তথা পাহাড়িদেরকে প্রথমবারের মতাে ভােটাধিকার দেওয়া হয়।

এই নির্বাচনই পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে প্রথম নির্বাচন। এ নির্বাচনে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষিত আসন থেকে একজন এবং তফসিলি সমপ্রদায় থেকে একজন প্রার্থী প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

এছাড়া ১৯৬০ সালে আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র আদেশ অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামে ৩৯টি ইউনিয়ন কাউন্সিল এবং ৩টি থানা কাউন্সিল নিয়ে একটি জেলা কাউন্সিল গঠিত হয়। কাউন্সিল সমুহের মােট ৪০৫ জন সদস্য হিল যার মধ্যে ২৭০ জন নির্বাচিত সদস্য এবং ১৩৫ জন ছিল মনােনীত সদস্য। থানা কাউন্সিল সমুহের মােট সদস্য সংখ্যা ছিল ৩৭ জন (সকলে মনােনীত)।

জাতীয় নির্বাচন গুলােতে উপজাতীয় প্রধানদের প্রাধান্য ও নেতৃত্ব অক্ষুন্ন থাকলেও স্থানীয় নির্বাচনগুলাের দ্বারা পাহাড়ি সমাজে ঐতিহ্যবাহী নেতৃত্বের বাইরেও সাধারণ জনগণের মধ্যে থেকে একটা নেতৃত্ব গড়ে উঠার সুযােগ সৃষ্টি হয়।

এভাবে বিদ্যমান চিফহেডম্যান-কাবরিী কাঠামাের পাশাপাশি চাকমা সমাজে নতুন নেতৃত্ব গড়ে ওঠে। একজন চাকমা স্কলার আদিত্য কুমার দেওয়ান পার্বত্য চট্টগ্রামের সামাজিক প্রতিষ্ঠানের উপর মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থার প্রভাব মূল্যায়ন করেছেন এভাবে:

Finaly, the traditional indigenous institutions have been severely affected by the introduction of Basic Democracy in 1959. The BD system led to the weakening of the traditional karbari, Headman and Chief system. Now a BD member has more power and function in the villages and at the local level than a Mouza and a village headman because all rural development works programs initiated by the government are implemented through the Union Council Chairman and the Council members in collaboration with the government appointed Circle officers (CO) and Sub-division officers (SDO).9

এভাবে ষাটের দশকে চাকমা সমাজে বিদ্যমান চিফ-হেডম্যান-কার্বারী কাঠামাের পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে নতুন নেতৃত্ব গড়ে ওঠে যা আধুনিক রাজনৈতিক চেতনার বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

(Endnotes)
১. উপাত্ত গুলাে হান্টার:১৮৭৬, হাটচিনসন:১৯০৯, বেসাইনেটঃ১৯৫৮,আদিত্য দেওয়ান,সুগত ২০১০, থেকে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া ভারতের ১৯৬১ সালের গণশুমারীনুযায়ী বিভিন্ন প্রদেশে (ত্রিপুরা, মিজোরাম আসাম, মেঘালয়,ও পশ্চিম বঙ্গ)। ৪৩,১০৩জন চাকমা বসবাস করছে।
২. অশােক কুমার দেওয়ান, চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার, দ্বিতীয় খন্ড, ঢাকা, ১৯৯৩, পৃ-৩৬, ৭৯৮০,-৮৩
৩. A.M. Serajuddin, “The Chakma tribe of the Chittagong Hill Tracts in the 18th century” Journal of the royal Asiatic society of Great Britain, 1(1984); p.90-9৪
৪. বিরাজ মােহন দেওয়ান, চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত, (২য় সংস্করণ, রাংগামাটিঃ সরােজ আর্ট প্রেস,২০০৫) পৃ-১৩২ ।
৫. Willem van Schendel and others. The Chittagong Hill Tracts:Living in Boarderland (Dhaka: University Press Limited,2001) 78
৬. Mizanur Rahman shelly (ed.) The Chittagong Hill Tracts of Bangladesh: The Untold Story (Dhaka:CDRB, 1992).30
৭. A. B.Rajput,CIS, The Tribes of Chittagong Hill Tracts (Karachi, Pakistan Publications, 1965), 34
৮. জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পার্বত্য স্থানীয় সরকার পরিষদ, (রাংগামাটিঃ স্থানীয় সরকার পরিষদ, ১৯৯৬)পৃ-১১
৯. AK Dewan , op. cit., 181

লেখকঃ অধ্যাপক আনন্দ বিকাশ চাকমা

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা