পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বিরোধ প্রসঙ্গে

Jumjournal
Last updated Jul 30th, 2020

3166

featured image

 ভূমিকা

পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যসহ এই অঞ্চলের ভাষিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনাচার পদ্ধতি ও ধরণ বাংলাদেশের অপরাপর অঞ্চলের ভূ-গঠন প্রকৃতি ও অধিবাসীদের আচরিত জীবন ব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর। ভিন্ন এই অঞ্চলের সমাজ, অর্থনীতি ও প্রশাসনিক কাঠামো। ভূমি ব্যবস্থাপনায়ও রয়েছে মৌলিক পার্থক্য।

সুনিদির্ষ্টভাবে যদি বলি, ১৯৪৭ এর পর থেকে পার্বত্য অঞ্চল শাসনের জন্য সমতল ও পাহাড়ের এই সমস্ত মৌলিক স্বাতন্ত্র্যের ক্ষেত্রগুলোকে বিবেচনায় না এনে শাসকগোষ্ঠী কতৃর্ক ধারাবাহিকভাবে সমগ্র দেশের জন্য শাসনের অভিন্ন মানদন্ড প্রয়োগের প্রবণতার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম ১৯০০ শাসন বিধি নামক বিশেষ আইনের উপস্থিতি সত্ত্বেও এখানকার জনগোষ্ঠীর ব্যাপক অশিক্ষা ও অসচেতনতার কারণে এই পার্বত্য ভূ-খন্ডের আদিবাসীরা ব্যাপক ও ক্রমাগত বঞ্চনার শিকার হয়েছে।

পুরুষানুক্রমে ভোগ করে আসা ভূমি থেকে বিপুল সংখ্যায় উৎখাত হয়েছে, সে প্রক্রিয়া এখনও অব্যাহত আছে। সমস্যার অপনোদনে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে অথচ আদিবাসীদের ভূমি বিছিন্নতা হ্রাস না পেয়ে বরঞ্চ আরও গতিবেগ পেয়েছে।

এটি একটি অবাক হওয়ার মতো ঘটনা। মূলতঃ পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসন সংক্রান্ত ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে অস্বীকার করার কারণেই এই অবাঞ্চিত ও অনাকাঙ্খিত বিরোধ এবং সমস্যাদির উদ্ভব ঘটেছে। এই ঐতিহাসিক সত্যের অস্বীকৃতি বিদ্যমান সমস্যাকে শুধু নিবিড় করেছে। এখন সময় দাবী করছে অনভিপ্রেত জট খুলে যাক, মিথ্যা নির্বাসনে যাক, সত্য প্রকাশিত হোক।

 পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন ব্যবস্থার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে (নোটিফিকেশন নং: ৩৩০২) পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি পূর্ণাঙ্গ জেলা হিসেবে বৃটিশ ভারত সাম্রাজ্যভূক্ত হলে এই অঞ্চলের ভৌগলিক স্বাতন্ত্র্য, অধিবাসীদের স্বতন্ত্র ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো ও জীবনধারা লক্ষ্য করে বৃটিশ সরকার সমতল এলাকার জেলাসমূহের জন্য প্রণীত আইন পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রয়োগ না করে এই এলাকার শাসনের জন্য বিশেষ আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।

বৃটিশ সরকারের উক্ত উপলদ্ধিবোধ থেকে বিভিন্ন সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসন পরিচালনার জন্য নিম্নলিখিত আইনসমূহ প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা হয়।

ক. একটি স্বতন্ত্র জেলা হিসেবে আনুষ্ঠানিক যাত্রার পর ১৮৬০ সালের Frontier Tribes Act no. 22 ও ১৮৬৩ সালের ৪নং আইনের আওতায় পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসিত হতে থাকে। শাসনবর্হিভূত এলাকাসমূহ (Non-Regulated Tracts) শাসনের সুবিধার্থে ১৮৬১ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারতীয় পরিষদ আইন (Indian Council Act) পাশ করে শাসন বর্হিভূত এলাকা শাসনের জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক জারিকৃত বিধি/নির্দেশগুলোকে সমর্থন দেয়।

পরবর্তীতে ১৮৭০ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভারত শাসন আইন বা Government of India Act (Administration of the Backward Tracts), ১৮৭০ পাশ করে ব্রিটিশ ভারতের Governor General-in-Council-কে শাসন বর্হিভূত বিশেষ এলাকাসমূহের শাসনের জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষের তৈরী করা বিধি/নির্দেশসমূহকে অনুমোদন দেওয়ার ক্ষমতা অর্পণ করা হয়।

খ. বস্তুত, ১৮৬১ সালের ভারতীয় পরিষদ আইন ও ১৮৭০ সালের ভারত শাসন আইনের চেতনাকে ধারণ করে ১৮৭৩ সালে Inner Regulation Line (Act No-III) জারি করে পার্বত্য চট্টগ্রামে বহিরাগতদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা হয় এবং ১৮৭৪ সালে Scheduled District Act (Act No XIV) প্রণয়নের মাধ্যমে ব্রিটিশ ভারতের ৩৫টি বিশেষ অঞ্চলের (আদিবাসী অধ্যুষিত/অনগ্রসর/দুর্গম পার্বত্যঞ্চল) একটি তালিকা করে তালিকাভুক্ত প্রতিটি অঞ্চলকে জেলায় রূপান্তর করা হয়।

এই তালিকায় পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্রমিক অবস্থান ছিল ৭। ১৮৭৪ সালের এই আইনের দ্বারা তফসিলীভুক্ত জেলাসমূহে পৃথক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনসহ আদিবাসীদের ভূমি অধিকার ও সীমিত স্বশাসন নিশ্চিত করা হয়।

৩৫টি বিশেষ অঞ্চল হল: ১। আসাম, ২। আজমীর মাড়ওয়া, ৩। কুর্গ, ৪। আন্ডামান দ্বীপকুঞ্জ, ৫। জলপাইগুড়ি, ৬। দার্জিলিং, ৭। পার্বত্য চট্টগ্রাম, ৮। সাওতাল পরগনা, ৯। ছোট নাগপুর, ১০। আঙ্গুল মহল, ১১। এডেন, ১২। সিন্দুপ্রদেশ, ১৩। পাঁচ মহল, ১৪। পশ্চিম খানদেশ এরমেওয়াসি সরদারদের তালুক সমূহ, ১৫। চান্দা জমিদারি অঞ্চল, ১৬। চত্রিশ গড় জমিদারি অঞ্চল, ১৭। চিন্দোয়ারা জায়গীরদারী অঞ্চল, ১৮। গঞ্জমের চেীদ্দটি মারিয়া, ১৯। ভিশাখা পট্টমের নয়টি মালিয়া, ২০। গোদাভরির কতকগুলো অংশ, ২১। লাকখা দ্বীপকুঞ্জ, ২২। হাঁজার, ২৩। পেশোয়ার, ২৪। কোহাট, ২৫। বান্নু, ২৬। ডেড়া ইসমাইল, ২৭। লহৌল ও স্পিতি, ২৯। ঝাঁসি বিভাগ, ৩০। কুমায়ুন ও গাড়োয়াল, ৩১। তরাই পরগনা, ৩২। মির্জাপুর জেলার ৪টি পরগনা, ৩৩। বারাণসী মহারাজার পারিবারিক বসতি অঞ্চলসমূহ, ৩৪। দেরাদুন জেলার জওনসার-বাওয়ার এবং ৩৫। মণিপুর পরগণা।

গ. পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন ব্যবস্থার বিশেষত্বের বিবেচনায় শুধুমাত্র আদিবাসীদের নিয়ে একটি পুলিশ বাহিনী গঠনের উদ্দেশ্যে ১৮৮১ সালে The Chittagong Hill Tracts Frontier Police Regulation III প্রণয়ন করে স্থানীয় আদিবাসীদের সমন্বয়ে একটি স্বতন্ত্র পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলা হয়। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে ১৯৪৮ সালে এই বাহিনী ভেঙ্গে দেয়া হয়।

ঘ. ১৮৮৪ সালে ব্রিটিশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসন ও রাজস্ব সংগ্রহের সুবিধার্থে Rules for Administration of Circles in the Chittagong Hill Tracts জারির মাধ্যমে চাকমা সার্কেলকে দ্বিখন্ডিত করে চাকমা ও মং সার্কেল এবং বোমাং সার্কেলকে নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে মোট ৩টি সার্কেল সৃষ্টি করা হয়।

ঙ. ১৮৯২ সালে এই আইনের আংশিক সংশোধনের মাধ্যমে Rules for Administration of Circles in the Chittagong Hill Tracts প্রণয়ন করে বিদ্যামান ৩টি সার্কেল ছাড়া ফরেষ্ট সার্কেল নামে নতুন ১টি সার্কেলসহ মোট ৪টি সার্কেল সৃষ্টি করে।

রির্জাভ ফরেষ্ট সার্কেলকে ব্রিটিশ সরকারের বনবিভাগের নিয়ন্ত্রণে রেখে অপর ৩টি সার্কেলের আওতাধীন সকল ভূমি ডেপুটি কমিশনারের সভাপতিত্বে রাজা ও হেডম্যান কর্তৃক সরাসরি পরিচালনা করা হতো।

এছাড়া ১৮৯২ সালে জারিকৃত উপরোক্ত আইনের দ্বারা পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা ও রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে মৌজা সৃষ্টি করা হয়। (দুই বর্গ‌মাইলের কম নয় ও দশ বর্গমাইলের বেশি নয় এমন এলাকা নিয়ে একটি মৌজা গঠিত)।

Rules for Administration of Circles in the Chittagong Hill Tracts, ১৯৮২ অনুসারে –

১. মৌজার হেডম্যান রাজার নিয়ন্ত্রণাধীনে থেকে মৌজাস্থ সকল জমির ব্যবস্থাপনার, খাজনা আদায়সহ মৌজার শান্তি শৃঙ্খলার দেখভাল করেন।

২. হেডম্যান চাষযোগ্য জমির খাজনা আট ভাগের ১ অংশ ও রাজা ১৬ ভাগের এক অংশ পাবেন। তদুপরি হেডম্যান তার মৌজার অন্তর্গত ৫০ একর পর্যন্ত জমি বিনা খাজনায় নিজের ভোগ দখলে রাখতে পারেন।

৩. ১৮৭০ থেকে ১৮৯২ সন অবধি পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল শাসনের জন্য যেসকল আইন প্রণীত হয়েছে সেসকল আইনের একটি সমন্বিত ও বিস্তৃত রূপ হিসেবে ১৯০০ সালে The Chittagong Hill Tracts Regulation ১৯০০ (I of ১৯০০) জারি করা হয়। তদবধি এই আইন পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসন ব্যবস্থার মূল আইনি উৎস হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে।

এ আইনে মোট ২০টি ধারা আছে এবং ১৮ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতা বলে মোট ৫৪টি বিধি প্রণীত হয়েছে। ১৯০০ সালের শাসনবিধিতে শান্তি রক্ষা, অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণ, ফৌজদারি ও দেওয়ানি বিচার ব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয় ব্রিটিশ শাসকেরা তাঁদের এখতিয়ারে রেখে ভূমি ব্যবস্থাপনা ও রাজস্ব আদায়ের কর্তৃত্ব প্রথাগত নেতৃত্ব রাজা, হেডম্যান, কার্বারির উপর ছেড়ে দেয়া হয়। শুধু তাই নয় আদিবাসীদের রীতি প্রথা পদ্ধতি, সামাজিক বিচার ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রথাগত নেতৃত্ব সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিলেন এবং ব্রিটিশ শাসকেরা এসব ক্ষেত্রে কখনোই কোন ধরণের হস্তক্ষেপ করতেন না।

এছাড়াও ১৯০০ সালের শাসনবিধিতে একটি তফসিলও সংযুক্ত করা আছে যেখানে সমতল জেলায় প্রযোজ্য আইন সমূহের কোন কোন ধারা অথবা এ ধারা সমূহের কি পরিমাণ বা কতটুকু পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য হবে বা হবে না তার উল্লেখ আছে।

চ. ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনে জারি হলে ঐ আইন মূলে ১৮৭৪ সালের তফসিলভুক্ত জেলা তালিকা সংশোধন করে Backward Tract বা অনগ্রসর অঞ্চল নাম দিয়ে একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়। এ তালিকায় মোট ১৯টি অঞ্চল অন্তর্ভূক্ত হয় এবং এ তালিকায় পার্বত্য চট্টগ্রাম ২নং ক্রমিক স্থান পায়।

ছ. ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে পার্বত্য চট্টগ্রামকে Totally Excluded Area বা “সম্পূর্ণ শাসন বর্হিভূত অঞ্চল” হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। উল্লেখ্য যে, ১৮৭০ থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ভারতের অনুন্নত ও অনগ্রসর অঞ্চলের জন্য যে সমস্ত আইন প্রণীত হয় তাতে তৎকালীন ভারতীয় আদিবাসীদের ভূমি অধিকারসহ তাঁদের জাতিসত্ত্বার অস্তিত্ব রক্ষা ও পরিচয়ের সংকট মোচন সহায়ক ছিল।

শাসন বর্হিভূত অঞ্চল:

ব্রিটিশ ভারতে দু’ধরণের শাসন বর্হিভূত অঞ্চলের অস্তিত্ত্ব আছে:
১। সম্পূর্ণভাবে শাসন বর্হিভূত অঞ্চল (Totally Excluded Area)
২। আংশিক শাসন বর্হিভূত অঞ্চল (Partially Excluded Area)

সম্পূর্ণ শাসন বর্হিভূত অঞ্চলসমূহ স্বপরিষদ গভর্নর জেনারেলের অধীনে তাঁর প্রতিনিধি প্রাদেশিক গভর্নরদের দ্বারা শাসিত হয়। পক্ষান্তরে, আংশিক শাসন বর্হিভূত অঞ্চসমূহের ক্ষেত্রে প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার সঙ্গে পরামর্শ করে আংশিক শাসন বর্হিভূত অঞ্চল শাসন করেন।

উল্লেখ্য যে, আংশিক শাসন বর্হিভূত অঞ্চল প্রাদেশিক আইন সভায় প্রতিনিধি প্রেরণ করে থাকে। কিন্তু সম্পূর্ণ শাসন বর্হিভূত এলাকা থেকে প্রাদেশিক আইন সভায় কোন প্রতিনিধি প্রেরণ করা হয় না।

১৯২৯ সালে সাইমন কমিশন ৪টি সম্পূর্ণ শাসন বর্হিভূত অঞ্চল ও ১১টি আংশিক শাসন বর্হিভূত অঞ্চলের একটি তালিকা তৈরী করে। ৪টি সম্পূর্ণ শাসন বর্হিভূত অঞ্চলের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি। অন্য ৩টি হল: উত্তর পূর্ব সীমান্ত অঞ্চল (সদিয়া, বলিপাড়া ও লখিমপুর), নাগা হিল ডিষ্ট্রিক্ট ও লুসাই হিল। পরবর্তীতে এই তালিকায় আংশিক শাসন বর্হিভূত অঞ্চলের একটি তালিকা চূড়ান্ত করে অনুমোদন করা হয়। সংশোধিত এই তালিকাতেও সম্পূর্ণ‌ শাসন বর্হিভূত অঞ্চল হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম অন্তভূক্ত ছিল।]

জ. ১৯৫৬ সালে গৃহীত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রামের “শাসন বর্হিভূত অঞ্চল” এর মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখা হয়। কিন্তু, ১৯৬২ সালে রচিত পাকিস্তানের দ্বিতীয় সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রামকে “উপজাতীয় অঞ্চল” হিসেবে দেখানো হয়।

ঝ. ১৯৬৩ সালের শেষদিকে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে (পার্লামেন্ট) পার্বত্য আদিবাসীদের ভূমির অধিকার ক্ষুণ্ণ করার উদ্দেশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় এলাকার মর্যাদা রহিত করে একটি প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে আদিবাসী নেতৃবৃন্দের দাবীর মুখে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার এক নির্বাহী আদেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম ১৯০০ সালের শাসনবিধি পুনর্বহাল করেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের Tribal Area মর্যাদা বিলুপ্ত করে পাশকৃত আইনটি স্থগিত রাখা হয়।

ঞ. ১৯৭২ সালে প্রণীত ও গৃহীত বাংলাদেশের সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য আলাদা কোন শাসনতান্ত্রিক মর্যাদা কিংবা কোন ধরণের রক্ষাকবচ অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি। তবে প্রচলিত আইন বিভিন্ন সময়ের অনেকগুলো সংশোধনী সমেত (যা পার্বত্য আদিবাসীদের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করেছে) পার্বত্য ১৯০০ শাসন বহাল রাখা হয়েছে।

 পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি মালিকানা

পার্বত্য চট্টগ্রামে দু’ধরণের ভূমি মালিকানার চর্চা রয়েছে –
ক. প্রথাগত মালিকানা/অধিকার।
খ. প্রচলিত আইন স্বীকৃত মালিকানা।

ক. প্রথাগত মালিকানা/অধিকারঃ
একে সমষ্টিগত মালিকানাও বলা হয়। এই প্রথা অনুসারে ভূমির উপর কিংবা সম্পদের উপর ব্যক্তির মালিকানা প্রতিষ্ঠা পায় না কিংবা স্বীকার করা হয় না। যেমনঃ জুম ভূমি, মৌজাস্থ বন, শ্মশান, পাড়াবাসী কর্তৃক উপাস্য কোন স্থান/বস্তু (গাছ, পাহাড়, জলাশয় ইত্যাদি)। সাধারণত পাঁচ বছরের মধ্যে এক জুমচাষী কখনই অপর এক জুম চাষীর জুমভূমি দখল করে না যদিও পতিত থাকা অবস্থায় পাড়াবাসীদের যে কেউ জুম ভূমি থেকে বনজ দ্রব্য আহরণ করতে পারে। তদুপরি, প্রথাগতভাবে কোন ধানী জমির মালিক তার জমির পার্শ্ববর্তী পাহাড়ের একটি নির্দিষ্ট অংশের মালিকানা ভোগ করে। কেউ এখানে বাগড়া দিতে আসে না। একজনের ভোগ দখলীয় জমির উপর কেউ দখল কায়েম করে না।

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫২ ধারায় প্রথাকে আইন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছেঃ

পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র অনুযায়ী কোন উপজাতীয় অঞ্চলের সাংবিধানিক মর্যাদা পরিবর্তন/রহিত করতে হলে ঐ অঞ্চলের জনগণের মতামত নেয়া রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় অঞ্চলের মর্যাদা রহিত করার সময় তা অনুসরণ কর হয়নি।

আইন অর্থ কোন আইন, অধ্যাদেশ, আদেশ, বিধি, প্রবিধান, উপ-আইন, বিজ্ঞপ্তি অন্যান্য আইনগত দলিল এবং বাংলাদেশের আইনের ক্ষমতা সম্পন্ন যে কোন প্রথা বা রীতি।

পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের এইসব প্রথাগত অধিকার ১৯০০ শাসন বিধিতে কোন না কোন ভাবে স্বীকৃত আছে। যেমন:
– ভূমি বন্দোবস্তী পাওয়ার ক্ষেত্রে হেডম্যানের সুপারিশ/মতামত গ্রহণ (৩৪ ধারা)
– রাজা ও হেডম্যান কর্তৃক জমি ও জুমের খাজনা আদায় (৪২ ও ৪৩ ধারা)
– রাজা ও হেডম্যান কর্তৃক সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা ও সামাজিক বিচারকার্য সম্পাদন (৪০ ধারা)
– পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক প্রশাসন পরিচালনায় জেলা প্রশাসন কর্তৃক রাজার পরামর্শ গ্রহণ (৩৯ ধারা)
– হেডম্যান কর্তৃক প্রাকৃতিক ও বনজ সম্পদ রক্ষণ (৪১ ধারা) ইত্যাদি।

খ. প্রচলিত আইন–স্বীকৃত মালিকানাঃ
পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রচলিত আইন সমূহের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম ১৯০০ শাসন বিধি, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি অধিগ্রহণ আইন ১৯৫৮, জেলা পরিষদসমূহ আইন ১৯৮৯ (সংশোধিত) আঞ্চলিক পরিষদ আইন ১৯৯৮, পার্বত্য চুক্তি ১৯৯৭ অন্যতম।

পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৯০০ শাসন বিধিতে উদ্দেশ্য প্রণোদিত সংশোধন:

১৯৯৭ সালে পার্বত্য শাসন বিধি ৩৪ ধারায় আমূল সংশোধন আনার পূর্ব পর্যন্ত এই ধারাতে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের ভূমি অধিকার মোটামুটি স্বীকৃত ছিল। কিন্তু ১৯৬১ সালের তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার ৩৪ বিধিতে সংশোধন এনে আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত ভূমি অধিকারের উপর সর্বপ্রথম আঘাত হানে।

১৯৬৫ সালে ১৯০০ শাসনবিধির ৫১ ধারাকে পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্ট অসাংবিধানিক ঘোষণা করলে পার্বত্য চট্টগ্রাম বহিরাগতদের স্থায়ী বসবাসের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। আবারও ১৯৭১ সালে ১৯০০ শাসনবিধিতে সংশোধনী আনা হয়। এ সময় ৪৩ বিধিকে সংশোধন করা হয় ও ৪৪ বিধিকে বাতিল করে দেয়।

১৯৭৯ সালে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ১৯০০ শাসনবিধির ৩৪ বিধিতে আবারও সংশোধনী এনে বিধির মূল স্পিরিটকেই ধ্বংস করে দেয়া হয়। এইভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসনবিধিতে (১৯০০ শাসনবিধি) বার বার সংশোধন এনে বাঙালি বসতি স্থাপনকে বৈধতা দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী অঞ্চলের চরিত্রকে আমূল বদলে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

পাবর্ত্য জেলা পরিষদসমূহ আইন ১৯৮৯ (সংশোধিত), পার্বত্য চুক্তি, ১৯৯৭

পার্বত্য চুক্তির “ক” খন্ডের সাধারন অংশের ধারা ১ এ বলা হয়েছে: উভয় পক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে “উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল” হিসেবে এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করিয়াছেন;

১৯৮৯ সালের জেলা পরিষদ আইনের (সংশোধিত) প্রস্তাবনায়ও পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলাকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ যদি করতে হয় তাহলে অবশ্যই সরকারকে প্রধানত ও প্রথমত এই একটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে, “আদিবাসীদের ভূমি অধিকার সুরক্ষিত আছে”।

অন্যথায় আদিবাসীরা অ-আদিবাসীদের ক্রমবর্ধমান অগ্রাভিযান/আগমনের মুখে ভূমি হারিয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়ে একসময় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে যেমনটি অতীতে ঘটেছে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে অনেক আদিবাসীর ক্ষেত্রেে চুক্তির ‘খ’ খন্ডের ২৬ ধারা ও পাবৃত্য জেলা পরিষদসমূহ আইন ১৯৮৯ (সংশোধিত) এর ৬৪ ধারা অনুসারে:

আপাততঃ বলবৎ অন্য কোন আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন,
– পার্বত্য জেলার এলাকাধীন বন্দোবস্তোযোগ্য খাস জমিসহ কোন জায়গা জমি পরিষদের অনুমোদন ব্যতিরেকে ইজারা প্রদানসহ বন্দোবস্ত, ক্রয়-বিক্রয় ও হস্তান্তর করা যাইবে না।
– পার্বত্য জেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণ ও আওতাধীন কোন প্রকারের জমি পাহাড় ও বনাঞ্চল পরিষদের সাথে আলোচনা ও ইহার সম্মতি ব্যতিরেকে সরকার কর্তৃক অধিগ্রহণ ও হস্তান্তর করা যাইবে না।
– কাপ্তাই হ্রদের জলে ভাসা জমি অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে জমির মূল মালিকদের বন্দোবস্ত দেওয়া হইবে।

যেহেতু এই বিধিসমূহ এখনও অপরীক্ষিত কিংবা অচর্চিত রয়ে গেছে তাই এগুলো কতখানি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি অধিকার সংরক্ষণে কার্যকর হবে তা বলার সময় এখনও আসেনি।

পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি থেকে উচ্ছেদ প্রক্রিয়া ও তার প্রেক্ষাপট

পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের ভূমি অধিকার কেড়ে নেওয়ার ঘটনা সর্বপ্রথম ঘটে ১৮৭০ সালে যখন পার্বত্য চট্টগ্রামের এক চর্তুথাংশ এলাকায় সংরক্ষিত বনাঞ্চল সৃষ্টি করে সেখানে বসবাস, চাষাবাদ অবৈধ ও সেখান থেকে বনজ দ্রব্য আহরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

১৯০০ শাসন বিধিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে বহিরাগতদের জমির মালিকানা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ১৯৪৮ সালে ভারত থেকে আগত অনেক মুসলমান বাঙালী রিফিউজী পরিবারকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুর্নবাসন করা শুরু হয়। কিন্তু আদিবাসী নেতৃবৃন্দের প্রতিবাদের মুখে তা স্থগিত করা হলেও পুনর্বাসিত লোকদের আর ফেরত নেওয়া হয়নি।

১৯৫৪ সালে আবারও তৎকালীন লামা থানায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাঙ্গালী পরিবারদের এনে বসতি করানো হয়।

১৯৬০ সালে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে উর্বর ৫৪ হাজার একর জমি (মোট চাষযোগ্য জমির ৪০%) পানির নীচে তলিয়ে যায়। বাস্তুহারা হয় ১ লক্ষেরও বেশী মানুষ।

কথা ছিল জমির বদলে জমি দেওয়া হবে। কিন্তু কাসালং রির্জাভের একাংশ উন্মুক্ত করে দেয়ার পরও জমি পাওয়া গেল মাত্র ২০,০০০ একর, তাও নিম্নমানের। এই পরিমাণ জমি দিয়ে নিমজ্জিত জমির মাত্র এক-তৃতীয়াংশ প্রতিস্থাপন করা গেছে।

ক্ষতিপূরণের জন্য নির্ধারিত ৫১ মিলিয়ন ডলার নির্ধারিত থাকলেও মাত্র ২.৬ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণে ব্যয় করা হয়েছে। ফলে হতাশায়, ক্ষোভে আর দুঃখে দিশাহারা হয়ে মারিশ্যা পুনর্বাসন এলাকা থেকে আনুমানিক আঠারশ’ পরিবার ১৯৬৪ সালে ভারতে পাড়ি জমায় যারা এখন অরুণাচল প্রদেশে রাষ্ট্রহীন নাগরিক হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে।

অথচ স্থানীয় উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান না করে ১৯৬৪ সালে আবারও ফেণী ও কাসালং উপত্যকায় কয়েকশত বাঙ্গালী পরিবারকে এনে পুনর্বাসিত করা হয়।

স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধে পাহাড়িদের অসহযোগীতার অজুহাতে মুক্তিবাহিনীর একটি অংশ কর্তৃক খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি এলাকায় পাহাড়ি হত্যার ঘটনায় সৃষ্ট অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সুযোগে ঐ একই জেলার অন্তর্গত তবলছড়ি এলাকার আশেপাশের মৌজাগুলোতে কয়েক হাজার বাঙালী রাষ্ট্রশক্তির পরোক্ষ সমর্থনে বসতি স্থাপন করেন।

সবচেয়ে চরম ও অপরিণামদর্শী পদক্ষেপ গৃহীত হয় ১৯৭৯ সালে। সরকার এক গোপন সার্কুলারের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় ৪ লক্ষাধিক দরিদ্র বাঙালীদের পার্বত্য চট্টগ্রামে এনে জমির মালিকানা দিয়ে পুনর্বাসিত করেন।

যেখানে চাষযোগ্য জমির অভাবে কাপ্তাই বাঁধে ক্ষতিগ্রস্থ জুমিয়া উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন সম্ভব হয়নি, সেখানে এই ৪ লক্ষাধিক দরিদ্র বাঙালীদের পার্বত্য চট্টগ্রামে এনে জমির মালিকানা দিয়ে বসিয়ে দেয়।

যেখানে চাষযোগ্য জমির অভাবে কাপ্তাই বাঁধে ক্ষতিপ্রস্থ বাস্তুহারা পরিবারদের পুনর্বাসন করা যায়নি, সেখানে এই ৪ লক্ষ বাঙালীর ঠাঁই কোথায় হবে? সুতরাং বাস্তবে যা ঘটলো আদিবাসীদের রের্কডকৃত কিংবা দখলে থাকা জমিতে এদের বসিয়ে দেয়া হল কিংবা এরা জোর করে বসে গেল। সেই যে আদিবাসীরা ভূমি হারাতে শুরু করলো তা আজও অব্যাহত রয়েছে।

সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও অর্থায়নে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিপুল সংখ্যক দরিদ্র সমতলবাসীদের বসতি স্থাপনের ফলে ক্রমবর্ধমান ভূমি সংকটের মূখে আবারও নতুন সংরক্ষিত বনাঞ্চল সৃষ্টির নামে প্রায় ২ লক্ষ ১৮ হাজার একর জমি অধিগ্রহণের নোটিশ জারি হয়েছে।

সেনাবাহিনীর ব্যবহারের জন্য আদিবাসীদের সমষ্টিগত জুম ও বনভূমির প্রায় ৭৬ হাজার একর শিল্প স্থাপনে ও বাণিজ্যিক বনায়নের জন্য ৪৬ হাজার একর, ইকোপার্ক নির্মাণের জন্য ৫৬০০ একর, গেম স্যাংচুয়ারি প্রতিষ্ঠার জন্য ৫৫০০ একর অধিগ্রহণ করা হয়েছে কিংবা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এগুলোর কোনটাই চলামান সংকটকে প্রশমিত না করে ঘনীভূত করতেই যথেষ্ট।

পার্বত্য চট্টগ্রামে মোট জমির পরিমাণ ৩২,৫৭,০৯১ একর যা অধিকাংশই উঁচু, খাড়া পাহাড় (প্রায় ৭৪%)। মাত্র ৩.১% জমি লাঙ্গল চাষের উপযোগী, অবশিষ্টাংশের কিছু অংশ (প্রায় ২৩%) ধাপ-চাষ ও ফলজ বাগানের উপযোগী কিন্ত সিংহভাগ অংশে (৭২.৯%) কেবল বনায়নই সম্ভব।

সংরক্ষিত ও রক্ষিত বনাঞ্চলে জমির পরিমাণ ৯,৯২,৪০৭.১৬ একর। হ্রদ, নদী-নালা মিলে মোট ২,০৫,৫৯১ একর। অতএব, কৃষিজমি, ঢালু জমি, উদ্যান চাষের উপযোগী জমি, বনায়নের উপযোগী জমি, বন-বাগান উপযোগী জমি ও বাস্তভিটার জন্য থাকল ১৭,০৬৯৪২.৮৪ একর ২০০১ এর আদমশুমারী অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংখ্যা ১৪ লক্ষের মত।

সেই হিসেবে গড়ে মাথাপিছু জমির পরিমাণ দাঁড়ায় ১.২১ একর। আর যদি কেবলমাত্র আদিবাসী ও স্থায়ী বাঙালীর জনসংখ্যা ৯ লক্ষ ধরা হয় তাহলে গড় মাথাপিছু জমির পরিমাণ দাঁড়াবে ১.৮২ একর এতে ফসল উপযোগী জমির পরিমাণ আছে মাত্র ০.১৬ একর। অবশিষ্টাংশ শস্য চাষের অনুপোযোগী।

একটি হিসাবে দেখা যায় ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি জুমিয়া পরিবারের সারা বছরের খাদ্যের চাহিদা মেটানোর জন্য বর্তমানে বিদ্যমান পাহাড়ি ভূমির উর্বরতার নিরিখে (প্রতি একরে ৩৬০ কেজি ধান; জুমিয়া পরিবার থেকে প্রাপ্ত তথ্য) নিদেনপক্ষে ৭-৮ একর জুম ভূমির প্রয়োজন।

প্রদত্ত তথ্য থেকে এটি নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে অঢেল জমি পড়ে থাকার গল্প কল্পকাহিনী ছাড়া আর কিছুই নয়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে জন-স্থানান্তরের নীতিকে কার্যকর করার উদ্দেশ্যেই এই কল্পকাহিনীর অবতারণা করা হয়েছে। বস্তুত, এখানে জন-স্থানান্তরের কোন সুযোগই নেই।

তা সত্ত্বেও কেবলমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে এখানে বহিরাগত পুনর্বাসনের নীতি গ্রহণের ফলে আদিবাসীরা ক্রমশ ভূমি হারিয়ে তাদের অস্তিত্ব নিয়ে সংকটের মুখে পড়েছে।

যে ভ্রান্ত ও প্রশ্নবিদ্ধ নীতির কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে সেই নীতি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে থামিয়ে না দিয়ে এখনও চালু রাখা রীতিমত বেদনাদায়ক ও হতাশাব্যঞ্জক।

এর সত্যতা ডিসেম্বর ২০০৯ সালে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসন কর্তৃক প্রকাশিত একটি পুস্তিকার (খাগড়াছড়ি জেলা পর্যটন গাইড) উদ্ধৃতিতেও স্পষ্ট হয়েছে – “১লা মে ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দ তারিখে ব্রিটিশ সরকার Chittagong Hill Tracts Regulation ১৯০০ নামে আরও একটি প্রবিধান জারি করে।

উক্ত প্রবিধানমূলে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন পার্বত্য জেলা শাসিত হয়ে আসছে,  যাতে অন্য জেলা থেকে আগত অ-আদিবাসীদের  এ জেলায় জমি বন্দোবস্ত পাবার ব্যাপারে বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়েছিল।

তৎকালীন সরকার কর্তৃক এ এলাকায় বাঙ্গালী ও আদিবাসীদের মধ্যে জনসংখ্যার ভারসাম্য আনয়নের প্রচেষ্টায় উক্ত বিধির ব্যাপক সংশোধনের মাধ্যমে অ-আদিবাসীদের এ অঞ্চলে জমির মালিকানা লাভের পথ সুগম করে দেওয়াসহ বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হলে সংশ্লিষ্ট আদিবাসীদের সাথে বিরোধ সৃষ্টি হয়।

স্বাধীনতা-উত্তর বিভিন্ন সময়ে সরকার আদিবাসী ও অ-আদিবাসীদের মধ্যে জনসংখ্যা সংক্রান্ত ভারসাম্য আনয়নের কার্যক্রমও বর্তমানে সীমিত আকারে অব্যাহত আছে।

উপসংহার

১৯১৮ সালে যখন পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংখ্যা মাত্র ২ লক্ষ তখনও ব্রিটিশ সরকার পার্বত্য অঞ্চলের ভূমির দুষ্প্রাপ্যতার বিষয়টি মাথায় রেখে এতদঞ্চলে বহিরাগতের প্রবেশে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিলেন।

কিন্তু ১৯৪৭ পরবর্তী সরকারসমূহের স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও তাদের সমস্যার প্রতি অসংবেদনশীলতা অত্র অঞ্চলে অভাবিতপূর্ণ ভূমি বিরোধ ও গোষ্ঠী সংঘাতের পথকে অবারিত করেছে।

এজন্য অতীতে অনুসৃত পার্বত্য চট্টগ্রামে কেন্দ্রিক ভ্রান্ত নীতিসমূহ প্রত্যাহৃত না হলে এই অঞ্চলে বিদ্যমান সমস্যা ইতি কিছুতেই টানা যাবে না, বোদ্ধা ব্যক্তিদের অনেকেই এমনটাই মনে করেন।

সুতরাং আর কোন অহেতুক বিতর্ক নয়, স্থায়ী শান্তির অন্বেষায় ও প্রত্যাশায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আর্দশের আলোকে আসুন আমরা সকলেই বর্ণ, ধর্ম, জাতি নির্বিশেষে লক্ষ্যার্জনের চেতনায়, সংহতিতে ও প্রতিজ্ঞায় একলব্য হই।


লেখক: প্রফেসর মংসানু চৌধুরী

তথ্যসূত্র:
১. চাকমা, মঙ্গল কুমার – পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি ব্যবস্থাপনা শীর্ষক গোল টেবিল বৈঠকে পঠিতত আলোচনা পত্র, এ এল আরডি প্রশিক্ষণ মিলানায়তন, ২৪ শে অক্টোবর ২০০৯।
২. ত্রিপুরা, শান্তিপদ – আদিবাসীদের ভূমির অধিকার ও ভূমি বিরোধ: প্রেক্ষিত পার্বত্য চট্টগ্রাম।
৩. পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি অধিকার শীর্ষক কর্মশালা: এইচ.টি.এন.এফ, কাপেং, বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলন, ম্রো-চেট, মালেইয়া ও টংগ্যা – ২০০৫।
৪. জেলা প্রশাসন, খাগড়াছড়ি: খাগড়াছড়ি জেলা পর্যটন গাইড, ডিসেম্বর ২০০৯।
৫. ঘোষ, সুবোধ: ভারতে আদিবাসী, ন্যাশনাল কুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ২০০০।
৬. Mohsin, Amena. Thepolitics of Nationalism: The case of Chittagong Hill Tracts, Bangladesh, UPL-Dhaka.
৭. Roy, Raja Devasis. Customary Land Right in The Chittagong Hill Tracts: Bangladesh: Land, Forest and Forest People, P.Gain(ed), SEHD, Dhaka, 1998,
৮. Adnan, Shapan. Migration, Land Alienation and Ethnic Conflict: Causes lf Poverty in the Chittagong Hill Tracts of Bangladesh, Research & advocacy Services, Dhaka, m 1004
৯. পার্বত্য চট্টগ্রাম আইন সংহিতা – পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, রাঙ্গমাটি ২০১০।

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা