ত্রিপুরা লোককাহিনী: বানর বউ

Jumjournal
Last updated Jul 14th, 2020

937

featured image

অনেক অনেক দিন আগের কথা। এক গ্রামে বাস করত এক জুমিয়া পরিবার।

সেই জুমিয়ার নাম ছিল নারান। নারানের ছিল সাত ছেলে। তার কোনো ছেলেই বিয়ে করেনি। সেও বৃদ্ধ হয়ে গেছে। তাই সে সিদ্ধান্ত নিল ছেলেদের বিয়ে দেবে।

একদিন সে সকল ছেলেকে ডাকল। ছেলেদের বলল, আমি তোমাদের বিয়ে দিতে চাই।

তোমাদের বিয়ের জন্য কনে ঠিক করতে চাই। কিন্তু আমি তো বৃদ্ধ হয়ে গেছি। আমি তোমাদের জন্য কনে খুঁজতে গ্রামে গ্রামে ঘুরতে পারব না।

তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি কনে ঠিক করার জন্য একটা পরীক্ষার আয়োজন করব।
কনে নির্বাচনের জন্য পরীক্ষার দিন ঠিক হল।

নির্দিষ্ট দিনে সকল ছেলে তীর-ধনুক নিয়ে হাজির হল। নারান বড় ছেলেকে তীর ছুঁড়তে বললেন। তীর গিয়ে পড়ল এক বাড়িতে।

সেই বাড়ির মেয়েকে বড় ছেলের কনে হিসেবে ঠিক করা হল। এভাবে ছয় ছেলের কনে নির্বাচন করা হল।

সব শেষে ছোট ছেলের তীর গিয়ে পড়ল একটা শুকনো মরা গাছে। সকলে এতে খুব অবাক হল।

গাছটির মূল পর্যন্ত উপড়ে গেছে। এর পাশে বসে আছে একটা মাদি বানর। নারানের সিদ্ধান্ত অনুসারে ছোট ছেলেটি বানর কনেকে বিয়ে করল।

নারান তার ছেলের বিয়ে নিয়ে খুবই অখুশি ছিল। সে ছেলেকে বানর বউ নিয়ে গ্রামের বাইরে গিয়ে বসবাস করতে বলল।

নারানের বউ ছোট ছেলেকে খুব স্নেহ করত। সে যখন দেখল ছেলেকে বাড়ির বাইরে বের করে দেওয়া হচ্ছে, সেও তাদের সঙ্গে গিয়ে বসবাসের সিদ্ধান্ত নিল।

নারানের ছোট ছেলে, নারানের বউ এবং বানর বউ গ্রামের বাইরে গিয়ে বসবাস করতে লাগল।

দিনে দিনে নারান আরো বৃদ্ধ হল। একদিন সে সকল ছেলেকে ডাকল। সকলকে বলল, আমার অনেক বয়স হয়েছে।

যে কোনো সময় আমি মরে যেতে পারি। আমার শেষ ইচ্ছা আমি সকল বউয়ের রান্না খাব।

ছোট ছেলে বাড়িতে এলো। সে তার মাকে বাবার শেষ ইচ্ছার কথা বলল। বানর বউ মা-ছেলের কথাবার্তা শুনল ।

ছোট ছেলে অভাগা। আমি বাবাকে খাওয়াতে পারব না। তার শেষ আশা পূরন করতে পারব না।

মধ্যরাতে বানর বউ একটি সুন্দরী রমণীর রূপ ধারণ শাশুড়ি আর স্বামী তখন ঘুমাচ্ছিল।

এই সযোগে সে খাবার রান্না করে ফেলল। সে খাবারগুলো দুটি পাত্রে বেড়ে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখ।

এরপর ঘুমন্ত স্বামীর পাশে খাবারের পাত্রগুলো রেখে দিল। ছোট ছেলে সকালে ঘুম থেকে ওঠে ঢেকে রাখা দুটো পাত্রে খাবার দেখে অবাক হল।

সে খাবারের পাত্রগুলো নিয়ে তার বাবার কাছে গেল।

নারান একে একে সব ছেলেদের আনা খাবার খেল। সব শেষে ছোট ছেলেকে খাবার দিতে বলল।

সে সঙ্গে আনা খাবারের পাত্র দুটো বাবাকে দিল। পাত্রের ঢাকনা খোলা মাত্র খাবারের মিষ্টি গন্ধ বেরিয়ে এলো।

সেই মিষ্টি গন্ধে ভরে গেল পুরো বাড়ি। খাবারের মিষ্টি গন্ধ পেয়ে পাড়াপড়শিরা পর্যন্ত ছুটে এলো। এতে সবাই খুব অবাক হল।

নারান খাবার খেতে শুরু করল। এ খাবার তার খুব ভালো লাগল। সে বলল, ছোট বউয়ের পাঠানো খাবার সবচেয়ে ভালো হয়েছে।

খাওয়া শেষে নারান ছেলেদের বলল, আমি ছেলেদের বউয়ের তৈরি কাপড় পরতে চাই।

ছোট ছেলে বাড়ি ফিরে গেল। মাকে পুরো ঘটনা খুলে বলল, বাবা এখন ছেলেদের বউয়ের হাতে তৈরি কাপড় পরতে চায়।

আমি বাবার জন্য কাপড় পাব কীভাবে? মা বললেন, চিন্তা করোনা, ঈশ্বর তোমাকে সাহায্য করবেন। মা ও ছেলের কথাবার্তা শুনল বানর বউ।

রাতে তার স্বামী যখন ঘুমিয়ে পড়ল, তখন সে স্বর্গে গেল তার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে।

মাকে বলল, ছোটবেলায় সে যে পোশাকগুলো পরত সেগুলো তাকে দিয়ে দিতে। মা তাকে পোশাকগুলো দিয়ে দিল।

সে কাপড়গুলো একটা বাক্সে ভরে স্বামীর ঘরে ফিরে এলো। কাপড় ভরা বাক্সটা সে ঘুমিয়ে থাকা স্বামীর পাশে রেখে দিল।

পরদিন সকালে ছোট ছেলে ঘুম থেকে জেগে উঠল, তার পাশে একটা বাক্স দেখে সে অবাক হল।

বাক্স খুলে দেখল তাতে খুব সুন্দর পোশাক। সে বাক্সসহ বাবার কাছে গেল। নারান একে একে সকল ছেলেদের কাছ থেকে কাপড়চোপড় নিলেন।

কিন্তু কাপড়গুলো নারানের খুব একটা পছন্দ হল না। কাপড়গুলো ছিল আকারে ছোট। তারপর ছোট ছেলেকে তার আনা কাপড় দিতে বললেন।

ছোট ছেলে বাক্সটি খুলল, কাপড়গুলো বের করে বাবার হাতে দিল। বিভিন্ন প্রাণীর ছবি আঁকা আর নানা রঙের ছাপ দেওয়া কাপড় দেখে অবাক হয়ে গেল নারান।

কাপড়গুলো ছিল আকৃতিতে বেশ বড়। নারান বুঝল, তার বানর বউ আসলে বানর নয়, সে হয়ত শাপগ্রস্ত দেবী।

সে বানর বউকে দেখতে চাইল এবং তাকে ধন্যবাদ জানানোর ইচ্ছা প্রকাশ করল।

সে ছেলেদের ডেকে বলল, আমি অনেক দিন বউদের দেখি না। সামনের সোমবারে তাদের আসতে বলো। আমি মরে যাওয়ার আগে একবার তাদের দেখে যেতে চাই।

নির্ধারিত সোমবারের আগের রাত। মা ও ছেলে ঘুমাচ্ছিল। সেই সুযোগে বানর বউ স্বর্গে গেল মায়ের কাছে।

তার মা ভগবান ইন্দ্রের স্ত্রী। সে মাকে বলল, তাকে যাদুর আংটি দিতে। মা তাকে যাদুর আংটি দিল।

বানর বউ যাদুর আংটিকে একটি রাজপ্রাসাদ তৈরি করতে বলল। ভৃত্য, প্রহরী সমেত রাজপ্রাসাদ সাজিয়ে দিতে বলল।

মুহূর্তের মধ্যেই তার ছোট ঘর রাজপ্রাসাদে পরিণত হল। তাতে হাতি, ঘেড়া, প্রহরী, ভৃত্য সমেত সাজানো হল।

বানর বউ ঘুমন্ত স্বামীকে একটা সোনার খাটে শুইয়ে দিল। আর সে নিজের বানরের চামড়া বদলে ফেলে একটি সুন্দরী নারীর রূপ ধারণ করল।

সে তার স্বামীর পাশে একটা রূপোর খাটে ঘুমিয়ে পড়ল।

রাতে ছোট ছেলে হঠাৎ জেগে ওঠল। সে নিজেকে সোনার খাটে শোয়া।

দেখে খুব অবাক হল। সে দেখল তার পাশে ঘুমিয়ে আছে একটি সুন্দরী নারী।

তার পাশেই পড়ে আছে বানরের চামড়া। সে বুঝতে পারল এই নারীই তার স্ত্রী।

সে বিছানা ছেড়ে উঠল। বানরের চামড়াটি নিয়ে আগুনে পুড়িয়ে ফেলল, যাতে তার স্ত্রী আর কখনো বানরের রূপ ধারণ করতে না পারে।

পরদিন সকালে ছয় বউ নারানকে দেখতে গেল। কিন্তু ছোট বউ তখনো পৌছতে পারল না।

নারান ছোট বউকে খুঁজে আনার জন্য কিছু লোক পাঠাল। কিছু সময় পর তারা ফিরে এলো। তারা নারানকে বলল তোমার ছোট বউ সাধারণ বানর নয়।

সে রাজকুমারী। প্রহরী, সঙ্গী-সাথীসহ সে রাজপ্রাসাদে বাস করে। নারান ছোট বউকে দেখতে পাচ্ছে।

তাকে দেখে ছেলে আর ছেলের বউ বাইরে বেরিয়ে এলো। তাকে অভ্যর্থনা জানাল। নারান বউকে দেখে খুশি হল।

চোট বউ ভগবান ইন্দ্রের মেয়ে এ কথা জেনে নারান খুব খুশি হল। এতদিন সে বানরের ছদ্মবেশ ধারণ করেছিল।

সে নারানকে বলল, একদিন আমার বাবা ইন্দ্র আমার উপর খুব রেগে গেল। রাগের মাথায় সে আমাকে অভিশাপ দিল। তার অভিশাপে আমি বানর হয়ে গেলাম।

বানর হওয়ার পর ভগবান ইন্দ্রকে আমার মা অনেক অনুনয়-বিনয় করল আমাকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য।

ভগবান ইন্দ্র অনেক অনুরোধের পর বললেন, তুমি বানরই থাকবে। তবে কোনো মানব সন্তান যদি তোমাকে বিয়ে করে তবে তুমি আবার আগের রূপ ফিরে পাবে। |

ছোট বউ নারানকে বলল, আপনার ছোট ছেলে আমাকে বিয়ে করায় আমি শাপমুক্ত হয়েছি।

নারান নিজেকে অপরাধী ভাবল। সে দুর্ব্যবহারের জন্য ছেলের বউয়ের কাছে ক্ষমা চাইল। তারপর থেকে নারান ছোট ছেলের সঙ্গে প্রাসাদেই বসবাস করতে লাগল।

কিছুদিনের মধ্যেই ছোট ছেলে ও তার বানর বউয়ের পুনরায় বিয়ের অয়োজন করা হল। সকল বন্ধু-বান্ধব আর আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত দেওয়া হল।

সবাই পেট পুরে খানাপিনা করল, বর-বউকে আশীর্বাদ করল। তারপর সকলে মিলেমিশে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগল।

লেখক : আবু রেজা

চিত্রায়নঃ তনময় চাকমা

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা