ভুলে যাওয়া ত্রিপুরা গণহত্যা

Jumjournal
Last updated Dec 4th, 2020

1166

featured image

প্রদত্ত শিরোনামের সাথে ছবিটি মিলিয়ে দেখলে যা দাঁড়ায়, সে বিষয়ে খাগড়াছড়ির প্রতিটি ত্রিপুরা মাত্রই বুঝবেন বলে আমার মনে হয়। অনেকেই হয়তো এটাকে “গোমতী গণহত্যা” বলে স্মরণ করতে চান।

প্রকৃতপক্ষে, এই গণহত্যাটি কেবল গোমতীতে সংঘটিত হয়নি, বরং লক্ষ্মীছড়ি, মানিকছড়ি, গুইমারা, মাটিরাঙ্গা, দীঘিনালা, পানছড়ি, তবলছড়ি, তাইন্দং, বরনালা, কুমিল্লা টিলা, বেলছড়ি, অযোধ্যা প্রভৃতি ত্রিপুরা অধ্যুষিত প্রায় সব জায়গাতেই এরূপ গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল।

তাই অনেকটা বলা চলে – “খাগড়াছড়ি জেলায় ত্রিপুরা গণহত্যা”। সংক্ষেপেও বলা যায় – “ত্রিপুরা গণহত্যা”। সম্ভবত এই গণহত্যার কারণে, খাগড়াছড়িতে ত্রিপুরা জনসংখ্যার হার দ্রুত পরিমাণে হ্রাস পেয়েছিল।

সোশ্যাল মাধ্যমে কিংবা অন্য কোন মাধ্যমে এই গণহত্যাকে স্মরণ করা হয়েছে কিনা, সেই বিষয়ে কোন তথ্য আমার চোখে পড়েনি। হয়তো সকলেই ভুলে গেছেন!! এমনকি যেসকল পক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিয়মিত সোচ্চার ও লেখালেখি করেন, তারাও বোধয় ভুলে গেছেন!! এই ভুলে যাওয়া বিষয়টি একটু স্মরণ করে দেওয়ার স্বার্থেই এই লেখাটি।

হাইস্কুলে পড়ার সময় “বাবার হাত ও ১৯৮৪” (১৯৮৪ কিনা এখন মনে করতে পারছিনা!) এবং “বিধ্বস্ত লেবানন ও একটি ঘুমন্ত অতীত” শিরোনামের দুইটি লেখা আমার পড়া হয়েছিল। দুইটি লেখাই ত্রিপুরাদের ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল।

স্বাভাবিকভাবে ধরে নেওয়া যায় যে, ত্রিপুরাদের মধ্যে অনেকেই সেই লেখা দুইটি পড়েছেন।

লেখা দুইটিতে তুলে ধরা হয়েছিল গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া কিছু ত্রিপুরাদের জীবনী ও সাক্ষাৎকার, যারা স্বচোখে সেসব হত্যাকাণ্ড দেখেছিলেন এবং ভয়ে, ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পালিয়ে বাঁচতে বাধ্য হয়েছিলেন।

ক্লাস টেন পর্যন্ত লেখা দুইটি আমার সাথে ছিল। সময় পেলে মাঝে মাঝে খুলে পড়তাম। লেখা দুইটি আমাকে এতোটাই নাড়া দিতো যে, পড়তে পড়তে আমার চোখে পানি চলে আসতো।

লেখা দুইটি পড়ার পরই আমার প্রথম ইচ্ছা হই যে, গোমতীতে যাওয়ার। পরে আমার সেই ইচ্ছে পূরণ হয় আমার বন্ধুদের কারণে।

গোমতীতে এখন পর্যন্ত ৪/৫ বার যাওয়া হয়েছে। গোমতীতে যতবারই আমার যাওয়া হয়েছে, ততবারই “একটি ঘুমন্ত অতীত”-এর কথা আমার মাথায় চলে আসতো।

গোমতীতে যাওয়ার আরেকটি কারণ ছিল। আমার এক বন্ধুর দাদু ছিলেন আমার বাবার শিক্ষাগুরু। বাবা প্রায়ই তাঁর কথা বলতেন। তাঁকে দেখার আমার খুব ইচ্ছে ছিল।

আমি যখন বন্ধুটির সাথে গোমতী নদী পার হয়ে পায়ে হেঁটে হেঁটে তাদের বাড়ি দিকে যাচ্ছিলাম, তখন বন্ধুটি আমাকে সেই অঞ্চলের অতীত ও বর্তমান সম্পর্কে কিছু কিছু বিষয় শেয়ার করেছিল।

পথে একটি ঘর দেখিয়ে সে আমাকে বলেছিল যে, সেখানে একজন ত্রিপুরা মেয়ে বাঙ্গালি ছেলের সাথে পরিবার গড়েছে।

পরে আরও জানা হয় যে, গোমতীতে অনেক বাঙালি পরিবার রয়েছে, যেখানে পুত্রবধু হচ্ছে – ত্রিপুরা মেয়ে!! বিষয়টি সত্যিই আমাকে হতবাক করেছিল – এতো নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটে যাওয়ার পরও, কি করে এটা সম্ভব???

বন্ধুটি বহুল বিস্তৃত ফসলি জমি আমাকে দেখিয়েছিল, যা কিনা দলিল সূত্রে তাদেরই। অথচ বাঙালিরা দখল করে চাষাবাদ করছে সেই আশি দশক থেকেই। তবে, কোন কোন বাঙালি নাকি স্বীকার করে যে, সেই জমিগুলো তারা জোর করে দখল করেছিল।

কিন্তু, যখন মালিকানা দাবী করতে গিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে যায়, তখন তারা দেখতে পায় যে, দলিল সূত্রে জমির মালিক হচ্ছেন – আমার বন্ধুটির দাদু!!!

আর তখন থেকেই তারা নাকি বন্ধুটির পরিবারকে জমি বিক্রি করার প্রস্তাব প্রায়ই করে থাকে, যাতে করে তারা ক্রয়সুত্রে মালিক হতে পারে। এজন্য নাকি যত টাকা লাগুক, তারা দিতে রাজি!!!

বন্ধুটি আমাকে একটা আম গাছ দেখিয়ে বলেছিল যে, গাছটি কমপক্ষে হলেও ১০০ বছরের এবং এটি ছিল তাদেরই। এর আশেপাশে আগে ত্রিপুরা গ্রাম ছিল।

তখন বাঙালি বলে কোন জনগোষ্ঠীই ছিল না। অথচ, আশির দশক থেকে সবই বাঙালিদের দখলে চলে যায়!!! সেই আম গাছটি আজও সেই ইতিহাস বহন করে চলেছে।

এবার আসি মূল ঘটনায়, যেটি আমরা সকলেই ভুলতে বসেছি। “বাবার হাত ও ১৯৮৪” এবং “বিধ্বস্ত লেবানন ও একটি ঘুমন্ত অতীত” শিরোনামের লেখা দুইটি যে কারো বিবেককে নাড়া দিতে বাধ্য।

কিন্তু, দুঃখের বিষয় হচ্ছে, লেখা দুইটি এখন আর আমার সাথে নেই। যদি কারো সংগ্রহে থাকে, তাহলে আমাকে ম্যাসেজিং করে পাঠাতে পারেন। লেখা দুইটি যদি আমার সাথে থাকতো, তাহলে আর কোন রেফারেন্সের প্রয়োজন হতো না।

কারণ, “ত্রিপুরা গণহত্যা” সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা পেতে সেই দুইটি লেখাই যথেষ্ট। মূলত লেখা দুইটি সাথে না থাকার অন্যদের লেখা খোঁজার চেষ্টা করতে হয়েছে।

আমি ভেবেছিলাম যে, “ত্রিপুরা গণহত্যা” বিষয়ে ত্রিপুরারা, বিশেষ করে যারা সেই গণহত্যার শিকার কিংবা ভুক্তভোগী, তারা লেখালেখি করে বিস্তারিত তুলে ধরতে সক্ষম হবেন।

ভেবেছিলাম, যেসকল ত্রিপুরারা জেএসএস, সংস্কার, ইউপিডিএফ এবং গণতান্ত্রিক, এমনকি বিভিন্ন বাম সংগঠনে জড়িত, তারা হয়তো লেখালেখি করে স্মরণ করবেন, ঠিক যেমনটা অন্যান্য হত্যাকাণ্ড বিষয়ে জোরালভাবে লেখালেখি হয়ে থাকে।

কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে এরূপ কোনকিছুই লেখালেখি হয়নি। ধরে নেওয়া যায় যে, “ত্রিপুরা গণহত্যা”র বিষয়টি প্রায় সকলে ভুলেই গেছেন!!

তবে, একদম যে তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি, এমনটা নয়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর কিছু বিচ্ছিন্ন তথ্য হলেও পাওয়া গেছে, যা এখানে যুক্ত করাটা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তাহলে, জেনে নেওয়া যাকঃ-

১। আমার ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্টে থাকা Rana Bikash Tripura Twishrang নামের এক ছোটভাই ২০১৭ সালের ৭ জুলাইয়ে একটা স্ট্যাটাসে লিখেছিলঃ-

“গুমতি “ত্রিপুরা গণহত্যা” পার্বত্য চট্টগ্রামে এক ভয়াবহ হত্যাকান্ড। যেখানে হাজারেরও অধিক ত্রিপুরাকে পাকিস্তানি কায়দায় নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়েছিল।

যার ফলে “গোমতি হারুং” নামে এক বিশাল এলাকা নিয়ে গঠিত ত্রিপুরাদের ধান্য জামি বাঙ্গালিরা দখলে নিয়ে নেয়, হাজার হাজার ত্রিপুরা প্রাণভয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

সেদিনের ত্রিপুরাদের গণকবর এখন গুমতি-তাইন্দুং এলাকায় বিভিন্ন জায়গায় প্রমাণ মেলে। জানিনা এই গণহত্যা সুস্থ তদন্ত আজো হয়েছে কিনা।”

এই স্ট্যাটাসের প্রতিক্রিয়ায় যেসকল মন্তব্য দেখা যায়, তার কয়েকটি এখানে তুলে ধরা হলঃ-

Satyajit Tripura: “য্যেগেন্দ্র চেয়ারম্যান, দীনবন্দু মহাজন ত্রিপুরা, যামিনী হেডম্যান এবংচেয়ারম্যান, তারেন্দ্র মহাজন। গ্যেমতী বেলছড়ি, নিউ অয্যেধ্য, রাম সিরা, গৌরাংগপাড়া লাইফুকার্বারী পাড়া তাইন্দং বিশ থেকে ত্রিশ হাজার ত্রিপুরাসহ এই ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়।

কার কাছে বিচার চাইবেন এখন লাইফু পাড়া এবংকাইসারা পাড়াতে কয়েক জন ত্রিপুরাদের গায়ের দায়ের কোপের দাগ ক্ষত চিহ্ন রয়েছে এবং দেখা যায়।”

Henry Prodip Tripura: “এটা নিয়ে তো আঞ্চলিক দলের ও মাথাব্যথা নেই যাদের কারণে গোমতিতে হামলা হয়েছে। আজ সেই গোমতিতে নিজেদের অস্তিত্ব নেই। একটু হলে লংগদু হত্যা, লোগাং হত্যা, নানিয়াচর সব নিজেদের ডান্ডা নিজেরাই করে।”

Rana Bikash Tripura Twishrang: “ঠিক বলেছেন, বলতে গেলে পার্বত্য চট্টগ্রামের অনান্য সব হত্যাকান্ড থেকে “গোমতি গণহত্যা” হতাহতের পরিমান বেশি। কাজেই এটিই গুরুত্ব দেওয়া যোগ্য।”

২। যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বিষয়ক গবেষক Roger Moody’র লেখা “The Indigenous Voice : Visions and Realities” (1993) গ্রন্থের ৯৭ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে – “In the early of 1977, the Govt. sent to massacre the inhabitants of Matiranga, Guimara, Manikchari, Laksmichari etc. 50 tribals were shot dead, 23 women tortured to death, 54 men died in pits, many women were raped, the villagers were robbed of their property and the houses were set on fire. Five thousands tribals were pushed into Tripura, India.”

৩। Bina D’Costa (Cambridge University) – এর লেখা “Children and Violence: Politics of Conflict in South Asia” গ্রন্থের ১৫৫ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে – “Another source documented that after the Matiranga massacre about 200 Tripuras trying to cross over to India were intercepted at Comillatilla-Taindong and all were gunned down by the BDR.”

৪। সুবির ভৌমিকের (কলকাতা) লেখা “Living on the Edge: Essays on the Chittagong Hill Tracts” গ্রন্থের ৭০ পৃষ্ঠায় উল্লেখিত তথ্যানুযায়ী – ১৯৮১ সালের জুন মাসে মাটিরাঙ্গা ও তবলছড়িতে প্রায় ৫০০ ত্রিপুরাকে মেরে ফেলা হয়েছিল, ১০০ বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।

৫। Jayanta Kumar Ray (কলকাতা) – এর লেখা “India’s Foreign Relations, 1947-2007” (2013) গ্রন্থে বলা হয়েছে – “There was a massacre of tribals at the Tabalchari and Matiranga areas of the CHT on 26-28 June 1981. Muslim settlers and soldiers carried out this massacre, which resulted in the flight of nearly 18,000 refugees to Tripura in India.”

৬। Dhurba P. Rizal ও Yōzō Yokota – এর লেখা “Understanding Development, Conflict, and Violence: The Cases of Bhutan, Nepal, North-East India, and the Chittagong Hill Tracts of Bangladesh” (2006, University of Michigan) গ্রন্থের ১৯৫ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে – “On 30 April 1986, the Bangladesh armed forces attacked six villages in Matiranga sub-Division. Properties were looted, houses were burnt, women were abducted and gangraped.”

৭। http://www.angelfire.com – সাইটে দেওয়া প্রদত্ত তথ্যমতেঃ-

a) Banraibari-Beltali-Belchari Massacre, 26/06/1981:

Bangladesh army backed Muslim settlers invaded the indigenous area in the vicinity of Banraibari, Beltali and Belchari, murdered 500 Tripura men, women and children, and occupied their villages and farmlands. Thousands of indigenous people fled to the nearby forests and 5,000 of them managed to seek refuge in the Tripura State of India

b) 19/09/1981: Telafang-Ashalong-Gurangapara-Tabalchari-Barnala Massacre

Bangladesh army and the Muslim settlers made co-ordinated attacks on 35 indigenous Tripura villages including Telafang, Ashalong, Gurangapara, Tabalchari, Barnala etc. in the Feni valley of the CHT, plundered and burned the villages, and killed many thousand men, women and children. Thousands of indigenous indigenous people died as a direct and indirect result of these attacks.

c) May 1986: Matiranga Massacre

Following the Bangladesh military atrocities described above many people from the affected areas sought refuge in the forests away from their homes. A few hundred people from several different villages gathered during the first week of May between the villages of Sarveswarpara and Manudaspara, in the Matiranga area.

One night, probably that of 1/2 May although the precise date is not known, while they were trying to reach the Indian border, they were ambushed by a detachment of Bangladesh army. The soldiers opened fire without warning and shot at them randomly, without provocation. Over 70 Tripura were killed.

d) 18-19 May 1986: Comillatialla, Taindong Massacre

After the Matiranga massacre a large group of indigenous people fleeing from their homes, numbering over 200, most of whom were of the Tripura nationality, were moving towards the Indian border at Silachari in southern Tripura in mid May.

Their presence in the area appears, to had been known for some time to the Bangladeshi security personnel. They were eventually discovered by the troops of the 31st battalion of the Bangladesh Rifles (BDR), who surrounded them and made them walk into a narrow valley between the villages of Comillatilla and Taindong.

In the restricted space of this valley, the soldiers fired indiscriminately at the group, killing most of the people. Once the firing had ceased, a number of Muslim settlers further attacked the group with machete to kill the injured men, women and children.

প্রদত্ত তথ্যাবলি থেকে আমরা কেবল ৩ টি বছরের (৭৭, ৮১, ৮৬) গণহত্যার তথ্য খুঁজে পাই। তার মানে এই নয় যে, অন্যান্য বছরগুলোতে হত্যাযজ্ঞ হয়নি।

বরং সত্য হচ্ছে, তখনকার পরিস্থিতিই ছিল কোথাও না কোথাও হত্যাযজ্ঞ চালানো। একদিন হয়তো একস্থানে কয়েকজনকে মেরে ফেলা হয়েছিল, পরদিন হয়তো আরেক স্থানে আরো কয়েকজনের মেরে ফেলা হয়েছিল।

কিন্তু সেই হিসাব, কেউ কখনো রাখেনি। তাছাড়া, চাকমারা যতটা ভারতে পালাতে ও আশ্রয় নিতে সক্ষম হয়েছিল, ত্রিপুরারা ততটা পারেনি।

এর ফলেও কিন্তু ত্রিপুরারা আরও বেশি হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়েছিল। সেই হিসাবও কেউই রাখতে পারেনি। কাজেই, প্রায় ১০ বছর ধরে (১৯৭৭-৮৬) ত্রিপুরাদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল, এমনটি দাবী করলে খুব একটা ভুল হবে না।

আমার বড় দাদা সেসময় মাটিরাঙ্গা উপজেলা সদরে একটি সরকারী অফিসে ছোটখাটো চাকরী করতেন। তাই সকাল সকাল গ্রাম থেকে তাকে রওনা দিতে হতো।

একদিন তিনি খুব সকালে নিজের কর্মস্থলে পৌঁছেছিলেন। তখন মাত্র সূর্য উঠেছিল। তিনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন।

হঠাৎ তিনি দেখতে পান যে, কয়েকটি ট্রাক মাটিরাঙ্গায় জড়ো করা হয়েছে। ট্রাকগুলো এসেছিল গোমতী-তাইন্দং-তবলছড়ি থেকে। শেষে ট্রাকগুলো রওনা হল গুইমারা-চট্টগ্রামের পথে।

দাদা মোটামুটি লক্ষ্য করে দেখেছিলেন যে, ট্রাকগুলো ছিল মানুষের লাশ-ভর্তি!!! তিনি এবিষয়ে কারো সাথে কোন কথা পারেননি। সামরিক শাসন বলে কথা!!! সম্ভবত, ত্রিপুরা গণহত্যার স্মৃতি-চিহ্ন যাতে কোথাও খুঁজে পাওয়া না যায়, সেজন্য এরূপ কায়দায় লাশ সরানো হয়েছিল। এথেকে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, ত্রিপুরারা কি পরিমাণ গণহত্যার শিকার হতে হয়েছিল।

এসব গণহত্যার জন্য কে দায়ী? – যদি এরূপ প্রশ্ন রাখা হয়, তাহলে বোধয় পাল্টাপাল্টি অভিযোগের শেষ হবে না। কিন্তু এজন্য ত্রিপুরাদের কোনভাবেই যে দায়ী করা যায় না, সেটা অনেকটা নিশ্চিতে বলা যায়।

হ্যাঁ, ত্রিপুরাদের একটাই অপরাধ হচ্ছে – তারা সহজ-সরল জীবন-যাপনে বিশ্বাসী!!! আর ত্রিপুরাদের এই সরলতাকে সুযোগ হিসেবে নিয়েছে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীরা।

প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, গোমতীর ত্রিপুরারা কখনোই ভাবেননি যে, সেনাবাহিনী ও বাঙালিরা তাদের উপর আক্রমণ চালাবে।

কারণ, অনেক আগে থেকেই ব্যবসা করতে আসা বাঙালিদের সাথে স্থানীয় ত্রিপুরাদের কোন কালেই কখনোই মারামারি-কাটাকাটি তো দূরে থাক, কথা কাটাকাটি পর্যন্ত হয়নি।

এমনকি দুলুমিয়া (ডাকনাম, সেসময়কার স্থানীয় গোয়েন্দা এজেন্ট, ত্রিপুরা ভাষা জানতেন) যখন বিশ্বস্ত কয়েকজন ত্রিপুরাদের জানিয়েছিলেন যে, ত্রিপুরাদের উপর যেকোনো সময় হামলা চালানো হতে পারে, তখনো ত্রিপুরারা বিশ্বাস করেনি!!

তাহলে বুঝে নিন, ত্রিপুরারা কতটা সরল বিশ্বাসী!! অথচ ত্রিপুরাদের এই সরলতার সুযোগ নিয়ে বাঙালিরা ও সেনাবাহিনীরা গণহত্যা চালাল!! এরূপ তথ্য “বিধ্বস্ত লেবানন ও একটি ঘুমন্ত অতীত” প্রবন্ধেও উল্লেখ পাওয়া যায়।

তবে, গোমতীর একাংশ ত্রিপুরা মনে করেন যে, গোমতীতে ত্রিপুরাদের উপর আক্রমণের পেছনে তৎকালীন শান্তিবাহিনীও অনেকটা দায়ী।

এই অভিযোগটি আমার বন্ধুর পরিবারটিও করে থাকেন। শান্তিবাহিনীরা ভারত-বাংলাদেশ সুরঙ্গ পথে গোপনে এসে বাঙালিদের উপর প্রথম আক্রমণ চালায় এবং দ্রুত ভারতে ফিরে যায়। এর প্রতিক্রিয়ায় বাঙালিরা প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠে আর এতে সরাসরি ইন্ধন ও সশস্ত্র রসদ যোগায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। অবশেষে গণহত্যার শিকার হতে হয় ত্রিপুরাদের।

তবে, আমি মনে করি যে, শান্তিবাহিনীদের আক্রমণ পরিকল্পনা নেওয়ার পেছনে হয়তো ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘RAW’ (Research & Analysis Wing)-এর ভূমিকা থাকতে পারে। এমনটি সম্ভাবনা আসলে উড়িয়ে দেওয়াও যায় না।

কারণ, শান্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষিত করে তুলেছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থারাই। তাছাড়া, সেসময় বাংলাদেশ সরকার আশ্রয় দিয়েছিল উলফাদের।

সেকারণে, বাংলাদেশ সরকারের প্রতি ভারতের স্বভাবতই ক্ষোভ ছিল। কাজেই, শান্তিবাহিনীর আক্রমণ পরিকল্পনায় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা কোন না কোনভাবেই জড়িত ছিল, হোক প্রত্যক্ষ, কিংবা পরোক্ষ।

চাকমাদের মধ্যে অনেকেই অভিযোগ করে থাকেন যে, ভারত সরকার তাদের ব্যবহার করেছিল মাত্র, কাজের কাজ কিছুই দিতে পারেনি।

যদি এই বিষয়টি সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে বাঙালিদের উপর আক্রমণ করে পুনরায় ভারতে ফিরে যাওয়াটা শান্তিবাহিনীর মারাত্মক ভুল ছিল বলে আমার ধারণা।

কারণ, তারা অবশ্যই জানতেন যে, বাঙালিরা প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে আদিবাসীদের উপর পাল্টা হামলা চালাতে পারে। কাজেই, আদিবাসীদের গ্রাম রক্ষার দায় অবশ্যই তাদের উপর বর্তায়।

এবং সেই দায়িত্ব তাদের পালন করা উচিত ছিল, তাহলে অনেক হামলা ঠেকানো যেতো। কারণ, সেই পরিমাণ শক্তি-সামর্থ্য, সামরিক রসদ শান্তিবাহিনীর কাছে ছিল।

এখানে যে বিষয়টি না বললে নয়, সেটি হচ্ছে – নিরস্ত্রের উপর সশস্ত্রের হামলা, আক্রমণ – পাল্টা আক্রমণ – কোনভাবেই মেনে যাওয়া যায় না।

এটা কেবল পারস্পরিক ঘৃণা ছড়িয়ে দেওয়া ছাড়া কিছুই নয়। যে ঘৃণার বীজ রোপিত হল আশির দশকে, সেই ঘৃণা আজও বিরাজমান।

এই সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে লাভবান হয়েছে এলিট শ্রেণীর রাজনীতিবিদরা, ভারত ও বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থারা, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক অস্ত্র ব্যবসায়ি ও কোম্পানিরা। মাঝখানে আমাদেরকে দাবা গুটির মতো ব্যবহার করা হয়েছে এবং হচ্ছে।

ত্রিপুরারা যেন বারংবার দাবা গুটির মতো ব্যবহৃত না হয়, সেজন্য সময়ের প্রয়োজনে “কৌশলী” হওয়াটা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করি এবং সেইসাথে প্রত্যাশা রাখি।

কারণ, কেউই আমাদের হয়ে আমাদের কথাগুলো বলবে না, আমাদের কথা আমাদেরকেই বলতে হবে।

লেখক : মুকুল ত্রিপুরা

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা