খিয়াং জনগোষ্ঠীর উত্তরাধিকার (উমুই পেঙং খাল)

Jumjournal
Last updated Dec 23rd, 2019

1116

featured image

খিয়াং উত্তরাধিকার প্রথার উদ্ভব

পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসকারী খিয়াং সমাজ | ব্যবস্থায় অদ্যাবধি জুম চাষ ও পশুপাখি শিকার তাদের অন্যতম পেশা। ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধির ৪২ নং বিধিমতে পাহাড়ে জুম চাষের জন্য জমির মালিকানা স্বত্বের প্রয়োজন হয় না, যার কারণে খিয়াং সমাজে স্থাবর সম্পত্তি তথা ভূমির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বা স্থায়ী মালিকানা অর্জনের প্রচেষ্টা অতীতে তেমন একটা ছিল না বললেই চলে।

এ অবস্থায় সম্পত্তির উত্তরাধিকার অর্জনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে পার্বত্য জেলাসমূহে বসবাসকারী খিয়াং সমাজে অতীতে তেমন একটা সুস্পষ্ট ধারণা গড়ে ওঠেনি। ইদানীংকালে জুম চাষের জন্য নূতন নূতন জমির অপ্রতুলতা এবং পর্যায়ক্রমে একই জমিতে বংশানুক্রমিকভাবে চাষাবাদের কারণে খিয়াং জনগোষ্ঠীর মধ্যে উদ্যান কৃষির প্রতি মনোযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি বর্তমান শিক্ষিত সমাজে ভূ-সম্পত্তির উপর স্থায়ী মালিকানা অর্জনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ধারণার উদ্ভব হয়েছে।

খিয়াং সমাজভুক্ত কোনো একটি পরিবারে কেউ মারা গেলে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদনের দায়-দায়িত্ব পালন দ্বারা মৃতের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবার বিষয়টি সম্পর্কযুক্ত এবং পারিবারিক কর্তব্য হিসেবে সমাজে স্বীকৃত।

 

খিয়াং উত্তরাধিকারের সাধারণ নীতি

উত্তরাধিকার: খিয়াং সমাজভুক্ত পরিবারের কেউ মারা গেলে তার সৎকার, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদনের বেলায় সামাজিক রীতিনীতি | অনুসরণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সমাজের অনুশাসন ও রীতি অনুসারে মৃতের আত্মার সদগতির জন্য বিশেষ কয়েকটি আচার-অনুষ্ঠান পালনের মধ্য দিয়ে উত্তরাধিকারী হতে হয়। অন্যথায় অপর কোনো উত্তরাধিকারীর আপত্তি বা অসম্মতির কারণে মৃতের ত্যাজ্য সম্পত্তির উত্তরাধিকার হতে তাকে বঞ্চিত করার রীতি বা নিয়ম খিয়াং সমাজে প্রচলিত আছে।

খিয়াং সমাজে সম্পত্তির মালিকের মৃত্যুর পর মৃতের সৎকার, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার পর, তার অনাদায়ী ঋণ (যদি থাকে), জীবদ্দশায় সম্পাদিত উইল বা দানমূলে দখল হস্তান্তরিত হয়েছে কিন্তু মালিকানা হস্তান্তরিত হয়নি এমন ভূ-সম্পত্তির দায়/দাবী মেটানোর পর যা অবশিষ্ট থাকে তার উপরই উত্তরাধিকারীগণের অধিকার বর্তায়। একজন সম্পত্তির মালিকের সম্পূর্ণ স্থাবর সম্পত্তি উত্তরাধিকারযোগ্য সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হয় না।

 

উত্তরাধিকারযোগ্য সম্পত্তি কি কি: সম্পত্তির মালিক যেসব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি রেখে মারা যায় সেসবই উত্তরাধিকারযোগ্য সম্পত্তি হিসেবে গণ্য। অস্থাবর সম্পত্তি যেমনঃ- আসবাবপত্র, থালা-বাটি, কাপড়-চাপড়, অলংকার, গরু, মহিষ, ছাগল ইত্যাদিও উত্তরাধিকারীগণের মধ্যে আপোষ রফায় ভাগবন্টন ও হস্তান্তর হয়। কিন্তু লিখিত কোনো আইন বা বিধি-বিধানমতে সেগুলো ভাগবন্টন করা হয় না। কেবলমাত্র ভূমি তথা জায়গা-জমিকে স্থাবর সম্পত্তি হিসেবে সামাজিক বিধি-বিধানমতে ভাগবন্টন করা হয়। তাই উত্তরাধিকারযোগ্য সম্পত্তি বলতে সাধারণভাবে স্থাবর সম্পত্তিকেই বুঝানো হয়।

কিন্তু একজন সম্পত্তির মালিকের সম্পূর্ণ স্থাবর সম্পত্তি উত্তরাধিকারযোগ্য সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হয় না। সম্পত্তির মালিকের মৃত্যুর পর তার সৎকার/অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যয়, তার অনাদায়ী ঋণ (যদি থাকে) এবং জীবদ্দশায় দখল হস্তান্তরিত হয়েছে কিন্তু মালিকানা স্বত্ব হস্তান্তরিত হয়নি এমন ভু-সম্পত্তির দায়/দেনা মেটানোর পর যা অবশিষ্ট থাকে তার উপরই উত্তরাধিকারীগণের অধিকার বর্তায়।

 

সম্পত্তির উত্তরাধিকার রীতি: তিন পার্বত্য জেলার সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক সংশ্লিষ্ট মৌজার হেডম্যান/ইউ.পি চেয়ারম্যান/কার্বারী/পৌর চেয়ারম্যান/সার্কেল চীফ-এর নিকট হতে মতামত ও সুপারিশ গ্রহণ পূর্বক ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশনের ধারা মতে প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে সংশ্লিষ্ট জেলার দেওয়ানী আদালতের ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে বিবিধ মামলা মূলে তিনি মৃত ব্যক্তির আইনগত উত্তরাধিকারীগণকে উত্তরাধিকার সনদপত্র প্রদান করেন।

পার্বত্য জেলাসমূহে বসবাসকারী খিয়াং পরিবারের কারো মৃত্যুর পর তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যয় খরচ, তার জীবদ্দশায় অনাদায়ী ঋণ এবং জীবদ্দশায় কোনো সম্পত্তি দান বা বিক্রি কিংবা মৃত্যুর পূর্বে সম্পাদিত উইল ইত্যাদির দাবী পরিশোধ বা নিষ্পন্ন করার পর নিম্নোক্ত উপায়ে খিয়াং সমাজে উত্তরাধিকারযোগ্য স্থাবর সম্পত্তি ভাগবন্টন হয়ে থাকেঃ-

ক) খিয়াং জনগোষ্ঠীর ‘লাইতু’ ও কংতু উভয় দলের/শাখার প্রচলিত রীতি অনুসারে মৃত ব্যক্তির পুত্র ও কন্যাগণ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। মৃত পিতার নামীয় সম্পত্তি হতে পুত্রগণ  ভাগ এবং স্ত্রীসহ কন্যাগণ  ভাগ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়।

খ) পুত্রের অবর্তমানে কন্যা সন্তানগণ মৃত পিতার সম্পূর্ণ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। মৃত ব্যক্তি নিঃসন্তান হলে তার স্ত্রী, সহোদর ভাই, ভাইয়ের অবর্তমানে ভ্রাতুস্পুত্রগণ মৃতের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়।

গ) মৃত ব্যক্তির একাধিক স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্র-সন্তানগণ মৃতের সম্পত্তিতে সমান উত্তরাধিকার লাভ করে।

ঘ) দত্তক পুত্র পালক পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। দত্তক পুত্র গ্রহণের পর যদি পালক পিতার ঔরসজাত পুত্র সন্তান হয়, সেক্ষেত্রে নিজ সন্তানের ন্যায় দত্তক পুত্র ও ধৰ্মত পিতার সম্পত্তির  অংশের উত্তরাধিকারী হয়। তবে সে পালক পিতামাতার ভরণপোষণ দিলে তাদের ঔরসজাত সন্তানের সমান অংশের উত্তরাধিকারী হয়।

ঙ) অবৈধ সন্তান এবং সমাজচ্যুত সন্তান যদি সামাজিক বিচারে স্বীকৃতি পায়, তাহলে মৃত পিতার আইনগত উত্তরাধিকারী।

চ) পুত্রগণ মাতার সম্পত্তিতে কন্যাদের সাথে সমান অংশের উত্তরাধিকারী হয়। তবে পুত্র না থাকলে কন্যাগণ মাতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়।

ছ) দান বা উইলের মাধ্যমে পিতা-মাতার নিকট হতে কন্যা অথবা স্বামীর নিকট হতে স্ত্রী সম্পত্তির অধিকারী হয়।

বিঃদ্রঃ বর্তমানে বোমাং ও চাকমা সার্কেলে বসবাসরত খিয়াং সমপ্রদায়ের কন্যা সন্তানেরা মৃত পিতার স্থাবর সম্পত্তিতে পুত্রসন্তানগণের সাথে উত্তরাধিকার স্বত্ব পেয়ে থাকে। এক্ষেত্রে পুত্রগণ মৃতের সম্পত্তির  ভাগ এবং স্ত্রী ও কন্যাসন্তানগণ   ভাগ পেয়ে থাকে। দত্তক সন্তান   ভাগ পায়।

 

উত্তরাধিকারযোগ্য পদ পদবী: পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি ১৯০০-এর ৪৮ নং বিধিমতে সার্কেল চীফ নিয়োগ এবং হেডম্যান নিয়োগ ও বরখাস্ত বিষয়ে লিপিবদ্ধ আছে।

ক) পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধির ১৯০০-এর ৪৮নং বিধিতে খিয়াং সমাজের হেডম্যান/কার্বারী এসব পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সার্কেল চীফের সুপারিশ বা মতামতকে অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়। হেডম্যান/কার্বারী নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্র যদি যোগ্য হন তাকে সেই পদে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রদান করা হয়।

খ) খিয়াং সমাজের পাড়া প্রধান বা সমাজপতির পদটি বংশানুক্রমিক পদৰী হিসেবে পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্র এতে অগ্রাধিকার পায়, যদিও উক্ত পদটি ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধিসম্মত নয়।

 

খিয়াং সমাজের উত্তরাধিকার প্রশ্নে অগ্রাধিকার ভিত্তিক শ্রেণীবিন্যাস:-

ক) খিয়াং পরিবারে মৃত ব্যক্তির স্ত্রী, পুত্র ও কন্যা সন্তানেরা পিতার অপ্রতিরোধ্য উত্তরাধিকারী। তার বা তাদের উপস্থিতি অন্য সকল নিকটাত্মীয়ের অধিকারকে খর্ব করে। অবশ্য এক্ষেত্রে সন্তান বলতে- ঔরসজাত, অবৈধ ও দত্তক সন্তানকেও বুঝায় । পুত্রের মৃত্যুজনিত কারণে পৌত্রগণ উত্তরাধিকারী হিসেবে গণ্য হয়।

খ) খিয়াং সমাজে মৃত ব্যক্তির পুত্র সন্তান যদি না থাকে, সেক্ষেত্রে স্ত্রী ও কন্যা সন্তান, তাদের অনুপস্থিতিতে মৃতের পিতা, অবর্তমানে সহোদর ভাই/ভাইয়ের সন্তানগণ মৃতের সম্পত্তিতে আইনগত উত্তরাধিকারী হয়।

গ) স্বামীস্ত্রী: খিয়াং পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলে স্বামীর মৃত্যুতে স্ত্রী স্বামীর স্থাবর সম্পত্তির উত্তরাধিকারসহ ভরনপোষণ পাবার অধিকারী হয়। স্ত্রীর সম্পত্তিতে স্বামীর অবর্তমানে সন্তানেরা উত্তরাধিকারী হয়।

ঘ) পিতামাতা: মৃত ব্যক্তির স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, নাতি যদি না থাকে, সেক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তি যাদের ঔরসজাত অথবা দত্তক সন্তান রূপে যাদের স্নেহে লালিত পালিত হয়েছে সেই পিতা মৃতের আইনগত উত্তরাধিকারী হয়।

ঙ) রক্ত সম্পর্কীয়: খিয়াং সমাজে মৃত ব্যক্তির পুত্র, স্ত্রী, কন্যা, নাতি, পিতা কেউ যদি জীবিত না থাকে অথবা জনুগ্রহণ না করে, সেক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির সহোদর ভ্রাতা, অবর্তমানে তার সন্তানগণ মৃত ব্যক্তির আইনগত উত্তরাধিকারী হয়।

চ) খিয়াং পরিবারে মৃতের যদি পুত্র, স্ত্রী, কন্যা, পিতা, নাতি, ভাই এবং ভাইয়ের সন্তান এ সকল রক্ত সম্পর্কীয় কেউ যদি জীবিত না থাকে অথবা জন্মগ্রহণ না করে, সেক্ষেত্রে মৃতের কাকা/জেঠা, তাদের অবর্তমানে তাদের পুত্র-কন্যা উত্তরাধিকারী হয়।

সম্পত্তির ভাগবন্টন: খিয়াং পরিবারে মৃতের ঔরসজাত পুত্র ও কন্যা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়।

অবৈধ সন্তানের উত্তরাধিকার স্বত্ব: যে ব্যক্তির ঔরসে অবৈধ সন্তান (জারজ) জন্মগ্রহণ করে সেই ব্যক্তির (জন্মদাতা) সামাজিক রীতিনীতি ও প্রথা অনুসারে সন্তানের উত্তরাধিকার নির্ধারণ হয়। তবে ভিন্ন কোনো ব্যক্তির পিতৃ পরিচয়ে সে যদি পরিচিত হয়, সেক্ষেত্রে জন্মদাতা পিতার উত্তরাধিকার সে দাবী করতে পারে না, কেবলমাত্র নিজ মায়ের নামীয় সম্পত্তির (যদি থাকে) উত্তরাধিকারী হয়।


তথ্যসূত্রঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আদিবাসীদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন (গ্রন্থনা ও সম্পাদনা – এডভোকেট জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা,  এডভোকেট প্রতিম রায়, সুগত চাকমা)।

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা