রাধামন-ধনপতি পালা: প্রেম এবং প্রকৃতি

Jumjournal
Last updated Jul 15th, 2020

1399

featured image

ভূমিকা

‘রাধামন-ধনপতি’ চাকমা এবং তঞ্চঙ্গ্যা পৌরাণিক সাহিত্যের অন্যতম একটি সাহিত্য উপাদান। এটি মূলত একটি ঐতিহাসিক প্রণয়োপাখ্যান। এই প্রণয়োপাখ্যানে প্রেম-বিরহ এর পাশাপাশি সমন্বয় ঘটেছে দেশপ্রেম, প্রকৃতি এবং ইতিহাসের।

আমরা লক্ষ্য করি যে, বাংলা সাহিত্যে বিশেষ করে মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য একই উপাদানে সংমিশ্রণ ঘটেছে এই সৃষ্ট কর্মের মধ্যেও। এই রাধামন-ধনপতির মতো চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা পৌরাণিক ইতিহাসে আরও বেশ কিছু পালা (উপাখ্যান) রয়েছে।

যে উপাখ্যানগুলি দেশ, কাল, সামাজিক জীবন, সংস্কৃতি এবং ইতিহাসকে আশ্রয় করে রচিত হয়েছে।  এই উপাখ্যানগুলি রচিয়তাদের সুনির্দিষ্ট করা না গেলেও এর কাহিনী এবং বিষয়বস্তু কালে কালে ছুঁইয়ে গেছে দেশ, কাল, জাতি ও সমাজকে।

বিশেষ করে গেংখুলীদের কণ্ঠে বেহালার সুরে এই পালাগুলি যখন পরিবেশিত হয় তখন ব্যক্তি আর তার মধ্যে থাকে না সে ফিরে যায় শত বছর আগে আপন জনের ফেলে আসা স্মৃতির মধ্যে।

চাদিগাঙ, জুম কাবা, রান্যা বেড়া, ফুল পারা ও রাধামন-ধনপতি পালাগুলি হচ্ছে অন্যতম। আমরা ইতিহাসে দেখি রাজা বিজয়গিরির সেনাপতি হচ্ছেন রাধামন আর রাধামনের সহধর্মিনী হচ্ছেন ধনপতি।

রাধামন-ধনপতি পালাতে তারা নায়ক নায়িকা, পরবর্তীতে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে আমরা দেখতে পাই। রাধামন এখানে বীরযোদ্ধা, সেনাপতি, বলবান, বীর্যবান, রুপবান এবং আদর্শবান একজন পতি।

স্ত্রীর আকুল ভালোবাসাকেও যত্নে পাশে দেন, সযত্নে মাতৃভূমিকে রক্ষা এবং বিপদে প্রতিবেশী বা বন্ধুকে সাহায্য করাই যেন তার ব্রত নিয়ে। আর ধনপতি পতিব্রতা একজন সতী নারী, যেখানে স্ব্বামীর মঙ্গলই তার একমাত্র কামনা।

তারা চম্পক নগরের নরপতি সাদেংগিরির কন্যাদ্বয় মেনকা এবং কপতি’র পুত্র এবং কন্যসন্তান।  মেনকা জয়মঙ্গলের গর্ভে জম্ম নিল রাধামন আর কপতি- নিলগিরির গর্ভে জম্ম নিল ধনপতি।

সম্পর্কে তারা মামাতো আর মাসিতো ভাই-বোন। রাধামন এবং ধনপতির শৈশব কৈশোর কেটেছে হেলে দুলে, হাসি আনন্দে, সুশীতল স্নিগ্ধ ছায়াতলে। জুমের ভুলপথে ঘুরেফিরে আর দল বেধেঁ জুম ঘরে বসে হেসে খেলে তাদের দিনগুলি অতিবাহিত হতো।

যুবক যুবতীরা মিলে জুমে নানা তরকারি খুঁজতে যেতো। বিষু দিন হলেতো কথাই নেই। পাইসনের জন্যে যুবক-যুবতীরা দলবেধেঁ জুমে যেত তরকারি খুঁজতে। তারা জুম থেকে মা শমোই, মারফা, জুম্ম্যা বেগুন, জুম কুমড়াসহ নানা তরকারী খুঁজে নিয়ে আসতো।

আর বাড়িতে ফেরার সময় নিয়ে আসতো জুম ফুলের (গাদা ফুল) গাছ। তারা এসে এটি রোপণ করতো ছড়ার কোন বড় মরঙের (প্রকৃতিসৃষ্ট বর কূয়া) পাশে।

আর প্রার্থনা করতো তারা যেন সারাজীবন এইভাবে হেসেখেলে সুখে শান্তিতে থাকতে পারে। তাদের এই আনন্দের সাথে যোগ দিত সবুজ গাছের সারি ও জঙ্গল আর নানা রকম ফল-ফলাদি, পাখির কল-কাকলী এবং আকাশে সাদা মেঘের ভেলা।

রাধামন এবং ধনপতির যৌবনের প্রথম বসন্ত কেটেছে সৌরভিত ফুল বনে। তাদের প্রেম ভালোবাসা দেখে বসুন্ধরা হেসে উঠে আপন মনে। বসন্তের কোকিলও গেয়ে উঠে গান। ফাগুনের নব হিল্লোলে তাদের প্রাণে জাগে নব শিহরণ।

ধনপতি শুরু থেকে নানাভাবে রাধামণকে ভালোবাসার কথা জানান দিলেও রাধামন ধনপতির ভালোবাসাকে সেভাবে সেভাবে গ্রহণ করতে চাইনি প্রকৃতির নিয়মে।

সে রাধামনকে পাওয়ার জন্য কুমারী বয়সে শ্রীবুদ্ধ চরণে পূজা দিবে বলে মানস করে রেখেছে। ধনপতি রাধামনকে যখন তার ভালোবাসার কথা জানায় তখন প্রকৃতিও যেন খুশিতে ভরে উঠেছে তবু রাধামন বিনয়ের সাথে বলেছে সমাজের নানা বাঁধাধরা নিয়ম আছে।

রাধামনের কথা শুনে ধনপতি বলেছেন – আমি মানি না এইসব বাঁধাধরা নিয়ম কানুন। তিনি রাধামনকে মিনতি করে বলেছেন-

  ‘তব পায়ে এ মিনতি মম,

 আশা তুমি করেছ পূরণ,

দাসী হয়ে চিরদিন সেবিব জীবনে তব দু’চরণ”।

ধনপতি- চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারাদের ধর্ম সাক্ষী রেখে আরো বলে-

‘তুমি বিনে পতি নাই নিজে আমিত্য জীব জীবন,

তোমায় চরণ বিনে কিছুই নাই মম’।

এতকিছুর পরেও রাধামনের মন কিছুতে গলে না। ধনপতি অনেক অনুনয় বিনয় করে শেষে রাধামনের মন গলে যায়। তখন রাধামন বলে-

 ‘ধর্মসাক্ষীকরে আজ হতে তুমি মম পত্নী হলে,

 মানবের সত্যধর্ম বিনা নাই কিছু এই মহীতলে,

সত্যের মহিমা সতী নারী নাম ভবে রবে চিরদিন”।

শেষ পর্যন্ত রাধামন ধনপতির পবিত্র প্রেমে সাড়া দিতে বাধ্য হয়। এরপর তারা প্রেমের সাগরে ভাসতে থাকে।

একে অপরকে দাদা এবং বোন হিসেবে সম্বোধন করলেও রাধামন আদর করে ধনপতিকে ডাকেন ‘প্রাণেশ্বরী, ওগো সতি, সুবদনি, হিসেবে আর ধনপ্তি স্বামীকে আদর করে ডাকে ‘প্রাণ নাথ, প্রাণেশ্বর’ হিসেবে।

সে স্বামীকে খুব বেশি ভালোবাসে এবং শয়নে স্বপনে শুধু স্বামীর মংগল কামনা করেছে। এই ভালোবাসার দাবী নিয়ে ধনপতি মাঝেমধ্যে রাধামনের কাছে নানা কিছু আবদার করে বসত।

সেরকম একদিন ধনপতি নদীতে গোসল করে গিয়ে দেখে সুন্দর একটি ফুল নদীর পানিতে ভেসে আসছে। সে ফুলের গন্ধ কি মনোরম, সুশীতল। এই পর্যন্ত যতগুলো ফুল সে দেখেছে এবং গন্ধ নিয়েছে এই ফুলটির কাছাকাছি কোনটি নয়।

ফুলটি তুলে নিয়ে তার মাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল- মা এটি কিসের ফুল। মা বলল এটি ‘দেব নাগেশ্বর ফুল’। ধনপতি আর জিজ্ঞেস করল এই ফুল কোথায় পাওয়া যায়? মা বলল- অলিরা মধু খেয়ে এই ফুল নদীতে ফেলে দিয়েছে।

ধনপতি তখন মনে মনে ভাবতে থাকে সদ্য ফোটা এই দেব নাগেশ্বর ফুলটি একদিন সে দেখবে এবং দাদা রাধামনকে তার মনের বাসনা কথা জানাবে।

একদিন বাসন্তী পূর্ণিমায় শুভ্র রাতে সে তার মনের কথা রাধামনকে বলছে, ধনপতির ঘুমের মধ্যে এই স্বপ্নগুলি দেখছে। একটু শীতল আমেজ আলোর ছলকানি হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে উঠে দেখে দিনমনি পূর্বাকাশে জ্বলজ্বল করছে।

বছর শেষ বাসন্তী পূর্ণিমা উৎসব। ধনপতি ঠিক করল বাসন্তী পূর্ণিমা রাতে রাধামনকে তার মনের কথা জানাবে। এই বাসন্তী উৎসবে সবাই নিজের মতো করে ব্যস্ত থাকে। বিশেষ করে যুবক-যুবতীরা ঘিলা খেলা, নাদেং খেলা নিয়ে মেটে উঠে।

সেসময় রাধামন রাধামন-ধনপতির মতো প্রেমিক যুগল; কুঞ্জবী-কুঞ্জধন, নিলংবী-নিলংধন, মেয়াবী-মেয়াধন, কানেকবী-কানেকধন সবাই মিলে ঘিলা খেলা খেলবে বলে ঠিক করল।

বাসন্তী পূর্ণিমা উৎসবে সবাই যখন অনুষ্টান নিয়ে ব্যস্ত ঠিক তখন সবার অগোচরে রাধামন আর ধনপতি দেব নাগেশ্বর ফুল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ইরাবতী নদীতে চলে যায়। তারা বনে গিয়ে দেখে অতি উচ্চ ডালে এই ফুলগুলি ফুটে আছে।

ধনপতি মনে মনে ভাবে এই ফুল নিতে হলে অবশ্যই বৃক্ষ দেবতার আর্শীবাদ লাগবে। এই দিকে রাধামন যখন দেব নাগেশ্বর ফুল নেয়ার জন্য লতাগুলিকে বাঁশের মতো করে বেঁধে তৈরি করতে লাগল তখন ধনপতি বলল, আমি অন্ধকারে কিভাবে নিচে একা একা থাকব।

তাছাড়া তখন এই ইরাবতী নদীর গভীর বনে বন্য হাতি, ভাল্লুক, বাঘ, নেকড়েসহ আরও অনেক বন্যপ্রাণী ঘুরে বেড়াচ্ছে। ধনপতির বিপদের কথা ভেবে রাধামন জলের উপর এটা জলটংগীতে তুলে দেয়, যেন ধনপতি নির্ভয়ে থাকতে পারে।

সে যখন ফুলের জন্য বৃক্ষ  শাখায় উঠে হঠাৎ দেখা ফুলগুলি অদৃশ্য হয়ে যায়, দূরের শাখায় মাত্র একজোড়া ফুল দেখা যাচ্ছে। রাধামন বুঝতে পারে বৃক্ষ দেবতা ফুলগুলিকে অদৃশ্য করে রেখেছে।

পরক্ষণে রাধামন লক্ষ্য করে বৃক্ষ দেবতা তাকে বাঘের ছায়া হয়ে ভয় দেখাচ্ছে। এতে রাধামন ভয় পেয়ে গাছ থেকে নিচে পড়ে গিয়ে মুর্ছা যায়। মূর্ছা পাওয়া রাধামনকে ধনপতি কোলে তুলে নিয়ে খাদির আচল দিয়ে মুখ মুছে দেয় এবং রাধামনকে ডাকতে থাকে প্রাণেশ্বর, প্রাণেশ্বর বলে।

রাধামনের কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে ধনপতি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। শোকাকুল হয়ে ইষ্ট দেবতাকে স্মরণ করে বলে- ‘প্রভু দাও হে আমায় কুল’। তখনও বৃক্ষ দেবতা নানাভাবে ধনপতিকেও ভয় দেখাচ্ছে।

মাঝেমধ্যে বাঘের গর্জনে, মাঝে কালান্তর সাপ হয়ে, আর মাঝে মধ্যে বৃহৎ হস্তি রুপে।  এদিকে ধনপতির আকুল ক্রন্দনে এবং শোকে দেহ মন হয়ে গেছে মলিন কারণ তার জীবনের সাথী পড়ে আছে অচেতন হয়ে।

তবু এ ঘোর বিপদে ধনপতি ভগবানকে ডাকে বারে বারে। ধনপতি বলে আমি যদি সতী নারী হয়ে থাকি তাহলে আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দাও। ধনপতির কথা শুনে বৃক্ষদেবতা হাজির হয়ে সঞ্জিবনী মন্ত্র পাঠ করলে রাধামন আগের অবস্থায় ফিরে আসে।

সে সুস্থ হয়ে দেখে ধনপতির কোলে তার মাথা। তখন রাধামন শুনতে পায়- আকাশ ও ভুমিবাসীদেব নাগ যক্ষ মহা ঋদ্ধিমান, রক্ষে সদা সতী নারী ধার্মিক পূন্যবান।

রাধামন পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে ধনপতির জন্য সুউচ্চ বৃক্ষডালে উঠে দেব নাগেশ্বও ফুল নিয়ে আসে। হাতে দেব নাগেশ্বও ফুল পেয়ে ধনপতি কি খুশি। সে খুশিতে রাধামনকে জড়িয়ে ধরে পরম সোহাগে।

প্রেম ভালোবাসা আর রাগ-অনুরাগের এবং মান-অভিমানের মধ্যে দিয়ে রাধামন ধনপতির বালোবাসা পূর্ণতা পায় তাদের শুভ পরিণয়ের মধ্য দিয়ে। রাধামন ধনপতির বিয়ের সমস্ত কিছু আয়জন করল রাজ পুরোহিত ছলাবাপ।

যিনি রাজ দরবারে শুভ-অশুভ, মংগল-অমংগল এবং নানাবিধ পুজা-অর্চনা করে থাকেন। রাধামন-ধনপতি  যাকে দাদু বলে সম্বোধন করেন। ছলাবাপও তাদের নাতি-নাতনি বলে যথেষ্ট আদর স্নেহ করেন।

একদিন রাধামন-ধনপতি ছলাবাপের কাছে গিয়ে বলে দাদু আমাদের বিয়ের চুমুলাঙ আপনাকে করে দিতে হবে।  ছলাবাপ তখন বলে, দাদা-দিদিভাই আমি বুড়ো মানুষ কিভাবে আমি তোমাদের চুমুলাঙ করে দিব আমিতো হাঁটতে তেমন পারিনা।

রাধামন-ধনপতি তবু ছলাবাপকে অনুরোধ করতে লাগল- তাদের বিয়ের চুলুলাঙ করে দিতে। অনেক অনুরোধের পর ছলাবাপ রাজী হয়ে গেল। তখন রাধামন-ধনপতি বলল, দাদু তাহলে তুমি আমাদের বিবাহ জীবন কেমন হবে রাত্রে নিশাদেবীকে স্মরনে জিজ্ঞেস করো। ছলাবাপ বলল – ঠিক আছে।

পরদিন ছলাবাপ রাধামন-ধনপতির বিয়ের চুমুলাঙ করে দিল। পোরানিক নিয়মে তঞ্চংগ্যা সমাজে এখনও বিয়ের পর চুমুলাঙ করে নতুন বউকে আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করে ঘরে তোলার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয়।

বিয়ের চুমুলাঙ করে দেয়ার পর ছলাবাপ তাদের মনভরে আর্শিবাদ করল এবং বলল- আর্শীবাদ করছি তোমাদের দাম্পত্য জীবন মঙ্গলময়, সুখময় এবং মধুর হউক।

তোমরা নিরাময় দীর্ঘ জীবন এবং তোমাদের যথা ইচ্ছা পুর্ণ হউক আর তোমাদের ঘরে লাল টুকটুকে এক বীর সন্তান আসুক। চুমুলাঙ শেষে রাধামন তার দাদুকে জিজ্ঞেস করল, রাত্রে তুমি নিশাদেবী দর্শন করে কি দেখলে?

তখন ছলাবাপ বলল, না অমঙ্গল কিছুই দেখি নি, তবে। ‘তবে মানে কি দাদু’- রাধামন-ধনপতি জিজ্ঞেস করল।

তাহলে মন দিয়ে শোন দাদা-দিদি আমার স্বপ্নের বিবরণ। আমি গত রাত্রে নিশাদেবী স্মরণ করে ঘুমিয়ে পড়ি, প্রথম প্রহরে স্বপ্ন দেখলাম- আমি চৌদ্দ ডিঙ্গা সেজে নানাবিধ পন্যদ্রব্য নিয়ে উজান গাঙে পাল তোলে চলেছি।

অনেকদুর এগিয়ে নানা ফুল-ফল ও পশু-পক্ষী পরিপুর্ন এক সুবিশাল ছায়াশীতল বট বৃক্ষের নিচে বিশ্রাম করতেছি। এমন সময় ঘুম ভেঙ্গে যায়। তারপর দাদু কি হলো উভয়ে প্রশ্ন করলো।

তারপর ছলাবাপ বলল- আমি আবার ঘুমিয়ে পড়ে নিশাদেবী স্বপ্ন দর্শন দেয়ার অনুরোধ করলে তখন দেখলাম- পূর্বদিকে উঠেছে এক ধুমকেতু নক্ষত্র তারা। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে জেগে দেখি পূর্ব গগনে সূর্য উঠছে।

স্বপ্নের অর্থ কি হবে জিজ্ঞেস করলে ছলাবাপ বলল- উজান গাঙে অর্থ হচ্ছে- তোমাদের দাম্পত্য জীবন উজান দিকে চলবে, মানে সুখের হবে। ছায়া শীতল বতবৃক্ষ অর্থ হচ্ছে তোমাদের একটা সু-পুত্র জম্মাবে বৃদ্ধ বয়সে সেই পুত্রের আশ্রয়ে সুখে শান্তিতে জীবন অতিবাহিত করতে পারবে।

আর দ্বিতিয় স্বপ্ন পূর্বদিকে যে ধুমকেতু তারা দেখেছিলাম তার অর্থ হচ্ছে – একসময় ছলারবাপ দেশে যুদ্ধের ধামাকা বেজে উঠবে। তারপর রাধামন প্রশ্ন করে- ‘তাই যদি হয় দাদু তাহলে কি আমায় যুদ্ধে যেতে হবে?’

তার দাদু বলল- দেশে যদি যুদ্ধের ডাক এসে যায় তাহলে কি তুমি নীরব থাকতে পারবে? এভাবে সুখ দুঃখের স্বপ্ন দর্শন নিয়ে তারা সংসার শুরু করতে লাগল। আগের মত করে তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে এখনও শুভ কাজ করার আগে এরকম শুভ-অশুভ স্বপ্ন দর্শন চাওয়া হয়।

একদিন রাজসভা থেকে খবর এল  যুদ্ধে যেতে হবে। পার্শ্ববতী রাজা উদয়রাজ তার রাজ্যে পূর্ব দিকের জংলী কুকীরাজ কালঞ্জয়, দক্ষিণ দিকের রোয়াঙ্গের মঙ্গল্রাজা আর সমুদ্র কুলের জল দস্যুরা দিবালোকে এসে নরহত্যা নারী নির্যাতন করছে।

আজ তার রাজ্যবাসীরা গৃহহারা। তাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মিত্র চম্পক রাজার (উদয় গিরি) থেকে সাহায্য চেয়েছেন। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, এরই মধ্যে রাধামন যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে যুবরাজ বিজয়গিরির সেনাপতি হিসেবে যোগদান করেছেন।

একদনি বিজয়গিরি  রাধামনকে ডেকে বলল- শুন, প্রিয়সখা- উদয়পুর রাজ্য আজ দস্যু কবলিত, পিতা আমাকে সেখানে যাওয়ার জন্যে অনুরোধ করছে, তুমিও যাবে আমার সাথে সেনাপতি হিসেবে।

প্রতিউত্তরে রাধামন বলল- যুবরাজ, তুমি মম সখা, তুমি যা আদেশ করবে আমি তা পালন করতে বাধ্য। তিনি আরো বললেন- ‘বীরধর্ম্মো হলো বিপন্নকে প্রাণপনে রক্ষা করতে হবে যুদ্ধ করে’।

এইদিকে যুদ্ধের কথা শুনে ধনপতির মন অস্থির এবং চঞ্চল হয়ে উঠল, তবু সে কিন্তু তার স্বামীকে যুদ্ধে না যাওয়ার জন্যে অনুরধ করল না।

এখানে দেশপ্রেম ও পতিভক্তি সমতালে। তবু স্বামী বলে কথা, এই চিন্তা থেকে সে গভীর রাতে ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখে বলে-

                                              ‘শুন ওগো স্বামী! গভীর নিশীতে দেখেছি স্বপন

অতীব ভীষণ- কাঁপে ভয়ে মম প্রাণ,

সে স্বপ্ন স্মরি। ভাগ্যে মোর কিবা আছে জানি না।,

রাধামন বলল কি স্বপ্ন দেখেছ তুমি আমাকে খুলে বলো না, কি ভীষণ স্বপ করিলে দর্শন কেন ভয় পেলে মনে। ধনপতি বলল- ‘তাহলে শুনো মোর প্রাণনাথ!

                                          ‘গেরিয়া স্বপন ভীত মম প্রাণ, রহে যেন প্রলয় পবন,

কাপায়ে ধরণীতল, কক্ষচ্যুত তারকা মন্ডল,

 রাজদন্ড উড়ে মহাশূন্যে, তুমি নাই পাশে মম,

     তাই একাকীনি আমি, চেয়ে থাকি শূন্যপানে, বসে একা শূন্য ঘরে।,

ধনপতি আরো বলে স্বপ্ন দেখে রাত্রে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল তখন শুনলাম- নানা পশু-পাখি ডাকিতেছে।

পাখি ভীম্রাজ ডাকছে গগন বিদারী করুন স্বরে। আরো শুনলাম টিয়া পাখি ঝাক উড়ে যাচ্ছে, বিকট শব্দে বানর-বানরী ডাকছে, সশব্দে পালিয়ে যায় হরিণ-হরিণী।

ঘুঘু ডাকছে আম ডালে বসে। এমন নিশীত রাতে পশু-পক্ষী  দিশেহারা হয়ে কেন আর্ত্নাদ করছে। জিজ্ঞেস করে ধনপতি তার স্বামী রাধামন থেকে। রাধামন বলে দূর কর মনের গতি।

রাধামন বলে ত্রেতা যুগে সীতাকে উদ্ধারের জন্যে রাবণ এবং রামের মধ্যে যুদ্ধ হয় আর দ্বাপর যুগে কুরু ও পান্ডবে যখন যুদ্ধ হয় তখনও নিশীথে লোকে পশু-পক্ষীর দাক শুনেছে।

কই তখনতো কোনো অধর্মের জয় হয়নি, ন্যায় ধর্মের ও সত্যের জয় হয়েছে। তু,ই জেনে রেখো কোনো অমংগল হবে না আমাদের। বীরের রমণী তুমি, হাসি-মুখে আমাকে বিদায় দিতে হবে তোমাকে।

তুমি মনে রাখবে সতীর পতি হয় না পরাজয় কখনও। রাধামন আরো বলে- ‘কোনো চিন্তা তুমি করো না’ দেব ধর্ম থাকিবে সহায় আমাদের সাথে।

সত্য যদি হয় তুমি সতী নারী তাহলে শত্রুএ সাথে রণে আমি অবশ্যই জয়ী হবো।‘ ধনপতি বললো “তুমি অবশ্যই যুদ্ধে জয়ী হবে, আমি এই প্রার্থনা করি শ্রী ভগবান বুদ্ধের কাছে।”

ধনপতি আরো বলল- “তুমি  যেদিন জয়ী হয়ে ফিরবে সেদিন দুজনে মিলে বুদ্ধের চরণ তলে পুজা দেব, তা আমি মানস করে রাখবো।”

ধনপতি স্বামীকে বলে- “মিনতি তোমার চরণে তুমি দিগ্বিজয় হয়ে ফিরে আসবে, আমি তৃষিত হরিণীর মত তোমার পথের পানে চেয়ে থাকব।”

রাধামন বলে- “প্রাণেশ্বরী তুমি চিন্তা করোনা- রণ স্থলে সর্বক্ষেত্রে তোমার চাঁদ মুখখানি আমার অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।”

রাধামন একদিকে যুদ্ধে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে আর অন্যদিকে ধনপতির মন চঞ্চল হয়ে উঠছে তার স্বামীর জন্যে।

স্বামীর মংগল কামনার জন্য তার কত না মানস, কত না নানা আয়োজন। তারই অংশ হিসেবে সে তার স্বামীকে  যুদ্ধে যাত্রার আগে সতীত্ব-নিদর্শন হিসেবে নিজ হাতে বুনা একটি কোমড় বন্ধনী স্বামীকে উপহার দেয়।

যে কাপড়টি সে একদিনে সুতা কেটে একদিনের মধ্যে তৈরি করেছে। ধনপতি তার স্বামীকে বলে- এই কোমড় বন্ধনী পড়ে যুদ্ধ করলে তুমি অবশ্যই জয়ী হবে। রণ সম্মুখে শত্রু পরাজিত হবে।

ইতিহাসে জনশ্রুতি আছে রাধামন এই কোমড় বন্ধনী পড়ে যুদ্ধে জয়ী হয়। এখানে ইতিহাসের একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, তঞ্চঙ্গ্যা মেয়েরা যে পাঁচটি কাপড় পরিধান করেন (পিনোন, খাদি, সালুম, মাদা কাবং, পা-দুরি) তার মধ্যে পা-দুরি (কোমড় বন্ধনী) অন্যতম।

  এই পা দুরিই হচ্ছে ধনপতির সতীত্ব নিদর্শন কোমড় বন্ধনী।  এই কোমড় বন্ধনীর বিশেষত্ব হচ্ছে পরনের কাপড়কে শক্ত করে আটকে রাখা যেন কোনভাবে খুলে না যায়।

যে কাজটি তঞ্চঙ্গ্যা মেয়েরা তাদের পরনের কাপড় পিনন পড়ার সময় করে  থাকে। যে কাপড়টি অন্য কোন আদিবাসি সম্প্রদায় বা মেয়েরা পড়ে না।

সে জন্য ধনপতির কোমড় বন্ধনীর সাথে তঞ্চঙ্গ্যা মেয়েদের পরিধেয় বস্ত্র ‘পা-দুরি’র একটা ঐতিহাসিক যোগসূত্র আমরা লক্ষ্য করি।

তাছাড়া ব্যক্তি রাধামন-ধনপতির  মাঝে তঞ্চঙ্গ্যা জাতি তাদের ইতিহাসের সুখ স্মৃতি অনুভব করে। যেটি ইতিহাসের পাঠ্য বা গবেষণার বিষয় হতে পারে।

উপসংহার

রাধামন-ধনপতির মত আরো অন্যান্য যে আদিবাসী পৌরাণিক সাহিত্য বা পালা সাহিত্য রয়েছে সেগুলো যদি যত্ন নেওয়া হয় তাহলে সাহিত্য প্রেমীদের পাশাপাশি বাংলাদেশী সাহিত্য উপকৃত বা সমৃদ্ধ হবে।

কারণ বলছি সাহিত্যরস আস্বাদনে  এখনও অবহেলায় অযত্নে পড়ে আছে সবার গগোচরে। এগুলিকে তুলে এনে যত্ন করতে হবে রত্ন পাওয়ার জন্য। তখন আদিবাসী সাহিত্যের পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যও নতুন মাত্রা বা প্রাণ পাবে।

তথ্যসূত্র:

১। শ্রী কার্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, রাধামন ধনপতি কাব্য।

২। শ্রী কার্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, বিজয়গিরি (নাটক)


লেখক: কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা, জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা, কাপ্তাই, রাংগামাটি।

আমার ভাষায় আমার  সাহিত্য, দ্বিতীয় পার্বত্য চট্টগ্রাম আদিবাসী লেখক সম্মেলন ২০১৬

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা